৮.
২৮শে জানুয়ারী ২০২০, সকাল ৮-টা। গাড়ি ছুটে চলেছে জাকার্তার পথে। পথিমধ্যে আমার কয়েকজন ইন্দোনেশীয় বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি। প্রিয় বন্ধু শুআ‘ইব আব্দুল হালীমসহ ছোটভাই সান্দ্রী, এমহা ও আহমাদ ফাতেহের সাথে কথা হয়। তবে এরা জাভা, সুলাওয়েসী প্রভৃতি প্রদেশে থাকে। ফলে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। জাকার্তার কেন্দ্রস্থল যতই এগিয়ে আসে, ততই ট্রাফিক জ্যাম দীর্ঘতর হ’তে থাকে। জ্যামের তীব্রতা কমাতে সরকার অফিসকালীন সময়ে একদিন জোড়, অপরদিন বেজোড় নম্বরের গাড়ি শহরে ঢুকতে দেয়। কিন্তু তাতেও জ্যাম থেকে মুক্তি মেলে না। শম্ভুক গতিতে প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর গাড়ি সেন্ট্রাল জাকার্তায় প্রবেশ করে। শহরের মধ্যে অবশ্য তেমন জ্যাম নেই। বিভিন্ন ব্যাংক ও বিজনেস সেন্টার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিনন্দন আকাশচুম্বী ইমারতে ছেয়ে আছে চারিদিক। প্রাইভেট গাড়ির সাথে অসংখ্য মটরবাইক চলাচল করছে। কারো মধ্যে আইন ভাঙ্গার প্রবণতা নেই। ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়ে না। রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সবকিছু খুবই পরিপাটি ও সুনিয়ন্ত্রিত। চাকচিক্যে আভিজাত্যে সিঙ্গাপুরের চেয়ে মোটেও পিছিয়ে আছে মনে হ’ল না সুবিশাল জনসংখ্যার এই শহরটিকে। রাস্তা-ঘাটে নারীসমাজের বিপুল উপস্থিতি। তবে সিঙ্গাপুরের সাথে পার্থক্য হ’ল যে, এখানকার নারীরা কিছুটা শালীন ও হিজাব পরিহিতা। আর সিঙ্গাপুর হ’ল একজন সুশীল মানুষের জন্য স্রেফ দৃষ্টি অবনত রাখার স্থল। মা‘আযাল্লাহ! বদরুদ্দীন খুবই অভিজ্ঞ ড্রাইভার। গল্প করতে করতে সাবলীলভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। বিশাল জাকার্তা শহরের অলি-গলি সব যেন তার চেনা। নিজেই বলল, জাকার্তার ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও প্রায়শ রাস্তা ভুল করে। কিন্তু আমার ভুল হয় না। কেননা সেই পনের বছর বয়স থেকে এই শহরে নিয়মিত ড্রাইভ করি। তার দক্ষতায় সত্যিই মুগ্ধ হ’লাম।
প্রথমেই আমরা এলাম ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মসজিদ ইস্তিকলাল মসজিদে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই মসজিদটি ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা স্মারক হিসাবে নির্মিত। ১৯৭৮ সালে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এই মসজিদে একত্রে প্রায় ২ লক্ষ মুছল্লী ছালাত আদায় করতে পারেন। মসজিদের ৭টি প্রবেশদ্বার রয়েছে, যেগুলো আল্লাহর ৭টি গুণবাচক নাম যেমন আল-ফাত্তাহ, আর-রায্যাক, আস-সালাম প্রভৃতি নামে নামকরণকৃত। পার্কিং-এ গাড়ি রেখে আমরা ভিতরে প্রবেশ করি। নতুন করে সংস্কারকাজ আরম্ভ হওয়ায় মসজিদের বেশকিছু অংশ বন্ধ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বিরাটকায় নকশাদার গম্বুজ, যাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম-মৃত্যু দিবস (তাদের ধারণামতে, ১২ই রবীউল আওয়াল)-কে ধারণ করা ১২টি স্টেইনলেস স্টিলের চওড়া পিলার। মসজিদের ছাদের উচ্চতা ৫০ মিটার বা প্রায় ১৬০ ফুট। সেই সুউচ্চ ছাদের দিকে তাকালে বুকটা দিগন্তছোঁয়া যমীনের মত বিস্তৃত হয়ে যায়। ইবাদতে আসে অসীম প্রশান্তি। মসজিদের প্রায় মধ্যভাগ থেকে হালকা পার্টিশন দিয়ে মসজিদকে দু’টি অংশে বিভক্ত করা। একপার্শ্বে পুরুষ, অপর পার্শ্বে মহিলারা ছালাত আদায় করে। যোহরের আযান হ’ল। দশ মিনিট পরই জামা‘আত। সাধারণ মুছল্লী ছাড়াও প্রচুর স্কুল ড্রেস পরা ছাত্রকে জামা‘আতে উপস্থিত হ’তে দেখা গেল। মহিলা মুছল্লীদের সংখ্যাও অনেক। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করলাম। ইমাম ছাহেব যথারীতি দাঁড়িবিহীন। ছালাতের পর মিনিট পাঁচেক স্থানীয় ভাষায় কিছু নছীহত করলেন বটে; তবে তাতে প্রাণের ছোঁয়া পেলাম না।
