সঊদী আরবের বিভিন্ন শহরে অবস্থানরত অসংখ্য দ্বীনী ভাই প্রতিনিয়তই নওদাপাড়া মারকাযে আসেন। তাদের প্রবাস জীবন, দাওয়াতী কাজের হাল-হাকীকত বর্ণনা করেন। কখনও দাওয়াত দেন নিজ নিজ শহরে-কর্মস্থলে। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর প্রবাসী সংগঠনের সুপ্রিয় দায়িত্বশীলগণও প্রায়শঃই দাওয়াত দিয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে সঊদী সরকার ওমরা ভিসা উন্মুক্ত করে দেয়ায় মক্কা-মদীনা ভিন্ন অন্যান্য শহরগুলো সফরের দুয়ার অবারিত হয়ে যায়। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ও আকাংখার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সঊদী আরব সফরের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক প্রতিনিধি দল নির্বাচন করা হয়। তবে কারণবশতঃ সফরের সময়ে একটু হেরফের করা হয় এবং বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা ২০২৩-এর পর সফরসূচী নির্ধারণ করা হয়। সেই সাথে গন্তব্যে যুক্ত হয় আরো একটি রাষ্ট্র। সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভিসা ও টিকেট সংক্রান্ত বিষয়াদি সামাল দিলেন আমাদের আইটি বিভাগের বিশ্বস্ত দায়িত্বশীল মুজাহিদ ভাই, যিনি এই সফরে আমাদের একজন সফরসঙ্গীও বটে। দুবাইয়ে বর্তমানে তার নিয়মিত যাতায়াত। আমাদের যাত্রার সপ্তাহখানেক পূর্বেই তিনি দুবাই পৌঁছে গেলেন।
১৩ই মার্চ ২০২৩ রাত সাড়ে নয়টায় শুরু হ’ল আমাদের ইলমী ও দ্বীনী সফর। রাত সাড়ে ৯টায় ফ্লাই দুবাইয়ের একটি বিমানে করে আমরা ঢাকা থেকে রওয়ানা হ’লাম। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মাসিক আত-তাহরীক সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি শরীফুল ইসলাম মাদানী এবং আমি। ঘটনার পিছনে লুকিয়ে থাকে হাযারো ঘটনা। সংক্ষেপণের জন্য সেসবের বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। তবে একটু বলতে হয় যে, প্রথমবার যারা দুবাই সফরের যান, তাদেরকে বাংলাদেশী ইমিগ্রেশন পার হ’তে বেশ হেনস্থা হ’তে হয়। অকারণ প্যাঁচে ফেলে ও নানা প্রশ্নের মুখে ফেলে বিব্রত করা হয়। কেননা অপরাধচক্রের লোকজন দুবাইকে হামেশা ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে। আমরাও বোধহয় সেই ফাঁদে আটকা পড়লাম। বিশেষ ডেস্কে বেশ কিছুক্ষণ বিব্রতকর অপেক্ষার পর উর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার এসে আমাদেরকে দেখে কিছু জিজ্ঞেস না করেই পাসপোর্টে সাইন করে দিলেন। অধঃস্তন অফিসার তাতে সন্তুষ্ট না হ’লেও কিছু বলতে পারলেন না। আমরা একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এমন ভদ্র অফিসারও দায়িত্ব পালন করেন ইমিগ্রেশনে!
