১.
العلم إن طلبته كثير والعمر عن تحصيله قصير فقدمِ الأهم منه فالأهم
‘জ্ঞানার্জনের বিষয়বস্ত্ত অসীম। কিন্তু মানুষের বয়স সসীম। তাই জ্ঞানার্জনের
জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেই অগ্রাধিকার দাও’।
২. الحق ثقيل فلا نثقله بأسلبونا ‘হক স্বভাবতই ভারী। সুতরাং আমরা আমাদের পদ্ধতি দ্বারা (দাওয়াতী ময়দানে কঠোরতা অবলম্বন করে) তাকে আরো ভারী করতে পারি না’।
৩. خير الأمور الوسط، وحب التناهي غلط ‘সর্বাধিক কল্যাণকর হ’ল মধ্যপন্থা অবলম্বন। চরমপন্থার প্রতি আকর্ষণটা ভূল।
৪. العلم لا يقبل الجمود ‘জ্ঞান কখনও স্থবিরতাকে গ্রহণ করে না’ (কেননা তা গতিশীল)।
৫.طالب الحق يكفيه دليل واحد، و صاحب الهوى لا يكفيه ألف دليل، الجاهل يُعلّم، وصاحب الهوى ليس لنا عليه سبيل. ‘সত্যাসন্ধানীর জন্য একটি দলীলই যথেষ্ট। আর প্রবৃত্তিপূজারীর জন্য হাযার দলীলও কাজে আসে না। অজ্ঞ ব্যক্তিকে শিক্ষাদান করা যায়। কিন্তু প্রবৃত্তিপূজারীর জন্য আমাদের কিছু করার নেই’।
৬. السَّعيد من وُعظ بغيره ‘সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ প্রাপ্ত হয়’।
৭.طريق الله طويل.. ونحن نمضي فيه كالسلحفاة.. وليس الغاية أن نصل لنهاية الطريق.. ولكن الغاية أن نموت علي الطريق..
‘আল্লাহর পথ সুদীর্ঘ। আমরা সেখানে কচ্ছপের ন্যায় পরিভ্রমণ করছি। পথের শেষ সীমায় পৌঁছতে হবে এটা আমাদের লক্ষ্য নয়; বরং মৃত্যু অবধি পথের উপর টিকে থাকাই আমাদের লক্ষ্য’।
৮. শায়খ আলবানীর গাড়িটি ছিল তাঁর দ্বীনী ভাইদেরও বাহন। তিনি এই গাড়িতে করে বন্ধুদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া বা নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করতেন। এর কারণ সম্পর্কে একদিন তিনি তাঁর সাথীকে বলেন, হে মুহাম্মাদ! আমার পিতা বলতেন, لكل شيء زكاة، وزكاة السيارة حمل الناس بها ‘প্রত্যেক বস্ত্তর যাকাত রয়েছে। আর গাড়ির যাকাত হ’ল মানুষকে বহন করা’।
৯. দাওয়াতী নীতি প্রসঙ্গে :
(ক) আমাদের দাওয়াত ৩টি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) কুরআন (২) হাদীছ (৩) সালাফে ছালেহীনের অনুসরণ। যে ব্যক্তি মনে করবে যে, সে কেবল কুরআন ও হাদীছের অনুসরণ করবে। কিন্তু সালাফে ছালেহীনের মাসলাক অনুসরণ করবে না এবং বলবে যে, তাঁরাও মানুষ আমরাও মানুষ (তাই তাদের অনুসরণের প্রয়োজন নেই); সে গোমরাহীতে নিপতিত হবে।
(খ) সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা অনুযায়ী আমরা মানুষের উপর কোন শারঈ আধিপত্য চাপিয়ে দিতে চাই না। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছেন, ‘তুমি তাদের উপর দারোগারূপে প্রেরিত হওনি’ (গাশিয়া ৮৮/২২)। সুতরাং আমরাও মানুষের উপর দারোগার ভূমিকায় অবতীর্ণ হ’তে পারি না। বরং আমরা সকলকে সেই বাক্যটিই বলতে চাই, ألْقِ كلمتَك وأَمشِ ‘তুমি তোমার বক্তব্য পেশ কর, অতঃপর চলে যাও’। তোমার মত অনুযায়ী পরিচালনার জন্য মানুষের উপর তরবারি দিয়ে ক্ষমতা বিস্তার করার অধিকার তোমার নেই। কারণ হক-এর নীতি হ’ল, الحق أبلج والباطل لَجْلَج ‘হক সর্বদা