ছালাত শেষে বিশাল মসজিদের ভেতর-বাহির ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গাড়িতে উঠার সময় হঠাৎ একজন হকার চোখে পড়ে। বাচ্চাদের খেলনা হিসাবে ১০ টাকা (১৫০০ রুপাইয়া) মূল্যের সামান্য প্লাস্টিকের পাখি বিক্রি করছে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে। পার্কিং-এ থাকা শত শত দামী গাড়ি বহরের ফাঁক গলে তার ভগ্নস্বাস্থ্য সকরুণ চেহারায় আমার দৃষ্টি আটকে যায়। অন্তর্দেশ কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। দশ টাকার খেলনা ধনীরা তার কাছ থেকে কেনইবা নেবে? সহসাই আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, কোন ভিক্ষুকের দেখা পাওয়া যায় কি-না। না, কোথাও কোন ভিক্ষুক নেই। কেবল একজন হকার। দাঁড়িয়ে আছে বিত্তের বিপুল ঠমকের মাঝে এক ‘অসুন্দর তিলক’ হয়ে! আমি একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকি আর বুকের ভেতর থেকে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। কে জানে, এই মানুষগুলো আজ যাদের করুণার পাত্র, হয়ত অন্য জগতে তারা একটি নেকির আশায় তাদের কাছেই করুণার ভিখারী হবে।
পরবর্তী গন্তব্য মারদেকা স্কয়ার বা ন্যাশনাল মন্যুমেন্ট। ইস্তিকলাল মসজিদের কাছাকাছিই এর অবস্থান। পার্কিং-এ গাড়ি রেখে এক রেস্টুরেন্টে আমরা ঢুকলাম হালকা নাশতার জন্য। নুডল্সের সাথে সব্জি, মাশরুম আর মীট বল সহকারে এক রকম খাবারের অর্ডার করল বদরুদ্দীন। নামটা সম্ভবত মী বাকসো। সাথে যথারীতি আইস চা। নাশতা সেরে মেইন গেট দিয়ে সুবিশাল মন্যুমেন্ট প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলাম। পায়ে হেঁটে পুরোটা দেখতে সারাদিন লেগে যাবে। পর্যটকবাহী ট্যুরিস্ট কারে চড়ে আমরা চত্বরটা একবার প্রদক্ষিণ করলাম। ১৯৭৫ সালে স্থাপিত এই স্বাধীনতার স্মারক মন্যুমেন্টটির উচ্চতা ১৩২ মিটার। মন্যুমেন্টের বেসমেন্ট অংশে ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম রয়েছে। মন্যুমেন্টের উপর ১১৫ মিটার উচ্চতায় একটি অবজার্ভেশন ডেক আছে, যেখান থেকে জাকার্তা শহরের স্কাইভিউ চমৎকারভাবে নযরে আসে। তবে একবারে ৫০ জনের বেশী ওঠা যায় না। কিউতে পর্যটকদের দীর্ঘ লাইন দেখে আমরা ফিরে এলাম। বদরুদ্দীন বলল, এর চেয়ে আমরা বরং ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে যেতে পারি, যেটি কিনা মন্যুমেন্টের চেয়েও খানিকটা উঁচু। শুধু তাই নয়, এটি বিশ্বের সর্বাধিক উচ্চতার লাইব্রেরীও বটে।
