এ পৃথিবীতে মানুষ পার্থিব জগতের উন্নয়নে বড় বড় বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে অনেক বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বা করছেন। আল্লাহর শক্তির (বিকল্প) অন্তর্ভুক্ত প্রাকৃতিক শক্তি নিয়েও ব্যাপক গবেষণা চলছে বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানীদের মাঝে। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি এখন নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে। এসব আবিষ্কারে মানুষ আর আশ্চর্যবোধ করে না। মনে হয় এগুলো যেন একটা চিরাচরিত ব্যাপার বা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তা-বিবেচনা ও গবেষণার সুফল। কিন্তু এগুলোর গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও আধ্যাত্মিক অর্থ কি তাই? একটি সামান্য মোবাইল সেটের কার্যকারিতা বা ক্ষমতা নিয়ে আমরা চিন্তা করেছি কি? কম্পিউটার সারাবিশ্বে আজ প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু এর সীমারেখা বা কার্যক্ষমতা কত ব্যাপক! অথচ এগুলো এখন সহজ ব্যবহার্য বস্ত্ত হয়ে পড়েছে। কারণ আজকাল পাঁচ-সাত বছর বয়সের একটা বুদ্ধিমান শিশুও মোবাইলের ব্যবহার সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল। কম্পিউটার ও ভিডিও চিত্রের অদ্ভূত নৈপূণ্য সম্পর্কেও তারা অনেক অবগত, যা ষাট-সত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধরাও বুঝে না। শুধু এগুলোই নয়, আরও অসংখ্য বিষয়ে মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহর শক্তির ও জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বর্তমানে মহাকাশের অন্তর্ভুক্ত গ্রহ-উপগ্রহগুলোতে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী পরিবেশের অনুসন্ধান করছেন। মহাশূন্যের নিকটতম চাঁদের দেশে বসবাস নিয়েও উন্নত দেশসমূহে চলছে বিপুল আলোড়ন। এসব আলোড়ন ও আন্দোলনে এখন আর কোন বিষ্ময়ের নমুনা প্রতিফলিত হচ্ছে না। বরং অনেকের কাছেই যেন এগুলো স্বাভাবিক। ভাল কর্মপরিকল্পনার ক্ষেত্রে যেমন প্রকাশ্য বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপ মন্দ পরিকল্পনা তথা সন্ত্রাস, হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন প্রভৃতিও দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব আল্লাহ বন্ধ করতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলার নিকট এটা অতি সহজ। কারণ তিনি সকল শক্তির মালিক ও উৎস। বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহাক্ষমতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

قُلْ سِيْرُوْا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوْا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ.

‘বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন, অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ (আনকাবুত ২৯/২০)

অন্যত্র তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাদের কতক বুকে ভর দিয়ে চলে, কতক দুই পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চার পায়ে ভর দিয়ে চলে। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (নূর ২৪/৪৫)

আল্লাহ আরো বলেন, لِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَا فِيْهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ. ‘নভোমন্ডল, ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান বা ক্ষমতাবান’ (মায়েদাহ ৫/১২০)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘আল্লাহর জন্যই হ’ল আসমান ও যমীনের বাদশাহী। আল্লাহই সর্ববিষয়ে ক্ষমতার অধিকারী’ (আলে ইমরান ৩/১৮৯)। মহান আল্লাহ বলেন, لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ. ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব তাঁরই। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। তিনি সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (হাদীদ ৫৭/২)

মহান আল্লাহ বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা এবং ফেরেশতাগণকে করেছেন বার্তাবাহক। তারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার পাখা বিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা যোগ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (ফাতির ৩৫/১)

তিনি আরো বলেন, يُسَبِّحُ لِلّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ. ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (তাগাবুন ৬৪/১)

মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তিনি স্বয়ং শ্রেষ্ঠ, মহাজ্ঞানী, পরাক্রমশালী ও সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। উপরে বর্ণিত আয়াতগুলিতে তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।

