খেয়ালখুশির বিরুদ্ধাচরণের উপকারিতা :
ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেছেন, أَفْضَلُ الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى ‘কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদই সর্বোত্তম জিহাদ’।[1]
সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, أَشْجَعُ النَّاسِ أَشَدُّهُمْ مِنَ الْهَوَى
امْتِنَاعًا، وَمِنَ الْمُحَقَّرَاتِ تُنْتَجُ الْمُوْبِقَاتُ
‘কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে যে যত বেশী বিরত থাকতে সক্ষম, সে তত বড় বীর
পুরুষ। আর তুচ্ছ সব জিনিস থেকেই বড় বড় ধ্বংসাত্মক জিনিস জন্ম নেয়’।[2]
অন্তরের
রোগ-ব্যাধির প্রকৃত চিকিৎসা কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতার মধ্যে নিহিত। সাহল বিন
আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,هَوَاكَ دَاؤُكَ، فَإِنْ خَالَفْتَهُ فَدَوَاؤُكَ
‘তোমার কুপ্রবৃত্তি তোমার রোগ। তুমি যদি তার বিরোধিতা কর তাহ’লে সেটাই
তোমার ঔষধ’।[3]
১. জান্নাত লাভ :
কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতা করে ইসলামী নিয়ম-নীতি অনুযায়ী জীবন-যাপনকারী মানুষ জান্নাত লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَأَمَّا مَن طَغَى، وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، فَإِنَّ الْجَحِيْمَ هِيَ الْمَأْوَى، وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘অতঃপর যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে এবং দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে অবশ্যই জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল। আর যে ব্যক্তি (কিয়ামতের দিন) তার মালিকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় করেছে এবং নিজের মনকে কামনা-বাসনা থেকে বিরত রেখেছে, অবশ্যই জান্নাত হবে তার ঠিকানা’ (নাযি‘আত ৭৯/৩৭-৪১)।
সুতরাং যে ব্যক্তি তার মনের সাথে যুদ্ধ করে এবং মনের চাওয়া-পাওয়ার বিরোধিতা করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করে, সে কিয়ামতের দিন উত্তম প্রতিফল পাবে। জান্নাতে প্রবেশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন হবে তার প্রতিদান। এটা মূলত মনের কামনা-বাসনার বিরোধিতায় ধৈর্য ধারণের প্রতিদান। মহান আল্লাহ বলেন, وَجَزَاهُمْ بِمَا صَبَرُوْا جَنَّةً وَّحَرِيْرًا ‘তারা যে কঠোর ধৈর্য (সহিষ্ণুতা) প্রদর্শন করেছে তার পুরস্কার হিসাবে তিনি (আললাহ) তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোশাক দান করবেন’ (দাহর ৭৬/১২)।
আবু সুলাইমান আদ-দারানী বলেছেন, ‘আল্লাহ তাদের ধৈর্যের প্রতিদান স্বরূপ জান্নাত ও রেশমী পোষাক দান করবেন’ কথার অর্থ ‘তারা যে কামনা-বাসনা থেকে ধৈর্যধারণ করেছিল তার প্রতিদান’।[4] জনৈক কবি বলেছেন,
وَآفَةُ الْعَقْلِ الْهَوَى فَمَنْ عَلَا + عَلَى هَوَاهُ عَقْلُهُ فَقَدْ نَجَا
‘কুপ্রবৃত্তি বিবেকের জন্য এক মস্তবড় আপদ। সুতরাং যার বিবেক তার কুপ্রবৃত্তির উপর জয়যুক্ত হ’তে পেরেছে সে মুক্তি পেয়েছে’।[5]
২. হাশর দিবসের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি :
হাশর ময়দানে পার্থিব জীবনের প্রতিফল লাভের জন্য সকল প্রাণী একত্রিত হবে। সেখানে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় স্থান না পেলে কঠিন দুর্দশায় পড়তে হবে। সেদিন সাত শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর রহমতের ছায়া লাভ করবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)
কর্তৃক নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ
اللهُ تَعَالَى فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ
عَدْلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِى عِبَادَةِ اللهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ
فِى الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِى اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ
وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ
وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّى أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ
فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ،
وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ- ‘যেদিন আল্লাহর বিশেষ
ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তা‘আলা সাত শ্রেণীর
ব্যক্তিকে তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক (২) এমন যুবক যে
আল্লাহর ইবাদতে জীবন অতিবাহিত করেছে (৩) এমন ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের
সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে (৪) এমন দু’জন ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির
উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালবেসে একত্রিত হয় এবং পৃথক হয় (৫) এমন ব্যক্তি যাকে
কোন সুন্দরী ও অভিজাত নারী (ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য) আহবান করে, তখন সে
বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি (৬) এমন ব্যক্তি যে গোপনে ছাদাক্বা করে কিন্তু
তার বাম হাত জানতে পারে না যে তার ডান হাত কি ব্যয় করে (৭) এমন ব্যক্তি যে
নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রুধারা প্রবাহিত করে’।[6]
আল্লামা
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘পাঠক, আপনি যদি ভেবে দেখেন, যে ৭ জনকে
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আরশের ছায়াতলে সেদিন আশ্রয় দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া
ব্যতীত কারো ছায়া থাকবে না তাহ’লে বুঝতে পারবেন যে, সে সাতজনই কিন্তু
কুপ্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশির বিরুদ্ধাচরণ হেতুই তা লাভ করেছে। কারণ একজন
দোর্দন্ত প্রতাপশালী শাসক তার কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ ব্যতীত ইনছাফ ও
সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। যে যুবক তার যৌবনের চাহিদার উপর আল্লাহর
ইবাদতকে প্রাধান্য দেয় সে যদি তার যৌবনের কামনা-বাসনার বিপরীতে না দাঁড়াত
তাহ’লে তার পক্ষে তা করা সম্ভব হ’ত না। যে ব্যক্তির মন মসজিদের সাথে যুক্ত
থাকে, দুনিয়ার নানা স্বাদ-আহ্লাদ ও উপভোগের জায়গায় যাওয়া বাদ না দিলে তার
পক্ষে কোনক্রমেই মসজিদে যাওয়া সম্ভব হ’ত না। বাম হাতকে না জানিয়ে ডান হাতে
দানকারী যদি তার মনস্কামনার উপর জোর খাটাতে না পারে তাহ’লে তার পক্ষেও এমন
দান করা কখনই সম্ভব হয় না। যাকে কোন সুন্দরী বংশীয় মহিলা কুকর্মের প্রতি
আহবান জানায় এবং আল্লাহর ভয়ে সে তা না করে, সে তো তার ইন্দ্রিয় সম্ভোগের
সুযোগ প্রত্যাখ্যানের ফলেই এমনটা করতে সক্ষম হয়। আর যে নির্জনে আল্লাহকে
স্মরণ করে এবং তাঁর ভয়ে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে মূলত নিজ কুপ্রবৃত্তির
বিরোধিতাই তাকে ঐ স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং কিয়ামতের দিনে হাশরের ময়দানের
গরম তাপ, ঘাম ও দুর্বিসহ অবস্থায় তাদের উপর প্রভাব খাটানোর কোনই সুযোগ
থাকবে না। অথচ কুপ্রবৃত্তির পূজারীরা সেদিন উত্তাপ আর ঘামে জর্জরিত হবে। আর
হাশরের ময়দানে এহেন অবস্থার পর তারা খেয়ালখুশির কারাগারে প্রবেশের
অপেক্ষায় থাকবে’।[7]
৩. উচ্চমর্যাদা লাভ :
হযরত
মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেছেন, المروءة ترك الشهوات وعصيان الهوى، فاتباع الهوى
يزمن المروءة ومخالفته تنعشها ‘পৌরুষ হ’ল কামনা-বাসনা বর্জন এবং
কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতার নাম। কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ পৌরুষকে ব্যাধিগ্রস্ত করে
দেয়, আর তার বিরোধিতায় পৌরুষ সুস্থ-সবল থাকে’।[8] মুহাল্লাব বিন আবু
ছাফরাকে বলা হ’ল, ‘কীভাবে আপনি এত উচ্চমর্যাদা লাভ করলেন’? উত্তরে তিনি
বলেন, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা অবলম্বন এবং প্রবৃত্তির বিরোধিতার মাধ্যমে’।[9]
জনৈক
ব্যক্তি বলেছেন, ‘বিদ্বানদের মধ্যে সেই বেশী মহৎ, যে তার দ্বীন সাথে নিয়ে
দুনিয়ার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচে এবং কামনা-বাসনার উপর তার কর্তৃত্ব মযবূত
করে’।[10] আবু আলী আদ-দাক্কাক বলেছেন, من ملك شهوته في حال شبيبته أعزه
