ভূমিকা :

রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন। প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে তিনি ছাহাবীদেরকে দ্বীনী ও দুনিয়াবী জীবনে চলার পথ দেখিয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন একাধারে কুরআনের ব্যাখ্যাকার, ইমাম, শিক্ষক, বিচারক ও সেনাপতি। ফলে ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক তথা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছাহাবীদেরকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভুল হ’লে সংশোধন করে দিয়েছেন। এসব ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং আল্লাহরই নির্দেশমালা।[1]

সুতরাং তাঁর এই দিকনির্দেশনা কুরআনের আয়াত হিসাবে লিপিবদ্ধ না হ’লেও তা কুরআনেরই সমমর্যাদাসম্পন্ন এবং অহী হিসাবে পরিগণিত। রাসূল (ছাঃ)-এর এ সকল নির্দেশনা কখনও তাঁর বাণী হিসাবে, কখনও তাঁর কর্ম হিসাবে এবং কখনও তাঁর স্বীকৃতি হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে অনুল্লেখিত এই নির্দেশমালার নাম হ’ল ‘হাদীছ’ বা ‘সুন্নাহ’। পবিত্র কুরআন যেমন একত্রিত আকারে নাযিল হওয়ার পরিবর্তে সুদীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে নানা ঘটনাপ্রবাহে ও প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে, ঠিক তেমনি হাদীছ বা সুন্নাহও রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক কুরআনের ব্যাখ্যা, তাঁর নবুঅতী জীবনের প্রতিটি নির্দেশনা এবং প্রতিটি দিক ও বিভাগের পুংখানুপুংখ আলেখ্য হিসাবে সংরক্ষিত হয়েছে। ছাহাবীগণ যেভাবে কুরআনকে সংরক্ষণ করেছিলেন, ঠিক সেভাবে সুন্নাহকেও যথাযথ গুরুত্বের সাথে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। আলোচ্য প্রবন্ধে এই প্রক্রিয়া কিভাবে ঘটেছিল, কিভাবে এত সুচারুরূপে এই পরিক্রমা সম্পন্ন হয়েছিল তার ধারাবাহিক বিবরণ উল্লেখ করা হ’ল।

ক. ছাহাবীদের শরী‘আত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন পদ্ধতি :

সাধারণত ৩টি পদ্ধতিতে ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর কাছ থেকে শারঈ বিধান অবগত হ’তেন। যেমন :

১. রাসূল (ছাঃ)-এর নিজস্ব বর্ণনা :

ছাহাবীগণ সরাসরি তাঁর কাছ থেকে হাদীছ শুনতেন এবং অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) একবার এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যে কি-না খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করছিল। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিরূপে বিক্রয় কর? সে উত্তর দিল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে অহী আসল, তোমার হাত খাদ্যের ভিতরে ঢুকিয়ে দাও। তিনি হাত ঢুকিয়ে দেখলেন ভিতরের অংশটি আর্দ্র বা ভেজা। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[2]

কখনও শ্রোতার সংখ্যা কম হ’লে রাসূল (ছাঃ) হাদীছটি প্রচারের জন্য লোক পাঠাতেন। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘খায়বার যুদ্ধের দিন ছাহাবীদের একটি দল বলতে লাগলেন, ‘অমুক শহীদ’, ‘অমুক শহীদ’। এভাবে একজন ব্যক্তিকে অতিক্রম করার সময় বললেন, ‘অমুক শহীদ’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘কখনই নয় আমি তাকে জাহান্নামে দেখেছি, একটি চাদরের কারণে, যা সে চুরি করেছে’। অতঃপর তিনি বললেন, হে ইবনু খাত্ত্বাব! তুমি যাও, মানুষকে ডেকে বল যে, ‘মুমিনরা ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। ওমর (রাঃ) বললেন, আমি বের হয়ে মানুষকে ডেকে বললাম, ‘সাবধান! মুমিন ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[3]

২. কোন ঘটনায় রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশিত সমাধান :

