হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (শেষ কিস্তি)


হিজরী ৩য় শতক পরবর্তী হাদীছ সংকলনসমূহ :

হিজরী ৩য় শতকের পরও যথারীতি হাদীছ সংকলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। তবে পরবর্তী যুগের বিদ্বানগণ মূলতঃ বুখারী, মুসলিম এবং চারটি সুনান গ্রন্থের সংক্ষেপায়ন, সমন্বয়করণ এবং পুনঃসজ্জায়নে প্রবৃত্ত হন। এ সময় মৌখিকভাবে হাদীছ বর্ণনাধারা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং লিখিত গ্রন্থসমূহের ওপর সার্বিক নির্ভরতা চলে আসে। এজন্য ইমাম যাহাবী (৭৪৮হি.) হিজরী তৃতীয় শতককে পূর্ববর্তী (মুতাক্বাদ্দিমীন) এবং পরবর্তী (মুতাআখখিরীন) মুহাদ্দিছদের মাঝে পার্থক্যরেখা গণ্য করেছেন।[1] এ সকল মুহাদ্দিছ বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাদীছ সংকলন ও সজ্জায়ন করেছেন। যথা-

(ক) একদল মুহাদ্দিছ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের অনুসরণে কেবল ছহীহ হাদীছগুলো একত্রিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন। যেমন মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনু খুযায়মা আন-নায়সাপুরী (৩১১হি.)[2], আবূ আলী সাঈদ ইবনু ওছমান ইবনুস সাকান (৩৫৩হি.)[3], আবূ হাতিম ইবনু হিববান আল-বুস্তী (৩৫৪হি.)[4] প্রমুখ। নিঃসন্দেহে এই সংকলনগুলি বিশুদ্ধতায় ‘ছহীহাইন’-এর স্তরের নয়। যেমন ইবনু খুযায়মা ও ইবনু হিববান ছহীহ এবং হাসান হাদীছের মধ্যে কোন পার্থক্য করতেন না। এমনকি হাদীছ ছহীহ হওয়ার জন্য ইল্লত বা গোপন ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়াকেও শর্ত মনে করতেন না।[5] ফলে এ সকল গ্রন্থে ছহীহ হাদীছের সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যঈফ ও মওযূ‘ হাদীছও রয়েছে।

(খ) কেউ সুনান গ্রন্থসমূহের অনুকরণে হাদীছ গ্রন্থ সংকলন করেন। যেমন আলী ইবনু ওমর আদ-দারাকুৎনী (৩৮৫হি.)[6], হাফেয আবূ বকর আহমাদ ইবনুল হোসাইন আল-বায়হাক্বী (৪৫৮হি.)[7] প্রমুখ।

(গ) কেউ المعجم বা অভিধানের ধারাবাহিকতায় হাদীছ গ্রন্থ সংকলন করেছেন। এ সকল গ্রন্থে ছাহাবীদের নাম অথবা মুহাদ্দিছদের শায়খগণের নামের ধারাবাহিকতা অনুসারে তাদের হাদীছসমূহ একত্রিত করা হয়। যেমন আবুল কাসিম সুলায়মান ইবনু আহমাদ আত-ত্ববারাণী (৩৬০হি.)। তিনি ‘আল-মু‘জামুল কাবীর’[8], ‘আল-মু‘জামুছ ছাগীর’[9] এবং ‘আল-মু‘জামুল আওসাত্ব’[10] নামে ৩টি বৃহৎ সংকলন প্রস্ত্তত করেন। যেগুলো সবই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আবূ সাঈদ ইবনুল আ‘রাবী আছ-ছূফী (৩৪০হি.) প্রণীত একটি মু‘জাম প্রকাশিত হয়েছে।[11]

(ঘ) কেউ ছহীহাইনের শর্তানুযায়ী হওয়া সত্ত্বেও যে সকল হাদীছ ছহীহাইনে সন্নিবেশিত হয়নি, তা একত্রিত করায় সচেষ্ট হন। যেমন আবূ আব্দিল্লাহ হাকেম আন-নায়সাপুরী (৪০৫হি.)। তিনি সংকলন করেনالمستدرك على الصحيحين।[12]

