পূর্ব ১ ।
(১৬) অনুধাবন করে কুরআন তেলাওয়াত করা :
সার্বিক জীবনে রহমত ও বরকত লাভ করার এবং হেদায়াতের তাওফীক্ব লাভ করার প্রধান মাধ্যমে হ’ল পবিত্র কুরআন। কুরআন হ’ল মানবজীবনের সংবিধান। কুরআনকে যত মযবূতভাবে ধারণ করা হবে, হেদায়াত ও নাজাতের পথ ততই নিষ্কণ্টক ও মসৃণ হবে। আল্লাহ বলেন,فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَاعْتَصَمُوا بِهِ فَسَيُدْخِلُهُمْ فِي رَحْمَةٍ مِنْهُ وَفَضْلٍ وَيَهْدِيهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا، ‘অতঃপর যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে ও তাঁর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে। অবশ্যই তিনি তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ ও কল্যাণের মধ্যে প্রবেশ করাবেন এবং তাদেরকে তাঁর প্রতি সরল পথ প্রদর্শন করবেন’ (নিসা ৪/১৭৫)।
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করে, তাঁর গুণাবলীর প্রতি পূর্ণ বিশ^াসী হয়, তাঁকে যাবতীয় অপূর্ণতা ও দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত মনে করে এবং কুরআনকে ধারণ করে তাঁর অভিমুখী হয়, আল্লাহ সেই সব বান্দার প্রতি খাছ রহমত বর্ষণ করেন, তাদের যাবতীয় কল্যাণের তাওফীক্ব দান করেন, তাদের উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করেন এবং অপসন্দনীয় বিষয়সমূহ থেকে তাদের দূরে রাখেন’। আর আয়াতের শেষে সরল পথের (صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا) ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, يوفقهم للعلم والعمل، معرفة الحق والعمل به، ‘তাদেরকে ইলম ও আমলের তাওফীক্ব দেন এবং হক্ব চেনার ও তদনুযায়ী আমল করার সক্ষমতা দান করেন’।[1]
এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হ’ল আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান রেখে কুরআন অনুধাবন ও তেলাওয়াতে আত্মনিয়োগ করতে হবে, নয়ত কুরআনের মাধ্যমে হেদায়াতের তাওফীক্ব নাও অর্জিত হ’তে পারে। কেননা আল্লাহ এই কুরআনের মাধ্যমে সবাইকে হেদায়াত দান করেন না; বরং কাউকে কাউকে এই কুরআনের মাধ্যমেই পথভ্রষ্ট করেন।[2] সুতরাং হৃদয়কে ঈমান ও তাক্বওয়ার স্বচ্চ সলিলে ধৌত করে কুরআন অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ কুরআন শুধু তেলাওয়াতের জন্য অবতীর্ণ হয়নি; বরং তা অনুধান করে সার্বিক জীবন গঠনের জন্য নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন, كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَاب،ِ ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا، ‘তবে কি তারা কুরআন অনুধাবন করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)।
ফখরুদ্দীন রাযী বলেন,فَإِنَّ مَنْ لَمْ يَتَدَبَّرْ وَلَمْ يَتَأَمَّلْ وَلَمْ يُسَاعِدْهُ التَّوْفِيقُ الْإِلَهِيُّ لَمْ يَقِفْ عَلَى هَذِهِ الْأَسْرَارِ الْعَجِيبَةِ الْمَذْكُورَةِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ الْعَظِيمِ، ‘যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে না এবং এলাহী তাওফীক্ব যাকে (কুরআন অনুধাবনে) সাহায্য করে না, সে এই কুরআনে উল্লিখিত বিস্ময়কর রহস্যের তত্ত্ব উদঘাটন করতে পারে না’।[3]