অবশ্য কিছু মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কোন বস্ত্তকে পূজা করে, সম্মান-শ্রদ্ধা করে, মান্য করে এবং তাদের উদ্দেশ্যে অনেক কিছু উৎসর্গও করে। যে কাজগুলি করতে আল্লাহ তা‘আলা পুরোপুরিভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র তাঁকেই উপাস্য হিসাবে মান্য করার জন্য বার বার আদেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। অনেক মানুষ যাদেরকে আল্লাহর সমতুল্য জ্ঞানে সারাজীবন আনুগত্য করে, সত্যি সত্যি তাদের কোন ক্ষমতা নেই। সারা জীবনে তারা একটা মশা-মাছিও সৃষ্টি করতে পারেনি বা পারবে না। সুদূর অতীতে এসব দেবতা ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগূছ, ইয়াউক, নাসর, লাত, ওযযা প্রভৃতি নামে খ্যাত ছিল। এরা নিতান্তই শক্তিহীন ও অর্থহীন অবলম্বন মাত্র। এরা কারো জন্ম-মৃত্যুরও মালিক নয়, কোন কিছু সৃষ্টিতেও সক্ষম নয়। এদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হ’ল, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনো একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন’ (হজ্জ ২২/৭৩-৭৪)

মহান আল্লাহ বলেন, أَمِ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ فَاللهُ هُوَ الْوَلِيُّ وَهُوَ يُحْيِي المَوْتَى وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ. ‘তারা কি আল্লাহ ব্যতীত অপরকে অভিভাবক স্থির করেছে? আল্লাহই তো একমাত্র অভিভাবক। তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান’ (শূরা ৪২/৯)। অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ مِنْ شَيْءٍ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ. ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে যা কিছুকে ডাকে, আল্লাহ তা জানেন। তিনি শক্তিশালী মহাজ্ঞানী’ (আনকাবুত ২৯/৪২)

এ দুনিয়ায় কিছু সংখ্যক মানুষ নিঃসন্তান, কিছু সংখ্যক শুধু পুত্র-সন্তানের অধিকারী এবং কিছু শুধু কন্যা সন্তানের জনক। এমতাবস্থায় নিঃসন্তানের জনক ঈমানদার হ’লে আল্লাহর দরবারে সন্তানের জন্য, পুত্র সন্তানের জনক কন্যার জন্য এবং কন্যা সন্তানের জনক পুত্র সন্তানের জন্য প্রার্থনা করে এবং আল্লাহর উপরই নির্ভর করে। কেউবা পীর-দরবেশ, ফকীরের শরণাপন্ন হয়। এ বিষয়ের সকল সঠিক সমাধানও সর্বশক্তি আল্লাহর হাতেই রয়েছে। তিনি বলেন, ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান’ (শূরা ৪২/৪৯-৫০)

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম জ্ঞানের দ্বারা, সকল প্রাণী ও প্রাকৃতিক বস্ত্তগুলিরও স্রষ্টা এবং এসবের জন্ম-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর একটি (উল্লেখযোগ্য) নিদর্শন এই যে, আপনি ভূমিকে দেখবেন অনুর্বর পড়ে আছে। অতঃপর আমি যখন তার উপর বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন সে শস্য-শ্যামল ও উর্বর হয়। নিশ্চয়ই তিনি একে জীবিত করেন, তিনি জীবিত করবেন মৃতদেরকেও। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু করতে সক্ষম’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৩৯)

একই মর্মার্থে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তিনি আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর আপনি দেখতে পান তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টিধারা। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা পৌঁছান, তখন তারা আনন্দিত হয়। তারা প্রথম থেকেই তাদের প্রতি এই বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ার পূর্বে নিরাশ ছিল। অতএব আল্লাহর রহমতের ফল দেখে নাও, কিভাবে তিনি মৃত্তিকার মৃত্যুর পর তাকে জীবিত করেন। নিশ্চয়ই তিনি মৃতদেরকে জীবিত করবেন এবং তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ (রূম ৩০/৪৮-৫০)

