হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা  (৫ম কিস্তি)

পর্ব ১। পর্ব ২ পর্ব ৩। পর্ব ৪


রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পর ছাহাবীদের লিখিত সংকলন সমূহ:

রাসূল (ছাঃ) থেকে যেমন হাদীছ লিখিত সংরক্ষণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ও অনুমতি উভয় প্রকার হাদীছ পরিলক্ষিত হয়, তেমনি তা ছাহাবীদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। তাদের মধ্যে কেউবা ছিলেন এর পক্ষে, কেউবা বিপক্ষে। কারও পক্ষ থেকে উভয় দলীলই পাওয়া যায়। যারা হাদীছ লিপিবদ্ধ করতে অনাগ্রহী ছিলেন তাঁরা মূলতঃ এই ভয়ে ভীত ছিলেন যে, হয়তবা এতে মানুষ কুরআন থেকে দূরে সরে যাবে।[1]

কিন্তু সাধারণভাবে ছাহাবীগণ হাদীছ লেখনীকে অবৈধ মনে করতেন না। যেমনভাবে আবূবকর (রাঃ) ফরয ছাদাক্বাসমূহের ব্যাপারে বাহরাইনে তাঁর নিযুক্ত গভর্নর আনাস (রাঃ)-কে লিখিত আকারে দীর্ঘ নির্দেশনা দিয়েছিলেন।[2] ওমর (রাঃ) আযারবাইজানে বা শামে অবস্থানরত তাঁর সেনাপতি উতবাহ ইবনু ফারক্বাদ (রাঃ)-কে হাদীছ লিখে দিয়েছিলেন।[3] এছাড়া তাঁর তরবারীর কোষে পশুর ছাদাক্বা সম্পর্কে লিপিবদ্ধ ছিল।[4] আলী (রাঃ)-এর নিকট একটি ছহীফা ছিল যাতে রক্তমূল্য বা দিয়াত, বন্দী মুক্তি এবং কাফিরকে হত্যার জন্য মুসলমানের মৃত্যুদন্ড হবে না- মর্মে হাদীছ উদ্ধৃত হয়েছে।[5] অনুরূপভাবে আয়েশা[6], আবূ হুরায়রা, মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ান[7], আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ[8], আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস[9], আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর[10], আব্দুল­াহ ইবনু আমর ইবনুল আছ, বারা ইবনু আযেব[11], আনাস ইবনু মালেক[12], সা‘দ ইবনু উবাদাহ[13], উবাইদাহ আস-সালমানী[14], হাসান ইবনু আলী[15] প্রমুখ ছাহাবীগণ হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন কিংবা অনুমতি দিয়েছেন।[16] এতে দেখা যায় যে, যে সকল ছাহাবী পূর্বে অপসন্দভাব প্রকাশ করেছেন, তাদের অধিকাংশই পরে ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। কেননা লেখনীর প্রতি তাদের আপত্তির কারণ ছিল, কুরআনের সাথে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার আশংকা। সুতরাং যখন এই শংকা দূরীভূত হ’ল, তখন তাদের আপত্তিও অপসৃত হ’ল। নিম্নে ছাহাবীদের সংকলিত প্রসিদ্ধ হাদীছের ছহীফাসমূহ উল্লেখ করা হ’ল।

(১) সা‘দ ইবনু উবাদাহ আল-আনছারী (১৪ হি.)-এর সংকলিত ছহীফা।[17]

(২) আব্দুল্লাহ ইবনু আবী আওফা (৮৬/৮৭হি.)-এর সংকলিত ছহীফা।[18]

(৩) সামুরা ইবনু জুনদুব (৫৮/৫৯হি.)-এর সংকলিত ছহীফা।[19] অনুমান করা যায়, ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে এই ছহীফার অধিকাংশ কিংবা সকল হাদীছই নিয়ে এসেছেন।[20] 

(৪) আবূ রাফি‘ মাওলান্নাবী (৪০হি.)-এর সংকলন, যাতে ছালাত সম্পর্কিত হাদীছ ছিল।[21]

