ইসলাম এসেছে দাওয়াতের মাধ্যমে (আহমাদ, মিশকাত হা/৪২, ১৯৮)। কথাটি শুনেছিলাম নওদাপাড়ার তাবলীগী ইজতেমায়। কুরআন ও হাদীছ না জানার কারণে আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে অজ্ঞ ছিলাম। মানুষ সাধারণ শিক্ষায় যত শিক্ষিতই হোক না কেন, কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান না থাকলে দ্বীনী বিষয়ে সে অজ্ঞ থাকে, এটিই স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে আমি ছিলাম পীরভক্ত। আর পীরেরা তাদের মুরীদদেরকে কুরআন-হাদীছ শিক্ষার জন্য কোন প্রকার উপদেশ দেয় না। বরং বলে যে, কুরআন ও হাদীছ কঠিন বিষয়। এগুলো তোমাদের শিক্ষার প্রয়োজন নেই। যদি পার শুধু তিলাওয়াত শিখ, এতটুকুই যথেষ্ট। অথচ কুরআন ও হাদীছ আল্লাহ প্রেরিত অহী। আর অহীর শিক্ষা হচ্ছে সহজ (ক্বামার ১৭, ২২, ৩২, ৪০)। এই পীর বা ছূফীরা তাদের নিজেদের রচিত বইগুলো মুরীদদের পড়ার জন্য উপদেশ ও উৎসাহ দেয়। যেভাবে উপদেশ দিয়েছিল আমাকে। তারা আরও বলে যে, পীর-আউলিয়ারা যা উপদেশ দেয় তা মানতে হবে। এ বিষয়ে কোন প্রকার প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করা যাবে না। তাদের ভাষায় এটাই নাকি প্রকৃত ইসলাম। 

কোন এক পীরের মুরীদ তাদের পীরের ওয়ায মাহফিলে আমাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি একজন মুরীদ স্টেজ থেকে আল্লাহু আল্লাহু বলে যিকির পরিচালনা করছে। অন্যান্য মুরীদরাও একই তালে একইভাবে যিকির করার পরামর্শ দিলে আমিও তাদের সাথে তাল মিলাচ্ছিলাম। তারা আমাকে বলল যে, যিকির অবস্থায় উপরের দিকে তাকানো নিষেধ। মাথা নীচু করে মাটির দিকে চেয়ে যিকির করতে হবে। আমি তাই করছি এবং চুপিসারে স্টেজের দিকে মাঝে-মধ্যে তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি তাদের পীরছাহেব স্টেজে উঠছে এবং যিকির পরিচালনাকারী পীর ছাহেবকে ডান হাত দিয়ে কুর্নিশ করতে করতে তার আসন ছেড়ে দিয়ে নীচে বসল এবং পীর ছাহেব যিকির পরিচালনাকারীর আসনে বসলেন। যাত্রাগানে উযীর-নাযীর যেভাবে রাজা-বাদশাহকে কুর্নিশ করে, সেই কুর্নিশ মুরীদরা এখন তাদের পীর ছাহেবকে করে। মুরীদরা কেউ কেউ যিকির অবস্থায় স্টেজের খুঁটি বেয়ে উঠানামা করছে। কেউ কেউ আবার গাধার মত চিল্লাচ্ছে। এভাবে যিকির শেষে পীর ছাহেব বক্তব্য শুরু করলেন। নেক আমলের ফযীলতের বিভিন্ন বয়ান। যে বয়ানগুলো কুআন ও ছহীহ হাদীছের সাথে অধিকাংশ মিলে না। এদিকে মুরীদরা বক্তব্য শুনে পীর ছাহেবকে বাহবাহ্ দিচ্ছে। তিনি বক্তব্যে বলছেন, ভোট দিয়ে পীর ছাহেবকে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্ট পদে আনার পরে দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে হবে। ঐ মাহফিলে যে কয়জন বক্তা ওয়ায করেছেন তাদের পীরসহ সব বক্তা সুর ধরে কেঁদে কেঁদে ওয়ায করেছেন। তাদের কান্নার সুর হ’ল- বাবাগো... ও বাবাগো... এভাবে যাকিছু কেচ্ছা-কাহিনী সুর ধরে বলে।

