গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহের কোন এক পড়ন্ত বিকেলে রাজশাহীতে
‘মাসিক আত-তাহরীক’ চত্বরে আনমনা হয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন
বাংলাদেশ’, কুমিল্লা যেলার সভাপতি মাওলানা ছফিউল্লাহ ভাই মোবাইল করে
জানালেন মালদ্বীপ প্রবাসী তাঁর এক চাচাতো ভাই ‘যুবসংঘ’-এর কর্মী ফায়ছাল তার
সহযোগীদের নিয়ে মালদ্বীপের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাভাষী ভাইদের
জন্য এক সংক্ষিপ্ত দাওয়াতী কর্মসূচীর আয়োজন করতে যাচ্ছে। কথাটা শুনেই কেমন
যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। মালদ্বীপ নামক দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীরা আছেন,
এমনকি সেখানে আহলেহাদীছরাও যথেষ্ট সংখ্যক আছে এ ব্যাপারে আমার কোন
পূর্বধারণা ছিল না।
কিছুক্ষণ পরেই মালদ্বীপ থেকে ফায়ছাল ভাইয়ের ফোন পেলাম। আমাকে এবং মাওলানা আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফকে দ্বীপদেশ মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে দাওয়াতী সফরে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমে কাজ এগিয়ে চলল। মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই মহান আল্লাহ পাকের অপার অনুগ্রহে এবং মালদ্বীপ প্রবাসী আহলেহাদীছ ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আনুসঙ্গিক কাজ মোটামুটি সম্পন্ন হ’ল। কয়েকদিন থেকে ঢাকাতেই অবস্থান করছিলাম। ফলে সময় স্বল্পতায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে বিদায় নেয়ার সুযোগ হ’ল না। অগত্যা মোবাইলের মাধ্যমে বিদায় আরয করলে প্রবীণ এই দেশবরেণ্য জ্ঞানতাপস তাঁর স্বভাবসূলভ ভাষায় হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে আবেগ আপ্লুত কন্ঠে মর্মস্পর্শী নছীহতের মাধ্যমে বিদায় দিলেন। বারাকাল্লাহু ফী হায়াতিহি-আমীন!
রাজশাহী থেকে সফরসঙ্গী বন্ধুবর মাওলানা আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ ঢাকায় উপস্থিত হ’লেন। অতঃপর পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী ৭ই জুলাই’১৩ মঙ্গলবার দুপুর দু’টার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করে মালদ্বীপ এয়ারওয়েজের বিশাল বোয়িং-এ চড়ে বসলাম। বিকাল তিনটায় বিমান উড়ল। সফর নিয়ে নানা ভাবনা জেঁকে বসল অন্তরে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনার রাজ্যে মিশে গেলাম।
প্রায় ৩ ঘণ্টার উড়ুক্কু যাত্রা শেষে ভারতের চেন্নাই (মাদ্রাজ) এয়ারপোর্টে নামলাম। ঘণ্টাখানেক বিরতির পর আমাদের গন্তব্য মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। প্রায় দুই ঘণ্টা উড়ার পর নামলাম ভারত মহাসাগরের বুকে ছবির মত সাজানো ছোটবড় ১২০১টি দ্বীপের সাম্রাজ্য মালদ্বীপে।
যার ইতিহাস আমাদের সফর শুরুর আগেই মুহতারাম আমীরে জামা’আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের ডক্টরেট থিসিস থেকে পড়ে এসেছিলাম। ভারত মহাসাগরীয় ক্ষুদ্র এ দেশটিতে আরব বণিকদের অবাধ যাতায়াত ছিল। ফলে এখানকার জনসংখ্যার শতভাগই মুসলমান। ঐতিহাসিকদের মতে লৌহ, তাম্র, রৌপ্য, আলকাতরা ইত্যাদি ধাতুর আধিক্য থাকার কারণে আরবগণ এই দ্বীপাঞ্চলকে ‘জাযীরাতুল মুহল’ বলত। সংস্কৃত ভাষায় ‘জাযীরাহ’-কে ‘দীব’ বলা হয়। ফলে আরব-সংস্কৃত মিশ্রিত ‘মুহলদীব’ পরবর্তীতে ‘মালদ্বীপ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই ক্ষুদ্র দেশটির আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা বর্তমান তিন লক্ষের কিছু বেশী। রাজধানী মালের নিকটবর্তী হুলহুলে দ্বীপে অবস্থিত মালে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বিমানবন্দরে নেমে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে আসলাম। মালদ্বীপ সরকার ও সেদেশের জনগণের আক্বীদা-বিশ্বাস কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মুতাবিক হওয়ার কারণে আহলেহাদীছদেরকে তারা খুবই সম্মানের চোখে দেখে থাকেন। এজন্য আমাদের পরিচয় পেয়ে তারা মোটেও সময় নিল না। অথচ আমাদের সফরের সামান্য কয়েকদিন পূর্বে আমাদের দেশের একজন প্রসিদ্ধ বিদ‘আতী বক্তা মালদ্বীপ গেলে তাকে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকিয়ে রাখা হয়েছিল এই বিমানবন্দরে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগেই সাক্ষাৎ পেলাম নরসিংদীর শরীফ ভাইয়ের। তার সাথে ফরীদপুরের কামরুল হাসান বিপ্লব ভাই সহ আরও কয়েকজন ভাইয়ের উষ্ণ অভিবাদনে আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে দেশ ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। দ্বীপ দেশ বলে চারিদিকে পানি আর পানি। স্পীডবোটই বোধহয় এ দেশের মূল যাতায়াত বাহন। হুলহুলে থেকে রাজধানী শহর মালে যেতে সাগরপথে বেশ কিছু পথ পাড়ি দিতে হয়। তাই মালে যাওয়ার জন্য দ্রুতগতিসম্পন্ন এক স্পীডবোটে চড়ে রওনা করলাম। নীল পানিরাশি কেটে কেটে আমাদের স্পীডবোট এগিয়ে চলল। দূরে সাজানো গোছানো মালে শহরের উঁচু ঊঁচু ভবন পরিদৃষ্ট হচ্ছে। অবশেষে ফেরী টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম। পূর্ব থেকেই সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষমান ছিলেন দ্বীনী ভাই আবুল হাশিম। তার কফীল মালদ্বীপের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তাকে গাড়ীসহ পাঠিয়েছেন আমাদের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার জন্য।
শহরের উপকণ্ঠে হোটেল এভিলায় পেঁŠছে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাতের খাবার সেরে প্রোগ্রামের ভেন্যু ‘ইস্কিন্দার’ স্কুল অডিটোরিয়ামে পেঁŠছলাম। সেখানে গিয়ে শত শত বাংলাভাষী ভাইদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদেরকে কী পরিমাণ যে আনন্দ দিয়েছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মুছাফাহার সাথে আবার কেউ কেউ হাতের মধ্যে গুঁজে দিচ্ছিলেন নানান ধরনের হাদিয়া-তোহফা। সত্যিই আমাদের দেশের মানুষ দ্বীনকে ভালবাসে মনে-প্রাণে। যদিও তাদের মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের আক্বীদা ও আমলগত দুর্বলতা ও অজ্ঞতা। কিন্তু আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই। টিভি আর ইন্টারনেটের পর্দায় দেখা আপনজনকে বিদেশের মাটিতে সরাসরি এত কাছে থেকে দেখতে পেয়ে তাদের অনুভূতিই ছিল আলাদা। এই তো সেই মাওলানা আব্দুর রাযযাক ছাহেব, যার বলিষ্ঠ বক্তব্য শুনে শত শত যুবক দাড়ি রেখেছে, ফুলপ্যান্ট কেটে-ছেঁটে টাখনুর উপরে পরেছে, শিরক ও বিদ‘আতের কুহেলিকা থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনেছে-আজ তিনি স্বয়ং তাদের সামনে উপস্থিত।