সুস্পষ্ট আর বাতিল অস্পষ্ট ও বক্রতাপূর্ণ’। আর সুনিশ্চিতভাবেই একথাটি দুনিয়ার সর্বাধিক সত্য বাক্য لا إله إلا الله -এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(গ) দাঈকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যখন সে বুঝবে যে, তার প্রতিপক্ষ স্বীয় মতের উপর এমনই কঠোর, যে তার সাথে বিতর্কে যেয়ে কোন লাভ নেই এবং যদি সে ধৈর্য নিয়ে বিতর্ক চালিয়ে যেতে থাকে, তবে হয়ত অনাকাংখিত কিছু ঘটে যাবে, তখন বিতর্ক পরিত্যাগ করাই তার জন্য উত্তম হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া পরিত্যাগ করে, আমি জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহের যিম্মাদার হব’ (আবূদাঊদ হা/৪৮০০)।
(ঘ) রাসূল (ছাঃ) বলেন, إن بني إسرائيل لما هلكوا قصوا ‘নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলগণ কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনায় লিপ্ত হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়েছিল’ (ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/১৬৮১)। এ হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ আলবানী বলেন, সম্ভবত এটা এ কারণে বলা হয়েছে যে, তাদের আলেম ও বক্তাগণ জনগণকে ফিকহ এবং উপকারী জ্ঞানের পরিবর্তে অলীক কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনাকে গুরুত্ব দিয়েছিল এবং এই কাজকেই নেকআমল গণ্য করা শুরু করেছিল। ফলে তারা ধ্বংসে নিপতিত হয়েছিল। আজকের যুগের বহু গল্পকার বক্তাদেরও একই অবস্থা। যাদের অধিকাংশ বক্তব্যের বিষয়বস্ত্ত হ’ল ইসরাঈলী গাল-গল্প, হৃদয় গলানো বক্তব্যসমূহ এবং ছূফী ধ্যানধারণাভিত্তিক অলীক কাহিনী।
১০. ইসলামী খেলাফত প্রসঙ্গে :
بدون هاةين المقدّمةين: العلم الصحيح، والةربية الصحيحة على هذا العلم الصحيح يستحيل - في اعتقادي - أن تقوم قائمة الإسلام، أو حكم الإسلام، أو دولة الإسلام-
(ক) ‘আমার মতে, প্রাথমিক দু’টি বিষয় অর্থাৎ শরী‘আতের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন এবং উক্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিক প্রশিক্ষণ ব্যতীত ইসলামের প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিংবা ইসলামী শাসন বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব’ (আলবানী, আত-তাছফিয়াহ ওয়াত তারবিয়াহ পৃঃ ৩১)।
(খ) আধুনিক যুগের একজন প্রখ্যাত দাঈ শায়খ হাসানুল বান্নার পরে যিনি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের মুর্শিদে ‘আম কাযী হাসান হুযায়মী (১৮৯১-১৯৭৩ইং)-এর একটি মন্তব্য শায়খ আলবানী খুবই পসন্দ করেছিলেন। তার বিভিন্ন গ্রন্থে উক্তিটি লক্ষ্য করা যায়। সেটি হ’ল- أقيموا دولة الإسلام في قلوبكم، تقم لكم في أرضكم- ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে প্রথম ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কর, তবেই তোমাদের রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে’। তিনি বলেন, ‘এটি খুবই সুন্দর একটি মন্তব্য। আর তদনুযায়ী কাজ করা তার চেয়ে আরো সুন্দর’ (সিলসিলা যঈফাহ, মুকাদ্দামা)। শায়খ আলবানী তাঁর এই বক্তব্যকে অন্য স্থানে ‘এটা যেন আসমানী অহী-র ন্যায় যথার্থ’ বলে মন্তব্য করেছেন (আত-তাছফিয়াহ ওয়াত তারবিয়াহ পৃঃ ৩৩)।