মানুষকে এ বিষয়ে আরও অধিক জ্ঞান দানের প্রয়াসে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন, ‘তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল-সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়, অতঃপর তা এমন শুষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এসব কিছুর উপর শক্তিমান। ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য এবং স্থায়ী সৎ কর্মসমূহ আপনার পালনকর্তার কাছে প্রতিদান প্রাপ্তি ও আশা লাভের জন্য উত্তম। যেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) আমি পর্বত সমূহকে পরিচালনা করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি উন্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব, অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না’ (কাহফ ১৮/৪৫-৪৭)

আল্লাহর মহাশক্তি বা অসীম শক্তির বর্ণনায় উপরের আয়াতগুলোর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। মহাজ্ঞানবান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান যে কত স্বল্প তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। পবিত্র কুরআনে তিনি তাঁর মহাজ্ঞানের কথা সহজ ভাষায় উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, هَذَا كِتَابُنَا يَنْطِقُ عَلَيْكُم بِالْحَقِّ إِنَّا كُنَّا نَسْتَنْسِخُ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ. ‘আমার কাছে রক্ষিত এই আমলনামা তোমাদের সম্পর্কে সত্য কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করতাম’ (জাছিয়া ৪৫/২৯)

অন্য আয়াতে তিনি বলেন, وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا. ‘আমি সবকিছুই লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষিত করেছি’ (নাবা ৭৮/২৯)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نُحْيِي الْمَوْتَى وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوْا وَآثَارَهُمْ وَكُلَّ شَيْءٍ أحْصَيْنَاهُ فِيْ إِمَامٍ مُبِيْنٍ. ‘আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্ত্ত স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি’ (ইয়াসীন ৩৬/১২)। আল্লাহ আরো বলেন, فَمَنْ يَّعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلاَ كُفْرَانَ لِسَعْيِهِ وَإِنَّا لَهُ كَاتِبُوْنَ. ‘অতঃপর যে বিশ্বাসী অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার প্রচেষ্টা অস্বীকৃত হবে না এবং আমি তা লিপিবদ্ধ করে রাখি’ (আম্বিয়া ২১/৯৪)। সর্ববিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা অতি নিখুঁতভাবে মানুষের কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করছেন। শুধু বাহ্যিক বা প্রকাশ্য কথাবার্তাই নয় অন্তরের গোপন চিন্তা বা কল্পনার ভাল ও মন্দ বিষয়গুলিও তিনি অবগত হন। এসব অসম্ভব তথ্যপ্রবাহে যে মহাজ্ঞান, মহাশক্তি, ও সর্ববিষয়ের সর্বশক্তির সীমাহীন ভাবার্থ নিহিত রয়েছে তা যেকোন ব্যক্তির জন্য সর্বান্তকরণে গভীর শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করা উচিত। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ. ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী’ (ক্বাফ ৫০/১৬)

আল্লাহ আরও বলেন, وَأَسِرُّوْا قَوْلَكُمْ أَوِ اجْهَرُوْا بِهِ إِنَّهُ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ ‘তোমরা তোমাদের কথা গোপনে বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তরের বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (মুলক ৬৭/১৩)। মানুষকে অত্যধিক সতর্ক করার প্রয়াসে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُوْرُ ‘চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন’ (মুমিন ৪০/১৯)। অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তায় অন্তর্যামী আল্লাহ বলেন, ثُمَّ إِلَى رَبِّكُم مَّرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ إِنَّهُ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ ‘অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ফিরে যাবে। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের কর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন। নিশ্চয়ই তিনি অন্তরের বিষয় সম্পর্কেও অবগত’ (যুমার ৩৯/৭)

মহান আল্লাহ বলেন, وَاللّهُ خَلَقَكُمْ ثُمَّ يَتَوَفَّاكُمْ وَمِنْكُم مَّنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لاَ يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئاً إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ قَدِيْرٌ. ‘আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, এরপর তোমাদের মৃত্যুদান করেন। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ পৌঁছে যায় জরাগ্রস্ত অকর্মণ্য বয়সে, ফলে যা কিছু তারা জানত সে সম্পর্কে তারা সজ্ঞান থাকবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিজ্ঞ সর্বশক্তিমান’ (নাহল ১৬/৭০)

