আল্লাহ
তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। এটা আসমানী কিতাব
আল-কুরআনে বিঘোষিত হয়েছে। এজন্য পৃথিবীতে মানবের বংশ বিস্তারের
প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের কারণে নর এবং নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পুরুষ এবং
নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মানব বংশ বিস্তার করবে। আল্লাহ তা‘আলা অপূর্ব
কৌশলে পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যে একটা আকর্ষণীয় শক্তি দিয়েছেন। তা না দিলে
সৃষ্টি প্রক্রিয়া অকার্যকর হ’ত। চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু অন্য
ধাতুকে আকর্ষণ করে না। তাহ’লে বলতেই হবে যে লোহারও আকর্ষিত হবার গুণ রয়েছে।
এটাই সঠিক যে, পুরুষ আকৃষ্ট হয় নারীর প্রতি, আর নারী আকৃষ্ট হয় পুরুষের
প্রতি। তথাপি এটাই সত্য যে, নারীর প্রতি পুরুষই অধিক আকর্ষণ বোধ করে।
মানসিকভাবে পুরুষই নারীর প্রতি অধিক দুর্বল। আদম (আঃ) হাওয়া (আঃ)-এর অনুরোধ
উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই তিনি হাওয়ার অনুরোধে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ
করেছিলেন। এটা শুধু আদি মানবের বেলাতে ঘটেছিল তা নয়, আজও এরূপ ঘটতে দেখা
যায়।
নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা প্রতিহত করতেই নারীর জন্য পর্দা ফরয করা হয়েছে। নির্দিষ্ট কয়েকজন পুরুষ ব্যতীত অন্যান্য পুরুষের সংগে নারীর দেখা-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনের বিধান। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি আল্লাহর অহী, ‘মুমিনা নারীগণকে বল, তারা যেন তাদের আপন দৃষ্টি সংযত রাখে, আপন লজ্জাস্থান রক্ষা করে চলে, প্রকাশ না করে তাদের বেশ-ভূষা এবং অলংকার ততটুকু ব্যতীত, যতটুকু সাধারণতঃ প্রকাশমান এবং আপন চাদর গলা ও বুকের উপর জড়িয়ে দেয় এবং প্রকাশ না করে তাদের সাজ-সজ্জা তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের পুত্র, স্বামীর পুত্র, সহোদর ভাই, ভাইয়ের পুত্র, ভাগিনা অথবা তাদের নারীগণ, তাদের অধীনস্থ গোলাম অথবা কামপ্রবৃত্তিহীন গোলাম অথবা সেই সকল শিশু যারা নারীর গোপন বিষয় সম্পর্কে জানে না এদের নিকট ব্যতীত। আর নারীরা যেন তাদের পা এমন জোরে না ফেলে, যা দ্বারা তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ পায়’ (নূর ৩১)।
কুরআন মাজীদে আরও বলা হয়েছে, ‘হে নবীর বিবিগণ তোমরা সাধারণ নারীর মত নও, যদি তোমরা পরহেযগার হও, তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলবে না, তাহ’লে যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারা তোমাদের প্রতি কু-বাসনা করবে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে আর গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে এবং পূর্বের মূর্খতার যুগের ন্যায় নিজেদের প্রদর্শন করবে না’ (আহযাব ৩২-৩৩)।
আল্লাহ তা‘আলা জানেন, তারা যা মনের মধ্যে গোপন রাখে। নারীদের সৌন্দর্য এবং মধুর বাক্য পুরুষের অন্তরে রোগের সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (ছাঃ)-কে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন ‘হে নবী! তুমি নিজের বিবিদেরকে ও কন্যাদেরকে এবং মুমিন গণের নারীদেরকে বল যেন তারা নিজেদের চাদর মাথার উপর কিছুটা টেনে নেয়, এতে তাদেরকে চিনতে সুবিধা হবে, ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না’ (আহযাব ৫৯)।
অতএব নারীদের সঙ্গে পুরুষের সাবধানতা রক্ষা করে চলা কর্তব্য। নইলে অঘটন ঘটা স্বাভাবিক, যা ধর্ম এবং নীতির নিরিখে বৈধ নয়। এ কারণেই নারীর প্রতি পর্দার আদেশ। পর্দা নারীর বর্ম স্বরূপ। তার সুরক্ষার জন্য, পাপ ও পতন থেকে রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ ধর্মে আল্লাহ মানুষের জন্য যে সকল আচরণবিধি নির্দেশ করেছেন, তা সবই মানুষের শান্তি, মঙ্গল এবং সুশৃংখল জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে। তার ব্যতিক্রম হ’লে ইহকালে অশান্তি, পরকালে কঠিন আযাব অবধারিত। আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে শান্তি-শৃংখলার সঙ্গে বসবাস এবং তাঁর ইবাদত করতে পারে সেই লক্ষ্যে কুরআন মাজীদের মাধ্যমে বিধি-বিধান জারী করেছেন। মহানবী (ছাঃ) কুরআনের আলোকে শরী‘আ আইন প্রচার করেছেন। সবই মানব কল্যাণের নিমিত্তে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা পোষাক সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি পোষাক নাযিল করেছি তোমাদের লজ্জা নিবারণের জন্য এবং শোভার জন্য। আর পরহেযগারীর পোষাকই উত্তম। ইহা আল্লাহর মহিমার নিদর্শন, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে’ (আ‘রাফ ২৬)।
পোষাক লজ্জা নিবারণের জন্য। আর পরহেযগারীর পোষাককে উত্তম বলা হয়েছে। পরহেযগারীর পোষাক মানে আল্লাহ নির্দেশিত পোষাক, যার নমুনা আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশনাতেই পেয়ে থাকি। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নিদর্শন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নারীর সতর-এর সীমা পুরুষ থেকে ভিন্ন এবং পোষাকও ভিন্ন। আর পর্দাও নারীর পোষাকের অন্তগর্ত।
এক সময়ে নারীর পোষাকে ভিন্নতা সকল দেশ ও জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল। সম্ভবতঃ পাশ্চাত্যের ইহুদী-খৃষ্টান সমাজই প্রথম নারীর পোষাক খর্ব করেছে। সেই সমাজে পুরুষের চাইতেও নারীদের পোষাকে অধিক খর্বতা পরিদৃশ্য হয়, যা অত্যন্ত আপত্তিকর। ঐ সকল দেশের ধর্মীয় নেতারাও তাতে হস্তক্ষেপ করছেন না। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, সেকালে তাদের পরিবারের নারীদেরও পর্দা মেনে চলতে হ’ত। জানা যায়, সেকালে অভিজাত হিন্দু পরিবারে নারীদের জন্য পর্দার ব্যবস্থা ছিল, যদিও তা পুরোপুরি ইসলাম সমর্থিত কায়দায় নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলাদেশের রংপুর যেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়। তিনি একজন লেখিকাও ছিলেন। মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার পথিকৃৎ হিসাবে তিনি পরিচিত। জানা যায়, তিনি নিজে পর্দা মেনে চলতেন। কিন্তু তিনি লেখনী চালনা করতেন পর্দার বিরুদ্ধে। পর্দাকে তিনি অবরোধ বলেছেন। পর্দাকে তিনি নারী শিক্ষার অন্তরায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘অবরোধবাসিণী’ নামে তিনি একটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাতে পর্দা তথা বোরক্বা নিয়ে অনেক ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে। বেগম রোকেয়ার বাল্য জীবনের কাহিনী থেকে জানা যায়, সেকালে মুসলমান সমাজে পর্দা নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল। তা সত্যি হ’তে পারে। আবার রোকেয়ার পর্দাবিরোধী রচনাতেও যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, তাও সত্যি। তার রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম সমাজে পরবর্তী সময়ে পর্দা ভাঙ্গার হিড়িক লেগে যায়। মানুষের চিন্তা-চেতনাতেও পর্দা বিভীষিকার রূপ নেয়। বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল হোসেনও এক সময়ে লিখেছিলেন, আকাশের বিদ্যুৎকে ধরে এনে পরিয়ে দেয় বোরক্বা। নারীরা যদি হয় বিদ্যুৎ, তাহ’লে তাকে অবশ্যই একটি আবরণের মধ্যে আবৃত রাখতে হবেই, নতুবা সর্বনাশের সম্ভাবনা। আমরা বিদ্যুৎতের ক্ষেত্রে অহরহ এ ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি।
অধুনা আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী পর্দা মেনে চলছে না। কেউ কেউ বা পুরোপুরি পাশ্চাত্যের ইহুদী-খৃষ্টান রমণীদের মতো বেপর্দায় চলাফেরা করছে। এরা ব্যভিচার ছড়াচ্ছে, এইডস সহ বিভিন্ন ঘাতক ব্যাধির জন্ম দিচ্ছে। বেপর্দার কারণে সমাজে নিয়ম-শৃংখলা বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের দেশে নারী ধর্ষণ ও অপহরণের কারণও বেপর্দা চলাফেরা। অবশ্য অন্য কারণও রয়েছে। তবে পর্দাহীনতাই অন্যতম।
পর্দাহীনা নারীরা সীমালংঘনকারিণী। তারা ধর্ম বিধি মানে না বলে তাদেরকে স্বেচ্ছাচারিণী হ’তে দেখা যায়। ফলে সমাজের শান্তি-শৃংখলা এবং পবিত্রতা হরণ হয়। পর্দার খেলাফ হ’লে তা অশান্তি, বিশৃংখলা এবং অপবিত্রতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা নিষিদ্ধ বিধায় তা আল্লাহ তা‘আলার রোষের কারণ হয়ে দেখা দেয়। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে মানুষের ইহকালেও নিরবচ্ছিন্ন সুখ হবে না এবং পরকালেও ভোগ করতে হবে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। অতএব কালক্ষেপণ না করে সাবধানতা অবলম্বন যরূরী। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
সম্পাদক, কালান্তর, রাজাবাড়ী, পিরোজপুর।