আর যারা কুরআনের মর্ম অনুধাবনের তাওফীক্ব লাভ করে, আল্লাহ এর মাধ্যমে তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেন। আর একজন বান্দার জীবনে সবচেয়ে দামী ও সম্মানিত বিষয় হ’ল ঈমান। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ، ‘মুমিন কেবল তারাই, যখন তাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করানো হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)।
শায়খ ইবনে উছায়মীন (রহঃ) বলেন, إذا رأيت من نفسك انك كلما تلوت القران ازددت إيمانا، فان هذا من علامات التوفيق، ‘যখন তুমি দেখবে যে, কুরআন তেলাওয়াতের সময় তোমার ঈমান বেড়ে যাচ্ছে, তবে মনে রেখ! সেটা তাওফীক্ব লাভের আলামত’।[4] সুতরাং প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত ও অনুধাবনের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা যরূরী। কুরআনের সাথে যার সম্পর্ক যত মযবূত হয়, তার ঈমান-আমল, জীবন-জীবিকা, পরিবার-পরিজন, ঘর-বাড়ি তত বেশী বরকত ও তাওফীক্বের ফল্গুধারায় সিক্ত হয়। আর যে ব্যক্তি কুরআন থেকে দূরে থাকে এবং কুরআনকে পরিত্যাগ করে, সে দুনিয়া ও আখেরাতের তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি ক্বিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার বিরুদ্ধে বাদী হবেন।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, من لم يقرأ القرآن فقد هجره، ومن قرأ القرآن ولم يتدبره فقد هجره، ومن قرأ القرآن وتدبره ولم يعمل به فقد هجره، ‘যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে না, সে কুরআনকে পরিত্যাগ করল। যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে, কিন্তু তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না, সেও কুরআনকে পরিত্যাগ করল। আর যে কুরআন তেলাওয়াত করল এবং তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করল, কিন্তু সেই অনুযায়ী আমল করল না, সে ব্যক্তিও কুরআনকে পরিত্যাগ করল’। তারা সবাই আল্লাহর সেই আয়াতে শামিল হবে, যেখানে তিনি বলেছেন,وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوْا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوْراً- ‘(সেদিন) রাসূল বলবে, হে আমার রব! আমার সম্প্রদায় তো এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)।[5] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,لَو علم النَّاس مَا فِي قِرَاءَة الْقُرْآن بالتدبر لاشتغلوا بهَا عَن كل مَا سواهَا، ‘মানুষ যদি জানতো অনুধাবন করে কুরআন তেলাওয়াতের মাঝে কি কল্যাণ নিহিত আছে, তাহ’লে তারা সকল কাজ ফেলে রেখে কুরআন পাঠে মশগূল হয়ে পড়ত’।[6]
(১৭) আল্লাহর কাছে দো‘আ করা ও তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করা :