অন্যত্র মানব জাতিকে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেন, ‘হে লোকসকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হও, তবে (ভেবে দেখ) আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট মাংসপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি, যাতে তোমরা যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌঁছানো হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে পতিত দেখতে পাও, অতঃপর আমি যখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। এগুলো একারণে যে আল্লাহ সত্য এবং তিনি মৃতকে জীবিত করেন এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (হজ্জ ২২/৫-৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘তারা কি জানে না যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তিনি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর সৃষ্টিতে কোন ক্লান্তিবোধ করেননি, তিনি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম। কেন নয়, নিশ্চয়ই তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (আহকাফ ৪৫/৩৩)

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, إِلَى اللهِ مَرْجِعُكُمْ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘আল্লাহর সান্নিধ্যেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ (হূদ ১১/৪)

সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহাশক্তি, মহাজ্ঞান ও যাবতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষমতার বিষয়টি জগদ্বাসীকে অবহিত করতেই এসব অবতীর্ণ করেন। এতে ধনী-দরিদ্র, শক্তিশালী-দুর্বল, অল্পজ্ঞানী-অধিক জ্ঞানী, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবার জন্যে একই রূপ শিক্ষা, জ্ঞান ও উপদেশ লুক্কায়িত আছে। অন্যত্র তিনি ঘোষণা করেন, ‘বলুন, হে আল্লাহ! আপনিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। আপনার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। আপনি রাতকে দিনের ভেতরে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের ভেতরে। আর আপনিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আনেন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের করেন। আর আপনিই যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন। মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশংকা করলে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্পর্কে সতর্ক করেছেন তোমাদেরকে এবং সবাইকে। তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। বলুন! তোমরা যদি মনের কথা গোপন করে রাখ অথবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ সে সবই জানতে পারেন। আর আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সেসবও তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (আলে ইমরান ৩/২৬-২৯)

পৃথিবীর মানুষ যদি উপরোল্লেখিত মাত্র কয়েকটি আয়াত নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করে, মনোযোগ সহকারে গবেষণা করে, তবে এগুলোকে স্পষ্ট দিবালোকের ন্যায় স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে দেখতে পাবে, অনুভব করতে পারবে এবং সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে চলে যাবে। তখন আল্লাহকে সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান ভাবতে বা মান্য করতে আরও অনেক সহজ হবে। কারণ পৃথিবীর বুকে বড় বড় রাজা-বাদশাহ, সম্রাট, প্রেসিডেন্ট তাদের শাসনকার্য, দিগ্বিজয় ও তাদের শেষ পরিণতির যে ইতিহাস রেখে গেছেন, তা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। ঐসব শক্তিশালী নরপতিদের অধিকাংশেরই উচ্ছাকাংখা বা স্বেচ্ছাচারিতা পূর্ণ হয়নি। বরং আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের ভাগ্যে ঘটেছে লজ্জাজনক ও কষ্টদায়ক মর্মান্তিক পরিণতি। আবার তাদের অনেকের ভাগ্যে তাদের ন্যায়পরায়ণতা ও সুশাসনের সুফলও রয়েছে। তাদের কাহিনীও কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে। যেমন ন্যায়পরায়ণ, সুশাসক ও আল্লাহর সন্তুষ্টির বাহক হিসাবে দাউদ (আঃ), সোলায়মান (আঃ), বাদশাহ তালূত, যুলকারনাইন প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অপর দিকে দুরাচার ফেরআউন, নমরূদ, আবরাহা, জালূত প্রমুখ স্বৈরাচারী সম্রাটদের দুঃসাশন ও কুশাসনের নির্মম ও নিপীড়ণের চিত্রও কুরআনের পাতায় স্থান লাভ করেছে। পবিত্র কুরআনের এসব বাস্তব ঘটনা সর্বশক্তিশান ও মহাজ্ঞানবান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে।

জীবন-মৃত্যু সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘পুণ্যময় তিনি, যাঁর হাতে রাজত্ব, তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন। যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল’ (মুলক ৬৭/১-২)

