অতিক্রান্ত
সময়ের পথচলাতে ভালমন্দের মেলবন্ধনে ছোট-বড় কত স্বপ্ন হৃদয়ে লালিত হয়। কিছু
স্বপণ বাস্তবায়িত হয়, কিছু থেকে যায় মরীচিকা। আলহামদুলিল্লাহ! মহান
আল্লাহর রহমতে যখন থেকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সান্নিধ্যে এসেছি,
সঠিক পথটা অনুধাবন করতে পেরেছি, তখন থেকে একটা স্বপ্ন লালিত হচ্ছিল মনের
গহীনে। তা হল শিরক-বিদ‘আতে আচ্ছন্ন মাযহাবী সমাজে সঠিক পথের দিশার সূচনা
করতে একটা ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করা। যাতে সমাজে একটা পরিবর্তনের জাগরণ
সৃষ্টি হয়। সমাজের সর্বস্তরে তাওহীদের চারাগাছ রোপিত হয়। বিশুদ্ধ
আক্বীদা-আমল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়।
স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায় কয়েক বছর যাবৎ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। কিন্তু একদিকে দ্বীনবিমুখ মানুষের আধিক্য অন্যদিকে কঠোর মাযহাবী পরিবেশ। সবমিলিয়ে এমন সমাবেশের প্রতি কারো আগ্রহ নেই। কাছের মানুষগুলোই তাচ্ছিল্য করে, হেয় করে স্বপ্নকে বার বার নির্বাসনে পাঠায়। তারপর ২০১৯ সালের শেষদিকে পুরনো স্বপ্নকে নতুনভাবে ঝালাই করে নবউদ্যমে অনেকের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। আলহামদুলিল্লাহ! কয়েকজন ভাই আশানুরূপ সাড়া দিলেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুরু হ’ল পথচলা। কয়েকজন আলোচকের সাথে কথা বললাম। গাজীপুর-২ আসনের মাননীয় এমপি এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ভাইয়ের সাথে কয়েকজন মিলে দেখা করে এই বিষয়ে কথা বলতেই তিনি বললেন- ‘ওয়ায মাহফিলগুলোতে যেতে মন চায় না। অধিকাংশ বক্তাই সমাজ সংস্কারমূলক আলোচনার পরিবর্তে অন্যদের হেয় করার জন্য অশ্লীল শব্দচয়ন করে থাকেন, অন্যকে কাফের উপাধি দেন এবং সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ান। যেখানে কুরআন-হাদীছের আলোচনা হবে, মানুষ পরকালমূখী হবে সেখানে এখন উল্টোই হচ্ছে। তাই এসব এড়িয়ে চলি।
আয়োজক কমিটির প্রধান আহসানুল্লাহ ভাই উত্তরে বললেন, আমাদের সম্মেলনটা ভিন্নধারার বিষয়ভিত্তিক হবে। বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে, বিষয়ের বাইরে কেউ কোন বক্তব্য রাখবে না। আমরা তথাকথিত বক্তাদের না এনে ইসলামী গবেষকদের নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ। মন্ত্রী ছাহেব হেসে বললেন, সবাই একধারার মাহফিল করে আর আপনারা ভিন্নধারার করবেন! কারা আসবেন? হুমায়ুন কবীর নামে আয়োজক কমিটির অন্য ভাই দু’জন আলোচক ছাহেবের নাম বললেন ও ছবি দেখালেন। মন্ত্রী ছাহেব বললেন, ঠিক আছে যাবো ইনশাআল্লাহ।
এলাকার প্রবীণ মুরববীদের সাথে আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা করতেই কয়েকজন সোৎসাহে বললেন, এ এলাকায় জীবনে কখনও মাহফিল হতে দেখিনি। আয়োজন করতে পারলে এটা বড় সফলতা হবে। কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেন। বললেন, এলাকার পাশে যে মাদ্রাসা আছে সেখানেই তো মাহফিল হচ্ছে, এ এলাকায় আবার কি প্রয়োজন? মাদ্রাসার প্রধান তো আমাদের এলাকার মসজিদেরও ইমাম। এতেই কি হচ্ছে না! ছোট ছোট না বোধক বিষয়গুলো এড়িয়ে