ছোটবেলায় মাকে দেখতাম ছালাত আদায় করতে। আমিও তার অনুকরণে ছালাত পড়তাম। আযান হ’লেই মসজিদে যাওয়ার জন্য মন ছুটত। মসজিদে যাওয়ার প্রবল আগ্রহের কারণে আমাকে পাঞ্জাবী, টুপি পরিয়ে দেয়া হ’ত। আমিও ভদ্রভাবে মসজিদের এক পাশে ছালাত আদায় করতাম। বয়স্ক মুছল্লীগণ দুষ্টুমির কারণে অন্যান্য বাচ্চাদের শাসন করতেন। শান্তভাবে অবস্থানের দরুন আমার প্রতি তারা কোমল আচরণ করতেন। মায়ের কাছে আমি কুরআন পড়া শিখেছি।

ঢাকার অন্যতম পুরাতন বাযার হচ্ছে শ্যামবাযার। সেখানে আমার পিতার দোকান ছিল। যা ছিল পরিবারের আয়ের একমাত্র মাধ্যম। হঠাৎ পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমি তখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ি। অসুস্থ পিতাকে সহায়তার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে দোকানে নিযুক্ত হ’লাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে পৌঁছে যেতাম শ্যামবাযার। এক নতুন ভুবন। দৈনন্দিন বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ে মুখরিত বাযার। যেথায় বিদ্যালয়ের গৎবাঁধা ক্লাস নেই, নেই পড়া মুখস্থ করার চাপ, নেই ছুটির পর নানা কথায় ও খেলায় মেতে উঠার উৎফুল্লতা। আছে শুধু ক্রেতার অপেক্ষায় থাকার বাস্তবতা। অবশ্য জীবনের নতুন গতিপথে ধর্মকে ভুলে যাইনি।

মসজিদের সাথে সম্পর্কের পাশাপাশি সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন উৎসব পালনে ঘাটতি ছিল না। শবেবরাতের রাতে সন্ধ্যায় গোসল সেরে পাঞ্জাবী টুপিতে সজ্জিত হয়ে, সুগন্ধি মেখে মসজিদে যেতাম। আগরবাতি ও মোমবাতি নিয়ে কবরস্থানে গমন করতাম। ছওয়াবের আশায় সেখানে এগুলো জ্বেলে আধাঁরে আলো ছড়াতাম। সাথে কবরবাসীদের জন্য দো‘আ তো আছেই। কখনো কখনো দো‘আ কবুলের আশায় পরিবারের বা বন্ধুদের সাথে চলে যেতাম সিলেটস্থ শাহজালাল ও শাহপরাণের মাযারে। যিকরের নামে নানা ঢং-এর মাহফিলগুলোতে উপস্থিত হ’তাম। অবশ্য চরমোনাই, জৈনপুরী, ফুরফুরার মাহফিলগুলোতে বেশি যেতাম। মনোযোগ সহকারে পীর ছাহেবদের বক্তব্য শুনতাম। মনে হ’ত উনারা হক পথে আছেন। মোটকথা ধর্মের আবরণে যে যা বলত, সেটাকে মেনে চলাই ছিল জীবনের ব্রত।

বই ও পত্রিকা কিনতে ও পড়তে ভালবাসতাম খুবই। বছরের পর বছর ধরে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের মাসিক মদীনা, আলোচিত বক্তা মামূনুল হকের শ্রদ্ধেয় পিতা মাওলানা আজিজুল হক ছাহেবের রহমানী পয়গাম, মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী ছাহেবের আদর্শ নারী পত্রিকাগুলো পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকতাম। সাথে অন্যান্য বই তো ছিলই। এমনও হ’ত ক্লান্তিহীন সারারাত কেটে যেত বই পড়ায়। রাত জাগার কারণে মায়ের ও অন্যদের রূঢ় কথাও শুনতে হ’ত।

এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল বছরের পর বছর। হঠাৎ এক ক্ষণ। ফুরফুরার মাহফিল শেষে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)-এর একটা বই কিনেছিলাম। এটা পড়ার সময় লক্ষ্য করলাম আমরা যেভাবে ইবাদত করি তা থেকে ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে লেখা পড়তে ভালোই লাগছিল। কারণ বইটতে দলীল-প্রমাণ উল্লেখ ছিল। বুকে হাত বাধাঁর কথা আছে, রাফঊল ইয়াদায়নের কথা আছে। বিষয়গুলো নতুন মনে হ’ল। বুকে হাত বেঁধে তো মহিলারা ছালাত আদায় করে।

চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হ’ল। এটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ছাহেবের আরেকটি বই পড়লাম ‘হাদীছের নামে জালিয়াতি’। এই বই পড়ে মনে প্রশ্ন আরো বিস্তৃত হ’ল। কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। আমার সাথে প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে এক ভাই কাজ করেন। তাকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি আমাকে ইসলামী ফাউন্ডেশনের বুখারী পড়ার উৎসাহ দিলেন।

