আমরা লক্ষ্য করি যে, ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা, মাদরাসার সিলেবাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীগুলো দ্বীনী জ্ঞান ও শারঈ বিষয়াবলী মুখস্থ করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে না। এতে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তারা জ্ঞানার্জন, পাঠদান, দাওয়াত, পথনির্দেশ ও সংস্কারের ময়দানে তাদের কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং মুসলিম উম্মাহকে সঠিক ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সুযোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে পারে না।

কাজেই আলেম ও ছাত্র সমাজকে দ্বীনী জ্ঞান ও শারঈ নছ সমূহ মুখস্থ করার গুরুতব উপলব্ধি করানোর জন্য আমরা একটু আলোকপাত করতে চাই। হয়ত এটা তাদের হৃদয়ে সাড়া জাগাবে এবং এর মাধ্যমে তারা উপকৃত হবে।

حفظ (মুখস্থকরণ)-এর সংজ্ঞা :

হে প্রিয় ছাত্র! জেনে রাখ আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে الحفظ শব্দটি نقيض النسيان  অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার বিপরীত। এর অর্থ হ’ল, التعاهد যত্নশীল হওয়া, قلة الغفلة  অমনোযোগিতার বিপরীত।

আর التحفظ অর্থ হ’ল التقيّظ অর্থাৎ মনোযোগী হওয়া, জাগ্রত হওয়া।

যেমন বলা হয়, تحفّظتُ الكتابَ ‘আমি একটু একটু করে বইটি মুখস্থ করেছি’।[1] অনুরূপভাবে যখন সম্পদকে ধ্বংস ও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা হয়, তখন বলা হয়حفظتُ المالَ وغيره حفظا ‘আমি সম্পদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র ভালভাবে সংরক্ষণ করেছি’। আবার কেউ যখন পবিত্র কুরআন পরিপূর্ণভাবে স্মৃতিশক্তিতে ধারণ করতে সক্ষম হয়, তখন বলা হয়, حَفِظَ القرآنَ ‘সে কুরআন মুখস্থ করেছে’।[2]

‘আল-মু‘জামুল ওয়াসীত’ প্রণেতা বলেন,الحافظة قوة تحفظ ما تدركه القوة الوهمية من المعاني وتذكرها، وتسمى الذاكرة أيضا- ‘স্মরণশক্তি এমন একটি ক্ষমতা, যা অর্থের কল্পনাপ্রসূত উপলব্ধিকে সংরক্ষণ করে রাখে এবং পরবর্তীতে সেটা মনে করিয়ে দেয়। আর এটাকে যাকিরাহ বা স্মৃতিশক্তিও বলা হয়’।[3]

حفظ -এর পারিভাষিক অর্থ :

الحفظ ملكة يقتدر بها على تأدية المحفوظ-

‘মুখস্থকরণ এমন একটি প্রতিভা, যার মাধ্যমে স্মৃতিতে সংরক্ষিত বিষয়াবলী উপস্থাপন করা যায়’।[4]

আলেম-ওলামা ও শিক্ষার্থীদের নিকটে এ কথা অস্পষ্ট নয় যে, কুরআনুল কারীম ও হাদীছ বিশেষভাবে মুখস্থ করা এবং সাধারণভাবে শারঈ জ্ঞান সমূহ স্মৃতিতে সংরক্ষণ করা শারঈ দাবী এবং জ্ঞানের পরিপক্কতা ও স্থায়িত্বের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। নবী করীম (ছাঃ) তাঁর উম্মতকে কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান সযত্নে মুখস্থ করতে, অনুধাবন করতে এবং তা হৃদয়ঙ্গম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি হিফযের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

نَضَّرَ اللهُ امْرَأً سَمِعَ مَقَالَتِيْ فَوَعَاهَا وَحَفِظَهَا وَبَلَّغَهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ-‏‏

‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন, যে আমার কথা শুনেছে, তা মুখস্থ করেছে, সংরক্ষণ করেছে এবং অন্যের নিকটে পৌঁছে দিয়েছে। অনেক জ্ঞানের বাহক এমন ব্যক্তির নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায় যিনি তার (বাহকের) চেয়ে বেশী বিজ্ঞ’।[5]

এই হাদীছের প্রতি আমল করেই ছাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাতকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে মুখস্থ করেছেন। তাদের একনিষ্ঠ অনুসারী তাবেঈগণ তাদের রীতিতেই পথ চলেছেন। আর তাদের পর সালাফে ছালেহীনের মধ্যে যত মুহাদ্দেছীনে কেরাম, ফক্বীহ ও ওলামায়ে কেরাম এসেছেন, সবাই তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। ফলে মুখস্থকরণ ও তীক্ষন স্মরণশক্তিকে হাদীছ গ্রহণের অন্যতম একটি শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ বর্ণনাকারী হাদীছ সংরক্ষণে যত্নবান হবেন, সেটা হুবহু মুখস্থ করার মাধ্যমে হোক অথবা যথাযথভাবে কিতাবে লিখে রাখার মাধ্যমে হোক। যাতে শব্দগতভাবে এবং অর্থগতভাবে তিনি যেভাবে হাদীছটি শুনেছেন, ঠিক সেভাবে তা বর্ণনা করতে পারেন। সুতরাং হাদীছের বিশুদ্ধতার জন্য হাদীছ মুখস্থকরণ একটি অন্যতম শর্ত। এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই’।[6]

