(১৩) ঈশ্বরদীতে হকের দাওয়াত
রাজশাহী বিভাগের পাবনা যেলাধীন ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের জন্য বিখ্যাত। এখানে বহু মুসলিমের বসবাস। তাদের অধিকাংশই মাযহাবপন্থী। এ থানার বিভিন্ন এলাকার কিছু মানুষ হকের পথে ফিরে আসছেন। মাযহাবী গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে এসে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মানতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। যেসব ভাইয়েরা প্রতিকূলতার শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিবরণ এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হ’ল।-
(১) আমি হাসান আলী ঈশ্বরদী থানাধীন চরমিরকামারী গ্রামের সন্তান। বাপ-চাচার যৌথ পরিবারে আমার বাস। গ্রামে আমাদের প্রভাব অনেক বেশী। আমার চাচাতো ভাই মুহাম্মাদ তরীকুল ইসলাম সঊদী আরব প্রবাসী। দাম্মাম ইসলামিক সেন্টারের শায়খ মতীউর রহমান মাদানীর আলোচনা শুনার পর আল্লাহ তাকে হক পথের সন্ধান দান করেন। ছুটিতে দেশে আসার পর তিনিও বাড়ীর সবাইকে হকের দাওয়াত দেন। এতে নিজ পরিবার সহ গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে নানা বাধার সম্মুখীন হন। আমরা যারা ছোট আমাদের নিয়ে গ্রামের মসজিদে ছালাত আদায় করতে গেলে ‘আমীন’ বলা নিয়ে মুছল্লীদের সাথে গন্ডগোল বেঁধে যায়। এদিকে মীলাদ, শবেবরাতের বিপক্ষে কথা বলায় বড় চাচা ও নোয়া চাচা বলেই ফেললেন, এসব কথা তো কাফের হওয়ার লক্ষণ। আমাদের দেশের বড় বড় আলেমরা কি জানেন না? তিনি এর কোন প্রতিবাদ করেননি। দাম্মামে থাকা অবস্থায় শায়খ মতীউর রহমান মাদানীর মুখে শুনেছিলেন, বাংলাদেশে হক-এর উপর প্রতিষ্ঠিত জামা‘আতের আমীর হ’লেন, ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। তিনি রাজশাহীর নওদাপাড়াতে থাকেন। তরীকুল ভাই রাজশাহীতে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন তাঁর কাছ থেকে মূল্যবান উপদেশ শ্রবণ করেন।
ছুটি শেষে তিনি সঊদী আরব চলে যান। কিন্তু বাড়ীতে রেখে যান অনেক হাদীছের কিতাব ও বক্তব্যের ক্যাসেট। ঐসব বই-পুস্তক পড়ে ও ক্যাসেট শোনার ফলে তাঁর পাঁচ চাচা সহ সবাই ছহীহ আক্বীদা ও আমল শুরু করে দেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ। এতে মাযহাবীদের মসজিদে ছালাত আদায় করতে গেলে অনেক বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে বাড়ীতেই বড় একটি কক্ষে রামাযানের তারাবীহ সহ পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন। পরে তরীকুল ভাইয়ের নিজস্ব উদ্যোগে ও চাচাদের প্রচেষ্টায় বাড়ীর সামনেই একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
তরীকুল ভাই সঊদী আরব থাকায় আমরা অনেক সময় দাওয়াতী কাজে বাধাগ্রস্ত হয়েছি। আমরা যারাই ছহীহ হাদীছের উপর আমল শুরু করেছিলাম তারা সবাই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। গত ২০১২ সালের ২২ জুন ‘যুবসংঘ’ ঈশ্বরদী উপযেলা কমিটি গঠন করা হয়। আমি সভাপতি মনোনীত হই। অতঃপর ৫ ডিসেম্বর’১৩ তারিখে পাবনা যেলা ‘যুবসংঘ’-এর সাহিত্য ও পাঠাগার সম্পাদক মনোনীত হই। কর্মী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গত ১২ জুন’১৩ তারিখে অনুমোদিত কর্মী হিসাবে শপথ গ্রহণ করি।
(২) মাগরিবের আযানের বিরোধিতা :