(ঙ) কেউ সংকলন করেন এমন কিছু গ্রন্থ যেখানে পূর্ববর্তী হাদীছ সংকলকদের আনীত হাদীছসমূহ ভিন্ন সূত্রে আনা হয়েছে সনদের উচ্চতা সৃষ্টি কিংবা সনদসূত্র (طرق الإسناد) বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। এগুলোকে المستخرج বলা হয়। যেমন আবূ বকর আল-ইসমাঈলী (৩৭১হি.), আবূ আওয়ানাহ ইয়াকূব ইবনু ইসহাক্ব আল-ইসফারায়ীনী (৩১৬হি.) এবং আবূ নাঈম আল-আস্ফাহানী (৪৩০হি.)[13]-এর মুসতাখরাজ।

(চ) কেউ সংকলন করেন এমন গ্রন্থ যেখানে ছহীহাইন কিংবা কুতুবে সিত্তাহ ও অন্যান্য গ্রন্থ একত্রিত করা হয়েছে। যেমন-

  • মুহাম্মাদ ইবনু নাছর আল-হুমাইদী (৪৮৮হি.) বুখারী এবং মুসলিমের হাদীছসমূহ একত্রিত করেন তাঁর الجمع بين الصحيحين البخاري ومسلم، গ্রন্থে।[14]
  • ইবনুল আছীর আল-জাযারী (৬০৬হি.) কুতুবে খামসাহ এবং মুওয়াত্ত্বা মালিক সুবিন্যস্তভাবে একত্রিত করেন তাঁর প্রসিদ্ধ جامع الأصول في أحاديث الرسول গ্রন্থে।[15]
  • ইমাম মুহিউস সুন্নাহ আল-বাগাভী (৫১৬হি.) কুতুবে সিত্তাহ, মুওয়াত্ত্বা মালিক, মুসনাদে আহমাদ, সুনান আদ-দারেমী, সুনান আদ-দারাকুৎনী, সুনান আল-বায়হাক্বী এবং আবূ রাযীনের হাদীছসমূহ থেকে নির্বাচিত হাদীছসমূহ একত্রিত করেন তাঁর مصابيح السنة গ্রন্থে।[16] পরবর্তীতে ওয়ালীউদ্দীন আল-খাত্বীব এর পূর্ণতা দান করেন এবং অধ্যায়ভিত্তিক বিন্যাস করেন। তিনি এর নামকরণ করেন مشكاة المصابيح।[17]
  • হাফেয ইবনু কাছীর আদ-দিমাশকী (৭৭৪হি.) কুতুবে সিত্তাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদ আবূ ইয়া‘লা, মুসনাদুল বায্যার এবং ইমাম ত্ববারানীর ‘আল-মু‘জামুল কাবীর’ গ্রন্থসমূহ একত্রিত করেছেন جامع المسانيد والسُّنَن নামে। এতে প্রায় লক্ষাধিক হাদীছ ছিল। তবে রচনাকালে তিনি অন্ধত্ব বরণ করেন। ফলে সংকলনকাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি।[18]
  • হাফেয জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী (৯১১হি.) তিনি সকল হাদীছ একত্রিত করার প্রয়াস নেন এবং সংকলন করেন جمع الجوامع বা الجامع الكبير। এতে কুতুবে সিত্তাহসহ ৯২টি গ্রন্থ থেকে প্রায় লক্ষাধিক হাদীছ একত্রিত করা হয়। সেজন্য এটি হাদীছের সর্ববৃহৎ বিশ্বকোষ হিসাবে পরিগণিত।[19] অতঃপর আল-মুত্তাক্বী আল-হিন্দী (৯৭৫হি.) এটিকে পুনর্বিন্যাস ও সংক্ষেপায়ন করে প্রণয়ন করেন كنز العمال في سنن الأقوال والأفعال،।[20] দু’টি গ্রন্থেই ছহীহ হাদীছের সাথে অসংখ্য যঈফ ও মাওযূ‘ হাদীছও রয়েছে। ইমাম সুয়ূত্বী নিজেই الجامع الكبير থেকে নির্বাচিত কিছু হাদীছ একত্রিত করে الجامع الصغير من حديث البشير النذير নামে অপর একটি সংকলন প্রস্ত্তত করেন।[21]
  • মুহাম্মাদ ইবনু সুলায়মান আল-ফারিসী আল-মাগরিবী (১০৯৪হি.) কুতুবে সিত্তাহ সহ মোট ১৪টি গ্রন্থের সমন্বয়ে একটি সংকলন প্রস্ত্তত করেন جمع الفوائد من جامع الاصول ومجمع الزوائد।[22]