আমিও এই পীর-মুরীদী ব্যবসাকে খুবই পসন্দ করতাম। আমার পীরের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে আমি তার উপরে প্রচন্ড রেগে যেতাম ও মনে মনে ভাবতাম যে, পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙ্গে দেই। এভাবে কয়েক বছর চলে গেল। এরই মধ্যে আমি কয়েকজন পীরকে বদলিয়ে ফেলেছি। কারণ পুরাতন মুরীদরা বলাবলি করে যে, এ পীরের থেকে অমুক পীর ভাল, তার থেকে অমুক পীর ভাল। এভাবে তাদের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষ এক পীর বাদ দিয়ে অন্য পীরের কাছে মুরীদ হচ্ছিল। আমিও তাই করেছিলাম।

আমার পেশা হচ্ছে চিকিৎসা। আমার চেম্বারে বিভিন্ন আক্বীদার রোগী আসে। একদিন কিছু সংখ্যক টুপি ও পাগড়িওয়ালা মানুষ আমার চেম্বারে এসে আমাকে মসজিদে ছালাত আদায়ের জন্য যেতে বলল। আমি বললাম, আমরা তো ছালাত আদায়ের জন্য মসজিদে যাই। কিন্তু যারা ছালাত আদায় করে না তাদেরকে ডাকা বিশেষ প্রয়োজন। জবাবে তারা বলল, মসজিদে দ্বীনের কথা আলোচনা হবে। এভাবে প্রায়ই এই পাগড়িওয়ালারা আমার চেম্বারে আসত এবং মসজিদে দ্বীনের আলোচনা হবে বলে ডাকত। তাছাড়া মসজিদে আছর, মাগরিব ও এশার ছালাতের পর বলত যে, ঈমান ও আমলের কথা হবে সবাই বসে পড়ি। তাই আমি তাদের সাথে কিছুদিন সময় দিলাম। তারা ‘ফাজায়েলে আমল’, ‘ফাজায়েলে জিকির’, ‘ফাজায়েলে দরুদ শরীফ’ ইত্যাদি বই থেকে আলোচনা করত। আর এই বইগুলোতে মুরুববীর গল্প, যুবকের গল্প, অলীক কাহিনী, ইসরাঈলী কাহিনী ইত্যাদি এবং জাল ও যঈফ হাদীছে ভরা। ছহীহ হাদীছ খুবই কম। সরাসরি কুরআন ও হাদীছ থেকে তারা কোন আলোচনাই করে না। আমারও সেই সময় কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান ছিল না বলে তাদের ভুলগুলো আমি ধরতে পারিনি। এভাবে তাদের সাথে ঢাকার কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী ইজতেমায় সময় দেই।

একদিন কয়েকজন খোঁচা দাড়িওয়ালা ও দাড়িকাটা লোক আমার চেম্বারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে আমার কয়েকজন রোগীও ছিল। কথার ফাঁকে একজন আমাকে বলল ডাঃ ছাহেব আপনি তো দুই নৌকায় পা দিয়েছেন। আমি বললাম, ভাই বুঝলাম না। কথাটি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিন। তখন সে বলল, আপনি অনেক আগে থেকেই পীর-মুরিদীর দলে আছেন, সেটা না ছাড়তেই আবার ইলিয়াসী তাবলীগে যোগ দিয়েছেন। অর্থাৎ দুই নৌকায় পা দিয়েছেন। আর দুই নৌকা দুই দিকে টান দিলে মাঝখানে নদীতে পড়ে পানিতে হাবু-ডুবু খেয়ে শেষে মারা পড়বেন। আমি প্রশ্ন করলাম, এই দুই নৌকার মাঝির মধ্যে ভাল কোন্টি? সে বলল, নৌকার মাঝি একটিও ভাল না। কারণ প্রথম নৌকার মাঝি প্রশিক্ষণ না নিতেই নৌকা চালাতে শুরু করেছে। ফলে এরকম কত মাঝিই যে নৌকার যাত্রীসহ ডুবে মরেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর দ্বিতীয় নৌকার মাঝি হচ্ছে অশিক্ষিত। সে নদীর খেয়াঘাট চিনে না। যেখানে সেখানে নৌকায় যাত্রী উঠায়, আর খেয়াঘাট ছাড়া যাত্রী নামিয়ে দেয়। ফলে মানুষ ভুল পথে গিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারে না।