ছাহাবীগণ কোন সমস্যায় পতিত হ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট সমাধান চাইলে তিনি সমাধান দিতেন। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের খুঁটিনাটি সকল বিষয়েই তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর শরণাপন্ন হ’তেন। শহর কিংবা গ্রামবাসী নির্বিশেষে অবাধে তাঁকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেতেন। এমনকি তারা অতি গোপনীয় বিষয়ে পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করতেন না। যেমন আলী (রাঃ) বলেন, একবার এক বেদুঈন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, হে রাসূল (ছাঃ)! আমরা পল্লীতে থাকি। আমাদের কোন কোন ব্যক্তির বায়ু নির্গত হয়। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ সত্য বলতে লজ্জাবোধ করেন না। তোমাদের কেউ যদি অনুরূপ কাজ করে, তবে সে যেন ওযূ করে নেয়। আর তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের পশ্চাতদেশে গমন করো না’।[4]

একটি মাত্র প্রশ্নের জন্য তাঁরা দীর্ঘ পথ সফর করে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আগমন করতেন। ‘উকবাহ ইবনুল হারিছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি আবূ ইহাব ইবনু আযীযের কন্যাকে বিবাহ করলেন। পরে এক মহিলা এসে বলল, আমি তো ‘উকবাহ এবং যাকে সে বিয়ে করেছে দু’জনকেই দুধ পান করিয়েছি। উকবা (রাঃ) তাকে বললেন, এটা আমার জানা নেই যে, আপনি আমাকে দুধ পান করিয়েছেন আর আপনিও এ বিষয়ে আমাকে অবহিত করেননি। অতঃপর আবূ ইহাব পরিবারের নিকট লোক পাঠিয়ে তিনি তাদের নিকট জানতে চাইলেন। তারা বলল, সে আমাদের মেয়েকে দুধ পান করিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তখন তিনি (মক্কা থেকে) মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন এবং নবী করীম (ছাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, যখন এরূপ বলা হয়েছে তখন এই (বিবাহ) কিভাবে সম্ভব? তখন ‘উকবাহ (রাঃ) তাকে ত্যাগ করলেন। আর সে স্ত্রীলোক অন্যজনকে বিবাহ করল।[5]

এতদ্ব্যতীত তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ জানার পরও পুনরায় তার সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁর কাছে যেতেন। জনৈক ছাহাবী রামাযান মাসে ছিয়াম অবস্থায় তাঁর স্ত্রীকে চুম্বন করে খুব অনুতপ্ত বোধ করেন। ফলে তাঁর স্ত্রী রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী উম্মু সালামার কাছে গিয়ে বিষয়টি বর্ণনা করলেন। উম্মু সালামা তাঁকে বললেন, রাসূল (ছাঃ)ও ছিয়াম অবস্থায় চুম্বন করেন। মহিলাটি ফিরে গিয়ে তার স্বামীকে এ সংবাদ দিলেন। কিন্তু তিনি আরও অনুতাপ নিয়ে বললেন, ‘আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর মত নই। আল্লাহ তাঁর জন্য যা খুশি হালাল করতে পারেন’। অতঃপর মহিলাটি আবারও উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর নিকট ফিরে এসে দেখতে পেল তাঁর সাথে রাসূল (ছাঃ)ও রয়েছেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এই মহিলাটির কী হয়েছে? উম্মু সালামা তাঁর ব্যাপারে জানালেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি কি তাঁকে বলনি যে আমি এমনটি করি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাকে জানিয়েছি’। মহিলাটি ফিরে গিয়ে আবারও তার স্বামীকে এ কথা জানালেন। কিন্তু তিনি তীব্র অনুতাপ নিয়ে একই কথা পুনরাবৃত্তি করলেন যে, ‘আমরা তো রাসূল (ছাঃ)-এর মত নই। আল্লাহ তাঁর (রাসূল (ছাঃ)-এর) জন্য যা খুশি হালাল করতে পারেন’। এ কথা জেনে রাসূল (ছাঃ) ক্রদ্ধ হ’লেন এবং বললেন, أَنَا أَتْقَاكُمْ لِلَّهِ وَأَعْلَمُكُمْ بِحُدُودِ اللهِ ‘আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু এবং আল্লাহর বিধান সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’।[6]

