(খ) মুখস্থকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ :
পবিত্র কুরআনের মত হাদীছও আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত হওয়ার পূর্বে প্রথমত সংরক্ষিত হয়েছিল মুখস্থকরণের মাধ্যমে। প্রাথমিক যুগে মুখস্থকরণই ছিল হাদীছ সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যম। ছাহাবীগণ কুরআনের মত হাদীছকেও সমগুরুত্বের সাথে মুখস্থ সংরক্ষণ করেছিলেন।[1]
রাসূল (ছা.) তাঁদেরকে মুখস্থ করা ও মানুষের কাছে প্রচারের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন,نَضَّرَ اللهُ عَبْداً سَمِعَ مَقَالَتِى فَوَعَاهَا ثُمَّ أَدَّاهَا لِمَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا، ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন, যে আমার কথা শুনেছে, মুখস্থ করেছে, অতঃপর তা পৌঁছে দিয়েছে তাদের কাছে যারা তা শোনেনি’।[2] অপর বর্ণনায় এসেছে, فحفظه فأداه إلى من هو أحفظ منه ‘অতঃপর তা মুখস্থ করল এবং অধিকতর মুখস্থকারীর নিকট পৌঁছে দিল’।[3]
রাসূল (ছা.) আরো বলেন,تَسْمَعُونَ وَيُسْمَعُ مِنْكُمْ وَيُسْمَعُ مِمَّنْ سَمِعَ مِنْكُمْ، ‘তোমরা (আমার হাদীছ) শুনবে এবং (আমার পর যে আসবে) সে তোমাদের নিকট (আমার হাদীছ) শুনবে এবং যারা তোমাদের কাছে শুনেছে তাদের কাছ থেকে অন্যরা শুনবে’।[4] একবার আব্দুল কায়েস গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল (ছা.)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তাদেরকে দ্বীনের কিছু বিষয়াদি শিক্ষাদান করেন এবং তাদেরকে বললেন, احْفَظُوهُ وَأَخْبِرُوهُ مَنْ وَرَاءَكُمْ ‘তোমরা কথাগুলো মুখস্থ রাখ এবং তোমাদের পশ্চাতে যারা রয়েছে তাদেরকেও এ ব্যাপারে সংবাদ দিও’।[5]
বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূল (ছা.) বলেছিলেন, فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ، فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ ‘এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের কাছে (আমার বার্তাগুলো) পৌঁছে দেয়। কেননা হ’তে পারে যে, (অদ্যকার) শ্রোতার চেয়ে যার কাছে পৌঁছানো হবে সে অধিকতর (হাদীছ) সংরক্ষণকারী’।[6] রাসূল (ছা.) আরো বলেছেন, بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً، ‘আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর, যদিওবা একটি আয়াতও হয়’।[7]
ফলে ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ছা.)-এর এই নির্দেশ পালনে সদা তৎপর ছিলেন। সামুরা বিন জুনদুব (রা.) বলেন, لَقَدْ كُنْتُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غُلَامًا، فَكُنْتُ أَحْفَظُ عَنْهُ، ‘আমি রাসূল (ছা.)-এর যুগে একজন বালক ছিলাম এবং আমি তাঁর কথা (হাদীছ) মুখস্থ করতাম’।[8] ইবনু আববাস (রা.) বলেন, كُنَّا نَحْفَظُ الْحَدِيثَ، وَالْحَدِيثُ يُحْفَظُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ‘আমরা হাদীছ মুখস্থ করতাম এবং রাসূল (ছা.)-এর নিকট থেকে হাদীছ মুখস্থ করা হ’ত’।[9] এমনকি তাদের অনেকে রাসূল (ছা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণী শোনার জন্য নিজের বাড়ী ছেড়ে দিয়ে রাসূল (ছা.)-এর মসজিদে এসে দীর্ঘদিন বসবাস করতেন, যাতে তারা হাদীছ শুনতে পারেন। বিশেষ করে আহলুছ ছুফফার কথা উল্লেখযোগ্য, যারা দিন-রাত চবিবশ ঘণ্টাই রাসূল (ছা.)-এর দরবারে পড়ে থাকতেন। বিখ্যাত হাদীছ সংগ্রাহক ছাহাবী আবূ হুরায়রা (রা.) ছিলেন এই দলভুক্ত।[10]
এভাবে ছাহাবীগণ নিজেরা যেমন হাদীছ মুখস্থ করতেন এবং অন্যদের মধ্যে প্রচার করতেন। ফলে দূর-দূরান্তের মুসলমানদের নিকটেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে হাদীছের বাণী পৌঁছে যায়। হাদীছ সংরক্ষণ ও প্রচার লাভের এটাই ছিল প্রাথমিক ও স্বাভাবিক পন্থা।
