আমি
যাকারিয়া খন্দকার। চুয়াডাঙ্গা যেলার দামুড়হুদা উপযেলার ছোট্ট গ্রাম
চারুলিয়ায় আমার বাসস্থান। প্রাথমিক জীবনে কিছুকাল মাদরাসায় পড়েছিলাম। এরপর
স্কুলজীবনে কিছুকাল ইসলামী ছাত্র সংগঠনের কর্মী ছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল
আল্লাহকে রাযী-খুশি করা। অনেক মিছিল মিটিং-এ গিয়েছি। হাড় কাঁপানো শীতের
রাতে ভোট চাইতে গিয়েছি। পারিবারিক সমর্থন পেয়েছি। কিন্তু কখনও নফসকে খুশি
করতে পারতাম না। ভাবতাম ভোট আর রাজনীতিই কি তাহ’লে ইসলাম। যে মানুষগুলো
আদর্শের নামে অন্য মানুষকে হত্যা করতে পারে, সেই মানুষগুলো সঠিক দ্বীন পালন
করছে কি-না এ ব্যাপারে চরম সন্দেহের কারণে সেই ছাত্রসংগঠন ছেড়ে দিলাম।
ভাবলাম ছালাত আদায় করব, ইসলাম মানব, একা একাই ইনশাআল্লাহ জান্নাত পাব।
মাধ্যমিক স্কুলে কোন মসজিদ নেই। আমার পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক জনাব রূহুল
আমীন স্যার গাছতলায় ছালাত পড়তেন। একদিন আমি তাঁর পাশে ছালাতে দাঁড়ালাম।
দেখলাম তিনি একটু ভিন্ন নিয়মে ছালাত আদায় করলেন। আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম
আপনি এভাবে ছালাত আদায় করলেন কেন? স্যার আমাকে কিছু হাদীছ শোনালেন। অতঃপর
বললেন, তোমার বাড়ি কোন হাদীছের বই আছে? আমি বললাম, বুখারী শরীফ আছে। তিনি
ওটা স্কুলে আনতে বললেন। আমি স্কুলে বইটা আনলে তিনি কিছু হাদীছ নোট করে দেন।
আমি দেখে হতবাক হই। তাহ’লে এতবড় আলেমরা ভুল করছে? বিশ্বাস করতে পারলাম না
কিছুই। বাড়িতে বললে নিশ্চিত মার খেতে হবে। কারণ আমার দাদাও একজন বড় ইমাম।
কিছু দিন পরের কথা, রূহুল স্যার বললেন, কুনিয়া চাঁদপুর আমাদের একটা
প্রোগ্রাম আছে, এসো। আমি ও আমার বন্ধু দীপু কুনিয়া চাঁদপুর গেলাম। এক
মসজিদে প্রোগ্রামটা হচ্ছিল। এক ভাইয়া বক্তব্য রাখছিলেন। মনে হচ্ছিল তার
কথায় জাদু আছে। প্রত্যেক কথায়ই যেন হাদীছ। কিছু প্রশ্ন করলাম ভাইয়াকে
ব্যক্তিগতভাবে। সন্তোষজনক উত্তর পেলাম। ভাবলাম আমাকে জানতে হবে অনেক। হাদীছ
পড়া শুরু করলাম। এরপর থেকে জীবনে আসলো নতুন অধ্যায়। বিকেলে খেলতাম, খেলা
বাদ দিয়ে খেলার মাঠে বুখারী শরীফ পড়ি। হাদীছ মতো চলার চেষ্টা করি। ছহীহভাবে
মসজিদে ছালাত পড়তে গেলে লোকেরা বলল যে, বুখারীর এসব হাদীছ এখন আর চলবে না।
তারপর শুনালো বগলে পুতুল রাখার প্রসিদ্ধ কেচ্ছা। কথাগুলো স্যারকে বললে
স্যার প্রকৃত ঘটনা বুঝিয়ে দিতেন। কিছুদিন পর দেখলাম আমি যেন আর আমি নেই। যে
লোকগুলো আমাকে গ্রামে এক বাক্যে ভাল বলে চিনত, তারা আমাকে ঘৃণা করে। খেলার
মাঠে ক্যাপ্টেন ছিলাম, সেই দলের কেউ তাদের পাশে বসতে দেয় না। যে দাদাকে এত
ভালবাসি, সেই দাদা আমার ছালাত দেখে টিটকারি দেয়। বাড়ি থেকে বের করে দিতে