গত রামাযান মাসে তথা ১৭ জুলাই’১৩ তারিখ বুধবার ঢাকায় সূর্যাস্তের সময় ছিল ৬-টা ৪৯ মিনিট। এর সাথে ৫ মিনিট যোগ করে পাবনায় সূর্যাস্তের সময় ছিল ৬-টা ৫৪ মিনিট। সঠিক সময়ে আযান দেওয়ায় এলাকার মাযহাবী মসজিদের মুছল্লী ও গ্রামের অনেকে আমাদের মসজিদে আক্রমণ করে। আমাদেরকে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করে। আমরা তাদের থামাতে গেলে তারা তেড়ে আসে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি হয়ে যায়। তারা বলে, আগামী কাল যদি আযান আগে হয়, তাহ’লে বড় কিছু হয়ে যাবে। আমার চাচা আব্দুছ ছামাদ বললেন, পৃথিবীতে যখন এসেছি তখন সবাইকে মরতে হবে। তো ভয় কিসের? আমরা আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। পরের দিনও যথারীতি সঠিক সময়েই মাগরিবের আযান দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এই ঘটনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে সত্যের দাওয়াত দ্রুত পৌঁছে যায়। বাতিল মাথা নত করে এবং সত্য উন্মোচিত হয়।
(৩) অরণকোলায় হকের আওয়াজ :
ঈশ্বরদীতে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর দাওয়াতে অনেকেই সত্যের সন্ধান পেয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হ’লেন মুহাম্মাদ এনামুল ইসলাম। সুন্দর চেহারা, মুখে লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট ২৬-২৭ বছরের যুবক। এনামুল বাড়ীর পার্শ্বের মসজিদে নিয়মিত ছালাত আদায় করে। ছহীহ হাদীছের উপর আমল শুরু করায় মসজিদের ইমাম ও মুছল্লীদের সাথে প্রায় প্রতিদিন আমীন বলা, রাফঊল ইয়াদায়েন করা ও অন্যান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটি হ’ত। একদিন ছালাত শেষে এনামুলকে বলা হয়, তোমাদের আলেম ও আমাদের আলেমদের উপস্থিতিতে কোনটা ঠিক এবং কোনটা বেঠিক আলোচনা হবে। তোমার দায়িত্বশীলকে মাগরিবে ডাকবে, আমরা তার সাথে কথা বলে দিন ঠিক করব। তাদের সাথে কথা বলার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে এনামুল, আকরাম হোসাইন ও ছিদ্দীকুর রহমান সেখানে যান। তাদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মসজিদ কর্তৃপক্ষ, উক্ত ওয়ার্ডের কমিশনার এবং ঈশ্বরদীর নামধারী কয়েকজন মুফতী। আলোচনার শুরুতেই ঐ তথাকথিত মুফতীদের উস্কানিতে মুছল্লীরা আকরাম চাচা ও এনামুলকে মসজিদের মধ্যে মারধর শুরু করে। এতে তাদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। তাদের দু’জনকে মসজিদ হ’তে বের করে দেওয়া হয়। আর ছিদ্দীক চাচাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হয়। তারপর তিনি মোবাইল ফোনে ঘটনাটি আমাদেরকে জানান। আমার বড় চাচা কমিশনারের সাথে কথা বলেন। কমিশনার তখন ছিদ্দীক চাচাকে ছেড়ে দেন। পরের দিন ঈশ্বরদীর স্থানীয় পত্রিকায় মিথ্যা সংবাদ ছাপানো হয় যে, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আহলেহাদীছদের শায়েস্তা করা হয়েছে’। এভাবে হকের উপর আমল করতে গিয়ে তারা নির্যাতনের শিকার হন।
(৪) নারীদা গ্রামে হকের বিজয় :
নারীদা হাইস্কুলের পার্শ্বেই বাড়ী, বয়স পঞ্চাশ, মাথায় বাবরি চুল। নারীদা হাইস্কুলের গণিতের শিক্ষক আনোয়ার স্যার। তিনি আত-তাহরীক-এর নিয়মিত পাঠক। আল্লাহর রহমতে তিনি ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল শুরু করেন। বাড়ীর পার্শ্বের মসজিদের নিয়মিত মুছল্লী তিনি। আমীন বলা ও রাফঊল ইয়াদায়েন করার কারণে মসজিদ হ’তে তাকে বের করে দেয়া হয়। মসজিদে ছালাত আদায় করতে গেলে জীবন হারাতে হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়। এজন্য প্রায় তিন মাস তিনি মসজিদ ছেড়ে বাড়ীতেই ছালাত আদায় করেন।
মসজিদের নিয়মিত মুছল্লী হওয়ায় মসজিদ ছেড়ে বাড়ীতে একাকী ছালাত আদায় করা তার কাছে ছিল খুবই কষ্টের। দু’দিন আগে যিনি ছিলেন গ্রামবাসী ও মুছল্লীদের কাছে প্রিয়পাত্র, ছহীহ হাদীছ মেনে চলায় তিনি হ’লেন সকলের চক্ষুশূল। এসব হয়েছিল মূলতঃ ঈশ্বরদীর নামধারী কতিপয় আলেমের কারণে। অবশেষে ধৈর্যশীল স্যারের আদর্শের কাছে হার মানে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। তাকে মসজিদে ছালাত আদায় করতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। বর্তমানে তিনি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সাথে কাজ করছেন এবং তার ছাত্র-ছাত্রীদের ও গ্রামবাসীদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
(৫) রূপপুরে হকের বলিষ্ঠ কণ্ঠ :
দরিদ্র পিতা-মাতার বড় আদরের সন্তান মুহাম্মাদ রঈসুদ্দীন। হকের দাওয়াত পেয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এলাকার মসজিদে ছালাত আদায় করতে গিয়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তাকে ছালাত আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সকলে তার বিরুদ্ধে চলে যায়। মসজিদ হ’তে বের করে দেয়া হয়। এরপরও ক্ষান্ত হয়নি। স্থানীয় চেয়ারম্যান রঈসের পিতাকে ডেকে ছেলে হারানোর হুমকি প্রদান করে।
এই খবর জানার পর আমরা রঈসুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়ে তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে জেনেছি, এর মূলে রয়েছে স্থানীয় আলেমরা। তারা তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য সাধারণ মুছল্লীদের কাছে আহলেহাদীছ সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করেছেন। এরা জঙ্গী, লা-মাযহাবী ও ইসলামের শত্রু ইত্যাদি বলে অপপ্রচার করছেন।
(৬) মাথালপাড়ায় হকে প্রচার :
দরিদ্র পরিবারের সন্তান আব্দুল আউয়াল। ছহীহ হাদীছের উপর আমল করার কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ১৭ অক্টোবর’১৩ তারিখে কুরবানীর দ্বিতীয় দিন স্থানীয় আলেমদের কাছে কুরবানীর সাথে আক্বীক্বার মাসআলা জানতে গেলে তারা ষড়যন্ত্র করে সাধারণ জনগণকে তার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। লোকজন তাকে মেরে গুরুতর আহত করে। উক্ত নির্যাতনে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ঈশ্বরদীতে একটিমাত্র আহলেহাদীছ মসজিদ; তাও আবার ওয়াক্তিয়া। মাযহাবীদের মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করতে গেলে নানা বাধার সম্মুখীন হ’তে হয়। এছাড়া আহলেহাদীছদের পৃথক কোন গোরস্থান না থাকায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হচ্ছে। আহলেহাদীছ কেউ মারা গেলে, জানাযা ছালাত নিয়ে ও মাটি দেওয়ার পর হাত তুলে সম্মিলিত মুনাজাত নিয়ে মাযহাবীদের সাথে বিরোধ হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঈশ্বরদীর ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন ভাইয়েরা সম্মুখীন হচ্ছেন নানা প্রতিকূলতার। তবুও তারা হকের উপরে অটল আছেন। সকল দ্বীনী ভাইয়ের নিকটে দো‘আ চাচ্ছি আমরা যেন শত বাধার পরেও হকের উপরে টিকে থাকতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমৃত্যু সঠিক পথে থাকার তাওফীক দান করুন-আমীন!
হাসান আলী
ঈশ্বরদী, পাবনা।