হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (৪র্থ কিস্তি)

পর্ব ১। পর্ব ২ পর্ব ৩

লিখিতভাবে সংরক্ষণের ধাপসমূহ :

(১) অনানুষ্ঠানিক লেখনী :

ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনকালেই হাদীছ লিপিবদ্ধ করতেন। তবে সেটা ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে করেছিলেন না রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে করেছিলেন, তা নির্ণয় করা মুশকিল।[1] সাধারণভাবে ধারণা করা যায় যে, সেটা ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং মুখস্থকরণে সহযোগী মাধ্যম হিসাবেই সম্পাদিত হয়েছিল।[2] এসব লেখনী ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে হওয়ার কারণে প্রাচ্যবিদগণ এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত একদল মুসলমান ধারণা করে যে, হাদীছ শাস্ত্র হিজরী ১ম শতাব্দীতে লিপিবদ্ধ হয়নি। অথচ এই সময়টি ছিল হাদীছ শাস্ত্র সংরক্ষণ ও সংকলনের প্রাথমিক ধাপ। এসময় একদল ছাহাবী এবং তাবেঈ যখন হাদীছ মুখস্থকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রয়াস নিয়েছিলেন, তখন অপর একদল ছাহাবী লিখিতভাবে সংরক্ষণেও সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই ধাপে অনানুষ্ঠানিকভাবে সংকলন শুরু হয়। যা ছিল পরবর্তীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ কিতাব রচনার জন্য প্রধান রসদ। এভাবে তাদের ধারাবাহিক প্রয়াস হাদীছের চূড়ান্তভাবে গ্রন্থাবদ্ধ হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

প্রথম হিজরী শতাব্দীতে হাদীছ লিপিবদ্ধভাবে সংকলনের ইতিহাসের উপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন ড. ফুয়াদ সেযগীন (১৯২৪খৃ.-)[3], ড. মুছত্বফা আল-আ‘যামী (১৯৩০-২০১৭ খৃ.)[4], ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ (১৯০৮-২০০২ খৃ.)[5] এবং প্রাচ্যবিদদের মধ্যে ড. নাবিয়া এ্যাবোট (১৮৯৭-১৯৮১ খৃ.)[6]। তাঁরা নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই যুগে বিক্ষিপ্তভাবে সংকলিত ও লিপিবদ্ধ হাদীছসমূহ অনেকটাই উদ্ধার করেছেন। এতে দেখা গেছে পরবর্তী যুগে সংকলিত অধিকাংশ হাদীছই প্রথম যুগে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং এ কথা বলার আর সুযোগ নেই যে, প্রথম যুগে শুধুমাত্র মুখস্থ আকারে সংরক্ষিত হওয়ায় হাদীছ শাস্ত্র সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি। নিম্নে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় লিখিত নথিসমূহ উল্লেখ করা হ’ল।

রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে লিখিত সংকলনসমূহ :

রাসূল (ছাঃ) আরবে এবং আরবের বাইরে রাজনৈতিক সমঝোতা এবং ইসলামের দাওয়াত প্রচারের উদ্দেশ্যে গোত্রপতি, শাসক প্রমুখের উদ্দেশ্যে পত্র প্রেরণ করতেন এবং চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করতেন। হাদীছ ও ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে এসবের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ (২০০২খৃ.) রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর মাক্কী জীবন থেকে শুরু করে বিদায় হজ্জ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হওয়া এমন প্রায় ২৮০টি দলীল উপস্থাপন করেছেন।[7] এ সকল লিখিত দলীলসমূহ কয়েকভাবে বিভক্ত। যেমন-

(ক) শাসক ও রাজন্যবর্গের প্রতি প্রেরিত পত্রসমূহ :

রাসূল (ছাঃ) রোম সম্রাট কায়ছার হেরাক্লিয়াস, পারস্য সম্রাট কিসরা, মিসর রাজা মুক্বাওক্বিস, ইয়ামামার খৃষ্টান শাসক হাওযাহ ইবনু আলী, দামিশকের খৃষ্টান শাসক হারিছ ইবনু আবী শিমর আল-গাস্সানী, বাহরাইনের শাসক মুনযির ইবনু সাওয়া, ওমানের শাসক জায়ফার ও তাঁর ভাই, হাবশার সম্রাট নাজাশী, হিময়ারের বাদশাহ প্রমুখ প্রতাপশালী শাসকের নিকটে পত্র প্রেরণ করেন।[8]