গেলাম। মাহফিল আয়োজনে সহযোগী শামসুল চাচাকে অনুরোধ করা হ’ল মসজিদের খত্বীব ছাহেবকে বিষয়টা জানানোর জন্য। খত্বীব ছাহেবও যেন সাথে থাকেন। তিনি নিজেও আলোচনা রাখবেন অন্য ১/২জন আলোচকও দিবেন। খত্বীব ছাহেব মাহফিলের কথা শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বললেন, এটাতো ভালো কাজ। বক্তা কি কাউকে নির্ধারণ করা হয়েছে? চাচা বললেন, সমাজের যুবকরা আয়োজন করছে তো তাই সবার নাম বলতে পারবো না তবে অমুক বক্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে শুনেছি। কথা শেষ না হ’তেই খত্বীব ছাহেব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
বললেন, সে তো আহলেহাদীছ! বিতর্কিত বক্তা। এসব বক্তা আনার প্রশ্নই আসে না। চাচাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিলেন না!
জুম‘আর ছালাতের খুৎবা শুরু হবে। তাই সময়ও নেই। চাচা মন খারাপ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলেন। খত্বীব ছাহেব একটি রাজনৈতিক ইসলামী দলের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক। প্রায় ১৮ বছর যাবৎ খত্বীব পদে আসীন। এলাকার সাধারণ জনগণের মাঝে প্রভাব ঈর্ষণীয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সাথে সরকারদলীয় একাংশের সাথেও তার সম্পর্ক মধুর। অতীতে প্রায়ই আহলেহাদীছের ব্যাপারে, ড. জাকির নায়েককে নিয়ে তিনি খুৎবায় তীব্র সমালোচনা করেছেন। পুরো সমাজে আহলেহাদীছ শব্দটিও অধিকাংশের কাছে নতুন!
খত্বীব ছাহেব এর বিরোধপূর্ণ আচরণ আয়োজক কমিটির কর্ণগোচর হ’তেই তারা বিস্মিতবোধ করলেন। সমাজের অন্যান্যদের সাথে আলাপচারিতায় জানানো হ’ল যে আলোচক ছাহেবের নাম খত্বীব ছাহেবকে বলা হয়েছে তিনি একজন হানাফী মাযহাবের আলেম। তিনি মাযহাবী নিয়মানুযায়ী ধানমন্ডি ২৭নং সংলগ্ন মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করান। প্রয়োজনে আমাদের সাথে চলেন গিয়ে যাচাই করে দেখুন। তিনি যদি মাযহাবী মতে ছালাত আদায় না করান তাহ’লে ওনাকে বাদ দিয়ে দিব। খত্বীব ছাহেব ও অন্যান্যরা তাতেও রাজী নন। এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর পর খত্বীব ছাহেব আহলেহাদীছ বাদ দিয়ে নতুন সুর উঠিয়ে বললেন, উনি অমুক ইসলামী দলের লোক, বিতর্কিত ব্যক্তি। তাকে রাখা যাবে না। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কৌশল ছিল যাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে তাকে সামনে রেখে অন্যান্য আলোচকগণের আলোচনা চালিয়ে নেয়া অথচ উনাকে নিয়েই সমস্যা তৈরী হ’ল।
সপ্তাহের শেষদিকে সংবাদ আসলো তারা চক্রান্তের জাল বুনছেন, আসছে জুম‘আতে খত্বীব ছাহেব মুছল্লীদের উত্তেজিত করে তুলবেন। উত্তেজিত জনতাকে সাথে করে মাননীয় মন্ত্রী ছাহেবের কাছে গিয়ে মাহফিল বন্ধ করার চেষ্টা করবেন। আয়োজক কমিটি সংবাদ পেয়ে থানার ওসি ছাহেবের মাধ্যমে খত্বীব ছাহেবকে এই বিষয়ে বক্তব্য না রাখতে অনুরোধ করেন। কিন্তু খত্বীব ছাহেব পূর্বের সিদ্ধান্তকেই খুৎবায় বাস্তবায়ন করেন।
তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্যের এক পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেন। মসজিদ থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্তের কূটকৌশল প্রয়োগ করেন। সাধারণ মুছল্লীদের অধিকাংশ বুঝে না বুঝে উচ্চ আওয়াযে বার বার ঠিক ঠিক ধ্বনিতে তাকে সমর্থন করে কাঁদতে থাকেন! যদিও কেন তার এই হাহাকার উপস্থিত প্রায় আড়াই হাযার মুছল্লীর বড় অংশই বুঝে উঠতে পারছেন না। কি হচ্ছে, কেন এসব হচ্ছে! কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করছেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কার কার জন্য এরকম হচ্ছে। সুকৌশলে তিনি মুছল্লীদের মাঝে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিলেন। মসজিদের দায়িত্বশীল দু’জনও মাইক হাতে নিয়ে তাকে সমর্থন জোগালেন। মাহফিলের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সবাইকে হাত উঠিয়ে শপথও করালেন।
আলহামদুলিল্লাহ! ঐদিন মাননীয় মন্ত্রী ছাহেব দলীয় সম্মেলনে ঢাকাতে ছিলেন। তাই সকলকে নিয়ে খত্বীব ছাহেব যেতে পারেননি। তার কূটকৌশলও সফল হয়নি। জুম‘আ শেষে এলাকায় একটা থমথমে ভাব। জীবনের প্রথম কোন মাহফিল করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে এরকম কূটকৌশলী কারবার দেখে ক্ষণিকের জন্য হ’লেও মনজগতে কিছুটা আতংক বিরাজ করছে। মসজিদে বসে নানা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। এভাবেই বিভিন্ন স্থানে ধর্মকে ব্যবহার করে তৌহিদী জনতার ব্যানারে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা হয়। গেল বছর থেকে চলমান ভোলার ঘটনা পরম্পরা যার জাজ্বল্য প্রমাণ।
মনকে প্রবোধ দিলাম যে সমস্যাতেই পড়ি না কেন, তাতো কেবল দ্বীনী স্বার্থেই। তাই মসজিদে বসে থেকে ‘আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মাতি মিন শাররি মা খালাক্বা (অর্থ: আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমাসমূহের অসীলায় আমি তাঁর নিকটে তাঁর সৃষ্টির ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই) দো‘আটি সহ নানাভাবে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলাম।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলাকার থমথমে পরিস্থিতিতে করণীয় কি বুঝতে পারছিলাম না। অনেক কাছের মানুষের চাহনীগুলোয় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সেসব সযতনে এড়িয়ে দ্রুত মায়ের সান্নিধ্যে গিয়ে সব খুলে বললাম। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, মাহফিল হবেই ইনশাআল্লাহ। মায়ের দৃঢ় উচ্চারণে মনে আশার বাতিগুলো পুনরায় উজ্জ্বল হ’তে থাকলো। আরো অনেক দ্বীনী ভাইকে বিষয়টি জানালাম। রাজশাহীস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সবকিছু অবহিত করলাম। আমার সফলতার জন্য সবাই দো‘আ করলেন। দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি তাদের কূটকৌশলের বিরুদ্ধে আমরাও নানা কৌশলে আগাতে থাকলাম।
কৌশল হিসাবে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে দুইজন ভাই খত্বীব ছাহেবের সাথে দেখা করে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছেন। খত্বীব ছাহেব নিজে থাকবেন ও একজন আলোচক দিবেন এভাবে সমঝোতা হচ্ছিল। খুব বেশী ফল না হ’লেও এর ফলস্বরূপ পরবর্তী জুম‘আতে তিনি মাহফিলের বিরুদ্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য করেননি। যদিও গোপনে গোপনে তাঁর বিরোধিতা চলছিলই। এরই ধারাবাহিকতায় থানার ওসি ছাহেব আয়োজক কমিটিকে ডেকে নিয়ে মাহফিল বন্ধ করার নির্দেশনা দিলেন। যদিও আল্লাহর অশেষ রহমতে মাহফিল বন্ধের বিষয়ে বলার কারণে মন্ত্রী ছাহেব ওসিকে ভৎর্সনা করেন।