(গ) رأينا في هذا الزمان أن من السياسة ةرك السياسة ‘আমি মনে করি এ যুগে (প্রচলিত) রাজনীতি পরিত্যাগ করাই হ’ল রাজনীতি’।
১১. আদব-আখলাক প্রসঙ্গে :
(ক)كنت أظن بأن مشكلة المسلمين عقائدية فقط، فتبين لي فيما بعد بأنها أخلاقية أيضا ‘আমি ধারণা করতাম মুসলমানদের সমস্যা কেবলমাত্র আক্বীদাগত। কিন্তু এখন আমার কাছে স্পষ্ট যে, এর সাথে নৈতিক বা চারিত্রিক সমস্যাও একটি বড় সমস্যা’।
(খ) শেষ যামানার আমাদের মুসলমানদের মাঝে যদিও ইলমী জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে; কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, এর সাথে নৈতিক ও চারিত্রিক জাগরণ সৃষ্টি হচ্ছে না। আমাকে দোষারোপ করো না যদি তোমাদের বলি যে, এই মজলিসে তোমরা যখন প্রবেশ করছিলে তখন খুব হুড়োহুড়ি ও গোলযোগ সৃষ্টি করছিলে। আমি তোমাদের বলব, এটা ইসলামী চরিত্র নয়। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য অপরিহার্য যে, ইলমী জাগরণের সাথে সাথে আমাদের চারিত্রিক দিকটিতেও যেন জাগরণ পরিলক্ষিত হয়।
(গ) একদিন আলবানী সালাফী দাওয়াতের ক্ষেত্রে কিছু রোগের সংক্রমণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আমাদের মাঝে কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যারা আক্বীদাগত দিক থেকে সালাফী মানহাজকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে চারিত্রিক দিক দিয়ে তারা মোটেও সালাফী নন।
১২. গণতন্ত্র প্রসঙ্গে :
فالديمقراطية والإسلام نقيضان لا يجتمعان، إما الإيمان بالله والحكم بما أنزل الله، وإما الإيمان بالطاغوت والحكم به وكل ما خالف شرع الله فهو طاغوت.. (مجلة الأصالة، العدد ٢ ص : 24)
(ক) ইসলাম ও গণতন্ত্র দুটো বিপরীতমূখী ব্যবস্থা। যা কখনো একত্রিত হ’তে পারে না। একটি হ’ল আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও তিনি যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী শাসন করা। অপরটি হ’ল ত্বাগূতের উপর বিশ্বাস ও তদনুযায়ী শাসন করা। আর যেটাই আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী, সেটাই ত্বাগূত।
لو كانت الديمقراطية تعني معنى إسلاميًا صرفًا لا غبار ولا شائبة عليه نحن لا نجيز أن نسمي معنى شرعيا بلفظ كافر أجنبي-
(খ) আর গণতন্ত্র যদি কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ না রেখে খালেছ ইসলামী অর্থও বহন করত, তবুও একটি অপরিচিত কুফরী অর্থবোধক শব্দকে শারঈ অর্থে নামকরণ করা আমরা সিদ্ধ বলতাম না।
১৩. চরমপন্থী খারেজীদের উদ্দেশ্যে :