প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপী প্রোগ্রাম শেষ করে হোটেলে ফিরে এলাম। জনৈক দ্বীনী ভাই তার নিজের দু’টি মোবাইল রেখে গেলেন আমাদের কথা বলার সুবিধার্থে। ক্লান্ত শরীরে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙালেন কামরুল হাসান ভাই। সাথে এসেছেন বেলাল ভাই, ইলিয়াস ভাই এবং নাম না জানা আরও অনেকে। ইলিয়াস তো নাছোড়বানদা। ওর সেলুনে গিয়ে আমাদের একটু হ’লেও সময় দিতে হবে। অবশেষে দোকানে নিয়ে ও নিজ হাতে আমাদের চুল ছেঁটে দিতে পেরে যেন সাত রাজার ধন হাতে পেয়ে গেলো। হাতে সময় খুবই কম। তাই দ্রুততার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর নাশতা সেরে রাজধানী শহর দেখার জন্য বের হ’লাম। ঢাকার সদরঘাটের মতই দু’টি ফেরী টার্মিনাল। দেখলাম কবুতর চত্বর, সেখানে বাংলাদেশী ভাইয়েরা প্রবাস জীবনের একঘেঁয়েমী কাটানোর জন্য জড়ো হন। এ দেশে প্রবাসী বাঙালীর সংখ্যা ৭০ হাযারের মত। অর্থাৎ সেখানে বসবাসকারী জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশই বাঙালী। যাদের একটি বড় অংশ আবার অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছে। সেদেশের নৌবাহিনীর জোয়ানেরা সাগরের পাড়ে সাঁতার কাটছিলেন। তাদের সাথে কুশল বিনিময় হ’ল। সবজী মার্কেটে প্রবেশ করে বাংলাদেশী ভাইদের সাথে কুশল বিনিময় হ’ল। চাঁদপুরের আলমগীর নামক জনৈক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি খুবই খুশী হয়ে বললেন, এ প্রোগ্রামের জন্য আমি আমার এ মার্কেটের দ্বীনী ভাইদের নিকট থেকে অনুদান কালেকশন করে দিয়েছি। কুমিল্লার দাউদকান্দির মাহফূয ভাই অতীব উৎফুল্ল চিত্তে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। মনে হচ্ছিল এ দাওয়াতী কাজ করতে পেরে যেন তিনি বিশ্বজয় করে ফেলেছেন।
শহর ছেড়ে আবার ফেরী টার্মিনালে আসলাম। তারপর ট্রলারে চড়ে রওনা করলাম ভিলিঙ্গিলি দ্বীপের উদ্দেশ্যে। ট্রলারের ভেতর যানবাহনে আরোহণের দো‘আ লেখা ছিল। মাওলানা আব্দুর রাযযাক ছাহেবকে আর রুখে কে? তিনি বললেন, ‘এই শোন! ঐ ট্রলারের চালককে বল, এটা নৌকারোহনের দো‘আ নয়!’
চারিদিকে নীল পানিরাশির মধ্যখানে মনোরম গাছগাছালীতে পরিপূর্ণ দ্বীপটি দেখে অন্তর জুড়িয়ে গেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারিদিকে আকন্দ (দুধরাজ), ঝাউগাছ আর যায়তুনের মত এক প্রকার গাছ। সাগরের পানিতে ওযূ করলাম। আরব সাগর কিংবা লোহিত সাগরের তুলনায় পানি একটু কম লবণাক্ত মনে হ’ল। সাগরের পাড়ে পর্যটকদের জন্য বড় গাছের সাথে দোলনা বাঁধা ছিল। সেটা দেখে একটা কৈশরিক আবেগ উছলে উঠল অন্তরে। আহা... কতদিন সুযোগ পাই না এমন দোল খাওয়ার। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসলাম শহরে।
হোটেলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হ’লাম ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে। মন্ত্রী মহোদয় সেসময় প্রেসিডেন্ট হাউজে মিটিংয়ে ছিলেন বলে সাক্ষাৎ পেলাম না। তাঁর পিএস জনাব হাসান তাওফীক আব্দুর রহমান ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে মুহতারাম আমীরে জামা’আতের পাঠানো হাদিয়া তাঁরই অমর কীর্তি ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন আন্দোলন কি ও কেন?’ (ইংরেজী ভার্সন) হস্তান্তর করলাম। আর সেখানেই সাক্ষাৎ হ’ল মালদ্বীপের গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল লতীফের সাথে।
প্রটোকল বিহীনভাবে মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে এসে সেদেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব ইব্রাহীম শিহাবের বাসায় মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করলাম। আমাদের দ্রুত ভিসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই ভদ্রলোকেরই মুখ্য ভূমিকা ছিল। ভদ্রলোকের সাথে খাওয়ার সময় ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে কথা হ’ল, যা আমার খাওয়ার রুচিকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি আবার ভোজন বিলাসী, মাওলানা আব্দুর রাযযাক ছাহেব তা ভাল ভাবেই জানেন। জনাব হাফীযুর রহমান ছাহেবের বাসায় দাওয়াত খাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে। তাই তিনি আমাকে বিশেষ ছাড় দিয়েছিলেন।
সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেই জানতে পারলাম মন্ত্রী মহোদয় জনাব শাহীম আলী সাঈদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাই দ্রুত পেঁŠছে গেলাম তাঁর চেম্বারে। প্রবেশ করা মাত্রই তিনি এগিয়ে এসে আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানালেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়েই লেখাপড়া করেছেন। তাই আহলেহাদীছদের সম্পর্কে তাঁর খুব উচ্চ ধারণা। দাওয়াত দিলাম তাঁকে বাংলাদেশে আহলেহাদীছদের বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমায় আসার জন্য। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন। মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের নাম শুনে তিনি চিনতে পারলেন এবং সাগ্রহে তাঁর বইগুলো হাতে নিয়ে দেখলেন। সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি আমাদের সাথে যে আন্তরিকতার পরিচয় দিলেন তা ছিল সত্যিই অভূতপূর্ব। তিনি জানালেন যে, বিদ‘আতীদের আমরা কখনই এ দেশে বরদাশত করব না। আশা করছি তোমরা মাঝে মাঝে আমাদের দেশে আসবে। তাহ’লে তোমাদের দেশের মানুষ যারা এখানে অবস্থান করছে তারাও শিরক ও বিদ‘আত থেকে ফিরে আসতে পারবে। এত বড় দায়িত্বশীলকে আর বেশী বিরক্ত করা যায় না। তাই বিদায়ের পালা। পরিশেষে আমাদের প্রোগ্রামে থাকার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। জানালেন রাতের ফ্লাইটে তাঁকে দেশের বাইরে সফরে যেতে হবে। আগামী বছর মালদ্বীপে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র প্রোগ্রাম হ’লে তাঁকে অবশ্যই উপস্থিত থাকার জোর আবেদন রেখে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
সেখান থেকে বের হয়ে আরেক দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। দ্বীপের নাম হুলহুমালি। ট্রলারকে মালদ্বীপের স্থানীয় দিভেহি ভাষায় ‘ধনী’ বলা হয়। ধনীতে চড়ে দ্বীপে নামলাম। শরীফ ভাইয়ের মোটরবাইকে অল্প সময়ে দ্বীপটি দেখার সুযোগ হ’ল। এই দ্বীপ থেকে স্থলপথে হুলহুলের এয়ারপোর্টে যাওয়া যায়। মোটরবাইকের ব্যাপক প্রচলন থাকা সত্ত্বেও এই দ্বীপে বড় বড় বাস দেখতে পেলাম, যা অন্যান্য দ্বীপে দেখা যায়নি। বড় বড় বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে। এ দ্বীপও প্রচুর গাছপালায় ঘেরা। মাগরিবের ছালাতের পর হুলহুমালি দ্বীপ ত্যাগ করলাম। এশা পড়লাম সেই ঐতিহাসিক বায়তুল ইয্য মসজিদে। যেখানে ইতিপূর্বে ‘মাদরাসাতুত ত্বাইয়েবাহ’ নামক আহলেহাদীছ মাদরাসা ছিল। সে ইতিহাস আমীরে জামা‘আতের থিসিসে আগেই পড়েছিলাম। ইমাম ছাহেব মাওলানা ইসমাইল মাদানীর সাথেও সাক্ষাৎ হ’ল, যার কথা আমীরে জামা‘আত থিসিসে উল্লেখ করেছেন। তবে তার ব্যস্ততা এবং আমাদেরও ব্যস্ততার কারণে