মাগরিবের কিছুক্ষণ পর আমরা মারজান দ্বীপে পৌঁছাই। ততক্ষণে দাম্মাম ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি জনাব আব্দুল্লাহ আল-মামূন ভাইয়ের নেতৃত্বে দায়িত্বশীল ভাইয়েরা উপস্থিত হয়েছেন। সবুজ ঘাসে মোড়া ও গাছপালা ঘেরা এই কৃত্রিম গোলাকার দ্বীপটি মরুর বুকে এক টুকরো মরুদ্যানের মত। বাড়তি যোগ হয়েছে সমুদ্র থেকে আসা বিশুদ্ধ লোনা বাতাসের পরশ। পার্কের আদলে গড়ে তোলায় এখানে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন অনেকেই। আমাদের প্রোগ্রাম সবুজ ঘাসের উপর উন্মুক্ত ময়দানে শুরু হ’ল। রবিবার কর্মদিবস। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও দূর-দূরান্ত থেকে দ্বীনী ভাইয়েরা উপস্থিত হ’লেন। প্রায় ঘন্টা দুয়েক আলোচনার পর ছিল সামুদ্রিক মাছসহ নানা পদের সমাহারে সুস্বাদু সান্ধ্যভোজের আয়োজন। পরিশেষে উপহার বিতরণের মাধ্যমে শেষ হ’ল প্রাণবন্ত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ এই চমৎকার সমাবেশ। আব্দুল্লাহ মুন্না, জামাল গাযী, আইয়ূব হোসাইন, মাস‘ঊদ আহমাদ, আবুল বাশার প্রমুখ দ্বীনী ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই প্রোগ্রাম। আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন-আমীন!
পরদিন বাদ ফজর শায়খ মতীউর রহমান মাদানীর সাথে বিদায়ী সাক্ষাতের কথা। ফজরের পরপরই আব্দুল্লাহ মুন্না ভাই আমাদের নিয়ে রওয়ানা হ’লেন মারজান দ্বীপের পথে। আমরা পৌঁছানোর পরপরই শায়খ পুরোনো মডেলের একটি সিক্স-সিটার গাড়ি নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে আসলেন। সঙ্গে ছিলেন ইন্ডিয়ার জনাব আব্দুল কাদের, যিনি শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী (রহ.)-এর ছোট ভাই। দ্বীপের ঘাসে ভরা চত্বরের এক প্রান্তে ফরাশ পেতে সমুদ্রমুখী হয়ে আমরা বসলাম গোল হয়ে। শায়খ বাড়ি থেকে চা, খেজুর, বিস্কুট নিয়ে এসেছেন। সেটা দিয়ে নাশতা করতে করতে আমাদের আলাপ চলতে লাগল। পারিবারিক আলাপ দিয়েই শুরু হ’ল। এই দ্বীপ থেকে কাছেই তাঁর বাসভবন। নয় সন্তানের বড় পরিবার তাঁর। বড় ছেলে মুহাম্মাদ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যিনি আমেরিকায় থাকেন এবং মেজ ছেলে ওবায়দুল্লাহ লন্ডনে একটি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে ইমাম ও দাঈ হিসাবে কর্মরত আছেন। অপর দু’জন আব্দুল আযীয ও আব্দুল মাজীদ দাম্মাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। অসাধারণ ব্যাপার হ’ল পাঁচ মেয়ে সহ তাঁর সন্তানরা সবাই হাফেযে কুরআন।
তাঁর দাম্মামে আসার গল্পটা ছিল খুব সাধারণ। তিনি মদীনা থেকে পড়াশোনা শেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মালদহে নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন। শিক্ষকতা শুরু করেছেন শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী (১৯৫৪-২০১০খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত বিহারের কিষাণগঞ্জে অবস্থিত জামি‘আতুল ইমাম বুখারী