(ক) কিভাবে তোমরা ইলাহী শরী‘আত বাস্তবায়নের আহবান জানাচ্ছ, অথচ প্রথমে তোমরা নিজেরাই আল্লাহর হুকুম লংঘন করছ? কিভাবে তোমরা ভ্রষ্টতা, প্রবৃত্তিপরায়ণতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষগুলোর উপর ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়ন করবে? মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আনীত দ্বীন ইসলামের বাস্তবতা সম্পর্কেই তো তারা অজ্ঞতায় ঢাকা পড়ে রয়েছে। আল্লাহ তোমাদের কাছে যা চেয়েছেন তা হ’ল, তোমরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিক জীবনে ইসলামের হুকুম জারী কর।
১৪. কম্পিউটার প্রসঙ্গে :
(ক) الكمبوتر يجعل طالب العلم بليدا ‘কম্পিউটার জ্ঞান অন্বেষণকারীকে অলস বানিয়ে দেয়’।
(খ) শেষ জীবনে আলবানী কম্পিউটার সম্পর্কে তাঁর মতামত পরিবর্তন করেছিলেন। যেমন জনৈক ব্যক্তি তাকে ইলমে হাদীছে কম্পিউটারের ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি মনে করি ব্যবহারকারী যদি হাদীছ শাস্ত্রের একজন আলেম হন, তাহ’লে তার জন্য কম্পিউটার আধুনিক যুগে মুসলিম উম্মাহর নিকটে হাদীছে নববীকে পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হবে। আর ব্যবহারকারী যদি হাদীছ শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ হন, তাহ’লে সেটা হবে অন্ধকার রাতে দিশাহীন পথিকের মত। তাদের অবস্থা হবে ঐসব (অযোগ্য) লোকের মত যারা ইদানীংকালে হাদীছশাস্ত্র নিয়ে লিখছে এবং তাদের জন্য ঐ প্রবাদ বাক্যটি প্রযোজ্য হবে যেটি আমি প্রায়ই বলে থাকি, أنه تزبب قبل أن يتحصرم অর্থাৎ ‘আঙ্গুর পাকার আগেই সে কিসমিস হয়ে গেছে’ (অর্থাৎ কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের পূর্বেই যোগ্যতা হাছিলের দাবী করা। বাংলায় যাকে বলে ‘ইঁচড়ে পাকা’)।
১৫. ওলামায়ে কেরামের প্রতি সম্মান :
(ক) শায়খ আহমাদ সালেক শানক্বীত্বী (১৯২৮-২০১০ইং)-কে শায়খ আলবানী খুবই সম্মান করতেন। তাঁর কাছে কোন ফৎওয়া আসলে কোন কোন সময় তিনি শায়খ শানক্বীত্বীর কাছে জিজ্ঞেস করতেন। একবার তিনি বলছিলেন, أشتري مجالسة السالك بالذهب ‘আমি সালেকের সাথে বসাকে স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রয় করব’। এছাড়াও তিনি তাঁকে জর্দানের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ফকীহ বলে আখ্যায়িত করতেন।
(খ) তাঁর ছাত্র ইছাম হাদী বলেন, আমি একদিন শায়খ আলবানীকে শায়খ আরনাউত্বের নাম উচ্চারণ না করে তাকে সর্বদা ‘الإحسان في تقرير صحيح ابن حبان-এর তা‘লীক প্রদানকারী’ বলার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমি শায়খ শু‘আইব আরনাউত্ব সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করি তাতে তিনি এরূপ ভুল করতে পারেন না। আমার বিশ্বাস এটা তাঁর অধীনে যারা কাজ করে তাদের ভুল। তবে যখনই আমার ধারণা হবে যে, এটা শু‘আইব আরনাউত্বেরই ভুল, কেবল তখনই আমাকে তাঁর নাম উল্লেখ করতে দেখবে।
১৬. ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক :
(ক) শায়খ আলবানী স্বীয় ছাত্রদেরকে খুবই ভালোবাসতেন। তাদেরকে সবসময় إخواني বা ‘আমার ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করতেন। ইছাম হাদী বলেন, আমাকে তিনি বহুদিন বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ما رأيك يا أسةاذ في هذه المسألة ‘হে উস্তায! এই মাসআলায় তোমার মত কি?’
(খ) তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্র শায়খ মাশহূর হাসান সম্পর্কে সিলসিলা ছহীহাহর ৫০০ নং হাদীছে একটি বিষয় উল্লেখ করার পর বলেছেন, আমি এ বিষয়টি গ্রহণ করেছি বিশিষ্ট ভাই মশহূর হাসান কৃত خلافيات للبيهقي গ্রন্থের তাহকীক থেকে। আল্লাহ তাকে উক্ত তাখরীজ কর্মটি পূর্ণভাবে সম্পন্ন করার তাওফীক দান করুন এবং পাঠকদের জন্য উপকারী করে দিন’। এছাড়া তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন স্থানে তার ছাত্রসহ অনেক আলেমের নাম উল্লেখ করে তাদের জন্য দো‘আ করেছেন, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন।
(গ) ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সময়ে ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল তা তাঁর বক্তব্যে ফুটে ওঠে। তিনি একবার বলেছিলেন,بلغ من تعلق الطلاب بي أنني عندما أذهب إلي سيارتي أجدها ممتلئة بالطلاب ‘ছাত্রদের সাথে আমার সম্পর্ক এমন হয়ে গিয়েছিল যে, আমি যখনই আমার গাড়ির নিকটে যেতাম, তখনই তাকে আমি ছাত্রদের দ্বারা পূর্ণ পেতাম’।
১৭. শত্রুদের সম্পর্কে :
জনৈক ছাত্র আলবানীকে বলেন, আমাদের একজন আপনার প্রতি শত্রুতা পোষণ করে এবং আপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা বলে থাকে। আমরা কি তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করব?
আলবানী বললেন, সে কি ব্যক্তি আলবানীর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, নাকি আলবানীর কিতাব ও ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক অনুসৃত আক্বীদা ও দাওয়াতের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে?
যদি সে কিতাব ও সুন্নাহর আক্বীদার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তাহ’লে তার সাথে আলবানীর আলোচনা করতে হবে এবং ধৈর্যধারণ করতে হবে। এরপরও যদি সে সংশোধন না হয় এবং তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করাই কল্যাণকর বিবেচিত হয়, তাহ’লে তাই করতে হবে। আর যদি ব্যক্তি আলবানীর প্রতি সে শত্রুতা রাখে কিন্তু আমাদের কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবেক আক্বীদার সাথে একমত থাকে, তাহ’লে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা যাবে না।
১৮. বিনয় প্রকাশ :
(ক) আলবানী অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহংকার ছিলেন। ইছাম হাদী বলেন, আমি কখনোই তাকে কোন প্রশংসাকারীর প্রশংসায় মুগ্ধ হ’তে দেখিনি। যদি তিনি কখনো প্রশংসা শুনতে বাধ্য হ’তেন, তখন তিনি দো‘আ করতেন, اللهم لا تؤاخذني بما يقولون واجعلني خيرا مما يظنون واغفرلي ما لا يعلمون- ‘হে আল্লাহ! তারা যা বলছে, সেজন্য আমাকে পাকড়াও করো না। তারা যা ধারণা করে তা থেকে আমাকে উত্তম করো এবং আমার যে দোষ-ত্রুটি তারা জানে না তা ক্ষমা করে দাও’। এসময় তাঁর দু’গন্ড বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে দেখা যেত।
(খ) তিনি প্রায়ই বলতেন, أنا طُوَيْلِبُ العلم ‘আমি নগণ্য জ্ঞানান্বেষী মাত্র’। তাঁর ঘনিষ্ট ছাত্র ইছাম হাদী একদিন তাকে বললেন, আপনি যদি নিজেকে নগণ্য জ্ঞান না করে কেবল طالب علم বা ‘জ্ঞানান্বেষী’ বলতেন, তাহ’লে আমাদের মত ছাত্ররা নিজেদেরকে طويلب العلم বলতে পারতাম! আলবানী হেসে ফেললেন এবং পুনরায় বললেন, না আমি طويلب العلم বা ‘নগণ্য জ্ঞানান্বেষী’।
(গ) ইছাম হাদী বলেন, একদিন আমি তাকে একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এটা আমার জানা নেই। আগামীকাল আমাকে জিজ্ঞেস করো। হয়তো আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে আমার সামনে কিছু উদ্ভাসিত করবেন। কিন্তু পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আল্লাহ আমার সামনে এ ব্যাপারে কিছুই খুলে দেননি।
১৯. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে :
আল-বায়ান পত্রিকার সম্পাদক এক সাক্ষাৎকারে শায়খ আলবানীকে জিজ্ঞেস করেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু মানুষ সমালোচনা করে এবং অভিযোগ করে যে সেখান থেকে বিজ্ঞ আলেম বের হচ্ছে না। আপনার মতে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি কি?
