আমার
শ্রদ্ধেয় পিতা ছিলেন হানাফী মাযহাবের আলেম ও তাবলীগ জামাতের উপযেলা আমীর।
পরিবারে আমার বড় ভাই, বোনের স্বামী, চাচাসহ বংশের অনেকেই আলেম। আমার মায়ের
বংশও অনুরূপ। পিতা আলেম হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই আমি দ্বীনী পরিবেশে বড়
হই। আমাকে পড়াশোনার জন্য সবসময় তিনি উৎসাহ দিতেন। যখন পবিত্র কুরআন পড়া
শিখলাম, তখন পিতা আমাকে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী প্রণীত সংক্ষিপ্ত তাফসীরসহ
বঙ্গানুবাদ কুরআন উপহার দেন। আমিও সোৎসাহে কুরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথে
বঙ্গানুবাদ ও তাফসীর পড়তাম।
তখন আমার বয়স প্রায় ১০/১১ বছর হবে। গ্রামের হাটের দিনে দূর-দূরান্ত থেকে বিবিধ পেশার মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আসতেন। সেসময় লক্ষ্য করতাম এক/দু’জন মুছল্লী আমাদের চেয়ে ভিন্নভাবে ছালাত আদায় করেন। যারা আমাদের পরিচিত নন। দূর গ্রামের কেউ হবেন। অবাক হয়ে ভাবতাম উনারা এভাবে কেন ছালাত আদায় করছেন! অবশ্য চোখের বিহবলতা মননে প্রশ্নের উদ্রেক করার পরিবর্তে হেয় প্রতিপন্নতায় ছুঁয়ে যেত। আমার পিতা যেহেতু মসজিদের ইমাম ও খত্বীব তাই আমার আস্থা তো তার জ্ঞান ও আমলের উপরেই। যে এক/দু’জন মুছল্লী আমাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে ছালাত আদায় করেন, ফরয ছালাত শেষে মোনাজাত করেন না, তাদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব আসাটা স্বাভাবিক। তাদের দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে তাকাতাম আর ভাবতাম, কি মুছল্লী হয়েছে? এরা আমার পিতার চেয়ে বেশি বুঝে!
আমি আমার পিতার সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মীলাদ-কিয়ামে অংশগ্রহণ করতাম। তিনি পবিত্র কুরআনের যে আয়াতগুলো দিয়ে সুর করে মীলাদ পড়াতেন, আমি সেসব আয়াত যত্নসহকারে অনুবাদসহ মুখস্থ করতাম। যখন এসএসসিতে এ প্লাস (জিপিএ-৫) পেলাম, তখন পিতা আমাকে এক সেট বেহেশতি জেওর উপহার দিলেন। আমিও আনন্দ নিয়ে পুরোটা পড়ে ফেললাম। এভাবে ফাযায়েলে তাবলীগ, ফাযায়েলে নামাজ, ফাযায়েলে কুরআন, ফাযায়েলে রমজান, ফাযায়েলে জিকির, হেকায়েতে সাহাবা প্রভৃতি বই পড়ি আর অন্যদের দাওয়াত দেই।
ঢাকার নটরডেম কলেজে যখন পড়ার সুযোগ হ’ল। সেখানে সমমনা কয়েকজন সহপাঠী মিলে তাবলীগের কাজ করতাম। বিশেষ করে তিন বন্ধু এক সাথে চলতাম। কখনও আমি কখনও অন্য বন্ধুর ইমামতিতে আমরা ছালাত আদায় করতাম। একদিন দেখি খানিক দূরে কলেজেরই এক ভাই ছালাত আদায় করছেন। সাথে সাথে আমার ছোটবেলায় গ্রামের হাটের মসজিদে ভিন্ন তরীকার মুছল্লীদের ছালাতের কথা মনে পড়ে গেলা। আরে