মারদেকা স্কয়ার থেকে ১২৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৪ তলাবিশিষ্ট ন্যাশনাল লাইব্রেরীটি দেখা যায়। বদরুদ্দীন সেখানে যাওয়ার প্রস্তাব করলে আমি সানন্দে সায় দেই। লাইব্রেরী বরাবরই আমার প্রিয় স্থান। তাছাড়া এত বড় আধুনিক লাইব্রেরী দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। মন্যুমেন্ট থেকে মূল রাস্তা অতিক্রম করলেই লাইব্রেরী। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে রঙ-বেরঙের বৈচিত্র্যপূর্ণ ফুলগাছ, অর্কিড দেখে। উন্মুক্ত চত্বরে মানুষ বসে আছে। কেউ বই পড়ছে, কেউ গল্প করছে। জাকার্তায় এমন স্থান কমই রয়েছে, যেখানে গাড়ি পার্কিং-এর জন্য ফী দিতে হয় না। কিন্তু লাইব্রেরীতে পার্কিং ফী নেই। পড়ুয়াদের উৎসাহিত করার জন্য যাবতীয় অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনাই এতে রয়েছে। ডিজিটাল লাইব্রেরী সিস্টেমে মুহূর্তের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত বই বা বিষয়ের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে এখানে পঞ্চাশ লক্ষাধিক বই রয়েছে।
কেন্দ্রীয়ভাবে শীততাপনিয়ন্ত্রিত লাইব্রেরীর বেশ কয়েকটি ফ্লোর ঘুরে দেখলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত বইয়ের র্যাক। রয়েছে পড়ার জন্য সোফা ও টেবিল-চেয়ার। শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিঃশব্দে পড়াশোনা করছে। সর্বোচ্চ তলায় উঠার পর দৃশ্যটা ছিল সারপ্রাইজের মত। অবজার্ভেশন ডেকের মত চারিদিকে কাঁচে ঘেরা ফ্লোর। পুরো জাকার্তা শহর এখান থেকে দেখা যায়। কক্ষের একপার্শ্বে ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের চিত্রপ্রদর্শনী। অপরদিকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য সোফা ও টেবিল। এক কোণে ১০-১২টির মত বিশেষ চেয়ার-টেবিল গ্যালারীর মত করে সাজানো। সেখানে ন্যাশনাল মন্যুমেন্টসহ জাকার্তা শহরের স্কাইভিউ সামনে রেখে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। কি যে অদ্ভূত সুন্দর জায়গাটা! একটা চেয়ারে কিছুক্ষণ পড়াশোনার লোভ সামলানো কঠিন। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও ফাঁকা চেয়ার মিলল না। সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম আর মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকলাম, কোন একদিন এমন কোন লাইব্রেরীর আশেপাশে বসবাসের সৌভাগ্য আমার হবে ইনশাআল্লাহ। এতবড় না হোক, ছোটখাটো একটা লাইব্রেরী থাকবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ২৪ ঘন্টা স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে পারবে। গবেষকদের জন্য দিনের পর দিন থাকার বন্দোবস্ত থাকবে। পাকিস্তানে ইসলামাবাদের মারী রোডে অবস্থিত মুফতী সাঈদ ছাহেবের লাইব্রেরীর কথা মনে পড়ে। পাহাড়ের গায়ে স্থাপিত তাঁর বিশালকায় অত্যাধুনিক লাইব্রেরীটির পাশ দিয়ে কলকল ধ্বনিতে নিত্য বয়ে যায় পাহাড়ী ঝর্ণা। জঙ্গল থেকে শন শন বয়ে আসে সজীব হাওয়া। লাইব্রেরীর সাথেই গবেষকদের জন্য রয়েছে পাঁচটি রুম। সেখানে তাদের যতদিন খুশী থাকার সুযোগ রয়েছে। থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। আমারও সুযোগ হয়েছিল সেই মনোরম অতিথিশালায় দু’দিন থাকার। কি যে চমৎকার সময় কেটেছিল সেখানে! সুবহানাল্লাহ।