الله تعالى في حال كهولته ‘যৌবনে যে তার কামনা-বাসনার উপর কর্তৃত্ব বজায়
রাখতে পেরেছে, বার্ধক্যে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সম্মান দান করবেন’।[11]
কবি ইবনু আব্দিল কাভী বলেছেন,
فَمَنْ هَجَرَ اللَّذَّاتِ نَالَ الْمُنَى وَمَنْ + أَكَبَّ عَلَى اللَّذَّاتِ عَضَّ عَلَى الْيَدِ
وَفِيْ قَمْعِ أَهْوَاءِ النُّفُوْسِ اعْتِزَازُهَا + وَفِيْ نَيْلِهَا مَا تَشْتَهِيْ ذُلُّ سَرْمَدِ
وَلَا تَشْتَغِلْ إِلَّا بِمَا يُكْسِبُ الْعُلَا + وَلَا تُرْضِ النَّفْسَ النَّفِيْسَةَ بِالرَّدِي
وَفِيْ خَلْوَةِ الْإِنْسَانِ بِالْعِلْمِ أُنْسُهُ + وَيَسْلَمُ دِيْنُ الْمَرْءِ عِنْدَ التَّوَحُّدِ
وَيَسْلَمُ مِنْ قِيْلٍ وَقَالَ وَمِنْ أَذَى + جَلِيْسٍ وَمِنْ وَاشٍ بَغِيْضٍ وَحُسَّدِ
فَكُنْ حِلْسَ بَيْتٍ فَهْوَ سِتْرٌ لِعَوْرَةٍ + وَحِرْزُ الْفَتَى عَنْ كُلِّ غَاوٍ وَمُفْسِدِ
وَخَيْرُ جَلِيْسِ الْمَرْءِ كُتْبٌ تُفِيْدُهُ + عُلُوْمًا وَآدَابًا وَعَقْلاً مُؤَيِّدِ
‘যে
স্বাদ-আহ্লাদ ত্যাগ করেছে সে আশা পূরণ করতে পেরেছে। আর যে স্বাদ-আহ্লাদের
মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সে অনুশোচনায় হাত কামড়ে ধরেছে। মনের কামনা-বাসনাকে
দমন করাতেই তার সম্মান নিহিত রয়েছে। কিন্তু মন যা চায় তাই জোগাতে থাকলে এক
সময় চিরস্থায়ী লাঞ্ছনায় ডুবে যেতে হবে। কাজেই উচ্চমর্যাদা অর্জিত হয় এমন
কাজ বাদে অন্য কোন কাজে মশগূল হয়ো না। মূল্যবান জীবনটাকে নিকৃষ্ট জিনিসের
মাঝে সন্তুষ্ট থাকতে দিও না। একান্তে বিদ্যাচর্চা মানুষের জন্য বন্ধুত্ব
বয়ে আনে আর একাকীত্বের মাঝেই মানুষের দ্বীন-ধর্ম-নিরাপদ থাকে। সে সমালোচনা,
খারাপ সঙ্গীর কষ্টদান এবং বিদ্বেষপরায়ণ নিন্দুক ও হিংসুকের হিংসা থেকে
রক্ষা পায়। সুতরাং তুমি সর্বদা তোমার ঘরে অবস্থান কর। এটাই তো তোমার
গোপনীয়তার জন্য হবে পর্দা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টাচারী ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী
থেকে (তরুণের) রক্ষাকবচ। উপকারী বই-পুস্তকই তো মানুষের উত্তম সঙ্গী। যা
তাকে বিদ্যা-বুদ্ধি ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়’।[12]
৪. সংকল্পের দৃঢ়তা :
কুপ্রবৃত্তির
অনুসরণ মানুষের সঙ্কল্পকে দুর্বল করে দেয় এবং তার বিরোধিতা সংকল্পকে দৃঢ় ও
শক্তিশালী করে। এই দৃঢ় সংকল্পই বান্দার জন্য আল্লাহর ও আখিরাতের পথের
বাহন। সুতরাং যানবাহন যখন বিকল হয়ে যাবে তখন মুসাফিরের যাত্রাও পন্ড হয়ে
যাবে। ইয়াহইয়া বিন মু‘আযকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, ‘সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকল্পের
অধিকারী কে? তিনি বললেন, ‘তার প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জয়লাভকারী’।[13]
৫. স্বাস্থ্য রক্ষা :
ইবনু
রজব বলেছেন, জনৈক বিদ্বান ১০০ বছর বয়স পার করেছিলেন, তখনও তার দেহ সুঠাম
এবং বোধশক্তি সতেজ ছিল। একদিন তিনি খুব জোরে এক লাফ দিলেন। সেজন্য তাকে
গালমন্দ করা হ’ল। কিন্তু তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, ছোটকালে এই
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে আমরা পাপ-পঙ্কিলতা থেকে রক্ষা করেছি, তাই বুড়োকালে
আল্লাহ আমাদের জন্য সেগুলো রক্ষা করছেন। এর বিপরীতে জনৈক পূর্বসূরী ব্যক্তি
এক বৃদ্ধকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখে বললেন, এই লোকটা
অবশ্যই দুর্বল। সে শৈশবে আল্লাহর হক নষ্ট করেছিল, তাই তার বার্ধক্যে আল্লাহ
তাকে কষ্টে ফেলেছেন’।[14]
৬. দুনিয়ার বালা-মুছীবত থেকে মুক্তি :
ইবরাহীম
বিন আদহাম (রহঃ) বলেছেন, أَشَدُّ الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى، وَمَنْ
مَنَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا فَقَدِ اسْتَرَاحَ مِنَ الدُّنْيَا وَبَلَائِهَا،
وَكَانَ مَحْفُوْظًا وَمُعَافًى مِنْ أذَاهَا ‘কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে
জিহাদই সবচেয়ে কঠিন জিহাদ। যে নিজের মনকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে হেফাযত
করতে পারবে, সে দুনিয়া ও দুনিয়ার বালা-মুছীবত থেকে আরামে থাকবে। সে দুনিয়ার
কষ্ট-ক্লেশ থেকেও রক্ষা পাবে’।[15]
খেয়ালখুশির অনুসরণের প্রতিকার
যে কুপ্রবৃত্তির শিকারে পরিণত হয়েছে, কুপ্রবৃত্তির থাবা থেকে বাঁচার জন্য তার মনের চিকিৎসা প্রয়োজন। তাতে করে আল্লাহ তা‘আলা হয়তো তাকে দয়া করবেন এবং সৎলোকদের কাতারে তাকে শামিল করবেন। কুপ্রবৃত্তির চিকিৎসায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।-
এক. পূতপবিত্র মহামহিম আল্লাহ তা‘আলার দিকে ফিরে যাওয়া এবং কুপ্রবৃত্তির অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাঁর নিকট দো‘আ করা। নবী করীম (ছাঃ) ও পূর্বসূরীদের এটা ছিল নিয়মিত অভ্যাস।
কুতবা বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
নবী করীম (ছাঃ) এই বলে দো‘আ করতেন, اَللَّهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ
مُنْكَرَاتِ الْأَخْلاَقِ وَالْأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ ‘হে আল্লাহ! আমি
তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি মন্দ স্বভাব, আমল ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে’।[16]
ওমর
বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) খালিদ বিন ছাফওয়ান (রাঃ)-কে বললেন, সংক্ষেপে আমাকে
কিছু নছীহত করুন। তিনি তখন বললেন, يَا أَمِيْرَالْمُؤْمِنِيْنَ إِنَّ
أَقْوَامًا غَرَّهُمْ سِتْرُ اللهِ، وَفَتَنَهُمْ حَسَنُ الثَّنَاءِ فَلَا
يَغْلِبَنَّ جَهْلُ غَيْرِكَ بِكَ عِلْمَكَ بِنَفْسِكَ، أَعَاذَنَا اللهُ
وَإِيَّاكَ أَنْ نَكُوْنَ بِالسِّتْرِ مَغْرُوْرِيْنَ وَبِثَنَاءِ النَّاسِ
مَسْرُوْرِيْنَ وَعَمَّا افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْنَا مُتَخَلِّفِيْنَ
وَمُقَصِّرِيْنَ وَإِلَى الْأَهْوَاءِ مَائِلِيْنَ ‘আমীরুল মুমিনীন! অনেক
লোক আছে যারা আল্লাহপাক পাপ গোপন রাখবেন এই আশায় ধোঁকায় পতিত হয়, আবার
অন্যদের মুখে নিজেদের প্রশংসা শুনেও তারা ফিৎনার শিকার হয়। কাজেই আপনার
সম্বন্ধে অন্যের অজ্ঞতাপ্রসূত কথা যেন আপনার সম্বন্ধে আপনার নিজের জ্ঞানের
উপর বিজয়ী না হয় (অর্থাৎ যে গুণ ও যোগ্যতা আপনার মধ্যে নেই বলে আপনার জানা
অন্যেরা আপনার মধ্যে সেই গুণ ও যোগ্যতা আছে বলে আপনার মিথ্যা প্রশংসা করলে
আপনি তাতে খুশি ও প্রলুব্ধ হবেন না)। মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে ও আপনাকে
রক্ষা করেন- যাতে আমরা আল্লাহর পাপ গোপন রাখার কথা দ্বারা প্রতারিত না হই,
অন্যের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে উৎফুল্ল না হই, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর
যা কিছু ফরয করেছেন তা পালনে পিছপা না হই বা কোন ত্রুটি না করি এবং খেয়ালি
মন-মানসিকতার দিকে যেন ঝুঁকে না পড়ি’। একথা শুনে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং
বললেন, أَعَاذَنَا اللهُ وَإِيَّاكَ مِنِ اتِّبَاعِ الْهَوَى ‘আল্লাহ
আমাদেরকে এবং তোমাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে রক্ষা করুন’।[17]
ইবরাহীম
তাইমী (রহঃ) দো‘আ করতেন আর বলতেন, اَللَّهُمَّ اعْصِمْنِي بِكِتَابِكَ
وَسُنَّةِ نَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم مِنَ اخْتِلَافٍ فِي
الْحَقِّ، وَمِنَ اتِّبَاعِ الْهَوَى بِغَيْرِ هُدًى مِنْكَ، وَمِنْ سُبُلِ
الضَّلَالَةِ، وَمِنْ شُبُهَاتِ الْأُمُوْرِ، وَمِنَ الزَّيْغِ،
وَاللُّبْسِ، وَالْخُصُوْمَاتِ ‘হে আল্লাহ! আপনার কিতাব আল-কুরআন এবং আপনার
নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের বরকতে আমাকে ন্যায় ও যথার্থ বিষয়ে
মতভেদ, আপনার হেদায়াত ছেড়ে খেয়াল-খুশির অনুসরণ, গোমরাহী, সন্দেহজনক
বিষয়াদি, অন্তরের বক্রতা, সন্দেহ ও বাক-বিতন্ডা থেকে রক্ষা করুন’।[18]
দুই. খেয়ালখুশির বিরোধী জিনিস দ্বারা অন্তর পূর্ণ রাখা :
আল্লাহর ভালবাসা অন্তরে ভরে রাখলে এবং তাঁর নৈকট্য লাভের আমল করে গেলে এক সময় অন্তর সম্পূর্ণরূপে খেয়ালখুশির অনুসরণ থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
তিন. আলেম ও আল্লাহভীরুদের সাহচর্য গ্রহণ :
কবি ইবনু আব্দুল কাভী বলেছেন,
وَخَالِطْ إذَا خَالَطْتَّ كُلَّ مُوَفَّقٍ + مِنَ الْعُلَمَاءِ أَهْلِ التُّقَى وَالتَّسَدُّدِ
يُفِيْدُكُ مِنْ عِلْمٍ وَيَنْهَاكَ عَنْ هَوًى + فَصَاحِبْهُ تُهْدَ مِنْ هُدَاهُ وَتَرْشُدْ
وَإِيَّاكَ وَالْهَمَّازَ إنْ قُمْتَ عَنْهُ وَالْ + بَذِيِّ فَإِنَّ الْمَرْءَ بِالْمَرْءِ يَقْتَدِيْ
وَلَا تَصْحَبِ الْحَمْقَى فَذُو الْجَهْلِ إنْ يَرُمْ+صَلَاحًا لِشَيْءٍ يَا أَخَا الْحَزْمِ يُفْسِدْ
‘যখন তুমি উঠাবসা করবেই তখন আল্লাহভীরু আলেম ও সঠিক পথের অনুসারী সৎ মানুষের সঙ্গে উঠাবসা করো।
তাতে তুমি যেমন বিদ্যা দ্বারা উপকৃত হবে, তেমনি খেয়ালখুশির অনুসরণ থেকে নিবৃত্তি লাভ করবে। তুমি এমন মানুষের সঙ্গী হও। দেখবে তার সৎপথের দিশা থেকে তুমি দিশা লাভ করছ।
সাবধান! সাবধান!! অগোচরে নিন্দাকারী অশ্লীল ভাষীর ধারে কাছেও যাবে না। কেননা মানুষ মানুষের অনুসরণ করে।
আর নির্বোধদের সাথে থাকতে যেয়ো না। কেননা হে সাবধানী বন্ধু! নির্বোধ যদি কোন ভাল কিছুও করতে চায় তবুও সে তা বিনষ্ট করে ফেলে’।[19]
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) অনেকগুলো বিষয় উল্লেখ করেছেন যা অবলম্বন করলে আল্লাহর মর্যিতে যে কোন ব্যক্তি কুপ্রবৃত্তির ছোবল থেকে মুক্তি পাবে। তিনি বলেছেন, ‘যদি প্রশ্ন তোলা হয়- যে কুপ্রবৃত্তির মাঝে ডুবে আছে সে কীভাবে তা থেকে মুক্তি পেতে পারে? উত্তরে বলা যায়, আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তায় নিম্নের কাজগুলো তাকে মুক্তি দিতে পারে।-
প্রথম : কুপ্রবৃত্তি বা খেয়ালখুশির অনুসরণ না করতে মন থেকে পাকাপোক্ত সঙ্কল্প করা।
দ্বিতীয় : ধৈর্য-সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা। যখন মনের মধ্যে খেয়ালখুশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তখনই ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে হবে। ধৈর্য হারানো চলবে না।
তৃতীয় : যাতে এক্ষেত্রে ধৈর্য অবলম্বন করা যায় সেজন্য মানসিক শক্তি বাড়াতে হবে। বলবীর্যতা তো আসলে সময়মত ধৈর্যের সাথে টিকে থাকার নাম। আর বান্দা ধৈর্যের মাধ্যমে যে জীবন-জীবিকা লাভ করে তাই উত্তম।
চতুর্থ : কামনা-বাসনার অনুসরণ না করলে ভবিষ্যতে যে শুভ পরিণতি অপেক্ষা করছে তা ভেবে দেখা এবং ধৈর্যের দাওয়া দ্বারা আরোগ্য লাভ করা।
পঞ্চম : খেয়ালখুশির আনুগত্য করলে তাৎক্ষণিক স্বাদ হয়তো মিলবে। কিন্তু সেজন্য কী পরিমাণ খেসারত ও যন্ত্রণা পোহাতে হবে তা লক্ষ্য করা।
ষষ্ঠ : আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার অবস্থান আর মানুষের মনে তার যে জায়গা আছে তা বহাল রাখতে সচেষ্ট হওয়া। খেয়ালখুশিমত চলা থেকে এটা তার জন্য অনেক উত্তম ও উপকারী।
সপ্তম : পাপের স্বাদ থেকে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও পাপ থেকে দূরে থাকার স্বাদকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
অষ্টম : সে যে তার খেয়ালখুশি নামক শত্রুকে পরাস্ত ও তাকে পদানত করতে পেরেছে সেজন্য আনন্দিত হওয়া। এজন্যও আনন্দিত হওয়া যে তার শত্রু নিজের ব্যর্থতার জন্য ক্রোধ ও দুঃখ-বেদনায় জর্জরিত হয়ে ফিরে গেছে। তার থেকে সে তার আশা পূরণ করতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলাও চান বান্দা যেন তার শত্রুকে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত করার মত আমল করে। আল্লাহ কুরআনুল কারীমে বলেছেন, وَلَا يَطَئُوْنَ مَوْطِئًا يَغِيْظُ الْكُفَّارَ وَلاَ يَنَالُوْنَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ ‘এমন কোন স্থানে তারা যাবে, যেখানে যাওয়ায় কাফিরদের তাদের উপর ক্রোধ সৃষ্টি হবে এবং শত্রুদের কাছ থেকেও যুদ্ধলব্ধ গণীমত হিসাবে তারা কিছু লাভ করবে। মূলতঃ এর প্রতিটি কাজের বদলে তাদের জন্য নেক আমল লেখা হবে’ (তওবা ৯/১২০)। প্রিয়জনের শত্রুকুলকে ক্ষেপিয়ে তোলা ও ক্ষুব্ধ করে তোলা সত্যিকারের মহববতের লক্ষণ।
নবম :
খেয়ালখুশির বিরোধিতা করলে দুনিয়াতেও সম্মান মিলবে, আখিরাতেও সম্মান মিলবে,
প্রকাশ্যেও ইযযত লাভ হবে, গোপনেও ইযযত লাভ হবে। পক্ষান্তরে খেয়ালখুশির
অনুসরণ করলে সর্বত্রই ধ্বংস ডেকে আনবে, প্রকাশ্যেও সে অপদস্থ হবে
অপ্রকাশ্যেও অপদস্থ হবে। এসব কথা মনে করে এবং জেনে বুঝে সকলকে খেয়ালখুশির
অনুসরণ না করে বরং বিরোধিতায় সচেষ্ট হ’তে হবে।[20]
প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি ও নিন্দনীয় প্রবৃত্তি
খেয়ালখুশি মাত্রেই যেমন নিন্দনীয় নয় তেমনি তার সবটাই প্রশংসনীয়ও নয়। এক্ষেত্রে বাড়াবাড়িটাই নিন্দনীয়। সুতরাং উপকার বয়ে আনা ও অপকার প্রতিরোধ করার উপর বেশী যা কিছু করা হবে তাই হবে নিন্দনীয়। এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় কামনা-বাসনাও আছে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট প্রিয়। আর তা তখনই হবে যখন মন তাই কামনা করবে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট প্রিয়।
আয়েশা
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত মহিলা নিজেকে রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর সাথে বিয়ের জন্য তাঁর সামনে প্রস্তাব পেশ করত আমার মনের মধ্যে
তাদের জন্য একরকম অস্বস্তি কাজ করত। আমি বলতাম, একজন মেয়ে মানুষ কি এভাবে
নিজেকে দান করতে পারে? তারপর যখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন,تُرْجِيْ
مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ وَتُؤْوِي إِلَيْكَ مَنْ تَشَاءُ وَمَنِ
ابْتَغَيْتَ مِمَّنْ عَزَلْتَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكَ ‘তুমি ইচ্ছে করলে
তাদের মধ্য থেকে কাউকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখতে পার, আবার যাকে ইচ্ছা
নিজের কাছে স্থান দিতে পার। যাকে তুমি দূরে রেখেছিলে তাকে যদি পুনরায় তুমি
নিজের কাছে রাখতে চাও তাতেও তোমার কোন দোষ হবে না’ (আহযাব ৩৩/৫১)। তখন আমি
মনে মনে স্বগতোক্তি করলাম, আমার মনে হয় আমার প্রভু দ্রুতই আমার কামনার
অনুকূলে সাড়া দিয়েছেন’।[21]
নবী করীম (ছাঃ)ও
কিছু কিছু জিনিসের আকাঙ্খা করতেন। আল্লাহ তা‘আলা তার আকাঙ্খার অনুকূলে
কুরআনের আয়াত নাযিল করতেন। এতে করে বুঝা যায়, মন যা কামনা করে তার কতক
প্রশংসনীয়। নবী করীম (ছাঃ)-এর কামনার মধ্যে ছিল, বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে
কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তন করা। এর কারণ সম্পর্কে আলেমগণ বলেছেন নবী করীম
(ছাঃ) ইবরাহীম (আঃ)-এর কিবলার অনুসরণ করতে মনে মনে কামনা করতেন।[22]
আবু
বারযা নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, إِنَّ مِمَّا
أَخْشَى عَلَيْكُمْ شَهَوَاتِ الْغَىِّ فِىْ بُطُوْنِكُمْ وَفُرُوْجِكُمْ
وَمُضِلاَّتِ الْفِتَنِ ‘আমি কেবলই তোমাদের ক্ষেত্রে তোমাদের পেট তথা
পানাহার ও জননেন্দ্রিয়ের অবৈধ সম্ভোগ এবং শরী‘আত বিরুদ্ধ কামনা-বাসনা
চরিতার্থ করার ভয় করি’।[23]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিন্তু তাঁর উম্মাতের জন্য সব রকম কামনার ভয় করেননি। বরং তিনি কেবল ভয় করেছেন পথভ্রষ্টকারী কামনা-বাসনা। কারণ কামনা-বাসনা কখনো কখনো পথভ্রষ্টকারী হয়ে থাকে। এরূপ কামনা-বাসনা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং দ্বীন-ধর্মকে বিনষ্ট করে দেয়। কিন্তু যে কামনা-বাসনা পথভ্রষ্ট করে না তাতে কোন দোষ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তাই সে সম্পর্কে সতর্ক করেননি। কিন্তু নিন্দনীয় কামনা-বাসনাই অধিকহারে প্রচলিত। এজন্যই আমরা অনেক আয়াত, হাদীছ এবং পূর্বসূরী ছাহাবী, তাবেঈগণের ও তাঁদের পরবর্তীদের কথায় সাধারণভাবে কামনা-বাসনার নিন্দা দেখতে পাই। এখানে অবশ্যই ওগুলো দ্বারা নিন্দনীয় কামনা বুঝানো হয়েছে, সাধারণভাবে সব কামনা ও খেয়ালখুশি নয়।
ইবনুল ক্বাইয়িম
(রহঃ) বলেছেন, ‘কামনা-বাসনা ও লালসার অনুগামী লোকেরা বেশির ভাগই উপকার
লাভের মাত্রা পর্যন্ত এসে থামে না; বরং সীমালংঘন করে। তাই সাধারণভাবে এর
ক্ষতিকারিতার কারণেই কামনা ও লালসার নিন্দা করা হয়েছে। খুব কম লোকই
এক্ষেত্রে ইনছাফ বজায় রাখতে পারে বা ইনছাফের পর্যায়ে এসে থামতে পারে।
এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর গ্রন্থে যেখানেই কামনা বা খেয়ালখুশির কথা
বলেছেন, সেখানেই তার নিন্দা করেছেন। হাদীছেও তা নিন্দনীয়ভাবে উপস্থাপিত
হয়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে শর্তযুক্তভাবে তার প্রশংসা এসেছে’।[24]
হাদীছে
যে কামনার নিন্দা করা হয়নি তা যেমন ইতিপূর্বে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে
এসেছে, তেমনি হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছেও
এসেছে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে
না যে পর্যন্ত না তার কামনা-বাসনা আমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছি তার অনুগত হয়’।[25]
হাদীছ হ’তে বুঝা যায়, কিছু কামনা প্রশংসনীয়। আর তা হ’ল সেসব কামনা যেগুলো শরী‘আতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে দিন বদর যুদ্ধ হ’ল, সেদিন বন্দীদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে বলেছিলেন, مَا تَرَوْنَ فِى هَؤُلاَءِ الأُسَارَى ‘এসব বন্দীদের বিষয়ে আপনাদের অভিমত কী’? তখন আবুবকর (রাঃ) বলেছিলেন, يَا نَبِىَّ اللهِ هُمْ بَنُو الْعَمِّ وَالْعَشِيْرَةِ أَرَى أَنْ تَأْخُذَ مِنْهُمْ فِدْيَةً فَتَكُوْنُ لَنَا قُوَّةً عَلَى الْكُفَّارِ فَعَسَى اللهُ أَنْ يَهْدِيَهُمْ لِلْإِسْلاَمِ ‘হে আল্লাহর নবী! তারা তো আমাদেরই চাচাত ভাই ও জ্ঞাতি লোক। আমি মনে করি, মুক্তিপণ নিয়ে আপনি ওদের ছেড়ে দিন। মুক্তিপণের অর্থ কাফিরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি জোগাবে। আর এ লোকগুলোকেও আল্লাহ ভবিষ্যতে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় দিতে পারেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুনরায় বললেন, مَا تَرَى يَا ابْنَ الْخَطَّابِ ‘হে খাত্ত্বাবের সন্তান ওমর! তোমার অভিমত কী’? আমি বললাম,
لاَ وَاللهِ يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا أَرَى الَّذِىْ رَأَى أَبُوْ بَكْرٍ وَلَكِنِّى أَرَى أَنْ تُمَكِّنَّا فَنَضْرِبَ أَعْنَاقَهُمْ فَتُمَكِّنَ عَلِيًّا مِنْ عَقِيْلٍ فَيَضْرِبَ عُنُقَهُ وَتُمَكِّنِّى مِنْ فُلاَنٍ- نَسِيْبًا لِعُمَرَ- فَأَضْرِبَ عُنُقَهُ فَإِنَّ هَؤُلاَءِ أَئِمَّةُ الْكُفْرِ وَصَنَادِيدُهَا فَهَوِىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ وَلَمْ يَهْوَ مَا قُلْتُ-
‘না, আল্লাহর কসম! আবুবকর যেমন ভাবছেন আমি তা মনে করি
না। বরং আমার সিদ্ধান্ত এই যে, আপনি ওদেরকে আমাদের হাতে দিন, আমরা ওদের
গর্দান উড়িয়ে দেই। আকীলকে দিন আলীর হাতে সে তার গর্দান উড়িয়ে দিক। আমার
হাতে দিন অমুককে (ওমরের বংশীয়) আমি তার ঘাড় নামিয়ে দেই। এসব লোক তো
কাফিরদের বড় বড় নেতা। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকরের ইচ্ছেমত কাজ
করলেন। আমি যা বললাম সে মত অনুযায়ী করলেন না’।[26]
দেখুন দয়াল নবী (ছাঃ) আবুবকর (রাঃ)-এর কথা ও ইচ্ছার দিকে ঝুঁকলেন। কারণ এতে তিনি ইসলামের কল্যাণ দেখেছিলেন। এটা ছিল প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। নবী করীম (ছাঃ) নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে ওমর (রাঃ)-এর সিদ্ধান্তকে সঠিক আখ্যা দিয়ে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল।
শেষ কথা :
খেয়ালখুশি বা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা একটি আয়াসসাধ্য কষ্টকর ব্যাপার। এ সংগ্রামে দেহ-মন উভয়কে কষ্টের বোঝা বইতে হয়। তবে এ সংগ্রামের পরিণাম হয় খুবই সুন্দর এবং ফলাফল হয় খুবই মর্যাদার। তাই খেয়ালখুশির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া থেকে দুর্বলচেতা অসুস্থ মন-মানসিকতার লোকেরা ছাড়া আর কেউ-ই পিছপা হয় না। কবি আবুল আতাহিয়া বলেন,
أَشَدُّ الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى + وَمَا كَرَّمَ المَرْءَ إِلاَّ التُّقَى
‘কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদই (সংগ্রাম) সবচেয়ে কঠিন জিহাদ। আর তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতিই কেবল মানুষকে মহিমান্বিত করে’।
আরেক কবি বলেছেন,
صَبَرْتُ عَلَى الْأَيَّامِ حَتَّى تَوَلَّتِ + وَأَلْزَمْتُ نَفْسِيْ صَبْرَهَا فَاسْتَمَرَّتِ
وَمَا النَّفْسُ إِلاَّ حَيْثُ يَجْعَلُهَا الْفَتَى + فَإِنْ أُطْمِعَتْ تَاقَتْ وَإِلاَّ تَسَلَّتِ
‘আমি কালের কুটিলচক্রের শিকার হয়ে বিপদে ধৈর্য ধরেছি। ফলে এক সময় বিপদ কেটে গেছে। আমি আমার মনকে ধৈর্যের উপর অবিচল রেখেছি, ফলে সে ধৈর্য ধারণ করেই গেছে’।
আসলে মন তো সেখানেই থাকে যেখানে মানুষ তাকে রাখে। যদি মনের
সামনে লোভ ধরিয়ে দেওয়া হয় তাহ’লে সে লোভের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। নতুবা সে
শান্ত থাকে’।[27]
খেয়ালখুশির অনুসরণ না করার
সবচেয়ে বড় আলামত হ’ল পার্থিব জীবনের সাজসজ্জা ও চাকচিক্য থেকে দূরে থাকা।
মালিক বিন দীনার (রহঃ) বলেন, مَنْ تَبَاعَدَ مِنْ زُهْرَةِ الْحَيَاةِ
الدُّنْيَا فَذَلِكَ الْغَالِبُ لِهَوَاهُ ‘যে দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য ও
আড়ম্বর থেকে দূরে থাকবে সেই তার কামনা-বাসনাকে পরাস্তকারী হবে’।[28]
খেয়ালখুশি
সব মানুষের মধ্যেই অনুপ্রবেশ করে। শুধুই নাদান-মূর্খ কিংবা শিশুদের মধ্যেই
নয়; বরং আলেম-ওলামা, বিদ্বান, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, ছোট-বড়,
নারী-পুরুষ সকলের মধ্যেই তা প্রবেশ করে। জনৈক বিজ্ঞজন বলেছেন, অভিজ্ঞ
জ্ঞানী-গুণীজনেরও পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে তার সিদ্ধান্ত যাতে
খেয়ালখুশির প্রেক্ষিতে না হয় সেজন্য’।[29]
সুতরাং কারো জন্য এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, আমি তো আমার খেয়ালখুশির অনুসরণ করি না, সুতরাং খেয়ালখুশির নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে যেসব কথা এসেছে তা আমার বেলায় প্রযোজ্য নয়। মানছূর আল-ফকীহ বলেছেন,
إِنَّ الْمَرَائِيَ لاَ تُرِيْكَ + خُدُوْشَ وَجْهِكَ فِيْ صَدَاهَا
وَكَذَاكَ نَفْسُكَ لاَ تُرِيْكَ + عُيُوْبَ نَفْسِكَ فِيْ هَوَاهَا
‘আয়না
জংধরা বা ময়লাযুক্ত হ’লে তাতে তোমার মুখের দোষ ধরা পড়বে না। অনুরূপভাবে
খেয়ালখুশির মাঝে মজে থাকলে তুমি তোমার নিজের ভিতরকার দোষ-ত্রুটি দেখতে পাবে
না’।[30]
বরং যিনি সবচেয়ে বুদ্ধিমান, ধার্মিক ও সবচেয়ে বড় বিদ্বান বলে পরিচিত তাঁর মধ্যেও কখনো কখনো খেয়ালখুশি অনুপ্রবেশ করে। তাই মহামহিম আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমাদের প্রার্থনা তিনি যেন খেয়ালখুশির উপায়-উপকরণ থেকে আমাদের হেফাযত করেন। নিকৃষ্ট আচার-আচরণ থেকে আমাদের ফিরিয়ে রাখেন এবং আমাদেরকে ভাল কাজের তাওফীক দেন। আর আল্লাহ তা‘আলা করুণা ও শান্তি বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ), তাঁর পরিবারবর্গ, সঙ্গী-সাথীদের সকলের উপর।
মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
কামিল, এম.এ; সহকারী শিক্ষক, হরিণাকুন্ডু সরকারী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহ।
[1]. ইবনু মুফলিহ, আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ৩/২৫১।
[2]. ঐ ৩/২৫১।
[3]. তাফসীরে কুরতুবী ১৬/১৪৪।
[4]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৯/২৬৮।
[5]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল ইসতিযকার ২/৩৬৪।
[6]. বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১।
[7]. রাওযাতুল মুহিববীন, পৃঃ ৪৮৫-৪৮৬।
[8]. রাওযাতুল মুহিববীন, পৃঃ ৪৭৭-৪৭৮।
[9]. ইবনু আবিদ্দুনিয়া, আল-আকলু ও ফাযলুহু, পৃঃ ৯২।
[10]. যাম্মুল হাওয়া, পৃঃ ২৭।
[11]. রাওযাতুল মুহিববীন, পৃঃ ৪৮৩।
[12]. আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ৩/৩০৩-৩০৪।
[13]. যাম্মুল হাওয়া, পৃঃ ২৬।
[14]. ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ১৮৬।
[15]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/১৮; শু‘আবুল ঈমান, পৃঃ ৮৭৬।
[16]. তিরমিযী হা/৩৫৯১, মিশকাত হা/২৪৭১, সনদ ছহীহ।
[17]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/১৮।
[18]. ঐ, ৪/২১২।
[19]. ইবনু মুফলিহ, আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ৩/৩০৪।
[20]. রাওযাতুল মুহিববীন পৃঃ ৪৭১-৪৭২।
[21]. বুখারী হা/৪৭৮৮।
[22]. তাফসীর ত্বাবারী ২/২২ পৃঃ।
[23]. আহমাদ হা/১৯৭৮৮, ছহীহ তারগীব হা/৫২, সনদ ছহীহ।
[24]. রওযাতুল মুহিববীন (৪৬৯) ঈষৎ পরিবর্তন সহ।
[25]. নববী, শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/১৬৭, আলবানী, সনদ যঈফ।
[26]. মুসলিম হা/১৭৬৩, ইবনু হিববান হা/৪৭৯৩।
[27]. যাম্মুল হাওয়া, পৃঃ ১৫৩।
[28]. হিলয়াতুল আওলিয়া ২/৩৬৪।
[29]. বাহজাতুল মাজালিস ওয়া উনসুল মাজালিস, পৃঃ ১৭১।
[30]. আবু উবায়েদ আল-বিকরী, ফাছলুল মাকাল ফি শারহি কিতাবুল আমছাল, পৃঃ ২৭৫।