(ছ) কেউ কোন একটি গ্রন্থে এবং গ্রন্থসমষ্টিতে উল্লেখিত অতিরিক্ত হাদীছ সমূহের সংকলন প্রণয়ন করেন, যাকে الزوائد বলা হয়। যেমন-

  • হাফেয নূরুদ্দীন আলী ইবনু আবী বাকর আল-হায়ছামী (৮০৭হি.) প্রণয়ন করেন مجمع الزوائد ومنبع الفوائد। এ গ্রন্থে তিনি কুতুবে সিত্তাহ বহির্ভূত যে সকল হাদীছ মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদ আবূ ইয়া‘লা, মুসনাদুল বায্যার এবং ইমাম ত্ববারাণীর মু‘জামসমূহে বর্ণিত হয়েছে তা একত্রিত করেছেন। মুহাক্কিক হুসামুদ্দীন আল-কুদসীর হিসাব মতে এই গ্রন্থে ১৮৭৭৬টি হাদীছ রয়েছে।[23]
  • হাফেয আহমাদ ইবনু আবী বাকর শিহাবুদ্দীন আল-বুছীরী (৮৩০হি.) প্রণয়ন করেনمصباح الزجاجة في زوائد ابن ماجه। এ গ্রন্থে তিনি সুনান ইবনু মাজাহ-এ ছহীহাইন এবং অপর তিনটি সুনানে যে সকল হাদীছ উদ্ধৃত হয়নি, তথা ইবনু মাজাহ স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করেছেন, সে হাদীছসমূহ একত্রিত করেছেন।[24] তিনি অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘যাওয়ায়েদ’ সংকলন করেছেনإتحاف الخيرة المهرة بزوائد المسانيد العشرة শিরোনামে। এতে মুসনাদুত তায়ালিসী, মুসনাদুল হুমাইদী, মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদ আবী ইয়া‘লা, মুসনাদ ইবনু আবী শায়বাহসহ মোট দশটি মুসনাদ গ্রন্থে উদ্ধৃত যে সকল হাদীছ কুতুবে সিত্তায় বর্ণিত হয়নি, সে সকল হাদীছ একত্রিত করা হয়েছে এবং ফিক্বহী রীতি মোতাবেক বিন্যাস করা হয়েছে। এতে মোট ৭৯৬৮টি হাদীছ রয়েছে।[25]
  • ইবনু হাজার আসক্বালানী (৮৫২হি.) সংকলন করেন المطالب العالية بزوائد المسانيد الثمانية। এই গ্রন্থে মুসনাদুত তায়ালিসী, মুসনাদুল হুমাইদী, মুসনাদ ইবনু আবী শাইবাহসহ মোট ৮টি গুরুত্বপূর্ণ মুসনাদের যে সকল হাদীছ কুতুবে সিত্তাহ এবং মুসনাদ আহমাদে বর্ণিত হয়নি, সেসব হাদীছ একত্রিত করা হয়েছে এবং ফিক্বহী ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এতে বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা ৪৬২৭টি।[26]

(জ) কেউ শুধু আহকাম সংক্রান্ত হাদীছসমূহ একত্রিত করেছেন। যেমন হাফেয আব্দুল গণী আল-মাক্বদাসী (৬০০হি.) সংকলন করেনعمدة الأحكام من كلام خير الأنام صلى الله عليه وسلم। এই গ্রন্থে ছহীহাইনে উল্লেখিত আহকাম সংক্রান্ত কিছু নির্বাচিত হাদীছ একত্রিত করা হয়েছে। মোট হাদীছ সংখ্যা ৪৩০টি।[27] এছাড়া ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) প্রণীত بلوغ المرام من أدلة الأحكام[28] এবং মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী আল-ইয়ামানী (১২৫০হি.) প্রণীত نيل الأوطار شرح منتقى الأخبار[29] প্রভৃতি।