প্রশাসনিক বাধা দূর হলেও সামাজিক অসন্তোষ ও অসহযোগিতা চলমান। কূটকৌশলীরা হঠাৎ করেই সমাজের সকল শ্রেণীর শীতার্ত মানুষের বাসা-বাড়িতে কম্বল বিতরণ শুরু করেন। যার প্রয়োজন তাকে দিচ্ছেন যাদের প্রয়োজন নেই তাদের কয়েকজনের বাসা-বাড়িতেও জোর করে কম্বল দিচ্ছেন! যাতে তাদের পক্ষে সাধারণ জনগণের মনোভাব একীভূত থাকে (মহান আল্লাহ সর্বাধিক অবগত)। অথচ বিগত বৎসরগুলোতে আদৌ এত মানবতাবোধ দেখা যায়নি। তাদের এসব বিবিধ কূটকৌশল প্রতিহত করতে গিয়ে আমরা মাত্র ৪-৫ দিন সময় পেলাম মাহফিলের প্রস্ত্ততি নেয়ার।
অর্থ সংগ্রহ, পোস্টার, দাওয়াত কার্ড, প্রচারণার জন্য এ সময়টুকু বিষম প্রতিকূল। যারাও সাথে থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন তারাও সম্মুখে একরকম, পাশ থেকে সরতেই আরেকরকম। এদিকে ইমাম ছাহেবের আহলেহাদীছ বিরোধী প্রচারণায় বহু মানুষ বিভ্রান্ত। এরই মধ্যে অবশ্য মহান আল্লাহর উপরই ভরসা রেখে পুরোদমে কাজ শুরু করা হ’ল।
ভালোবেসে, হাত বুলিয়ে, নমনীয় হয়ে, নিজে সাথে থেকে, বাসা-বাড়িতে কার্ড পৌছিয়ে, মৌখিকভাবে দাওয়াত পৌঁছাতে থাকলাম। সাথী ছোট-বড় ভাইদের বললাম, কেউ আর্থিক সাহায্য দিলে নিবেন। প্রয়োজনে চাইবেন। তাতে মাহফিলে আসার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। যদিও এক্ষেত্রে অনেকের গোমড়া মুখের তীর্যক বাক্য শুনতে হয়েছে! শিকার হ’তে হয়েছে নানা অপমানের।
মাহফিল বিরোধীরা কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা না করার ব্যাপারে একাট্টা ছিল। তবে আয়োজক কমিটি নিজেরাই ব্যক্তিগতভাবে মোটা অংকের চাঁদা দিয়েছেন। প্রয়োজনে আরো দিয়ে হ’লেও মাহফিল করার বিষয়ে তারা জেদী ছিলেন। মাহফিল ছিল ২ ও ৩রা জানুয়ারী ২০২০। সময় ঘনিয়ে আসছে। আয়োজক কমিটির সদস্য অল্প হ’লেও সকলেই উদগ্রীব। সময়ের প্রতিটি স্পন্দনে চোখ-কান খোলা রাখতে হচ্ছে। আবার না কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়।
থার্টি ফার্স্ট নাইট চলে আসলো। মাহফিল আয়োজনকারী অনেক সাথী ভাই রাতটি উদযাপন থেকে বিরত থাকলেন। কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করলেন এটা হারাম। যাইহোক অন্তত আয়োজনকারীদের মধ্যে পরিবর্তনের প্রবাহ শুরু হয়েছে। এদিকে মাহফিলের বিরোধীতাকারীরা কুটকৌশল চালিয়েই যাচ্ছে। মাহফিল শেষমেষ হয়েও যায়, তাহলে সেখানে যেন তেমন কোন শ্রোতা উপস্থিত না হয় সেজন্যও তাদের কেউ কেউ দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। পাশের মাদ্রাসাগুলোর দায়িত্বশীলগণ মাহফিলের দিনেই পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করলেন। যাতে সেখান থেকে কোন ছাত্র না আসতে পারে। বাস্তবতা যে কত ভয়াবহ, বিদ্বেষ যে কত গভীরে তা প্রমাণ হয় এসব নামধারী মাওলানাদের কাজে। সাথী ভাইদের কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়ছেন। যদি লোকজন না হয়, তাহ’লে এত আয়োজন করে কি লাভ। সবই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে। অন্তরে দুশ্চিন্তা থাকলেও সাথী ভাইদের নিরাশ করছি না। বললাম, লোক সমাগম হবে ইনশাআল্লাহ।