ছাহাবীগণ যেমন নিয়মিত হাদীছ মুখস্থকরণের চর্চা করতেন, তেমনি পরস্পরকে চর্চায় সাহায্য করতেন। আনাস ইবনু মালেক (রা.) বলেন,كنا نكون عند النبي صلى الله عليه وسلم فنسمع منه الحديث فإذا قمنا تذاكرناه فيما بيننا حتى نحفظه، ‘আমরা রাসূল (ছা.)-এর নিকট থাকতাম এবং হাদীছ শ্রবণ করতাম। এরপর যখন মজলিস থেকে উঠতাম, তখন নিজেরা পরস্পরকে তা শুনাতাম এবং মুখস্থ করে ফেলতাম’।[11]
উক্ববাহ ইবনু ‘আমের (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (ছা.)-এর সাথে (তাঁকে কেন্দ্র করে) নিজেদের যাবতীয় কাজকর্ম করতাম। (এমনকি) আমাদের উট চরানোর কাজ আমরা পালাক্রমে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতাম। একদা আমার উপর উট চরাবার পালা এলো। সন্ধ্যায় উটগুলো নিয়ে ফিরে এসে রাসূল (ছা.)-কে ভাষণরত অবস্থায় পেলাম। আমি শুনলাম, তিনি জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘তোমাদের মধ্যকার যে কেউ উত্তমরূপে ওযূ করে, অতঃপর দাঁড়িয়ে বিনয় ও একাগ্রতার সাথে দু’রাকআত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়’। একথা শুনে আমি বললাম, বাহ্ বাহ্, এটা তো অতি উত্তম কথা! তখন (আগে থেকেই উপস্থিত) আমার সামনে বসা এক ব্যক্তি বললেন, হে উক্ববাহ! এর আগে তিনি যা বলেছেন, সেটা আরও উত্তম। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি হ’লেন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রা.)। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আবূ হাফছ! সেটা কি? ওমর (রা.) বললেন, তুমি এখানে আসার একটু আগেই নবী (ছা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যকার যে কেউ উত্তমরূপে ওযূ করার পর এরূপ বলে,أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি একক এবং তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’- তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেয়া হয়। যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’।[12]
এই হাদীছ থেকে ৩টি বিষয় প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ ছাহাবীগণ তাদের কাজগুলো পালাক্রমে ভাগ করে নিতেন যাতে রাসূল (ছা.)-এর সান্নিধ্যে অধিক সময় থাকা যায় এবং তাঁর নিকট থেকে হাদীছ শ্রবণ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ তারা অতি আগ্রহ ও আনন্দের সাথে হাদীছ শ্রবণ করতেন যদি তা অতি অল্পও হ’ত। তৃতীয়তঃ ছাহাবীগণের পারস্পরিক জ্ঞানচর্চার অভ্যাস, যেমনটি ওমর (রা.) এবং উক্ববাহ ইবনু আমের (রা.)-এর মধ্যে ঘটেছিল। কারো কোন জ্ঞান ছাড়া পড়ে গেলে অপরজন সেটি জানিয়ে দিতেন। এভাবেই ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ছা.)-এর হাদীছকে অতি যত্ন ও আগ্রহের সাথে সংরক্ষণ করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা বিশ্বস্ততার সাথে পৌঁছে দিয়েছেন।
সুতরাং হিজরী প্রথম শতকে মূলত মুখস্থকরণই ছিল হাদীছ সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যম। লেখনী এসেছিল পরবর্তী ধাপে। ইবনুল আছীর (৬৩০হি.) বলেন, وكان اعتمادهم أولاً على الحفظ والضبط في القلوب والخواطر غير ملتفتين إلى ما يكتبونه، ولا معوِّلين على ما يسطرونه محافظة على هذا العلم كحفظهم كتاب الله عز وجل، فلما انتشر الإسلام، واتسعت البلاد، وتفرقت الصحابة في الأقطار وكثرت الفتوح ومات معظم الصحابة وتفرق أصحابهم وأتباعهم وقلَّ الضبط احتاج العلماء إلى تدوين الحديث وتقييده بالكتابة ‘তাদের (হাদীছ বর্ণনাকারীগণ) প্রাথমিক নির্ভরতা ছিল মুখস্থকরণ এবং হৃদয়াঙ্গমের উপর, লেখনীর উপর নয়। তারা আল্লাহর কিতাবকে যেভাবে মুখস্থ রাখতেন সেভাবে এই জ্ঞানকেও (হাদীছ) মুখস্থ রাখার লক্ষ্যে লিখিত বস্ত্তর উপর নির্ভর করতেন না। কিন্তু ইসলামের যখন সম্প্রসারণ ঘটল, দেশে দেশে তা বিস্তৃত হ’ল, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছাহাবীগণ ছড়িয়ে পড়লেন, একের পর এক অঞ্চল বিজিত হ’তে লাগল, অধিকাংশ ছাহাবীর মৃত্যু ঘটল, তাদের সাথী ও শিষ্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন এবং মানুষের মুখস্থ সংরক্ষণে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হ’ল, তখন বিদ্বানগণ হাদীছ সংকলন এবং তা লিখিতভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজন বোধ করলেন’।[13]
মুখস্থকরণের মাধ্যমে হাদীছ সংরক্ষণকারী ছাহাবীদের মধ্যে যারা সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন, তারা হ’লেন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (৩২হি.), আয়েশা (৫৮হি.), আবূ হুরায়রা (৫৯হি.), উম্মু সালামাহ (৬১হি.) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আছ (৬৩হি.), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (৬৮হি.), আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (৭৩হি.), আবূ সাঈদ আল-খুদরী (৭৪হি.), জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (৭৮হি.), আনাস ইবনু মালিক (৯৩হি.) প্রমুখ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)।
ছাহাবীদের পরবর্তী প্রজন্ম তথা তাবেঈদের মধ্যে যারা হাদীছের প্রসিদ্ধ হাফেয ছিলেন তারা হ’লেন, সাঈদ ইবনু জুবায়ের (৯৪হি.), আবূ সালামা ইবনু আব্দুর রহমান (৯৪হি.), উরওয়া ইবনুয যুবায়ের (৯৪হি.), সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (৯৪হি.), ইবরাহীম নাখঈ (৯৬হি.), নাফি‘ ইবনু যুবায়ের (৯৯হি.), আমির আশ-শা‘বী (১০৩হি.), ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (১০১হি.), ইকরামা (১০৫হি.), সলিম ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনু ওমর (১০৬হি.), তাঊস ইবনু কায়সান (১০৬হি.), সুলায়মান ইবনু ইয়াসার (১০৭হি.), হাসান বছরী (১১০হি.), মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (১১০হি.), মাকহূল শামী (১১২হি.), ‘আমর ইবনু দীনার (১১৬হি.) নাফে‘ মাওলা ইবনু ওমর (১১৭হি.), কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ আস-সাদূসী (১১৭হি.), ইয়াহইয়া ইবুন ইয়া‘মুর (১১৯হি.), ইবনু শিহাব আয-যুহরী (১২৪ হি.), আবূ ইসহাক্ব আস-সাবীয়ী‘ (১২৭হি.), মানছূর ইবনুল মু‘তামির (১৩৬হি.), উকাইল ইবনু খালিদ আল-আয়লী (১৪৪হি.), হিশাম ইবনু উরওয়াহ (১৪৬হি.), উবায়দুল্লাহ ইবনু ওমর (১৪৭হি.), মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (১৫১হি.), হাম্মাম ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু দীনার আল-বাছরী (১৬৪হি.) প্রমুখ।
ইমাম যাহাবী তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে উপরোক্ত ছাহাবী ও তাবেঈগণসহ মোট ১১৭৬ জন হাদীছের হাফেযের নাম সংকলন করেছেন।[14] সুতরাং নিঃসন্দেহে রাসূল (ছা.)-এর মৃত্যুকালে ছাহাবীগণের কাছে যেমন কুরআন মুখস্থাকারে সংরক্ষিত ছিল, তেমনি রাসূল (ছা.)-এর সুন্নাহও সংরক্ষিত ছিল। ছাহাবীগণের হাদীছ মুখস্থকরণে বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ামক ভূমিকা রেখেছিল।[15]
ক. স্বচ্ছ মস্তিষ্ক এবং প্রখর ধীশক্তি :
