২৮ শে জুলাই’১৪ সোমবার :

ঈদুল ফিতরের দিন। রাত সাড়ে তিনটায় ঘুম থেকে উঠলাম। আযানের আগেই বাসা থেকে বের না হ’লে মাসজিদুল হারামের ভিতরে বসে ঈদের ছালাত পড়া যাবে না। তাই দ্রুততার সাথে গোসল সেরে ৩টি খেজুর খেয়ে তৈরী হয়ে গেলাম। পার্শ্ববর্তী হোটেল থেকে এসে শায়খ আব্দুল বারী ও ইমরান ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলেন। রাস্তায় নেমে তো চক্ষু চড়কগাছ। লাখো মানুষের পদভারে প্রকম্পিত মক্কার অলি-গলি। হাটতে লাগলাম ভীড়ের সাথে সাথে। রাস্তার আইল্যান্ডে মানুষ জায়নামায নিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসে গেছে। ভীড় ঠেলে আগাতে আগাতে ৪.১০-য়ে আযান হয়ে গেল। তারপর হারামে পৌঁছানোর আগেই ফজরের ছালাত শুরু হয়ে গেল। অগত্যা খোলা রাস্তায় অন্যান্যদের সাথে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। ছালাত শেষে আবার চলতে শুরু করলাম। কা‘বার মূল চত্বর পরিপূর্ণ। একের পর এক গেট পার হচ্ছি। কিন্তু সকল গেট আটকে রাখা হয়েছে। বেশ অনেকটা পথ হাটার পর হারামের নির্মানাধীন সর্বশেষ বর্ধিত অংশে পৌঁছনোর পর গেট খোলা পেলাম। নবনির্মিত অংশের খোলা ময়দানে জায়গা খালি পেয়ে সেখানেই বসে পড়লাম। অতঃপর স্থানীয় সময় সকাল ৬.১০ মিনিটে ঈদের ছালাত শুরু হ’ল। এসি-র বাইরে পুরু কার্পেটে মোড়া সুন্দর আবহাওয়ায় ভিড়মুক্ত পরিবেশে ঈদের ছালাত আদায় করলাম। তাকবীরে তাহরীমা বাদে অতিরিক্ত সাত ও পাঁচ বারো তাকবীরে ছালাত শেষ হ’ল। এরপর খুৎবা শুরু হ’ল। হারামের প্রবীণ ইমাম শায়খ ছালেহ বিন হামীদ-এর খুৎবা সর্বাধুনিক মাইকের চমৎকার আওয়াযে এক ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করছিল। লাখো মানুষের পিন-পতন নীরবতার মধ্যে মাঝে মাঝে ইমামের সাথে সমবেত কণ্ঠে ঈদের তাকবীর ধ্বনি ধ্বনিত হয়ে উঠছিল, ‘আল্লাহু আকবার...ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ। আল্লাহু আকবার কাবীরা ওয়াল হামদু লিল্লাহি কাছীরা, ওয়া সুবহানাল্লাহে বুকরাতাওঁ ওয়া আছীলা...।’ অতঃপর ৬.৪৫-য়ে খুৎবা শেষ হ’ল।

খুৎবা শেষে আববু দূর থেকে ঢাকার মাদারটেকের জনাব সা‘দ আল-ফারূক ছাহেবকে দেখতে পেয়ে ইমরান ভাইকে পাঠিয়ে তাঁকে ডাকিয়ে আনলেন ও কুশল বিনিময় করলেন।  

অতঃপর আমরা পুরা হারাম এলাকা ঘুরে দেখতে বের হ’লাম। ছাফা-মারওয়া মূল পাহাড় ও অন্যান্য সব নিদর্শন দেখে ছাদের উপর উঠলাম। পুরা ছাদ কার্পেটে মোড়া। এখানেও নিয়মিত ছালাত হয়। ছাদ থেকে চারদিকের সারি সারি পাহাড় ও আকাশছোঁয়া অট্রালিকাগুলি সুন্দরভাবে দেখা যায়। ঘন্টাখানিক ঘোরার পর হারামের মূল মসজিদ পরিদর্শন শেষ হ’ল। তারপর গেলাম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাসগৃহ বলে পরিচিত ভবনটি দেখতে। এখন সেখানে লাইব্রেরী করা হয়েছে। বিদ‘আতীদের উপদ্রব ঠেকাতে বাহির থেকে কাঁচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া সহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অতঃপর প্রবেশ করলাম আবু জাহলের কথিত বাড়ীতে। যেখানে এখন বিশাল আকারের পাবলিক টয়লেট করা হয়েছে। অতঃপর জিন আটকানোর স্থানে। এখানে সরকারীভাবে লাগানো দীর্ঘ সাইনবোর্ডে লেখা محبس الجن।

তার পাশেই মূল ‘যমযম’ কূপ থেকে টেনে আনা যমযম পানি সংরক্ষণাগার। যেখান থেকে যমযম পানি সরবরাহ করা হয়। যমযমের এই সংরক্ষণাগারটি কা‘বা গৃহ থেকে বেশ দূরে। মক্কায় আগত মানুষ এখান থেকে ইচ্ছামত যেকোন পাত্রে পানি ভরে নিয়ে যেতে পারে। ছাফা পাহাড়ের শুরুতে যেখানে যমযম কূয়ার অবস্থান, সেখানে যাওয়ার পথ এখন বন্ধ। তবে বাইরে ট্যাপ লাগানো আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে পানি পান করা যায়। সামনে ছাতা দিয়ে ছায়া করা আছে। সেখানে গিয়ে রিয়াদ থেকে আগত একজন সঊদী শায়খকে পেয়ে গেলাম। উনাকে আববু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জিন আটকানোর স্থান’ বলে তো হাদীছে বা ইতিহাসে কিছু পাওয়া যায় না। তাহ’লে এটা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? প্রশ্ন শুনে উনি বিস্মিত হ’লেন। পরে আব্দুল বারী ভাইয়ের নিকট থেকে আববুর পরিচয় পেয়ে খুব খুশী হ’লেন। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী লিখছেন শুনে আরো আনন্দিত হ’লেন এবং যত বই প্রয়োজন সব দিবেন বলে ওয়াদা করলেন। এরপর দীর্ঘ আলাপ শুরু করলেন। যেন শেষ হতেই চায় না। কোনমতে আলাপ সংক্ষেপ করে বিদায় নিতে হ’ল। বিদায়ের সময় উনি আববুর হাত ধরে একটা সুন্দর কথা বললেন, মানুষকে ছহীহ ও যঈফ বিষয়ে সতর্ক করতে থাকুন। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

দীর্ঘ হাটাহাটিতে ক্লান্তি এসে ভর করল। তাই আর দেরী না করে ফিরতি পথ ধরলাম। হোটেলে এসে অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে এবার আমাদের নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সাম্প্রতিক সময়ে হারাম শরীফকে ঘিরে নির্মিত মক্কা রয়েল ক্লক টাওয়ারের মধ্যস্থ পাঁচ তারকা হোটেল মারওয়া রায়হানায় একটি কক্ষ আমাদের জন্য বুকিং দেওয়া হয়েছে মেযবানের পক্ষ থেকে। হারাম শরীফ থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে অবস্থিত ১৯৭২ ফুট উচ্চতা এবং ১২০ তলা বিশিষ্ট হোটেলটির মূল নাম আবরাজ আল-বাইত, যা বর্তমানে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ ভবন এবং সর্বোচ্চ হোটেল। ১৪ তলা মূল ভবনের উপর মোট ৭টি টাওয়ার নির্মিত হয়েছে। ৩০০০ হোটেল কক্ষ ও এপার্টমেন্ট বিশিষ্ট হোটেলটিতে একই সাথে ৬৫ হাযার মানুষ অবস্থান করতে পারে। মূল টাওয়ারের শীর্ষদেশে চতুর্মুখীভাবে স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ঘড়ি, যা ২০ কি.মি. দূর থেকেও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ঘড়ির নীচেই রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ ডেক। যেখান থেকে দেখা যায় গোটা মক্কা নগরী। সেখানে আরো রয়েছে চারতলাবিশিষ্ট মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ইসলামী জাদুঘর।