অনুরূপভাবে মিসওয়ার ইবনু মাখরামাহ থেকে বর্ণিত, ওমর (রাঃ) বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম ইবনে হিযামকে সূরা ফুরক্বান পড়তে শুনলাম। সে তাতে এমন কিছু শব্দ পড়ল যা রাসূল (ছাঃ) আমাকে পড়াননি। ফলে আমি ছালাতরত অবস্থায় তার সাথে প্রায় লড়াইয়ে লিপ্ত হ’তে যাচ্ছিলাম। অতঃপর সে যখন ছালাত শেষ করল, আমি বললাম, তোমাকে এই পাঠরীতি (ক্বিরাআত) কে পড়িয়েছে? সে বলল, রাসূল (ছাঃ) পড়িয়েছেন। আমি বললাম, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহর কসম! তোমাকে রাসূল (ছাঃ) এভাবে পড়াননি। আমি তাকে হাত ধরে টানতে টানতে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে নিয়ে এলাম। আমি বললাম, হে রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাকে সূরা ফুরক্বান পড়িয়েছেন। কিন্তু আমি এই ব্যক্তিকে উক্ত সূরায় এমন কিছু শব্দ পড়তে শুনলাম, যা আপনি আমাকে পড়াননি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, পড় তো হিশাম! সে পূর্বের মতই পড়ল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘এভাবেই নাযিল হয়েছে’। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি পড় ওমর! আমি পড়লাম। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘এভাবেই নাযিল হয়েছে’। অতঃপর তিনি বললেন, إِنَّ الْقُرْآنَ نَزَلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ ‘নিশ্চয়ই কুরআন সাত হরফে নাযিল হয়েছে’।[7]

এভাবে বিভিনণ ঘটনায় প্রদত্ত রাসূল (ছাঃ)-এর সিদ্ধান্ত, ফৎওয়া ও রায় হাদীছ গ্রন্থসমূহের বিবিধ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। যে সকল ছাহাবীর সাথে ঘটনাগুলো ঘটেছিল তারা সেসব ভুলে যাবেন কিংবা ভুলভাবে বর্ণনা করবেন, তা অকল্পনীয়। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ঘটে যাওয়া এ সকল ঘটনা ছিল তাদের জীবনের চিরস্মরণীয় অংশ।

৩. ছাহাবীগণের স্বচক্ষে দেখা রাসূল (ছাঃ)-এর কর্মসমূহ :

যে সকল কাজ ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, সফর, যুদ্ধ প্রভৃতি সময়ে করতে দেখেছেন, অতঃপর তাবেঈদের কাছে তা বর্ণনা করেছেন। হাদীছ গ্রন্থসমূহের একটি বিরাট অংশ জুড়ে এমন সব বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়েছে, যাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যক্তিজীবন, ধর্মীয় জীবন, সামাজিক জীবন সবকিছুই বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন হাদীছে জিবরীল। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত প্রসিদ্ধ এই হাদীছে ঈমান, ইহসান, ইসলাম এবং ক্বিয়ামতের সময় সম্পর্কে জিবরীল (আঃ)-এর প্রশ্ন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর উত্তর দেয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।[8]

অনুরূপভাবে নিযাল ইবনু সাবরাহ থেকে বর্ণিত, একদিন আলী (রাঃ) কূফায় যোহরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর মানুষের প্রয়োজন পূরণার্থে মসজিদের আঙ্গিনায় বসলেন। এমতাবস্থায় আছরের ছালাতের সময় হয়ে গেল। তাঁর জন্য ওযূর পানি আনা হ’ল। তিনি পানি পান করলেন, (ওযূর জন্য) মুখ, হাত, মাথা ও পা ধৌত করলেন এবং অতিরিক্ত পানিটুকু দাঁড়িয়ে পান করলেন। অতঃপর বললেন, মানুষ দাঁড়িয়ে পান করা অপসন্দ করে। অথচ আমি রাসূল (ছাঃ)-কে এভাবে (দাঁড়িয়ে) পান করতে দেখেছি, যেভাবে তোমরা আমাকে দেখছ।[9]