মাদ্রাসায়। পাশাপাশি কিছু দাওয়াতী কাজও করছেন। হঠাৎ একদিন ফোন আসল তাঁর একজন পরিচিত সুহৃদের কাছ থেকে। দাম্মাম ইসলামিক সেন্টারে দাঈ হিসাবে কাজ করার জন্য। তিনি শর্ত দিলেন পরিবারসহ সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শর্ত মেনে নেয়া হ’ল। তবুও বলা যায়, অনেকটা নিমরাজির মধ্য দিয়েই তিনি দাম্মামে এলেন.. সপরিবারে। সন্তানরা পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে গেল। তখন ১৯৯৯ সাল। বয়স সবে ৩৩ বছর (জন্ম : ১৯৬৭) তাঁর। দাম্মাম সেসময় বিশেষ উন্নত শহর ছিল না। মক্কা-মদীনা থেকে অনেক দূরের রাস্তা। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা করা কঠিন ছিল। অন্য কোন শহরে যাওয়ার আহবান যে আসেনি, তাও নয়। তবুও সন্তানদের পড়াশোনার স্বার্থে তিনি দাম্মামকেই আপন করে নিলেন। তারপর ২০০৫-০৬ সালের দিকে ভিডিও মাধ্যম ব্যবহার করে মিডিয়ায় দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন।
তাঁর আক্বীদা ও মানহাজ বিষয়ক সিরিজ বক্তব্যগুলো বাংলাভাষীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে লাগল। কবরপুজারী, ইখওয়ানী বিভিন্ন ঘরানা থেকে তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগারও কম হ’ল না। এভাবেই যুগপৎ খ্যাতি ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন আজকের শায়খ মতীউর রহমান মাদানী। খ্যাতি পাওয়ার পর দুবাই কিংবা অন্যান্য দেশ ও শহরের প্রসিদ্ধ ইসলামিক সেন্টারগুলোতে দাঈ হিসাবে আহবান করা হ’লেও তিনি আর কোথাও যাননি। ২৪ বছর অবধি এই দাম্মামেই থিতু হয়ে আছেন। সাফল্য পেতে গেলে কোন জায়গায় থিতু হওয়ার এই গুণটা আয়ত্ত করা বোধহয় গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মানসিক অস্থিরতা আর চঞ্চলমতিত্বের খপ্পরে পড়ে অনেক মেধাবী মানুষকেও দিকভ্রান্ত হ’তে দেখেছি। অনেক সময় নিশ্চিত সফলতার রাস্তায় উঠেও তাদেরকে ছিটকে পড়তে দেখেছি।
শায়খ আমার আববা ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয়পর্বের স্মৃতিচারণ করলেন। ১৯৯৮ সাল। তখনও তিনি দাম্মামে যাননি। সেসময় আববা ইন্ডিয়া সফরে গেলে তিনি মুর্শিদাবাদে তাঁকে কয়েকদিন সঙ্গ দিয়েছিলেন। তাছাড়া শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী (রহ.)-এর ভগ্নিপতি হওয়ার সুবাদে তিনি পূর্ব থেকেই আববাকে ভালভাবে জানতেন। সেজন্য আববার প্রতি তাঁর মহববতের প্রকাশটা স্বাভাবিক সৌজন্যবোধের গন্ডি ছাড়িয়ে নিখাঁদ পারিবারিক বন্ধনের আবেশ ছড়ালো। ইতিপূর্বে একবার তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন। সেবারে ঢাকা যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত সফর করে আবার ফিরে গিয়েছিলেন।