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা ও তিনি সমস্ত কিছুর কর্মবিধায়ক। আকাশ ও পৃথিবীর চাবিও তাঁরই কাছে’ (যুমার ৩৯/৬২-৬৩)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তিনিই আসমান ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে, তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভাল কাজ করে’ (হূদ ১১/৭)

অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِيْنَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً- ‘আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে’ (কাহফ ১৮/৭)

অতঃপর মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ- ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫৯/৫৬)

মূলতঃ নভোমন্ডল-ভূমন্ডল, দৃশ্য-অদৃশ্য এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত অগণনীয় বস্ত্তর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহাজ্ঞানের এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন। এ চিত্রের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে আমরা রয়েছি। আর এসব সম্বন্ধে আমাদের যৎসামান্য ধারণা আছে মাত্র। যেমন আমাদের মাথার উপর মহাকাশ এবং সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ প্রভৃতি। এগুলির সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَخَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ- ‘মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না’ (মুমিন ৪০/৫৭)

এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقاً أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا- ‘তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না আকাশের, যা তিনি নির্মাণ করেছেন’ (নাযি‘আত ৭৯/২৭)

উপরোক্ত আয়াতগুলির বর্ণনায় জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের চেয়ে জড়শ্রেষ্ঠ আকাশের সৃষ্টিকে কঠিন বলা হয়েছে। মহান আল্লাহর এই বক্তব্যের মধ্যে গভীর জ্ঞানের বিষয় লুক্কায়িত আছে। আমরা মহাকাশের রহস্যপূর্ণ অবস্থান লক্ষ্য করে একটু গভীর চিন্তা করলে এবং মানব সৃষ্টির উপাদানগুলি একটু ব্যাখ্যা করলেই অনেকটা বুঝতে পারব। মানব তৈরী গগনস্পর্শী বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকাগুলির ভিত্তি ও ছাদে ব্যবহৃত উপাদান কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উচ্চ প্রযুক্তি দ্বারা নির্ণয় করা হয়, তা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে। অবশ্য সেগুলিতে অতি শক্তিশালী স্তম্ভ দ্বারা ছাদকে ও ছাদের উপাদানসমূহকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আর আকাশের সৃষ্টি তো আরও অত্যাশ্চর্য। আকাশ তো মহাশূন্যের বহু ঊর্ধ্বে নির্মিত একটি শক্তিশালী ছাদ। এত বিপুলায়তনের ছাদ একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষেই নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু যত বড় বস্ত্তই নির্মাণ করা হোক, তার জন্যে উপাদানের প্রয়োজন হবে। মানুষ তৈরী করতেও অনেক উপাদান ও মহামূল্যবান জ্ঞানের প্রয়োজন হয়েছে। এগুলি সম্পর্কে আমরা এখন কিছুটা ওয়াকিফহাল। কিন্তু আকাশ নির্মাণের উপাদান, তা সংযোজনের চিন্তা বা কল্পনা করাও মানব জাতির পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু আল্লাহর পক্ষে সহজ। কারণ তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। উপরের আয়াতগুলি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

আলোচনার শেষোক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি কঠিনতর’। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির উপাদান ও প্রযুক্তির চেয়ে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টি উপাদান ও প্রযুক্তি কঠিনতর, তাই তাদের সৃষ্টিও কঠিন। তার অর্থ এই নয় যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি আল্লাহর পক্ষে কঠিন। শুধু মানবজাতিকে আল্লাহর মহাশক্তি সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারণা প্রদানের নিমিত্তেই এ ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ আয়াতের অবতারণা।