একজন খোঁচা দাড়িওয়ালা বলল, প্রকৃত তাবলীগ হচ্ছে ইক্বামতে দ্বীন। সেটি হচ্ছে রাষ্ট্র কায়েম করা। নিয়ম হচ্ছে ভোটের মাধ্যমে ইসলামী দলকে বিজয়ী করা ও নেতা তৈরী করা। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতা হাতে নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। এবার আমি পীর-মুরিদী ও ইলিয়াসী তাবলীগ ছেড়ে দিয়ে তাদের দলে যোগ দিলাম। সেখানে সময় দিচ্ছি, নিয়মিত এয়ানত দিচ্ছি। তারা আমাকে তাদের দলের বিভিন্ন আলেমের লেখা কিছু বই পড়তে দিল। আর কুরআন তিলাওয়াত শিখার জন্য খুব তাকীদ দিল। তাই আমি আমার বিভিন্ন আলেম সহপাঠিদের কাছে কুরআন তিলাওয়াত শিখলাম। কিছুদিন পর ৩০ পারা কুরআন সম্পূর্ণরূপে তিলাওয়াত শেষ করেছি। এর পরে তারা আমাকে কুরআনুল কারীমের কিছু কিছু আয়াত চিহ্নিত করে দিল অর্থসহ পড়ার জন্য। আমি সেগুলোও পড়েছি। কিন্তু তারা আমাকে হাদীছ পড়তে উৎসাহ দেয় না এবং পড়তেও বলে না। বরং হাদীছের উপর আমল করতে নিষেধ করে। হাদীছ সম্পর্কে মতবিরোধ আছে মতানৈক্য আছে ইত্যাদি নানা কথা বলে। আমি তখনও জানতাম না যে, কুরআনের ব্যাখ্যা হচ্ছে হাদীছ।

কিছুদিন পর ঐ দলের একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা আমাকে মাওলানা আবুল আলা মউদূদী লিখিত কুরআনুল কারীমের একটি তাফসীর পড়তে দিল। বিশেষ করে তারা আমাকে কুরআনুল কারীমের যে আয়াতগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছিল, সেই আয়াতগুলোর তাফসীর বেশী বেশী করে পড়ার জন্য তাকীদ দিচ্ছিল। যার অধিকাংশের ব্যাখ্যায় ছিল প্রচলিত রাজনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। তাদের দলীয় বৈঠকে আমি অনেক সময় দিয়েছি। বিভিন্ন মিটিং মিছিলেও গিয়েলিাম। যারা পুরাতন কর্মী ছিল, তারা প্রচুর অর্থ ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। এভাবে এই দলে থেকে বহু সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন মাগরিবের ছালাত আদায় করার জন্য নতুন এক মসজিদে গেলাম। সেখানকার মুছল্লীগণ দেখছি পায়ের সাথে পা  মিলিয়ে কাতারে দাঁড়িয়েছে। আর অধিকাংশ মুছল্লী বুকে হাত বেঁধে ছালাত আদায় করছে। জামা‘আতে ছালাত আদায়ের সময় ইমাম ছাহেব যখন সূরা ফাতিহা শেষ করলেন, তখন মুছল্লীগণ এক সাথে স্বশব্দে আমীন বলছেন। ঐ সময় মনে হচ্ছিল মসজিদে গুম গুম শব্দ হচ্ছে। রুকূতে যাওয়ার আগে ও পরে মুছল্লীগণ উভয় হাত কাঁধ বরাবর উত্তোলন করছে। ইতিপূর্বে আমি একটি বই পড়তে গিয়ে দেখেছি শাফেঈ মাযহাবের লোকেরা এভাবে ছালাত আদায় করে। ভাবলাম এরাই মনে হয় শাফেঈ মাযহাবের লোক হবে। তাই ছালাত শেষে ইমামকে না পেয়ে মুয়াযযিনকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি শাফেঈ মাযহাবের লোক? তিনি বললেন, আমরা আহলেহাদীছ। তখন আমার পিতার কথা মনে পড়ল। আমার পিতা বিদ‘আতী মসজিদের ইমাম ও খত্বীব ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছ নামে একটি সঠিক দল আছে। পরের দিন ঐ মসজিদের ইমাম ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং আহলেহাদীছ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ফারসী ভাষায় ‘আহলেহাদীছ’ আর আরবী ভাষায় ‘আহলুল হাদীছ’ অর্থ হাদীছের অনুসারী। পারিভাষিক অর্থে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারীকে আহলেহাদীছ বলে। আর ‘আহলেহাদীছদে’র আরেকটি নাম হচ্ছে ‘মুহাম্মাদী’।