এটি দ্বীনি ইলম মুখস্থ করার গুরুত্ব, এর উচ্চমর্যাদা ও সম্মানের স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। আর কেনই বা হবে না? কারণ হাদীছ ও শারঈ জ্ঞান সমূহ মুখস্থ থাকা ছাড়া কোন শিক্ষার্থীর উপর আস্থা রাখা যায় না এবং কোন আলেমের উপরেও নির্ভর করা যায় না। উছূলে হাদীছের কিতাবগুলোতে আমরা এগুলো পড়েছি এবং জেনেছি। কিন্তু হায় আফসোস! আমরা কি আমাদের শিক্ষা জীবনে তা বাস্তবায়ন করতে পারছি? বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসার দায়িত্বশীলবৃন্দ কি এই ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দেন এবং এদিকে ভ্রূক্ষেপ করেন? আল্লাহ্র ওয়াস্তে আমাকে বলুন তো, ক’জন শিক্ষার্থী কুরআনুল কারীম, হাদীছ এবং কোন শাস্ত্রের (উলূমুল কুরআন, উছূলে হাদীছ/ফিক্বহ) মূল টেক্সট মুখস্থ করে?

অথচ আমরা গুণীজনদের কাছে ঠিকই শুনি এবং পাঠ্য বইয়ে পাঠ করি যে, আমাদের মহান পন্ডিতবর্গ বা ওলামায়ে কেরাম জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে তাদের শিক্ষার্থীদেরকে যথোচিত উৎসাহিত করেছেন এবং শারঈ ও ইলমী টেক্সটগুলো মুখস্থ করার ব্যাপারে তাদেরকে জোরালোভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মুখস্থ করার গুরুত্ব :

এখানে আমি মুখস্থ করার গুরুত্ব সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের কতিপয় মূল্যবান উক্তি তুলে ধরব।

১. ইমাম আব্দুর রায্যাক বলেন, ‘যে জ্ঞান তার বাহকের (শিক্ষার্থীর) সাথে বাথরুমে প্রবেশ করে না, তাকে তুমি জ্ঞান হিসাবে গণ্য করো না’। অর্থাৎ শিক্ষার্থী যে জ্ঞানের ব্যাপারে যত্নশীল হয় না, যা তার সাথে থাকে না। এমনকি বাথরুমে গোসলের সময়ও সে তা আওড়ায় না, সেই জ্ঞান কখনো উপকার বয়ে আনতে পারে না। কেননা সে এটাকে শুধু কিতাবে লিখে রেখেছে এবং পুঞ্জীভূত করে রেখেছে। তা কখনো পড়ে দেখেনি, মুখস্থ করেনি এবং এর প্রতি যত্নশীলও হয়নি। ফলে এই পুঁথিগত বিদ্যায় কোন ফায়েদা নেই’।[7]

২. আ‘মাশ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের অর্জিত জ্ঞান মুখস্থ করে রাখ। কেননা যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে কিন্তু মুখস্থ করে না, তার উপমা হ’ল সেই ব্যক্তির মত, যে দস্তরখানায় বসে অল্প অল্প করে খাবার নিয়ে তা পিছনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এমন ব্যক্তির পেট কি কখনো ভরবে’?[8]

৩. মারওয়ান বিন মুহাম্মাদ বলেন, ‘জ্ঞানী ব্যক্তি তিনটি বিষয় থেকে বিমুখ থাকতে পারে না। ১. সত্যবাদিতা ২. মুখস্থ করা ও ৩. নির্ভরযোগ্য বই। এই তিনটি বিষয়ের কোন একটি যদি তাকে ভ্রমে নিপতিত করে, তাহ’লে এটা তার ততটা ক্ষতি করতে পারে না। সে কোন কিছু ভুলে গেলে কোন বিশুদ্ধ পুস্তক থেকে তা জেনে নিলে তার কোন ক্ষতি হয় না’।[9] অর্থাৎ এই তিনটি বিষয়ে কোন একটির অনুপস্থিতিতে জ্ঞানী ব্যক্তি কোন জটিলতায় পড়েন না। বরং যে কোন একটির অবর্তমানে অপরটি দিয়ে তিনি সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন।

৪. জনৈক বেদুঈন বলেন,حرف في تامورك- علقة القلب- خير من عشرة في كتبك، ‘তোমার বইয়ের পাতায় দশটি হরফ লিপিবদ্ধ থাকার চেয়ে তোমার স্মৃতির পাতায় একটি হরফ মুখস্থ রাখা উত্তম’।[10]

৫. ওবায়দুল্লাহ ইবনুল হাসান বলেন, ‘আমি মুখস্থ করার কারণে আমার মনে জ্ঞানের উপস্থিতি অনুভব করেছি এবং আমার জিহবাকে সেই জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছি’।[11]

৬. কাযী হাসান রামাহুরমুযী বলেন, ‘নিশ্চয়ই জ্ঞান নিরীক্ষণের জন্য তা মুখস্থ করে রাখতে হয়। কেননা যে মুখস্থ করে, আলাপ-আলোচনায় অগ্রগণ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব তারই দখলে থাকে। আর সেই জ্ঞানের কোন উপকারিতা নেই, যা শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় মলাটবদ্ধ অবস্থায় অবহেলিত পড়ে থাকে’।[12]

৭. কবি খলীল বলেন,

لَيْسَ بِعِلْمٍ مَا حَوَى الْقِمَطْرُ * مَا الْعِلْمُ إِلاَّ مَا حَوَاهُ الصَّدْرُ.