একজন বক্তার নাম প্রকাশ করতেই এত হুলস্থুল! তাই কৌশলগত কারণে অন্য নামগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি। পোস্টারে, কার্ডে পরিচিত আলোচকদের নাম ব্যবহার না করে তাদের উপনাম বা অন্যকোনভাবে নাম উপস্থাপন করেছি। যাতে অনলাইনে সার্চ দিয়ে কেউ খুঁজে না পায়। উদ্বেগ-উৎকন্ঠা পেরিয়ে সময়ের আবর্তনে কাংখিত সেই ২ জানুয়ারী ২০২০ চলে আসলো। হ্যাঁ অত্র এলাকার জন্য ইতিহাসই। আজই প্রথম এখানে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সভা হবে। ইতিপূর্বে যে স্থান থেকে এলাকাবাসী গান ও খেলাধূলার অনুভূতি পেয়েছে। আজ সেখান থেকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সজীবতা ছড়িয়ে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
গাজীপুরে মাহফিলে এলইডি স্ক্রীনের ব্যবহার এই প্রথম। পুরুষ-মহিলা ভিন্ন ভিন্ন প্যান্ডেল করা হয়েছে। পুরো এলাকা ও আশেপাশে ২৫টি মাইক দেয়া হয়েছে। পুরোপুরি প্রস্ত্ততি সম্পন্ন। বাদ আছর আহলেহাদীছ আলোচক মুহাম্মাদ ইউছুফ ভাই পরকালীন জীবনে কি কি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে? এই বিষয়ের উপর আলোচনা শুরু করলেন।
আলহামদুলিল্লাহ! টঙ্গীর বুকে যে মাঠের অদূরেই তুরাগ নদীর তীরে কয়েকদিন পরই অনুষ্ঠিত হবে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা, সেখানে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আজ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রকাশ্যে আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছেন! মাহফিলে আশপাশ থেকে উৎসুক অনেক আহলেহাদীছ ভাই এসেছেন। তাই মাগরিবের ছালাতে ‘আমীন’ শব্দের অপার্থিব ও অপরিচিত গুঞ্জরণ! এসব অনুভূতি যে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ছালাত শেষে মসজিদের ইমাম ও পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসার মুহতামিম মুখতার ছাহেব আলোচনা রাখলেন। বিষয় ছিল সময়ের মূল্যায়ন। কওমী আলেম হ’লেও মাহফিলের পরিবেশ বুঝে শেষের অংশ বাদে আলোচনা ছহীহ হাদীছ দিয়েই করলেন। বিবিধ কূটকৌশলের কারণে প্রথমদিকে লোকসমাগম কম থাকায় আয়োজক কমিটির প্রধান আহসানুল্লাহ ভাই কে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। বার বার উৎসুক দৃষ্টিতে প্রশ্ন রাখছেন লোক সমাগম না হ’লে তো এই আয়োজন ব্যর্থ হবে। বললাম, মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। মানুষ না আসলে আল্লাহ ফেরেশতা পাঠাবেন ইনশাআল্লাহ।
বাদ এশা বক্তব্য শুরু করলেন ড. আহসানুল্লাহ বিন ছানাউল্লাহ। তিনি ছহীহ ফাযায়েলে আমল-এর লেখক। তাঁর বিষয়- পাপ ও ক্ষমা। অন্তর্ভেদী আলোচনা শুরু করলেন। আধাঘন্টা পার হ’তেই ধীরে ধীরে লোকসমাগম বাড়তে থাকল। আলহামদুলিল্লাহ! বাড়তে বাড়তে প্যান্ডেল প্রায় পূর্ণ। আয়োজক কমিটির সাথী ভাইয়েরাও স্টেজে। তাদের বিমর্ষ চেহারাগুলোতে বেশ আলোর ঝলকানি দেখে স্বস্তিবোধ করলাম। গুটিকয়েক এই সাথী ভাইদের অবর্ণনীয় ত্যাগ, কৌশল, মানসিক যন্ত্রণাকে ছাপিয়েই তো আজকের মাহফিল!