চায়। আমার পিতা প্রতিদিন রাতে হাত ঝেড়ে ব্যাঙ্গ করে। ভাল করে একটা কথা
পর্যন্ত কেউ বলে না। শুধু পাশে পেলাম মাকে। ঘরে ছালাত আদায় করতাম। মা ঘরের
দরজা দিয়ে দিত, কেউ দেখে ব্যাঙ্গ করবে বলে। আমি মায়ের কাছে কাঁদতাম,
জান্নাতে যাব বলে কি নিজের বাবাকেও বিসর্জন দিতে হবে? এভাবে আর কত সহ্য করা
যায়? মাও কাঁদত। আর বলত, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে দিন কাটছিল। আমি
এসএসসি পরীক্ষার কোচিং করার জন্য একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হ’লাম। পরিচিত
হ’লাম সোহাগ নামের একজন বন্ধুর সাথে। সেও ছিল ছহীহ আক্বীদার অনুসারী। তার
বাবা আমাদের ইংলিশ টিচার। তার জীবনী শুনে সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলাম। যখন
জানলাম তাকেও কাঁদতে হয়, তার পিতাও তাকে কষ্ট দেয়, তখন ভাবলাম আমি একা নই,
অনেকেই হয়ত আমার মত আছে। অনুপ্রেরণা পেলাম। দাওয়াতী কাজ বাড়িয়ে দিলাম। আমার
দাওয়াত গ্রহণ করল হাসীব নামের এক বন্ধু এবং নাঈম নামের একজন বড় ভাই। আর
আমার একমাত্র সহযোগী ছিল দীপু। আমরা ওয়াক্তের ছালাত বিভিন্ন স্থানে পড়তাম।
আছর আর মাগরিব পড়তাম খেলার মাঠে। আমাদের ব্যবহার ও আচরণে মুগ্ধ হয়ে ছোট
ভাইয়েরা ও কিছু বন্ধু পাশে এসে বসত। ছহীহ বুখারী হাতেই থাকত। হাদীছ দেখিয়ে
ওদেরকে ছহীহভাবে ছালাত আদায় করা শিখিয়ে দিতাম। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের
সমমনা সদস্য হ’ল প্রায় ৮/১০ জন। ফলে গ্রামে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হ’ল। আমাকে
মারবে সবাই সিদ্ধান্ত নিল অথবা গ্রাম থেকে বের করে দেবে। পরের দিন শুক্রবার আমরা জুম‘আর ছালাত আদায় করতে গিয়েছি। আমাদের আমীন শুনে আর রাফঊল ইয়াদাইন দেখে ছালাত শেষে ওরা সবাইকে বের করে দিল।
মসজিদ থেকে আমাকে হুমকি দিল আবার কেউ গালি দিল। ছোট ভাইয়েরা যারা গ্রামে
ভাল ছাত্র হিসাবে আমাকে সম্মান করত তারাও গালি দিতে বাদ দিল না। বুকভরা
কষ্ট নিয়ে বাড়িতে গেলাম। আববু যেতে না যেতেই বলল, ‘ইট দিয়ে মেরে লোকে মাথা
ফাটিয়ে দেবে, রাস্তায় পড়ে থাকবি, কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাবে না’। ছোট চাচা
বলল, ‘বেশি বুঝিস, না? বাড়ি থেকে বের করে দেব’। মনে আছে সেদিন দরজায়
দাঁড়িয়ে আল্লাহকে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, এদের হেদায়াত দাও, আল্লাহ এদের
হক্ব বুঝার জ্ঞান দাও। রাতে আববু আমাকে বললেন, তোর বুখারীতে দেখা হাদীছ আমি
দেখব। আববুকে হাদীছ দেখালাম, মনটা একটু নরম হ’ল। কিছুদিন পরে আহসানুল হক
ভাইয়াকে দাওয়াত দিলাম আর আববুকে কৌশলে বলেছিলাম, কোনটা ঠিক আজকে বুঝে
নিয়েন। ভাইয়া হাদীছগুলো সম্পর্কে বলছে এমন সময় আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা
এসে শুরু করল গালি-গালাজ। আববুরা ক্ষেপে গিয়ে তাকে ওখান থেকে বের করে দেন।
ঐদিনই আববু আর সেজ চাচা আল্লাহর রহমতে হক্ব বুঝে ফেলেন। ভাইয়া কিছু বই দিয়ে
গেলেন দাদুকে। আববুও সেগুলো দিলেন চাচাদের পড়তে। তারা হক্ব বুঝলেন কিন্তু
সমাজের ভয়ে হক্বের উপর আমল করলেন না। আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্য ডাঃ
জাকির নায়েকের খুব ভক্ত। আমি আমার বন্ধু সোহাগের কাছ থেকে ‘মুসলিম উম্মাহর
ঐক্য’ বিষয়ক লেকচারটি আনলাম ও সবাইকে শোনালাম।
এরপর সবাই আমল শুরু করল ছহীহভাবে। এরপর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল আমি পীর হয়েছি। আমার কাছে সবাই বায়‘আত নিচ্ছে। দাদা, আববু সবাই আমার কাছে বায়‘আত নিয়েছে। ফলে আববু, দাদা সবার মসজিদে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিল লোকজন। আমার চাচা মসজিদে দাঁড়িয়ে এক হাজীকে জিজ্ঞেস করলেন, সঊদীতে আমীন জোরে বলে নাকি আস্তে বলে? তিনি কসম করে বললেন, আস্তে বলে। লোকে তাই বিশ্বাস করল। এরপর ঐ হাজী ছাহেব যার সাথে আমার আববুর খুব বন্ধুত্ব ছিল সে আববুকে মারার হুমকি দেয়। তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আবার খুশিও হয়েছিলাম এই ভেবে যে, প্রত্যেকের পরীক্ষা নিবেন আল্লাহ। আমার দো‘আ কবুল হয়ে গেল। কিন্তু হারালাম অনেক কিছু। আমার প্রথম জীবনের বন্ধু দীপু, নাঈম ভাই, ছোটভাই আলামীন সমাজের চাপে টিকতে পারল না। এখন সামাজিক চাপ আমার পুরো পরিবারের উপর। আর আল্লাহর রহমতে এতে দ্বীন প্রচার বাড়ছে বৈ কমছে না।
এখন বাইরের নতুন কিছু ভাই যোগ দিয়েছেন আমাদের এই ছোট্ট জামা‘আতে। ইতিমধ্যে একটা লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছি। আল্লাহ চাইলে হক্বের প্রচার বাড়তে থাকবে। এখন আমাকে সেই হাজী ছাহেব দেখলে সহ্য করতে পারে না। পায়ের টাখনুর উপর কাপড় দেখে বলে, ‘জানোয়ার, কাপড় উচিয়ে ভাব নেয়’। যাই হোক অবশেষে যারা হক্বের পথে সংগ্রামে বাধার শিকার হয়ে হতাশ হচ্ছেন তাদেরকে বলি ধৈর্য ধরুন, শত্রুদের জন্য দো‘আ করুন। ওরাই আপনার ভবিষ্যতের বন্ধু হবে ইনশাআল্লাহ। আমার পরিবারের একজনমাত্র চাচা যিনি আমাকে ডাক্তারি পড়াতে চেয়েছিলেন, বর্তমানে সঊদী আরবে থাকেন, আমাদের পরিবারের এই অবস্থা দেখে আমার সাথে সম্পর্ক প্রায় ত্যাগই করেছেন। পরিবারের কারো সাথে তিনি আর কথা বলেন না। তার জন্য আমি বিশেষভাবে দো‘আ চাইছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জান্নাতের পথে অটুট থাকার এবং জান্নাতে যাওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!
যাকারিয়া খন্দকার
চারুলিয়া, দামুড়হুদা, চুয়াডাঙ্গা।