আরবরা ছিল নিরক্ষর জাতি। তারা লেখাপড়া জানত না। একজন নিরক্ষরকে নির্ভর করতে হয় তার স্মৃতিশক্তির ওপর। এতে মস্তিষ্কের অধিক ব্যবহারের কারণে স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়ে ওঠে। আর আরব জাতি ছিল অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। তারাই ছিল সেই জাতি যারা নিজেদের বংশপরিচয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর মুখস্থ করে রাখত, তা যত দীর্ঘই হোক না কেন। তারা কোন সুদীর্ঘ কবিতা বা বক্তব্য একবার শুনেই মুখস্থ করে ফেলত। লেখনীর কোন প্রচলন বা চর্চা না থাকায় তারা বংশতালিকা, কাব্যসাহিত্য, চলমান ঘটনাসমূহ, প্রাচীন গল্প-কাহিনী সবকিছুই মুখস্থ করে রাখত। সেই সাথে সভ্যতা থেকে দূরে থাকা এবং অতি সহজ-সরল জীবন যাপনের ফলে তাদের মস্তিষ্ক যাবতীয় পার্থিব জটিলতা থেকে পবিত্র ছিল। ফলে তীক্ষ্ম ধীশক্তি ও বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার জন্য তারা কিংবদন্তীতুল্য হয়ে উঠেছিল।
মুখস্থশক্তিতে আরব জাতি যে সুউচ্চ খ্যাতি অর্জন করেছিল তার তুলনা পৃথিবীর আর কোন জাতির মধ্যে পাওয়া যায় না। তাদের অধিকাংশই তাদের বংশতালিকা মুখস্থ রাখত। শুধু নিজেদের পরিবার ও সম্প্রদায়ই নয়, এমনকি ঘোড়া ও উটের বংশতালিকা পর্যন্ত তারা মুখস্থ রাখত। তাদের ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত তা মুখস্থ রাখত। হাম্মাদ আর-রাভিয়াহ (৯৫-১৫৫হি.) ছিলেন আরবী কবিতার একজন বর্ণনাকারী। তিনিই প্রথম বর্ণনাকারীর অভিধায় ভূষিত হন। তিনি আরবী বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর দিয়ে একশতেরও অধিক কবিতা মুখস্থ করেছিলেন। যার অর্থ কমপক্ষে ৩ হাযার ৩৮টি দীর্ঘ কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল।[16] এই ছিল সাধারণ আরবদের অবস্থা। তাহ’লে ছাহাবীদের ক্ষেত্রে এটি কেমন হবে, যারা কি না রাসূল (ছা.)-কে তাঁদের জীবনের চূড়ান্ত আদর্শ হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ও কর্মমালাকে যেকোন মূল্যে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকতেন? তারা তো কুরআন ও হাদীছকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে স্মৃতিতে ধারণ করে রাখবেন, সেটিই স্বাভাবিক।
খ. ধর্মীয় অভিপ্রায় :
আরবগণ যখন থেকে ইসলামের পরিচয় পেয়েছেন এবং ইসলামকে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হিসাবে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছেন, তখন থেকে দ্বীন পালনই ছিল তাদের জীবনের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সন্দেহ নেই যে, তাদের হাদীছ মুখস্থকরণের পিছনে শক্ত প্রভাবক হিসাবে এই একটি কারণই যথেষ্ট ছিল। পার্থিব জীবনে কোন বিষয় যখন মানুষ গুরুত্বের সাথে নেয়, তখন তার জন্য সর্বোচ্চ মেধা ও প্রচেষ্টা ব্যয় করে।
সুতরাং যাকে ছাহাবীরা জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান বিষয় জ্ঞান করেছিলেন, যার জন্য শত কষ্ট স্বীকার এমনকি জীবন দিতেও সদা প্রস্ত্তত ছিলেন, তার প্রতি তাঁরা কতটুকু মনোযোগী হবেন, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষত রাসূল (ছা.) নিজেই যখন ছাহাবীদেরকে হাদীছ মুখস্থকরণের প্রতি উৎসাহিত করেছিলেন,نَضَّرَ اللهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا، فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ، ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন, যে আমার কোন হাদীছ শ্রবণ করেছে, অতঃপর তা মুখস্থ করেছে এবং তা প্রচার করেছে। কেননা (মুখস্থ ও প্রচারের মাধ্যমে) হয়ত কোন জ্ঞানের বাহক তার চেয়ে অধিকতর জ্ঞানীর কাছে (সেটি) পৌঁছে দেবে। অথবা হয়তবা কোন জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নন’।[17] ফলে হাদীছ মুখস্থ করা ও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াকে ছাহাবীগণ আবশ্যিক কর্তব্য হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন।
