মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৩য় কিস্তি)

পর্ব ১ । পর্ব ২ ।


ইত্তিহাদের মধ্যম গোছের ফ্লাইটটি শ’দেড়েক যাত্রী নিয়ে আরব উপসাগরের উপর দিয়ে ধীরলয়ে উড়ে চলে গন্তব্যের পথে। অধিকাংশই ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশী গতর খাটা মানুষ। কত স্বপ্ন, কত সংকল্প নিয়ে মানুষগুলোর এই অভিযাত্রা। তবে তাতে উচ্ছাসের ছোয়া নেই। বরং তাদের বিষণ্ণ, বিরস, ভাবলেশহীন বদনের আবডালে যেন লুকিয়ে আছে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে আসার অস্ফূট বেদনা। তাদের চেহারা দেখি আর ভাবি আমাদের জীবনটা যেন এক রহস্যময় মায়াজাল ভরা সমুদ্র। সেই মায়াজালে ডুবে গিয়ে আলগোছে কত অপ্রয়োজনকে যে আমরা প্রয়োজন বানিয়ে ফেলি, কত অন্যায়কে ন্যায় বানিয়ে ফেলি, কত ভুলকে শুদ্ধে রূপান্তরিত করি, কত মজবুত বন্ধনকে নিমিষে ছিন্ন করে ফেলি, তার খোঁজ-খবর কে রাখে!

দুবাই সফরকালে আমাদের সফরপতি মহোদয় জনাব ড. সাখাওয়াত হোসাইন এক কেতাদুরস্ত সাইজের লাগেজ ব্যাগ নিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ব্র্যান্ডের বেশ আদিকালের। দাম্মামের পথে ইত্তিহাদের ফ্লাইটে হ্যান্ড ক্যারি ছাড়া বাড়তি লাগেজ নিলে কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া গুণতে হবে। তাই তিনি আপাতত কারো যিম্মায় রেখে ব্যাগটি দেশে পাঠাতে চাইলেন। আমি এবং ‘যুবসংঘ’ সভাপতি মুহতারামকে বোঝানোর কোশেশ করলাম, ব্যাগটা দেশে ফেরত পাঠাতে যে খরচ ও ঝামেলা পোহাতে হবে, তার চেয়ে কাউকে হাদিয়া দেয়াই ভাল। কিন্তু না! ঐ যে মায়া বলে কথা। সম্পাদক ছাহেব কিছুতেই ব্যাগটি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ‘মায়া’ নামক অদৃশ্য পিছুটানের কাছে হার মানলেন। কয়েক হাত বদল করে ব্যাগটি দেশে পাঠানোর ঝামেলা এবং এতে সম্ভাব্য ব্যাগের ক্রয়মূল্যের দ্বিগুণ খরচ- কোনটাই তাকে নিবৃত্ত করতে পারল না। সত্যিই এ মায়ার জগৎ এমনই রহস্যময়, যার কোমল অথচ প্রবল হাতছানি আর অলংঘনীয় পিছুটান আমাদেরকে কোন এক অদ্ভূত ঘোরে তাড়িয়ে ফেরে।

আমাদের ফ্লাইট আরব উপসাগর পেরিয়ে দাম্মামের আকাশে পৌঁছায়। আসমান থেকে বিশাল উন্মুক্ত ধুধু মরুভূমির বুকে ধুসর ছোট্ট দাম্মাম শহরের দৃশ্য বিশেষ সাড়া জাগায় না। বিশুষ্ক খাঁ খাঁ বাদামী বরণ ময়দান উল্টো বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করে দেয়। মনে হয় এ শহরে অপেক্ষা করছে এক ঘাম ঝরানো ভীষণ তপ্ত দুপুর, যেখানে খেজুর গাছের ছায়ায় দুদন্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত পথিকরা উন্মুখ অপেক্ষমান।

বেলা পৌনে দশটায় দাম্মাম কিং ফাহাদ এয়ারপোর্টে আমাদের ফ্লাইট অবতরণ করে। বেশ পুরোনো এবং নিরিবিলি বিমানবন্দর। মূল শহর থেকে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরে। তেমন জনসমাগম নেই বললেই চলে। প্রায় নির্বিঘ্নে আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেরিয়ে এলাম। যদিও ইমিগ্রেশন অতিক্রম করার পর একজন সিকিউরিটির লোক সম্পাদক মহোদয় এবং যুবসংঘ সভাপতিকে অনাকাংখিত প্রশ্নবাণে বিব্রত করার চেষ্টা করলেন। শেষাবধি এটাও প্রশ্ন ছিল যে, আপনারা শুদ্ধ আরবীতে কথা বলছেন কিভাবে? যেন এটাও অপরাধ। আজীব!