উত্তরে তিনি বলেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই আলেম বের করার ক্ষমতা রাখে না। বরং ছাত্রদেরকে আলেম হওয়ার জন্য ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে দেয় মাত্র। এটা সত্য যে, যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারেগ হচ্ছে তারা পরবর্তীতে নিজ নিজ কর্তব্যের উপর দৃঢ় থাকতে পারছে না। তারা জ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য যেসব নিয়ম-পদ্ধতি ও দিক-নির্দেশনা তাদের শিক্ষকদের থেকে অর্জন করেছে তদনুসারে কাজ করছে না। সেইসাথে লেখনী, বক্তব্য ও প্রকাশনার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের পরিপক্কতা লাভের চেষ্টাও তাদের মধ্যে নেই। বরং অধিকাংশের লক্ষ্যবস্ত্ত হয়ে যাচ্ছে কোথাও শিক্ষক হওয়া অথবা কোন দেশে গিয়ে বড় চাকুরীতে যোগদান করা। আসলে আজ মুসলিম আলেমদের সবচেয়ে বড় মুছীবত হ’ল তাদের মধ্য থেকে তাক্বওয়া এবং জ্ঞানের চর্চা হারিয়ে যাওয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন করে বসে থাকলে তা যথেষ্ট হয় না, বরং তা জ্ঞানার্জনকারীর জন্য ক্ষতিই বয়ে আনে (মাজাল্লাতুল বায়ান, ৩৩ তম সংখ্যা, রবীউল আখের ১৪১১ হিঃ)।
২০. তাখরীজ প্রসঙ্গে :
জনৈক ব্যক্তি শায়খ আলবানীকে তাখরীজের ক্ষেত্রে তাঁর যে সব ভুল হয়েছে এবং পরবর্তীতে সংশোধন করেছেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। উত্তরে তিনি বললেন, যদি তুমি জিজ্ঞেস কর যে, আলবানী কি তার কোন কিতাবে ভুল করেছেন এবং পরে তা শুদ্ধ করেছেন? তাহ’লে আমি স্বীকার করব যে, সেখানে আমি কিছু ভুল করেছিলাম। পরে তা শুদ্ধ করে দিয়েছি। যেমন ইমাম শাফেঈ বলেছেন, أبي الله أن يتم إلا كتابه، بس كتاب الله هو التمام- ‘আল্লাহ তাঁর নিজের কিতাব ব্যতীত অন্য কোন কিতাব পূর্ণাঙ্গ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাবই পূর্ণাঙ্গ’।
২১. জামা‘আত প্রসঙ্গে :
জনৈক ব্যক্তিকে আলবানী বললেন, তুমি কোন জামা‘আতভুক্ত? লোকটি বলল, আমি কোন ফেরকাবাজি করি না। শায়খ বললেন, ফেরকাবাজি এবং জামা‘আত দু’টি ভিন্ন জিনিস। একটির সাথে অপরটির কোন সম্পর্ক নেই।
২২. নিজেকে সালাফী বলে পরিচয় দেওয়া প্রসঙ্গে :
পরবর্তী যুগের মানুষ হিসাবে অবশ্যই আমাদেরকে কুরআন, হাদীছ এবং পূর্ববর্তী মুমিন বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। আমাদের জন্য একথা বলা জায়েয হবে না যে, আমরা সালাফে ছালেহীনের মাসলাক অনুসরণ ব্যতীতই কুরআন ও হাদীছকে বুঝে অনুসরণ করব। এ যুগে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নিসবত গ্রহণ করা ব্যতীত উপায় নেই। আমাদের এটা বলা যথেষ্ট হবে না যে, আমি একজন মুসলিম অথবা ‘আমার মাযহাব ইসলাম’। কারণ রাফেযী, ইবাযী, কাদিয়ানী সকল ফেরকাই একথা বলে থাকে। কিসে তাদের থেকে তোমাকে পার্থক্য করবে?