আসলে মানুষ সৃষ্টি তো আল্লাহর একটি সুবিজ্ঞ পরিকল্পনা। আর মানুষের সরল পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্যে শয়তানের উদ্ভবও একটি রহস্যজনক পরিকল্পনা। যাহোক শয়তানের আবির্ভাব ও মানুষের উপর তার প্রাথমিক বিজয় কাহিনী সহ শত্রুতার অভিযান সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে অবহিত করেছেন। অতঃপর পৃথিবীর বুকে শয়তানের ঘৃণ্য কাজগুলি হ’তে বেঁচে থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার জন্যেই আহবান জানিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা। কারণ তিনি পৃথিবীকে মানুষের জন্য পরীক্ষাকেন্দ্র হিসাবে স্থাপন করেছেন। আর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তিনি মানব জাতির ইবাদতের ব্যবস্থা করেছেন। একই সঙ্গে ইবাদতে বাধা সৃষ্টির জন্য শয়তানকেও স্বাধীনতা দিয়েছেন।

মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর দ্বারা, অধম শয়তানের অদৃশ্য দোষসমূহের মোকাবিলা করাই ইবাদতের প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। শয়তানের কাজ হ’ল মানুষের গুণাবলীকে নষ্ট করে দিয়ে নিজের দোষগুলি তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। আর মানুষের কাজ হ’ল শয়তানকে প্রত্যাখ্যান করে নিজ গুণে মানুষ হিসাবে টিকে থাকা। যারা শয়তানকে পরাস্ত করে মানুষ হিসাবে টিকে থাকবে তারাই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দলভুক্ত হবে। আর যারা শয়তানের কাছে পরাস্ত হয়ে তার পরামর্শ ও পসন্দনীয় কাজ করবে তারা শয়তানের দলভুক্ত হয়ে যাবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা উভয় দলের কার্যাবলীর হিসাব নিবেন। অতঃপর অপরাধীদের শাস্তি দিবেন এবং সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যা কিছু আসমান সমূহে রয়েছে এবং যা কিছু যমীনে, সব আল্লাহর। যদি তোমরা মনের কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নিবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অতঃপর সীমালংঘনের পর যে তওবা করে এবং সংশোধিত হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহর নিমিত্তেই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য। তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ (মায়েদাহ ৫/৩৯-৪০)। ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ এ বাণীর অর্থ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হ’তে তাঁকেই একমাত্র নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে পাওয়া যায়। তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

পৃথিবীর রাজা-বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীগণ তাদের রাজ্য পরিচালনা করতে বেশ কিছু সংখ্যক মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আমাদের বাংলাদেশের মত একটা ছোট দেশেও ৩০/৩৫ জন মন্ত্রীর দরকার হয়। তাছাড়া বড় বড় কর্মকর্তাদের সংখ্যা তো আরো অনেক। এভাবে সমগ্র বিশ্ব প্রায় লক্ষ লক্ষ মন্ত্রী এবং কোটি কোটি বড় বড় কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসীম ও অনন্ত রাজত্বের অগণনীয় মানুষের অসংখ্য ধর্মের, বিভিন্ন মতাবলম্বীর, অগণনীয় ভাল-মন্দ কাজের, সত্যের সুফল, মন্দের শাস্তি, ন্যায়ের পুরস্কার, অন্যায়ের তিরস্কার, সুবিচারের প্রতিদান, অবিচারের প্রতিফল, বিশ্বাসের মহাপুরস্কার, অবিশ্বাসের কঠোর শাস্তি, বিবেকবানদের জন্য ক্ষমা ও সহানুভূতি, বিবেকহীনদের জন্য বিমুখতা ও নিষ্ঠুরতা, পুণ্যবানদের জন্য জান্নাত এবং পাপীদের জন্য জাহান্নাম লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। ক্বিয়ামতের দিন তিনি একাকী সমস্ত মানুষের হিসাব নিবেন এবং বিচার করবেন, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এজন্যেই পবিত্র কুরআনে বার বার ঘোষিত হয়েছে, ‘আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’।

রফীক আহমাদ

শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।






বিষয়সমূহ: সৃষ্টিজগৎ
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (২য় কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মানবাধিকার ও ইসলাম (৬ষ্ঠ কিস্তি) - শামসুল আলম
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সঠিক আক্বীদাই পরকালীন জীবনে মুক্তির উপায় - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (১ম কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (প্রথম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (শেষ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ছালাত পরিত্যাগকারীর ভয়াবহ পরিণতি (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.