এই ভাইও তো ঐভাবে ছালাত আদায় করছেন! ছেলেবেলায় ফেলে আসা স্মৃতির সাথে বাস্তবতার মিল পেয়ে কৌতুহল দ্বিগুণ হয়ে গেল। ঐ সহপাঠির প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরী হ’ল। কেন সে এভাবে ছালাত আদায় করছে? কলেজের কোলাহলমুখর সময় ও পড়ালেখার ব্যস্ততার ফাঁকে চোখ ও মনে তাকে খুঁজে ফিরি। প্রশ্ন একটাই কেন আমাদের ও তার ছালাতের মাঝে ব্যতিক্রম। তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
একদিন কলেজের Extra Curriculum Program-এ বসে আছি। এক ভাই এসে বললেন, আপনার পাশে বসতে পারি। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, ঐ ভাই; যাকে আমি খুজঁছি। প্রতীক্ষার অবসান ও অজানাকে জানার আনন্দে হৃদয়ের উৎসাহ বিস্তৃত করেই বললাম, জ্বী বসুন। ক্লাস শেষ করে একটু অপেক্ষা করবেন, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ছালাতের ওয়াক্ত হওয়ায় ক্লাস শেষে তাকে নিয়ে মসজিদে গেলাম। পথিমধ্যে জিজ্ঞেস করলাম, সমাজে চলে আসা নিয়মের বাইরে কেন আপনি ছালাত আদায় করেন? আমাদের মতোই কেন ছালাত আদায় করেন না এবং আমাদের সাথেও কেন নয়?
তিনি বললেন, আপনারা যেভাবে ছালাত আদায় করেন তা রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে হচ্ছে না। বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে বললাম, কেন হচ্ছে না? উত্তর না দিয়ে বললেন, আপনি ওযূ কিভাবে করেন? আমি ওযূর বর্ণনা দিলাম। তিনি বললেন, ঘাড় মাসাহ করার কথা উল্লেখ করেছেন তা কোথায় আছে? ঝটপট উত্তর দিলাম, কেন বেহেশতী জেওরে আছে। ভাই, বেহেশতী জেওর তো দলীল নয়। দলীল দিতে হবে পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ থেকে। এভাবে আরো কিছুক্ষণ আলাপ চলতে থাকল। বিশেষ করে মাওলানা ইলিয়াস ছাহেবের ফর্মুলার প্রচলিত তাবলীগের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে। তিনি আমাকে প্রচলিত তাবলীগের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো যেমন কোনটা শিরক, কোনটা বিদ‘আত, কোনটা কুফর সে সর্ম্পকে বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থের হাদীছ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। আমি বেহেশতি জেওর দিয়ে যুক্তিগুলো খন্ডানের বৃথা চেষ্টা করে অবশেষে বললাম, কোন বিষয় সঠিক তা জানার জন্য আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে।