(৫) আবূ হুরায়রা (৫৯হি.)-এর সংকলনসমূহ। যেমন হাম্মাম ইবনু মুনাবিবহ (৪০-১০৩হি.) সংকলিত ছহীফা। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, সাঈদ আল-মাক্ববুরী প্রমুখ তাবেঈও তাঁর নিকট থেকে বর্ণনা করেন। হাম্মাম ইবনু মুনাবিবহ-এর সংকলনটি ‘ছহীফা ছহীহা’ (الصحيفة الصحيحة) নামে প্রসিদ্ধ। এটি তিনি আবূ হুরায়রা (৫৯হি.) হ’তে সরাসরি সংকলন ও বর্ণনা করেছিলেন। এর হাদীছ সংখ্যা মোট ১৩৮টি। এটি ছাহাবীদের সংকলনের মধ্যেই ধরা হয়, কেননা এটি মূলতঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে সরাসরি সংকলিত ছহীফা। ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ এই ছহীফাটির পান্ডুলিপি উদ্ধার করেন জার্মানীর রাজধানী বার্লিনের এক লাইব্রেরী থেকে। পরে দামিশকের যাহেরিয়া লাইব্রেরীতেও এর অনুলিপি পাওয়া যায়। তিনি এ দু’টি পান্ডুলিপি সম্পাদনা করেন এবং ১৯৫৩ সালে দামেশকের এক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। তিনি দামিশকের এই পান্ডুলিপিটি হিজরী প্রথম শতকে সংকলিত এবং হাদীছের সর্বপ্রাচীন পান্ডুলিপি বলে অভিহিত করেছেন।[22] তিনি উক্ত পান্ডুলিপিদ্বয়ের সাথে মুসনাদ আহমাদের বর্ণনাগুলো তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, এতে সামান্য কিছু শাব্দিক পার্থক্য ছাড়া মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম যুগে লিপিবদ্ধ তাবেঈদের সংকলনসমূহ পরবর্তী হাদীছগ্রন্থসমূহের অন্যতম উৎস ছিল।

(৬) আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (৪৪হি.)-এর ছহীফা।[23] ছুবহী আস-সামার্রাই (১৯৩৬-২০১৩খৃ.)-এর তথ্যমতে এর পান্ডুলিপি বর্তমানে তুরস্কের ‘মাকতাবা শহীদ আলী পাশা’-এ সংরক্ষিত রয়েছে।[24]

(৭) জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ আল-আনছারী (৭৮হি)-এর ছহীফা।[25] এই ছহীফার হাদীছগুলোও মুসনাদে আহমাদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অনুমিত হয়। ছুবহী আস-সামার্রাই-এর তথ্যমতে এর পান্ডুলিপিও বর্তমানে তুরস্কের ‘মাকতাবা শহীদ আলী পাশা’-এ সংরক্ষিত রয়েছে।[26]

(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (৬৩/৬৫হি.)-এর ছহীফা, যা ‘ছহীফা ছাদেকা’ (الصحيفة الصادقة) নামে খ্যাত।[27] আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) হ’তে আমার চেয়ে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী আর কেউ ছিলেন না। তবে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) ব্যতীত। তিনি হাদীছ লিখতেন আর আমি লিখতাম না’।[28] এটিই ছাহাবীদের সংকলিত ছহীফাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে এর অধিকাংশই উল্লেখ করেছেন।[29]

(৯) আবূ সালামা নুবাইত্ব ইবনু শারীত্ব আল-আশজা‘ঈ (রাঃ) সংকলিত ছহীফা। তাঁর মৃত্যুসন জানা যায় না। তবে প্রথম হিজরী শতাব্দীর প্রথমাংশে তিনি জীবিত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। দামিশকের মাকতাবা যাহিরিয়াতে এর ১৩ পৃষ্ঠার একটি পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। ড. ফুয়াদ সেযগীন বলেন, ‘এই পান্ডুলিপিটি যদি সরাসরি নুবাইত্ব ইবনু শুরাইত্ব কর্তৃক সংকলিত হয়ে থাকে, তাহ’লে এটিই হবে হাদীছের সর্বপ্রাচীন ছহীফা।’[30] এর একটি অংশ মুসনাদ আহমাদে সংকলিত হয়েছে।[31]