‘যে জ্ঞান বইয়ের পাতায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়, তা কোন জ্ঞান নয়। কেননা প্রকৃত জ্ঞান সেটাই যা বক্ষে ধারণ করে রাখা হয়’।

৮. মানছূর আল-ফক্বীহ বলেন,

عِلمي مَعي حَيثُما يَمَّمتُ أحمله  

بطني وِعاءٌ لَهُ لا بَطنُ صُندوقِ

إِن كُنتُ في البَيتِ كانَ العِلمُ فيهِ مَعي

أَو كُنتُ في السوقِ كانَ العِلمُ في السوقِ

‘আমার জ্ঞান আমার সাথেই থাকে। আমি যেখানেই যাই, সেই জ্ঞানকে আমার সাথে বহন করে নিয়ে যাই। আমার পেটে জ্ঞান রাখার একটি পাত্র আছে, তবে সেটা বাক্সের পেটের মত নয়। আমি যখন বাড়িতে থাকি, জ্ঞান আমার সাথেই অবস্থান করে। আর বাজারে গেলে, জ্ঞানও আমার সাথেই হাযির থাকে’।[13]

৯. মুহাম্মাদ বিন বাশার আল-আযদী বলেন,

أأشهد بالجهل في مجلس * وعلمي في البيت مستودع

إذا لم تكن حافظا واعيا * فجمعك للكتب لا ينفع

‘আমি কি আমার জ্ঞানকে বাড়িতে গুদামজাত করে রেখে মজলিসে হাযির হয়ে অজ্ঞতার পরিচয় দিব? তুমি যদি জ্ঞানের প্রতি মনোযোগী না হও এবং তা আয়ত্ত করে না রাখ, তাহ’লে তোমার বইয়ের স্তূপ তোমার কোন উপকার সাধন করতে পারবে না’।[14]

হে শিক্ষার্থী! উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে তোমার নিকট মুখস্থ করার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এবং তুমি হিফযের মহিমা ও মর্যাদা অবগত হয়েছে। সুতরাং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ আহরণে অলসতা না করে জ্ঞানার্জনে কঠোরভাবে নিয়োজিত থাক। আল্লাহ তোমাকে হেফাযত করুন!

প্রথম কোন জিনিসের জ্ঞান অর্জন করবে :

প্রিয় শিক্ষার্থী! সর্বপ্রথম তুমি কী মুখস্থ করবে? আমি শুধু তোমার কাছেই এই প্রশ্নটি উত্থাপন করছি না; বরং পিতা-মাতা, অভিভাবকবৃন্দসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা সমূহের শিক্ষক মন্ডলী ও দায়িত্বশীলদের নিকটেও আমার একটাই প্রশ্ন যে, প্রথমতঃ তারা তাদের সন্তান-সন্ততি এবং শিক্ষার্থীদের মুখস্থের ব্যাপারে কতটুকু গুরুত্ব দেন? দ্বিতীয়তঃ তারা তাদের ছেলে-মেয়ে ও শিক্ষার্থীদেরকে কোন বিষয় মুখস্থ করাবেন?

এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হ’ল সালাফে ছালেহীনের দিক-নির্দেশনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং তাঁদের সুন্দর সুন্দর বাণীগুলো অধ্যয়ন করা। যাতে আমরা জানতে পারি যে, মুখস্থ করার ব্যাপারে তাঁরা কত গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁরা তাঁদের ছাত্রদেরকে এ ব্যাপারে কতটুকু প্রেরণা যুগিয়েছেন এবং কিভাবে শিক্ষার্থীদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন। এতে করে আমরা তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারব এবং তাঁদের অনুগামী হ’তে পারব।

হয়তো আমাদের মধ্যকার দু’জনও এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবে না যে, কুরআন মুখস্থ করার মাধ্যমেই আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণের শিক্ষাজীবনে হাতেখড়ি হয়েছিল। কেননা আলেম-ওলামার নিকটে কুরআন মুখস্থ করাই ছিল জ্ঞানার্জনের শুভ সূচনার মূল ভিত্তি। ফলে মুখস্থ করার মাধ্যমে শিক্ষা জীবন আরম্ভ করার ব্যাপারে তাদের কেউই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেননি। আর তাদের এই হিফযকরণ নীতি জ্ঞানী-গুণী ও শিক্ষার্থী মহলে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। রাবীদের বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে নযর দিলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। উপরন্তু কুরআন মুখস্থ না থাকার কারণে তাদের কারো কারো সমালোচনা পর্যন্ত করা হ’ত। যেমন হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ‘তাক্বরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে ওছমান বিন আবী শায়বাহ্র জীবনবৃত্তান্তে এর প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। তিনি ইবনু শায়বাহ্র দোষ-গুণ বর্ণনা করে বলেন, ‘তিনি বিশ্বস্ত ও প্রসিদ্ধ হাফেয। তার কিছু ভুল-ত্রুটি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে,  তার  কুরআন মুখস্থ ছিল না’।[15]  অর্থাৎ কুরআন মুখস্থ না থাকাকে তিনি ত্রুটি ও নিন্দনীয় হিসাবেই উল্লেখ করেছেন, প্রশংসনীয় হিসাবে নয়।