এয়ারপোর্টে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন দাম্মাম শাখা ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীল মুন্না ভাই (কুমিল্লা) ও জামাল গাযী ভাই (চাঁদপুর)। আবহাওয়া বেশ চমৎকার। শীতের পর গ্রীষ্মের শুরু এখন। মরুভূমির গা জ্বলা গরম অনুপস্থিত। গাড়ি চলা শুরু করল দাম্মাম শহরের উদ্দেশ্যে। শুক্রবার আজ। জুম‘আ ধরার জন্য মুন্না ভাই গাড়ি টেনে চালাচ্ছেন। প্রায় আধাঘন্টা পর পুরোনো শহরের প্রাণকেন্দ্র সিকো মার্কেট এলাকায় আমরা পৌঁছালাম এবং ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল বাশার ভাইয়ের বাসায় হালকা চা-নাশতা সেরে জুম‘আর জন্য প্রস্ত্তত হয়ে নিলাম। অতঃপর দাম্মাম পাসপোর্ট অফিসের পার্শ্বস্থ রাইয়ান মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করলাম। দাম্মাম শহরে প্রবেশের পর প্রথম বিস্ময়মাখা অনুভূতি ছিল- এটাই দাম্মাম! সিকো মার্কেট এলাকাটি মনে হয়েছিল বেশ পুরোনো ও অনুন্নত শহরের অংশ। তবে পরবর্তীতে সে ধারণা পরিবর্তন হয়ে যায়। সে কথায় পরে আসছি। মসজিদে কয়েকজন দ্বীনী ভাইয়ের সাথে দেখা হ’ল। পরে সবাই একত্রিত হলাম দাম্মাম শাখা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি জনাব আব্দুল্লাহ আল-মামূন ভাইয়ের বাসায়। এখানে দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। তার আগে সংক্ষিপ্ত ও প্রাণবন্ত আলোচনা বৈঠক হ’ল দাম্মাম শাখা ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীল ও কর্মীদের সাথে। তাদের চোখেমুখে আলোর দীপ্তি আমাদেরকে সত্যিই আলোড়িত করল। বিদেশ-বিঁভুইয়ে এসে কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে তারা যেভাবে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন, তা একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ।

দুপুরের খাবার সেরে আমরা দ্রুত রওয়ানা দিলাম সুপ্রসিদ্ধ দাম্মাম ইসলামিক সেন্টারের উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রাণপ্রিয় শায়খ মতীউর রহমান মাদানী বাদ জুম‘আ দারসের পর সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা কনফারেন্স রুমে বসার পরপরই শায়খ চলে আসলেন। প্রথম সাক্ষাৎ তাঁর সাথে। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে সাক্ষাৎপর্বটি হ’ল। শায়খ প্রথমেই আফসোস করলেন এজন্য যে, বিশেষ কিছু অভ্যন্তরীণ কারণে আমাদের প্রতিনিধি দলটির জন্য সেন্টারের নিয়মিত প্রোগ্রামে কোন সময় বরাদ্দ দিতে পারেননি। আববার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আন্তুরিকতার অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। নানা বিষয়ে তাঁর সাথে আলাপচারিতা হ’ল। শায়খের একটা বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করল। সেটা হ’ল- তার একধরণের সরলতা। ভিডিওতে তাঁকে বলার ভঙ্গিতে বেশ রাশভারী আবার কখনও বেশ কঠোর মনে হয়। কিন্তু সাধারণ বাক্যালাপে সেটা একেবারেই নেই। বরং মুর্শিদাবাদী সাদাসিধে হাসিতে তাকে আর দশজন আটপৌরে আলাপী মানুষের মতই মনে হয়েছে, যিনি সাথী-বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে পসন্দ করেন। শায়খের শরীরও খুব হালকা-পাতলা, যা এই বয়সে প্রায় বিরল।

আছরের ছালাতের পূর্বেই আমাদেরকে আল-খাফযীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। সেখানে বাদ মাগরিব অনুষ্ঠান। ফলে শায়খের কাছ থেকে আমাদের দ্রুত বিদায় নিতে হ’ল। আছরের পূর্বে আমরা খাফজীর পথে রওয়ানা দিলাম। সাথী হলেন জামাল গাযী ভাইসহ দাম্মাম শাখার বেশ কয়েকজন ভাই।

দাম্মাম থেকে উত্তরমুখে আল-খাফজীর দূরত্ব প্রায় তিন শত কি.মি.। চমৎকার সুমসৃণ রাস্তা ধরে গাড়ি তীরের গতিতে এগিয়ে চলে। একইসাথে চলতে থাকে দ্বীনী ভাইদের সাথে নানা বিষয়ে প্রশ্নোত্তর ও আলাপচারিতা। সন্ধ্যার পূর্বে মরুভূমির কোন স্থানে গাড়ি দাঁড়ায়। ধুধু বিরান সমতলভূমি সোজা আকাশ ছুঁয়েছে। কোথাও গাছপালা বা পাহাড়ের অস্তিত্ব নেই। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে সঊদী আরবে। ফলে বালুর মধ্যে সবুজ লতা-গুল্ম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কোথাও তো নিচু স্থানে পুকুরের মতই পানি জমে আছে। সহযাত্রীরা জানালেন এ পথে এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য সচরাচর হয় না।

মাত্র তিন ঘন্টার মধ্যে আমরা খাফজী পৌঁছে যাই। এশার ছালাতের পর আমাদের বক্তব্য। সেই ফাঁকে খাফজী আন্দোলনের উপদেষ্টা তোফায্যল হোসাইন (কুমিল্লা) ভাইয়ের বাসা কাম খাফজী ছানাইয়া শাখা ‘আন্দোলন’ অফিসে পৌঁছে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর সোজাসুজি অনুষ্ঠানস্থল তথা আল-খাফজী ইসলামিক সেন্টারের সম্মেলনকক্ষে পৌঁছে যাই। এই সেন্টারে বাঙালী দাঈ হিসাবে কর্মরত আছেন আমাদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও ‘আন্দোলন’ সঊদীআরব শাখার সাবেক সভাপতি প্রয়াত শায়খ আবুল কালাম মাদানী ভাইয়ের ছেলে প্রিয় ভাতিজা আব্দুল্লাহ ফারূক মাদানী। প্রাণবন্ত এই অনুষ্ঠানে প্রায় ৩ শতাধিক দায়িত্বশীল, কর্মী ও সুধী অংশগ্রহণ করেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে এত সুন্দর আয়োজন ছিল আমাদের ধারণাতীত। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন। অনুষ্ঠান শেষে খাবারের আয়োজনে অংশগ্রহণের পর আমরা বের হয়ে এলাম। দ্বীনী ভাইদের সাথে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে কুশল বিনিময় হ’ল। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর ভাতিজা আব্দুল্লাহ ফারূক আমাদেরকে নিয়ে গেল সমুদ্র তীরে। কুয়েত বর্ডারের কাছেই অবস্থিত এই শহর থেকে দূর সমুদ্রে কুয়েতের কিছু দৃশ্যপট দেখা যায়। আমরা ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে সাগরতীরে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তোফায্যল ভাইয়ের বাসায় ফিরে আসি এবং সেখানেই রাত্রিযাপন করি।

পরদিন ১৭ই মার্চ ২০২৩ সকালে রুটি ও গোশত দিয়ে সুস্বাদু নাশতার পর তোফায্যল ভাই দুপুরের রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তোফায্যল ভাই একজন নিখাদ আন্দোলন অন্তঃপ্রাণ মানুষ। সঊদী আরবে আন্দোলনের প্রথম সারির মুখলিছ কর্মীদের একজন তিনি। বহু টাকা খরচ করে প্রায় একক প্রচেষ্টায় কুমিল্লার মুরাদনগরে তিনি গড়ে তুলেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসা। নিজের আয়-রোযগারের বেশির ভাগই তিনি ব্যয় করেন আন্দোলন এবং মাদরাসার জন্য। কয়েক বছর পূর্বে মারাত্মক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি সেই ধাক্কা থেকে ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন। এখনও পুরোপুরি সুস্থ না হ’লেও মনে-প্রাণে, কর্মে-আচরণে তিনি একজন পুরোদস্ত্তর সংগ্রামী কর্মী। আল্লাহ তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। আমীন!