এ সকল ছহীফার পরিচিতি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন ড. ফুয়াদ সেযগীন[32] ও ড. মুছত্বফা আল-আ‘যামী।[33] তবে এ সকল ছহীফা আনুষ্ঠানিক সংকলনের মধ্যে পড়ে না। কেননা তাঁরা মূলতঃ মুখস্থকরণের সহযোগী কিংবা ব্যক্তিগত আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে এগুলো ব্যবহার করেছিলেন। এর মধ্যে কতক রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় এবং কতক তাঁর মৃত্যুর পর সংকলন করা হয়েছিল। কিন্তু নিঃসন্দেহে এগুলো প্রমাণ করে যে, ছাহাবীগণ হাদীছ মুখস্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছিলেন। স্মর্তব্য যে, এ সকল ছহীফায় উদ্ধৃত হাদীছসমূহ অধিকাংশই পরবর্তীতে হাদীছের মূল সংকলন গ্রন্থসমূহ এবং সিয়ার ও মাগাযী (ইতিহাস ও যুদ্ধবৃত্তান্ত) গ্রন্থসমূহে সনদসহ স্থান পেয়েছে।

এ যুগে হাদীছ সংকলনের বৈশিষ্ট্যসমূহ :

(ক) হাদীছ লেখনীর বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুমতির বিষয়টি নিয়ে ছাহাবীদের মধ্যে কোন দ্বিধা ছিল না। এতদসত্ত্বেও কতিপয় ছাহাবী এবং তাবেঈর মধ্যে লেখনীর বিষয়ে অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। আর এই অনাগ্রহের মূল কারণ ছিল লেখনীর প্রতি অধিক নির্ভরশীলতা সৃষ্টির আশংকা করা এবং কুরআনের সাথে হাদীছের মিশ্রণ ঘটে যাওয়া। কেননা তখন পাথর কিংবা চামড়া ছিল লেখনীর মূল উপকরণ, যা সহজেই বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল।

(খ) প্রধানত হিফয বা মুখস্থকরণের মাধ্যমে হাদীছ সংরক্ষিত হ’ত। তবে লেখনীর প্রচলন পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(গ) ব্যক্তিগত সংরক্ষণের জন্য হাদীছ লিপিবদ্ধ করা হ’ত। ওমর (রাঃ)-এর যুগে সরকারীভাবে হাদীছ সংকলনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল বটে, কিন্তু ওমর (রাঃ) এক মাস ইস্তিখারার পর এই পরিকল্পনা থেকে ফিরে আসেন। সম্ভবত কুরআন সংরক্ষণের বিষয়টিই খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগে বেশী প্রাধান্য পেয়েছিল। অতঃপর ওছমান (রাঃ)-এর যুগে এটি সম্পন্ন হয়। এরপর আলী (রাঃ) তাঁর খিলাফতকালে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মোকাবিলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে তিনিও আনুষ্ঠানিকভাবে হাদীছ সংকলনের কাজ শুরু করতে পারেননি।

(ঘ) এই যুগে ব্যাপকভাবে হাদীছ সংকলনের কোন প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়নি। কেননা ছাহাবীরা জীবিত ছিলেন। তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পর হাদীছের চর্চা করতেন, মুখস্থ রাখতেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাচ্ছন্দে পৌঁছে দিতেন।

(ঙ) এ সমস্ত সংকলনে কোন অধ্যায়ভিত্তিক বিন্যাস বা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হ’ত না।

তাবেঈদের লিখিত সংকলনসমূহ :