মোটকথা ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহর প্রেরিত নবী, মানবজাতির শিক্ষক এবং চূড়ান্ত অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে তাঁর প্রতিটি কথা, কর্ম ও পদক্ষেপ অনুসরণ করতেন। তাঁর প্রতিটি বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন ও জানার চেষ্টা করতেন। আর কেনইবা নয়, যাকে মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ট মানুষ হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে, তাঁর প্রতি যেকোন মানুষের সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকাই স্বাভাবিক। ফলে এ কথা সুনিশ্চিত যে, পবিত্র কুরআনের মত রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ ও ছাহাবীদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। যদিও মানবিক ক্ষমতা অনুসারে সেই সংরক্ষণে তারতম্য ছিল। কেউ বেশী সংরক্ষণ করেছিলেন, কেউ মধ্যম পর্যায়ে, কেউবা কম। এভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর পুরো জীবন ও কর্মই তাঁরা ধারণ করেছিলেন।

খ. হাদীছ সংরক্ষণের সূচনা

সুন্নাহর সংরক্ষণের কাজটি ছাহাবীদের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। তারা ছিলেন সেই প্রজন্ম, যাদেরকে আল্লাহ তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সাহচর্যের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। তারাই ছিলেন মুসলিম উম্মাহর সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম, যার স্বীকৃতি রাসূল (ছাঃ) নিজেই প্রদান করেছেন।[10] তারাই ছিলেন সেই প্রজন্ম, যারা কুরআনকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের মহান দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফলে অতি স্বাভাবিকভাবে তারাই ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশাবলী এবং জীবনাচার তথা সুন্নাহ সংরক্ষণের মূল কারিগর। তাদের এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়।

(ক) আমলের মাধ্যমে সংরক্ষণ :

সুন্নাহর অনানুষ্ঠানিক সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল ছাহাবীদের আমলের মাধ্যমে। কেননা সুন্নাহ কেবল তত্ত্বীয় ও দার্শনিক বিষয় নয়, বরং তা বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। রাসূল (ছাঃ)-এর নবুঅত প্রাপ্তির পর যখন দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন প্রাথমিক পর্যায়ে গোপনে গুটিকয়েক নবমুসলিমকে নিয়ে মক্কার ‘দারুল আরকাম’ এ একত্রিত হ’তেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে কুরআনের মর্মবাণী এবং দ্বীনের বিধি-বিধান শিক্ষা দিতেন। এভাবে মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে সুন্নাহর চর্চা শুরু হয়। রাসূল (ছাঃ) কেবল ছাহাবীদেরকে উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং তাঁর ২৩ বছরের নবুঅতী যিন্দেগীতে ছাহাবীদেরকে দৈনন্দিন জীবনের ইবাদতের পদ্ধতি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান পদ্ধতি সবই হাতে-কলমে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

আর ছাহাবীরাও ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (ছাঃ)-কে সাহচর্য দানের জন্য মনোনীত ব্যক্তি। সুতরাং তারা রাসূল (ছাঃ) থেকে কোন কথা জানা মাত্রই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে তা পূর্ণভাবে অনুসরণ করতেন। এমনকি তাঁর প্রতিটি ব্যক্তিগত অভ্যাসও তারা অনুসরণ করতেন। পুরো পরিবেশটা তখন ছিল সুন্নাহর উপর আমলের পরিবেশ। সুন্নাহকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হ’ত তাদের সার্বিক জীবনাচার। অতঃপর তাদের নিকট থেকে পরবর্তী প্রজন্ম তথা তাবেঈগণও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ শিক্ষা করেছিলেন এবং পূর্ণ আমানতদারীর সাথে সুন্নাহকে তাবে‘ তাবেঈদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সুতরাং ছাহাবী ও তাবেঈদের সুন্নাহর উপর আমল এবং নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মাধ্যমে সুন্নাহ সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে।[11] মূলতঃ কয়েকটি বিষয় এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল।-

১. রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যক্তিগত প্রয়াস :