শায়খের ইতিহাস ও ভূ-রাজনীতির জ্ঞান আমাদের মুগ্ধ করল। বিশেষতঃ দাম্মাম কেন্দ্রিক শী‘আদের তৎপরতা এবং পূর্ব সঊদী আরবের আহসা, কাত্বীফ ও দাম্মাম জুড়ে তাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সঊদী আরবের জন্য কতটা হুমকির কারণ-তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেন। পুরো সঊদীআরবে বর্তমানে শী‘আদের সংখ্যা যেখানে ২-৩% (১০ লক্ষ), সেখানে কেবল এই পূর্বাঞ্চলেই ২৫%। ক্বাতীফ শহরের ৮৫%ই শী‘আ। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যেও অনেক অগ্রসর। দাম্মামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখন্ড বর্তমানে তাদের মালিকানাধীন। ইরানের গোপন সহায়তায় তারা দিন দিন তাদের অবস্থান মযবূত করছে বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া শী‘আ অধ্যুষিত দেশ বাহরাইনও এই শহরের পার্শ্বেই অবস্থিত। সেখান থেকেও তারা সমর্থন পায়। ২০১৫ সালে এক শী‘আ মসজিদে হামলায় অনেকে নিহত হওয়ার পর থেকে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও সরকার কঠোর শী‘আবিরোধী অবস্থান ধরে রেখেছে। সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও সঊদী সরকার সর্বদা তাদের প্রতি কড়া নযরদারী রেখেছে।
১৯৩৮ সালে সঊদী আরবের প্রথম তৈলক্ষেত্র আবিষ্কার হয় এই দাম্মামে। সেই থেকে তৈলসমৃদ্ধ ধনী দেশ হিসাবে আবির্ভাব আধুনিক সঊদী আরবের। এভাবে একদিকে তৈলসমৃদ্ধ পূর্ব সঊদী আরবের কেন্দ্রস্থল, অপরদিকে শী‘আ জনগোষ্ঠীর শক্ত অবস্থান মিলিয়ে দাম্মাম মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্র।
গল্পে গল্পে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক সময় চলে গেল। শায়খ যে এতটা বন্ধুবাৎসল এবং সদালাপী, তা সাধারণভাবে বোঝার উপায় নেই। পারিবারিক বৈঠকী আলাপের আবহে আলোচনা যেন শেষ হ’তেই চায় না। ওদিকে বেলা দশটায় আমাদের রিয়াদের উদ্দেশ্যে গাড়ি ধরতে হবে। বৈঠক শেষে শায়খকে বাংলাদেশে আসার দাওয়াত দিলাম। আগামী বছর রাজনৈতিক পরিবেশ ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে আসতে চাইলেন। উনাকে আমাদের কিছু বই হাদিয়া দিয়ে আমরা বিদায় গ্রহণ করলাম। শায়খও নিজের গাড়িতে বাড়ির পথ ধরলেন। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁর খেদমতগুলো কবুল করে নিন এবং তাঁর দাওয়াতী তৎপরতায় বরকত দান করুন- আমীন!
হোটেলে এসে আমরা দ্রুত রওয়ানা হ’লাম আব্দুল্লাহ মুন্না ভাইয়ের সাথে। পার্শ্ববর্তী শহর আল-খোবার থেকে সাপ্টকো বাস ছাড়লো ঠিক বেলা দশটায়। যাহরান হয়ে মরুভূমির বুক চিরে বাস চলতে থাকে। বাসে যাত্রী তেমন নেই। দাম্মাম থেকে বিমান কিংবা ট্রেনের যোগাযোগব্যবস্থা ভাল। এটাই হয়ত কারণ। মরুভূমির গঠনটা এদিকে অন্য রকম। চোখ ধাঁধানো নিরেট সাদা বালু চারিদিকে। কখনও পাহাড়ের মত ঢেউ খেলানো। গাছাপালা, বাড়িঘরের কোন চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে কেবল দূরের বালিয়াড়িতে চরে বেড়ানো বিক্ষিপ্ত উটের দল প্রাণের জানান দেয়।