এই পরিসরে বিষয়টি যদি এত দোষণীয় হয়, তাহ’লে আল্লাহ্র কিতাব মুখস্থ করার ব্যাপারে আমাদের অবস্থা কেমন হবে? ভারতের জ্ঞানী সমাজে তো কুরআন মুখস্থ না করাটাই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এক্ষণে আমরা বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কুরআন মুখস্থ করার গুরুত্ব সম্বলিত আলেমদের কতিপয় উক্তি পেশ করব।

১. প্রাচ্যের হাফেয খত্বীব বাগদাদী (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন মুখস্থ করার মাধ্যমে তালিবুল ইলমের শিক্ষা জীবন শুরু করা উচিৎ। কেননা অগ্রগণ্য ও অগ্রবর্তিতার ক্ষেত্রে এটা মহিমান্বিত জ্ঞান। তারপর আল্লাহ যদি তাকে কুরআন হিফয করার তাওফীক্ব দান করেন, তাহ’লে তার উচিত হবে না সাথে সাথেই হাদীছ অথবা এমন কোন জ্ঞান আহরণে মশগূল হয়ে পড়া, যা তাকে কুরআন ভুলে যাওয়ার দিকে ঠেলে দিবে। কুরআন মুখস্থের পর শিক্ষার্থী রাসূলের হাদীছের প্রতি মনোনিবেশ করবে। কারণ মানুষের কর্তব্য হ’ল হাদীছের জ্ঞান অর্জন করা। কেননা হাদীছ শরী‘আতের অন্যতম মৌলিক উৎস ও ভিত্তি। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৯)। তিনি আরো বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে রাসূলের আনুগত্য করে, সে তো আল্লাহ্রই আনুগত্য করে’ (নিসা ৪/৮০)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না’ (নাজম ৫৩/৩)।[16]

২. মরক্কোর হাফেয ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন,

فَأَوَّلُ الْعِلْمِ حِفْظُ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَتَفَهُّمُهُ وَكُلُّ مَا يُعِيْنُ عَلَى فَهْمِهِ فَوَاجِبٌ طَلَبُهُ مَعَهُ،

‘শিক্ষার প্রথম পাঠ হ’ল কুরআন মুখস্থ করা এবং তা অনুধাবন করা। কুরআন অনুধাবনের জন্য সহায়ক জ্ঞান অর্জন করাও আবশ্যক’।[17]

তিনি আরো বলেন, ‘কুরআন হ’ল জ্ঞানের মূল। যে শিক্ষার্থী বালেগ হওয়ার আগেই তা হিফয করবে। অতঃপর আরবদের বাকরীতি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের সহায়তায় কুরআন অনুধাবনের প্রতি পুরোপুরি নিয়োজিত হবে। তখন কুরআনের মর্ম উদ্ঘাটনে তার জন্য এটা বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তারপর কুরআনের নাসেখ-মানসূখ ও তার হুকুম-আহকামের প্রতি নযর দিবে এবং এ ব্যাপারে আলেমদের মতৈক্য ও মতভেদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে। আর আল্লাহ্র নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের জন্য এটা একটি সহজ ব্যাপার। এরপর সে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত নির্ভরযোগ্য হাদীছগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। এর মাধ্যমে সেই শিক্ষার্থী আল্লাহ্র কিতাবের অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হ’তে সক্ষম হবে এবং কুরআনের বিধি-বিধানে তার জন্য জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিবে’।[18]