বেলা ৯টার দিকে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের সাথে মতবিনিময় বৈঠক শুরু হ’ল শাখা কার্যালয়ে। তাদের সাথে পরিচয়পর্ব শেষে বিভিন্ন সাংগঠনিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ তাদের জাযবা এবং দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করল। আমাদের উপস্থিতিতে তারা এতটাই খুশী একটাই আফসোস তাদের এজন্য যে, জীবিকার পিছনে ছুটতে গিয়ে তারা দ্বীনের জন্য বিশেষ সময় বের করতে পারছেন না। এগারোটার দিকে সমুদ্র তীরে আরেকটি দাওয়াতী প্রোগ্রাম রয়েছে। আমরা সবাই মিলে সমুদ্র তীরে গেলাম। সেখানে পর্যটকদের বসার ছাউনীতে খাবারের আয়োজন। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্বীনী ভাইরা এসেছেন। তাদের সাথে কুশলপর্ব শেষে আমরা সী বীচে দাঁড়ালাম। নীল পারস্য উপসাগরকে বেষ্টন করে সাগরতীর পরিকল্পিতভাবে সাজানো। নিরবচ্ছিন্ন নিরব। আমরা ছাড়া কেউ নেই নির্জন বীচে। সুবহানাল্লাহ এত সুন্দর দৃশ্য! নীল সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় যেন মুক্তোদানা খেলা করছে। আমরা প্রাণভরে উপভোগ করি।

এই সেই খাফজী শহর, যার নাম সাংগঠনিক সূত্রে সবসময় শুনে আসছি। দেশে আমরা যাদেরকে খাফজীর কর্মী হিসাবে পেয়েছি, তাদের অধিকাংশকেই বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী পেয়েছি। তারা কর্মঠ, সচেতন এবং দায়িত্বশীল। ফলে খাফজী শহরের ব্যাপারে সুধারণা আগে থেকেই ছিল। আজ মধ্যপ্রাচ্যের নানা শহর-নগর পেরিয়ে এই ছোট্ট শহরে আমরা দাঁড়িয়ে! দূরের স্কাইলাইনে কুয়েতের দৃশ্যপট দেখে মনটা কেমন স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় পত্র-পত্রিকায় দেখা ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে সারি সারি আগুন জ্বলা তেলক্ষেত্রের লেলিহান অগ্নিশিখার দৃশ্যগুলো স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। আমার ছোট্ট মনে সেই দৃশ্যগুলো ভীষণ রেখাপাত করেছিল। লক্ষ লক্ষ গ্যালন তেল অকাতরে পোড়ার দৃশ্য দেখে এর খলনায়কদের প্রতি জন্ম নিয়েছিল ভীষণ ক্ষোভ। মানুষের প্রতি মানুষের প্রবল আক্রোশের চিত্র মুষড়ে দিয়েছিল কচি অন্তরকে।

আজ দাঁড়িয়ে আছি সেই সঊদী আরব-কুয়েত সীমান্তে অবস্থিত তেলসমৃদ্ধ খাফজী শহরে। ১৯৬০ সালে তেল আবিষ্কারের মাধ্যমেই মূলতঃ এই জনবিরল শহরের পরিচিতি ঘটে। এই তেলক্ষেত্রটির মজুত সঊদী আরব ও কুয়েতের নিরপেক্ষ এলাকায়।

ফলে উভয়দেশের মধ্যে ৫০ : ৫০ চুক্তির মাধ্যমে এই তেল বন্টিত হয়। ১৯৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকী সেনাবাহিনী এই শহর দখল করলে প্রবল যুদ্ধের মাধ্যমে দুই দিনেই তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়। তবে ইরাকী বাহিনীর ধ্বংসাত্মক হামলায় খাফজীর তেলকুপগুলোতে আগুন ধরে যায় এবং বহু সম্পদ বিনষ্ট হয়। 

আমাদের দ্বীনী ভাইরা বললেন, ছোট এই শহরটি একেবারেই নিরিবিলি। মানুষজন ঘরবাড়ি থেকে কমই বের হয়। এখানকার বাসিন্দাদের বড় অংশই মূলতঃ সঊদী তেল কোম্পানীগুলোতে চাকুরীরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবার। তাদের জীবন-জীবিকা এর উপরই নির্ভরশীল। সঊদী ‘আরামকো’ কোম্পানীর সুবিশাল অবকাঠামো ও ক্যাম্পাস রয়েছে এই শহরে।

আমরা তোফায্যল ভাইয়ের রান্না করা অসাধারণ ইন্ডিয়ান স্টাইল বিরিয়ানী খেয়ে উপস্থিত ভাইদের সাথে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করি। পরে তোফায্যল ভাই কয়েক কি.মি. দূরত্বে কুয়েত বর্ডারের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আমরা আবার অফিসে ফিরে আসি। আছরের আগে ও পরে মাগরির পর্যন্ত আবারো দায়িত্বশীল ভাইদের সাথে লম্বা বৈঠক হয় এবং প্রশিক্ষণমূলক আলোচনা হয়। সন্ধার পর আমরা খাফজী শহর পরির্দশনে বের হ’লাম এবং হালকা কেনাকাটা করলাম। মাঝে আব্দুল্লাহ ফারূক সী বীচে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে অত্যন্ত সুস্বাদু কুনাফা ও গাহওয়া খাওয়ালো। এশার পর অফিসে পুনরায় সংক্ষিপ্ত কর্মী বৈঠক সেরে রাতে বরিশাল বাকেরগঞ্জের শহীদুল ইসলাম ভাইয়ের বাসার দাওয়াত খেতে গেলাম। ফিরতে ফিরতে রাত ১টা বেজে গেল। তোফাযয্ল ভাইয়ের বাসাতেই আরো একটি সুন্দর রাত কাটলো।

পরদিন ১৮ই মার্চ ২০২৩ সকাল সাতটায় আমরা পুনরায় দাম্মামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। আব্দুল্লাহ ফারূক তার গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে চলল। পথিমধ্যে শিল্প শহর জুবাইলে আমরা যাত্রাবিরতি দিলাম। জুবাইলে সঊদী আরবের সবচেয়ে বড় জালিয়াত ও ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে বাংলা বিভাগে কর্মরত রয়েছেন শায়খ কাছেম বিন আববাস এবং শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী। তারা পরস্পরের আত্মীয়ও বটে। তাঁদের সাথে সেন্টারে দেখা হ’ল। তাঁরা আমাদেরকে সেন্টারের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখালেন। সেন্টারের ব্যবস্থাপনা মনোমুগ্ধকর এবং সাজানো-গোছানো। আইটি বিভাগটি খুবই সমৃদ্ধ, যেখানে প্রতিমুহূর্তে ডিসপ্লেতে দেখানো হচ্ছে এই সংস্থার মাধ্যমে কতজন ইসলাম গ্রহণ করছে। তাদের হিসাব মতে এ পর্যন্ত ৪৮টি দেশের প্রায় ৫০ হাযার মানুষ এখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে। প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ১ হাযার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। সবচেয়ে বেশী ইসলাম গ্রহণকারীরা হ’লেন ফিলিপাইনীরা।

জুবাইল ইসলামিক সেন্টার থেকে বের হেয় বেলা ১২টার দিকে আমরা আবার দাম্মামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম এবং যোহরের আগেই দাম্মাম শহরে পৌঁছলাম।

যোহর পড়লাম সিকো মার্কেট এলাকার কিং ফাহাদ মসজিদে। এটি দাম্মামের সবচেয়ে বড় মসজিদ। দুপুরের খাবার খেলাম মুন্সিগঞ্জের শহীদুল ইসলাম ভাইয়ের বাসায়। দাম্মামে উনার চশমার ব্যবসা। বেশ বড় দোকান নিয়ে উনি ব্যবসা সাজিয়েছেন। আমাদের সবাইকে জোর করে মূল্যবান ব্রান্ডের চশমা হাদিয়া দিলেন।