বিস্তারিত কথা বলার সুযোগ হ’ল না। সেখান থেকে বের হয়ে ‘হিরিয়া’ স্কুলের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করলাম। বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্রাধিক বাঙালী উপস্থিত হয়েছে এখানে। প্রশ্নোত্তর পর্বে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন মাওলানা আব্দুর রায্যাক। এ প্রোগ্রাম শেষে শরীফ আহমাদ (নরসিংদী) সভাপতি এবং কামরুল হাসান বিপ্লব (ফরিদপুর) ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ মালদ্বীপ শাখা কমিটি গঠন করা হ’ল। মাওলানা আব্দুর রায্যাক সমাবেশ শেষে জনসম্মুখে তাদের নাম ঘোষণা করলেন। উল্লেখ্য যে, মালদ্বীপের মাটিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে এটাই ‘আন্দোলন’-এর প্রথম গঠিত শাখা। ফালিল্লাহিল হাম্দ। ‘আন্দোলন’, ‘যুবসংঘ’ ও ‘সোনামণি’ গঠনতন্ত্রের কপিগুলি সহ কেন্দ্র থেকে পাঠানো অন্যান্য বই তাদেরকে হাদিয়া দিয়ে এলাম।
রাতে সামান্য ঘুমের পর সকালে বিদায়ের পালা। একে একে বিদায় নিলাম সবার কাছ থেকে। দ্বীনী বন্ধন যে কত মযবূত হয়, তাওহীদী প্রেরণা যে কত গভীর হয়, আক্বীদা ও ঈমানের ভ্রাতৃত্ব যে কত অটুট হয়, তা মাত্র দু’দিনের এ সফরে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম। কত কথা যে মনের বেণুবনের প্রান্তে প্রান্তে উথাল-পাথাল করে ফিরছিল, তা যদি কবি সাহিত্যিক হ’তাম, তবে অবশ্যই প্রকাশ করতে পারতাম। আর একটা কথা বলতেই হয় দু’দিনের সফরে কোথাও কোন মাযার কিংবা শিরক-বিদ‘আতী কার্যক্রম দেখিনি। বরং তাওহীদ ও সুন্নাতের ব্যাপক চর্চা দেখে বার বার সঊদী আরবের কথাই মনে হচ্ছিল।
বিমানবন্দরে ঢুকে ইমিগ্রেশন পার হ’তেই হতবাক হ’লাম। কয়েকজন যুবক আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন। তারাও বাঙ্গালী মায়ের সন্তান। এ দেশের এয়ারপোর্টে ডিউটি-ফ্রী শপে কাজ করেন তারা। গত রাতের প্রোগ্রামে দেখা মেহমানদ্বয়কে তাদেরই সামনে দিয়ে বিমানে উঠতে দেখে একান্তে কথা বলার সুযোগ পেয়ে তারা আবেগাকুল হয়ে পড়ল। বিমানে উঠে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান উড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে। চেন্নাইয়ের বিরতি সহ প্রায় ছয় ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের বিমান ঢাকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করল। বিমানবন্দরে নেমেই শুনতে পেলাম এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফরীদা ইয়াসমীনের ইন্তেকাল। আববা-আম্মা উভয়েরই অসুস্থতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। দ্বীনের কাজে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অনেক ধৈর্যধারণ করতে হয়। তাই দুঃখ-শোক সবকিছু বুকে চেপে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। এয়ারপোর্টে আগে থেকেই আমাদের ইয়াসীন ভাই অপেক্ষা করছিলেন গাড়ি নিয়ে। নাছোড়বান্দা ইয়াসীন ভাইয়ের বাসায় দুপুরের খানা খেতেই হবে, তাই তাঁর বাসায় গেলাম। আরও কত কিছু লিখতে মন চাচ্ছিল। কিন্তু এই রামাযানের মুহূর্তে আর কিছুই মনে পড়ছে না। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে কবুল করুন- আমীন!
মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল (পাবনা)
খতীব, মাদারটেক আহলেহাদীছ জামে মসজিদ ও সাবেক সভাপতি, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, ঢাকা যেলা।