আল্লাহর নবী হিসাবে রাসূল (ছাঃ) দ্বীনের প্রচারে সর্বোচ্চ আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছাহাবীদেরকে জুম‘আ বা ঈদের দিনের মত উপলক্ষ ছাড়াও নিয়মিত আল্লাহ প্রদত্ত হুকুম-আহকাম শিক্ষা দিতেন। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান দিতেন। এ সকল হুকুম-আহকাম মুসলমানদের অভ্যাসে এবং স্বভাবে পরিণত করার জন্য বিশেষ যত্ন নিতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ রাসূল (ছাঃ) ছালাত সম্পর্কে বলেন,صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي ‘তোমরা সেভাবে ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখেছ’।[12] অনুরূপভাবে হজ্জ সম্পর্কে তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ ‘তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জের নিয়ম-কানূন গ্রহণ কর’।[13] এভাবে ধীরে ধীরে ইসলামী শরী‘আত পূর্ণতা লাভ করতে থাকে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু অবধি এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে।

২. ইসলামের নতুন জীবনবিধানের স্বাভাবিক চাহিদা :

নবমুসলিমগণ প্রাত্যহিক জীবনের নানা সমস্যার সমাধান পেতে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসতেন। বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পর ধর্মীয় তাকীদেই তাদেরকে প্রতিটি বিষয় জানার প্রয়োজন হ’ত। তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে জেনে নিয়ে তা আবার স্বীয় পরিবারে কিংবা স্বীয় গোত্রে প্রচার করতেন। এভাবেই সুন্নাহর প্রসার হ’তে লাগল। অনেকেই দ্বীন শিক্ষার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতেন। মালিক ইবনুল হুয়ায়রিছ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে আসলাম। আমরা তখন প্রায় সমবয়সী যুবক ছিলাম। বিশ দিন তাঁর কাছে আমরা থাকলাম।

অতঃপর তিনি অনুভব করলেন যে, আমরা আমাদের পরিবারের কাছে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। তিনি আমাদের কাছে বাড়িতে অবস্থানরত পরিবার-পরিজনের খবরাখবর জানতে চাইলেন। আমরা তাঁকে জানালাম। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও দয়ার্দ্র। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যাও। তাদের (দ্বীন) শিক্ষা দাও, (সৎ কাজের) আদেশ কর এবং যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনভাবে ছালাত আদায় কর। ছালাতের ওয়াক্ত হ’লে, তোমাদের একজন আযান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামতি করবে’।[14] 

৩. ছাহাবীদের ঐকান্তিক আগ্রহ :

ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-কে প্রাণাধিক ভালবাসতেন। তাঁর সাথে ছায়ার মত লেগে থাকতেন। সবসময় তাঁর পক্ষ থেকে নতুন কোন বিধান নাযিলের জন্য অপেক্ষা করতেন। ফলে কোন বিধান জারী হওয়ার সাথে সাথে তা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতেন এবং বাস্তবে আমলে পরিণত করতেন। যেমন মদ হারাম ঘোষণার কাহিনী সম্পর্কে আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, ‘আমি একদা আবূ তালহার বাড়িতে লোকজনকে মদ পান করাচ্ছিলাম। সেসময় লোকেরা ফাযীখ বা কাঁচা-পাকা খেঁজুরের মদ পান করত। এমতাবস্থায় (মদ হারামের ঘোষণা দিয়ে) রাসূল (ছাঃ) একজনকে পাঠিয়ে দিলেন যে, ‘সাবধান! মদ হারাম করা হয়েছে’। (ঘোষণা শোনার পর) আবূ তালহা আমাকে বললেন, ‘তুমি বাইরে যাও এবং সমস্ত মদ ঢেলে দাও। (তাঁর নির্দেশ মোতাবেক) আমি বাইরে গেলাম এবং সমস্ত মদ ঢেলে দিলাম। সেদিন মদীনার রাস্তায় রাস্তায় মদের স্রোত গড়াতে লাগল।’[15]

এক ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-কে বললেন, আমরা কুরআনে কেবল ভয়কালীন ছালাত এবং নিজ বাড়িতে অবস্থানকালীন ছালাতের উল্লেখ দেখতে পাই; কিন্তু সফরকালীন ছালাতের কোন উল্লেখ কুরআনে পাই না। এর কারণ কি? উত্তরে তিনি বললেন,إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ بَعَثَ إِلَيْنَا مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا نَعْلَمُ شَيْئًا، وَإِنَّمَا نَفْعَلُ كَمَا رَأَيْنَا مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْعَلُ ‘আমরা দ্বীন সম্পর্কে কিছু জানতাম না। এমতাবস্থায় আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে রাসূল করে পাঠালেন। অতঃপর আমরা কেবল তা-ই করি যেভাবে রাসূল (ছাঃ)-কে করতে দেখেছি।[16] এভাবে তারা পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের বিধান পালনে ও একে অপরের কাছে তা প্রচারে সহযোগিতা করার জন্য উন্মুখ থাকতেন।