যাইহোক টাওয়ারের একই ফ্লোরে মেযবানের নিজস্ব এপার্টমেন্টে শহীদুল চাচা এদিন নিজ হাতে ঈদের বিশেষ খাবার তৈরী করে ডা. যাকির নায়েক, ড. ইদ্রীস যুবায়ের, ডা. আতাত সহ আমাদের মোট ৩৫ জনকে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন। তিন কক্ষ বিশিষ্ট এ এপার্টমেন্টের ডাইনিং-এর বিশাল জানালা দিয়ে হারাম শরীফ সহ পুরা মক্কা নগরীর দৃশ্য চমৎকারভাবে দেখা যায়। ইতিপূর্বে ছবিতে যা দেখেছি তা স্বচক্ষে দেখে অবাক-বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে রূমে গিয়ে সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার পর বাদ আছর সাঈদুল ইসলাম ভাইয়েরা আসলেন এবং আমরা একত্রে ঐতিহাসিক ত্বায়েফ নগরী পরিদর্শনের জন্য বের হলাম।

ত্বায়েফ যাত্রায় আমাদের সফরসঙ্গী হ’লেন শায়খ আব্দুল বারী। যিনি বিগত কয়েক বছর সেখানকার দাওয়াহ সেন্টারে কর্মরত ছিলেন এবং বর্তমানে রিয়াদে আছেন। আরো ছিলেন ইমরান হোসাইন ও সাঈদুল ইসলাম ভাই। অাঁকাবাঁকা আল-হাদা জিগজাগ রোড ধরে মক্কা থেকে ৯১ কি.মি. দূরে অবস্থিত ত্বায়েফ নগরী। সারাওয়াত পর্বতশ্রেণীর উপরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬,১৬৫ ফুট উঁচুতে অবস্থান এই নগরীর। উচ্চতার কারণে এখানে অধিকাংশ সময় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। সেকারণ এখানে বিপুল পরিমাণ ফলমূলসহ বিবিধ ফসলাদি উৎপন্ন হয়। শহরটি সঊদী আরবের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীও বটে। রওনা দেয়ার পর কিছুদূর যেতেই শুরু হ’ল আল-হাদা রোড। ৯৩টি চমৎকার বাঁক সমৃদ্ধ এবং ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ চমৎকার এই রোডটি নির্মাণ করেছে সঊদী আরবের সুপ্রসিদ্ধ নির্মাণ কোম্পানী বিন লাদেন গ্রুপ। দুই লেনের চওড়া রাস্তাটি পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। খুবই অাঁকাবাঁকা সড়ক। সামান্য অসতর্ক হ’লেই গাড়ি গভীর খাদে আছড়ে পড়বে। ড্রাইভার বলল, এ রাস্তায় মাঝে মাঝেই এক্সিডেন্ট হয়ে থাকে। আর এক্সিডেন্ট হ’লে গাড়ী বা যাত্রী কিছুই খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও আমাদের প্রবল আত্মবিশ্বাসী ড্রাইভার বড় বড় উঁচু বাঁক অতিক্রমের সময়ও গাড়ির গতি ১২০-এর নিচে নামাচ্ছিল না। পাথুরে পাহাড়গুলির তাপদগ্ধ নাঙ্গা দেহ এবং তার মধ্যবর্তী গভীর খাদগুলির ভীতিকর দৃশ্য বার বার অন্তরাত্নায় কাঁপুনি ধরাচ্ছিল। সাথে সাথে হৃদয়কন্দরে ভাসছিল রাসূল (ছাঃ)-এর তায়েফ গমনের সেই বেদনাময় স্মৃতি। ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য দেড় হাযার বছর পূর্বে জুন-জুলাইয়ের প্রচন্ড দাবদাহে রাসূল (ছাঃ) কেবল যায়েদ বিন হারেছাহকে সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটে এই দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল পথ কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন!

কিছু দূর অতিক্রম করার পর উপর থেকে নেমে আসা Rope-way বা ‘রজ্জু সড়ক’ দেখতে পেলাম। যার মাধ্যমে ৪ সিটের ঝুলন্ত বাসে করে মক্কা থেকে ত্বায়েফ যাতায়াত করা যায়। এজন্য ১ দিন আগেই টিকিট কেটে রাখতে হয়। পাহাড়ী পথে উপরে উঠতে উঠতে একসময় ত্বায়েফের মূল নগরীতে প্রবেশ করলাম। ঠান্ডা আবহাওয়া একটু আগে থেকেই টের পেতে শুরু করেছিলাম। ড্রাইভার এসি বন্ধ করে দিয়েছিল। চমৎকার আবহাওয়ায় গাড়ি থেকে নেমে দারুন প্রশান্তি লাগছিল। স্থানীয় মসজিদে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। মসজিদ থেকে আমাদের রিসিভ করলেন জনাব আব্দুল মজীদ (নোয়াখালী)। যিনি ৩৫ বছর যাবত সেখানে আছেন। আগে আত-তাহরীকের এজেন্ট ছিলেন। তিনি তাঁর গাড়ীতে করে ত্বায়েফ নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখালেন। যদিও সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় সবকিছু লাইটের আলোতেই দেখতে হচ্ছিল।

প্রথমে ক্বিছাছ মসজিদ দেখলাম। তারপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর বাড়ী ও কবরস্থান দেখালেন। এখানে তিনি ৬৮ হিজরীতে ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর পুরা বাড়ী ও কবরস্থান প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। যাতে বিদ‘আতীরা কোন সুযোগ নিতে না পারে। এমনকি সামনে কোন সাইনবোর্ডও নেই। কেবল তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে, যেমন অন্যান্য ছাহাবীর নামেও আছে। এছাড়া এর অদূরেই আছে বিখ্যাত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস মসজিদ, যেটি ৫৯২ হিজরীতে আববাসী খলীফা নাছের লে-দীনিল্লাহর শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। সেখানে ছালাত আদায়ের পর সামান্য দূরে অবস্থিত বিশাল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ইবনু আববাস কবরস্থান। যা সর্বদা বন্ধ থাকে। একটা মাইয়েত আসায় কবরস্থানে ঢোকার সুযোগ হ’ল। কিন্তু কোথাও কোন কবরের চিহ্ন নেই, কারো নাম লেখা নেই ছোট ছোট পাথর ছাড়া। বুঝলাম আসলে কবরপূজার কোন চিন্তাও যেন মাথায় না আসে সেজন্যই এ ব্যবস্থা। তারপর বিশালাকার বাদশাহ ফাহদ মসজিদ এবং আরো কয়েকটি স্থান পরিদর্শন শেষে একটি পাকিস্তানী হোটেলে সবাই একত্রে রাতের খাবার খেয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আসার সময় বেশ কিছু স্থানীয় প্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হ’ল। শহরের মধ্যে জমকালো ফলের মার্কেট দেখলাম। উপযোগী আবহাওয়ার কারণে এখানকার মাটিতে প্রচুর ফলমূল ও শাক-সবজি উৎপন্ন হয়। রওয়ানা হওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হ’ল। তারপর রওয়ানা হয়ে রাত ১-টায় মক্কা পৌঁছে গেলাম।

২৯শে জুলাই মঙ্গলবার :

ফজরের ছালাত শেষে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে হোটেলের বুফেতে জানা-অজানা নানা প্রকার খাবার দিয়ে সকালের নাশতা সেরে বেলা ১১-টায় জেদ্দার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।

দুপুরে জেদ্দা ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীলদের ব্যবস্থাপনায় সভাপতি সাঈদুল ইসলাম ভাইয়ের কক্ষে খাওয়া-দাওয়া করলাম। এখানেই আমরা প্রথমবারের মত উটের গোশত খেলাম। প্রবাসী দায়িত্বশীল ভাইদের নিজ হাতে রান্না করা খাবার মারওয়া হোটেলের দামী খাবারের চেয়ে বহুগুণ সুস্বাদু লাগছিল। খাওয়া শেষে শাখার দায়িত্বশীল ভাইদের উদ্দেশ্যে আববু দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করলেন। তারপর আমরা আবু তাহের ভাইয়ের গাড়িতে করে শহর পরিদর্শনে বের হ’লাম। প্রথমেই গেলাম আরব সাগরের পাড়ে। ঈদের পরের দিন। তাই হাযারো মানুষের ভীড়ে পরিপূর্ণ সাগর তীর। অকুল পাথারের সামনে দাঁড়িয়ে স্বভাবতই মনে একধরনের বিশালতার জন্ম হয়। দূরে বিশাল বিশাল মার্চেন্ট শীপ দেখা যাচ্ছে। তবে চারিদিকের চোখ ধাঁধাঁনো প্রাসাদোপম বিল্ডিং-হোটেল, পরিকল্পিত ওয়াক-ওয়ে এবং সৌন্দর্য বর্ধন কার্যক্রমের জন্য সাগরের মূল সৌন্দর্য যেন অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। সত্যিই কৃত্রিম সৌন্দর্য কখনোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নান্দনিকতার পাশে দাঁড়াতে পারে না।