(ঝ) কেউ কেউ হাদীছের তাখরীজ এবং তার বিবিধ সনদ অনুসন্ধানে গুরুত্বারোপ করে হাদীছ সংকলন করেছেন। এর উদ্দেশ্য হ’ল সহজে পাঠক যেন কোন হাদীছের প্রাপ্তিস্থান অবগত হ’তে পারে। এ সকল গ্রন্থে কোন হাদীছের ছোট একটি অংশ উদ্ধৃত করা হয় এবং কোন গ্রন্থে তার অবস্থান রয়েছে তা নির্দেশ করা হয়। যেমন জামালুদ্দীন আল-মিয্যী (৭৪২হি.) প্রণীত تحفة الأشراف بمعرفة الأطراف।[30] এই গ্রন্থে তিনি কুতুবে সিত্তাহ এবং কয়েকটি ছোট হাদীছ গ্রন্থের সকল হাদীছ একত্রিত করেছেন বিশেষ পদ্ধতিতে কেবল হাদীছের অংশবিশেষ উল্লেখ করার মাধ্যমে। অনুরূপভাবে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) সংকলন করেনإتحاف المهرة بالفوائد المبتكرة من أطراف العشرة। এতে তিনি ১১টি গ্রন্থ তথা মুওয়াত্ত্বা মালিক, মুসনাদুশ শাফেঈ, মুসনাদে আহমাদ, সুনানুদ দারিমী, ইবনুল জারূদের আল-মুনতাক্বা, ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ, মুসতাখরাজ আবূ আওয়ানাহ, ইমাম ত্বহাভীর শারহু মা‘আনিল আছার, ছহীহ ইবনু হিববান, সুনানুদ দারাকুৎনী এবং মুসতাদরাক আল-হাকিম-এর সকল হাদীছের আত্বরাফ তথা হাদীছের অংশবিশেষ উল্লেখ করেন।[31]

(ঞ) কেউ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের হাদীছসমূহ তাখরীজে মনোনিবেশ করেন। যেমন হাফেয জামালুদ্দীন আয-যায়লাঈ (৭৬২হি.) প্রণয়ন করেন نصب الراية لأحاديث الهداية।[32] এতে হানাফী মাযহাবের শীর্ষ গ্রন্থ আল-হিদায়াহ-এর হাদীছ সমূহ তাখরীজ করা হয়েছে। এছাড়া হাফেয যাইনুদ্দীন আল-ইরাক্বী (৮০৬হি.) প্রণয়ন করেনتخريج أحاديث إحياء علوم الدين।[33] এতে ইমাম গায্যালীর ‘ইহয়াউল উলূম’ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীছ সমূহের তাখরীজ করা হয়েছে।

এভাবে ৩য় হিজরী শতকের পর মূলত প্রথম দুই শতাব্দীর প্রাথমিক হাদীছ সংকলনগুলোর পুনর্বিন্যাস, ব্যাখ্যা এবং একত্রিতকরণে মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরাম তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। এছাড়া আরও প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বহু হাদীছ সংকল গ্রন্থ রয়েছে, যা আলোচনার কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় এখানে উল্লেখিত হয়নি। কেবল তা-ই নয়, হাদীছ সংকলনকালে সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং হাদীছের বিশুদ্ধতা সংরক্ষণে তাঁরা যে অকল্পনীয় পরিশ্রম করেছেন, যে সকল মূলনীতি ও পরিভাষার জন্ম দিয়েছেন এবং এ বিষয়ক শত শত বৃহৎ আকারের গ্রন্থ রচনা করেছেন তা-ও এখানে স্থানাভাবে উল্লেখিত হয়নি। তদুপরি উপরোক্ত গ্রন্থতালিকা থেকেই সুস্পষ্টভাবে অনুমান করা যায় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সংরক্ষণে এবং তা মুসলিম উম্মাহর জন্য সহজলভ্য করতে এমন কোন উপায় নেই যা মুহাদ্দিছগণ অবলম্বন করেননি, হেন প্রচেষ্টা নেই যা তারা করেননি। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, হাদীছের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ যে পরিমাণ শ্রম এবং মেধা ব্যয় করেছেন, তা ইসলামের ইতিহাসে অন্য কোন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যয়িত হয়নি। যুগ পরম্পরায় হাদীছ সংরক্ষণের জন্য এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র আজও হাদীছ গ্রন্থসমূহ সমান গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে, পঠিত হচ্ছে এবং সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতা বজায় রেখে তা মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