৪. রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ :

সুন্নাহর প্রসারে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে রাসূল (ছাঃ)-এর একান্ত ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তাঁরাই সবচেয়ে বেশী অবহিত করেছেন। মহিলারা অনেক সময় গোপনীয় বিষয়সমূহ রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করত। ফলে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের নিকট যেতেন এবং মাসআলা জেনে নিতেন। রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা (রাঃ) ছিলেন জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী। উদাহরণস্বরূপ ইবনু আবী মুলায়কা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) নিজের অজানা কোন বিষয় শোনামাত্র তা পুনরালোচনা করতেন যতক্ষণ না সেটি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত হ’তেন। (একদা) রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তির হিসাব গ্রহণ করা হবে, তার শাস্তি হবে’। (এ কথা শুনে) আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ কি (কুরআনে) বলেননি যে, ‘তার হিসাব-নিকাশ সহজেই নেয়া হবে’ (ইনশিক্বাক্ব ৮৪/৮)? রাসূল (ছাঃ) বললেন, এর দ্বারা (আমলনামা মীযানের পাল্লায়) উপস্থাপনকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু যার হিসাব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা হবে, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।[17] ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আয়েশা (রাঃ) শরী‘আতের বিধি-বিধান জানার জন্য ছাহাবীদের নিকট অন্যতম প্রধান সূত্র হিসাবে পরিগণিত হ’তেন।

৫. মহিলা ছাহাবীগণ :

মহিলা ছাহাবীগণও সুন্নাহর প্রসারে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। পুরুষদের পাশাপাশি তাঁরাও রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বিশেষ বৈঠকের দিন নির্ধারণ করেছিলেন, যাতে তারা তাদের প্রয়োজনীয় বিষয় জেনে নিতে পারেন এবং দ্বীনের হুকুম-আহকাম শিখতে পারেন।[18] অনুরূপভাবে তারা বিশেষ উপলক্ষসমূহে যেমন ঈদের জামা‘আতে হাযির হ’তেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ শুনতেন।[19] এ সকল মহিলা ছাহাবীগণ বিশেষত নারী বিষয়ক এবং বৈবাহিক জীবন সম্পর্কিত অনেক হুকুম-আহকাম মুসলিম উম্মাহর জন্য সংগ্রহ করেছেন, যা কি-না পুরুষ ছাহাবীদের পক্ষে রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা কঠিন ছিল।

৬. রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত দূতগণ :

হিজরতের পর মদীনা নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত দূতগণ আশেপাশের গোত্রসমূহে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতেন। নতুন মুসলমানদের দ্বীনের বিধি-বিধান শেখাতেন। রাসূল (ছাঃ) এ সকল দূতকে দাওয়াতের নীতিমালা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতেন। যেমন মু‘আয (রাঃ) এবং আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ)-কে ইয়ামানে দাওয়াতী সফরে প্রেরণকালে উপদেশ দিলেন যে, ‘তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না; মানুষকে সুসংবাদ দাও, আশাহত করো না’।[20] মু‘আয (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি অচিরেই আহলে কিতাবদের একটি সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ। তুমি তাদেরকে আহবান কর এই সাক্ষ্যদানের জন্য যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন হক্ব উপাস্য নেই এবং আমি তাঁর রাসূল’। যদি তারা এই ব্যাপারে তোমাদেরকে মান্য করে, তবে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাদের ওপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। যদি এ ব্যাপারে মান্য করে, তাহ’লে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তোমাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের মধ্যকার ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হবে। যদি এ ব্যাপারে তারা তোমার আনুগত্য করে, তবে (যাকাত গ্রহণের সময়) তাদের সর্বোত্তম সম্পদসমূহ নেয়া থেকে সাবধান থেক। আর মাযলূমের দো‘আ থেকে ভয় কর। কেননা তার মাঝে এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না’।[21] আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট একদল লোক আসল এবং তারা বলল, ابْعَثْ مَعَنَا رِجَالًا يُعَلِّمُونَا الْقُرْآنَ وَالسُّنَّةَ ‘আমাদের সাথে কিছু লোক প্রেরণ করুন, যারা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ শেখাবে’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ৭০ জন আনছার ছাহাবীকে প্রেরণ করলেন’।[22]