সী-বীচ থেকে দেখা যায় ১৯৮৫ সালে উদ্বোধন হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফোয়ারা ১০২৪ ফুট উঁচু কিং ফাহদ ফাউণ্টেন। রাত্রির আকাশে যার রং-বেরংয়ের রূপ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। অতঃপর সমূদ্রের তীর ঘেঁষে নির্মিত একটি মসজিদে মাগরিবের ছালাত আদায় করে গেলাম তীরবর্তী মাছের বাজারে। নানা প্রজাতির ও নানা রংয়ের বিচিত্র সাইজের সব মাছ দেখে ‘থ’ বনে গেলাম। আমরা মাছের দেশের মানুষ হলেও সামুদ্রিক এসব মাছের সাথে আগে কখনো পরিচয় ঘটেনি।

ইতিমধ্যে এশার পর আববুর প্রোগ্রামের সময় ঘনিয়ে আসছে। রওয়ানা হলাম আসফান রোডের থ্রিসিসি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। রাতের আলোক ঝলমলে জেদ্দা নগরী দেখতে দেখতে একসময় পৌছে গেলাম আমাদের প্রোগ্রামস্থলে। তখন শায়খ আব্দুল বারী জামা‘আতী যিন্দেগীর উপর সুন্দর আলোচনা রাখছিলেন। কর্মী ও সূধীবৃন্দ ছাড়াও নওদাপাড়া মাদরাসায় আমার শিক্ষক এবং বর্তমানে সঊদী আরব প্রবাসী দাঈ শায়খ মুহসিন মাদানী (রাজশাহী) উপস্থিত ছিলেন। এশার ছালাত আদায়ের পর বক্তব্যের শুরুতে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক শায়খ আব্দুল্লাহ আল-বাক্বী (রংপুর) কেন জানি হঠাৎ আমার নাম ঘোষণা করে বসলেন। উনি জানতেন না যে মুখে জড়তার (মাম্বলিং) সমস্যার কারণে আমি কখনও জনসম্মুখে বক্তব্য দেইনি। কিন্তু ঘোষণা যেহেতু দিয়েই ফেলেছেন তাই দাঁড়াতেই হ’ল মাইকের সামনে। আববু বললেন, যাও! আল্লাহ সাহায্য করবেন। অতঃপর সালাম দিয়ে দু’এক কথা বলে বসে পড়লাম। জীবনের প্রথম মাইকের সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতাটা শেষ পর্যন্ত বিদেশের মাটিতেই হল। এরপর আববু বক্তব্য শুরু করলেন। ১ ঘণ্টার প্রাণবন্ত ভাষণের পর নতুন ভাইদের সাথে বিদায়ী সাক্ষাতের পালা। তাতে আরো ঘন্টাখানেক সময় চলে গেল। বহু নতুন ভাই পেলাম, যারা বিদেশের মাটিতে আহলেহাদীছ আন্দোলনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধভাবে দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশের সাথেই এই প্রথম সাক্ষাৎ। তাই পরিবেশটা একটু আবেগঘনই ছিল। আক্বীদা-আমলের ঐক্যের কারণে সবাইকে যেন খুব আপনজন মনে হচ্ছিল। তারপর প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে আমরা আসফান শাখার ভাইদের বাসায় নিজেদের হাতে রান্না খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হলাম। অতঃপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আববু বেলাল ভাইয়ের গাড়ীতে এবং আমরা আবু তাহের ভাইয়ের গাড়িতে করে আবার মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আসফান শাখার ভাইদের আন্তরিকতা, আতিথেয়তা, প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট সবই ছিল মুগ্ধ করার মত। বিদেশের মাটিতে এতো বেশী আপনজনকে একসাথে পাবো তা ভাবতেই পারিনি। সত্যিই এক ভিন্ন ধরনের সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম।

৩০শে জুলাই বুধবার :

হারামে ফজরের ছালাত আদায়ের পর বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। পরে হোটেলের লিফটে উঠতে গিয়ে আমাদের মেযবান মহোদয়কে দেখি একজন মেহমানকে সাথে নিয়ে আববুর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি হোটেল রুমে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে ওনাদের বসার ব্যবস্থা করলাম। জানতে পারলাম উনি ফিলিস্তীনের ‘বায়তুল আক্বছা’ জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম শায়খ আলী আল-আববাসী। আমাদের সাথে একই হোটেলে তিনি সে সময় অবস্থান করছিলেন। ফিলিস্তীনের গাযায় তখন ইসরাঈলী আগ্রাসন চলছিল। সে বিষয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে অনেক কিছু বললেন। মুসলিম বিশ্বের নিশ্চুপ অবস্থানের ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কথার ফাঁকে আববু আমাদের বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমায় আসার দাওয়াত দিলেন। উনি খুব আন্তরিকতার সাথে দাওয়াত কবুল করলেন এবং আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। বিদায়ের সময় আববু উনাকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ বইয়ের ইংরেজী অনুবাদটি উপহার দিলেন।

বাদ যোহর আমরা মক্কার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনে বের হলাম। এদিন অন্যান্য ভাইয়েরা ছাড়াও আমাদের সাথে যোগ দেন জেদ্দা ‘আন্দোলন’-এর প্রশিক্ষণ সম্পাদক নিযামুদ্দীন (সন্দ্বীপ) ও আবু তাহের ভাই (সোনারগাঁ)। জাবালে আবু কুবাইস, আরাফা, মুযদালিফা, মিনা, জামরা (কংকর নিক্ষেপের স্থান), নবনির্মিত বিশাল বিশাল রেল স্টেশন, মসজিদে নামিরাহ, তানঈমের মসজিদে আয়েশা সহ সবকিছু ঘুরে দেখলাম। আরাফা ও মিনায় লাখ লাখ এয়ারকুলারযুক্ত স্থায়ী তাঁবু বানানো দেখলাম। যদিও হজ্জের মওসুম না হওয়ায় সবকিছু খা খা করছে। বছরে মাত্র কয়েকটি দিন আল্লাহর মেহমানদের সেবার জন্য সঊদী সরকারের এত বিশাল আয়োজন এবং সাজানো-গোছানো চমৎকার ব্যবস্থাপনা দেখে মনটা সত্যিই ভরে গেল।

সেখান থেকে গেলাম জাবালে রহমতে, যেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণ দিয়েছিলেন। পাহাড়ের উপরে উঠে দেখি প্রশাসনের কঠোর সতর্কতা সত্ত্বেও কেউ কেউ সেখানকার উঁচু পাথরটিকে সামনে রেখে ছালাত আদায় করছে। সাথী ভাইয়েরা বললেন, এদেশে সামান্য যেসব শিরকী বা বিদ‘আতী আমল হয়ে থাকে, তার অধিকাংশ করে থাকে আমাদের উপমহাদেশের লোকেরা। এরপর গেলাম জাবালে নূর পাহাড়ের উপর হেরা গুহা পরিদর্শনে। ভূমি থেকে ২১০৪ ফুট উঁচু গাছপালাশূন্য পাহাড়টি দেখে বেশ ভয় ভয় লাগে। এখানে এসে আববু গল্প করছিলেন, ২০০০ সালে রাজকীয় মেহমান হিসাবে হজ্জে এসে অন্যান্য মেহমানসহ এসেছিলেন এই পাহাড়ে আরোহণ করতে। কিন্তু চূড়ায় উঠার সাহস করেননি কেউ। কেবল আববু একাই মাত্র দুই ঘণ্টায় চূড়ায় উঠে গুহা পরিদর্শন করে ফিরে এসেছিলেন। এবারও আমাদেরকে উপরে উঠার জন্য উৎসাহিত করলেন। বেশ প্রস্ত্ততি নিয়ে সাঈদ ভাই, ইমরান ও নিযামুদ্দীন ভাইসহ আমরা চার জন উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু অর্ধেক পথ উঠতেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। তাছাড়া একটানা উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম। ক্লান্ত শরীর আর পাহাড় থেকে বের হওয়া ভ্যাপসা গরমে উদ্যম হারিয়ে গেল। ভাবলাম এতে তো কোন নেকী নেই। সুতরাং উঠার চিন্তা বাদ দিলাম। ফেরার পদক্ষেপ নিতে দেখে পাশের এক দুষ্ট টাইপ বাংলাদেশী বলল, এ মহাপুণ্যের কাজ থেকে একবার ফিরে গেলে ভবিষ্যতে অমঙ্গল হবে, আর কখনো উঠতে পারবেন না। সঊদীতে এসেও এদের চিন্তা- চেতনায় কোন পরিবর্তন আসেনি দেখে বিস্মিত হলাম। বাংলাদেশের ২য় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওকারাডং আরোহন করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। কিন্তু হেরা পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বুঝলাম আমাদের দেশের সবুজ অনিন্দ্যসুন্দর পাহাড়গুলিতে আরোহণ করা আর আরবের ধূসর পাথুরে পাহাড়ে আরোহণ করার অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। খুবই বিরক্তিকর ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার।