পরবর্তী আলোচক হিসাবে বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ঢাকা যেলা পূর্ব-এর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল-মারুফ আলোচনা শুরু করলেন। পূর্বের আলোচক ছাহেবের ভীতিকর বক্তব্যের পরেই পবিত্র কুরআনের মোহময় তেলাওয়াত ও জাগরণী সম্বলিত সুন্দর আলোচনার কয়েক মিনিট পার হ’তেই প্যান্ডেল পূর্ণ হয়ে শেষ সীমানায় স্থাপিত এলইডি মনিটরের সামনেও জনতার ঢল। অদূরে অবস্থিত মহিলা প্যান্ডেলে উপচেপড়া ভিড়। মূল প্যান্ডেলে পিনপতন নীরবতা। বিস্ময়ে বিমূঢ় সমাগত জনতা ও আয়োজক কমিটির সাথী ভাইয়েরা। তারা যে প্রতি বছর আশেপাশের এলাকাগুলোতে চিৎকার চেঁচামেচি আর অন্যদের গালমন্দ সম্বলিত ওয়ায শুনতেই অভ্যস্ত। কুরআন-হাদীছের দলীল উল্লেখ করে প্রদত্ত আলোচনা শ্রবণ অনেকের কাছে আজই প্রথম। প্রথমদিকে বয়স্ক যারা মাহফিলের বিরোধিতা করেছেন, অবজ্ঞা করেছেন তারাও দেখি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন। পাশে দাড়িয়ে মনোযোগ সহকারে বক্তব্য শ্রবণ করছেন।
যারা ইতিপূর্বে কেবল আহলেহাদীছদের ব্যাপারে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য শ্রবণে অভ্যস্ত। তারা আজ আহলেহাদীছদের আলোচনা শুনছে হৃদয়-মন এক করে! বার বার মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আনন্দাশ্রু লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি। ফেলে আসা টুকরো স্মৃতিগুলো বারবার হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে। সেই মসজিদের পার্শ্বেই মাঠে আহলেহাদীছ আলেমরা আলোচনা রাখছেন বীরদর্পে। আহলেহাদীছদের নিয়ে অপপ্রচার, তাচ্ছিল্য করে যিনি খুতবায় ব্যঙ্গ করতেন, অজ্ঞতার অহংকারে মসজিদ থেকে তাদের বের হয়ে যেতে বলতেন সেই ব্যক্তিটি আজ কেবল সময়ের মূল্য নিয়েই আলোচনা রাখলেন। তাও অধিকাংশই হাদীছ দিয়ে। আরো যেসব মাযহাবী আলেম সমাজে দাপট দেখিয়ে এসেছেন, ধর্মকে নিজেদের ব্যবসার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে চলেছেন যুগের পর যুগ। তাদের দৃষ্টিসীমানার মাঝেই বসে আজ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোচনা হাযারো জনতা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছেন। মাদ্রাসাগুলো থেকে ছাত্রদের বের হতে দেয়া হয়নি। কিন্তু মাইকের মাধ্যমে তারাও যে শুনতে বাধ্য হচ্ছে। তাই বারবার কেবল আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করছি।