তিনি বলেন, ‘হে আমার ভাই! উছূলের বিষয়াবলীর প্রতি মনোযোগী হও এবং তা মুখস্থ করে রাখ। মনে রেখ! যিনি কুরআনের নির্দিষ্ট বিধি-বিধান ও হাদীছ মুখস্থ রাখার ব্যাপারে যত্নশীল হন এবং ফক্বীহদের বক্তব্যগুলোর প্রতি খেয়াল রাখেন, ইজতিহাদ তার জন্য সহজ হয়ে যায়। গবেষণার পথ তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং আয়াতের তাফসীর করার জন্য সঠিক মর্মোদ্ধারের পন্থাও তার জন্য উন্মোচিত হয়ে যায়। ফলে শর্তহীনভাবে সর্বাবস্থায় যে সুন্নাতের অনুসরণ করা আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রেও তিনি কোন ফক্বীহর তাক্বলীদ করেন না এবং আলেম-ওলামার নিকট থেকে গৃহীত হাদীছগুলো মুখস্থ করা ও তা নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি নিজেকে কখনো বিশ্রাম দেন না। বরং গবেষণা, অনুধাবন ও মতামত গ্রহণের ব্যাপারে তাদেরকেই অনুকরণ করেন। আর তাদের মাধ্যমে উপকৃত ও সতর্ক হওয়ার জন্য তাদের কষ্টকর মেহনতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং তাদের সঠিক মতের প্রশংসা করেন। কিন্তু ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে তাদেরকে নিষ্কৃতি দেন না। যেমনভাবে তারাও নিজেদেরকে ত্রুটিমুক্ত ভাবেননি। আর এটাই ন্যায়নিষ্ঠ তালেবুল ইলমের বৈশিষ্ট্য। যার উপর সালাফে ছালেহীন অটল ছিলেন। আর প্রকৃত তালেবুল ইলম তো তিনি, যিনি হবেন সৌভাগ্যের কর্ণধার, হেদায়াতের কান্ডারী, সুন্নাতের পাবন্দ এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের পদাঙ্ক অনুকরণকারী। তবে যে ব্যক্তি নিজেকে ত্রুটিমুক্ত মনে করবে, বর্ণিত বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকবে ও স্বীয় রায়ের মাধ্যমে সুন্নাতের বিরোধিতা করবে এবং সেই রায়কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ফিরিয়ে দিতে চাইবে, সে নিজে যেমন পথভ্রষ্ট হবে, তদ্রূপ অপরকেও গোমরাহ করবে। আর যে ব্যক্তি উক্ত বিষয়গুলো না বুঝে এবং না জেনে ফৎওয়া দিতে প্রবৃত্ত হবে, সে স্পষ্ট অন্ধ ও চূড়ান্ত পথভ্রষ্ট। কবির ভাষায়,

لَقَدْ أَسْمَعْتَ لَوْ نَادَيْتَ حَيًّا ... وَلَكِنْ لَا حَيَاةَ لِمَنْ تُنَادِي.

وَقَدْ عَلِمْتُ أَنَّنِيْ لَا أَسْلَمُ ... مِنْ جَاهِلٍ مُعَانِدٍ لَا يَعْلَمُ.

‘তুমি যদি কোন জীবিতকে আহবান কর, তাহ’লে তাকে শোনাতে পারবে। কিন্তু আহূত ব্যক্তি যদি মৃত হয়, তাহ’লে তাকে শোনানো কখনো সম্ভব নয়। আর আমি অবশ্যই জানি যে, এমন কোন জাহেল থেকেও আমি নিরাপদ নই, যে কোন কিছু না জেনেই একগুঁয়েমি করে’।[19]

৩. ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘আগ্রহী ব্যক্তিদের উচিৎ শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে আরোহণ করা। অতঃপর কুরআন, তাফসীর ও রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ মুখস্থ করার প্রতি আত্মনিয়োগ করা এবং নবীদের জীবনচরিত, ছাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের জীবনী অধ্যয়ন করা। যাতে করে সে তাদের মহৎ জীবন ও সুউচচ মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হ’তে পারে। পাশাপাশি নাহুর প্রায়োগিক ও ভাষার ব্যবহারিক দিকগুলো জানা থাকা প্রয়োজন। আর ফিক্ব্হ হ’ল জ্ঞানের মূল এবং তা মুখস্থ রাখা এর উপকারী ও সুমিষ্ট ফল।[20]

৪. ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘শিক্ষা জীবনের শুরুতে সর্বপ্রথম কুরআন মুখস্থ করতে হয়। কেননা কুরআনই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। সালাফগণ কেবলমাত্র তাদেরকেই হাদীছ ও ফিক্বহ শিক্ষা দিতেন, যাদের কুরআন মুখস্থ থাকত। আর কুরআন হিফয করার পর হাদীছ, ফিক্বহ ও অন্য বিষয়ের বিদ্যার্জনে এমন গভীরভাবে ডুব দিতেও সতর্ক থাকবে, যা তাকে কুরআন বিস্মৃতির দিকে ঠেলে দিবে এবং ভুলে যাওয়ার প্রান্ত সীমায় উপনীত করবে। আর কুরআন মুখস্থ করার পর সংক্ষিপ্তাকারে প্রত্যেক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটগুলো আগে মুখস্থ করবে। তন্মধ্যে ফিক্বহ, নাহু, হাদীছ ও উছূল উল্লেখযোগ্য। এরপর বাকী সহজ বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিবে। তারপর আত্মস্থ করা বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি আত্মনিয়োগ করবে এবং শায়খদের কাছ থেকে গৃহীত প্রত্যেকটি বিষয়ের অধ্যয়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন করবে’।[21]

৫. ইবনু জামা‘আহ তার দরসে শিক্ষার্থীদের কতিপয় শিষ্টাচার তুলে ধরেছেন। যেমন-

একজন তালেবুল ইলম সর্বপ্রথম কুরআন পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন শুরু করবে। অতঃপর তা ভালভাবে মুখস্থ করবে এবং তাফসীর ও এতদসংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করবে। কেননা কুরআনই হ’ল সকল জ্ঞানের মূল উৎস এবং সর্বাধিক তাৎপর্যমন্ডিত জ্ঞান। এরপর জ্ঞানের প্রত্যেক শাখার কিছু সংক্ষিপ্ত পুস্তক মুখস্থ করবে। যা শিক্ষার দুই প্রান্তকে একত্রিত করে। যেমন- হাদীছ ও উলূমুল হাদীছ, উছূলে তাফসীর, উছূলে ফিক্বহ, নাহু ও ছরফ।