কলেজ ছুটির পর বাসায় গেলাম। এতদিন ধরে যত্নসহকারে করা আমলগুলো আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বিষয়গুলো যাচাই করতে হবে। আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরী থেকে বুখারী, মুসলিম, মিশকাত গ্রন্থ নিলাম। প্রথমেই মিশকাত পড়া শুরু করলাম। যেহেতু সব ধরনের হাদীছগুলো এই গ্রন্থে আছে। গ্রন্থকার এই গ্রন্থে প্রতিটি অধ্যায়কে তিনটি অনুচ্ছেদে ভাগ করেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদে মুত্তাফাকুন আলাইহ (বুখারী ও মুসলিম) হাদীছ দিয়ে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে তিরিমিযী, আবূদাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি এবং তৃতীয় অনুচ্ছেদে ইবনু আবী শায়বা, মুসনাদে আব্দুর রায্যাক ইত্যাদি। দেখলাম বুখারী ও মুসলিমের হাদীছগুলোর সাথে সহপাঠীর আমল ও বর্ণনা মিলে যাচ্ছে। আর আমরা এতদিন যে দলীলের উপর আমল করছি সেগুলোর কিছু দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে নয়তো তৃতীয় অনুচ্ছেদে আছে। আবার কিছু আমলের বর্ণনার বিপরীতে হাদীছ তো কোথাও নেই। যেমন ঘাড় মাসাহ করার হাদীছটা কোথাও পেলাম না! শেষে গিয়ে দেখলাম অনুবাদক টীকায় লিখেছেন, ‘যদিও ঘাড় মাসাহ করার কোন হাদীছ পাওয়া যায়নি। তবে হানাফী মাযহাব মতে এটা মুস্তাহাব’।
আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহ আমার ভাবনাকে আরো প্রসারিত করে দিলেন। যে বিষয়ে কোন ছহীহ বা যঈফ দলীল নেই সেটা কি করে মুস্তাহাব হ’তে পারে! আরো একটা বিষয় দেখলাম রাফউল ইয়াদায়েন নিয়ে যত হাদীছ আছে সবগুলোর টীকায় তিনি লিখেছেন মানসূখ (রহিত) হয়ে গেছে। কিভাবে মানসূখ হ’ল তার কোন ব্যাখ্যা নেই। ভাবছি, শুধু টীকা লিখে দিলেই হ’ল! রিজাল শাস্ত্রের কয়েকটা গ্রন্থ পড়লাম। কোন হাদীছ মানসূখ হ’তে হ’লে অন্য হাদীছ দিয়ে তার প্রমাণ দিতে হবে, কেন কিভাবে মানসূখ হ’ল। অথচ স্বপক্ষে কোন প্রমাণ না দিয়েই অনুবাদক মন্তব্য লিখে দিলেন। রাফউল ইয়াদায়েন এর পক্ষে অনেক হাদীছের বিপরীতে রাফউল ইয়াদায়েন না করার একটা হাদীছ পাওয়া গেল। পরবর্তীতে মীনা প্রকাশনীর মিশকাত পড়ার পর দেখলাম সেখানে লেখা আছে হাদীছটি ছহীহ নয়। নিজেকে প্রশ্ন করলাম আমাদের (মাযহাবের) প্রকাশনীর গ্রন্থ অথচ সেখানেই উল্লেখ আছে হাদীছ ছহীহ নয়। তারপরও সকল ছহীহ হাদীছ বাদ দিয়ে আমরা একটা প্রমাণিত সুন্নাতী আমলকে প্রত্যাখান করছি। এটা কি নিজেদের সাথে প্রতারণার শামিল নয়?
একদিন সহপাঠী ভাইটি মাওলানা ইলিয়াস ছাহেবের তাবলীগের দলীলসহ ত্রুটি-বিচ্যুতি উল্লেখ আছে এমন একটি বই দিলেন। বইটি সাথে নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরীতে গিয়ে হাদীছের গ্রন্থগুলোর সাথে মিলিয়ে যাচাই করে দেখলাম। আশ্চর্য সবই তো মিলে যাচ্ছে। হতাশা আতংকে পরিণত হ’ল। এতদিন কি তাহ’লে ছওয়াবের আশায় যত্নসহকারে নিজেও শিরক, বিদ‘আত, কুফরের সান্নিধ্যে ছিলাম এবং অন্যদেরও সে পথে আহবান করেছি?