(খ) গোত্রসমূহের প্রতি প্রেরিত পত্রসমূহ :

রাসূল (ছাঃ) ইসলামের প্রতি আহবান জানিয়ে বিভিন্ন গোত্রের নিকটেও পত্র পাঠাতেন। যেমন বনু হারিছা ইবনু আমর, নাজরানের এক বিশপ পাদ্রী, জুরবা ও আযরাহবাসী, ইয়ামানবাসী, আসলাম গোত্র, বনু জুযাম, বনু খোযা‘আহ প্রভৃতি গোত্রের নিকট তাঁর প্রেরিত পত্রসমূহ।[9] কখনও দূরবর্তী কোন গোত্রের প্রতিনিধি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসতেন এবং দীর্ঘ সময় তাঁর কাছে হাতে-কলমে দ্বীন শিক্ষার জন্য অবস্থান করতেন। অতঃপর প্রত্যাবর্তনের সময় তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট স্বীয় গোত্রের জন্য লিখিত নির্দেশিকা চাইতেন। রাসূল (ছাঃ) তাদের জন্য নির্দেশিকা লিখে দিতেন। যেমন (ক) ইয়ামান থেকে ওয়ায়েল ইবনু হুজর (রাঃ) এসেছিলেন এবং ফেরৎ যাওয়ার সময় তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে অনুরোধ করেন, اكْتُبْ لِي إِلَى قَوْمِي كتابا ‘আমার কওমকে উদ্দেশ্য করে আমাকে একটি পত্র লিখে দিন’। রাসূল (ছাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে দিয়ে ৩টি পত্র লিখিয়ে নিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল ওয়ায়েল ইবনু হুজর (রাঃ)-এর জন্য ব্যক্তিগত এবং অপর দু’টি সাধারণভাবে ছালাত ও যাকাত আদায় এবং মদ, সূদ প্রভৃতি থেকে বেঁচে থাকার উপদেশ সম্বলিত।[10] (খ) গামিদ গোত্রের ১০ জন লোক মদীনায় এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে শরী‘আতের বিধি-বিধান সম্বলিত একটি পুস্তক প্রদান করেন এবং উবাই ইবনু কা‘বের নিকট কুরআন শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন।[11] (গ) খাছ‘আম গোত্রের একদল লোক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসল এবং ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্য এমন একটি পত্র লিখে দিন, যা আমরা অনুসরণ করব। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে (দ্বীনের বিধান সম্বলিত) একটি পত্র লিখে দিলেন’।[12]

(গ) মুসলিম শাসক, বিচারক এবং যাকাত আদায়কারী কর্মকর্তাদের প্রতি প্রেরিত পত্রসমূহ :

মুসলিম রাষ্ট্রের প্রসারের সাথে সাথে রাসূল (ছাঃ) তাঁর নিয়োগকৃত বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তা, সেনাপতি, কাযী এবং সরকারী কর্মচারীদের নিকট লিখিত পত্র প্রেরণ করতেন। যেমন রাসূল (ছাঃ) আমর ইবনু হাযম (রাঃ) সহ অন্যান্য শাসকদেরকে যাকাত (রাজস্ব) আদায়ের নিয়মাবলী এবং দ্বীনের বিভিন্ন ফরয ও সুন্নাতসমূহ সম্পর্কে নির্দেশিকা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। রাসূল (ছাঃ) আমর ইবনু হাযম (৫০হি.)-কে দশম হিজরীতে ইয়ামানের নাজরানে গভর্নর হিসাবে প্রেরণকালে ইয়ামানবাসীর উদ্দেশ্যে একটি দীর্ঘ নছীহতনামা প্রদান করেন। যেখানে পবিত্রতা, ছালাত, যাকাত, ওশর, হজ্জ, ওমরাহ, জিহাদ, গনীমত ও জিযিয়া প্রভৃতি অনেক বিষয়ে নির্দেশিকা লিখিত হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর এই লিখিত দলীলটি তাঁর পৌত্র আবুবকর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযমের নিকটে রক্ষিত ছিল। ইবনু শিহাব আয-যুহরী এই দলীলটি নিজে পাঠ করেন এবং বর্ণনা করেন।[13] আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَتَبَ كِتَابَ الصَّدَقَةِ، فَلَمْ يُخْرِجْهُ إِلَى عُمَّالِهِ حَتَّى قُبِضَ، فَقَرَنَهُ بِسَيْفِهِ، فَلَمَّا قُبِضَ عَمِلَ بِهِ أَبُو بَكْرٍ حَتَّى قُبِضَ، وَعُمَرُ حَتَّى قُبِضَ ‘রাসূল (ছাঃ) যাকাতের নীতিমালা সম্পর্কে একটি ফরমান লিপিবদ্ধ করান। কিন্তু কর্মচারীদের নিকট প্রেরণের পূর্বেই তিনি ওফাত প্রাপ্ত হন। ফলে এটা তাঁর তরবারির সাথে যুক্ত ছিল। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) আমৃত্যু যাকাত আদায়ের উক্ত নীতিমালা অনুসরণ করেন। একইভাবে ওমর (রাঃ)ও আমৃত্যু একই নীতি অবলম্বন করেন’।[14] ইমাম যুহরী বলেন, সালিম ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) আমাকে এটি পড়িয়েছেন এবং আমি তা মুখস্থ করে নিয়েছি। ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (রহঃ) ইবনু ওমর (রাঃ)-এর দুই পুত্র সালিম এবং আব্দুল্লাহর নিকট থেকে এটি অনুলিপি করে নেন।[15]