প্রতিদিন নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা, এর প্রতি যত্নবান হওয়া এবং পঠন-পাঠন না করে অন্য সকল জ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত থাকা সমীচীন নয়। আর কুরআন মুখস্থ করার পর ভুলে যাওয়া থেকেও সতর্ক থাকতে হবে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যেখানে কুরআন ভুলে যাওয়াকে কঠোরভাবে তিরষ্কার করা হয়েছে। কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বহের জ্ঞান আহরণের পর শায়খদের নিকটে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জানার প্রতি মনোনিবেশ করবে। তবে সবসময় শুধু বই-পুস্তকের উপর নির্ভরশীল হওয়া থেকেও সাবধান থাকতে হবে। উপরন্তু প্রত্যেক বিষয়ে এমন আলেমের প্রতি নির্ভর করবে, যিনি সেই বিষয়ের জ্ঞানার্জনে ও শিক্ষাদানে সেরা এবং সেই বিষয় বিশ্লেষণে সবার্ধিক যোগ্য। যিনি তার পঠিত বইগুলোর ব্যাপারেও তাদেরকে সুপরামর্শ দিবেন। স্নেহ-ভালবাসা, সততা এবং দ্বীনদারী প্রভৃতি গুণ শিক্ষকের মধ্যে আছে কি-না তা যাচাই করার পর।[22]

৬. ইবনুল মুফলিহ (রহঃ) বলেন, মায়মুনী বলেছেন, ‘আমি আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমি আমার সন্তানকে আগে কুরআন শিক্ষা দিব নাকি হাদীছ শিক্ষা দিব? এই দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনটা আপনার নিকট বেশী পসন্দনীয়? তখন তিনি বললেন, না, বরং আগে কুরআন শিখাও। আমি বললাম, পুরা কুরআনই কি শিখাব? তিনি বললেন, যদি কঠিন না হয়, তাহ’লে পুরা কুরআনই শিখাও, তাহ’লে সে কুরআন থেকে আস্তে আস্তে জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। তারপর তিনি আমাকে বললেন, যদি সে প্রাথমিকভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে, তাহ’লে তাকে নিয়মিত তেলাওয়াতে অভ্যস্থ করবে। ইমাম আহমাদের অনুসারীরা আমাদের যুগ পর্যন্ত পাঠদানের ক্ষেত্রে এই নীতিমালাই অনুসরণ করে এসেছেন।[23]

নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে এই মূল্যবান কথাগুলোর অবতারণা করলাম এই কারণে, যাতে ইচ্ছাশক্তিগুলো জেগে ওঠে, প্রতিভাগুলো বিকশিত হয়। মননশীলতা যেন সুতীক্ষন হয় এবং মুখস্থ করার ব্যাপারে অন্তরসমূহে আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

মহামতি এই ইমামগণের দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখুন- কুরআন মুখস্থ করার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন শুরু করার ব্যাপারে তাঁরা সবাই একমত। বিশেষ করে  ইমাম নববীর এই কথাটি বার বার পড়ে মনে গেঁথে রাখুন,

وكان السلف لا يعلّمون الحديث والفقه إلا لمن يحفظ القرآن

‘পূর্বসূরী বিদ্বানগণ কেবল তাকেই হাদীছ ও ফিক্বহ শিক্ষা দিতেন, যার কুরআন মুখস্থ থাকত’।

বিদ্যা অর্জন ও শেখার ক্ষেত্রে এটাই ছিল আমাদের মহান পূর্বসুরীদের অবস্থা। কিন্তু আমাদের অবস্থা? আমরা কি তাদের সেই পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করছি?

ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) যথার্থই বলেছেন, ‘জেনে রাখ! আমাদের দেশে এবং আমাদের যুগের মানুষজন তাদের পূর্বসূরীদের জ্ঞান অর্জনের পথ থেকে সরে এসেছিল এবং এমন পথ অবলম্বন করেছে, যে ব্যাপারে তাদের ইমামগণ অবগত ছিলেন না। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা এমন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যার মাধ্যমে তাদের শুধু মূর্খতাই ফুটে উঠেছে এবং তাদের পূর্ববর্তী আলেমদের মর্যাদারও অবমাননা হয়েছে। তাছাড়া তাদের একটি দল হাদীছ বর্ণনা ও শ্রবণ করেই ক্ষান্ত হয়েছে। তারা অনুধাবন না করে শুধু হাদীছ সংগ্রহের সাধনাতেই তুষ্ট থেকেছে এবং অজ্ঞতা নিয়েই পরিতৃপ্ত হয়েছে। ফলে তারা একই কিতাবে এবং কখনো কখনো একই পৃষ্ঠায় সত্য-মিথ্যা, ছহীহ-যঈফ, ভাল-মন্দ সবকিছু একত্রিত করেছে। তারা কোন বিষয়ের পক্ষে আবার বিপক্ষে বলেছে। আহলে ইলমের ব্যাপারে তাদের কি কর্তব্য, এটাই তারা জানতে পারেনি। সেকারণ গভীর ভাবনা ও গুরুত্ব বিবেচনা ব্যতিরেকে তারা নিজেদেরকে কেবল অধিক পঠন-পাঠনে ব্যস্ত রেখেছে। ফলে তাদের জিহবাগুলোতে জ্ঞান উপচে পড়লেও তাদের হৃদয়গুলো অনুধাবনশূন্য থেকেছে। তাদের কারো কারো জ্ঞান লাভের মূল লক্ষ্য ছিল অপরিচিত নাম ও উপনাম জানা এবং মুনকার হাদীছ সম্পর্কে অবগত হওয়া। তারা এই বিদ্যা লাভ করলেও জ্ঞানের বিস্তর শাখায় যেমন- ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ও যাকাতের বিবি-বিধান সম্পর্কে তারা অজ্ঞই রয়ে গেছে।