কতিপয় তাবেঈর মধ্যেও হাদীছ লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে অনীহা কাজ করেছিল। যেমন উবায়দাহ ইবনু আমর আস-সালমানী (৭২হি.), ইবরাহীম ইবনু ইয়াযীদ আত-তায়মী (৯২হি.), জাবির ইবনু যায়েদ (৯৩হি.), ইবরাহীম ইবনু ইয়াযীদ আন-নাখঈ (৯৬হি.), ‘আমের আশ-শা‘বী (১০০হি.)।[34] তারা কেবল মুখস্থ করাকে যথেষ্ট মনে করতেন এবং লেখনীকে মুখস্থকরণের অন্তরায় মনে করতেন। তারা ভাবতেন এতে মানুষের মধ্যে জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলার সৃষ্টি হবে এবং জ্ঞান হারিয়ে যাবে। এর বিপরীতে আরেকদল তাবেঈ ছিলেন যারা হাদীছ লিপিবদ্ধ করতেন। যেমন সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (৯৪হি.), সাঈদ ইবনু জুবায়ের (৯৫হি.), ‘আমের আশ-শা‘বী, যাহ্হাক ইবনু মুযাহিম (১০৫হি.), হাসান বছরী (১১০হি.), মুজাহিদ ইবনু জাব্র (১০৩হি.), রাজা ইবনু হায়াওয়াহ (১১২হি.), আতা ইবনু আবী রাবাহ (১১৪হি.), নাফে‘ মাওলা ইবনু ওমর (১১৭হি.), কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ আস-সাদূসী (১১৮হি.) প্রমুখ।[35]

এছাড়াও আরও যে সকল তাবেঈ হাদীছ সংকলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করা হ’ল[36] :

  • মাকহুল ইবনু আবী মুসলিম আশ-শামী (১১২/১১৬হি.)। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক তাঁর সংকলিত ফিক্বহ বিষয়ক ‘কিতাবুস সুনান’ গ্রন্থ ছিল সর্বপ্রাচীন বিষয়ভিত্তিক হাদীছ সংকলন।[37]
  • আবুয যুবায়ের মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু তাদরুস আল-আসাদী (১২৬হি.)। তিনি জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ) সহ অন্য ছাহাবীদের থেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছিলেন।[38]
  • আবূ আদী আয-যুবায়ের ইবনু আদী আল-হামদানী আল-কুফী (১৩১হি.)।
  • আবুল উশারা আদ-দারিমী, উসামা ইবনু মালিক।
  • যায়েদ ইবনু আবী উনাইসা আবী উসামা আর-রুহাভী (১২৫হি.)।
  • আইয়ুব আস-সাখতিয়ানী (১৩১হি.)।
  • ইউনুস ইবনু উবায়েদ ইবনু দীনার আল-আবদী (১৩৯হি.)।
  • আবূ বুরদাহ বুরাইদ ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনু আবী বুরদাহ।
  • হুমাইদ আত-ত্বভীল (১৪২হি.)।

(১০) হিশাম ইবনু উরওয়া ইবনুয যুবায়ের (১৪৬হি.)।

(১১) ওবাইদুল্লাহ ইবনু ওমর ইবনু হাফছ ইবনু ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (১৪৭হি.) প্রমুখ।

ছাহাবীদের যুগের তুলনায় তাবেঈদের যুগে লেখনীর হার বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেননা জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধির ফলে এ যুগে বড় বড় শহরগুলোতে শিক্ষাগার গড়ে উঠতে শুরু করে। ফলে শিক্ষকগণের নিকট থেকে ছাত্ররা জ্ঞান লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন।[39] এ যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ :

(ক) হাদীছ বর্ণনার প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছিল, সনদও সম্প্রসারিত হয়েছিল। ফলে বর্ণনারকারীদের নাম, উপনাম, বংশধারাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(খ) বেশীর ভাগ হাদীছের হাফেয ছাহাবী এবং প্রথম স্তরের তাবেঈদের মৃত্যু ঘটেছিল। ফলে অনেক হাদীছ হারিয়ে যাওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়।