আব্দুল্লাহ আল-মারূফের বক্তব্য চলমান। আলোচনা চলছে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ নিয়ে। আল্লাহর বাণী, রাসূলের বাণীতে অনভ্যস্ত শ্রোতাদের অনেকেই চোখের পানি ঝরাচেছন। আয়োজক কমিটির প্রধান আহসানুল্লাহ ভাইকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। বললেন, এরকম ওয়াজ তো আর শুনি নাই। সকল কষ্ট, গ্লানি মুছে গেছে। এই মাহফিল নিয়ে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আল্লাহ পূর্ণতা দিয়েছেন।
প্রথমদিন সর্বশেষ আলোচনা রেখেছেন সুপরিচিত আলোচক জনাব মুখতার আহমাদ। গভীর রাত পর্যন্ত শ্রোতারা জীবনঘনিষ্ঠ অসাধারণ আলোচনা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন।
৩রা জানুয়ারী ২০২০ইং রোজ শুক্রবার। ফজরের পর থেকেই ভীষণ বৃষ্টি। ছালাত আদায় করেই স্টেজ ও প্যান্ডেল ঘুরে দেখলাম। ত্রিপল থাকায় বেশি ক্ষতি না হ’লেও মাঠ পানিতে সয়লাব। বৃষ্টি কিছুটা কমতেই স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা পানি সরানোর চেষ্টায় রত হ’লেন। মনটা বিষন্ন হ’লেও মহান আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে থাকলাম। গতরাতের বক্তব্যগুলো এলাকার মানুষের মনে দাগ কেটেছে। যদিও আজকের জুম‘আয় খত্বীব ছাহেব কি আলোচনা রাখবেন কিছুটা সংশয় ছিল। কিন্তু খুৎবায় তিনি কেন জানি মাহফিলের পুরো বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। পুরো সমাজে বক্তব্যগুলো ভালো প্রভাব ফেলেছে। সেকারণ হয়ত কিছু বলার পরিবেশ পাননি।
সন্ধ্যা নাগাদ থেমে থেমে বৃষ্টি। এর মাঝেই মঞ্চ ও প্যান্ডেলও প্রস্ত্তত করা হয়েছে। এলাকাবাসীর অনুরোধে আজ মাইক বাড়িয়ে ৩৭টি করা হয়েছে। আজ বাদ আছর থেকেই লোকসমাগম। বাদ মাগরিব আলোচনা শুরু হ’ল। প্রথম থেকেই প্যান্ডেল পূর্ণ। আলোচকদের নাম শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। নিজেদের কৌশলের কারণে পুরো নাম প্রকাশ করা হয়নি। মাঝে মাঝেই বৃষ্টির হানা। আমরাও মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করছি। শীত উপেক্ষা করে বৃষ্টির পানি গায়ে মেখে প্যান্ডেল ভর্তি পুরুষ ও মহিলারা আলোচনা শুনছেন!