হোটেলে ফিরে আসার পর আমাদের মেযবানসহ শহীদুল চাচা ও শারাফাত চাচা আসলেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হ’ল। এশার ছালাতের পর হোটেলের মসজিদে খ্যাতনামা দাঈ আহমাদ দীদাতের দত্তক পুত্র দিল্লীর ডা. আত্বাত-এর সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। বর্তমানে উনি জেদ্দা থাকেন। উনি আববুর কাছে ‘আহলেহাদীছ’ নামকরণ বিষয়ে জানতে চাইলেন। আববু বৈশিষ্ট্যগত নাম হিসাবে এই নামকরণের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন। হোটেল কক্ষে ফিরে আসার পর রাত দশটার দিকে দাম্মাম ইসলামিক সেন্টারের প্রখ্যাত বাঙ্গালী দাঈ শায়খ মতীউর রহমান মাদানী আগমন করলেন ৮-৯ জন সাথী নিয়ে। মজার ব্যাপার হ’ল, আমাদের জন্য ওনারা রাতের খাবার সঙ্গে নিয়েই এসেছিলেন। উনার সাথীদের মধ্যে ছিলেন দিল্লীর জামে‘আ মিল্লিয়া সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক জুনায়েদ হারেছ। এসময় শহীদুল চাচা এবং শারাফাত চাচাও ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হ’ল। ওনাকে আববু আমাদের বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমায় আসার আমন্ত্রণ জানালে উনি বাংলাদেশী তাবলীগ জামা‘আত, দেওবন্দী, জামায়াতে ইসলামী ও কবরপূজারীদের তাঁর প্রতি প্রবল অন্তর্জ্বালার কথা উল্লেখ করে সংশয় প্রকাশ করলেন। তারপর সবাই একত্রে রাতের খাবার গ্রহণ করে রাত্রি ১২টার পর ওনারা বিদায় নিলেন। সবমিলিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণভাবে এ সাক্ষাৎপর্ব শেষ হ’ল। এদিন লিফটে প্রখ্যাত সাবেক পাকিস্তানী ক্রিকেটার সাঈদ আনোয়ারের সাথে দেখা হ’ল। তাবলীগ জামা‘আতের প্রভাবে তিনি এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এক মানুষ। চেহারা দেখে তাঁকে চিনে ফেলার পর নাম ধরে প্রশ্ন করতে গেলাম। তিনি বললেন, ‘আব্দুল্লাহ বলাই যথেষ্ট’। বুঝলাম নিজেকে লুকানোর জন্যই তার এই প্রয়াস। ভাবছিলাম, একটুখানি সুনামের জন্য, একটুখানি নিজের পরিচিতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কতকিছুই না করি! অথচ দ্বীনদারীর কারণে আজ তিনি নিজের পরিচয় দিতেই নারায! যদি তাঁর এই দ্বীনদারী বিশুদ্ধ আক্বীদা-আমলের উপর হ’ত, তাহ’লে কতই না ভালো হ’ত! আল্লাহ সহায় হৌন- আমীন! 

৩১শে জুলাই বৃহস্পতিবার :

আগের দিন রাতে একই হোটেলে নিজস্ব এপার্টমেন্টে অবস্থানরত ডা. যাকির নায়েকের সাথে পরদিন সকাল ৭-টায় বিদায়ী সাক্ষাৎ ও একান্ত আলাপের জন্য সময় নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু ফজরের ছালাতের পর জানা গেল উনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত। আমাদের জেদ্দা যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় আর অপেক্ষা না করে আববু ওনার জন্য কিছু গিফট এবং বিদায়ী সালাম পাঠিয়ে দিলেন আমাদের মেযবানের মাধ্যমে। সকাল ৮-টায় এসেছিলেন মক্কায় দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাসকারী পশ্চিমবঙ্গের শায়খ বশীর বিন মুহাম্মাদ আল-মা‘ছূমী। ইনি ‘নামকরণে ইসলামী পদ্ধতি’ বইয়ের লেখক। ওনার রচিত অনেকগুলি বই হাদিয়া দিলেন। তাঁর সঙ্গী হুগলীর হাফীযুর রহমান মোল্লা বললেন, পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে ইসলামী বইসমূহের শতকরা ৭০ ভাগই আপনাদের। তাঁরা বিদায় নেওয়ার পর বেলা ১০টায় আমরা উপস্থিত ভাইদের বিদায় জানিয়ে শহীদুল চাচার নেতৃত্বে মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করলাম। আমাদের সাথে এবারও সফরসঙ্গী হ’লেন শায়খ আব্দুল বারী ও ইমরান ভাই। এছাড়া ছিলেন শহীদুল চাচার দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী বড় ছেলে তালহা ভাই এবং আমেরিকায় তাঁর পরিচালিত মাদরাসার একজন শিক্ষক।

মদীনা যাত্রা থেকে শুরু করে জেদ্দা থেকে বিদায় হওয়া পর্যন্ত তিনদিন নিজের সদ্য ক্রয়কৃত জীপ নিয়ে আমাদের সঙ্গ দিয়েছিলেন সঊদী প্রবাসী ও মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত পাকিস্তানী ছাত্র ভাই মতীউর রহমান ছগীর। বিগত ২৬ বছর যাবৎ সপরিবারে মদীনায় অবস্থানকারী ভ্রমণ পিয়াসী ও ইতিহাসমনস্ক এই ভাইটি নিজে ড্রাইভ করে আমাদেরকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। মদীনায় জন্ম হওয়ায় পুরো সঊদীআরবের প্রতিটি স্থান যেন তাঁর নখদর্পণে। ফলে তাঁর অভিজ্ঞ পরিচালনায় মদীনার ঐতিহাসিক স্থানগুলি আমাদের মানসপটে যেন নতুনভাবে প্রতিভাত হয়।

মক্কা থেকে মদীনাগামী ১০ লেন বিশিষ্ট বিশাল ও মসৃণ হাইওয়েতে গাড়ি দ্রুতগতিতে চলছিল। চারিদিকে বিস্তীর্ণ মরুভূমি আর সারি সারি ন্যাড়া পাহাড়। পথে একস্থানে কয়েক কি.মি ব্যাপী রাস্তার পাশে বানরের উপস্থিতি দেখলাম। বিভিন্ন যানবাহন থেকে তাদের উদ্দেশ্যে পাউরুটি, কেক ইত্যাদি ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। তারাও দক্ষতার সাথে প্যাকেট ছিঁড়ে খাবার খাচ্ছে। আমরাও গাড়ি থামিয়ে তাদের কিছু খাবার দিলাম। খাবার দিতে দেরী করায় একটা বানর আমাদের গাড়ির উপর উঠে পড়ল। পথে কিছুদুর পর পর মসজিদ ও হোটেলের ব্যবস্থা রয়েছে। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর আমরা একটি মসজিদে যোহর-আছর ছালাত আদায় করলাম এবং আল-তাযাজ হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম।

বিকাল ৪-টার দিকে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম। এখানে আগত প্রত্যেক মুসলমানই এক ভিন্ন আবেগ নিয়ে মাসজিদে নববীতে আগমন করেন। আমরাও তার বাইরে নই। কিন্তু সময় ছিল না। মুহূর্তকাল মসজিদের দিকে নজর বুলানোর পর চত্বরের নীচে চার তলা বিশাল পার্কিং লটে গাড়ি রেখে হোটেলের দিকে চললাম। আগে থেকেই মসজিদে নববীর চত্বর ঘেঁষে নির্মিত হোটেল ত্বাইয়েবায় ছয় বেডের একটি বড় এপার্টমেন্ট বুক করা ছিল। সেখানে উঠে ফ্রেশ হয়ে সামান্য বিশ্রামের পর ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আব্দুল মতীন ভাই সহ অন্যান্য ভাইয়েরা আসলেন। তারা আমাদেরকে সাথে নিয়ে মাগরিবের পূর্বমুহূর্তে মদীনার ‘হাই আল-মালিক ফাহদ’ এলাকায় আয়োজিত কর্মী ও সুধী সমাবেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন। সেখানে পৌছে দেখি মদীনার ভাইয়েরা ছাড়াও রিয়াদ থেকে সঊদী শাখা ‘আন্দোলনে’র প্রধান দায়িত্বশীলগণ সহ ৫০ জন গাড়ি রিজার্ভ করে এসেছেন। বহু অচেনা নতুন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় অনেক তৃপ্তি পেলাম। এমন অনেক ভাই ছিলেন যাদের সাথে কেবল ফোনেই কথা হ’ত, কিন্তু দেখা হয়নি কখনও। সমাবেশে আববু সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করলেন। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সঊদী আরব শাখার সভাপতি শায়খ মুশফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন আল-ক্বাছীম-এর আল-খাবরা দাওয়াহ সেন্টারের দাঈ শায়খ আখতার মাদানী, রিয়াদস্থ মাসিক আত-তাহরীক পাঠক ফোরামের সভাপতি মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সঊদী আরব শাখা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক শায়খ আব্দুল হাই। সম্মেলন শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর তাসলীম (কাপাসিয়া, গাযীপুর) নামে একজন কর্মী এসে আববুর হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন ও তওবা করলেন। তিনি নাকি ইতিপূর্বে আববুকে বহু গালি দিয়েছেন। কিন্তু এখন ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাচ্ছেন। আববু তাকে ক্ষমা করলেন ও তার সার্বিক কল্যাণের জন্য দো‘আ করলেন।

উল্লেখ্য যে, ঈদ উপলক্ষে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকায় ‘যুবসংঘ’ মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দায়িত্বশীল ও কর্মী ভাইদের অধিকাংশই দেশে অবস্থান করছিলেন। কেবল সভাপতি আব্দুল মতীন ভাই এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম ভাই আমাদের সঙ্গ দিতে পেরেছিলেন। অবশ্য মসজিদে নববীতে দায়িত্বপালন রত অবস্থায় নওদাপাড়া মারকাযের সাবেক ছাত্র আব্দুল গণীর সাথে স্বল্প সময়ের জন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল। মদীনা সাংগঠনিক প্রোগ্রাম সফল করার জন্য আব্দুল মতীন ভাইয়ের সাথে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন মদীনা ‘আন্দোলন’-এর সেক্রেটারী ওমর ফারূক (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী), জেদ্দা ‘আন্দোলন’-এর অর্থ সম্পাদক নিযামুদ্দীন (নোয়াখালী) ও তার ভাই মদীনার নূর আলম। সুন্দর একটি সমাবেশ শেষ করে আমরা পুনরায় হোটেলে ফিরে এলাম। রাত ১১-টার দিকে আহলেহাদীছ আন্দোলন সঊদীআরব শাখার নেতৃবৃন্দ আববুর সাথে একান্ত বৈঠকে মিলিত হ’লেন। ফজর পর্যন্ত টানা বৈঠক চলল। আর আমি সাথী ইমরান ভাইয়ের সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করে ফজরের কিছু আগে ঘুমিয়ে পড়ি।

১লা আগস্ট শুক্রবার :

ফজরের ছালাত আদায় করার মাধ্যমে প্রথমবারের মত আমরা মসজিদে নববীতে পা রাখলাম। খেজুর পাতার ছাউনীর নীচে খেজুরের কান্ডে ভর করা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া সেই ছোট্ট মসজিদটি আজ কত বিশাল, কত সুন্দর ও কত কারুকার্যমন্ডিত! মসজিদের চতুষ্পার্শ্বে বিশাল খোলা চত্বর। যার কিছু অংশ সাদা শীতল মার্বেল পাথর দিয়ে মোড়ানো, যাতে সূর্যতাপে তেতে না উঠতে পারে। বাকি অংশ গ্রানাইট পাথরে ঢাকা। বর্তমানে মূল মসজিদ ও চত্বর এলাকায় প্রায় পৌনে ৮ লক্ষ মুছল্লী একত্রে ছালাত আদায় করতে পারে। আর চলমান (২০১২-২০৪০ খৃঃ) সম্প্রসারণ কার্যক্রম শেষ হ’লে, এখানে মোট ১৬ লক্ষ মুছল্লী একত্রে ছালাত আদায় করতে পারবেন। ফালিল্লাহিল হামদ। মসজিদে নববীর নির্মাণ শৈলীর বৈচিত্র্য এবং পরিকল্পনার ছাপ মসজিদে হারামের চেয়ে অনেক বেশী মনে হল।

এদিন আমরা মসজিদে নববীতে জুম‘আর ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর খাওয়া-দাওয়া সেরে মদীনার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনে বের হলাম। শুরু হ’ল মতীউর রহমান ভাইয়ের কার্যক্রম। বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গাড়ি থামান আর বলতে থাকেন সেখানকার ইতিহাস। আর আববু নোট করতে থাকেন। প্রথমেই ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফের বাড়ী। সেখান থেকে সাদ্দে বাতহান, যা মদীনা মহানগরীকে বন্যা থেকে রক্ষার জন্য বাঁধ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অতঃপর এর সাথে লাগোয়া কালো পাহাড়টি দেখালেন, যাতে ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে আগুন ধরে যায় এবং তা পুড়ে কয়লার মত হয়ে যায়। যার আগুন মদীনার দিকে ধেয়ে আসতে থাকলে ছাহাবী তামীম দারী (রাঃ) লাঠি দিয়ে আঘাত করেন ও আগুন নিভে যায় বলে কথিত আছে। এরপর গেলাম সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর সেই বিখ্যাত খেজুর বাগিচা দেখতে, যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে খেজুরের চারা লাগিয়েছিলেন (আহমাদ, ছহীহাহ হা/৮৯৪)। অতঃপর ওহোদ যাওয়ার পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেখানে সেনাদল নিয়ে রাত্রি যাপন করেছিলেন এবং সকালে উঠে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার দলবল নিয়ে কেটে পড়েছিল, সে স্থানটি দেখলাম। এসব স্থানে বর্তমানে বিভিন্ন নামে মসজিদ হয়েছে। যেমন মাসজিদে শায়খাইন, মাসজিদে মুস্তারাহ ইত্যাদি। তারপর কয়েকটি প্রাচীন কূপ, প্রসিদ্ধ সাত মসজিদ (মসজিদে ওছমান, ওমর, আলী, ফাতেমা, সালমান ফারেসী (রাঃ) এবং মাসজিদুল ফাত্হ। মসজিদ ছয়টি হ’লেও সাত মসজিদ হিসাবে পরিচিত) দেখে আমরা আছরের ছালাত আদায় করলাম মসজিদে ক্বোবাতে।

ছালাত আদায়ের পর সোজা চলে গেলাম মসজিদে নববী থেকে ৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত ‘বি’রে ওছমান’ বা ‘বি’রে রূমাহ (بئر رومة)-তে। খেজুর বাগান সমৃদ্ধ বিশাল কূপ এলাকা। হিজরতের পর হযরত ওছমান (রাঃ) এই কূপটি মুসলমানদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য বহুমূল্যে (৩৫ হাযার দিরহাম) ক্রয় করে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন (ত্বাবারাণী কাবীর হা/১২২৬, বুখারী ‘সেচ’ অধ্যায়-৪২, অনুচ্ছেদ-২)। আশ্চর্যের বিষয় হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ থেকে অদ্যাবধি এই কূপটি ওয়াকফ হিসাবেই রয়েছে এবং পানি বিতরণ করে যাচ্ছে। সঊদী আরব সরকার আর-রাজেহী ব্যাংকে ওছমান (রাঃ)-এর নামে একটি একাউন্ট খুলে রেখেছেন, যেখানে বাগানের লভ্যাংশ জমা হয় এবং সঊদী সরকার তা বিভিন্ন দাতব্য কাজে ব্যয় করে থাকে। বাগানে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও মতীউর রহমান ভাই আববুর পরিচয় সুন্দরভাবে বর্ণনা করার পর বাগানের মিসরীয় দ্বাররক্ষী আমাদের অনুমতি দিলেন। ভিতরে পরিত্যক্ত একটি মসজিদ এবং তার পাশেই সেই বিখ্যাত কূপটি। চারিদিক ঘেরা। ভিতর থেকে মোটা পাইপ দিয়ে মেশিনের সাহায্যে পানি তুলে পুরো খেজুর বাগানে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা কুপের পানি ও বাগানের টাটকা টসটসে পাকা খেজুর গাছ থেকে ছিঁড়ে খেলাম। সঊদীতে আসার পর এত স্বাদ ও সুগন্ধিযুক্ত খেজুর এই প্রথম খেলাম। ফেরার সময় বাগানের তাজা খেজুর এবং বিখ্যাত ‘আজওয়া খেজুর কিনলাম দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শহীদুল চাচা এক প্যাকেট আমাদের বাসার জন্য হাদিয়া দিলেন।