(গ) লেখনীর প্রচলন শুরু হওয়ায় এবং বহুমুখী জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মুখস্থশক্তি দুর্বল হ’তে থাকে।

(ঘ) দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত তথা নব উদ্ভাবন, দুষ্টমতি মানুষের আবির্ভাব এবং মিথ্যা বলার প্রচলন শুরু হয়। ফলে সুন্নাহ রক্ষার স্বার্থে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক হয়ে ওঠে।

এভাবে ছাহাবী এবং তাবেঈদের যুগে মূলতঃ হিফযের মাধ্যমে হাদীছ সংরক্ষিত হ’লেও স্বল্পাকারে লেখনীর চর্চা শুরু হয়েছিল। তবে সেটাকে নিয়মতান্ত্রিক বা আনুষ্ঠানিক লেখনী বলা যায় না। ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী (৮৫২হি.) বলেন, علم علمني الله وإياك أن آثار النبي صلى الله عليه وسلم لم تكن في عصر أصحابه وكبار تبعهم مدونة في الجوامع ولا مرتبة لأمرين أحدهما إنهم كانوا في ابتداء الحال قد نهوا عن ذلك كما ثبت في صحيح مسلم خشية أن يختلط بعض ذلك بالقرآن العظيم وثانيهما لسعة حفظهم وسيلان أذهانهم ولأن أكثرهم كانوا لا يعرفون الكتابة ‘জেনে রাখ যে, আল্লাহ আমাদের সকলকে অবগত করেছেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছসমূহ ছাহাবী এবং জ্যেষ্ঠ তাবেঈদের যুগে গ্রন্থাবদ্ধ এবং সুবিন্যাস্ত আকারে সংরক্ষিত ছিল না। দু’টি কারণে এটি ঘটেছিল। প্রথমতঃ তারা প্রাথমিক যুগের মানুষ ছিলেন, যে সময় তাদেরকে কুরআনের সাথে মিশ্রণের আশংকায় হাদীছ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ তাদের ব্যাপক মুখস্থ দক্ষতা ও মস্তিস্কের সম্প্রসারতা এবং সেই সাথে লেখনীতে অপারদর্শিতা’।[40]

(ক্রমশঃ)

[1]. (ক) ওমর (রাঃ) হাদীছ সংকলনের ব্যাপারে ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। অতঃপর এক মাস যাবৎ ইস্তিখারা করার পর তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বলেন, ‘আমি হাদীছ লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্মরণ হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী এমন একটি কওমের কথা, যারা গ্রন্থসমূহ লিপিবদ্ধ করেছিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করে সেসব গ্রন্থেই মগ্ন হয়ে পড়েছিল। সুতরাং আমি অন্য কিছু লিপিবদ্ধ করে আল্লাহর কিতাবের মধ্যে কোন প্রকার বিশৃংখলা হ’তে দেব না’। (খ) আলী (রাঃ) বলেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, প্রত্যেক যে সকল ব্যক্তির কাছে কোন কিতাব রয়েছে তা ফিরিয়ে দেবে এবং তা মুছে ফেলবে। কেননা মানুষ তখনই ধ্বংস হয়েছে যখন তারা তাদের ওলামায়ে কেরামের মতামত অনুসরণ করেছেন এবং তাদের প্রভুর কিতাবকে পরিত্যাগ করেছে’। (গ) একইভাবে ছাহাবী যায়েদ বিন ছাবিত, আবূ হুরায়রা, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আবূ সাঈদ খুদরী, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর, আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) প্রমুখও একই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন (দ্রষ্টব্য : ইবনু আব্দিল বার্র, জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/২৬৮-২৭৬; খত্বীব বাগদাদী, তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৩৬-৪৩; ড. আকরাম যিয়া ঊমরী, বুহূছুন ফী তারীখিস সুন্নাহ আল-মুশাররাফাহ (মদীনা : মাকতাবাতুল ঊলূম ওয়াল হিকাম, ৪র্থ প্রকাশ : ১৯৮৪খৃ.), পৃ. ২২৬)।

[2]. বুখারী, হা/১৪৫৩, ১৪৫৪; আহমাদ, হা/৭৮।

[3]. আহমাদ, হা/৯২, ২৪৩, ৩৫৬; খত্বীব বাগদাদী, আল-কিফায়াহ ফী ইলমির রিওয়ায়াহ, তাহক্বীক : আবূ আব্দুল্লাহ আস-সাওরাক্বী ও ইবরাহীম হামদী (মদীনা : আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়াহ, তাবি), পৃ. ৩৩৬।

[4]. আল-কিফায়াহ ফী ইলমির রিওয়ায়াহ, পৃ. ৩৫৩।

[5]. বুখারী, হা/১১১; ‘জ্ঞান লিপিবদ্ধকরণ অধ্যায়’।

[6]. মুসলিম, হা/১৩২১; তিরমিযী, হা/২৪১৪; মুহাম্মাদ রফী‘ ওছমানী, কিতাবাতে হাদীছ আহদে রিসালাত ওয়া আহদে ছাহাবা মেঁ (করাচী : ইদারাতুল মা‘আরিফ, ১৯৮৯খৃ.), পৃ. ১৫২-১৫৬।

[7]. বুখারী, হা/১৪৭৭, ৬৪৭৩, ৭২৯২।

[8]. জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৩১১।

[9]. عن سلمى قالت: رأيت عبد الله بن عباس معه ألواح يكتب عليها عن أبي رافع شيئا من فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم -ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ২/২৮৩।

[10]. عن نافع أن ابن عمر كان له كتب ينظر فيها قبل أن يخرج إلى الناس -আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/২৩৮।

[11]. عن عبد الله بن حنش قال: رأيتهم عند البراء يكتبون على أيديهم بالقصب -জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৩১৬।

[12]. হুবায়রা বিন আব্দুর রহমান বলেন, আনাস (রাঃ) হাদীছ বর্ণনার সময় যখন অধিক মানুষ তাঁর নিকট একত্রিত হ’ত, তখন তিনি একটি স্থানে তাঁর সংকলিত হাদীছসমূহ রাখতেন এবং বলতেন, هذه أحاديث سمعتها وكتبتها عن رسول الله صلى الله عليه وعرضتها عليه -তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৯৫।

[13]. মুহাম্মাদ ইবনু হিববান আল-বুস্তী, মাশাহীরু উলামাইল আমছার

(মানছূরা : দারুল ওয়াফা, ১৯৯১খৃ.), পৃ. ২১০।

[14]. জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/২৮৬; তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৬১।

[15]. তিনি তাঁর সন্তান এবং ভ্রাতুষ্পুত্রদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, تعلموا تعلموا فإنكم صغار قوم اليوم، وتكونون كبارهم غدا فمن لم يحفظ منكم فليكتب -খত্বীব বাগদাদী, তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৯১; ঐ, আল-কিফায়াহ ফী ইলমির রিওয়ায়াহ, পৃ. ২২৯।

[16]. জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/২৯৮; তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৮৪-৯২; বুহূছুন ফী তারীখিস সুন্নাহ আল-মুশাররাফাহ, পৃ. ২২৭।

[17]. তিরমীযী, হা/১৩৪৩, সনদ ছহীহ।

[18]. বুখারী, হা/২৯৬৫, ২৯৬৬।

[19]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব (হিন্দ : দায়েরাতুল মা‘আরিফ আন-নিযামিয়াহ, ১৩২৬হি.), ৪র্থ/২৩৭।