সারকথা :

রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই। শুরুতে অনানুষ্ঠানিকভাবে হাদীছ মুখস্থকরণ এবং ব্যক্তিগতভাবে লিপিবদ্ধ করণের মাধ্যমে এই সংরক্ষণ প্রচেষ্টা শুরু হয়। অতঃপর ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (১০১হি.)-এর সরকারী ফরমানে হাদীছ একত্রিতকরণ এবং গ্রন্থাবদ্ধকরণ শুরু হয়। কেউ কেউ ধারণা করেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে হাদীছের কোন লিখিত রূপ ছিল না এবং হাদীছ সংকলন অনেক দেরীতে শুরু হয়। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমরা উপরোক্ত আলোচনায় লক্ষ্য করেছি যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই হাদীছ বিভিন্নভাবে সংকলন শুরু হয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ছাহাবীদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তা আরও বেগবান হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়েছে ২য় হিজরী শতাব্দীর শুরুতে। কুরআন যেমন প্রাথমিক যুগে সংকলিত হওয়ার পরও আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থাবদ্ধ করতে বেশ দেরী হয়েছিল, একইভাবে হাদীছের একটা বড় অংশও প্রথম যুগে সংকলিত হওয়া সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিক গ্রন্থাবদ্ধকরণ, বিন্যাস এবং মানুষের কাছে ব্যাপক প্রচারে দেরী হয়েছিল। এর অর্থ আদৌ এটি নয় যে, হাদীছ যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। আমরা অনুমান করি, তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই এই জাতীয় ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এটিই প্রমাণিত সত্য যে, হাদীছ সংকলনকর্ম সময়মতই শুরু হয়েছিল এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষিতও হয়েছিল। তবে তা একত্রিত করা এবং গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজটি সঙ্গত কারণে বিলম্বিত হয়েছিল।


[1]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ১৯৬৩ খৃ.), ১/৪।

[2]. এতে ৩০২৯টি হাদীছ রয়েছে। তবে এই গ্রন্থের বৃহত্তর অংশের পান্ডুলিপি হারিয়ে গেছে। মুছত্বফা আল-আ‘যামী (২০১৭ খৃ.)-এর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়েছে (ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ, বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ : ২০০৩খৃ.)। এতে বেশ কিছু যঈফ হাদীছ রয়েছে। মুছত্বফা আল-আ‘যামী এর প্রায় ৩ শতাধিক হাদীছ যঈফ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন এবং ২টি হাদীছকে জাল বলেছেন।

[3]. এটি অপ্রকাশিত রয়েছে এবং এর পান্ডুলিপি কোথায় রয়েছে সেটি অজ্ঞাত। দ্র. ড. ফুয়াদ সেযগীন, তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী, ১/৩৭৮। 

[4]. নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯খ্রি,) এবং শু‘আইব আল-আরনাঊত্বের সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে মোট ৭৪৯১টি হাদীছ রয়েছে এবং নাছিরুদ্দীন আলবানীর হিসাবে প্রায় ৩৪৫টি যঈফ এবং ৩টি মওযূ‘ বা জাল হাদীছ রয়েছে (নাছিরুদ্দীন আলবানী, যঈফু মাওয়ারিদুয যামআন (রিয়াদ : দারুছ ছুমাই‘ঈ, ২০০২খৃ.)। বিন্যাস পদ্ধতির জটিলতার কারণে ৮ম শতকের মুহাদ্দিছ আল-আমীর আলাউদ্দীন আলী ইবনু বালবান (৭৩৯হি.) এটি নতুনভাবে বিন্যস্ত করেন এবং এটিই বর্তমানে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এছাড়া আবূ বকর আল-হায়ছামী (৮০৭হি.) এই গ্রন্থ থেকে বুখারী ও মুসলিমের হাদীছসমূহ পৃথক করে موارد الظمآن إلي زوائد ابن حبان শিরোনামে একটি সংকলন প্রস্ত্তত করেন। এতে ২৬৪৭টি হাদীছ রয়েছে। বেশ কয়েকজন মুহাক্কিকের সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়েছে।