যদি তুমি বল, ‘আমি কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী মুসলিম’। এটাও যথেষ্ট নয়। কারণ বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী, আশ‘আরী, মাতুরীদী সকলেই একই দাবী করে থাকে।
নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পষ্ট ও বৈশিষ্টমন্ডিত নামকরণ হবে এই যে, তুমি বলবে আমি কুরআন, হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের অনুসারী। যেটা সংক্ষেপে তুমি বলবে, ‘আমি একজন সালাফী’। এক্ষেত্রে তিনি একটি চমৎকার পংক্তি উল্লেখ করতেন তা হ’ল-
وكل خير في اتباع من سلف + وكل شر في ابتداع من خلف
অর্থাৎ ‘সালাফে ছালেহীনের অনুসরণেই সকল কল্যাণ। পরবর্তীদের সৃষ্ট বিদ‘আতের মধ্যেই সকল অকল্যাণ’।
তারপর তিনি সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তর্কের খাতিরে যদি আমরা কেবল ‘মুসলিম’ হিসাবেই নিজেদের নামকরণ করি; যদিও ‘সালাফী’ সম্বন্ধটি একটি সঠিক এবং মর্যাদাপূর্ণ নাম। তাহ’লে তারা কি নিজেদের দল, মাযহাব বা তরীকার নামকরণ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন? যে সকল নাম আদতেই শরীআতসম্মত নয়?
এরপর তিনি বলেন,
فحسبكم هذا التفاوتُ بيننا + وكلُّ إناءٍ بما فيه ينضَحُ
তোমাদের সাথে আমাদের মধ্যকার এই পার্থক্যই যথেষ্ট। প্রত্যেক পাত্র তাই-ই নিঃসরণ করে, যা তার মধ্যে থাকে’।
তথ্যসূত্র :
১. ইছাম মূসা হাদী, মুহাদ্দিছুল ‘আছর ইমাম মুহাম্মাদ নাছেরুদ্দীন আলবানী কামা ‘আরাফতুহু, (জুবাইল : দারুছ ছিদ্দীক্ব, ১ম প্রকাশ, ২০০৩ ইং)।
২. সুমাইর বিন আমীন যুহায়ী, নাছেরুদ্দীন আলবানী, (রিয়ায : দারুল মুগনী, ১ম প্রকাশ, ১৪২০ ইং)।
৩. মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ, (মিসর : দারুল গাদ জাদীদ, ১ম প্রকাশ ২০০৬ ইং)।
৪. ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার, (রিয়ায: দারুত তাওহীদ, ১ম প্রকাশ ২০০৮ ইং)।
৫. মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, হায়াতুল আলবানী : আছারুহু, ছানাউল উলামা আলাইহে, (কায়রো : মাকতাবা সাদাবী, ১ম প্রকাশ ১৯৮৭ ইং)।
৬. আতিয়া বিন ছিদক্বী, ছাফহাতুন বায়যা মিন হায়াতিল ইমাম (সানা : দারুল আছার, ২য় প্রকাশ ২০০১ ইং)।
৭. এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।