লাইব্রেরীর সর্বোচ্চ তলা থেকে দূরে সমুদ্রের নীলাভ পানিরেখা দেখে সমুদ্র সৈকতে যেতে চাইলাম। গাড়ীতে উঠলে বদরুদ্দীন বলল মজলিস উলামা ইন্দোনেশিয়া (MUI)-এর অফিসে নিয়ে যাবে। এটি ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী সংগঠনগুলোর একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদ, যা সরকারীভাবে পরিচালিত। এই পরিষদে শী‘আ ও আহমাদিয়া ব্যতীত অন্যান্য সকল ইসলামী দলের অংশগ্রহণ রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার্থে এই পরিষদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সালাফী সংগঠন মুহাম্মাদিয়া এসোসিয়েশনের প্রধান ড. শামসুদ্দীন বিগত সেশনে এই সংগঠনের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এখানে যাওয়ার সুযোগ হবে জেনে খুব খুশী হ’লাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হ’ল, অফিসের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখা গেল সেই রাস্তায় সংস্কারের কাজ হচ্ছে। বিকল্প কোন রাস্তাও নেই। আবার জাকার্তায় যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং-এর সুযোগও নেই। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা সমুদ্র সৈকতের দিকে রওয়ানা হ’লাম। পথে বেশ কয়েকটি টোল প্লাজা পড়ল। ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা থাকায় কোথাও টাকা দেয়া লাগছে না। কেবল মেশিনে কার্ড দেখানোই যথেষ্ট। শুধু তাই নয়, এ কয়দিন সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ায় কার্ডের যে বহুল ব্যবহার দেখছি, তাতে মনে হয়েছে হয়তবা আর কিছুদিন পর এসব দেশ থেকে কাগজের নোট বা ধাতব মুদ্রার বিলুপ্তি ঘটবে।
আমরা আনচোল (Ancol) সী বীচ এরিয়ায় প্রবেশ করলাম। এই বীচকে কেন্দ্র করে পুরো একটা পর্যটন শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। কি নেই এখানে। আনচোল ড্রিমল্যান্ডে ঢুকলে ফাইভ স্টার আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে বিনোদনের যাবতীয় উপকরণ পাওয়া যাবে। এখানে রয়েছে ইকোপার্ক, ডলফিন ও সিন্ধুঘোটকসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণীদের প্রদর্শনী। রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এ্যাকুরিয়াম, ওয়াটার এ্যাডভেঞ্চার, ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডসহ বিশ্বমানের নানা আয়োজন। আমরা সী বীচে পৌঁছে আছরের ছালাত আদায় করলাম। প্রচন্ড গরম। পর্যটকদের ভীড় প্রায় নেই বললেই চলে। জাভা সাগরের পানি আশ্চর্য রকম শান্ত। কোন ঢেউ নেই। সমুদ্রের বুক থেকে লোনা পানির ভেজা বাতাসও গা জুড়িয়ে দেয় না। সমুদ্রকে সমুদ্রের রূপে না দেখতে পেয়ে কিছুটা নিরাসক্তভাবে বালিয়াড়িতে হেঁটে বেড়াই। লাভ ব্রীজ নামে একটি পায়ে হাঁটার ব্রীজ সমুদ্রের মাঝে অনেক দূর চলে গেছে। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। তারপর সেখান থেকে ফিরে আসি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বোগর (Bogor) সিটি। এটি জাকার্তা থেকে ৬০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত একটি পাহাড়ী শহর। প্রায় প্রতিদিনই এখানে বৃষ্টি হয় বলে এটি রেইন সিটি বা বৃষ্টির শহর হিসাবেও পরিচিত। সবুজ পাহাড় আর চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারণে মানুষ এখানে ভীড় জমায়। জাকার্তার বাইরে অন্য শহরগুলো কেমন তা দেখতে চাইলে বদরুদ্দীন এই পর্যটন শহরের কথা বলল। জাকার্তা পেরিয়ে বোগরমুখী জাগোরাভী টোল রোড ধরে যাত্রা শুরু হ’তেই ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গেলাম। ছয় লেনের রাস্তা যানবাহনে ঠাসা। বিকেলে অফিস ছুটি হওয়ায় সবাই জাকার্তা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর যখন অর্ধেক পথও অতিক্রম করা গেল না, তখন