[5]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আন-নুকাত আলা কিতাবি ইবনিছ ছালাহ, ১/৬৩।

[6]. তাঁর গ্রন্থ ‘আস-সুনান’ শু‘আইব আরনাঊত্বের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : মুআস্সাতুর রিসালাহ, ২০০৪ খৃ.)। এতে ৪৮৩৬টি হাদীছ রয়েছে।

[7]. তাঁর গ্রন্থ ‘আস-সুনানুল-কুবরা’ মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির আত্বার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : দারুল কুতুবিল-ইলমিয়াহ, ২০০৩ খৃ.)। এতে ২১৮১২টি হাদীছ রয়েছে।

[8]. ২৫ খন্ডে হামদী আব্দুল মাজীদ আস-সালাফীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে (কায়রো : মাকতাবা ইবনু তায়মিয়া, তাবি)। এতে প্রায় ২৫০০০ হাদীছ রয়েছে।

[9]. এতে প্রায় ১১৯৮টি হাদীছ রয়েছে। গ্রন্থটি বৈরূত, মিছর এবং সঊদী আরবের বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

[10]. এতে ৯৪৮৯টি হাদীছ রয়েছে। বেশ কয়েকজন মুহাক্কিকের তত্ত্বাবধানে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে (কায়রো : দারুল হারামাইন, ১৪১৫হি.)।

[11]. এতে ২৪৬০টি হাদীছ রয়েছে। আব্দুল মুহসিন ইবনু ইবরাহীম আল-হুসাইনীর সম্পাদনায় গ্রন্থটি ৩ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (সঊদী আরব : দারু ইবনুল জাওযী, ১৯৯৭ খৃ.)।

[12]. এতে ৮৮০৩টি হাদীছ রয়েছে। মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির আত্বার সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : দারুল কুতুবিল-ইলমিয়াহ, ১৯৯০ খৃ.)।

[13]. তিনি ছহীহ মুসলিমের উপর ‘মুস্তাখরাজ’ সংকলন করেন। এতে ৩৫১৬টি হাদীছ রয়েছে। মুহাম্মাদ হাসান ইসমাঈল আশ-শাফিঈ-এর সম্পাদনায় এটি ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৯৯৬খৃ.)।

[14]. ড. আলী হুসাইন আল-বাওয়াবের সম্পাদনায় ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : দারু ইবনু হাযম, ২য় প্রকাশ : ২০০২খৃ.)।

[15]. বৈরূত থেকে ১৯৭২ সনে আব্দুল কাদির আল-আরনাঊত্ব এবং বাশীর উয়ূনের সম্পাদনায় ১২ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

[16]. বৈরূত থেকে ১৯৮৭ সনে কয়েকজন মুহাক্কিকের সম্পাদনায় ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

[17]. বৈরূত থেকে নাছিরুদ্দীন আল-আলবানীর সম্পাদনায় ৩ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ইন্ডিয়া, মিসরসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকেও প্রকাশ পেয়েছে।

[18]. বৈরূত থেকে ১৯৯৮ সনে ড. আব্দুল মালিক ইবনু আব্দিল্লাহ আদ-দুহাইশের সম্পাদনায় ১০ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। অসম্পূর্ণ এই গ্রন্থে মোট ১৩৫৪৭টি হাদীছ স্থান পেয়েছে।

[19]. আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ২৫ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ২৮৪২৫টি হাদীছ এতে স্থান পেয়েছে।

[20]. বৈরূত থেকে ১৯৮১ সনে ১৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ইতিপূর্বে ইন্ডিয়া থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে মোট ৪৬৬২৪টি হাদীছ স্থান পেয়েছে।