দুপুরে সংক্ষিপ্ত বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত হোটেলে গেলাম। আছরের পর আব্দুল্লাহ মুন্না ভাই এবং জামাল গাযী ভাই হোটেল রুমে আসলেন। আজ রাতে দাম্মাম কর্ণিশে একটি প্রোগ্রাম রয়েছে। তার আগে দাম্মাম শহর ও শহরতলী দেখার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। প্রথমেই মুন্না ভাই সঊদী-বাহরাইন বর্ডারের উদ্দেশ্যে নিয়ে চললেন। দাম্মাম থেকে বাহরাইন বর্ডারের দূরত্ব প্রায় ৫০ কি.মি.। একটি ২৫ কি.মি. দীর্ঘ ব্রীজ বা কজওয়ের মাধ্যমে বাহরাইন ও সঊদী আরব পরস্পর সংযুক্ত হয়েছে। আমরা যখন আল-খোবার থেকে টোল প্লাজা অতিক্রম করে ব্রীজে উঠলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল সুনীল সাগরের বুকে অর্ধবৃত্তাকার ব্রীজের এমন চোখ ধাঁধাঁনো সৌন্দর্য দেখে। মনুষ্য সৃষ্ট এই বিস্ময়কর কীর্তি ভীষণ দৃষ্টিসুখকর ঠেকে। সুবহানাল্লাহ! মুন্না ভাই গাড়ির ছাদ খুলে দিয়ে উন্মুক্ত বাতাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। সে মুহূর্তের অনুভূতি বলে বুঝানো কঠিন। ১৯৮৬ সালে এই ব্রীজটি নির্মিত হয়। বর্তমানে প্রতিদিন অন্ততঃ ৫০ হাযার যাত্রী বর্ডার অতিক্রম করে। সঊদী বা বাহরাইনী পাসপোর্ট বা ইকামাধারীদের কোন ভিসা প্রয়োজন হয় না।

ব্রীজের মধ্যস্থলে বেশ বড় দ্বীপের মত করে পর্যটনস্থল তৈরী করা হয়েছে, যেখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। আমরা বর্ডারের সামনে দাঁড়াই। প্রচুর গাড়ি অতিক্রম করছে উভয় দিক থেকে। বর্ডার পাস নিতে খুব কম সময়ই লাগছে। আমরা সাগরতীরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করি। বেশ কিছু সঊদী পরিবার এখানে ঘুরাঘুরি করছে। আমরা কফি শপে কফি পান করি। তারপর মাগরিবের আগ দিয়ে দাম্মামের পথে ফিরে আসি। দাম্মামে ঢুকে সাগরপাড়ের কর্ণিশ রোডে যখন আসলাম, তখনই দাম্মামের আসল সৌন্দর্য ও জাঁকজমক টের পেলাম। পুরোনো দাম্মামের বিপরীতে এই দাম্মাম এবং পার্শ্ববর্তী খোবার শহর সম্পূর্ণই ভিন্ন। পুরো সাগরপাড় ঘিরে বিরাট নতুন শহর গড়ে উঠেছে। মক্কা, জেদ্দা ও রিয়াদের পর সঊদী আরবের চতুর্থ বৃহত্তম শহর কেন দাম্মাম, তা আর বুঝতে বাকি রইল না। আমরা সালেম বিন লাদেন মসজিদে মাগরিবের ছালাত আদায় করে দাম্মাম কর্ণিশে অবস্থিত কৃত্রিম দ্বীপ মারজানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। এখানেই এশার ছালাতের পর উন্মুক্ত ময়দানে দাওয়াতী প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।

(ক্রমশঃ)  






আমীরে জামা‘আতের নেতৃত্বে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে শিক্ষা সফর - ড. নূরুল ইসলাম
বালাকোটের রণাঙ্গনে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
খাইবারের পাদদেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
কোয়েটার ঈদস্মৃতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চলে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মসজিদুল হারামে ওমরাহ ও ই‘তিকাফ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালাকোটের রণাঙ্গণে (আগষ্ট সংখ্যার পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.