বদরুদ্দীনকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বললাম। কেননা এভাবে শম্ভুক গতিতে চলতে থাকলে দিনের আলোতে আর বোগর সিটি দেখার সুযোগ হবে না। সুতরাং জাকার্তা ফিরে যাওয়াই উত্তম। ফিরতি পথে অবশ্য জ্যাম তেমন পড়ল না। সুতরাং বেশ দ্রুতই জাকার্তা ফিরে বদরুদ্দীনের নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। টাঙ্গেরাং সিটিতে ঢোকার পর একটা শপিং মলে নিয়ে গেল বদরুদ্দীন। এখানে মাগরিব-এশার ছালাত আদায় করে নিয়ে কিছু ইন্দোনেশিয়ান কাপড়-চোপড় ও খাবার কিনলাম। তারপর এক হোটেলে গতদিনের মত সাতেই কাবাব দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। রাস্তা থেকে কিনে নিলাম ডুরিয়ান ও রামবুতান নামের দু’টি ফল।
বদরুদ্দীনের বাড়ী টাঙ্গেরাং শহর থেকে কাছেই পরিস জায়া এলাকায়। তার পিতা মাওলানা হাসানুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা দারুস-সালাম (Pondok Pesantren Darussalam) সংলগ্ন একতলা বাড়িতে তারা থাকে। বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। বদরুদ্দীনের পিতা মাওলানা হাসানুদ্দীন এবং তার বড় ভাই আহমাদ বাহরুল হিকাম দেখা করতে এলেন। তাঁদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হ’ল। বড় ভাই বদরুল হিকাম ইয়েমেনে পড়াশোনা করেছেন। ফলে ভালো আরবী জানেন। তিনি ডুরিয়ান ফল কেটে খাওয়া শিখালেন। প্রায় কাঠালের মত দেখতে ফলটি নামে সকল ফলের মা হিসাবে পরিচিত ইন্দোনেশিয়ায়। স্বাদ ও রংও প্রায় হুবহু কাঠালের মতই। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধ এতই তীব্র যে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা হ’ল আমার। কোনক্রমে দু’টো কোয়া খেয়ে ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু উনারা তিনজন মুহূর্তেই দু’টো মাঝারী সাইজের ডুরিয়ান ফল সাবাড় করে ফেললেন। রামবুতান ফলটি অবশ্য খেতে ভাল লাগল। অনেকটা লিচুর মতই স্বাদ।
ঘুমাতে ঘুমাতে ১২-টা বেজে গেল। পরদিন ২৯শে জানুয়ারী’২০ সকালে ফজরের ছালাতের পর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নছীহতমূলক বক্তব্য রাখলাম। বদরুদ্দীন অনুবাদ করে দিল। বক্তব্য শেষে তাওহীদ ও আক্বীদা বিষয়ক কিছু প্রশ্ন করলাম। ছাত্ররা উত্তর দিল বটে, কিন্তু খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সবচেয়ে কষ্ট পেলাম যখন বড় ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলাম বুলূগুল মারামের সংকলক কে? তারা কেউই বলতে পারল না স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পূর্বে। অতিরিক্ত লজ্জাবোধ হয়ত তাদেরকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। মসজিদ থেকে বের হয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় গতদিনের পুনরাবৃত্তি হ’ল। কুর্নিশের ভঙ্গিতে ডান হাত চুম্বন করল প্রায় শতাধিক ছাত্র। বাঁধা দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম তাদের সৌজন্যতার আতিশয্যে। একটা বিষয় আমাকে অবাক করেছে যে, গতকাল থেকে যে মাদ্রাসাগুলো চোখে পড়েছে সবগুলোতে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীও রয়েছে এবং তারা একই আবাসিক ক্যাম্পাসে পৃথক বিল্ডিং-এ থাকে। টিনেজ বয়সের ছেলে-মেয়েরা এভাবে পাশাপাশি বিল্ডিং-এ থাকলে স্বভাবতই কোন বিপদাপদ বা নিরাপত্তার সমস্যা হওয়ার কথা। বদরুদ্দীন যদিও বলল, কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে বলে সাধারণত কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আমার মনে খটকাই রয়ে গেল।