দীর্ঘ প্রায় ছয় ঘন্টা যাত্রার পর স্থানীয় সময় রাত দেড়টার দিকে দুবাই এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-২ -এ নামলাম। এটাই দুবাই এয়ারপোর্ট! টার্মিনালের নাজুক অবস্থা দেখে বেশ অবাক হ’লাম। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে এত লম্বা লাইন! কয়েকটি কাউন্টার বাদে অধিকাংশ কাউন্টার বন্ধ। দায়িত্বরত অফিসারদের মধ্যে খানিকটা গাছাড়া ভাব! এমনকি আমাদের তিনজনের ব্যাগও পাওয়া গেল তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইটের বেল্টে। বস্ত্তবাদী সভ্যতার শীর্ষচূড়ায় থাকা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জাকজমকপূর্ণ শহরটিতে প্রবেশের পূর্বে এমন খাঁপছাড়া অভিজ্ঞতা বেশ বেমানান ঠেকে।
বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষমান ছিলেন দুবাইপ্রবাসী কক্সবাজারের রূহুল আমীন এবং মহিউদ্দীন ভাই। উপস্থিত ছিলেন অপর ভাই মুনীরুল ইসলামও, তবে এয়ারপোর্টে তাঁর সাথে দেখা হয়নি। বাইরে বের হয়ে আমরা এলাম কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে দুবাইয়ের বাঙ্গালী অধ্যুষিত ‘দেরা’ এলাকায়। এখানকার বাংলা সাইনবোর্ড আর বাংলা ভাষাভাষীদের জয়জয়কার দেখে মনে হবে না যে ভিন্ন কোন দেশে এলাম। দেরা মূলতঃ দুবাইয়ের ঐতিহ্যবাহী পুরনো শহর। দুবাই ক্রীক খালের পূর্ব অংশে অবস্থিত এই দেরা এলাকাটি আধুনিক দুবাইয়ের আবির্ভাবের পূর্বে মাছ ধরা ও মুক্তা চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনও এটি মাছ, স্বর্ণ ও মসলার বাজারের জন্য সুপরিচিত।
একটু পর মুনীরুল ইসলাম ভাই এসে যোগ দিলে আমরা এক বাঙালী হোটেলে রাতের খাবার খেলাম। ফজর হ’তে খুব বাকী নেই। রূহুল ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা মুনীর ভাইয়ের সাথে জেএলটি বা জুমেইরাহ লেক টাওয়ার্সের দিকে রওয়ানা দিলাম। সেখানেই আমাদের সাময়িক নিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে। দুবাই ক্রীক খাল পার হয়ে শেখ যায়েদ রোড ধরে শহরের পশ্চিমের দিকে এগুতেই দুবাইয়ের আসল চেহারা দৃশ্যমান হ’তে লাগল। আকাশচুম্বী টাওয়ারে ভরপুর রাতের আলো ঝলমলে দুবাইয়ের দৃশ্যপট একে একে হাযির হতে থাকে। দুবাই ফ্রেম, মিউজিয়াম অফ দ্যা ফিউচার অতিক্রম করে দূর থেকে নযরে আসল বুর্জ আল-খলীফা, বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। ১৬৩ তলা বিশিষ্ট ভবনটি উচ্চতা সাড়ে আটশ মিটার অর্থাৎ প্রায় এক কিলোমিটার। ধাপে ধাপে কলমের নীবের মত চিকন হয়ে ছুঁয়েছে আকাশ। ২০১০ সালে উদ্বোধন হওয়া মনুষ্য সৃষ্ট এই বিস্ময় বিশ্ববাসীর কাছে দুবাইকে আলাদাভাবে চিনিয়েছে। চতুর্দিকে শত শত নানা ধরণ ও বরণের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের ভবনগুলো দেখলে একটা কথাই মনে হবে- ‘টাওয়ারের শহর দুবাই’। এই শহরে এত বেশী বিখ্যাত জিনিসের উপস্থিতি যে, ‘বিখ্যাত’ শব্দটাকেই বাহুল্য মনে হবে।