তারপর সেখান থেকে রওয়ানা হলাম ওহোদ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। এটি ৭ কি.মি. লম্বা ও ৩ কি.মি. চওড়া একটি একক পাহাড়। সেজন্যেই একে ‘ওহোদ’ বলা হয়। দূর থেকে ওহোদ পাহাড়টি দেখে সঊদী আরবের অন্যান্য পাহাড়গুলি থেকে একটু আলাদা বলে মনে হ’ল। কালচে-রক্তিম বর্ণের পাহাড়। কাছেই সেই ‘জাবালুর রুমাত’ পাহাড়, যেখানে ওহোদ যুদ্ধের দিন রাসূল (ছাঃ) ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেছিলেন। পাহাড়টি নীচু হওয়ার কারণে অনেক মানুষ সেটিতে আরোহন করছে। অন্য পাশে শোহাদায়ে ওহোদ কবরস্থান, যেখানে হযরত হামযা সহ ৭০ জন শহীদের কবর রয়েছে। চারদিকে উঁচু দেওয়াল বেষ্টিত। ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখা গেল যে, ভিতরে কবরের কোন চিহ্ন নেই। বাইরেও কোন সাইনবোর্ড নেই। সিজদা করার কোন সুযোগ নেই। আমরা যিয়ারতের দো‘আ পড়লাম। অতঃপর সেখান থেকে চললাম মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। পথে সম্প্রতি নির্মিত জামে‘আ ত্বাইয়েবাহ বাহির থেকে দেখে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গিয়ে দেখলাম ঈদের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ। তাই বাইরে থেকে দেখেই ফিরে আসতে হ’ল। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সীমানাই হারাম এলাকার শেষ সীমানা। সীমানা রাস্তার অপর পার্শ্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় জামে‘আ ত্বাইয়েবাহ। এরপর আমরা পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত বাদশাহ ফাহদের বাড়ী, সমতলে রাস্তার পাশে ফাহদ কুরআন কমপ্লেক্স এবং ফাহদ হাসপাতাল দেখে মসজিদে বনু সালামাহ-তে গেলাম। যেখানে হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথম জুম‘আ আদায় করেছিলেন। এরপর গেলাম খন্দক যুদ্ধের স্থানে। এলাকাটিকে হাই আল-ফাৎহ বা ‘বিজয়ের এলাকা’ বলা হয়। এখানেই সম্মিলিত আরব বাহিনী আল্লাহর গযবের শিকার হয়ে সদলবলে পলায়ন করেছিল। এরপর ছানিয়াতুল বিদা‘ হয়ে ছাক্বীফায়ে বনী ছা‘এদাহ গেলাম, যেখানে হযরত আবুবকর (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে আরো দু’একটি স্থান পরিদর্শন করে মসজিদে নববীতে গিয়ে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। বাদ মাগরিব মতীউর রহমান ভাই মসজিদে নববীর বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন দেখাতে লাগলেন। বিশাল মসজিদের ২২নং মালিক ফাহদ গেইটের বামদিকে অল্প দূরে বিখ্যাত কূয়া ‘বি’রে হা’ (بئر حاء)-এর স্থানটি খুঁজে বের করে কার্পেট উল্টিয়ে গোলাকার রেখা দিয়ে নিশানা করা স্থানটি তিনি দেখালেন। যেটি ছাহাবী আবু তালহা (রাঃ) আলে-ইমরান ৩ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর তার সর্বাধিক প্রিয় সম্পদ হিসাবে আল্লাহর ওয়াস্তে দান করে দেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় রিয়াযুল জান্নাহ পেঁŠছালাম। ২২ মিটার লম্বা ও ১৫ মিটার চওড়া স্থানটিকে রাসূল (ছাঃ) জান্নাতের বাগান সমূহের মধ্যে একটি বাগান হিসাবে উল্লেখ করেছেন (বুখারী হা/১১৯৫)। যা এখন ৫×৩টি সাদা পিলারে ঘেরা। যেখানে ছালাত আদায়ের জন্য অধিকাংশ সময় প্রচন্ড ভীড় থাকে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে মসজিদে নববীতে যে ৩৫টি খেজুর কান্ডের খুটি দিয়ে তৈরী ছিল, তা এখন ৬৬টি হালকা হলুদ রংয়ে চিহ্নিত পিলারের মধ্যে রয়েছে। দেখলাম রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ৮ম হিজরীতে নির্মিত তিনধাপ বিশিষ্ট ঝাউ কাঠের নির্মিত মিম্বরের (বুখারী হা/৯১৭, ইবনু মাজাহ হা/১৪১৪) বর্তমান রূপ। পরিবর্তিত রূপের বর্তমান মিম্বরটি বাইরে ৩টি এবং ভিতরে ৯টি ধাপ মোট ১২ ধাপ বিশিষ্ট মর্মর পাথর দ্বারা নির্মিত এবং স্বর্ণের প্রলেপ দ্বারা কারুকার্যমন্ডিত, যা ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে তুর্কী সুলতান মুরাদ কর্তৃক নির্মিত হয়ে আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ‘বাবে জিবরীল’ দেখলাম। এ দরজা দিয়ে রাসূল (ছাঃ) মসজিদে প্রবেশ করতেন। খন্দকের যুদ্ধের পর জিবরীল (আঃ) এ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে ইহূদী গোত্র বনু কুরায়যার উপর অবরোধ করার আহবান জানিয়েছিলেন (বুখারী হা/৪১১৭)। সেকারণ একে ‘বাবে জিবরীল’ বলা হয়।

মতীউর ভাই আমাদেরকে বিভিন্ন খুঁটি ও তার মাথায় আরবীতে লিখিত পরিচয় নির্দেশ করে দেখালেন। যেমন হান্নানাহ খুঁটি, যার গায়ে ঠেস দিয়ে রাসূল (ছাঃ) দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। পরবর্তীতে মিম্বরে বসে খুৎবা দিতে শুরু করলে সেটা পরিত্যক্ত হওয়ায় ক্রন্দন করেছিল (বুখারী হা/৩৫৮৩)। আবু লুবাবাহ খুঁটি, যেখানে তিনি নিজেকে কয়েকদিন বেঁধে রেখেছিলেন তওবা কবুল হওয়ার অপেক্ষায় (বায়হাক্বী হা/১৩৩০৭)। এছাড়া উফূদ খুঁটি, যেখানে বসে তিনি আগত মেহমানদের সাক্ষাৎ দিতেন। দেখালেন আহলে ছুফফার স্মৃতিময় স্থানটি, যেখানে রিক্তহস্ত নওমুসলিমরা এসে আশ্রয় নিতেন ও বসবাস করতেন। খুঁটিগুলি সব মূলত স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে নির্মিত।

ভীড়ের সাথে সাথে একসময় পৌঁছে গেলাম বহু কাংখিত রাসূল (ছাঃ)-এর রওযার নিকটে। কয়েকজন শায়খ সেখানে মানুষকে কবরপূজার নিষিদ্ধতার ব্যাপারে বুঝিয়ে স্রেফ দো‘আ করে দ্রুত প্রস্থানের জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। আমরাও সেভাবে অতিক্রম করলাম।