ঐদিন থেকে আমি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী ছালাত আদায় শুরু করি (২০০৫ইং)। এ বিষয়ে আমাকে যাবতীয় সহযোগিতা করেছিলেন লালমণিরহাট যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা শহীদুর রহমান। তিনি সর্বপ্রথমে ‘আত-তাহরীক’ পত্রিকার মাধ্যমে আমাকে সঠিক দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন। এরপরে আমি মুহতামার আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ছাহেবের লিখিত ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) সহ অন্যান্য বই পড়ে সে মোতাবেক আমল করার চেষ্টা করি। ফলে সমাজের বিদ‘আতী আলেমরা আমার উপর চড়াও হয়। তারা আমাকে বলে, আপনি হানাফী মাযহাব ত্যাগ করে মুহাম্মাদীদের মত ছালাত আদায় করছেন। আপনার ছালাত কবুল হবে না। আমি বললাম, ছালাত কবুল করার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি আমার ছালাত কবুল করবেন কি-না এ বিষয়ে তো আপনারা জানেন না। আর আপনি হানাফী বলছেন কেন? হানাফী নামে তো কোন নবী নেই। আর কবরে যে তিনটি প্রশ্ন করা হবে তার একটি হচ্ছে তোমার নবী বা রাসূলের নাম কি? সেদিন কি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নাম গোপন রেখে হানাফী বলবেন? তাহ’লে কবরে তার অবস্থা কি হবে? তারা আমার এই কথাগুলো শুনে বলল, আপনি তো আলেম না। আপনি কোন মাদ্রাসায়ও লেখাপড়া করেননি। অতএব আপনার কথা মানি না।

আমি আমার চেম্বারে যখন একাকী বসে ডাক্তারী বই ও কুরআন-হাদীছ পড়ি, তখন তারা আমার চেম্বারে সম্মুখ দিয়ে হেঁটে যায় এবং আঙুল উঠিয়ে বলে আপনার খবর হবে। আমি ধৈর্য ধরে নীরবে শুনে যাই। হকের পক্ষে কিছু কথা বললেই বিদ‘আতী আলেমরা এলাকার দু’একজন পাতি নেতা ও দলবল সাথে নিয়ে আসে আমাকে মারার ও অপমান করার জন্য। রোগীদেরকে নিষেধ করে আমার কাছে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু যে সমস্ত রোগীকে আমার চিকিৎসায় আল্লাহ সুস্থ করেছেন, তারা বিদ‘আতী আলেমদের বাধা উপেক্ষা করে আমার কাছেই চিকিৎসা নেয়।