সকাল ৯-টায় সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ফিরতি ফ্লাইট। সুতরাং দ্রুত সকালের নাশতা করে তৈরী হয়ে নিলাম। বদরুদ্দীনের পিতা আমার সাথেই নাশতা করলেন। ছোটখাটো বিনয়াবনত মানুষ তিনি। হালকা দাড়ি রেখেছেন। নাশতার পর কথার ফাঁকে বললেন, তিনি মাদ্রাসায় ফিকহ পড়ান। ফিকহের যে গ্রন্থটি পড়ান, সেটির নাম অপরিচিত মনে হ’লে লেখকের নাম জানতে চাইলাম। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ নামটি বলতে পারলেন না। নাশতার পর তিনি সিগারেট ধরালেন আর এ্যাশট্রেতে পোড়া অংশ ফেলতে লাগলেন। আজ আর অবাক হ’লাম না। এ দৃশ্যের সাথে পরিচয় হয়েছে আগেই। সকাল ৭-টার দিকে বাসা থেকে বের হ’লাম। বাসার কাছাকাছি অবস্থিত বাটু সেপের রেল স্টেশন। এখান থেকে মাত্র ২০ মিনিটে এয়ারপোর্টে পৌঁছানো যায়। সবকিছু ডিজিটালাইজ্ড। বদরুদ্দীন কার্ড ঢুকিয়ে টিকিট কেটে নিল। প্রতি ২০ মিনিট পর পর ট্রেন আসে। বৈদ্যুতিক ট্রেন বলে কোন আওয়াজ নেই। সফেদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ট্রেনে উঠতে না উঠতে মুহূর্তেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। বিদায়ের সময় বদরুদ্দীনকে দাওয়াত দেই বাংলাদেশে আসার জন্য। তার চেহারা কিছুটা আবেগাপ্লুত। বলল, আমি কাউকে বিদায় দিতে সাধারণত আসি না। এলেও বিদায় বলতে পারি না। মনটা এত খারাপ হয়ে যায়! আমি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেই। গত দু’দিন যেভাবে আমাকে পুরোটা সময় দিয়ে জাকার্তা শহর ঘুরিয়েছে, রকমারী খাবার খাইয়েছে, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বন্ধুত্ব যে কতটা মধুর সম্পর্কের নাম, সেটা সে যথার্থই প্রমাণ করে দেখিয়েছে। আল্লাহ তাকে উত্তম জাযা দান করুন। আমীন! ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি বদরুদ্দীন তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাত নাড়িয়ে বিদায় গ্রহণ করি।
যথাসময়ে ফ্লাইট ছাড়ল। বেলা ১২-টার দিকে সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। বিকাল ৩-টা ৫০-এ পুনরায় ঢাকাগামী ফ্লাইট ছাড়বে। সুতরাং সিঙ্গাপুরে আরও ঘন্টা তিনেক অবস্থান করতে হবে। আরেকবার এন্ট্রি নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এলাম। সিঙ্গাপুরের সাংগঠনিক ভাইয়েরা তখনও পৌঁছেননি। আমি সেই ফাঁকে চাঙ্গি এয়ারপোর্টের বিশেষ সৌন্দর্য ‘দ্যা রেইন ভরটেক্সে’ এসে বসলাম। চারিদিকে রূপকথার শাদ্দাদের বেহেশতের মত থরে থরে সাজানো বাগান আর মাঝে ১৩০ ফুট উচ্চতা থেকে পতন ঘটছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু কৃত্রিম ঝর্ণাধারা। কি যে এক চোখ ধাঁধানো অপরূপ সৌন্দর্যের আধার! দৃষ্টি ফেরানো দায়। কিছুক্ষণের মধ্যে মোয়ায্যম ভাই, সামী ইউসুফ ভাই ও মাহবূব ভাই এসে উপস্থিত হ’লেন। পরে এলেন আব্দুল লতীফ ভাই। আমার লাগেজ সিঙ্গাপুরেই রেখে গিয়েছিলাম। তাঁরা সেই লাগেজের সাথে আরো একটি লাগেজ যোগ করে দিয়েছেন উপহারসামগ্রী সমেত। কোনভাবেই তাদেরকে নিবৃত করা যায়নি। ভালোবাসার এক মধুর বিড়ম্বনা। ওদিকে আব্দুল লতীফ ভাই পথে আসতে আসতে রচনা করেছেন গোটা এক কবিতা। আল্লাহ তাঁদের এই মুহাববাতকে কবুল করুন এবং জাযায়ে খায়ের দান করুন- আমীন!