ইসলামের দাওয়াত প্রচার এবং শরী‘আতের বিধি-বিধান তথা সুন্নাহকে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ) প্রেরিত দূত এবং দাওয়াতী কাফেলার বিরাট ভূমিকা ছিল। ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এ সকল কাফেলা প্রেরণ আরও বৃদ্ধি পেল। রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের নিকট স্বীয় সিলমোহরকৃত বার্তাসহ দূত প্রেরণ করতে লাগলেন। এমনকি একই দিনে ছয় জন দূতকে ছয়টি গন্তব্যে প্রেরণ করেছিলেন, যাদের প্রত্যেকেই সেই সকল অঞ্চল সমূহের ভাষা জানতেন।[23] তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি বাইজান্টাইনের (রোমাক সাম্রাজ্য) রাজা হেরাক্লিয়াস, পারস্যের (সাসানী সাম্রাজ্য) রাজা খসরু পারভেজ, হাবশার রাজা নাজ্জাশী প্রমুখের নিকটেও তিনি দূত পাঠিয়েছিলেন।[24]

৭. মক্কা বিজয় :

মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এই বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামের পতাকা পৃথিবীর বুকে স্থায়ী ভিত্তি লাভ করে। এতে বিশ্বের নব্য পরাশক্তি হিসাবে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং বিশ্বজয়ের দ্বার খুলে যায়। এই বিজয়ের মাধ্যমে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। আরবের চতুর্দিক থেকে বিভিন্ন গোত্র থেকে প্রতিনিধিরা আগমন করতে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) নিজেও প্রতিনিধি প্রেরণ করতে থাকেন। ফলে ক্রমবর্ধমান মুসলিম সমাজে সুন্নাহর ব্যাপক প্রসার ঘটে।

৮. বিদায় হজ্জ :

দশম হিজরীতে রাসূল (ছাঃ) হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা রওয়ানা হ’লেন। তাঁর সহযাত্রী ছিলেন নববই হাযার ছাহাবী। হজ্জের দিন আরাফার ময়দানে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বিরাট সংখ্যক হাজীদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, যা ‘বিদায় হজ্জের ভাষণ’ নামে পরিচিত। এই ভাষণে মুসলমানদের রক্ত ও সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম, আমানত রক্ষা করা, সূদ হারাম হওয়া, পুরুষ ও মহিলার পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার প্রভৃতি হুকুম-আহকাম সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। আরবের গোত্রসমূহে সুন্নাহর প্রসার ঘটায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই ভাষণের। কেননা এতে শ্রোতা ছিল বিশাল সংখ্যক। তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর আহবানে (আমি কি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি? আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। তোমাদের মাঝে যারা উপস্থিত রয়েছে তারা অনুপস্থিতের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেবে)[25] সাড়া দিয়ে আরবের প্রান্তে প্রান্তে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহকে পৌঁছে দেন। বিদায় হজ্জে পাথর নিক্ষেপের সময় তিনি সমাবেত ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জের নিয়ম-কানূনগুলো গ্রহণ কর (শিখে নাও)। কারণ আমার জানা নেই, হয়তবা এই হজ্জের পর আমি আর হজ্জ আদায় করতে পারব না’।[26]

এভাবে নানা মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেই ধাপে ধাপে মুসলিম সমাজে হাদীছ বা সুন্নাহসমূহের সার্বিক প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ সম্পন্ন হয় এবং রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।[27] আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের ঘোষণা-الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নে‘মতরাজি সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পসন্দ করলাম’ (মায়েদা ৩)

(ক্রমশঃ)