চিন্তা করলাম বিষয়গুলো নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে জানতে হবে। নিজে নিজে পড়ে তো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। আলেমদের কাছ থেকে জানতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম জুম‘আর ছালাতগুলো বিভিন্ন মসজিদে আদায় করব আর যাচাই করব। সেখানে যারা ইমাম/খত্বীব আছেন তাদের কাছ থেকে জেনে নেব ইনশাআল্লাহ।
পরবর্তী জুম‘আতে গেলাম নটরডেম কলেজের অপর পার্শ্বে এক মসজিদে। জুম‘আর ছালাত আদায় শেষে খত্বীব ছাহেব সম্মিলিত মোনাজাত করলেন না। যে বিষয়ে প্রশ্ন করব ভেবে এখানে আসলাম সে বিষয়টাকেই দেখি বর্জন করা হয়েছে। আমরা সবাই সম্মিলিত মোনাজাত করি অথচ সহপাঠী বলছিলেন, এটা করতে হয় না। তা যাচাইয়ের জন্যই তো এখানে আগমন। ছালাত শেষে খত্বীব ছাহেবের সাথে দেখা করে বললাম, আমরা সারাজীবন ফরয ছালাতের পর সম্মিলিত মোনাজাত করে আসছি আর আজ আপনি তা করলেন না! এই বিষয়ে যদি বলতেন। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীরা কোনদিন ফরয ছালাতের পর সম্মিলিত মোনাজাত করেননি। এজন্যই আমরা তা করি না। যেটা রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম করেননি তা ছওয়াবের নিয়তে পালন করাই বিদ‘আত। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। আর ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।
পরবর্তী জুম‘আ আদায় করলাম তেজকুনিপাড়ার একটা মসজিদে। ছালাতের পর খত্বীব ছাহেবকে প্রশ্ন করলে উত্তরে বললেন, দেখুন আপনার উত্থাপিত বিষয়গুলো আসলেই হাদীছে নেই। যদিও কিছু আছে বলে আমরা পড়ি, জানি ও আমল করি। সত্যিকারার্থে সেগুলো যঈফ ও জাল হাদীছের মিশ্রণ। আমি সঊদী আরবে গিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত আমল গুলোর অধিকাংশই ভুল বলে জেনেছি। ওখানকার বিজ্ঞ আলেমগণ আমাদের পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের তা‘লীমও দিয়েছেন। কিন্তু লোকলজ্জা ও সমাজের চলমান গতির বিপরীতে সঠিক বিষয়গুলো আমরা মুছল্লীদের সম্মুখে উত্থাপন ও সংশোধনের আহবান যথাযথভাবে করতে পারছি না।
অতঃপর রাজাবাজার এক মসজিদে একদিন জুম‘আর ছালাত আদায় করলাম। ইমাম ছাহেব মীলাদ-ক্বিয়ামে অভ্যস্ত। তাকে সম্মিলিত মোনাজাত সর্ম্পকে বললাম, এই বিষয়টা কিছু আলেম বলছেন করতে হবে এবং কিছু আলেম বলছেন করতে হবে না, আপনার কি মত? তিনি বললেন, অবশ্যই করতে হবে। এই বিষয়ে হাদীছের দলীল চাইলে তিনি বললেন, কোন দলীল-প্রমাণ লাগবে না। পূর্ব থেকে এভাবে দেখে আসছি, করে আসছি, করতে হয় তাই করবেন।
পরবর্তী জুম‘আ তেজতুরী বাজারে এক মসজিদে গেলাম। ছালাতের পর ইমাম ছাহেবকে প্রশ্ন করতেই বললেন, ফরয ছালাতের পর মুছল্লীদের নিয়ে সম্মিলিত মোনাজাত জায়েয এই সম্পর্কে আমার কাছে দলীল আছে। আগামী জুম‘আয় আসবেন আমি দলীল দেব। পরের জুম‘আতে তিনি দো‘আ করা নিয়ে আলোচনা করলেন তাও পুরো শেষ না করে সামনের জুম‘আর জন্য রেখে দিলেন। উত্তর দিলেন না। পরবর্তী জুম‘আতে তিনি কোন দলীল না দিয়ে উদ্ভট তথ্য দিয়ে বুঝালেন। বললেন, এই যে অনেকে ফরয ছালাতের পর সম্মিলিত দো‘আ করেন না, তারা ঐ সময়টা কি করে? মসজিদের বাহিরে গিয়ে ধুমপান করে, অন্যের গীবত করে এসব অপকর্মের চেয়ে মোনাজাত করা ভালো নয় কি? হাসবো না কাঁদবো বুঝে আসছে না। তিন জুম‘আ ঘুরে এই দলীল পেলাম!