আমি বুখারীর পুরো সেট কিনে পড়া শুরু করলাম। ওযূ ও ছালাত অধ্যায়ে গিয়ে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ছাহেবের বইয়ের সাথে মিল পেলাম। তখন থেকে বুকে হাত বেঁধে ছালাত আদায় শুরু করলাম। যেহেতু বুখারীতে পড়েছি। একদিন মাযহাবী এক ভাই বললেন, অমুক জায়গায় চরমোনাই ও তাবলীগ বনাম আহলেহাদীছদের বাহাছ হবে। চলো গিয়ে দেখি। আহলেহাদীছ কথাটা শুনে বললাম, এরা আবার কারা? কারণ আমার জীবনের কোন সময়েই আহলেহাদীছ নাম শুনিনি। জানলাম, তারা বুকে হাত বেঁধে ছালাত আদায় করে। রাফঊল ইয়াদায়ন করে। উৎসাহ নিয়ে গেলাম। তবে হতাশ হ’তে হ’ল। আইন-শৃংখলা বজায় রাখতে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে বাহাছ বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য আহলেহাদীছ নামটা মনে গেঁথে গেল। আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম দোলেশ্বরে শুনেছি ‘রফেরা’ বাস করে। তারা আমাদের সময়ের পূর্বে আযান দেয় ও ছালাত আদায় করে। শবেবরাত পালন করে না। অনেকে তাদের ভ্রান্ত ফিরক্বা শী‘আ বা কাদিয়ানী বলে থাকে। এভাবে শুনেই আমরা ঘৃণ্য অনুভূতি নিয়ে ছোট থেকে বড় হচ্ছি। আমার চাচাতো বোনের ঐ গ্রামে বিবাহ হয়েছে। শবেবরাতের সময় সে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। কারণ তার শ্বশুর বাড়িতে শবেবরাত পালন করা হয় না। ঐ গ্রামে যে আহলেহাদীছদের বসবাস তাও জানতাম না। তারা ‘রাফাদানী’ বলেই শুনতাম।

একদিন একটা কাজে বংশাল অবস্থান করছি। মাগরিবের সময় হ’লে এক দোকানদারকে মসজিদের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি মসজিদে যাওয়ার রাস্তা দেখানোর সাথে সাথে বললেন, এটা আহলেহাদীছদের মসজিদ। হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হ’ল। আহলেহাদীছদের মসজিদ! যা আমি এতদিন খুজঁছি। ছালাত আদায় করার জন্য মসজিদে প্রবেশ করতেই দেখি মুছল্লীরা বিক্ষিপ্তভাবে ছালাত আদায় করছেন। ভাবলাম, জামা‘আত কি শেষ হয়ে গেল! আসলে তারা আযান ও এক্বামতের মধ্যবর্তী ২ রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করছিলেন। ছালাতের এক্বামত শুরু হ’ল। হৃদয়ে আনন্দের ঝিলিক। একে একে পায়ে পা মিলিয়ে দাঁড়ানো, বুকে হাত বাঁধা, সূরা ফাতেহা শেষে জোরে আমীন, রাফঊল ইয়াদায়ন, ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে ছালাত, সালাম ফিরানোর পর পঠিতব্য দো‘আ সবই দেখি হাদীছের সাথে মিল রয়েছে। অপার্থিব আনন্দে আপ্লুত হয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।

বংশাল থেকে ফিরে খুঁজতে থাকলাম আহলেহাদীছ মসজিদ। দোলেশ্বর গ্রামে গেলাম। মসজিদ খোঁজ করছি জেনে এক ভাই মসজিদ দেখিয়ে দিলেন। দোলেশ্বরের হানাফী মসজিদে প্রবেশ করলাম। তাদের সাথে ছালাত আদায় করলাম। এতদিন যেভাবে ছালাত পড়েছি এখানেও তেমন। আমি যাদের খুঁজছি তাদের না পেয়ে কিছুটা হতাশ হ’লাম। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আবার খোঁজ করলাম। পেয়ে গেলাম আহলেহাদীছ মসজিদ। তৃপ্তি সহকারে ছালাত আদায় করলাম। পরিচয় হ’ল মসজিদের খত্বীব শফীকুল ইসলাম আনছারীর সাথে। তিনি ঢাকা যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি। নিজ গ্রামে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী ছালাত আদায় করাতে মসজিদ কমিটির সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তারা বলে দেন, তাদের মত করে ছালাত আদায় করতে হবে। বাপ-দাদার আমল থেকে যেভাবে চলে আসছে সেভাবে। অবাধ্য হ’লে যেন মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাই এবং ঐ মসজিদে ছালাত আদায় না করি। প্রতিবাদে বললাম, আমি যেভাবে ছালাত আদায় করি তার দলীল আছে। যাচাই করুন। তারা বলছেন, ‘দলীল-টলিল বুঝি না। তোর মসজিদেই আসার দরকার নেই’। মুছল্লীদের অধিকাংশই চরমোনাইয়ের মুরীদ ও তাবলীগ জামাতের লোক। ঐ মসজিদে আর গেলাম না।