যেমন আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন,إِنِّي لَأُجَزِّئُ اللَّيْلَ ثَلَاثَةَ أَجْزَاءٍ: فَثُلُثٌ أَنَامُ، وَثُلُثٌ أَقُومُ، وَثُلُثٌ أَتَذَكَّرُ أَحَادِيثَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسلَّمَ ‘আমি রাতকে তিন ভাগে ভাগ করেছি, এক-তৃতীয়াংশে আমি ঘুমাই, এক-তৃতীয়াংশে রাতের ছালাত আদায় করি এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশে আমি রাসূল (ছা.)-এর হাদীছ মুখস্থ করি’।[18]
গ. পারস্পরিক হাদীছ চর্চার অভ্যাস :
কুরআনের মত হাদীছকে ইসলামী শরী‘আতের অলংঘনীয় ভিত্তি জানার পর ছাহাবীদের মন-মগজে হাদীছ মুখস্থ করার বিষয়টি সহজাত হয়ে পড়েছিল। কেননা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা রাসূল (ছা.)-এর অনুসরণ করতেন। তাঁর বর্ণিত বক্তব্য ও কর্মকে অস্থি-মজ্জায় ধারণ করে পুংখানুপুংখ বাস্তবায়ন ঘটাতেন। তারা জানতেন যে, রাসূল (ছা.)-এর প্রাপ্ত জ্ঞান সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, যাতে এতটুকু ভুলের আশংকা নেই।
ফলে স্বভাবতই মনে-প্রাণে হাদীছ মুখস্থ রাখা এবং মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া তাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অপরিহার্য অংশ ছিল। তাদের অবসরের প্রিয় কাজ ছিল রাসূল (ছা.)-এর কথা ও কর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা এবং তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া। সুন্নাহই ছিল তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ফলে তাদের এই হাদীছ চর্চার অভ্যাস হাদীছ সংরক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কেননা রাসূল (ছা.) তখন জীবিত ছিলেন। কোন হাদীছে কম-বেশী ঘটলে বা কেউ ভুলে গেলে তা সরাসরি তাঁর নিকট থেকেই সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ ছিল। এভাবে হাদীছ শাস্ত্রের হুবহু সংরক্ষণ এবং বহির্মিশ্রণ থেকে পরিশুদ্ধ রাখার প্রক্রিয়াটি আরো নিখুঁত হয়েছিল।
ঘ. রাসূল (ছা.)-এর গৃহীত পদ্ধতি :
রাসূল (ছা.) জানতেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছাহাবীরাই হবেন দ্বীন প্রচারের ধারক ও বাহক। তাই দ্বীন প্রচারে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন শিক্ষকের মত। একজন আদর্শ শিক্ষকের মতই তিনি ছাহাবীদের হাদীছ আত্মস্থকরণের সুবিধার্থে বেশ কিছু প্রক্রিয়া অবলম্বন করতেন। যেমন-
মুখস্থ সংরক্ষণের প্রধান কারণসমূহ :
(১) লেখালেখির প্রচলন না থাকা :
প্রাথমিক যুগে হাদীছ লিখনের পরিবর্তে মুখস্থকরণের অন্যতম কারণ ছিল যে, সেই যুগে আম জনসাধারণ লিখতে বা পড়তে জানত না কিংবা এতে অভ্যস্ত ছিল না।[24] সেজন্যে কুরআনে তাদেরকে নিরক্ষর জাতি হিসাবে পরিচয় দেয়া হয়েছে।[25] রাসূল (ছা.) নিজেই বলেছেন,إِنَّا أُمَّةٌ أُمِّيَّةٌ، لاَ نَكْتُبُ وَلاَ نَحْسُبُ، ‘আমরা হ’লাম নিরক্ষর জাতি। আমরা লিখতে জানি না, হিসাব করতেও জানি না’।[26]
সামান্য যে কয়েকজন লিখতেন, তারাও মূলত মুখস্থকরণের সুবিধার্থে লিখতেন। ১ম শতাব্দী হিজরীর শেষভাগ পর্যন্ত এই রীতিই চালু ছিল। সে যুগে মক্কা ও মদীনায় কেবল পবিত্র কুরআন ব্যতীত কোন লিখিত গ্রন্থ পাওয়া ছিল দুষ্কর। ইমাম মালিক (১৭৯হি.) বলেন, لم يكن مع ابن شهاب كتاب إلا كتاب فيه نسب قومه قال: ولم يكن القوم يكتبون إنما كانوا يحفظون فمن كتب منهم الشيء فإنما كان يكتبه ليحفظه فإذا حفظه محاه، ‘ইবনু শিহাব আয-যুহরীর (নিজস্ব) লিখিত কোন (হাদীছ) গ্রন্থ ছিল না, তাঁর কওমের বংশ সম্পর্কিত সম্বন্ধকৃত গ্রন্থ ছাড়া। মানুষ তখন কিছু লিখত না, বরং মুখস্থ করত। তাদের মধ্যে যারা লিখতেন, তারা কেবল মুখস্থ করার উদ্দেশ্যেই লিখতেন। অতঃপর মুখস্থ হয়ে গেলে তা মুছে ফেলতেন’।[27]