গাযীপুর যেলার সফিপুরে আমার বড় ভায়রা একটি কোম্পানীতে চাকুরী করত। আল্লাহর রহমতে ও ভায়রার সহযোগিতায় অবশেষে ২০১০ সালের অক্টোবরে গাযীপুরের সফিপুরে হিজরত করি। সেখানে গিয়েও ডাক্তারী চেম্বার দেই। সেখানকার স্থানীয় লোকেরা প্রকৃত ইসলাম বুঝে না। তাদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষ খুব কম। তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক পীর ও কবর পুজারী। বহিরাগত লোকদের মধ্যেও অধিকাংশ পীর ও কবর পুজারী এবং তাবলীগ জামাতের অনুসারী।

বহিরাগতরা স্থানীয় লোকদের সাথে মিলে মিশে মসজিদ ও মাদ্রাসা করেছে। আমি সেখানে আহলেহাদীছ মানুষ খুঁজে পাইনি। মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করি আর লক্ষ্য করি কে বুকে হাত বাঁধে ও রাফ‘উল ইয়াদায়ন করে। এভাবে খুঁজতে গিয়ে একদিন এক যুবককে বুকে হাত বেঁধে ও রাফ‘উল ইয়াদায়ন করে ছালাত আদায় করতে দেখলাম। ছালাত শেষে তার সাথে সালাম মুছাফাহা করলাম। তার নাম সোহেল জানলাম, মালেক স্পিনিং মিলের প্রডাকসন অফিসার। বাড়ী ঝিনাইদহ যেলায়। আরো জানলাম, সে হানাফী মাযহাবের লোক। পীস টিভির বিভিন্ন আলেম ও ডাঃ যাকির নায়েকের বক্তব্য শুনে ছালাত শুদ্ধ করেছে। কয়েকদিন পরে আমি তাকে একটি ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ও আত-তাহরীক পত্রিকা দিলাম। বইটি পড়ে তারা স্বামী-স্ত্রী ছালাতের ত্রুটি সংশোধন করে নিয়েছে। সোহেলের মাধ্যমে বগুড়ার আলাউদ্দীন এবং তার মাধ্যমে দিনাজপুরের আরীফের সাথে পরিচয় হয়। এই আলাউদ্দীন ও আরীফ আমাকে আহলেহাদীছদের তাবলীগী বৈঠকে নিয়ে যায়। তাদের সাথে আমি কয়েকটি তাবলীগী বৈঠকে অংশগ্রহণ করলাম। আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের দলীল ভিত্তিক বক্তব্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। এরপর থেকে নিয়মিত যেলার মাসিক ইজতেমা ও বার্ষিক কেন্দ্রীয় তাবলীগী ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে লাগলাম।

আস্তে আস্তে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে গাযীপুর যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি হাতেম বিন পারভেয আমাকে ‘যুবসংঘে’র সদস্য বানিয়ে সংগঠনের আওতাভুক্ত করলেন। আমি তখন সংগঠন সম্পর্কে ভাল জানি না। তাই সংগঠন সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করলাম, সংগঠন করলে আমাদের লাভ কি হবে? এর কার্যক্রম কি? ইত্যাদি। ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র উভয় সভাপতি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে বুঝিয়ে দিলেন।

এরপর থেকে সংগঠনের বিভিন্ন কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করি। বই-পত্র অধ্যয়ন করি, পরীক্ষা দেই, মাসিক এয়ানত দেই এবং যেলা ও কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে যোগদান করি। এভাবে সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াতী কাজেও সময় ব্যয় করি। আমার দাওয়াতে অনেকেই আক্বীদা পরিবর্তন করে আহলেহাদীছ হয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।