আলোচনা রাখলেন মাওলানা আশরাফুল ইসলাম। এরপর ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল ইহসান ইলাহী যহীর। তার বিষয় ছিল- সার্বিক জীবনে সুন্নাতের অনুসরণ। অসাধারণ আলোচনা রাখলেন। তারপর আলোচনা রাখলেন ড. আহমাদুল্লাহ ত্রিশালী। উপচে পড়া ভিড় আর পিনপতন নীরবতায় পরকালীন ভয়ের ওয়ায বিমোহিত করছে শ্রোতাদের।
পরবর্তী আলোচক হিসাবে মঞ্চে উঠলেন মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী। অনেক শ্রোতা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ পোস্টারে, কার্ডে, ব্যানারে আলোচক ছাহেবের অনুমতিক্রমে কৌশল হিসাবে নাম লেখা হয়েছিল আবূ আনিস মাদানী। বক্তব্য শুরু করলেন আক্বীদার শিক্ষা দিয়ে। তার বক্তব্যের মধ্যেই মঞ্চে উপস্থিত হ’লেন গাজীপুর-২ আসনের মাননীয় সাংসদ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ছাহেব। তিনি নিবিষ্ট মনে আলোচনা শ্রবণ করলেন। আক্বীদা, জিহাদ, দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করলেন মাদানী ছাহেব। আলোচনা শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বল্প সময়ে মাননীয় মন্ত্রী আমানুল্লাহ ছাহেবের আলোচনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং সকলকে ৫ ওয়াক্ত ছালাতের প্রতি গুরুত্বারোপ ও নববী আদর্শে জীবন গড়ার প্রতি উৎসাহিত করলেন। সর্বশেষ আলোচনা রাখেন সোবহানবাগ জামে মসজিদের খত্বীব জনাব শাহ ওয়ালীউল্লাহ ছাহেব। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুইদিন ব্যাপী সমাবেশের সফল সমাপ্তি ঘটল। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
দু’দিনব্যাপী এই মাহফিল শেষে পুরো সমাজের চিত্র যেন পাল্টে গেল। অধিকাংশ মানুষের একই কথা- আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক ওয়ায হয়। কিন্তু এরকম বক্তব্য তো আগে শুনিনি। এখন থেকে প্রতি বছর যেন এরূপ আয়োজন করা হয়।
মাহফিল সম্পন্ন হওয়ার কয়েকদিন পর পোশাকশিল্পে কর্মরত এক দ্বীনি ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি বললেন, আমাদের ফ্যাক্টরীতে ২-৩দিন ধরে একটা বিষয় আলোচিত হয়েছিল সকলের মাঝে। বললাম, কি বিষয়? ঐ যে আমানুল্লাহ মাদানী ছাহেব বক্তব্যের শুরুতেই বললেন, আল্লাহ কোথায় আছেন এবং রাসূল (ছাঃ) কিসের তৈরী। এটা নিয়ে আলাপচারিতায় সকলে বলাবলি করছিলেন, আমরা এতদিন যাবৎ বিশ্বাস করে আসছি যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এবং রাসূল (ছাঃ) নূরের তৈরী। অথচ তিনি কুরআন ও হাদীছ দিয়ে কত সুন্দরভাবে সঠিক বিষয়টা আমাদের বুঝিয়ে দিলেন!
মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আদায় করছি মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ছাহেব, সম্মানিত আলোচক বৃন্দ এবং আয়োজক কমিটির সদস্যবৃন্দ সহ জনাব মতিউর রহমান, শাহীন শিকদার, হুমায়ুন কবীর, মাহমূদুল হাসানসহ অন্যান্য সকল ভাইদের প্রতি। মহান আল্লাহ দ্বীনের পথে তাদের সকল খেদমতের উত্তম প্রতিদান দান করুন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন-আমীন।
শিক্ষা :
১. জীবনের প্রতিটি কাজে পূর্ণ ইখলাছ বজায় রাখতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কাজ করা হয় তাতে আল্লাহর সাহায্য আবশ্যিক হয়ে যায়। দুনিয়াবী কোন বাধা তার মোকাবেলায় টিকতে পারে না।
২. আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা এবং এলাহী মদদের উপর অবিচল আস্থা বজায় রাখতে হবে।
৩. নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় থাকতে হবে এবং সর্বদা ধৈর্যধারণ করতে হবে।
৪. সর্বদা জামা‘আতবদ্ধ থাকতে হবে। সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে এককভাবে কিছু করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি একাকী নিজেকে হকের উপর দৃঢ় রাখাও অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে আমৃত্যু বিশুদ্ধ দ্বীনের উপর টিকিয়ে রাখুন এবং আমাদের সকলকে দ্বীনে হকের প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার তাওফীক দান করুন- আমীন!!
-মুহাম্মাদ বেলাল বিন ক্বাসেম, গাযীপুর।