[20]. আহমাদ, হা/২০০৭৮-২০২৬৮।

[21]. আল-কিফায়াহ ফী ইলমির রিওয়ায়াহ, পৃ. ৩৩০।

[22]. ড. হামীদুল্লাহ, ‘আক্বদামু তা’লীফীন ফিল হাদীছিন নাবাভী ছহীফা হাম্মাম ইবনু মুনাবিবহ ওয়া মাকানাতুহা ফী তারীখি ইলমিল হাদীছ ’(দামিশক : মাজাল্লাতুল মাজমা‘ আল-ইলমী আল-‘আরাবী; ২৮তম সংখ্যা/১ম অংশ : ১৯৫৩খৃ.), পৃ. ১১২-১১৬।

[23]. আহমাদ, হা/১৯৫৩৭; সনদ ছহীহ লিগায়রিহি।

[24]. হুসাইন ইবনু আব্দুল্লাহ আত-ত্বীবী, আল-খুলাছাহ ফী উছূলিল হাদীছ, তাহক্বীক্ব : ছুবহী আস-সামার্রাই (কায়রো : আ‘লামুল কুতুব, ১৯৮৫খৃ.), পৃ. ১১।

[25]. যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায, ১/৩৫।

[26]. ত্বীবী, আল-খুলাছাহ ফী মা‘রিফাতিল হাদীছ, পৃ. ১২।

[27]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৩০৫; খত্বীব বাগদাদী, তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৮৪-৮৫।

[28]. বুখারী, হা/১১৩।

[29]. আহমাদ, হা/৬৪৭৭-৭১০৩।

[30]. ফুয়াদ সেযগীন, তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী, ১/১৫৫।

[31]. আহমাদ, হা/১৮৭২১-১৮৭২৫।

[32]. ফুয়াদ সেযগীন, তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী, ১/১৫৩-১৫৮।

[33]. মুছত্বফা আল-আ‘যামী, দিরাসাতুন ফিল হাদীছ আন-নববী, পৃ. ৯২-১৪২।

[34]. তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৪৫-৪৮।

[35]. জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১ম খন্ড, ৩১১-৩১৬; তাক্বয়ীদুল ইলম, পৃ. ৯৯-১০৮।

[36]. ড. ফুয়াদ সেযগীন, তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী, ১/১৫৮-১৬০; ড. আকরাম যিয়া আল-ঊমরী, বুহূছুন ফী তারীখিস সুন্নাহ আল-মুশাররাফাহ, পৃ. ২৩০-২৩১)। এ সকল পান্ডুলিপি প্রকাশিত না হ’লেও অধিকাংশই সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে দিমাশকের যাহিরিয়া লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।

[37]. ইবনু নাদীম, আল-ফিহরিস্ত, পৃ. ২৭৯; তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী, ১/১৬৫।

[38]. ইয়া‘কূব আল-ফাসাভী, আল-মা‘রিফাতু ওয়াত তারীখ (বৈরূত : মু‘আস্সাতুর রিসালাহ, ১৯৮১খৃ.), ১/১৬৬, ২/১৪২, ৪৪৩; জামালুদ্দীন আল-মিযযী, তাহযীবুল কামাল (বৈরূত : মু‘আস্সাতুর রিসালাহ, ১৯৮০খৃ.), ২৬/৪১০; তাহযীবুত তাহযীব, ৯ম/৪৪২।

[39]. ড. মুহাম্মাদ ইবনু মাত্বার আয-যাহরানী, তাদভীনুস সুন্নাহ আন-নববিইয়াহ : নাশআতুহু ওয়া তাত্বাওউরুহু (মদীনা : দারুল খুযাইরী, ১৯৯৮খ্রি,), পৃ. ৯৫।

[40]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী (মুকাদ্দামা, হাদিয়ুস সারী), ১/৬।






ছালাত পরিত্যাগকারীর ভয়াবহ পরিণতি - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৭ম কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা : একটি পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হেদায়াত লাভের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
চুল ও দাড়িতে মেহেদী ব্যবহার করার বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
নারী-পুরুষের ছালাতের পার্থক্য : বিভ্রান্তি নিরসন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ধবংসলীলা - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
খেয়াল-খুশির অনুসরণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হকের পথে বাধা : মুমিনের করণীয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.