(২) লেখাকে অবমাননাকর মনে করা :
প্রথম শতাব্দী হিজরীর লোকেরা ঐতিহ্যগতভাবে এতটাই স্মৃতিনির্ভর ছিলেন যে, তারা লেখাকে রীতিমত অপমানকর মনে করতেন। যদি কেউ লিখতেনও তবুও বিষয়টি কারো কাছে প্রকাশ করতেন না। কেননা তারা বিব্রতবোধ করতেন এই ভেবে যে, এতে মানুষের কাছে তাদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা প্রমাণিত হবে।[28] ফলে লেখা তো দূরের কথা, একবার কোন কথা শোনার পর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করাও অনেক সময় তাদের জন্য অস্বাভাবিক গণ্য হ’ত।
খ্যাতনামা তাবেঈ বিদ্বান শা‘বী (১০০হি.) বলেন, ما كتبت سوداء في بيضاء، ولا استعدت حديثا من إنسان، ‘আমি না কখনো সাদা কাগজে কালো অক্ষরে লিখেছি, আর না কখনো কোন মানুষের কাছে একবার হাদীছ শোনার পর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করেছি’।[29]
শা‘বী (১০০হি.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, একবার তিনি তাঁর ছাত্র শিবাককে বললেন,يا شباك، أرد عليك، يعني: الحديث؟ ما أردت أن يرد علي حديث قط ‘হে শিবাক! আমি তোমাকে হাদীছ পুনরায় শোনাব? আমি তো কখনই চাইতাম না যে, আমার জন্য কোন হাদীছ পুনরাবৃত্তি করা হোক’।[30]
ইমাম মালেক (১৭৯হি.) বলেন, ইবনু শিহাব যুহরী (১২৪হি.) একবার একটি হাদীছ বর্ণনা করেন। অতঃপর কোন এক রাস্তায় তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হ’ল। আমি তাঁকে তাঁর বাহনের লাগাম ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আবূ বকর (ইমাম যুহরীর উপনাম)! যে হাদীছটি আপনি আমাদেরকে শুনিয়েছিলেন, সেটি পুনরায় আমাকে শোনান। তিনি জবাব দিলেন, তুমি হাদীছ দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা কর? আমি বললাম, কেন আপনি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করতেন না? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, লিখতেনও না? তিনি বললেন, না’।[31]
আদ-দারিমী (২৫৫হি.) তাঁর ‘সুনান’-এর ভূমিকায় পৃথক পরিচ্ছেদ রচনা করে কাতাদাহ, মুজাহিদ, আওযাঈ, ইবরাহীম নাখঈ, ইবনু সীরীন, উবায়দাহ এমন বহু সংখ্যক খ্যাতনামা মুহাদ্দিছদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যারা হাদীছ লিপিবদ্ধ করাকে অপছন্দ করতেন।
ইবনু আব্দিল বার্র (৪৬৩হি.) তাঁর ‘জামেঊ বায়ানিল ইলম’ গ্রন্থে হাদীছ লিপিবদ্ধকরণের বিরোধী মুহাদ্দিছদের বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন, ‘আমি এই পরিচ্ছদে যাদের কথা উদ্ধৃত করেছি, তারা ছিলেন আরবদের পদাংক অনুসরণকারী। তারা প্রকৃতিগতভাবেই ছিলেন মুখস্থকরণের উপর নির্ভরশীল। এটাই ছিল তাঁদের বৈশিষ্ট্য। যারা লেখনীকে অপসন্দ করতেন তারা ছিলেন, ইবনু আববাস (রা.), শা‘বী, ইবনু শিহাব যুহরী, ইবরাহীম নাখঈ, কাতাদাহ এবং তাদের পদাংক অনুসরণকারী ও বৈশিষ্ট্যধারীগণ। মুখস্থ করাই ছিল তাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাদের কারো জন্য একবার শ্রবণ করাই যথেষ্ট হয়ে যেত। যেমন- ইবনু শিহাব যুহরী (১২৪হি.) বলতেন, আমি বাকী‘ অতিক্রম করার সময় নিজের কান বন্ধ করে রাখি এই ভয়ে যে, আমার কানে কোন মন্দ কথা ঢুকে যাবে। আল্লাহর কসম! আমার কানে এমন কোন কথা কখনো ঢোকেনি যা আমি ভুলে গেছি। আশ-শা‘বী (১০০হি.) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে। তারা ছিলেন প্রত্যেকেই আরব। রাসূল (ছা.) বলেন, ‘আমরা একটি নিরক্ষর জাতি, লিখতেও জানি না, হিসাবও জানি না’।[32]