[21]. নাছিরুদ্দীন আলবানী গ্রন্থটির শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করেছেন, যার একটি অংশ صحيح الجامع الصغير وزيادته শিরোনামে এবং অপর অংশটি ضعيف الجامع الصغير وزيادته শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম অংশে ৮২৩১টি এবং ২য় অংশে ৬৪৭৯টিসহ মোট ১৪৭০০টি হাদীছ সন্নিবেশিত হয়েছে। এতে ইমাম সুয়ূত্বী সংকলিত অপর গ্রন্থের الفتح الكبير في ضم الزيادة إلى الجامع الصغير-এর হাদীছ সমূহও সংযুক্ত হয়েছে।

[22]. বৈরূত থেকে ১৯৯৮ সনে ড. সুলায়মান ইবনু দুরাই‘-এর সম্পাদনায় ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে মোট ১০১৩১টি হাদীছ রয়েছে।

[23]. কায়রো থেকে ১৯৯৪ সনে ১০ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

[24]. ১৪০৩ হিজরীতে বৈরূত থেকে মুহাম্মাদ আল-মুনতাক্বা আল-কাশনাভীর সম্পাদনায় ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে ।

[25]. আবূ তামীম ইয়াসির ইবনু ইবরাহীমের সম্পাদনায় ৯ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (রিয়াদ : দারুল ওয়াত্বান, ১৯৯৯ খৃ.)।

[26]. কুয়েত, সঊদী আরব, মিসর এবং বৈরূতের বিভিন্ন প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তবে সঊদী আরব (দারুল আছিমাহ, ১৪১৯হি.) থেকে ১৯ খন্ডে প্রকাশিত সংকলনটি অধিকতর তাহক্বীক সমৃদ্ধ।

[27]. মাহমূদ আল-আরনাঊত্ব এবং আব্দুল কাদির আল-আরনাঊত্বের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : দারুছ ছাক্বাফাহ আল-আরাবিয়াহ, ২য় প্রকাশ, ১৯৮৮ খৃ.)। ব্যাপক সমাদৃত এই গ্রন্থের বহু ব্যাখ্যাগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।

[28]. বহুল প্রচলিত এই গ্রন্থের সর্বশেষ তাহক্বীক মোতাবেক ১৫৬৮টি হাদীছ রয়েছে। অসংখ্যবার এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ড. মাহির ইয়াসীন আল-ফাহলের সম্পাদনায় এর পূর্ণাঙ্গ তাহক্বীক প্রকাশিত হয়েছে (রিয়াদ : দারুল ক্বাবস, ২০১৪ খৃ.)।

[29]. এটি মাজদুদ্দীন ইবনু তায়মিয়াহ আল-হার্রানী (৬৫৩হি.) প্রণীত কুতুবে সিত্তাহ এবং আহমাদ থেকে সংকলিত আহকামসংক্রান্ত হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা এবং ফিকহী পর্যালোচনা। এতে মোট ৩৯৪৪টি হাদীছ রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে।

[30]. এতে ১৩৬২৬টি হাদীছের ‘আত্বরাফ’ বা অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে।

[31]. এতে ২৫৫১৪টি হাদীছের ‘আত্বরাফ’ বা অংশবিশেষ উল্লেখিত হয়েছে। এটি ১৯ খন্ডে মুদ্রিত হয়েছে (মদীনা : মারকাযু খিদমাতিস সুন্নাহ ওয়াস সীরাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খৃ.)।

[32]. অনেক দেশে থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সমকালীন সময়ে মুহাম্মাদ আওয়ামার সম্পাদনায় ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (বৈরূত : মুআস্সাতুর রাইয়ান, ১৯৯৭ খৃ.)।

[33]. ৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (রিয়াদ : দারুল আছিমাহ, ১৯৮৭ খৃ.)।






পরকালে পাল্লা ভারী ও হালকাকারী আমল সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
কুরবানীর মাসায়েল - -আত-তাহরীক ডেস্ক
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইসলামে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ও শ্রমিকের অধিকার - ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
ইসলামের কতিপয় সামাজিক বিধান - মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয় কেন? - মেহেদী হাসান পলাশ
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
অল্পে তুষ্টি (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামের আলোকে সম্পদ বৃদ্ধির উপায় - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
ক্ষমা প্রার্থনা : এক অনন্য ইবাদত - ইহসান ইলাহী যহীর
আরও
আরও
.