আরেকটি দল ছিল, যারা ছিল এদের মতই অথবা এদের চেয়ে আরও জাহেল। তারা হাদীছ মুখস্থ করার প্রতি গুরুত্ব দেয়নি, এর তাৎপর্যও উপলব্ধি করেনি এবং কুরআনের মৌলিক বিষয়াবলী মুখস্থ রাখারও প্রয়োজন অনুভব করেনি। তারা আল্লাহ্র কিতাবের প্রতি আত্মনিয়োগ করেনি। তারা কুরআন মুখস্থ করেছিল বটে। কিন্তু পূর্ববর্তী আলেমদের বুঝ অনুযায়ী তারা কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেনি এবং হালাল-হারামের বিষয়াবলীও উপলব্ধি করেনি।

সুন্নাত ও আছারের ইলমকে তারা দূরে নিক্ষেপ করেছে এবং এতদসংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন করা থেকে বিরত ও উদাসীন থেকেছে। ফলে তারা ইখতিলাফ ও ইজমা সম্পর্কে অবগত হয়নি এবং দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের মাঝে পার্থক্য করেনি; বরং আলেমদের রায় ও ইস্তিহসানের উপরেই নির্ভর করেছে। অথচ আইম্মায়ে কেরাম তাদের প্রদত্ত ফৎওয়ার ব্যাপারে ক্রন্দন করতেন এবং তারা কামনা করতেন যে, তাদের প্রদত্ত ফৎওয়াগুলো যেন সঠিক হয়।[24]

আমাদের মাঝে কতজন শিক্ষার্থী বা আলেম এমন আছে, যে আগে কুরআন মুখস্থ করে? তারপর কিছু বিষয় থেকে বা প্রত্যেক বিষয় থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান সংক্ষিপ্তাকারে মুখস্থ করে? আমাদের আলেম-ওলামা ও তালেবুল ইলমদের মধ্যে এমন কাউকে তো চোখে পড়ে না। তবে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত প্রাপ্ত এমন কেউ থাকতেও পারে।

হে শিক্ষার্থী বন্ধু! তুমি কি জ্ঞান-বিদ্যা মুখস্থ করার প্রতি তোমার দৃষ্টি ফিরাবে? শিক্ষকবৃন্দ কি ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন? মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলবৃন্দ এবং যারা শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাস নিয়ে কাজ করেন, তারা কি এই বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন? নাকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইলমী দুর্বলতা দেখেও তাতে সন্তুষ্ট থাকবেন?

মুখস্থ করার উপকারিতা :

সচেতন শিক্ষার্থী ও মহান আলেমদের জন্য মুখস্থ করার উল্লেখযোগ্য অনেক উপকারিতা রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা (শিক্ষক ও শিক্ষার্থী) তাদের ইলমী যোগ্যতা ও শিক্ষাগত দক্ষতা সম্পর্কে অবগত হ’তে পারবেন এবং সহকর্মী-সহপাঠীদের মধ্যে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের পারদ বুঝতে পারবেন। মুখস্থ করার বেশ কিছু ফায়েদা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছ-

১. জানা তথ্যাবলী স্মৃতিতে বিদ্যমান থাকে।

২. যে কোন মুহূর্তে মুখস্থ করা বিষয়ে অতিরিক্ত জ্ঞান হাছিল করা যায়।

৩. খুব সহজে বিভিন্ন তথ্য স্মরণ করা যায়।

৪. বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মুখস্থ করার উপকারিতা ও সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন- বই হারিয়ে গেলে, রাতে বিদ্যুৎ না থাকলে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললে।

মুখস্থকারী ব্যক্তি সবসময় অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী থাকে। জ্ঞানী মহলে তার শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। এজন্য ছাহেবে রাহবিয়া কুরআনে ওয়ারিছদের নির্ধারিত অংশসমূহের আলোচনায় বলেছেন। যেমন-

الثلثان وهما التمام *  فاحفظ فكل حافظ إمام

(নির্ধারিত অংশের অন্যতম হ’ল) দুই-তৃতীয়াংশ এবং এ দু’টি পরিপূর্ণ। সুতরাং এগুলো তুমি মুখস্থ রাখ। কেননা প্রত্যেক হাফেয বা মুখস্থকারী ইমাম।