[1]. নাজম, ৩ ও ৪; হাক্কাহ, ৪৭।

[2]. আহমাদ হা/৭২৯০; আবুদাঊদ হা/৩৪৫২, সনদ ছহীহ।

[3]. আহমাদ হা/২০৩; মুসলিম হা/১১৪; মিশকাত হা/৪০৩৪।

[4]. আহমাদ হা/৬৫৫, মিশকাত হা/৩১৪, সনদ হাসান।

[5]. বুখারী হা/২৬৪০।

[6]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/১০২০; আহমাদ হা/২৩৭৩২, সনদ ছহীহ।

[7]. আহমাদ হা/১৫৮, সনদ ছহীহ।

[8]. বুখারী হা/৫০; মুসলিম হা/৫ ও ৭।

[9]. বুখারী হা/৫০১৫ ও ৫০১৬।

[10]. ইমরান ইবনু হোছাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম। তারপর এর পরবর্তী যুগের লোকেরা। তারপর এর পরবর্তী যুগের লোকেরা। ইমরান (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) এ কথাটি দু’বার কি তিনবার বললেন, তা আমার স্মরণ নেই- তারপর এমন লোকেরা আসবে যে, তারা সাক্ষ্য দিবে, তাদের কাছে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। তারা খিয়ানত করবে, তাদের নিকট আমানত রাখা হবে না। তারা মানত করবে, তা পূরণ করবে না। তারা দেখতে মোটা তাজা হবে (বুখারী হা/২৬৫১, ৩৬৫০, ৬৪২৮, ৬৬৯৫; মুসলিম হা/২৫৩৫।

[11]. দ্র. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, হাদীস সংকলনের ইতিহাস (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, ১৯৯৭ খ্রি.), ১২৯-১৩৩।

[12]. বুখারী হা/৬৩১।

[13]. আহমাদ হা/১৪৭৯৩; ইবনু আব্দিল বার্র, জামে‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী (সঊদী আরব : দারু ইবনুল জাওযী, ১৯৯৪খ্রি.) হা/৭২১; মুসলিমে হাদীছের ভাষ্যটি হ’ল- لتأخذوا مناسككم হা/১২৯৭।

[14]. বুখারী হা/৬৩১, ৬০০৮, ৭২৪৬; মুসলিম হা/৬৭৪।

[15]. বুখারী হা/২৪৬৪।

[16]. আহমাদ হা/৫৩৩৩; নাসাঈ হা/১৪৩৪, সনদ ছহীহ।

[17]. বুখারী হা/১০৩।

[18]. বুখারী হা/১০১, ৭৩১০; মুসলিম হা/২৬৩৩।

[19]. বুখারী হা/৩০৪, ৯৫৬, ১৪৬২; মুসলিম হা/৮৮৯।

[20]. মুসলিম হা/১৭৩৩।

[21]. বুখারী হা/১৪৯৬, ৪৩৪৭; মুসলিম হা/১৯।

[22]. মুসলিম হা/৬৭৭; ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ৩/৩৯০।

[23]. মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন ইবনু হুদাইদা, আল-মিছবাহুল মুযী ফী কিতাবিন নাবিইয়িল উম্মী (বৈরূত : ‘আলামুল কুতুব, তাবি), ১/১৯৩-১৯৪।

[24]. দ্র. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছা.) (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০১৬ খ্রি.), পৃ. ৪৬৭-৪৮৮।

[25]. বুখারী হা/১৭৩৯, ১৭৪১; মুসলিম হা/১৬৭৯ ও ১৬৮০।

[26]. মুসলিম হা/১২৯৭।

[27]. দ্র. ড. মুহাম্মাদ উজাজ আল-খাত্বীব, আস-সুন্নাহ কাবলাত তাদভীন, পৃ. ৬৮-৭৪।






ইয়ারমূক যুদ্ধ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মাহে রামাযানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য - ড. মুহাম্মাদ আলী
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মসজিদের আদব - হাফীযুর রহমান, নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর
দাওয়াত ও সংগঠন - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
জালূলার যুদ্ধ ও হুলওয়ান বিজয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
হিজামা : নবী (ছাঃ)-এর চিকিৎসা - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
তালাক সংঘটিত হওয়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায় - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
আল্লাহর উপর ভরসা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আরও
আরও
.