দুপুর ২-টার মধ্যে সাড়ে চারশ’ কি. মি. অতিক্রম করে আমরা রিয়াদের আল-রাফি‘আহ এলাকায় পৌঁছলাম। ‘আন্দোলন’ সঊদী আরব শাখা সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব রিয়াযুল ইসলাম (মধু) জ্যাম ঠেলে বেশ কিছুক্ষণ পরে এসে আমাদের রিসিভ করলেন। সেখান থেকে আযীযিয়াহর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। আমার ফুফাতো ভাই নাছরুল আনাম দুপুরে খাওয়ার আয়োজন করেছেন, যিনি প্রয়াত কিং খালেদ বিন আব্দুল আযীযের কন্যা এবং সঊদী মজলিসে শূরার প্রথম নারী সদস্যা প্রিন্সেস মৌযী বিনতে খালেদের বাসভবন কমপ্লেক্সে কর্মরত রয়েছেন। প্রচন্ড জ্যাম ঠেলে রিয়াদ শহর দেখতে দেখতে আমরা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর আযীযিয়াহ এলাকায় পৌঁছালাম। এই এলাকায় সঊদী প্রিন্স ও প্রিন্সেসদের বাসভবন অবস্থিত। আমরা ভাইয়ের বানানো আট পদের কেকসহ রয়াল ডিশ থেকে নানান পদের সুস্বাদু খাবার দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। তারপর সামান্য বিশ্রামের জন্য রিয়াদ চিড়িয়াখানার পার্শ্বে রিয়াদের কেন্দ্রস্থল আল-মালাযে অবস্থিত রীম হোটেলে আসলাম। কিছুক্ষণ পর হোটেলে এসে যোগ দিলেন আমাদের দুবাইয়ের সফরসঙ্গী মুজাহিদ ভাই, যিনি আমাদের দাম্মাম সফরের ফাঁকে মক্কা থেকে ওমরাও করে এসেছেন। সঊদী আরবেও তিনি বাকী সময় আমাদের সফরসঙ্গী থাকবেন।
বাদ মাগরিব উত্তর রিয়াদের ‘ইস্তিরাহা লারিনে’ আন্দোলন-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত কর্মী সম্মেলন ২০২৩-এ আমরা অংশগ্রহণ করলাম। সভাপতি শায়খ মুশফিকুর রহমান মাদানীসহ সঊদী আরব শাখার দায়িত্বশীলবৃন্দ আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। রিয়াদের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শতাধিক কর্মী ও দায়িত্বশীলবৃন্দ এতে উপস্থিত ছিলেন। চমৎকার এ আয়োজনে উপস্থিতদের সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়ে আমরা খুব খুশী হ’লাম। প্রবাসের ব্যস্ত দিনগুলো তারা দ্বীনে হকের প্রচার ও প্রসারে ব্যয় করে যাচ্ছেন সাধ্যমত। আল্লাহ তাদের সবাইকে কবুল করুন- আমীন!
***
পরদিন ২১শে এপ্রিল’২৩ দুপুরে দাওয়াত ছিল ‘আন্দোলন’-এর দফতর সম্পাদক ইমরান ভাইয়ের বাসায়। আত-তাহরীক পাঠক ফোরামের প্রিয় ভাই আলী হায়দার (সিলেট) আমাদের নিতে আসলেন। ইমরান ভাই বেশ ভাল রান্না করেন। কয়েক পদের রান্না করেছেন নিজ হাতে। গতবার (২০২২ইং) হজ্জ সফরের সময় তিনি আমাদের জন্য কয়েকদিনের খাবার রান্না করে বিমানে রিয়াদ থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা এসেছিলেন। তার সেই তাজ্জব করার মত আন্তরিকতা ভোলার নয়। এবার তার শহরে এসে তার রান্না না খেয়ে যাওয়ার সুযোগ পাব না, তা জানাই ছিল। অপরদিকে আলী হায়দার ভাইও অন্তঃপ্রাণ ভালোবাসার মানুষ। মোবাইলে অনেকবার কথা হ’লেও এবারই প্রথম সরাসরি দেখা, কিন্তু সেটা মনে রাখার কোন সুযোগ দিলেন না। বাড়ি থেকে তিনিও খাবার নিয়ে এসেছেন হটপটে। ভালোবাসার এসব আয়োজনগুলো অন্তরে গভীর নাড়া দিয়ে যায় সঙ্গোপনে। জানি এসব ভালোবাসার কোন মূল্য দেয়া যায় না, কোন বিনিময়ও হয় না। কেবল দো‘আই করি- আল্লাহ যেন তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ কল্যাণ দান করেন এবং এই পারস্পরিক দ্বীনী মহববতকে জান্নাতের অসীলা বানিয়ে দিন- আমীন!
বিকালে এক টেইলার্সে নিয়ে আমাদের জন্য জুববার অর্ডার দিলেন ইমরান ভাই। সাথে আরো ছিলেন ফেনীর যিয়াউদ্দীন বাবলু ভাই। রিয়াদে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসী ব্যবসা। ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিজের বাসার চারটি ফ্লোরকে মসজিদ ও মাদ্রাসায় রূপান্তর করেছেন। বর্তমানে সেখানে হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড অধিভুক্ত ‘দারুল হাদীছ একাডেমী’ পরিচালিত হচ্ছে।
মৃদুভাষী, অসাধারণ ভদ্রজন যিয়া ভাই ব্যবসায়িক ব্যস্ততা ফেলে আমাদেরকে জুববা হাদিয়া দেয়ার নিয়তে এসেছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ দিলেন না ইমরান ভাই। পরে সবাই একসাথে হায়দার ভাইয়ের গাড়িতে রওয়ানা হ’লাম। রিয়াদ ডাউনটাউনের উদ্দেশ্যে। এমনিতে দুবাই সফরের পর অন্য কোন শহর সফর করলে সে শহর যতই জাঁকালো হোক না কেন, কিছুটা ম্রিয়মাণ লাগে। সেই হিসাবে সত্যি বলতে কি, রিয়াদ শহরের জাঁকজমক প্রথমে বিশেষ আকর্ষণ করেনি। বরং পুরোনো শহর হিসাবে এর প্রাচীন আভিজাত্য, বনেদিয়ানা যথেষ্ট নযর কেড়েছিল। তবে রাতের আলো ঝলমলে রিয়াদের চিত্র অন্য রকম। কিং খালেদ রোড ধরে যতই আগাই রিয়াদে আইকনিক ভবন ও স্থাপনাগুলো ততই মুগ্ধ করতে লাগল। বিশেষ করে ৩০০ মিটার উচ্চতার ৯৯তলা বিশিষ্ট কিংডম টাওয়ারের সৌন্দর্য রিয়াদকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
আমরা সিটি সেন্টারে এসে রিয়াদ মলে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। মাশাআল্লাহ দুবাই বা অন্য শহরের বিলাসবহুল মলগুলোর মত সৌন্দর্যে, চাকচিক্যে ভরপুর হ’লেও বেলেল্লাপনা, মিউজিকের উপদ্রব এখানে একেবারেই নেই। শুধু রিয়াদ নয়, গোটা সঊদী আরবে শালীনতার এই যে চক্ষুশীতলকারী চিত্র পরিদৃষ্ট হয়, তা সারা বিশ্বে নযীরবিহীন। তাওহীদের দেশ হিসাবে সঊদী আরবের এই অবস্থান যেন অটুট থাকে এবং ইদানীং কিছু ফিৎনার যেসব আভাস দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ তা থেকে যেন সঊদী আরবকে রক্ষা করেন- আমীন!
মাগরিবের পর আল-উলাইয়া রোডের রেড ওনিয়ন রেস্টুরেন্টে মাসিক আত-তাহরীক পাঠক ফোরাম রিয়াদ শাখার উদ্যোগে সুধী সমাবেশ। আমরা সময়ের পূর্বেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে উপস্থিত সুধীদের সাথে আলাপচারিতা হ’ল। সত্যি বলতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কূটনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এমন মিশ্র ধারার পেশাজীবী শ্রেণীর সাথে এমন বিশেষ বৈঠকে বসার সুযোগ আমার জন্য এই প্রথম। তাঁরা অধিকাংশই মাসিক আত-তাহরীকের নিয়মিত পাঠক এবং ডোনার জেনে খুব ভালো লাগল।
পাঠক ফোরাম সভাপতি জনাব শামসুল আলম একজন আপাদমস্তক নিপট ভদ্রলোক। তাকে দেখে কেবলই মনে হয়েছে, আল্লাহ যখন কারও দীল ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন, তখন তার চেহারায় এক অপার্থিব নূরের ঢেউ খেলে যায়। যেসব মানুষকে তিনি আজকের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে এনেছেন, তাদেরকে এভাবে একত্র করা মোটেও সহজ কাজ নয়। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁর পার্থিব জীবন-জীবিকায় যথেষ্ট বরকত দিয়েছেন। চাইলে বিলাসবহুল সময় কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব ভুলে যাননি। আজও তাই মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে আত-তাহরীক বিতরণ করেন। সুধীদের উদ্দেশ্যে তাঁর বিনয়াবনত বাচনভঙ্গিতে মানুষকে সৎপথে আনার তাড়না, শিরক-বিদ‘আতের গাঢ় আঁধার থেকে মানুষকে উদ্ধারের প্রেরণা যেন অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত হচ্ছিল। আহলেহাদীছ আন্দোলন এসকল দ্বীনদার মানুষদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করতে পারছে, তা অনুভব করে চোখটা ভিজে আসল। আলহামদুলিল্লাহ! হয়তোবা দেশের আনাচে-কানাচে এমনতরো হাযারো মানুষের নির্বিরাম ত্যাগ ও নিভৃত দো‘আর বরকতে বিশুদ্ধ দ্বীনের আলো একদিন সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। আল্লাহ আমাদের সকলকে জান্নাতের পথে দৃঢ়চিত্ত হয়ে সীসাঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ থেকে এগিয়ে চলার তাওফীক দান করুন- আমীন!