গ্রামের অন্য মসজিদে ছালাত আদায় করি। সেখানে সমস্যা হয়নি। একদিন মসজিদে চরমোনাই পীরের অনুসারীদের মাসিক মাহফিল। ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন সমবেত হয়ে যিকর ও আলোচনা করছেন। ছালাত আদায় করার সময় আমীন জোরে বলায় সালাম ফেরানোর পর পরই কয়েকজন মিলে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে আমার দিকে। উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে থাকে। আমিও ছাড়ার পাত্র নই, উত্তর দিতে থাকি। ইমাম ছাহেব এই অবস্থা দেখে আমাকে সুকৌশলে সরিয়ে দেন। কিন্তু তাদের রাগ জমে থাকে। অন্যদিন আমাদেরই সমমনা এক ভাই কামারুয্যামান মানিক। যার পিতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছেন। তাকে মসজিদের বাইরে নিয়ে বেদম মারধর করে। পরবর্তীতে বিচারের কথা বললেও আর বিচার হয়নি। ‘যুবসংঘে’র সভাপতি শফীকুল ভাইয়ের কাছ থেকে প্রফেসর ডঃ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করি। নিজের ছালাতকে সংশোধন করি। জুম‘আর ছালাতের জন্য মসজিদে উপস্থিত হই। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। তার অনুপ্রেরণায় একদিন মাদারটেক আহলেহাদীছ জামে মসজিদে উপস্থিত হ’লাম। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর প্রোগ্রাম চলছে। বক্তব্য রাখছেন মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী ও মাওলানা আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ। আমানুল্লাহ ভাইয়ের সুর ও যুক্তি দিয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বক্তব্যে সেদিন বেশি অনুপ্রাণিত হই। সেখান থেকে দাওয়াত দেয়া হয় রাজশাহী তাবলীগী ইজতেমার।

সময়টা ২০১৩ সাল। আনিস ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। ভাইয়ের নেতৃত্বে অন্যান্যদের সাথে আমরা ৩ জন যোগ দেই। বৃষ্টিস্নাত দিনে মসজিদে আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারকে দেখি। তিনি উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। স্যারসহ অন্যদের বক্তব্য আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করি। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল ভিত্তিক বক্তব্য শুনে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। ইজতেমা থেকে ফেরার সময় বই কিনে নিয়ে আসি। সাধ্যমত পড়ার চেষ্টা করি। সেই সময় থেকে পরিবার, শ্বশুরবাড়ি ও অন্যদের দাওয়াত দিতে থাকি। প্রতিমাসে মাসিক আত-তাহরীক বিতরণ করি।

মাসে দুই দিন কিছু বই নিয়ে মসজিদের সামনে বসে বিক্রয় করি। যাতে মানুষ বই পড়ে সত্যটা জানতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ! যাচাই করে জেনে বুঝে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণ করেছি। ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাথে সংযুক্ত আছি। জামা‘আতবদ্ধ জীবন যে রহমত তা পথচলাতেই বুঝতে পারি। মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে কেইবা শেষ করতে পারে। কত কথিত মুহাদ্দিছ, মুফতী, পীর লকবধারীরা শিরক-বিদ‘আতের ভ্রান্তপথে নিজেরা চলছেন ও অন্যদের পথভ্রষ্ট করছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর মহান আল্লাহর রহমতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথে যে যুক্ত হতে পেরেছি তার চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন! আহলেহাদীছ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে দ্বীনের পথে অন্য ভাইবোনদের আহবান করার তাওফীক দান করুন- আমীন!!

আল-আমীন

দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।






ছালাতে রাফঊল ইয়াদায়েন করার কারণে চাকুরীচ্যুতি - .
তুমি বেলাইনে চলে গেছ - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
ছহীহভাবে ছালাত আদায় করায় নিজের পিতাও বিদ্রূপ করা শুরু করলেন - আত-তাহরীক ডেস্ক
ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক আমলের কারণে শারীরিক নির্যাতন ও হত্যার হুমকি - আত-তাহরীক ডেস্ক
হকের পথে যত বাধা - মুহাম্মাদ ইসমাঈল হোসাইন - মাইজদী, নোয়াখালী
মাযহাব না মানার কারণে আশ্রয় হারাতে হ’ল - -খালিদ সাইফুল্লাহ, গাযীপুর।
থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব - -আব্দুল্লাহ, গাযীপুর।
ভ্রান্ত আক্বীদার বেড়াজাল ছিন্ন হ’ল যেভাবে - -আরিফ হাসান আল-গালিব, শার্শা, যশোর।
জঘন্য ষড়যন্ত্র এক মুসলিমের বিরুদ্ধে - * মুহাম্মাদ সোহেল রানাবাঘা, রাজশাহী।
যেভাবে আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণ করলাম - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলেহাদীছ আক্বীদায় বিশ্বাসী, এটাই কি আমার অপরাধ!
হক-এর পথে টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ - .
আরও
আরও
.