(ঘ) চুক্তিনামা এবং সন্ধিসমূহ :

ইতিহাসগ্রন্থসমূহে এরূপ অসংখ্য পত্রের নযীর পাওয়া যায়। যেমন রাসূল (ছাঃ) মদীনায় পৌঁছানোর পর সেখানকার অধিবাসী ইহুদী এবং অন্যান্য আরব গোত্রসমূহকে সাথে নিয়ে কিছু চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করেন। এতে প্রায় অর্ধশত ধারা সন্নিবেশিত হয়েছিল। যা মদীনা সনদ নামে পরিচিত। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ সীরাতু ইবনি হিশামসহ প্রাচীন ইতিহাসগ্রন্থসমূহে এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর শুরু ছিল এভাবে-هذا كتاب من محمد النبي رسول الله صلى الله عليه وسلم بين المؤمنين والمسلمين من قريش وأهل يثرب، ومن تبعهم فلحق بهم، ‘এটি আল্লাহর নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে একটি দলীল। যা সম্পাদিত হ’ল, কুরাইশের মুমিন-মুসলমান এবং ইয়াছরিব (মদীনা)-বাসী এবং যারা তাদের অনুসরণ করবে এবং তাদের সাথে যুক্ত হবে তাদের মধ্যে’।[16] এছাড়াও ৬ষ্ঠ হিজরীতে বিখ্যাত হুদায়বিয়ার সন্ধি, ৮ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের সময় বনু গাতফানের সাথে চুক্তি, ৯ম হিজরীতে দুমাতুল জান্দালের শাসকের সাথে চুক্তি, তাবুক যুদ্ধের সময় ইউহান্নাহ ইবনু রুবাহ ও আয়লাবাসীর সাথে চুক্তি, বনু নাজরান, বনু ছাক্বীফ, বনু যামরা, বনু যুর‘আ, বনু গাফফার, আসলাম গোত্র, বনু জুযাম, বনু ক্বুযা‘আহ, তায়েফবাসী, বনু হাওয়াযেন, বনু খোযা‘আহ প্রভৃতি গোত্রের সাথে কৃত সন্ধিনামাসমূহ সুপ্রসিদ্ধ।[17]

(ঙ) ক্ষমা ও অনুদানের সিদ্ধান্তসমূহ :

যেমন হিজরতের পূর্বে সুরাকা ইবনু মালিককে ক্ষমা করে দিয়ে নিরাপত্তা প্রদানের স্মারক[18] এবং ইসলাম গ্রহণের পর তামীম দারীকে ভূখন্ড প্রদানের স্মারক।[19] এছাড়া খায়বারের দখলকৃত জমি ইহুদীদের মধ্যে বণ্টনের চুক্তিনামা[20], আববাস বিন মিরদাস আস-সুলামী, ইয়ামনের আর-রুক্বাদ ইবনু আমর, বনু কুশায়ের গোত্র, বিলাল ইবনু হারিছ আল-মুযানীর গোত্র প্রমুখকে কৃষি ও সাধারণ জমি প্রদানচুক্তিসমূহ উল্লেখযোগ্য।[21]