***
পরদিন ২২শে এপ্রিল’২৩। আজ আলেম-ওলামাদের কেন্দ্র আর ফল-ফসলের ঝুড়ি আল-কাছীম যাওয়ার কথা। মধু ভাই ফজরের পর আমাদের নিতে আসলেন আমাদের হোটেলে। ৭-টার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আল-কাছীমের উদ্দেশ্যে। আমাদের কিছুদূর এগিয়ে দিতে রিয়াদ-কাছীম হাইওয়ে পর্যন্ত এলেন মধু ভাই। পথিমধ্যে বিখ্যাত কিং সঊদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন স‘ঊদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাহির থেকে দেখলাম। রিয়াদ শহর অতিক্রম করার পর বিপরীত দিক থেকে আবুল হোসাইন (ফরিদপুর) ভাই এলেন তার টয়োটা হাইলাক্স পিকআপ নিয়ে। গাড়িটা দেখে ছোটবেলার স্বপ্নের মনে পড়ল। প্রথম যখন রাস্তায় এমন গাড়ি দেখি, তখন মনে হয়েছিল, যদি এমন গাড়ি আমার থাকত, তাহ’লে তা নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরতাম। আসলেই এমন এমপিভি (মাল্টি পারপাস) গাড়ি সব কাজের কাজী।
আমরা রওয়ানা হয়ে অর্ধেক পথ যাওয়ার পর পৌঁছাই ছোট্ট সবুজে ঘেরা আল-মাজমা‘আহ শহরে। মূলতঃ ইসলামী সেন্টারটি পরিদর্শনের জন্য শহরে ঢুকলাম। এখানে কিছুদিন পূর্বে দাঈ হিসাবে কর্মরত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ দাঈ এবং লেখক শায়খ আব্দুল হামীদ ফায়যী। তবে বর্তমানে তিনি দেশে ফিরে গেছেন। তাঁর জামাই শায়খ মনীরুল ইসলাম বর্তমানে এখানে কর্তব্যরত আছেন। আমাদের দেখামাত্র চিনে ফেললেন এবং যথেষ্ট সমাদর-আপ্যায়ন করলেন। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা বের হ’লাম। শহরের মধ্যেই এক সাধারণ সুদানী হোটেলে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি হ’ল। সেখানে ফুল সুদানী, চিকন করে কাটা কলিজা ভুনা এবং মিক্স ডালের সাথে সুদানী লম্বা রুটি দিয়ে এত অসাধারণ আপ্যায়ন করা হ’ল, যার স্বাদ এখনও যেন মুখে লেগে আছে। পাঁচ জন মিলে ভরপেটে খাওয়ার পরও মাত্র ৩৫ রিয়াল বিল আসল। পরে মক্কা-মদীনাতেও সুদানী হোটেল খুঁজেছি সেই স্বাদের লোভে। খুঁজে পাইনি।
আল-ক্বাছীমের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আল-গাত্ব নামক এক লাল বালুকাময় পাহাড়ী মরুভূমিতে যাত্রাবিরতি করা হ’ল। মধ্যদুপুরে প্রখর রৌদ্রমাঝে এমন লালসমুদ্র যেন চোখ ঝলসাতে লাগল। সুবহানাল্লাহ। প্রায় ৫ ঘন্টা সফরের পর বেলা দেড়টার দিকে আমরা আল-ক্বাছীমের আল-খাবরা শহরে প্রবেশ করলাম। সঊদী আরব ‘আন্দোলন’-এর সহ-সভাপতি শায়খ হাফেয আখতার মাদানী আমাদেরকে তাঁর বাসায় অভ্যর্থনা জানালেন। সেখানে বিরাট মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন নিয়ে অপেক্ষমান ছিলেন আল-ক্বাছীমের প্রিয় দ্বীনী ভাইয়েরা। [ক্রমশঃ]