মুনীর ভাই মুত্তাকী-পরহেযগার, সজ্জন মানুষ। কেমন আছেন দুবাইয়ে- জিজ্ঞেস করতেই গল্পের ঝাপি খুলে দেন। অনেকদিন হ’ল দুবাইয়ে আছেন। এখানকার বিলাসী জীবন তাকে মোটেও টানে না। ইউরোপীয়দের অবাধ সয়লাব দুবাইয়ে। সেটা এতটাই যে, কখনও মনে হয় এটা কোন ইউরোপীয় শহর। পশ্চিমা নারীদের খুল্লামখুল্লা বিচরণে নিজের ঈমান-আমল ধরে রেখে অফিস করা বা চালানো যে কতটা কঠিন যুদ্ধের শামিল, তার বিবরণ দিলেন। শাসকরা ইসলামী সংস্কৃতি ধরে রাখার নানা চেষ্টা বজায় রাখলেও পর্যটন আর বিনোদনের যে বৈশ্বিক পসরা সাজিয়েছেন এবং বিদেশীদের আকর্ষণের জন্য হাজারো প্রলুব্ধকর সুযোগ-সুবিধা রেখেছেন, তাতে নর্দমার উপচেপড়া স্রোতের মত বিজাতীয় সংস্কৃতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে একসময়ের এক রক্ষণশীল ঐতিহ্যবাহী মুসলিম দেশটিতে। যেখান থেকে বাঁচার পথ দিনে দিনে যেন প্রায় রুদ্ধ হয়ে উঠছে।
প্রায় আধাঘন্টা পর আমরা পৌঁছলাম জেএলটির ক্লাস্টার-পিতে অবস্থিত আরমাদা টাওয়ার-১ য়ে। বুর্জ খলীফা থেকে প্রায় ১৫/২০ কি. মি. দূরত্বে এই জেএলটি দুবাইয়ের অন্যতম অভিজাত এরিয়া। তিনটি কৃত্রিম লেক দিয়ে ঘেরা এই এলাকা বর্ধিত দুবাইয়ের সুপরিকল্পিত বিলাসবহুল আবাসিক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল। দুবাইকে যদি টাওয়ারের শহর বলা হয়, তবে এই এলাকাটিকে টাওয়ারের কেন্দ্রবিন্দু বলা যায়, যেখানে এক প্রজেক্টেই ৩৫ থেকে ৬৬ তলা বিশিষ্ট ৮০টি টাওয়ার রয়েছে। আমরা আরমাদা টাওয়ার-১ এর ২৭ তলায় এক পরিচিত ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। দুই রুম আর এক কিচেনের ছোট ফ্লাট। সন্তানের জন্য কিনেছেন। তবে কেউ সাধারণতঃ থাকে না। রাত তখনও ফুরোয়নি। বাসার পূর্ব দিকে সুপরিসর উন্মুক্ত ব্যালকনি। সেখানে বসে সময় কাটানোর জন্য চেয়ার, টেবিল রাখা। আমরা আনন্দে আটখানা হই। ২৭ তলা উঁচু থেকে দুবাই শহরটা এত অদ্ভূত স্বপ্নপুরীর মত মনে হয়! যেন অন্য কোন গ্রহ! সুবহানাল্লাহ!
দৃষ্টি ফেরাতে পারি না। পুঁজিপতিদের স্বর্গে বসে সূরা আলে ইমরানের ১৪নং আয়াতটি একসময় আনমনে স্মরণ হয়- ‘মানুষের নিকট সুশোভিত করা হয়েছে নারী, সন্তান-সন্ততি, ধনভান্ডার, বিশেষ ঘোড়া (বাহন), প্রাণী ও ক্ষেতখামারের প্রতি মুগ্ধতা। এসব দুনিয়াবী জীবনের ভোগ্যবস্ত্ত মাত্র। আর আল্লাহ- তাঁর কাছেই রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল’।
মুনীর ভাই আমাদের রেখে চলে গেলেন। আমরা ফজর পড়ে ঘুমাতে গেলাম। সকাল দশটার দিকে পার্শ্ববর্তী ক্যারিফোর শপ থেকে পাউরুটি, বিস্কুট কিনে নাশতা সেরে নিলাম। ১১টার দিকে আসলেন মুর্শিদাবাদের ছফিউর রহমান ভাই। মতীউর রহমান মাদানীর আত্মীয়। আগেই তার সম্পর্কে খবর পেয়েছিলাম। মধ্যবয়সী, স্বাস্থ্যবান মানুষটি খুব রসিক। দু’চার কথাতেই তিনি আমাদের বড় আপনজন হয়ে উঠলেন। তিনি নিজে ও তার স্ত্রীসহ পরিবারের সবাই কুরআনের হাফেয। তিনি জানান, তার এক মামা একসময় সন্ত্রাসী ছিলেন। এলাকার লোকজন তাকে একনামে চিনত অপরাধকর্মের জন্য। একসময় আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি দ্বীনের পথে ফিরে আসেন এবং তার পরিবারে দ্বীনের তা‘লীম শুরু করেন। তার মাধ্যমেই গোটা পরিবারে বর্তমানে প্রায় জনা ত্রিশেক সদস্য হাফেয হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!