স্মর্তব্য যে, মদীনা থেকে মক্কা দক্ষিণদিকে অবস্থিত হওয়ায় মসজিদে নববীর কিবলা দক্ষিণ দিকে। আর তার বামদিকে মসজিদে নববীর পূর্ব প্রান্তে রাসূল (ছাঃ)-এর এই বাসস্থান ও কবর অবস্থিত। ৮৭ হিজরীর পূর্ব পর্যন্ত বাসস্থানটি মসজিদের বাইরে ছিল। মসজিদ প্রশস্ত করার প্রয়োজন দেখা দিলে বাসকক্ষগুলিকে মসজিদের মধ্যে শামিল করে নেয়া হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর কবরসহ একই স্থানে হয়ে শায়িত আছেন হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ)। চতুষ্কোণবিশিষ্ট ঘরে অবস্থিত এই তিনজনের কবরকে ঘিরে একটি পাঁচ কোনা উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে দেন খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)। যাতে সেটি কা‘বার মত না দেখায় এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ তাকে ঘিরে তাওয়াফ শুরু না করে। ৬৬৮ হিজরীতে সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাস কবরগাহের চারপাশ দিয়ে লোহা ও পিতলের জালি দিয়ে ঘিরে দেন, যাকে ‘মাকছূরা’ বলা হয়। ৮৮৮ হিজরীতে সুলতান কাতেবায়ী লোহা ও পিতলের ঘন জালি দিয়ে ছাদ পর্যন্ত ঢেকে দেন। পরবর্তীতে তুর্কী সুলতান সুলায়মান খান (৯২৬-৯৪৮ হিঃ) ‘মাকছূরা’র উপর মর্মর পাথর লাগিয়েছেন। অনেক মুছল্লী এই ‘মাকছূরা’কেই রাসূল (ছাঃ)-এর বাসগৃহ ভেবে ভুল করে। এই মাকছূরার চারটি দরজা রয়েছে। তবে সবগুলোই বন্ধ থাকে। কেবলমাত্র পূর্বদিকে ‘বাবে তাওবা’টি বিশেষ কোন উপলক্ষে খোলা হয়।

স্মর্তব্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কবর মসজিদের মধ্যে হয়নি, যেমনটি অনেকে ধারণা করে। বরং আয়েশা (রাঃ)-এর গৃহে তাঁকে কবরস্থ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মসজিদ প্রশস্ত করতে গিয়ে বাধ্যগত অবস্থায় তাঁর কবর মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা ছাদ পর্যন্ত উঁচু দেওয়াল দিয়ে পৃথক করা আছে।

মতীউর রহমান ভাই আরো কিছু কিছু নিদর্শন আববুকে দেখাচ্ছিলেন, যেদিকে আমি সেভাবে নযর করতে পারিনি। ফিরে আসার সময় দেখা হ’ল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান যেলার অধিবাসী জামে‘আ ত্বাইয়েবার তরুণ প্রভাষক ইবরাহীম ভাইয়ের সাথে। তিনি আববুকে ছহীহ আক্বীদার নেতৃবৃন্দের মধ্যে এত বিভক্তি কেন? সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আববু জবাবে বললেন, আক্বীদাগত দিক থেকে এক হ’লেও স্বার্থদ্বন্দ্ব এবং মনের রোগ মানুষকে বিভক্ত করে দেয়। অধিকাংশ মানুষ যা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হ’তে পারে না। বিভক্তির অন্যতম কারণ এর মাঝেই নিহিত। সুতরাং বিভক্তিকে বড় করে না দেখে আপনি কার্যক্রম যাচাই করে যাকে উপযুক্ত মনে করেন, তার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াতের কাজ করে যান। চলতে চলতে সংক্ষিপ্ত জবাবে উনি খুব খুশী হ’লেন বলে মনে হ’ল।

রাতে হোটেলে শায়খ আব্দুল হাই, আখতার মাদানী, সোহরাব হোসাইন, মদীনায় অবস্থানরত আমার ছোট ফুফুর বড় জামাই বাকী বিল্লাহ, আব্দুল মতীন, আব্দুল আলীম ভাই সহ আরো অনেকে আসলেন। উনাদের সাথে দেশের জন্য কিছু উপহার ক্রয় করলাম। উনারাও আমাদেরকে বিভিন্ন জিনিস হাদিয়া দিলেন। জনাব আখতার মাদানীর দেওয়া আল-ক্বাছীমের বিখ্যাত খেজুরের স্বাদ সত্যিই মনে রাখার মত। উনি সপরিবারে মদীনা এসেছিলেন।

এদিন রাতেই আমাদেরকে গত কয়দিনের সবসময়ের সঙ্গী শায়খ আব্দুল বারী এবং ইমরান ভাইকে বিদায় জানাতে হ’ল। বিশেষতঃ ইমরান ভাইয়ের সাথে অল্প সময়ে গভীর সম্পর্ক হয়ে যাওয়ায় তাকে বিদায় দিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। দ্বীনদারী, ইখলাছ, সেবা ও সরলতা সব মিলিয়ে বি-বাড়িয়ার এ ভাইটি আমাকে মুগ্ধ করেছে।

২ আগস্ট শনিবার :

মদীনা থেকে আমাদের বিদায়ের দিন। বিদায় নিতে হবে ভেবে মনটা কেমন আনচান করলেও এতদিন যাবৎ কখনো বাসার বাইরে না থাকায় একটু আনন্দও পাচ্ছিলাম। আসলে যে কোন সন্তানের জন্য মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার ক্ষণটি সর্বদাই আনন্দের। এ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রবাসে একাকী অবস্থানরত ভাইদের কথা ভেবে সত্যিই কষ্ট লাগে।

বাদ ফজর সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার পর আব্দুল আলীম ভাই তার বাসা থেকে সকালের নাশতা বানিয়ে আনলেন। রান্না সুন্দর হওয়ায় পেটপুরে খেলাম। তারপর ওনার সাথে কিছু কেনা-কাটার জন্য বাযারে গেলাম। সেখানে বর্তমানে আতর ব্যবসায়ী ঢাকা যেলা ‘যুবসংঘে’র সাবেক ‘কর্মী’ ফযলুল হক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। পরে একসাথে যোহরের ছালাত হারামে আদায় করলাম। এদিন মসজিদে নববীর বিশাল চত্বরে চমৎকারভাবে সুসজ্জিত স্বয়ংক্রিয় ফোল্ডিং ছাতাগুলি দেখলাম। তারপর স্মরণ হ’ল আরেক বিখ্যাত স্থান বাকী‘উল গারক্বাদে ভুলবশতঃ যাওয়া হয়নি। আব্দুল আলীম ভাইয়ের সাথে দ্রুত সেখানে গেলাম। বাদ যোহর হওয়ায় কবরস্থান খোলা ছিল এবং কয়েকটি লাশ তখন দাফন হচ্ছিল। বিশাল কবরস্থানে অগণিত ছাহাবায়ে কেরামের ও বিদ্বানগণের কবর রয়েছে। এখন প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মানুষ এখানে কবরস্থ হচ্ছেন। কিন্তু কোন কবরই বিশেষভাবে চিহ্নিত করা নেই। কেবল পাথর দিয়ে কবর দেওয়ার স্থানটি দেখানো রয়েছে। বর্তমানে লাশ দ্রুত মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য একধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যাতে তিন মাসের মধ্যে তা মাটির সাথে মিশে যায়। ফলে এতো বেশী মানুষ কবরস্থ করা সহজ হয়। কবরস্থানের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বিলবোর্ডে কয়েকটি ভাষায় লিখিত নির্দেশিকার বাংলা অংশটি আব্দুল আলীম ভাইয়ের অনুবাদ করা। সেখানে ‘সুতন্বী এমজি’র সাথে আমার তৈরী একটি ফন্টের ব্যবহার দেখে খুব ভালো লাগলো। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে বিকাল সাড়ে ৪-টায় আমরা মদীনা থেকে বদর হয়ে জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যা সরাসরি গেলে ৪৬৯ কি.মি. এবং বদর হয়ে গেলে ৫৫০ কি.মি.।  

মদীনা থেকে ১৬০ কি.মি. দূরে বদর প্রান্তরে আমরা সন্ধ্যা ৭-টায় পৌঁছে মাগরিব পড়লাম। পথিমধ্যে মদীনা থেকে ৮০ কি.মি. দূরে ‘বি’রে রওহা’ (بئر الروحاء) নামক কূয়ায় পৌঁছলাম। যেখানে রাসূল (ছাঃ) খায়বার যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে অবতরণ করেন এবং স্ত্রী ছাফিয়াহ বিনতে হুওয়াই (রাঃ)-এর ওয়ালীমা খানা খাওয়ান (বুখারী হা/২২৩৫)। এছাড়া এ স্থানের সাথে অনেক ঘটনা জড়িত রয়েছে।

বদরের অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনো বিদ্যমান রয়েছে। যেমন যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য তৈরী সামিয়ানাযুক্ত উঁচু স্থানটি, যেখানে তাঁর দো‘আ কবুলের আয়াতটি (আনফাল ৯) নাযিল হয় এবং উভয় বাহিনীর অবস্থানস্থল। তাছাড়া ১৪ জন শহীদ ছাহাবীর নামফলক ইত্যাদি। শহীদগণের কবরস্থান উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে উঠে কেউ ভিতরের দৃশ্য দেখতে গেলে পুলিশ এসে জরিমানা করে। এরপরও মতীউর রহমান ভাই আববুর পরিচয় দিয়ে ৫ মিনিটের জন্য অনুমতি নিলেন। পাহাড়ে উঠে ভিতরের দৃশ্য দেখলাম। বাক্বী‘ কবরস্থানের মতই পাথর দিয়ে চিহ্নিত ফাঁকা ময়দান। পাহাড়ে সূরা গাশিয়ায় বর্ণিত কাঁটাযুক্ত যরী‘ ঘাস দেখলাম। মতীউর ভাইয়ের দক্ষ বিবরণীতে বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলি এমনভাবে ফুটে উঠছিল, যেন উনি যুদ্ধের সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী। 

বদর থেকে চললাম রাইস সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। বদর থেকে জেদ্দার দিকে ২৫ কি.মি. যাওয়ার পর প্রধান সড়ক ছেড়ে ডান দিকে ১০ কি.মি. দূরে লোহিত সাগরের তীরে এটি অবস্থিত। এটি সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রেরিত সেনাদল ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে আল্লাহর হুকুমে সাগর থেকে বিরাট একটি মাছ উঠে আসে, যা উক্ত সেনাদল মাসাধিককাল যাবত ভক্ষণ করে শেষ করতে না পেরে কিছু অংশ মদীনায় এনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হাদিয়া দিলে তিনি বলেন, এটি তোমাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ দান। ঐ মাছের বাঁকা কাঁটার নীচ দিয়ে একটি বড় উট তার চালকসহ যেতে পারত। হাদীছে মাছটির নাম এসেছে ‘আন্বর’ (বুখারী হা/৪৩৬২)

আমরা পার্শ্ববর্তী মাছের দোকান থেকে ১২০ রিয়ালে ৩টি সামুদ্রিক মাছ কিনলাম। কথায় বলে ‘যেখানেই মাছ সেখানেই বাঙ্গালী’। হোটেলের বাঙ্গালী কর্মচারীরা বিশাল কড়াইয়ে মাছগুলি ভেজে দিল। তারপর বড় বারকোশে গরম ভাতসহ মাছগুলি ঢেকে গাড়ীতে উঠিয়ে দিল। যা প্রায় ১ কি.মি. দূরে সাগরের তীরে বসে আমরা পাঁচজনে মিলে খেলাম। ফেরার সময় এশার আযান হয়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধ পেলাম। সারা সঊদীতেই ছালাতের সময় এ দৃশ্য দেখা যায়। অগত্যা বন্ধ দোকানের সামনেই মতীউর ভাই বারকোশটি রেখে আসলেন।

এবার যাত্রা শুরু হ’ল জেদ্দার উদ্দেশ্যে। জেদ্দা পৌঁছার কিছু আগে রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ১২০ কি.মি. দেওয়া ছিল। কিন্তু মতীউর ভাই তা খেয়াল না করে ১৫০ কি.মি. গতিতে চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ রাস্তার পাশে লুকানো স্বংয়ক্রিয় গোপন ক্যামেরা থেকে স্বচ্ছ সাদা ফ্লাশ লাইট জ্বলে উঠে যাত্রীসহ পুরো গাড়ির ছবি উঠিয়ে নিল। হতচকিত মতীউর ভাই ইন্নালিল্লাহ পড়ে বললেন, ৩০০ রিয়াল জরিমানা হয়ে গেল। মোবাইল ম্যাসেজের মাধ্যমে উক্ত অংক জানিয়ে দেওয়া হবে। ১ মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট একাউন্ট নম্বরে তা পরিশোধ না করলে লাইসেন্স আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যাবে।

পুরো সফরে আরো কিছু বিষয় লক্ষণীয় ছিল যেমন রাস্তায়, পাহাড়ের গায়ে এবং বিভিন্ন খোলা স্থানে সাইনবোর্ড দিয়ে বিভিন্ন দো‘আ লেখা। যাতে চলাচলকারীরা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করে। সফরে কোথাও কোন অশ্লীল দৃশ্য বা বেপর্দা নারী দেখিনি। দেশের বাদশাহর প্রতি সঊদীদের দারুণ ভক্তি রয়েছে। প্রবাসী ভাইয়েরা তাদের শ্রদ্ধাবোধের কথা জানাতে গিয়ে বললেন, এরা বাদশাহের নাম ‘মালিক’ ছাড়া বলতেই জানে না। এছাড়া রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে তাদের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। আইনের ব্যাপারে সঊদী প্রশাসন খুবই কঠোর। ফলে জনগণও এ ব্যাপারে খুবই সজাগ। এমন শান্তি-শৃংখলার কারণেই বোধহয় দেশটি এতটা সমৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। নইলে আমাদের দেশের মত সারা বছর ক্ষমতা নিয়ে লড়াই চললে উন্নয়নের চিন্তা মাথায় আনাই দায় হ’ত। এক ভাই বললেন ১৫ বছরের প্রবাস জীবনে কখনো লোডশেডিং দেখিনি। প্রশাসনিক গতিশীলতা একটু হ’লেও টের পেলাম জেদ্দা-মক্কা-ত্বায়েফ-মদীনা-বদর-জেদ্দা ঘোরার পথে যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি, তার স্ট্রীট লাইট গুলি দেখে। একটিও কোথাও নষ্ট দেখলাম না।

রাত ১২-টায় আমরা জেদ্দা পৌঁছে গেলাম। সাঈদ ভাইয়ের বাসায় উটের গোশত সহ বিভিন্ন বাঙ্গালী খাবার দিয়ে রাতের খাবার শেষ করে বিদায়ের প্রস্ত্ততি শুরু হ’ল। সাঈদ ভাই সহ জেদ্দার কর্মী ভাইয়েরা দক্ষ হাতে আমাদের সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। অতঃপর জেদ্দার টিপু সুলতান ভাইয়ের গাড়ীতে শহীদুল চাচা ও সাঈদুল ইসলাম ভাই আমাদের রাত আড়াইটায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। সংগঠনের দায়িত্বশীলবৃন্দ ও শহীদুল ইসলাম চাচাকে এ কয়দিনের বিপুল পরিশ্রমের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ঢুকে গেলাম। খুব দ্রুত ইমিগ্রেশন শেষ হয়ে গেল। মনে হ’ল আসার দিনের কষ্টটা আল্লাহ আজ পুষিয়ে দিলেন। যথাসময় ৩রা আগস্ট রবিবার ভোর ৫-টায় সঊদীয়া এয়ার লাইন্সের বিমানটি ছাড়ল এবং বাংলাদেশ সময় বিকাল আড়াইটায় ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। যাওয়ার দিনের ন্যায় এদিনও বিমানবন্দরে কর্মরত রূপগঞ্জের রফীকুল ইসলাম চাচার ছেলে আবুবকর ও হামীদুর রহমান ভাই উপস্থিত ছিলেন। ব্যাগ-ব্যাগেজ বুঝে নিয়ে বাইরে এসে ঢাকা যেলা নেতৃবৃন্দের সাথে রফীক চাচার বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও ছালাত-বিশ্রাম সেরে নিলাম। তারপর বিকাল ৫-টায় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। অতঃপর রাত ১২-টায় রাজশাহী মারকাযে পৌঁছলাম। ফালিল্লাহিল হামদ হামদান কাছীরান তাইয়েবাম মুবারকান ফীহ

আমার জন্য দেশের বাইরে এটাই প্রথম সফর। প্রথম বিদেশ সফরেই পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থানটিতে যেতে পারা এবং সেখানে ওমরাহ ও ই‘তিকাফ পালনের সৌভাগ্যটা আমার নিকট আল্লাহর এক অনন্য উপহার।  উপরি পাওনা হয়েছে জাতীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কীর্তিমান কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ লাভ। আল্লাহ যেন আমাদের এই পবিত্র সফরকে কবুল করেন। যারা এই মহতী সফরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করেছেন এবং সাথে থেকে সফরের সময় প্রতি পদে পদে আমাদেরকে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে যেন আল্লাহ রববুল আলামীন ইহকালে ও পরকালে উত্তম জাযা দান করেন-আমীন!

আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব

এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।






সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালাকোটের রণাঙ্গণে (আগষ্ট সংখ্যার পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মালদ্বীপের পথে - আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল
মাসজিদুল হারামে ওমরাহ ও ই‘তিকাফ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
দক্ষিণাঞ্চল সফরের টুকিটাকি - -আত-তাহরীক ডেস্ক
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.