এরপর থেকে আরো বেশি করে পড়াশোনা শুরু করলাম। একদিন এক বন্ধু বলল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটে আহলেহাদীছদের একটা অনুষ্ঠান আছে, চলো যাই। সম্ভবত ২০০৯ সালে। কয়েক বন্ধু মিলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সম্মেলন। সেখান থেকে আহলেহাদীছ আন্দোলন ও ড. গালিব স্যার সম্পর্কে অবগত হ’লাম। আর ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’ বই ও অন্যান্য বইগুলো সংগ্রহ করলাম এবং মনোযোগ সহকারে পড়লাম। আলহামদুলিল্লাহ! ধীরে ধীরে আজন্ম ছওয়াবের নিয়তে পালন করে আসা শিরক, বিদ‘আত ও কুফরগুলো বর্জন করতে শুরু করলাম এবং ছহীহ হাদীছের দলীলভিত্তিক সুন্নাতগুলো পালন করতে আরম্ভ করলাম। এভাবে দিন-মাস-বছর অতিবাহিত হ’তে থাকে। অতিক্রান্ত হওয়া সময়গুলোতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকে পাশ করে ডিগ্রী অর্জন করি। এই সময়গুলোতে পিতার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে বারংবার আলাপ হ’ত। তিনি তার জ্ঞান মত বলতেন আর আমি কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল দ্বারা তা খন্ডন করতাম। এমন হ’ত যে, আলাপচারিতার এক পর্যায়ে পিতার আর উত্তর দেয়ার মতো দলীল থাকতো না। একদিন বলেছিলেন, তোমাকে নিয়ে কাকরাইল মসজিদে বসবো। সেখানে আরও বিজ্ঞ আলেম আছেন তাদের সাথে আলোচনা হবে। পরবর্তীতে আর বসা হয়নি। তবে পিতার মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস পূর্ব থেকে দেখতাম, তিনি ডা. যাকির নায়েকের লেকচার সমগ্রগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তেন।
আমার বড় ভাই হাফেয ও আলেম। তার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হ’ত। তিনি স্বাভাবিকভাবে এগুলো গ্রহণ করেননি। প্রকারান্তরে বাধা দিয়েছেন। একদিন তাবীযের ব্যবহার যে শিরক সে সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। আমি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল তাকে জানালাম। আরও বললাম, ভারতীয় উপমহাদেশে তাবীযের প্রচার ও প্রসারে আশরাফ আলী থানভী ছাহেবের বড় ভূমিকা আছে। তিনি বেহেশতী জেওরের ৩য় খন্ড পুরোটাই তাবীয ব্যবহার ও ফযীলতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন! এ কথা শোনার পর বড় ভাই বললেন, আমি অবশ্য মুফতী নই যে ফৎওয়া দেয়ার যোগ্যতা রাখি। তবে তুই যে কথা বলছিস এতে কোন মুফতি লাগবে না, আমিই ফৎওয়া দিচ্ছি যে, ‘তুই কাফের হয়ে গেছিস’।
মহান আল্লাহর রহমতে সত্যটা জানার পর নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি নিজের পরিবার ও সংশ্লিষ্টদেরসহ অন্যদের মাঝে সাধ্যমতো দাওয়াতী কাজ করছি। আমার স্ত্রী ও তার পিতা-মাতাসহ পরিবারের অনেকেই পরিবর্তন হয়েছেন। সমাজের অনেক ভাইও সংযুক্ত হয়েছেন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সুশীতল ছায়ায়। পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে যখন যে অবস্থানেই থাকুন, জেনে বুঝে সঠিক আমল করবেন এবং পরিবার ও অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিবেন। হয়তো কেউ গ্রহণ করবে, কেউ করবে না। এতে নিরাশ হওয়া বা থমকে যাওয়া যাবে না। নতুন উদ্যমে পথ চলতে হবে নিজের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্যই। যত মানুষের কাছে স্রেফ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারবো ততই ছওয়াবের অংশীদার হব ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের কল্যাণের পথে দৃঢ় রাখুন। ঐ কাফেলায় সংযুক্ত করুন, যাদের অবস্থান জান্নাতুল ফিরদাউস ইনশাআল্লাহ।
ডা. মুহাম্মাদ মাহবূবুর রহমান
সুপারিন্টেনডেন্ট এবং জেনারেল ফিজিশিয়ান
মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক হাসপাতাল
ফুলতলা, দোহার, ঢাকা।