ছফিউর রহমান ভাইয়ের সাথে আমরা নিচে নেমে আসলাম দুবাই শহর দেখার জন্য। মাশাআল্লাহ তিনি দেখি বিখ্যাত টেসলার ধুসর কালো এক্স মডেলের কার নিয়ে হাজির। বৈদ্যুতিক এই গাড়ি চার্জে চলে। একবার চার্জ দিলে প্রায় সাড়ে চারশত কি.মি. চলে। শব্দহীন কারটি মাত্র তিন সেকেন্ডেই ১৫০ কি.মি. গতিবেগ ওঠাতে পারে। জ্বালানী তেলের বিকল্প হিসাবে আগামী প্রজন্মের এই গাড়ি সারা বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছে। দুবাইয়ের রাস্তায় এই গাড়ির যথেষ্ট আনাগোনা দেখা গেল।
প্রথমেই আমরা গেলাম দুবাই মেরিনাতে। সেখান থেকে সেই সুবিখ্যাত খেঁজুর গাছ আকৃতির পাম জুমেইরা আইল্যান্ডের সম্মুখভাবে এলাম। কৃত্রিম এই দ্বীপের মুখেই আইকনিক হোটেল আটলাণ্টিস দ্যা পাম। অপরদিকে পারস্য উপসাগরের তীর ঘেষে মেরিন ড্রাইভ রোড ও ওয়াকওয়ে। নীল সাগরের ঠান্ডা বাতাসে প্রাণ ভরে ওঠে। দূরে দেখা যায় দুবাইয়ের আরেক আইকনিক হোটেল ৫৬ তলা বিশিষ্ট বুর্জ আল-আরব। জাহাযের পালের আকৃতিতে তৈরী করা এই হোটেল বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল হোটেল। কিছুক্ষণ মেরিন ড্রাইভের পার্শ্বে সাগরপাড়ে সময় কাটিয়ে আমরা আবার আরমাদায় ফিরে আসি।
ইতোমধ্যে মুজাহিদ ভাইসহ দুবাই প্রবাসী ভাই রূহুল আমীন, মহিউদ্দীন এবং বশীর আহমাদ আমাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসলেন। সাথে নিয়ে এলেন আরবের জনপ্রিয় খাবার খাবছাসহ বিভিন্ন খাবার। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলাম। রাতে এশার ছালাতের পর দেরাতে একটি হোটেলে স্বল্প সময়ের নোটিশে দ্বীনী আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। সেই বৈঠক নিয়ে কিছু কথা হ’ল। দুবাইয়ে যে কোন ধর্মীয় প্রোগ্রাম করতে হ’লে ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেয়া লাগে। এর জন্য অবলম্বন করতে হয় দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা এখন মোটেই সম্ভব নয়। এজন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঘরোয়া আয়োজনে প্রোগ্রামটির ব্যবস্থা করেছেন দুবাইয়ের দ্বীনী ভাইরা।
আছর ছালাত পড়ে আমরা প্রোগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। রাস্তায় যথেষ্ট জ্যাম। সুপ্রশস্ত রাস্তায় শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। রাজধানী ঢাকার মত জ্যাম দুবাইয়ে দেখে মনটা বিরক্তির পরিবর্তে কেন যেন খুশী খুশী লাগে। হয়তো বিশ্বসেরা পুঁজিপতিদেরও আমাদের মত একই পরিণতি দেখে। নিজের মধ্যে সাম্যবাদীদের মত শ্রেণী সংগ্রামের উষ্মা টের পেয়ে নিজেই হাসলাম।
এবারে আমরা গেলাম দুবাই মেরিনার পার্শ্ববর্তী ব্লু ওয়াটার্স আইল্যান্ডে। এটিও একটি কৃত্তিম দ্বীপ যেটি ২০১৩ সালে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এখান থেকে পারস্য উপসাগর, পাম জুমেইরাহর দৃশ্য চমৎকারভাবে দেখা যায়। বহু পর্যটক এখানে স্কাই ডাইভিং করে, সাগরের খাড়িতে দ্রুতগতিতে ওয়াটার মটরসাইকেল চালিয়ে যায়, সী ক্রুজে বের হয়, সমুদ্র তীরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে। এই দ্বীপে রয়েছে ‘আইন দুবাই’ বা দুবাই চোখ হুইল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু হুইল বা আমাদের ভাষায় নাগরদোলা, যা উচ্চতায় প্রায় সাড়ে আট’শ ফুট। করোনার পর থেকে এটি অবশ্য বন্ধ রয়েছে। এখান থেকে দুবাই স্কাইলাইনের চোখ ধাঁধানো আধুনিক সভ্যতার কিছু অংশ দেখে সেখানে দাঁড়িয়েই আফসোসে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম- A modernity with cruel luxuries, insanity and obscenity অর্থাৎ এ এক নিষ্ঠুর বিলাসিতা, উন্মাদনা ও অশ্লীলতাময় সভ্যতা।
সেখান থেকে বের হয়ে আমরা দুবাই ডাউনটাউনের দিকে রওয়ানা হলাম। পথে জ্যাম আর জ্যাম। নামী-দামী ব্র্যান্ডের গাড়ির পসরা। অবশেষে সন্ধ্যার আগ দিয়ে দুবাই মল পৌঁছলাম। একই স্থানে আকাশছোঁয়া বুর্জ খলীফা। শেষ বিকেলের আলোর প্রতিফলনে ঝলমলে বুর্জ খলীফা। উদ্ধতভাবের চেয়ে তার কমনীয় ভঙ্গিটাই দৃষ্টি কাড়ে। আমরা রুদ্ধশ্বাসে মনুষ্য সৃষ্ট এই অপার বিস্ময়গাঁথা উপভোগ করি। সাথেই লাগোয়া দুবাই মল। এটিও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শপিং মল, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষ আগমন করে। মলে প্রবেশ করে বোঝার উপায় নেই এটা কোন আরব দেশ। এ যেন সম্পূর্ণই পশ্চিমা এবং বিদেশীদের অভয়ারণ্য।
স্থানীয় ইমারতীদের পোষাক দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু তাদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। বেশীক্ষণ থাকার উপায় নেই এই পাপময় পরিবেশে। বিনোদনের কী উপকরণ নেই সেখানে। ইনডোর ঝর্ণা, ফোয়ারা, এ্যাকুরিয়াম, বিরাটকায় ডাইনোসরের আসল ফসিল, আধুনিক ও প্রাচীন নানা ঐতিহ্যের ছোঁয়া সবমিলিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য। হাটতে হাটতে আমরা নীচ তলায় এক চোখ ধাঁধানো এক প্রকান্ড এ্যাকুরিয়াম ও আন্ডার ওয়াটার জু’র সামনে দাঁড়াই। হাঙ্গর, রে, ডলফিনসহ ৩০০ প্রজাতির নানা রং ও আকারের হাযারো সামুদ্রিক প্রাণীর সমাহার এখানে। বিমলানন্দে কী সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রাণীগুলো। কারো সাথে কারো ঝগড়া নেই। মনে হয় রঙ-বেরঙের কোরাল, শৈবালভরা সমুদ্র তলদেশে যেন সরাসরি বসে প্রাণীগুলোর বিচরণ দেখছি। অসাধারণ অভিজ্ঞতা, সুবহানাল্লাহ!
মাগরিবের ছালাতের পর আমরা উন্মুক্ত চত্বরে বের হলাম। সন্ধ্যার পর থেকে বুর্জ খলীফা সংলগ্ন কৃত্রিম লেকে ঝর্ণা ও লাইট শো শুরু হয়। ভীষণ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। কিন্তু মিউজিক আর আশেপাশের পাপময় পরিবেশ সেখানে আর দাঁড়াতে দেয় না। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে দেরা সিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। এশার ছালাতের পর একটি বাঙালী হোটেলে প্রোগ্রাম শুরু হ’ল। প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় আলোচনায় তারা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে অংশগ্রহণ করলেন। পরিশেষে রাতের খাবারের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটল। দ্বীনী ভাইদের এই মিলনমেলায় বলা যায় সারাদিনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটলো। তাদের আগ্রহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, আতিথেয়তায় আমরা খুবই প্রীত হলাম। আরব আমিরাতের বাঙালী আহলেহাদীছ কম্যুনিটির অন্যতম প্রাণ শারজাহর আকরাম হোসাইন (কিশোরগঞ্জ) ভাই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর ইখলাছ ও সাংগঠনিক দক্ষতা আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে। এছাড়া বশীর ভাই, রূহুল আমীন ভাই প্রমুখ অনুষ্ঠানটি সুন্দর করার জন্য সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছেন। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম জাযা দান করুন। আমীন!