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, আরবরা মুখস্থবিদ্যায় পারঙ্গম ছিল। তাদের কেউ কারো কবিতা একবার শোনাতেই মুখস্থ করে ফেলতেন। ইবনু আববাস (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ওমর ইবনু আবী রাবী‘আহর কবিতা এক শোনাতেই মুখস্থ করেছিলেন। তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই বৈশিষ্ট্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং লেখনীর আবশ্যকতা প্রতিভাত হ’তে থাকে। এজন্য ইবনু আব্দিল বার্র (৪৬৩হি.) বলেন, ‘আজকের যুগে আর এমন কেউ নেই। যদি লিখিত বই না থাকত, তবে জ্ঞানের অনেক কিছুই বিনষ্ট হয়ে যেত। রাসূল (ছা.) জ্ঞান লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছেন। বিদ্বানদের বিরাট সংখ্যক একটি দলও এর অনুমতি দিয়েছেন এবং প্রশংসনীয় কাজ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন’।[33]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বিদ্বানদের মতে, ছাহাবী ও তাবেঈদের একটি দল হাদীছ লেখাকে অপসন্দ করতেন এবং তারা চাইতেন যে, যেমনভাবে তারা নিজেরা হাদীছ মুখস্থ করেছেন, তেমনিভাবে অন্যরাও তাদের কাছ থেকে হাদীছ মুখস্থ করুক’।[34]
(৩) কুরআনের সাথে সাদৃশ্যের আশংকা :
প্রাথমিক যুগে হাদীছ মুখস্থকরণকে প্রাধান্য দেয়ার অন্যতম কারণ ছিল, কুরআনের সাথে লিপিবদ্ধ হাদীছগ্রন্থের সাদৃশ্য ঘটার আশংকা। কুরআনের সমতুল্য বস্ত্তর আবির্ভাবকে তাঁরা কুরআনের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। আবূ নাযরা থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ সাঈদ খুদরী (রা.)-কে বলেন, আপনি কি আমাদেরকে লিখে দিবেন না, যাতে আমরা মুখস্থ করতে পারি? আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বললেন, না, আমি তোমাদেরকে লিখে দেব না এবং তা কুরআনে পরিণত হ’তে দেব না। বরং তোমরা আমাদের নিকট থেকে মুখস্থ কর, যেমনভাবে আমরা রাসূল (ছা.) থেকে মুখস্থ করেছি।[35]
ইবনু মাসঊদ (রা.) জানতে পারলেন যে, লোকদের কাছে একটি কিতাব রয়েছে, যা দেখে তারা চমৎকৃত হয়েছে। তিনি তাদের মাঝে অবস্থানকালেই তাঁর কাছে কিতাবটি আনা হ’ল। ইবনু মাসঊদ (রা.) সেটা পেয়ে মুছে ফেললেন। অতঃপর বললেন,إِنَّمَا هَلَكَ أَهْلُ الْكِتَابِ قَبْلَكُمْ، أَنَّهُمْ أَقْبَلُوا عَلَى كُتُبِ عُلَمَائِهِمْ، وَتَرَكُوا كِتَابَ رَبِّهِمْ ‘তোমাদের পূর্বে আহলে কিতাবরা ধ্বংস হয়েছে। (কেননা) তারা তাদের আলেমদের কিতাবে সন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং তাদের প্রভুর কিতাব থেকে দূরে সরে পড়েছিল’।[36]
ইবরাহীম আন-নাখঈ (৯৬হি.) পুস্তিকায় হাদীছ রচনাকে অপসন্দ করতেন এবং বলতেন, يشبه بالمصاحف ‘এটা কুরআনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যাবে’।[37]
উরওয়া ইবনুয যুবায়ের (৯৪হি.)-কে প্রথম সনদ সহকারে আনুষ্ঠানিক হাদীছ সংকলক বলা হয়। তিনিও কিতাব লেখার পর পুড়িয়ে ফেলেছিলেন কুরআনের সাথে সাদৃশ্য ঘটার ভয়ে। তাঁর পুত্র হিশাম বর্ণনা করেন, হার্রার যুদ্ধের দিন (৬৩হি.) আমার পিতা তাঁর লিখিত কিতাবসমূহ পুড়িয়ে ফেলেন যাতে তা কুরআনের মত গ্রন্থে পরিগণিত না হয়।[38] পরবর্তীতে তিনি অবশ্য এর জন্য অনুতপ্ত হন এবং বলেন, كنا نقول لا يتخذ كتاب مع كتاب الله فمحوت كتبي فوالله لوددت أن كتبي عندي إن كتاب الله قد استمرت مريرته ‘আমরা বলতাম যে, আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিতাব একত্রে থাকতে পারে না। সেজন্য আমার গ্রন্থটি আমি মিটিয়ে ফেলেছিলাম। (এখন) আল্লাহর কসম! আমার আকাঙ্ক্ষা হয় যে, যদি গ্রন্থগুলো আমার কাছে থাকত! আল্লাহর কিতাব তো তার আপন গতিতেই চলমান রয়েছে’।[39]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ.) প্রাথমিক যুগে হাদীছ লিপিবদ্ধ না হওয়ার ৩টি কারণ উল্লেখ করেছেন : (১) কুরআনের সাথে সংমিশ্রণের আশংকায় ছাহাবীদেরকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছিল, যেমনটি ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় পাওয়া যায়। (২) তাদের মুখস্থশক্তির ব্যাপকতা ও চালু মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া (৩) তাদের অধিকাংশেরই লেখনীর ক্ষমতা না থাকা।[40] (ক্রমশঃ)