গাযীপুর যেলার সফিপুরের রাখালিয়া চালায় আমার ডাক্তারী চেম্বার। এখান থেকে কিছুটা দূরে কোনাইচ্ছা পাড়ার একটি মসজিদে আমরা ছালাত আদায় করতাম এবং সাপ্তাহিক তা‘লীমী বৈঠক করতাম। আমাদের আমল-আক্বীদা তাদের বিপরীত হওয়ায় মুছল্লীরা আমাদেরকে ঐ মসজিদে তা‘লীমী বৈঠক করতে নিষেধ করে দেয়। এরপর আমার চেম্বারে বৈঠক শুরু করি। কিছু দিন যেতে না যেতে এখানেও বাধার সৃষ্টি হ’ল। যে লোকের ঘর ভাড়া নিয়ে চেম্বার করেছি, তিনি মাযহাবী কিছু আলেমদের প্ররোচনায় একদিন আমাকে বলছেন, বাবা তোমাকে ঘর ভাড়া দিয়েছি রোগীর চিকিৎসা করার জন্য। এখানে দাওয়াতী কাজের জন্য ঘর ভাড়া দেইনি। সুতরাং তুমি এখানে রোগী দেখা ছাড়া অন্য কোন কাজ করতে পারবে না।

এরপর তা‘লীমী বৈঠক করার জন্য ঘর ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু কেউ এ কাজে ঘর ভাড়া দিতে রাযী হয় না। কেউ আবার ৫০/৬০ হাযার টাকা জামানত দাবী করে। ফলে অনেক দিন তা‘লীমী বৈঠক বন্ধ থাকে। ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।

একদিন রোগী দেখার সময় রোগীলিপি লিখতে গিয়ে নীলফামারী যেলার ডিমলা থানাধীন ছোটখতা গ্রামের রাজু মিয়ার সাথে পরিচয় হয়। বর্তমানে সে রাখালিয়া চালায় বাড়ী করে আছে। জন্মগতভাবে আহলেহাদীছ হ’লেও এখানে এসে স্থানীয় লোকের আক্বীদা-আমলের সাথে মিশে হানাফী হয়ে গেছে। আমি তাকে বুঝিয়ে পুনরায় ছহীহ আক্বীদায় ফিরিয়ে আনলাম। আমরা তা‘লীমী বৈঠকের জন্য কোন ঘর ভাড়া পাচ্ছি না শুনে তার বাড়ীর একটি রুম আমাদেরকে ভাড়া দেয়। সেখানে আমরা পুনরায় তা‘লীমী বৈঠক শুরু করি। সেখানে একটা পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করি।

ঐ বাড়ীতে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মাসিক ইজতেমা করতাম কোনাইচ্ছা পাড়ার আব্দুল বাছীর চাচার বাড়ীর আঙ্গিনায়। রামাযানে ইফতার মাহফিলও সেখানে করতাম। এই গ্রামের আরীফুল ইসলাম নামে এক যুবক আক্বীদা পরিবর্তন করে আহলেহাদীছ হয়। পরবর্তীতে তার বাড়ীর পার্শ্বের ছোট্ট খোলা মাঠে সংগঠনের উদ্যোগে বছরে একবার ঐ শাখার মাসিক ইজতেমা করতাম। আর পাঠাগারে সাপ্তাহিক বৈঠক করা হ’ত। এভাবে কার্যক্রম চলছিল।

২০১৪ সালের ১৪ই জানুয়ারী বাদ আছর স্থানীয় আরীফুল ইসলামের বাড়ীর পার্শ্বের ফাঁকা জায়গায় মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আলোচক ছিলেন যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি জনাব হাবীবুর রহমান, যেলা ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি হাতেম বিন পারভেয, গাযীপুরের মাওলানা আছমত আলী এবং ঢাকা যেলা ‘যুবসংঘ’-এর তৎকালীন সভাপতি মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম (কুমিল্লা)।

বাদ আছর মাহফিল শুরু হয়। যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি বক্তব্য দিয়ে চলে যান। মাওলানা আছমত আলীর বক্তব্য চলছে এবং মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম রাতের খানা খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আছমত আলী বক্তব্য দিচ্ছিলেন শিরক সম্পর্কে। ফলে কিছু কথা পীর-মুরীদের বিরুদ্ধেও চলে যায়। এতে স্থানীয় এক পীর ওছমান গণী তার মুরীদ, কতিপয় বিদ‘আতী আলেম ও নেতাদের নিয়ে এসে মাহফিলের মঞ্চ দখল করে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বক্তব্য দিতে শুরু করে। আমাকে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। অন্যথা আমার প্রাণ নাশেরও হুমকি দেয়। পরের দিন দোকান মালিকের ছেলে ফোনে চেম্বার বন্ধ রাখার কথা বলে। এলাকার দ্বীনী ভাইদের সাথে পরামর্শ করলাম। তারাও একই পরামর্শ দিল। আমার বাসার মালিকের ছেলে তাবলীগ জামাতের সাথে জড়িত। তাই অনেকে আমাকে বাসা থেকে দূরে থাকতে বললেন। সেজন্য বাসায় না গিয়ে সফিপুরে আব্দুল্লাহিল কাফী ভাইয়ের বাসায় এক দিন থাকলাম। তিনিও আমাকে চেম্বার কয়েক দিন বন্ধ রাখার পরামর্শ দিলেন। ফলে আমি আমার জন্মস্থান লালমণিরহাটে গ্রামের বাড়ী চলে গেলাম। লালমণিরহাট যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা শহীদুর রহমানকে ঘটনা জানালাম। তিনি ধৈর্য ধারণের এবং আল্লাহর সাহায্য কামনার পরামর্শ দিলেন।

কয়েকদিন পরে মুহাম্মাদী ইসলামী পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ‘যুবসংঘ’-এর সদস্য রাজু মিয়ার সাথে ফোনালাপে জানতে পারলাম যে, বিদ‘আতী আলেমরা আমাকে মারার জন্য কিছু যুবক ঠিক করেছিল। এদিকে রাজু মিয়া আব্দুল্লাহ আল-মামূন ও অন্য একজনকে সাথে নিয়ে কালিয়াকৈর থানার জনৈক নেতার কাছে গিয়ে মাহফিলে আক্রমণের ঘটনাসহ সবকিছু খুলে বলে এবং এর প্রতিকারের জন্য সহযোগিতা চায়। তিনি আহলেহাদীছ পরিবারের সন্তান হওয়ায় এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং নিশ্চিন্তে এলাকায় বসবাস করার জন্য সাহস যোগান।

অতঃপর নিজ এলাকায় ৪ দিন কাটানোর পরে সফিপুরে ফিরে আসি। সপ্তাহখানেক পরে ঐ নেতার সাথে আমরা আবার দেখা করলাম। তিনি আমাদের যথেষ্ট সমাদর ও আপ্যায়ন করলেন। তিনি মাহফিল পন্ডকারীদের বিচারের তারখি ঠিক করে দিলেন। কিন্তু বিরোধীরা ৩ বার বিভিন্ন অযুহাতে তারিখ পিছিয়ে নেয়। ৪র্থ বারের মত বিচারের তারিখ ঠিক হ’ল। স্থান ঠিক হ’ল পীর ওছমান গণী যে মসজিদে খুৎবা দেন সেখানে। উল্লেখ্য যে, ঐ লোক পূর্বে থেকে ৬০/৭০ জন লোককে মসজিদে এনে রাখে। আর আমাদের পক্ষ থেকে কেবল অভিযোগকারীরা ছিল। আমরা যার কাছে অভিযোগ করেছিলাম, তিনি বিচারের দায়িত্ব দেন ঐ মসজিদের সভাপতিকে।

যথাসময়ে বিচারকার্য শুরু হ’ল। সভাপতি খত্বীবকে জিজ্ঞেস করলেন, আহলেহাদীছরা মুসলমান কি-না? সে উত্তরে বলল, হ্যাঁ, তারা মুসলমান। সভাপতি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কোন মুসলমান যদি কুরআন-হাদীছের আলোচনার মাহফিল