রাতে রূহুল আমীন ভাই এবং মহিউদ্দীন ভাই আমাদেরকে আরমাদায় রেখে গেলেন। আমরা রাত্রি দ্বিপ্রহরে বারান্দায় বসে দুবাইয়ের রূপসুধা দেখতে থাকি আর ভাবনার জগতে হারিয়ে যাই। মনে হয় ভোগবিলাসী জীবন মানুষকে কী অকৃতজ্ঞভাবে তার রব থেকে দূরে ঠেলে দেয়! মানুষ যখন নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে, তখন তার স্বেচ্ছাচারী মন যা খুশী তাই করতে চায়। পাপাচার, সীমালংঘন তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়। ভুলে যায় সে তার অতীত, ভবিষ্যৎ; স্রষ্টা, সৃষ্টিজগৎ। বর্তমানের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে জীবনকে সর্বোচ্চমাত্রায় উপভোগই হয়ে ওঠে তার একান্ত কর্মসূচী। ফ্যান্টাসী কিংডমের মত সাময়িক কিছু আনন্দক্ষণই হয় তাদের জীবনের সম্বল। সেই রাজ্য থেকে বের হওয়ামাত্রই আবার সবকিছু হারিয়ে সর্বহারা হওয়া ছাড়া যে এই আত্মভোলাদের গত্যন্তর নেই, তা তারা জানে না।
এই ফিৎনার সমুদ্রে আবার ঈমানদার ভাইদেরকে দেখে মনে হয় চক্ষুশীতলকারী সবুজাভ দ্বীপের মত, যারা হাযারো পাপ ও অন্যায়ের হাতছানি থেকে নিজেদের সযত্নে হেফাযতে রাখার চেষ্টা করেন। যে কোন মূল্যে পাল ঠিক রেখে হালটা শক্ত করে ধরে ছিরাতুল মুস্তাকীমের পথ আঁকড়ে থাকার জন্য অবিরাম যুদ্ধ করেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর দুর্নিবার তাকীদ তাদেরকে পথ হারাতে দেয় না। আল্লাহর তাদের উপর রহম করুন। আমীন! আবার কিছু মানুষের কপট চেহারা যুগপৎ বিস্মিত ও আহত করে। অন্যের উপকার তো দূরের থাক, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মত নিকৃষ্ট কাজ করতেও তাদের এতটুকু বাধে না। অথচ এর পরিণাম সম্পর্কে তারা অজ্ঞ নয়। স্বেচ্ছাচারী আত্মভোলা পাপাচারী মানুষদের চেয়ে এদেরকে তখন ঢের হীনকর মনে হয়। অন্ততঃ তারা নিজ বিলাসব্যসনে মত্ত থাকলেও অন্যের ক্ষতি তো করছে না।
বিচিত্র পৃথিবীর এই কুচিত্র পটভূমিগুলো হঠাৎ মাথায় ঢুকে পড়ে বিনিদ্র রজনীর অনন্য ভালোলাগার মুহূর্তগুলো নিমিষে তিক্ত করে ফেলে। দুবাই নগরীর আকাশছোঁয়া টাওয়ারগুলো ছাপিয়ে দূরের বিরান ধুধু মরুভূমির অন্ধকার থেকে হাহাকার ধ্বনি এসে অন্তর্জগতকে বিবশ করে দেয়। সবকিছু থাকলেও কোনকিছু নেই- এরই নাম বোধহয় পৃথিবী। পৃথিবীকে জান্নাত তথা সর্বসুখের জায়গা বানানোর ব্যর্থ প্রতিযোগিতা তাই কখনও সফল হওয়ার নয়। জান্নাত ব্যতীত অন্য কিছু মুমিনের আসল ঠিকানাও হওয়ার নয়। সুখ-দুঃখের প্রান্তসীমায় গিয়েও যেন আমরা এই মহান সত্যটাকে ভুলে না যাই। মহান রবের প্রতি এই হোক আমাদের কায়মনো দো‘আ। আমীন!
রাত্রি গভীর হয়। বারান্দার অসহ্য সৌন্দর্য থেকে নিষ্কৃতি নিয়ে আমরা ঘরে ঢুকি। কাঁচ ঘেরা দেয়াল থেকে ভারী পর্দাটা সরিয়ে শেষরাতের তারাভরা আকাশ আর আলোকসজ্জিত শহর দেখতে দেখতে ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যাই.. আরেকটি সুন্দর ভোরের প্রত্যাশায়। [ক্রমশঃ]