সবাই একসাথে এয়ারপোর্টে বসেই দুপুরের খাবার খেলাম এবং যোহর-আছরের ছালাত আদায় করে নিলাম। তারপর ফোনে সিংগাপুর সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এবার দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার পালা। পাঁচদিনের এই সফর অকৃপণ হস্তে জীবনের অভিজ্ঞতার খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা দু’টি পৃষ্ঠা যুক্ত করে দিল, যার পরতে পরতে রয়েছে প্রিয় মানুষদের অকৃত্রিম ভালোবাসার পরশ, রয়েছে আল্লাহর বিশাল সৃষ্টিরাজির ক্ষুদ্র অংশবিশেষকে আপন করে নিতে পারার সুখ। কৃতজ্ঞতাবনত চিত্তে মহান প্রভুর বারগাহে সিজদা সমর্পিত হই, আর প্রার্থনা করি জীবনপাখি উড়বার কালে আল্লাহর রাহে কাটানো এই সময়গুলো যেন মাক্ববূল আমল হয়ে উত্তম সম্বল হয়- আমীন!
উপস্থিত সাথী ভাইয়েরা আবেগমথিত বিদায়ে সিক্ত করলেন। মাত্র দু’দিনে এতগুলো দ্বীনী ভাইয়ের সাথে পরিচয়, অন্তরঙ্গতা কি যে পরিতৃপ্তির ছিল তা বলে বোঝানো যায় না। তাদের ভালোবাসার প্রকাশও এতটা অবারিত ছিল, যার ঋণ কখনও পরিশোধযোগ্য নয়। এই ভালোবাসার মূল্য কেবল মহান সৃষ্টিকর্তাই দিতে পারেন সেদিন, যেদিন কেউ কারো উপকারে আসবে না, যেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। সেই সুকঠিন মুহূর্তে এই ভালোবাসাগুলো যেন রহমতের ছায়া হয়ে ফিরে আসে, এই দো‘আই প্রাণখুলে করি।
সন্ধ্যা ৬-টায় ঢাকা বিমানবন্দরে নামি। ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি প্রিয় ভাই মুস্তাফীযুর রহমান সোহেল বংশাল থেকে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে রিসিভ করতে আসলেন। মিস করলাম ভাই হুমায়ূন কবীরকে। প্রতিবার বিদেশ থেকে ফিরে প্রথম দেখা পাই এই মানুষটার। আজ কোন ব্যস্ততায় আসতে পারেনি। এয়ারপোর্ট থেকে নতুন গন্তব্যের পথে রওয়ানা হই। কাল যেতে হবে কুমিল্লায় কয়েকটি প্রোগ্রামে অংশ নিতে। ক্ষণিকের এই পৃথিবীতে আমরা তো কেবল পান্থজনই। যাযাবর এই যিন্দেগানীর মহিমা তখনই আস্বাদিত হবে, যখন তার আখেরী মনযিল হবে মহান প্রভুর সন্তুষ্টি ও চিরন্তন মুক্তি। সেই লক্ষ্যপানে আমরা কতটুকু অবিচল থাকতে পারছি? আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন