জীবনের গতিপথ যে হিসাব মেনে চলে না, তার প্রমাণ ইদানিং একদম হাতে নাতে পেয়ে যাচ্ছি। মারী হিল্সে যাব ভাবছি ক’দিন ধরেই, কিন্ত আজ-কালের ঘূর্ণাবর্ত ভেদ করতে না পেরে ভাবনাটা দোদুল্যমান থাকে। হাড়কাঁপানো শীতের এক ভোর। আত-তাহরীকের সাময়িক প্রসঙ্গ কলামটি লিখতে বসেছি। কখন শেষ হবে জানি না। স্কাইপের বার্তাঘরটা ঘন ঘন হলুদবর্ণ হচ্ছে, ছোটভাই নাজীবের বিরামহীন তাগাদা, এত সময় লাগে কেন! ট্রেসিং বের করে কখন নিষ্ক্রান্ত হবে, সেই অপেক্ষায় রীতিমত ছটফট করছে। ওদিকে পেশোয়ার এগ্রিকালচারাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী ছাত্র রাহীল আরশাদ পেশোয়ার থেকে রওনা দিয়েছে। মারীতে বরফবারী শুরু হয়েছে আর আমি যাচ্ছি শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি। পরীক্ষার চাপ মাথায় নিয়েই ছুটে আসছে। অবশেষে একটানে লেখাটা শেষ করে বেলা ১০টা নাগাদ ভারমুক্ত হলাম আলহামদুলিল্লাহ। মেইল করে রেডি হলাম ঝটপট। বেরিয়ে পড়লাম দশ মিনিটের মধ্যে। আব্দুর রহমান ভাইয়েরও যাওয়ার কথা। কিন্তু সকাল থেকেই তাঁর মোবাইলে কবরের নিস্তব্ধতা। অগণিতবার রিং করার পর শেষ পর্যন্ত রিসিভ হ’ল। এক ব্যক্তি নাকি ভুল করে তাঁর কক্ষের দরজায় তালা আটকিয়ে কোথায় গিয়েছিল। তাতেই যত বিড়ম্বনা। মাত্রই তালা খুলে ঘরে ঢুকেছেন। মাথায় হাত পড়ল আমার। পিন্ডির যে প্রান্তে থাকেন, সেখান থেকে আসতে আরও ঘন্টাখানিক লাগবে! ফায়যাবাদ বাসস্টান্ডে নেমে কিছুক্ষণ পায়চারী করতেই রাহীল উপস্থিত। দু’জনে মিলে নির্মানাধীন ফ্লাইওভারের নীচে অলস গল্প-গুজব করতে থাকি আর জনমানুষের কীর্তিকলাপ দেখি। একসময় মুরববী উপস্থিত হলেন হাঁটু লম্বা উইন্টার কোট চাপিয়ে ইতিউতি তাকাতে তাকাতে। চেহারায় অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। উদাসীন পথিকের মনের কথা ধরতে গিয়ে ফের কোন বিপদে পড়ি, সেই ভয়ে আমরা কথা বাড়াই না। ‘বাবা বাঙ্গাল’ হিসাবে ইদানিং তার বেশ নাম-ডাক হয়েছে। চেহারায় অমন আনমনা ঋষিভাবটা তাই বেশ মানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ‘বাবা বাঙ্গাল’ বলতে পাকিস্তানীরা অজ্ঞান। তথাকথিত ‘কালা যাদু’র হাত থেকে রেহাই পেতে কি ধনী কি গরীব, দলে দলে সবাই কবিরাজের বাড়িতে ছোটেন। আর কবিরাজ মানেই এখানে এক ডাকে পরিচিত বাঙ্গালী কবিরাজরা। করাচী কেন্দ্রিক এই বাবা বাঙ্গালদের ব্যবসার প্রসার রীতিমত ঈর্ষণীয়। পাকিস্তানে আসার পর এই বাবাদের নামডাক শুনে আমি হতবাক হয়েছিলাম। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাঙালী মানেই সম্ভবত এদের অনেকের কাছে ‘বাবা বাঙ্গাল’। একদিন আমি নিজেই এমন এক বিব্রতকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। হোস্টেলে ওঠার পর একদিন পার্শ্ববর্তী রুমের এক পাকিস্তানী ছাত্র এসে প্রসঙ্গ ছাড়াই নিজের শারীরিক সমস্যা বর্ণনা করে চিকিৎসা চাইল। জানতে চাইলাম, আমাকে এসব বলার কারণ কি? সে বলল, আমি শুনেছি বাঙালীরা ঝাড়ফুঁকে খুব পারদর্শী, তারা কালা জাদু ঝাড়াতে পারে। আমি হেসে বললাম, ‘বাঙালী ব্ল্যাক ম্যাজিকের চিকিৎসা করে, সেটা তোমাদের দেশে এসেই প্রথম জেনেছি, দেশে থাকতে আমি এসব কোনদিন শুনিনি’। কিন্তু সে বিশ্বাসই করল না। বোধহয় ভাবল, আমি কৌশলে এড়াতে চাচ্ছি।
করাচীর অলি-গলিতে দেখেছি বাবা বাঙ্গালদের নামে অসংখ্য চিকা মারা। ইসলামাবাদ থেকে ট্রেনে লাহোর যাওয়ার পথে চোখে পড়েছে দেয়ালে দেয়ালে ‘আমেল আকাশ’, ‘শাদী মে রাকাওট... মহাববাত মে নাকামী...হার মাসআলা কি হাল’ ইত্যাদি চটকদার বিজ্ঞাপনের সমাহার। অবশ্য এই ব্যবসা এখন আগের মত আর একচেটিয়া নেই। এতে ভাগ বসিয়েছে প্রতারক চক্র। অর্থাৎ আসল বাবাদের জায়গা দখল করছে নকল বাবারা। জাতে পাকিস্তানী হলেও বাঙ্গালীদের খ্যাতি ব্যবহার করে তারা নিজেরাই ‘বাবা বাঙ্গাল’ হয়ে বসেছে। আর চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে সিন্ধু ও পাঞ্জাবের গঞ্জে-শহরে। দিন দিন দৌরাত্ম বাড়ছে নকল বাবাদের। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আসল বাবাদের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিতে হচ্ছে, ‘আসল বাবা বাঙ্গাল চিনে নিন’। চিকিৎসাপ্রার্থীরা তাই চোখ-কান খোলা রাখেন। তারপরও প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়ে সেকস্ত হতে হচ্ছে তাদের। আব্দুর রহমান ভাই অবশ্য এই টাইপের ‘বাবা’ নন। তিনি নিঃস্বার্থ জনসেবা করেন। শারঈ পদ্ধতিতে ঝাড়-ফুঁক এবং দো‘আ দেন। বিনিময়ে একটি পয়সাও নেন না। দুঃখের ব্যাপার, মানুষ তার এই মহানুভবতার মূল্য দেয় না। বরং তাকে ইচ্ছামত ব্যবহার করে। অনেক সময় দূরবর্তী কোন স্থানে রোগী দেখতে গেলে যাতায়াত ভাড়াটা পর্যন্ত পান না। মনের দুঃখে তাই অনেকবার এই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ জনসেবা ছেড়ে দেবার কথা ভেবেছেন, কিন্তু পারেননি।
লোকাল মাইক্রোতে আমরা রওয়ানা হলাম মারীর উদ্দেশ্যে। ইসলামাবাদ থেকে ৫০ কিলোমিটারের দূরত্ব। পৌঁছতে সোয়া ঘন্টা লাগে। গত দু’দিন প্রচুর তুষারপাত হয়েছে। ঘরবাড়ী, গাছপালা সব ধবধবে সাদা। রাস্তায় স্তূপাকারে জমে থাকা বরফ ঠেলে মল রোডে উঠে আসলাম। আকাশে ঘন কালো মেঘ। বিদ্যুতের চমক, সেইসাথে গর্জনও। খানিক বাদে ‘মুষলধারে’ তুষারপাত শুরু হ’ল। তুলোর মত নেমে আসতে লাগল অজস্র তুষারকণা। নেই রিমঝিম শব্দ, কিন্তু তাতে কি! মায়াময় স্বপ্নের জাল বোনার কাজটা থেমে থাকে না। শুভ্র মারীর শুভ্র বসনে কালিমার লেশমাত্র নেই আর। উপরে ওঠার রাস্তাগুলো ভয়াবহ পিচ্ছিল। দেহটাকে সামলে উঠে পড়লাম পাহাড়ের উপর এক মসজিদে। যোহর-আছরের ছালাত আদায় করলাম সেখানে। মসজিদে হিটার ছিল। তাই বেরিয়ে আসা মাত্রই বাতাসের শীতল ঝাপটায় আক্ষরিক অর্থেই হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল। ধাতস্থ হ’তে ঢের সময় লাগল। তাড়াহুড়ো করে মল রোডের একটি হোটেলে ঢুকে পড়লাম। সেখানে ঐতিহ্যবাহী ‘চিকেন-কড়াই’ পর্ব সেরে প্রকৃতির সাথে মিতালী গড়বার নিয়তে হাঁটা শুরু করলাম কাশ্মীর পয়েন্টের দিকে। জনমানব খুব একটা নেই। ধুসর মেঘেরা আকাশ থেকে নেমে এসে মর্ত্য ছুঁয়েছে। হিম হিম কুয়াশায় ঢেকে দিয়েছে শ্বেত-শুভ্র ধরণী। ঘন ম্যাপল, ওয়ালনাট, ফার, পাইনের বনে কোন পাখির কলকাকলী নেই। নেই কাঠপোকাদের ঝিঝি গান। জমাট মৌনতা। মাঝে মাঝে কেবল গাছের পাতায় পাতায় জমে থাকা তুষার রাস্তায় ঠাস করে পড়ে চমকে দেয়। প্রকৃতির এমন ঠাসবুনট রহস্যময়তায় এক অদ্ভূত বিহবলতা চেপে বসে। অচেনা অনুভূতির মন্দ্রিত আবেশে দ্রবীভূত হয়ে হারিয়ে যাই জাগতিক পৃথিবীর বাইরে..বহু দূরে। একটা সময় কেবলই মনে হ’তে থাকে, দুনিয়ার এই সৌন্দর্য যদি এমন বাঁধনহারা, পাগলপারা করে দেয়, তাহলে জান্নাতের সেই সৌন্দর্য কেমন! কল্পনার গতিপথটা অন্তহীন যাত্রায় শামিল হয়। জীবনের পথচলাকে হঠাৎ বড় দীর্ঘ মনে হতে থাকে। শিশুসুলভ কৌতুহলে বড় ছটফট করতে থাকে মনটা... সেই অপার সৌন্দর্যে অবগাহণের অধীর প্রতীক্ষায় ...যা কোন চোখ কখনও দেখেনি, কোন কান কখনও শুনেনি, কোন অন্তর কখনও কল্পনাও করেনি। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।
দূরে কোথাও আছরের আযান পড়লে টনক নড়ে। ঘড়িতে সময় দেখলাম। এত আগে আহলেহাদীছ মসজিদ ছাড়া কোথাও আযান হয় না। নিশ্চিতভাবে এখানে কোথাও আহলেহাদীছ মসজিদ আছে। তবে কাছাকাছি এমন কাউকে পেলাম না যার কাছে জানা যায় মসজিদের অবস্থান। আবার মল রোডে ফিরে আসি। কিছু কেনাকাটা করে আড্ডায় আসলাম। আমাদের প্লান ছিল রাতে এ্যাবোটাবাদে থাকব। বালাকোটের এহসান এলাহী ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছিলাম, গালিয়াতের যে অংশটি আহলেহাদীছ অধ্যুষিত, সেখানে মুরতাযা এবং মুছতফা নামে দুই ভাই আছেন। যাদের কাছে বালাকোট জিহাদের কিছু স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। যেমন জিহাদের পতাকা এবং শাহ ইসমাঈল (রহ.)-এর ব্যবহৃত কিছু জিনিস। তাদের বাড়িতে গিয়ে সেই স্মৃতিচিহগুলো স্বচক্ষে দেখে আসা এবং ছবি তুলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তার আগেই আব্দুর রহমান ভাইয়ের কাছে তাঁর এক কাশ্মীরী বন্ধুর ফোন এল। দীর্ঘ আলাপের পর আমার কথা শুনে উনি পাকাপাকি দাওয়াত দিয়ে বসলেন।
কাশ্মীর! কাশ্মীর যাওয়ার মওকা খুঁজছি অনেকদিন ধরেই। তাই বলে এমন হঠাৎ সুযোগ! আমি প্রমাদ গুণলাম। একরাশ দুর্ভাবনার বাগড়ায় উচ্ছ্বাসটা অবশ্য গোপন রাখতে হ’ল। কারণ নিয়ম অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া বিদেশীদের জন্য কাশ্মীরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। ইসলামাবাদে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে অনুমতি নিতে হয়। আমি তো নেইনি। অনুমতিপত্র ছাড়াই রওনা দেব? ঢুকতে দেবে? এদিকে অন্তর বলছে, সুযোগ হাতছাড়া করো না। সুতরাং মনস্থির করেই ফেললাম। রাহীলের পরীক্ষা থাকায় ওকে ইসলামাবাদের গাড়ীতে তুলে দিয়ে আমরা লোয়ার টপ্পা মোড়ে এসে মুযাফফরাবাদগামী ওয়াগনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মাগরিবের পর গাড়ি এল। প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ মারী থেকে। যাত্রা শুরুর পর পাহাড়ের উপরে গাড়ি যত উঠতে থাকে, রাস্তা ততই আঁকাবাঁকা হয়ে নাড়ি-ভুঁড়ি উল্টানোর যোগাড় করতে থাকে। আব্দুর রহমান ভাই সামলাতে পারলেন না। বমনের দমকে দমকে কাহিল হয়ে পড়লেন। পেটে থাকা সর্বশেষ বিন্দুটিও বোধ হয় উঠে গেল। ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মত সময়টা কাটল তাঁর। রাত ৮টার দিকে ঝিলাম নদীর উপরে ছোট্ট ব্রীজটা ক্রস করে কোহালা চেকপোস্টে এসে গাড়ি থামল। এখান থেকে মুযাফফরাবাদে ঢুকতে হয়। সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড এক এক করে চেক করতে লাগল প্রহরী। আমার বুক ঢিব ঢিব করছে। আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড। তাতে স্পষ্ট করে লেখা-বাংলাদেশী। সর্বশেষ ব্যক্তি হিসাবে কম্পিত হস্তে কার্ডটি এগিয়ে দিলাম। পরিচয়পত্রের দিকে নজর বুলিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখার পর কি ভাবল কে জানে! কিন্তু তার মুখে অর্থপূর্ণ বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। দু’কদম এগিয়ে এসে টর্চলাইটের আলো ফেলল সরাসরি আমার দিকে। হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে তাকাই। চেহারার বিবর্ণতা কি দেখে ফেলল বেটা! রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী বাক্য শোনার জন্য-‘বাহার নেকলে, আপ নেহি জা সাকতে’। একইসাথে পরবর্তী করণীয় ভাবছি ঝড়ো গতিতে। নাহ, ধারণা ভুল হল। বিস্ময়করভাবে বিনা বাক্য ব্যয়ে কার্ড ফেরৎ পেলাম। ইশারা পেয়ে গাড়ীও চলতে শুরু করল। আমি মনে মনে পড়লাম আলহামদুলিল্লাহ। তবে সংশয় কাটল না। সামনে কি আরও চেকপোস্ট আছে? সেখানে আটকাবে না তো!
অবশেষে আর কোন বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই মুযাফফরাবাদ শহরে পৌঁছে গেলাম ফালিল্লাহিল হাম্দ। রাতের আঁধারে চারিদিকে পাহাড় ঘেরা শহরটাকে তারা ঝিলমিল আকাশের মত দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে প্রসন্নচিত্তে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কাশ্মীরভূমে নিরাপদে পৌঁছবার স্বস্তি। স্ট্যান্ডে এসে গাড়ী থেকে নামার পর উমায়ের ভাইয়ের ফোন এল। একটু পর উনি উনার ভগ্নিপতি হেলাল ভাই সহ গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হলেন। অতিশয় ভদ্রলোক উমায়ের ভাই। সেই সাথে অতি সুদর্শন এবং সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত আছেন। তাঁর অতিরিক্ত তা‘যীমে আমি চরম বিব্রতবোধ করি। শহরের অন্য প্রান্তে উনার বাসায় এসে পৌঁছতে রাত ১০টা বাজল। খেতে বসে কাশ্মীরী পদের রান্নায় অনেকদিন পর ঘরোয়া খাবারের স্বাদ পেলাম। তবে খাওয়া শেষে ঐতিহ্যবাহী চিনিবিহীন ‘নামকিন’ চায়ে এক চুমুক দিতেই সব স্বাদ ভুলে যেতে হ’ল মুহূর্তেই। কাশ্মিরীরা এই লবণাক্ত চায়ে কী এমন মজা পায়, তা আমার বোধে আসে না। আগেও ২/৩ বার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই চা পানের। প্রতিবারই ওয়াদা করেছি-আর নয় এই শেষ। কিন্তু সামনে এলে মনে করি এবার বোধহয় স্বাদটা অন্য রকম হবে, দেখিই না এক চুমুক দিয়ে। অতঃপর বিরক্তির সাথে ফের ওয়াদাবদ্ধ হই, ইহ জনমে আর না, ভদ্রতা করেও না। আমার এক সঊদী বন্ধু মুহসিন আমার রুমে আসলে প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে আসে সঊদী ট্রাডিশনাল সবুজ কাহওয়া। সুবহানাল্লাহ! ছোট্ট ছোট্ট কাপে সেকি তিক্ততা। বিস্ময় নিয়ে তার তিক্ত চায়ে চুমুক দেয়া তৃপ্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি মহান আল্লাহর সৃষ্টির কী অনুপম বৈচিত্র্য! একজনের কাছে যা পিত্তসম তিক্ত, অপরজনের কাছে তা মধুসম অমৃত!
রাতে শোয়ার সময় উমায়ের ভাই জানালেন আমরা আগামীকাল ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তরেখা দেখতে যাচ্ছি, যেখান থেকে পাকিস্তানী কাশ্মীর এবং ইন্ডিয়ান কাশ্মীর বিভক্ত হয়েছে। মনটা আনন্দে চঞ্চল উঠে, একইসঙ্গে তটস্থও হয়। লাইন অফ কন্ট্রোলের কাছে বিদেশীদের যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, এমনকি যারা অনুমতি নিয়ে আসে কাশ্মীরে, তাদের জন্যও। উনারা হয়ত সেভাবে জানেন না। আমিও ব্যাপারটি চেপে গিয়ে চুপটি করে রইলাম। দেখিই না কি হয় সামনে। মনে মনে আওড়াই-পথে যখন নেমেই পড়েছ পথিক, পথের শেষ না দেখে ক্ষান্তি দিয়ো না।
পরদিন সকালে ৯টার মধ্যে প্রস্ত্তত হয়ে বের হলাম। হেলাল ভাই তাঁর কারটি নিয়ে সকাল সকালই হাযির হয়েছিলেন। উমায়ের ভাইয়ের ফুটফুটে আদূরে কন্যা ইংলিশ মিডিয়ামের ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া হাফছাও আমাদের সহযাত্রী হ’ল। মুযাফফরাবাদ থেকে উত্তর-পূর্বদিকে অপরূপ সৌন্দর্যের আধার বিখ্যাত নীলাম ভ্যালি। আমাদের গন্তব্য এই নীলাম ভ্যালির বুকের উপর দিয়েই। শহর থেকে বের হওয়ার পথে সবুজের চিহ্ন বিহীন ছাইকালো খাড়া পাহাড়ের মধ্য দিয়ে শুরু হ’ল আমাদের যাত্রা। কাশ্মীর মানেই আমার কল্পনায় পাইন, ফারের ঢেউ খেলানো সবুজ গালিচা, মুক্ত নীল আকাশের নীচে ঝলমলে বরফাবৃত পর্বতচুড়া; গিরিখাদের গহবরে স্বচ্ছ কাঁচপনা লেক আর হর্ষোৎফুল্ল জুনিপার, টিউলিপের রঙ ছড়ানো উপত্যকা। কিন্তু এমন কল্পনায় হোচট খেতে হয় শুরুতেই। কারণ সময়টা এখন ঘোর শীতকাল। গাছ-পালা পত্র-পল্লব বিহীন। যমীনের উপর ঘাসের চিহ্ন নেই প্রায়। পাহাড় গাত্র গাঢ় খয়েরী বা ছাইয়ের মত কালো বর্ণ। কুয়াশার প্রকোপে তা বড্ড স্যাঁতসেতে দেখায়। খানিকটা আশাহতই বোধ করি।
(ক্রমশঃ)