দো‘আ শব্দের অর্থই হ’ল আল্লাহর কাছে তাওফীক্ব কামনা করা। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যতগুলো দো‘আ বর্ণিত হয়েছে, সব দো‘আর মাধ্যমেই মূলতঃ এলাহী তাওফীক্ব কামনা করা হয়। জান্নাত লাভ করা, জাহান্নাম ও কবরের আযাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, নেক আমল করা, কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে থাকা, নেককার স্ত্রী ও সন্তান লাভ করা, আয়-রূযীতে বরকত লাভ করা, শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রভৃতির তাওফীক্বের জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দো‘আ করে থাকি। তবে দো‘আ কবুলের শর্ত পূরণ করে দো‘আ করা যরূরী। কেউ যদি দ্রুত দো‘আ কবুলে প্রত্যাশা করে, তবে তাকে শিরক-বিদ‘আত সহ যবাতীয় পাপ থেকে পবিত্র থাকা আবশ্যক। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগীতে তৎপর থাকা অপরিহার্য। হালাল উপার্জন ও হালাল খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হওয়া এবং অপরের অধিকার আদায়ে পূর্ণ সচেতন থাকাও কর্তব্য।
আরেকটি ব্যাপার হ’ল আমাদের অনেকের মাঝে এই প্রবনতা আছে, আমরা শুধু অন্যের কাছে দো‘আ চাই। কিন্তু নিজের জন্য নিজে দো‘আ করি না। আবার অনেকে বলে, আমার উপর আমার মায়ের দো‘আ আছে, এই সূত্র ধরে সে আল্লাহর অবাধ্যতা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। সুতরাং এই বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা যরূরী।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,فَإِذا كَانَ كل خير فأصله التَّوْفِيق وَهُوَ بيد الله إِلَى نَفسك وَأَن لَا بيد العَبْد فمفتاحه الدُّعَاء والافتقار وَصدق اللجأ وَالرَّغْبَة والرهبة إِلَيْهِ ‘প্রত্যেক কল্যাণের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তাওফীক্ব, যা কেবল আল্লাহর হাতেই রয়েছে। কোন বান্দার হাতে নয়। আর এই কল্যাণের চাবিকাঠি হচ্ছে- দো‘আ করা, আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া, একনিষ্ঠতার সাথে তাঁর নিকটে আশ্রয়গ্রহণ করা, তাঁর প্রতি আগ্রহী হওয়া এবং তাঁর (শাস্তির) ব্যাপারে ভীত হওয়া’।[7]
এই পৃথিবীর সবাই এলাহী তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী। এমনকি নবী-রাসূলগণও তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী। সুলায়মান (আঃ) ক্ষমাতাধর পয়গাম্বর হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া ও নেক আমল করার তাওফীক্ব চেয়ে আল্লাহর কাছে কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করতেন। মহান আল্লাহ সেই দে‘আটি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন,رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ، ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ। আর যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পসন্দ কর এবং আমাকে তোমার অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নামল ২৭/১৯)।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আমাদের একটি সারগর্ভ দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই দো‘আটি সবচেয়ে বেশী পাঠ করতেন। দো‘আটি হ’ল,رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ، ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের ইহকালে কল্যাণ দাও ও পরকালে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও!’ (বাক্বারাহ ২/২০১)। ইবনু কুতায়বা প্রমুখ মুফাসসিরের মতে, এখানে দুনিয়ার কল্যাণ বলতে অল্প রিযিকে পরিতৃপ্ত থাকা, পাপ থেকে বিরত থাকা, সৎ কাজের তাওফীক্ব লাভ করা ও সৎ সন্তান প্রভৃতি বুঝানো হয়েছে।[8] ইমাম নববী বলেন,الْحَسَنَة فِي الدُّنْيَا أَنَّهَا الصِّحَّة والعافية وَفِي الْآخِرَة التَّوْفِيق للخير وَالْمَغْفِرَة، ‘দুনিয়ার কল্যাণ হ’ল সুস্থতা ও নিরাপত্তা। আর আল্লাহর ক্ষমা ও তাওফীক্ব হচ্ছে আখেরাতের কল্যাণ’।[9]
আবূস স‘ঊদ আল-ইমাদী (রহঃ) বলেন,الحسنة في الدنيا هي الصِّحةُ والكَفاف والتوفيقُ للخير في الاخرة هي الثوابُ والرحمة، ‘দুনিয়ার কল্যাণ হ’ল সুস্থতা, জীবিকার যাবতীয় উপকরণ ও কল্যাণের তাওফীক্ব। আর আখেরাতের কল্যাণ হ’ল আমলের প্রতিদান ও আল্লাহর দয়া’।[10] বান্দা যদি এই দো‘আ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তবে দেখতে পাবে যে, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে মানুষের যত চাওয়া-পাওয়া আছে, সবকিছুই এই দো‘আতে শামিল আছে। মহান আল্লাহ আমাদের যাবতীয় প্রয়োজনে এই সারগর্ভ দো‘আ পাঠে অভ্যস্ত করুন।
(১৮) তাওফীক্ব লাভের প্রচেষ্টা অব্যাহত করা :
এলাহী তাওফীক্ব লাভের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকা আবশ্যক। কেননা তাওফীক্ব এমনিতেই অর্জিত হয় না; বরং এর জন্য বান্দার কিছু করণীয় আছে। যেমন শুধু কামনা করলেই জান্নাত পাওয়া যায় না; বরং এটা লাভ করার জন্য শরী‘আতের নির্দেশনা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হয়। জাহান্নাম থেকে বাঁচার কামনা করলেই এর ভয়াবহতা থেকে বাঁচা যায় না; বরং এর জন্য বান্দার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা আবশ্যক। পার্থিব জীবনে প্রচেষ্টা ছাড়া কেউ সফলতার চূড়ায় পৌঁছতে পারে না। পরিশ্রমী ছাত্ররা ভালো রেজাল্ট করতে পারে, পরিশ্রমী ব্যবসায়ীরা সফল হ’তে পারে। অনুরূপভাবে যারা এলাহী তাওফীক্ব লাভের জন্য প্রচেষ্টা করে, আল্লাহ তাদেরকে এটা দান করেন।
আবুল লাইছ সামারকান্দী (রহঃ) বলেন,من يَدْعُو اللهَ تَعَالَى أَنْ يُوَفِّقَهُ لِلْخَيْرِ وَلَا يَجْتَهِدُ، لَمْ يَنْفَعْهُ دُعَاؤُهُ شَيْئًا، وَيَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَجْتَهِدَ لِيُوَفِّقَهُ اللهُ تَعَالَى، ‘যে ব্যক্তি কল্যাণের তাওফীক্ব চেয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আ করে, কিন্তু পরিশ্রম করে না, তার দো‘আ কোন কাজে আসে না। তার জন্য উচিত হবে যথাসাধ্য চেষ্টা করা, যাতে আল্লাহ তাকে তাওফীক দেন’। কেননা আল্লাহ বলেছেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ، ‘আর যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমরা আমাদের পথ সমূহের দিকে পরিচালিত করব। বস্ত্ততঃ আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)। অর্থাৎالَّذِينَ جَاهَدُوا فِي طَاعَتِنَا وَفِي دِينِنَا لَنُوَفِّقَنَّهُمْ لِذَلِكَ ‘যারা আমাদের আনুগত্য ও দ্বীনের ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবে, আমরা তাদের তাওফীক্ব দান করব’।[11] আব্দুল্লাহ ইবনুল মুক্বাফ্ফা‘ বলেন,وَالتَّوْفِيقُ وَالاجْتِهَادُ زَوْجٌ: فَالاجْتِهَادُ سَبَبُ التَّوْفِيقِ، وَبِالتَّوْفِيقِ يَنْجَحُ الاجْتِهَادُ، ‘তাওফীক্ব ও প্রচেষ্টা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত : চেষ্টা-প্রচেষ্টা হচ্ছে তাওফীক্ব লাভের কারণ আবার তাওফীক্বের মাধ্যমেই চেষ্টা করা সম্ভব হয়’।[12]
