পাবনা
যেলার অন্তর্গত আতাইকুলা থানার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বালুঘাটা কেশবপুর
গ্রামের খুব সাধারণ একটি পরিবারে আমার জন্ম। মা-বাবার বিবাহিত জীবনের
সুদীর্ঘ ১৩ বছর পর জন্ম নেওয়া একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমি বাবা-মা ও
আত্মীয়-স্বজনের কাছে ছিলাম অতি আদরের। যাই হোক আমার মা অত্যন্ত ধার্মিক
ছিলেন বিধায় ছোট বেলা থেকেই আমাকে ছালাত আদায় করতে হ’ত। শিক্ষাজীবনের
শুরুতে বাবা-মা ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। ফলে লেখাপড়ার পাশাপাশি
আমার নাচ-গানের চর্চাও শুরু হয়। বাড়ির লোকজন ও আত্মীয়-স্বজন এতে অবশ্য
খুশিই ছিল। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আমার মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে,
মুসলমানগণ এক আল্লাহর ইবাদত করে আর হিন্দুরা বিভিন্ন মূর্তির পূজা করে। কোন
ধর্মটা সঠিক? বাবা মার চাপে মাঝে মধ্যে ইসলামী কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন
করলেও মন-মানসিকতা ও বিশ্বাসে ধর্ম সম্পর্কে আমার অবস্থান ছিল নড়বড়ে। এক
পর্যায়ে আমার ছোট চাচা কয়েকজনকে নিয়ে মসজিদে একটি ইসলামী সংগঠনের দাওয়াতী
কার্যক্রম শুরু করেন। তখন থেকে আবুল আলা মওদূদীসহ শিবিরের কর্মী ও সাথী
সিলেবাসের বই, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, নামায-রোজার হাকিকত ইত্যাদি বইগুলি
পড়ে শেষ করি এবং এর মাধ্যমে ধর্ম হিসাবে ইসলামের মৌলিকত্ব ও যথার্থতা
সম্পর্কে আমার ধারণা মযবূত হয়। তিন মাস ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা এবং কুরআন
তেলাওয়াত শিক্ষা করার পর ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮ রাত ৮-টায় আমি শিবিরের ‘সাথী’
হিসাবে শপথ গ্রহণ করি। সবেমাত্র তখন আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি।
একদিন আমি চাচাত ভাই হৃদয় (সাথী)-এর বাড়িতে গিয়ে ইবনুল ক্বাইয়িমের ‘রাসূল (ছাঃ) কিভাবে নামাজ পড়তেন’ বইটি দেখলাম। পরে আমি তার কাছ থেকে বইটা নিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলি। এই প্রথম জানতে পারলাম আহলেহাদীছদের ছালাত সম্পর্কে। এদিকে ছোট চাচা মাহফূযুর রহমান আল-আযহারে পড়ালেখা করতে গেলেন। সেখান থেকে মাঝে মাঝে যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন আমার পড়া ইবনুল ক্বাইয়িমের বইটিতে উল্লিখিত পদ্ধতি মোতাবেক ছালাত আদায় করতেন। এজন্য এলাকার লোকজন তাকে লা মাযহাবী, রফাদানী বলত। আমি নিজেও এক সময় তার এই ছালাত অপসন্দ করতাম। কিন্তু বইটা পড়ার পর এবং তার এই ছালাত দেখার পর আমিও তার অনুরূপ ছালাত আদায় করা শুরু করি। যদিও তিনি কিছুদিন পর শিবিরের নেতা ও এলাকার লোকজনের চাপে হাদীছ মোতাবেক ছালাত আদায় করা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি কিন্তু বাদ দেইনি। হঠাৎ একদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিবিরের সদস্য মুমিন ভাইকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম ছহীহ হাদীছ মোতাবেক লিখিত এই বইটার প্রতি আপনারা আমল করেন না কেন? তিনি বললেন, এসব ছোটখাট ব্যাপার। আগে ‘হুকুমাত কায়েম’ হোক তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর শিবিরের ‘সাথী’ ও ‘সদস্য’ সিলেবাসের সকল বই পড়ে শেষ করি। ‘ইসলামে রাজনৈতিক মতবাদ’ ও ‘রাসায়েল মাসায়েল’ ৬ খন্ড সম্পূর্ণ পড়ার পর বুঝতে পারি গণতন্ত্র ইসলামী আক্বীদা ও আদর্শের পরিপন্থী। অন্যদিকে গোলাম আযমের ‘ইক্বামাতে দ্বীন’ পড়ে বুঝতে পারি ‘হুকুমাত কায়েম’ হ’ল মূল কাজ। তাবলীগ জামাত, খানকা, মাদরাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম ইত্যাদি যারা দ্বীনের খেদমত করছেন তারা কেবল ‘খেদমতে দ্বীন’ করছেন। কিন্তু মূল ‘ইক্বামতে দ্বীন’-এর কাজ একমাত্র ‘জামায়াত’ই করছে। আমার ‘তাবলীগ জামাআত’ও খুব ভাল লাগত। ‘ফাযায়েলে আমল’ বা ‘তাবলীগী নিসাব’ কয়েকবার পড়েছি। যতই পড়ি ততই সব ছেড়ে মসজিদে দিন-রাত সবসময় কাটাতে ইচ্ছা করে। পীর-মুরীদীও অসম্ভব ভালবাসতাম। কিন্তু মাওলানা আব্দুর রহীম ছাহেবের ‘সুন্নাত ও বিদ‘আত’ এবং আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের ‘হাদিসের নামে জালিয়াতী’ পড়ে সব ভালবাসা গোল্লায় গেল। অবশেষে বুখারী ও মুসলিম থেকে ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, জিহাদ, লিবাস, জানাযা, ঈমান ইত্যাদি অধ্যায় পড়ে শেষ করি। হাদীছের আলোকে মানব জীবন (১-৪ খন্ড), আসান ফিক্বহ (১-২ খন্ড), এন্তেখাবে হাদিস (১-২ খন্ড), রিয়াযুস সালেহীন (১-৪ খন্ড), রাহে আমল (১-২ খন্ড), হাদীস শরীফ (১-২ খন্ড), ‘মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বন’, ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস’সহ শিবিরের সাথী ও সদস্য সিলেবাসের সমস্ত বই এবং আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর-এর এইইয়াউস সুনান’ বইটি গভীরভাবে অধ্যয়ন করে ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করি। ইতিমধ্যে ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের ‘হাদীছের প্রামাণিকতা’, ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ বইগুলো পড়ে একটি বিশুদ্ধ ইসলামী আন্দোলনের সন্ধান পাই। অবশেষে পাবনা শিবির অফিস তথা ‘মক্কা টাওয়ারে’ থাকা অবস্থায় আমি নিজেকে আহলেহাদীছ বলে প্রকাশ্য ঘোষণা দেই। এ কথা শুনে ছোট চাচা মাহফূয (বর্তমানে লন্ডনে আছেন) তার এক আত্মীয়কে ফোন করে এবং পাবনা শহর শাখার সভাপতিকে দিয়ে আমাকে একটি রুমে আটকে মারাত্মকভাবে প্রহার করায়। ফলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
পরবর্তীতে সেই মেস ছেড়ে দিয়ে অন্য মেসে উঠতে বাধ্য হই। আমাদের গ্রামে ও এলাকায় অপপ্রচারণা চালানো হয় এবং আমার বিরুদ্ধে মানুষকে উস্কে দেওয়া হয়। সর্বপ্রথম চাচাতো ভাই সাগর, শাহজাহান (সাথী ছিল) ও সালমান আমার দাওয়াতে সাড়া দেয়। আমার বন্ধু রাজশাহী মেডিকেলের ছাত্র ডাঃ মাহফূযুর রহমানের সাথে দীর্ঘক্ষণ এ বিষয়ে আলোচনা করি। সে আত-তাহরীকের ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন বইপত্র পড়ালেখা করে এবং অবশেষে আমার দাওয়াত গ্রহণ করে। সে তখন শিবিরের সাথী এবং পাঠচক্রের সদস্য ছিল।
সর্বশেষ গত রামাযানে বন্ধু মাহফূযের সাথে সাক্ষাতের জন্য বাড়ি যাই। মসজিদে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের সময় অভ্যাসমত জোরে আমীন বলায় উপস্থিত মুছল্লীদের মধ্যে শোরগোল সৃষ্টি হয়। সেদিন ছিল রবিবার। বাদ আছর বাবা ফোন করে বললেন, তোকে মারার জন্য মসজিদের মুছল্লীরা সবাই লাঠি হাতে নিয়ে প্রস্ত্তত। মসজিদে আসিস না। বন্ধু মাহফূয সব শুনে যেতে দিল না। যাহোক পরদিন দুপুরে ছিয়াম অবস্থায় যোহর ছালাতে তাকবীরে তাহরীমার পরে উপস্থিত হই। সালাম ফিরানোর সাথে সাথে আমাকে কাঠের টুকরা দিয়ে শরীরে আঘাত করা হয়। আমি রক্তাক্ত হয়ে যাই। পরে ইমাম ছাহেবের সামনে সবাই মিলে মসজিদ থেকে আমাকে বের করে দেয়। আমার অপরাধ হচ্ছে আমীন জোরে বললে মুছল্লীদের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটে। একই কারণে শাহজাহান ও সালমানকেও ছালাত শুরু করার পর মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয়। পরবর্তী ১৫ দিন বাড়ির বাইরেও যেতে পারছিলাম না। অবশেষে ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে সবার সাথে ছালাত পড়তে গিয়েও বাধা পাই। বাধ্য হয়ে একাই বাড়িতে পড়তে হয়। এখনও অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে আমাকে এ পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে। যে চাচাকে প্রথম দেখেছিলাম সঠিক পথের উপর, সে এখন হয়ে গেছে বড় বিদ‘আতী। এর একটাই কারণ, না জেনে, না বুঝে অন্যের প্রচারণায় অন্ধ দল ও ব্যক্তি পূজা। তাই হক্ব জেনে-বুঝেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমি এখন হাযারো সমস্যা ও কষ্টের মাঝেও প্রশান্তি পাই, আশার আলোয় উজ্জীবিত হই। যে হক্বের সন্ধান আমি পেয়েছি, তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সর্বদা তাকীদ অনুভব করি। আল্লাহ আমাকে হক্বের উপর টিকিয়ে রাখুন এবং সকলকে হক্ব বুঝার ও মানার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
ইকবাল বিন জিন্নাহ
রসায়ন বিভাগ, পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ।