পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩। শেষ পর্ব ।
১.
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সিঙ্গাপুর শাখার উদ্যোগে বেশ কয়েক বছর পর এবার বড় আয়োজনে বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা হ’তে যাচ্ছে জেনে খুশী হলাম। আরো ভাল লাগল যখন জানলাম শায়খ মতীউর রহমান মাদানী (দাম্মাম)-কে সম্মেলনে অতিথি হিসাবে দাওয়াত প্রদান করা হয়েছে। তবে আমাকেও সেখানে আমন্ত্রণ করা হয়েছে জেনে বিশেষ উৎসাহ বোধ করিনি। কেননা গত বছর সিঙ্গাপুরের ভিসার আবেদন করেছিলাম। কোন প্রত্যুত্তর আসেনি। তদুপরি গত মাসেই ঘুরে এসেছি পাকিস্তান। সুতরাং সিঙ্গাপুর হাই কমিশন এক পলকেই আবেদন রিজেক্ট করবে, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তবুও আয়োজক ভাইদের বিশেষ অনুরোধে আবেদন করলাম। অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে ট্রাভেল এজেন্সী থেকে জানাল যে, ই-ভিসা মিলেছে এক মাসের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ। ভিসাপ্রাপ্তিতে নিজে যেমন বিস্ময় বোধ করলাম, তেমনি বিস্মিত হলেন সিঙ্গাপুরের ভাইয়েরাও। ওদিকে শায়খ মতীউর রহমান মাদানীও আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। ফলে কমপক্ষে আমার ভিসা মঞ্জুর হয়েছে জেনে তারা খুব খুশী হলেন।
ইজতেমার পূর্বদিন সকাল ৮.২৫-এ বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে রওয়ানা হলাম ক্ষুদ্র অথচ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ সিঙ্গাপুরের পথে। জানালার পার্শ্বে বসে নীলাকাশের অপরূপ বৈচিত্র্য আর তলদেশে মায়ানমারের পাহাড়ী ভূখন্ড দেখতে দেখতে সম্মেলনে বক্তব্যের বিষয় ঠিক করে নেই। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ। ভাবনার রাজ্যে উঁকি-ঝুঁকি দেয় কতকিছু। দীর্ঘ সোয়া চার ঘণ্টার পথ। আকাশপথ কেন যেন শেষ হতে চায় না। গেল বার পাকিস্তান যাওয়ার পথে এক সহযাত্রীর কথা মনে পড়ে। বিমানযাত্রার একঘেয়ে সময়টার কথা বলতে চমৎকার এক প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। এই যে এত বিশাল একটা যান। অথচ বাতাসের বুকে কোন দৃশ্যমান ভর ছাড়াই কেমন তরতর গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই বাতাসে কি এমন অদৃশ্য শক্তি রয়েছে, যাতে ভর করে কয়েকশ টনী বিমান এতগুলো যাত্রী নিয়ে পাখির মত ভেসে চলেছে! আসমান-যমীনের যিনি মালিক তার সৃষ্টি কৌশল কতই না বিচিত্র! সূরা নাহল ৭৯ আয়াতে আল্লাহ এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘তারা কি লক্ষ্য করে না আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখিদের প্রতি? আল্লাহই ওদেরকে স্থির রাখেন। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য’। যে কোন সময় আল্লাহ চাইলে এই নিয়ন্ত্রণ ছিন্ন হ’তে পারে। অথচ মানুষ আমরা কতই না গাফেল? এমন অরক্ষিত অবস্থাতেও ভ্রুক্ষেপহীনভাবে কত লোক টিভি স্ক্রীনে অশালীন মুভিতে বুঁদ হয়ে আছে। মনে হয় না জীবন ও জগত সম্পর্কে তাদের কোন চিন্তা আছে। ক্ষণকালে মৌজ-মাস্তিতেই এরা জীবনের পরমার্থ খোঁজে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। করুণাময়ের কাছে হেদায়াতের পথে অবিচল থাকার প্রার্থনা করি।
স্থানীয় সময় ২.৪০ মিনিটে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ড করে। আগেই জেনেছি গত ৭ বছর ধরে এটি বিশ্বের সর্বসেরা এবং অন্যতম ব্যস্ত এয়ারপোর্ট হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। সেই হিসাবে যতটা কুলকিনারাহীন হবে ভেবেছিলাম ততটা নয়। সহজেই ইমিগ্রেশনে পৌঁছা গেল। আগে থেকে বার বার সতর্ক করা হয়েছে যে, দাড়ি-টুপি কিংবা পোষাকের কারণে হয়ত বিশেষ চেকিংয়ের শিকার হতে হবে। মানসিকভাবে প্রস্ত্তত ছিলাম। তবে বিস্ময়কর সৌজন্য দেখিয়ে ইমিগ্রেশনে বসা অফিসার কোন প্রশ্নই তুললেন না। নির্বিবাদে পাসপোর্ট ফেরৎ দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
লাগেজ বেল্টে যাওয়ার পথে চোখ আটকায় ডিউটি ফ্রি শপের দিকে। দেওয়ালে বড় করে টাঙানো বিজ্ঞপ্তি- ‘বাই অল দ্যা ওয়াইন ইউ ওয়ান্ট, নো লিমিটস্, নো ট্যাক্স, নো ডিউটিজ্ : ফ্রি হোম ডেলিভারী+ডিউটি ফ্রি এলাউন্স ২ লিটারর্স’। ভাবানুবাদ হ’ল- যত খুশী মদ কেনো, না লাগবে কর, না লাগবে শুল্ক। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ফ্রি। আর সাথে থাকছে আরো দুই লিটার শুল্কমুক্ত মদ’। পাশের দোকানে সাজিয়ে রাখা সারি সারি মদ। কলম্বোতে প্রথমবার যখন মোড়ে মোড়ে মদের দোকান দেখি, তখন অচেনা অনুভূতিতে মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। আজও তার ব্যতিক্রম হ’ল না। অপ্রসন্ন চিত্তে ব্যাগেজ হাতে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সিঙ্গাপুর শাখার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হালীম, উপদেষ্টা মুনীরুল ইসলাম ও মোয়াযযম হোসাইন এবং মাহবুবুর রহমান, সামী ইউসুফ, রাকীবুল ইসলাম, কাওছার হোসাইনসহ বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল ভাই। তাঁদের সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় শেষে মুনীর ভাইয়ের গাড়িতে রওয়ানা হ’লাম শহর অভিমুখে।
চাইনিজ নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে সিঙ্গাপুর সিটিতে এখন ছুটির আমেজ। রাস্তায় যান-বাহনের সংখ্যা বেশ কম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুমসৃণ ক্যানোট ড্রাইভ রোড। চোখ আটকে যায় ফুলের কারুকার্যে ঘেরা পরিপাটি আইল্যান্ডে। দু’ধারে ছাতার মত বিশাল বিশাল বক্রাকার শতবর্ষী রেইনট্রির সারি যেন গাড় সবুজে ঘেরা টানেল তৈরী করেছে। ছোট্ট দেশ বলে দৃষ্টিনন্দন স্কাইক্রাপার্সে ঘিরে আছে আকাশ। তবে উন্মুক্ত সবুজ পার্ক, ফুলেল চত্বরেরও অভাব নেই। বাড়ি-ঘরগুলোর গা বেয়ে সবুজ পাতাবাহার কিংবা অর্কিড ঝুলে রয়েছে। সিঙ্গাপুরে প্রবেশমাত্র সবুজের এই প্রাচুর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
মিনিট বিশেকের মধ্যে সিঙ্গাপুরের প্রসিদ্ধ শপিং মল মোসত্বফা সেন্টারের নিকটস্থ জালান বেসার রোডে হোটেল ক্লাসিকের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায়। এই হোটেলের ৪০৫ নং কক্ষটি আমার ক্ষণিকের আবাস স্থল। লাগেজ রেখে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম হোটেলের অদূরে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশীদের মিলনস্থল বাংলা স্কয়ারে। ছোট্ট এই দেশে প্রায় লক্ষাধিক বাঙালী রয়েছে। প্রতি রবিবার বাঙালীরা এখানে এসে জড়ো হন। মদীনার সুক বাঙ্গালের মত এই রোডের দোকানগুলোতে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা। বাজারের লোকজন অধিকাংশই বাঙালী। বাড়ীঘরগুলো বেশ পুরনো আমলের। বাঙালীদের কারণেই এলাকাটি আবাদ হয়েছে। দুঃখজনক হ’ল, এখানে রাস্তার কোণে আবর্জনা, পানের পিক আর আধা-পোড়া সিগারেটের অস্তিত্ব পাওয়া গেল, যা সিঙ্গাপুরের অন্য কোথাও বিরল। ডেসকার রোডে সামী ইউসুফ ভাইয়ের এক আত্মীয়ের হোটেল ধানসিঁড়িতে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। আশপাশে আরো বেশ কয়েকটি বড় বাঙালী হোটেল আছে। ভর্তা, ছোট মাছের চ্চচড়ি থেকে শুরু করে বাঙালী নানা প্রকার খাবার এখানে পাওয়া যায়। বাংলা স্কয়ারের এই এক টুকরো বাংলাদেশ প্রবাস জীবনে দু’দন্ড প্রাণখুলে কথা বলার উপলক্ষ্য এনে দেয় সিঙ্গাপুরের বাঙ্গালীদের। এক ফাঁকে পার্শ্ববর্তী আঙগুলিয়া মসজিদে যোহর-আছরের ছালাত আদায় করে আসি। তাবলীগ জামা‘আতের মারকায হিসাবে মসজিদটি পরিচিত। এই মসজিদের নাম অনেক শুনেছি সংগঠনের ভাইদের মুখে। একসময় তাঁরা এখানে সাড়ম্বর আয়োজনে সাংগঠনিক প্রোগ্রাম করতেন। তবে মসজিদটি পুনর্নির্মাণের পর এখনও অনুমতি পাননি।
আছরের পর হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই। মাগরিবের পূর্বে ‘আন্দোলন’ সিঙ্গাপুর শাখার উপদেষ্টা যিয়াউল করীম ভাই ও তাঁর স্ত্রী হোটেল রুমে আসলেন। তাঁদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের পর আমরা আঙগুলিয়া মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই এবং সেখানে মাগরিবের ছালাত আদায় করি। এসময় ‘আন্দোলনে’র সভাপতি শফীকুল ইসলাম ভাইসহ আরও বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল ও শুভাকাঙ্খী এসে সাক্ষাৎ করলেন। অতঃপর একসাথে এক ইন্ডিয়ান হোটেলে আমরা চা পান করে সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রাচীন ও জাতীয় মসজিদ সুলতান মসজিদে এশার ছালাত আদায়ের জন্য গেলাম। ১৮২৬ সালে নির্মিত এই মসজিদে একসাথে প্রায় পাঁচ হাযার মুছল্লী ছালাত আদায় করতে পারে। একসময় এই মসজিদে সংগঠনের নিয়মিত প্রোগ্রাম করার অনুমতি ছিল। দোতলার নির্দিষ্ট স্থানে কখনও প্রোগ্রামে পাঁচ শতাধিক লোকেরও উপস্থিতি হ’ত। তবে বর্তমানে নতুন কমিটি আসায় নিরাপত্তার অজুহাতে সে সুযোগ বন্ধ রয়েছে। ছালাত আদায়ের পর মুনাজাত ও উচ্চৈঃস্বরে যিকির-আযকার হ’ল। অতঃপর ইমাম ও মুওয়াযযিন উভয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে সুর করে দরূদ পাঠ করতে লাগলেন। অপরদিকে কিছু মুছল্লী দাঁড়িয়ে তাঁদের সামনে চক্রাকারে তাওয়াফের ভঙ্গিমা করেন। এমন বিদ‘আতী রীতি ইতিপূর্বে কোথাও দেখিনি। সেই সাথে মালয়ী সংস্কৃতি মোতাবেক সালামের পর পার্শ্ববর্তী মুছল্লীর সাথে মুছাফাহা করার রীতি তো আছেই। আমার মনে হ’ল, যেহেতু ছালাত শেষে উভয় পার্শ্বে সালাম ফিরানো হয়, তাই সালাম শেষে মুছাফাহা করার এই রীতি তারা চালু করেছেন। কুসংস্কার ও জাহেলিয়াতে মুসলিম সমাজ যে কিভাবে ভরে গেছে, তা দেখলে অবাক হ’তে হয়। এসব থেকে বোঝা যায়, রাসূল (ছাঃ) বিদ‘আতের বিরুদ্ধে কেন এত কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
সুলতান মসজিদ পরিদর্শন শেষে মসজিদ চত্বরে আমরা পরবর্তী দিন সম্মেলনের কার্যক্রম বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করি। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে আমরা আবার ধানসিঁড়ি হোটেলে এসে রাতের খাবার খাই। এসময় সিঙ্গাপুর প্রবাসী আমার মামা শ্বশুর তথা স্ত্রীর ছোট মামা হোটেলে এসে উপস্থিত হন এবং আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর রাত ১১টার দিকে ক্লাসিক হোটেলে ফিরলাম।
২.
সুলতান মসজিদ সংলগ্ন এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত। পার্শ্ববর্তী রোডগুলোর নাম আরব রোড, মাসকাট রোড, বাগদাদ রোড, কান্দাহার রোড ইত্যাদি, যা এখানে মুসলিম ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। সিঙ্গাপুরে মাত্র এই মসজিদেই মাইকে উন্মুক্ত আযান হয়। সাথে একটি আবাসিক মাদরাসা রয়েছে, যদিও শিক্ষার্থীদের দেখা পেলাম না। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনেইয়ের মত সিঙ্গাপুরও একটি মুসলিম দেশ ছিল। ১৫০০ থেকে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এটি মালাক্কা এবং জোহর মুসলিম সালতানাতের অংশ ছিল। অতঃপর দেশটি বৃটিশদের করতলগত হয় এবং শরী‘আহ আইন রদ করে দেয়া হয়। এ সময় ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রচুর চায়নিজ এদেশে অভিবাসী হয়ে আসে। এছাড়া থাইল্যান্ড, মিয়ানমার থেকেও বৌদ্ধরা আগমন করতে থাকে। ফলে একসময় দেশটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হয়। বর্তমানে মোট ৫৬ লক্ষ জনসংখ্যার প্রায় ৩৩% বৌদ্ধ। দখলদারিত্ব ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে বৃটিশরা ১৯৬৩ সালে দেশটিকে মালয়েশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে দিয়ে যায় কম্যুনিজমের উত্থান ঠেকাতে। পরে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হ’লে ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া দেশটিকে বহিষ্কার করে এবং সিঙ্গাপুর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন মালয়ী বংশোদ্ভূত মুসলমান ইউসুফ বিন ইসহাক। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী হন সিঙ্গাপুরের স্থপতি খ্যাত চাইনিজ বংশোদ্ভূত লি কুয়ান ইউ। যিনি তাঁর ত্রিশ বছরের শাসনকালে মাত্র ৭০০ বর্গকিলোমিটারের এই ক্ষুদ্র দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর অর্থনীতির দেশে পরিণত করেন। ব্যাপকভাবে নগরায়িত হওয়ার কারণে এই ক্ষুদ্রতা এখন বোঝার উপায় নেই। প্রতিটি জমিই এখানে কাজে লাগানো হয়েছে। তাছাড়া প্রতিবছরই সমুদ্রে ভরাট ফেলে দেশটির আয়তন অল্প অল্প করে বাড়ানো হচ্ছে।
বহু সংস্কৃতির দেশ সিঙ্গাপুর। একই স্থানে শিখ, হিন্দু কিংবা বৌদ্ধদের উপাসনালয়ের পাশাপাশি মসজিদ দেখা যায়। রাস্তাঘাটে একই সময়ে নানা বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষের চলাফেরা দেখে বুঝার উপায় নেই যে, কারা এখানকার মূল বাসিন্দা। তবে প্রধান ভাষা ইংরেজী হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। পথে-ঘাটে সচরাচর চোখে পড়ে সিংহের মূর্তি। প্রাচীন কাহিনী মতে, একবার সামুদ্রিক ঝড় থেকে তাদের বাঁচিয়ে দেয় মারলিন তথা সিংহ-মৎস আকৃতির একটি পৌরাণিক প্রাণী। সেই থেকে এই সিংহ-মৎস্য তাদের গর্বের প্রতীক। এজন্য নগরীর প্রাণকেন্দ্রে মারলিনের একটি মূর্তি তারা বানিয়ে রেখেছে যার মুখ থেকে অবিরাম পানির ফোয়ারা নির্গত হয়। সিঙ্গাপুরের সিঙ্গা শব্দটিরও জন্ম সংস্কৃত শব্দ ‘সিংহ’ থেকে। অর্থাৎ সিংহদের রাজ্য।
দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা বর্তমানে মাত্র ১৫%। তবে সমাজে তাদের উপস্থিতি ও প্রভাব বেশ চোখে পড়ার মত। নেপালের পর সিঙ্গাপুরই একমাত্র অমুসলিম দেশ যেখানে ইসলামের চিহ্ন হিসাবে জাতীয় পতাকায় চাঁদের ব্যবহার রয়েছে। প্রায় ৮০টির মত মসজিদ রয়েছে ছোট্ট এই দেশটিতে এবং সব মসজিদই চমৎকার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। রয়েছে ৬টি বড় মাদরাসাসহ ছোট ছোট অনেক মাদরাসা ও ইসলামিক স্কুল। মজলিস উলামা ইসলাম সিঙ্গাপুর (মুইস) নামে একটি সরকার অনুমোদিত সংস্থা এই মসজিদ ও মাদরাসাগুলো পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করে। সিঙ্গাপুরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন মহিলা ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত মুসলিম হালীমা ইয়াকুব। মুসলমানরা সিংহভাগ শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী হ’লেও হানাফীও রয়েছে, যারা মূলতঃ দক্ষিণ এশীয়। এছাড়া শী‘আ, বাহাই, আহমাদিয়াদেরও স্বল্প উপস্থিতি রয়েছে।
৩.
সিঙ্গাপুরে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাসও বেশ পুরনো। বেশ কয়েকটি সালাফী মসজিদ ও মাদরাসা সেখানে রয়েছে। সালাফীরা এদেশে মুহাম্মাদী নামে পরিচিত। তাদের পরিচালিত দাওয়াতী কার্যক্রম ‘মুহাম্মাদিয়া মুভমেন্ট’ নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক যুগে চল্লিশের দশকের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা থেকে রিজাল আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান হারূন এবং আমীর ঈসা নামক তিনজন দাঈ সিঙ্গাপুরে আগমন করেন এবং বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসায় শিরক ও বিদ‘আতবিরোধী দাওয়াত প্রচার শুরু করেন। তারা সমাজে প্রচলিত মীলাদ সহ নানা কুসংস্কার ও তাক্বলীদের বিরুদ্ধে মানুষকে সজাগ করতে থাকেন। কিন্তু স্থানীয় শাফেঈ আলেমগণ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক রেওয়াজ সংস্কারের এই দাওয়াতকে ভালভাবে নেননি, বরং তাদেরকে কাদিয়ানী এবং মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারী আখ্যা দিয়ে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলেন। এর প্রেক্ষিতে উপরোক্ত তিনজন দাঈ তাদের অনুসারীদের পরামর্শে ১৯৫৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ‘পেরসাতুয়ান মুহাম্মাদিয়া সিঙ্গাপুর’ বা ‘মুহাম্মাদিয়া এসোসিয়েশন সিঙ্গাপুর’ নামে একটি সালাফী সংগঠনের জন্ম দেন এবং ১৯৫৮ সালের ২রা সেপ্টেম্বর এটি সরকারী স্বীকৃতি পায়। ১৩ সদস্যের মূল কমিটিসহ মোট ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তৎকালীন বৃটিশ গোয়েন্দারা এই সংগঠনের কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণ করছিল এবং এটিকে সঊদী আরবের ওয়াহহাবী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বলে আখ্যা দিয়েছিল। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতারা ঘোষণা করেন যে, সিঙ্গাপুর দারুল ইসলামও নয়, দারুল হারবও নয়; বরং এটি দারুদ দাওয়াহ তথা দাওয়াত প্রচারের স্থলান। রিজাল আব্দুল্লাহ ছিলেন এই সংগঠনের প্রথম প্রেসিডেন্ট (১৯৫৮-৫৯খ্রি.)। অতঃপর উছমান তাইয়েব (১৯৫৯-৬০ খ্রি.), হুসাইন তাইয়েব (১৯৬০-৬৩খ্রি.), আব্দুর রহমান হারূন (১৯৬৩-৮৩খ্রি.), শায়খ হুসাইন ইয়াকুব (১৯৮৩-২০০১খ্রি.), আব্দুস সালাম সুলতান প্রমুখ ধারাবাহিকভাবে এই সংগঠনের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁদের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরে সালাফী আন্দোলন বলিষ্ঠভাবে প্রসার লাভ করে। তাঁরা আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মুকাবিলায় কুসংস্কারমুক্ত এবং তাওহীদ ও সুন্নাহভিত্তিক ইসলামী সমাজ উপহার দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, যা সিঙ্গাপুরের সচেতন ও শিক্ষিত মুসলমানদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। এই সংগঠনের যুব শাখাও ছিল যারা ‘পেমুদা মুহাম্মাদিয়া’ নামে কাজ করত। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের সাবেক ছাত্র যুলফিকার মুহাম্মাদ এবং আহমাদ খালিছ আব্দুল গণী আশি-নববইয়ের দশকে এই যুব সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। সরকারী সংগঠন ‘মুইস’-এরও সদস্য হিসাবে এই সংগঠনের দায়িত্বশীলগণ ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও সংগঠনটি আভ্যন্তরীণ সংকট এড়াতে পারেনি। ফলে সংগঠনটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন নামে আরও কিছু সালাফী সংগঠন গড়ে উঠেছে। যেমন ১৯৮০ সালে আনছারুস সুন্নাহ, ১৯৯৭ সালে পেরসাতুয়ান ইসলাম সিঙ্গাপুর, ২০০৪ সালে পেরসাতুয়ান আল-কুদওয়াহ প্রভৃতি। তবে এতে মূল সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি।
১৯৯৫ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরে সালাফী আন্দোলন যথেষ্ট
জনসমর্থন লাভ করে এবং এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ২৫০০০ ছাড়িয়ে যায়। আশির দশকে
কামবাঙ্গানে এই সংগঠনের মূল কার্যালয় স্থাপিত হয়। আশি ও নববই দশকের এই
সময়টি ছিল সিঙ্গাপুরে ইসলামের পুনর্জাগরণকাল এবং বিশেষ করে সালাফী
আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। নিয়মিত কনফারেন্স, সেমিনার ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে
দাওয়াতী কার্যক্রম ব্যাপক গতিশীলতা লাভ করে। এ সময় মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যয়নের জন্য অনেক ছাত্র পাঠানো হয়, যারা দেশে ফিরে দাওয়াতী কার্যক্রমে
যুক্ত হন। এই সংগঠনের অধীনে বেশ কিছু মাদরাসা ও দাতব্য চিকিৎসালয়সহ
সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে মাদরাসাতুল আরাবিয়া
আল-ইসলামিয়া নামে একটি মাদরাসা গড়ে তোলা হয়, যেখানে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক
পর্যন্ত পড়ানো হয়। অতঃপর ২০০০ সালে গেলাং-এ ‘কলেজ ইসলাম মুহাম্মাদিয়া’
(KIM) বা মুহাম্মাদিয়া ইসলামিক কলেজ নামে একটি উচ্চতর কলেজ প্রতিষ্ঠা করা
হয়, যেটি সরকারীভাবে স্বীকৃত। এখানে ডিপ্লোমাসহ ইসলামী শিক্ষার উপর ৪ বছরের
উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বর্তমানে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসাবে
দায়িত্ব পালন করছেন জনাব মুহাম্মাদ আজরী আজমান।[1]
তবে সমালোচকদের মতে ষাটের দশকে যে আবেদন ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল, বর্তমানে তা অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে যোগ্য ও গতিশীল নেতৃত্বের অভাবে। ফলে সংগঠনটির কার্যক্রম বর্তমানে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, যা এর দাওয়াতী কার্যক্রম অনেকটা শিথিল করে ফেলেছে।
অন্যদিকে সিঙ্গাপুরে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে বেশী দিন হয়নি। ইতিপূর্বে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াতী কাজ চললেও ২০০৯ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর ঈদুল ফিৎরের দিন বগুড়ার মোয়াযযম হোসাইন, কুমিল্লার আব্দুল হালীম, পটুয়াখালীর মাযহারুল ইসলাম, কুষ্টিয়ার আব্দুল মুকীত ও টাঙ্গাইলের আব্দুল আযীয প্রমুখের উদ্যোগে সিঙ্গাপুরে সর্বপ্রথম সংগঠনের শাখা গঠিত হয়। অতঃপর নিয়মিতভাবে সাংগঠনিক প্রোগ্রাম শুরু হ’লে বাঙ্গালীদের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে। তখন সুলতান মসজিদ ও আঙগুলিয়া মসজিদে নিয়মিত প্রোগ্রাম হ’ত। বিশেষতঃ আঙগুলিয়া মসজিদ ছিল মূল কেন্দ্র। এসব প্রোগ্রামে উপস্থিতি কখনও ৫/৬ শতাধিক পর্যন্ত হ’ত এবং প্রতিদিনই শ্রোতাদের কেউ না কেউ আহলেহাদীছ হ’তেন। এমনকি এক অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৪৫ জন পর্যন্ত আহলেহাদীছ হন। বিরোধীরা নানামুখী বাধার সৃষ্টি করলেও সংগঠনের দাওয়াতী কাজ
স্তিমিত হয়নি। বরং আল্লাহর অশেষ রহমতে এর মাধ্যমে বহু ভাই বিশুদ্ধ আক্বীদা ও মানহাজ গ্রহণ করে আহলেহাদীছ হয়ে যান এবং তাদের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দাওয়াত পৌঁছে যায়। শুধু তাই নয় এর মাধ্যমে অনেক নতুন কর্মী ও দাঈ তৈরী হ’তে থাকে, যারা ময়দানে নেমে যথেষ্ট দক্ষতার সাথে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করছিলেন। এর মধ্যে হঠাৎ করেই সংগঠনের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয় যখন ২০১৬ সালে কিছু অর্বাচীন বাঙ্গালী যুবক চরমপন্থী চিন্তাধারায় যুক্ত হয়। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে চরম ধৈর্য ও সাহসের পরিচয় দিয়ে দায়িত্বশীলরা প্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ফলে সেই দুর্যোগ মুহূর্ত কেটে উঠা সম্ভব হয় এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পূর্ণোদমে চালু হয়। বর্তমানে সিঙ্গাপুরের উডল্যান্ড, চুয়া চুকান, জুরং ইস্ট, গেলাং, কাকি বুকিত, পঙ্গল, তোয়াজ প্রভৃতি স্থানে ‘আন্দোলনে’র শাখা রয়েছে এবং প্রতিটি শাখায় নিয়ম মাফিক আলোচনা বৈঠক ও তাবলীগী ইজতেমা হয়ে থাকে। এছাড়া বার্ষিক ছুটির দিন ও রামাযান সহ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বড় ধরনের তাবলীগী ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এভাবে সিঙ্গাপুরে ‘আন্দোলনে’র দাওয়াতী কার্যক্রম যথেষ্ট গতিশীলভাবে চলমান রয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ।
(ক্রমশঃ)
[1]. তথ্যসূত্র : www.muhammadiyah.org.sg; Syed Muhd Khairudin Aljunied, The ‘other’ Muhammadiyah movement: Singapore 1958–2008, Journal of Southeast Asian Studies, 42(2), pp. 281–302, June 2011 (The National University of Singapore).