তাওফীক্ব লাভের আলামত :
বান্দা যখন এলাহী তাওফীক্ব লাভে ধন্য হয়, তখন তার মাঝে এর প্রভাব ফুটে ওঠে। যুন-নূন আল-মিছরী (রহঃ) বলেন, ثَلَاثَةٌ مِنْ عَلَامَاتِ التَّوْفِيقِ: الْوُقُوعُ فِي أَعْمَالِ الْبِرِّ بِلَا اسْتِعْدَادٍ لَهُ، وَالسَّلَامَةُ مِنَ الذَّنْبِ مَعَ الْمَيْلِ إِلَيْهِ، وَقِلَّة الْهَرَبِ مِنْهُ، وَاسْتِخْرَاجُ الدُّعَاءِ وَالِابْتِهَالِ، وَثَلَاثَةٌ مِنَ عَلَامَاتِ الْخِذْلَانِ: الْوُقُوعِ فِي الذَّنْبِ مَعَ الْهَرَبِ مِنْهُ، وَالِامْتِنَاعُ مِنَ الْخَيْرِ مَعَ الِاسْتِعْدَادِ لَهُ، وَانْغِلَاقُ بَابِ الدُّعَاءِ وَالتَّضَرُّعِ، ‘তাওফীক্ব লাভের আলামত তিনটি : (ক) কোন প্রস্ত্ততি ছাড়াই নেক আমল সমূহে আত্মনিয়োগ করতে পারা, (খ) পাপের প্রতি ঝোক এবং তা থেকে দূরে থাকার সম্ভাবনা কম থাকা সত্ত্বেও গুনাহ থেকে নিরাপত্ত্বা লাভ করা, (গ) আল্লাহর কাছে অধিক দো‘আ ও কাকুতি-মিনতি করতে পারা। অপরদিকে ব্যর্থতা বা তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার আলামত তিনটি : (ক) পাপ থেকে দূরে থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাপে জাড়িয়ে পড়া, (খ) প্রস্ত্ততি থাকা সত্ত্বেও ভালো কাজ করতে না পারা এবং (গ) দো‘আ ও বিনীত হওয়ার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া’।[13]
এছাড়াও ওলামায়ে কেরাম তাওফীক্ব হাছিলের আরো কিছু আলামতের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমল করতে পারা, খুব সহজেই নেকীর কাজ করতে পারা, আখেরাতের কাজে সময় ব্যয় করতে পারা, সকল কাজে খুলূছিয়াত বজায় রাখতে পারা, মনে-প্রাণে সর্বদা আল্লাহর যিকিরে অভ্যস্ত হ’তে পারা, পাপ করার পরেই তওবা করতে পারা, অপর মুসলিমের উপকার করতে পারা ইত্যাদি।
তাওফীক্বের দরজা বন্ধ হওয়ার কারণ :
কেউ যদি ঘরে বাহিরের আলো-বাতাস পেতে চায়, তবে তাকে ঘরের জানালা-দরজা খুলে রাখতে হয়। বাইরের পরিবেশ যতই মনোরম ও আলোকিত হোক না কেন, জানালা-দরজা বন্ধ থাকলে ঘরের ভিতর আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারবে না। অনুরূপভাবে জীবন জুড়ে তাওফীক্ব অর্জন করতে হ’লে তাওফীক্বের দরজা সবসময় খোলা রাখতে হবে।
শাক্বীক্ব ইবনে ইবরাহীম (রহঃ) বলেন, أُغلِقَ بابُ التوفيق عن الخلق من ستة أشياء: اشتغالهم بالنعمة عن شكرها، ورغبتهم في العلم وتركهم العمل، والمسارعة إلى الذنب وتأخير التوبة، والاغترار بصحبة الصالحين وترك الاقتداء بفعالهم، وإدبار الدنيا عنهم وهم يتبعونها، وإقبال الآخرة عليهم وهم معرضون عنها، ‘ছয়টি কারণে সৃষ্টিকূলের উপর থেকে তাওফীক্বের দরজা বন্ধ রাখা হয় : (১) শুকরিয়া আদায় না করে আল্লাহর নে‘মতরাজিতে বুঁদ হয়ে থাকা, (২) শুধু ইলম চর্চায় নিবিষ্ট থাকা। কিন্তু (সেই ইলম অনুযায়ী) আমল না করা, (৩) গুনাহের দিকে ধাবিত হওয়া এবং তওবা করতে বিলম্ব করা, (৪) নেককার লোকের সঙ্গ দ্বারা প্রতারিত হওয়া এবং তাদের কর্মের অনুকরণে অবহেলা করা, (৫) দুনিয়া তাদের থেকে প্রস্থান করা সত্ত্বেও এর দিকে অনুগামী হওয়া এবং (৬) আখেরাত তাদের সম্মুখে আসা সত্ত্বেও এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া’।[14] আমাদের জীবনে যাবতীয় দুর্গতি এবং তাওফীক্বহীনতার সবগুলো কারণ মোটা দাগে এই ছয়টির মধ্যেই রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
আবুল লাইছ সামারকান্দী (রহঃ) বলেন,يصل إلى الحاسد خمس عقوبات قبل أن يصل حسده إلى المحسود : غم لا ينقطع، مصيبة لا يؤجر عليها، مذمة لا يحمد عليها، سخط الرب، يغلق عنه باب التوفيق، ‘যাকে হিংসা করা হয় তার কাছে হিংসা পৌঁছার আগেই হিংসাকারী পাঁচটি শাস্তি পায় : (১) অন্তহীন টেনশন, (২) প্রতিদানবিহীন বালা-মুছীবত, (৩) প্রশংসাহীন নিন্দা-ভৎর্সনা, (৪) প্রতিপালকের অসন্তুষ্টি এবং (৬) তার থেকে তাওফীক্বের দরজা বন্ধকরণ’।[15]
এছাড়াও তাওফীক্বের দরজা বন্ধ হওয়ার আরো কিছু কারণ আছে। যেমন- আল্লাহর ইবাদত ও যিকির থেকে গাফেল থাকা, রিয়া বা লৌকিকতা, প্রবৃত্তিপরায়ণতা, পাপাচার, অহংকার, অলসতা ইত্যাদি। শামসুদ্দীন সাফ্ফারীনী (রহঃ) বলেন,مَنْ اعْتَرَضَ عَلَى اللهِ فَقَدْ عَدِمَ التَّوْفِيقَ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ বিমুখ হয়, সে তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হয়’।[16]
উপসংহার :
তাওফীক্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক ধরনের গায়েবী সাহায্য। প্রত্যেক বান্দা প্রতিটি মুহূর্তে এলাহী তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী। এটা ছাড়া বান্দার সফলতা কল্পনা করা যায় না, চাই সেটা দ্বীনের ক্ষেত্রে হোক বা দুনিয়ার ব্যাপারে হোক। সেজন্য সর্বদা তাওফীক্ব লাভের উপায় অবলম্বন করা অপরিহার্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদের উভয় জীবন তাওফীক্বের বারিধারায় সিক্ত করুন। আমাদের জন্য সর্বদা তাওফীক্বের দুয়ার উন্মুক্ত রাখুন। তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার সকল রাস্তা বন্ধ করে দিন। আমাদের সার্বিক জীবন কল্যাণময় করুন। দুনিয়াতে ছিরাতে মুস্তাক্বীমে অটল থেকে পরকালে জান্নাতুল ফেরদাঊস হাছিলে তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২১৭।
[2]. সূরা বাক্বারাহ ২/২৬।
[3]. ফখরুদ্দীন রাযী, মাফাতীহুল গাইব (তাফসীরে রাযী) ২৬/৩৮৯।
[4]. শারহু রিয়াযিছ ছালিহীন ১/৫৪৫।
[5]. আবূ যর ক্বালামূনী, ফাফির্রূ ইলাল্লাহ, পৃ:২৯৫; ই‘লামুল আছহাব, পৃ: ৬০৬।
[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাত ১/১৮৭।
[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১/১৪১।
[8]. আবূ হাইয়ান আন্দালুসী, আল-বাহরুল মুহীত্ব ২/৩১০।
[9]. শাওকানী, তুহফাতুয যাকিরীন, পৃ. ৪৫৭।
[10]. তাফসীরে আবিস স‘ঊদ (ইরশাদুল আক্বলিস সালীম) ১/২০৯।
[11]. আবুল লাইছ সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফিলীন, পৃ. ২৬।
[12]. আল-আদাবুছ ছাগীর, পৃ. ৫৯।
[13]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান ১/৩৭০।
[14]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১/২৫৮।
[15]. শিহাবুদ্দীন আবশীহী, আল-মুস্তাত্বরাফ, পৃ. ২২১; মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব ২/২২১।
[16]. সাফ্ফারীনী, গিযাউল আলবাব ২/৫৬০।