বাক্বরী বলেন, ‘প্রত্যেক মুখস্থকারীই নেতা’ এর অর্থ হ’ল-মুখস্থকারী সেই সকল লোকদের চেয়ে অগ্রগামী, তার মত যার মুখস্থ নেই। হয়ত তার কম মুখস্থ আছে অথবা কিছুই মুখস্থ নেই’।[25]

এই পংক্তির ব্যাখ্যায় ইবনু গালয়ূন বলেন, মুখস্থকারীকে অনুসরণ করা হয় এবং অন্যদের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাত হয়। সুতরাং যে মুখস্থ করার প্রতি আত্মনিয়োগ করে, সে এর সুমিষ্ট ফল আহরণ করে। যে বিছানায় শুয়ে থাকে, সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। যে চাষাবাদ করে, সেই তো উত্তম ফসল লাভ করে। আর যে অলসতা করে, সে উদ্বেগ, অনুতাপ ও কষ্টের সম্মুখীন হয়’।[26]

হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বুলূগুল মারামের ভূমিকায় বলেন, فهذا مختصر يشمل على أصول الأدلة الحديثية للأحكام، حررته تحريرا بالغا ليصير من يحفظه من بين أقرانه نابغًا ‘অতঃপর এই গ্রন্থটি ইসলামী শরী‘আতের বিধি-বিধান সম্বলিত হাদীছসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন। আমি এই কিতাবটি উৎসর্গ করলাম সেই শিক্ষার্থীর জন্য, যে এটাকে মুখস্থ করবে সে তার সমসাময়িকদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে’।[27]

সুতরাং হে শিক্ষার্থী! জ্ঞান বাগিচায় তুমি তোমার যোগ্যতা ও মর্যাদাকে মূল্যায়ন কর এবং এই পরিমন্ডলে তোমার শ্রেষ্ঠত্বের পরিধিকে উপলব্ধি করতে শেখো। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উপকারী জ্ঞান অর্জন করার ও সৎ আমল সম্পাদনের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

(সৌজন্যে : মাসিক ছওতুল উম্মাহ, জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ভারত, নভেম্বর-২০১৬, পৃঃ ১৩-২০)


[1]. ইবন মানযূর, লিসানুল ‘আরাব ৭/৪৪১।

[2]. আল-মিছবাহুল মুনীর, পৃঃ ৫৫।

[3]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত ১/১৮৫।

[4]. হাশিয়াতুল বাকারী আলা শারহির রাহবিয়াহ, পৃঃ ১৩।

[5]. তিরমিযী হা/২৬৫৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪০৪।

[6]. আব্দুল্লাহ বিন ইউসুফ আল-জুদাই, তাহরীরু ‘উলূমিল হাদীছ‘ ২/৭৯৬।

[7]. আল-জামে‘ লি আখলাকির রাবী ২/২৫০, পাদটীকা সহ।

[8]. ঐ, ২/২৪৮, নং ১৭৫০।

[9]. আল-জার্হ ওয়া তা‘দীল, ২/৩৬।

[10]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামি‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী ১/১৪০ (মুআস্সাসাতুর রাইয়ান)।

[11]. আল-জামে‘ লি-আখলাকির রাবী  ২/২৫০, নং ১৭৫৫।

[12]. আল-মুহাদ্দিছুল ফাছিল, পৃ: ৩৮৭

[13]. জামি‘উ বায়ানিল ইলম, ১/২৯২-২৯৩।

[14]. আল-জামে‘ লি আখলাকির রাবী  ২/২৫০; নং ১৭৫৫।

[15]. মা‘আলিম ফী ত্বরীকি তলাবিল ‘ইলম, পৃ: ১৯৩।

[16]. আল-জামি‘ লি আখলাকির রাবী ১/১০৬-১১১।

[17]. জামি‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/১১৩০।

[18]. ঐ ২/১১৩০।

[19]. ঐ ২/১১৩৯।

[20]. লাফতাতুল কাবিদ পৃ: ৩০।

[21]. আল-মাজমূ‘ ১/৬৯।

[22]. তাযকিরাতুস সামে‘ ওয়াল মুতাকাল্লিম, পৃ:১৬৭।

[23]. আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ ২/৩৫।

[24]. জামে‘উ বায়ানিল ইলম, ২/১১৩৫।

[25]. হাশিয়াতু বাক্বরী ‘আলা শারহি রাহবিয়্যাহ, পৃ:১৪।

[26]. তুহফাতু ফী ইলমিল মাওয়ারীছ, পৃ: ৯৯।

[27]. মুক্বাদ্দামা বুলূগুল মারাম, পৃ: ২০, আদ-দালীলু ইলাল মুতূনিল ইলমিইয়াহ, পৃ: ৫৪-৫৫ দ্রষ্টব্য।





ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
খারেজীদের আক্বীদা ও ইতিহাস - মীযানুর রহমান মাদানী
আতিথেয়তার আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (২য় কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
জিহাদের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল সমূহ - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইস্রাঈলীদের মন্দ পরিণতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নেতৃত্বের মোহ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.