[1]. মুছত্বফা আল-আ‘যামী, দিরাসাতুন ফিল হাদীছ আন-নাবাভী, ১/৪২; মানাযির আহসান গিলানী, তাদবীনে হাদীছ (লাহোর: আল-মীযান প্রকাশনী, ২০০৫ খ্রি.), পৃ. ৮০।
[2]. আহমাদ হা/১৬৭৫৪, মিশকাত হা/২২৮; ছহীহুত তারগীব হা/৯২।
[3]. দারিমী হা/২৩৫, যায়েদ বিন ছাবেত থেকে বর্ণিত, সনদ ছহীহ।
[4]. আবূদাঊদ হা/৩৬৫৯।
[5]. বুখারী হা/৫৩, ৮৭, ৭২৬৬; মুসলিম হা/১৭।
[6]. বুখারী, হা/১৭৪১; মুসলিম হা/১৬৭৯।
[7]. বুখারী হা/৩৪৬১।
[8]. মুসলিম হা/৯৬৪।
[9]. মুসলিম হা/৭।
[10]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, হাদীছ সংকলনের ইতিহাস, পৃ. ১২৪-১২৫।
[11]. খত্বীব আল-বাগদাদী, আল-জামে‘ লি আখলাকির রাবী, তাহক্বীক : ড. মাহমূদ আত-ত্বহ্হান (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১৯৮৩খ্রি.), ১/২৩৬ হা/৪৬৪।
[12]. মুসলিম হা/১৭ (২৩৪), আবূদাঊদ হা/১৬৯।
[13]. ইবনুল আছীর, জামেঊল উছূল ফী আহাদীছির রাসূল, তাহক্বীক : আব্দুল কাদের আরনাঊত্ব (বৈরূত : মাকতাবাতু দারুল বায়ান, ১৯৬৯খ্রি.), ১/৪০।
[14]. দ্র. শামসুদ্দীন যাহাবী, আল-মুঈন ফী তাবাক্বাতিল মুহাদ্দিছীন (আম্মান : দারুল ফুরকান, ১৪০৪হি.)।
[15]. ড. নূরুদ্দীন ‘ইত্র, মানহাজুন নাক্বদ ফী উলূমিল হাদীছ (দামেশক : দারুল ফিকর, ১৯৭৯ খ্রি.), পৃ. ৩৭-৩৯।
[16]. যিরিকলী, আল-আ‘লাম (বৈরূত : দারুল ইলম লিল মালায়ীন, ১৫শ প্রকাশ, ২০০২খ্রি.), ২/২৭১।
[17]. আবূদাঊদ হা/৩৬৬০; তিরমিযী হা/২৬৫৭; ইবনু মাজাহ হা/২৩০। হাদীছটি বহু সূত্র থেকে বর্ণিত এবং মুতাওয়াতির পর্যায়ভুক্ত।
[18]. দারিমী হা/২৭২।
[19]. বুখারী হা/৩৫৬৭; মুসলিম হা/২৪৯৩।
[20]. তিরমিযী হা/৩৬৩৯।
[21]. বুখারী হা/৯৪, ৯৫।
[22]. বাক্বারা ২/১২৯, ১৫১, ২৩১; আলে ইমরান ৩/১৬৪, নিসা, ১১৩ প্রভৃতি।
[23]. বুখারী হা/৭০১৩; মুসলিম হা/৫২৩।
[24]. মুছত্বফা আ‘যামী, দিরাসাতুন ফিল হাদীছ আন-নাবাভী, ১/৪৩।
[25]. (هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ) জুম‘আ ২।
[26]. বুখারী হা/১৯১৩; মুসলিম হা/১০৮০।
[27]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলম, ১/২৭৪।
[28]. আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দির রহমান আদ-দারিমী, দারিমী, তাহক্বীক : হুসাইন সালীম আসাদ (সঊদীআরব : দারুল মুগনী, ২০০০খ্রি.) হা/৪৯৯।
[29]. তদেব হা/৪৯৯।
[30]. তদেব হা/৪৬৬।
[31]. তদেব হা/৪৬৭।
[32]. মুসলিম হা/১০৮০।
[33]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলম, ১/২৯৪।
[34]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী ১/২০৮।
[35]. দারিমী হা/৪৮৭।
[36]. তদেব হা/৪৮৫।
[37]. তদেব হা/৪৭৯।
[38]. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৯০খ্রি.), ৫/১৩৭।
[39]. আবূ নাঈম আল-আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া (মিসর : দারুস সা‘আদাহ, ১৯৭৪খ্রি.), ২/১৭৬; আবুল কাসিম আলী ইবনুল হাসান ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৯৯৫খ্রি.), ৪০/২৫৮; শামসুদ্দীন যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা (বৈরূত : মু‘আস্সাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ : ১৯৮৫খ্রি.), ৪/৪৩৬।
[40]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১/৬।