করে তাহ’লে অন্য মুসলমানের সেই মাহফিলে সহযোগিতা করা উচিত, নাকি সেখানে বিশৃঙ্খলা করা উচিত? সে বলল, সহযোগিতা করা উচিত। সভাপতি বললেন, তাহ’লে আহলেহাদীছদের মাহফিল আপনার নেতৃত্বে পন্ড করা হ’ল কেন? সে বলল, তারা জঙ্গী। সভাপতি বললেন, জঙ্গী সনাক্ত করার দায়িত্ব সরকার প্রশাসনকে দিয়েছে। তাছাড়া সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী আছে। আপনিতো এ দুই দলের কেউ না। সুতরাং আপনি যে কাউকে জঙ্গী বলবেন, আর প্রশাসন ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পাগল নয় যে, তারা প্রমাণ ছাড়া আপনার কথা মেনে নেবে। আপনারা এমন কাজ করবেন না, যাতে প্রশাসন আপনাদের ধরে নিয়ে যায়, আর আমাদেরকে আপনাদের সুফারিশের জন্য যেতে হয়। আপনাকে মসজিদের খত্বীবের দায়িত্ব দিয়েছি, কারো মাহফিল পন্ড করার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়নি। গানের আসর, মদের আড্ডা বন্ধ করার জন্য তো কেউ এগিয়ে আসে না? ইসলামী মাহফিল বন্ধ করেন কোন আক্কেলে?

এদেশে অনেক পীর আছে, মুসলমানদের মধ্যেও অনেক দল আছে। এক পীরের সাথে অন্য পীরের মিল নেই; এক দলের সাথেও অন্য দলের মিল নেই। কিন্তু কেউ কারো সাথে ঝগড়া-ফাসাদ করে না। একে অপরের মাহফিল বন্ধ করতে যায় না। আপনিও তো মাহফিল করেন। আপনার মাহফিলতো কেউ পন্ড করে দেয় না? আপনি কেন আরেক দলের মাহফিল পন্ড করতে গেলেন? এবার যে ভুল করেছেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ আমরা আর শুনতে চাই না। এভাবে বিচার কার্য শেষ হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ। আল্লাহ আমাদেরকে সকল বাধা মোকাবেলা করে হকের উপর দৃঢ় থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!

ডা. মুহাম্মাদ ফযলুল হক

সফিপুর, গাযীপুর।






বিষয়সমূহ: দাওয়াত
জোরে ‘আমীন’ বললে মুছল্লীদের সমস্যা হয়! - আত-তাহরীক ডেস্ক
‘সকলের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে বল, এখন থেকে ইমাম আবু হানীফার আদর্শ অনুযায়ী জীবন-যাপন করব’ (!)
ভ্রান্ত আক্বীদার বেড়াজাল ছিন্ন হ’ল যেভাবে - -আরিফ হাসান আল-গালিব, শার্শা, যশোর।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি সমাজে তাওহীদের চারাগাছ রোপিত হ’ল যেভাবে - মুহাম্মাদ বেলাল বিন ক্বাসেম
আক্বীদার কারণে শত্রুতে পরিণত হওয়া আপন ভাইও শেষ পর্যন্ত হকের দিশা পেলেন - আত-তাহরীক ডেস্ক
জঘন্য ষড়যন্ত্র এক মুসলিমের বিরুদ্ধে - * মুহাম্মাদ সোহেল রানাবাঘা, রাজশাহী।
স্রেফ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হোক আমাদের পথচলা
আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে বাড়ীছাড়া! - -মুহাম্মাদ ইবরাহীম, দাগনভূঞা, ফেনী।
ও চটি বই পড়ে পাগল হয়ে গেছে...
হক-এর পথে যত বাধা
হকের পথে যত বাধা - .
হকের পথে যত বাধা - মুহাম্মাদ ইসমাঈল হোসাইন - মাইজদী, নোয়াখালী
আরও
আরও
.