(চ) মুসলমানদের সংখ্যা সংক্রান্ত রেকর্ড বহি :

যেমন রাসূল (ছাঃ) মদীনাবাসীদের মধ্যে কতজন মুসলমান হয়েছে তার একটি তালিকা তৈরী করতে বলেন। ছাহাবী হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ প্রদান করেন, اكْتُبُوا لِى مَنْ تَلَفَّظَ بِالإِسْلاَمِ مِنَ النَّاسِ- فَكَتَبْنَا لَهُ أَلْفًا وَخَمْسَمِائَةِ رَجُلٍ ‘তোমরা আমাকে যে সকল লোক মুসলমান হয়েছে তার একটি তালিকা লিখে দাও। অতঃপর আমরা তাঁকে ১৫০০ লোকের একটি তালিকা প্রদান করি’।[22]

(জ) দাসমুক্তিদানের সিদ্ধান্তসমূহ :

রাসূল (ছাঃ) তাঁর একজন দাস আবূ রাফি‘কে মুক্তি দানের সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেন। এতে লিখিত ছিল,كتاب محمد رسول الله لفتاه أسلم: إني أعتقك لله عتقا مبتولا، الله أعتقك وله المنّ عليّ وعليك. فأنت حرّ لا سبيل لأحد عليك إلا سبيل الإسلام وعصمة الإيمان. ‘এটি মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পত্র, তাঁর একজন ইসলাম গ্রহণকারী গোলামের নিকট। আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য পুরোপুরি মুক্ত করে দিলাম। আল্লাহ তোমাকে মুক্ত করুন। তাঁর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক আমার ও তোমার উপর। অতএব তুমি এখন স্বাধীন। ইসলামের পথ এবং ঈমানের সুরক্ষা ব্যতীত তোমার উপর আর কারও কোন অধিকার নেই’। এটি লিপিবদ্ধ করেন মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ান (রাঃ) এবং স্বাক্ষী থাকেন আবুবকর, ওছমান ও আলী (রাঃ)।[23] এছাড়া রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক এক ইহূদীর নিকট থেকে সালমান ফারেসী (রাঃ)-কে ক্রয় করে মুক্তি দানের চুক্তিনামা। যেটি লিখেছিলেন আলী (রাঃ) এবং সাক্ষী ছিলেন কয়েকজন ছাহাবী। অনুরূপভাবে তিনি জনৈক পারসিক দাস আবূ যামীরাহ এবং হিময়ারের যিল কিলা‘ গোত্রের নিকট পত্রপ্রেরণের মাধ্যমে ৪ হাযার মামলূক দাসকে মুক্ত করে দেন।[24]

(ঝ) কোন কোন ব্যক্তির জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ লিপিবদ্ধকরণ :

যেমনভাবে ইয়ামনের আবূ শাহকে বিদায় হজ্জের ভাষণ লিখে দেয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।[25]

রাসূল (ছাঃ)-এর লেখকগণ :

জাহিলী যুগে লেখনীকে অপমানজনক মনে করার রীতি রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেও অব্যাহত ছিল। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-ই সর্বপ্রথম এই চিরাচরিত মনোভাব দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু সাঈদ ইবনুল আছ (রাঃ)-কে মদীনাবাসীদের লিখনবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন।[26] বদরের যুদ্ধের বন্দীদের মুক্তির একটি শর্ত এটাও ছিল যে, তাদের প্রত্যেকে (যারা লিখতে জানে) দশজন করে নিরক্ষর মুসলমানকে লেখনীবিদ্যা শিক্ষা দিবে।[27] ফলে তাঁরই উৎসাহে মদীনায় একদল লেখকের সৃষ্টি হয়েছিল, যাদের সংখ্যা ছিল ৫০-এর অধিক। তাঁদের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন আলী ইবনু আবী তালিব (রাঃ), ওছমান ইবনু আফ্ফান (রাঃ), যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ), উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ), মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ান (রাঃ) প্রমুখ। এঁরা বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখির জন্য দায়িত্বশীল ছিলেন। যেমন-

(ক) কুরআন সংকলনকারী লেখকগণ।

(খ) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশসমূহ সংকলনকারী লেখকগণ।

(গ) শাসক এবং রাজন্যবর্গের নিকট পত্র-প্রেরণের জন্য লেখকগণ।

(ঘ) সন্ধিচুক্তি এবং দাফতরিক চিঠিসমূহের লেখকগণ।

(ঙ) আরবের বিভিন্ন গোত্রের সাথে চিঠি আদান-প্রদানকারী লেখকগণ প্রভৃতি।

মুছতফা আল-আ‘যামী (২০১৭খৃ.) মোট ৪৮ জন লেখকের নাম ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন।[28] এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেই তাঁর বাণীসমূহ অনানুষ্ঠানিকভাবে হ’লেও লিপিবদ্ধ হয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর লেখকরাই ছিলেন এক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা পালনকারী।

সারকথা :

উপরোক্ত ঐতিহাসিক দলীলসমূহ সবই রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী শরী‘আতের বহু দিক-নির্দেশনা এসব লৈখিক দলীল থেকে পাওয়া যায়। সুতরাং নিঃসন্দেহে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতে তাঁর নির্দেশক্রমেই হাদীছের কিয়দংশ লিপিবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়।

 (ক্রমশঃ)


[1]. মুছত্বফা আল-আ‘যামী, দিরাসাতুন ফিল হাদীছ আন-নববী, ১/৬৮।

[2]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলম, ১/২৭৪।

[3]. ফুয়াদ সেযগীন, তারীখুত তুরাছিল-আরাবী, (রিয়াদ : জামি‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ আল-ইসলামিয়াহ, ১৯৯১খৃ.)।

[4]. দিরাসাতুন ফিল হাদীছ আন-নববী।

[5]. ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ, মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ লিল আহদিন নাবাভী ওয়াল খিলাফাহ আর-রাশেদাহ (বৈরূত : দারুন নাফাইস, ১৯৮৭খৃ.)।

[6]. Nadia Abbott, Studies in Arabic Literary Papyri : Quranic Commentary and Tradition (Chicago, 1967).

[7]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ১/১৯৮-২৬৯; মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ৪৩-৩৬৮; হুসাইন শাওয়াত্ব, হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ ওয়া তারীখুহা, পৃ. ১২৩-১২৮; নূর মোহাম্মদ আ’জমী, হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস (ঢাকা : এমদাদিয়া পুস্তকালয়, ১ম প্রকাশ, ১৯৬৫, পুনর্মুদ্রণ (২), ২০০৮খৃ.), পৃ. ৫৩-৬১; মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, হাদীস সংকলনের ইতিহাস, পৃ. ১৬৫-১৭৯।

[8]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ৪৬৭-৪৮৮।

[9]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৯৮৬খৃ.), ৫/১৬, ৫৩; মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ১১৮, ১৭২, ২৭১, ৩২৪।

[10]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ১/২১৯; ড. হামীদুল্লাহ, মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ২৪৭।

[11]. (وكتب لهم رسول الله صلى الله عليه وسلم كتابا فيه شرائع الإسلام) আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ১/২৬০।

[12]. (آمنا بالله ورسوله وما جاء من عند الله فاكتب لنا كتابا نتبع ما فيه فكتب لهم كتابا) তদেব, ১/২৬২।

[13]. নাসাঈ, হা/৪৮৫৩-৪৮৫৭; দারিমী, হা/১৬৬১ ও অন্যান্য, ছহীহ ইবনু হিববান, হা/৬৫৫৯; ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলম, ১/৩০১; মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ২০৬-২১১। হাদীছটির সনদগুলো ত্রুটিপূর্ণ। এজন্য নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী নাসাঈ’র তাহক্বীক্বে এটি যঈফ বলেছেন। ইমাম মালেক তাঁর আল-মুওয়াত্ত্বায় (হা/৬৮০), আবুদাউদ তাঁর আল-মারাসীলে (হা/৯২) ও আন-নাসাঈ তাঁর সুনানে হাদীছটি মুরসাল সূত্রে এনেছেন। তবে অধিক প্রসিদ্ধির কারণে বিদ্বানগণ বর্ণনাটিকে ছহীহ গণ্য করেন। নাছিরুদ্দীন আলবানী তাঁর তাহক্বীক্ব ছহীহ ইবনু হিববানে এই কারণেই সম্ভবত হাদীছটিকে ‘ছহীহ লিগায়রিহি’ বলেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম শাফেঈ (আর-রিসালাহ, পৃ. ৪২০), ইয়া‘কূব আল-ফাসাভী (আল-মা‘রিফাতু ওয়াত তারীখ (বৈরূত : মু‘আস্সাসাতুর রিসালাহ, ২য় প্রকাশ : ১৯৮১খৃ.), ২/২১৬), ইবনু আব্দিল বার্র (আল-ইস্তিযকার (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২০০০খৃ.), ৮/৩৭) প্রমুখ ব্যাপক প্রসিদ্ধির কারণে বর্ণনাটিকে মুতাওয়াতির পর্যায়ের বলেছেন। ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,وقد صحح الحديث بالكةاب المذكور جماعة من الأئمة، لا من حيث الإسناد، بل من حيث الشهرة ‘উক্ত (আমর বিন হাযমের) কিতাবের বিষয়ে যে হাদীছটি এসেছে তার সত্যায়ন করেছেন ইমামদের একটি দল, ইসনাদের দিক থেকে নয় বরং প্রসিদ্ধির দিক থেকে’। দ্র. আত-তালখীছুল হাবীর ৪/৫৮।

[14]. আবূদাঊদ, হা/১৫৬৮-১৫৭০; তিরমিযী, হা/৬২১।

[15]. আবূদাঊদ, হা/১৫৬৮-১৫৭০।

[16]. আব্দুল মালিক ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাভিইয়াহ, তাহক্বীক : ত্বহা আব্দুর রঊফ সা‘দ (কায়রো : শারিকাতুত ত্বিবা‘আহ আল-ফান্নিয়াহ আল-মুত্তাহিদাহ, তাবি), ২/১০৬; আবূ উবাইদ আল-কাসিম ইবনু সাল্লাম, কিতাবুল আমওয়াল (বৈরূত : দারুল ফিকর, তাবি), হা/৩২৮, পৃ. ১৬৬; ইবনু যানজুয়াইহ, আল-আমওয়াল (রিয়াদ : মারকাযুল মালিক ফায়ছাল লিল বুহূছ ওয়াদ দিরাসাতিল ইসলামিয়াহ, ১৯৮৬খৃ.), হা/৭৫০; ২/৭৫০।

[17]. কিতাবুল আমওয়াল, হা/৫০৮-৫১৭, পৃ. ২৫০-২৫৯; ইবনু যানজুয়াইহ, আল-আমওয়াল, হা/৯৮, ৪১৮, ৪২৫, ৬৫৫, ৭৩৫, ৭৪০, ৭৪৬, ৭৪৮, ১৭০৫ প্রভৃতি; মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক পৃ. ২৬২-৩১১।

[18]. আল-বিদায়াহ, ৩/১৮৫; মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক পৃ. ৫৪।

[19]. কিতাবুল আমওয়াল, হা/৬৮২, পৃ. ৩৪৯; আল-আমওয়াল, হা/১০১৬, ২/৬১৪; মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ৩৭।

[20]. আল-বালাযূরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃ. ৭১৩।

[21]. মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ২৬৯, ৩০৭, ৩১৮।

[22]. বুখারী হা/৩০৬০।

[23]. মাজমু‘আতুল ওয়াছায়েক আস-সিয়াসিইয়াহ, পৃ. ৩১৬।

[24]. তদেব, পৃ. ৩২৮-৩৩০।

[25]. বুখারী হা/২৪৩৪, ৬৮৮০; মুসলিম হা/৪৪৭-৪৪৮।

[26]. ইবনুল আছীর, উসদুল গাবাহ ফী মা‘রিফাতিছ ছাহাবাহ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১৯৯৪খৃ.), ৩/২৬৩।

[27]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১৯৯০খৃ.), ২/১৬।

[28]. ড. মুছত্বফা আল-আ‘যামী, কুত্তাবুন নাবী (ছাঃ) (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য় প্রকাশ : ১৯৭৮ খৃ.)।






বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয় কেন? - মেহেদী হাসান পলাশ
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (ফেব্রুয়ারী’১৩ সংখ্যার পর) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
জান্নাতের পথ - ড. নূরুল ইসলাম
বিতর্কের ক্ষেত্রে করণীয়-বর্জনীয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বক্তার আধিক্য ও আলেমের স্বল্পতা - আছিফ রেযা, ছাত্র, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল
সেলফোন এবং অপব্যবহার - প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
শোকর (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা - ড. নূরুল ইসলাম
সমাজ সংস্কারে ইমামগণের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
শবেবরাত - আত-তাহরীক ডেস্ক
এক হাতে মুছাফাহা : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
আরও
আরও
.