পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩। শেষ পর্ব ।
৪.
২৫শে জানুয়ারী চাইনিজ ইয়ার উপলক্ষ্যে ছুটির দিন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বাস ছাড়া রাস্তাঘাটে তেমন গাড়িঘোড়া নেই। আজ সকাল ১০-টা থেকে ইজতেমা শুরু হবে কামবাঙ্গানের জালান সেলামাত রোডস্থ মুহাম্মাদিয়া জামে মসজিদে। সকালে হোটেল রুমে সামী ইউসুফ ভাই, মাহবুব ভাই এবং মোয়াজ্জেম ভাই এলে তাদের সাথে বাংলা স্কয়ারের ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এসময় মুনীর ভাই এলেন। তাঁর গাড়িতে আমরা রওয়ানা হলাম। সিমস্ এভেনিউ দিয়ে গাড়ি ২০ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে যায়। এটি সিঙ্গাপুরে আহলেহাদীছ তথা মুহাম্মাদীদের প্রধান কার্যালয়। সিঙ্গাপুরের অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এটি বেশ আড়ম্বরহীন মনে হ’ল। নীচ তলায় মসজিদের মূল কম্পাউন্ডে ইজতেমা শুরু হয়েছে। কোন ব্যানার নেই, ফেস্টুন নেই। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে, যেন বিরোধী কারো প্ররোচনায় অনুষ্ঠানের কোন ক্ষতি না হয়। তবুও অনুষ্ঠান শুরুর পরপরই মসজিদ ভরে গেল। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে কিছু ভাইদের স্ত্রী ও সন্তানরা উপস্থিত ছিলেন। ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি শফীকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুকীতের সঞ্চালনায় প্রোগ্রাম শুরু হ’ল। আমি যোহরের পূর্বে মুসলিম উম্মাহর জন্য ফিৎনাসমূহ ও তা থেকে বাঁচার উপায় সংক্রান্ত আলোচনায় ফিতনাতুশ শাহওয়াত তথা দুনিয়াবী কামনা-বাসনার ফিৎনা সম্পর্কে বক্তব্য রাখলাম। আমার পূর্বে ইংরেজীতে আলোচনা রাখলেন মুহাম্মাদিয়া এসোসিয়েশন সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আজরী আজমান। চল্লিশোর্ধ বয়সী এই ইমাম বর্তমানে সিঙ্গাপুরে সালাফী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুন্নাত-বিদ‘আত ও তাক্বলীদ-ইত্তিবা বিষয়ে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য রাখলেন। হক্বপন্থীদের ভাষা যে দুনিয়াভর একই, তারই প্রতিধ্বনি যেন খুঁজে পেলাম তাঁর বক্তব্যে। ফালিল্লাহিল হামদ। যোহরের পর দুপুরের খাবার দেয়া হ’ল। আড়াইশ লোকের আয়োজন হলেও উপস্থিতি তিন শতাধিক হওয়ায় পুনরায় বিশেষ ব্যবস্থাপনা করতে হ’ল। খাওয়ার পর আবার ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। আছরের ছালাতের পূর্ব পর্যন্ত পূর্বোক্ত আলোচনার বাকি অংশ তথা ফিতনাতুশ শুবহাত বা সংশয়ের ফিৎনা, যা মানুষের আক্বীদা ও আমল বিনষ্ট করে ফেলে সে সম্পর্কে আমি আলোচনা করলাম। অতঃপর আছরের ছালাতান্তে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। প্রায় ঘণ্টাখানেক প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
সবশেষে ছিল উপস্থিতিদের সাথে পরিচিতি পর্ব। দেশের বিভিন্ন যেলা থেকে আগত অনেক ভাইয়ের সাথে পরিচয় হ’ল, যারা সিঙ্গাপুরে এসে হকের দাওয়াত পেয়েছেন এবং দেশে নিজ পরিবার ও প্রতিবেশীদের মাঝে জোরেশোরে দাওয়াতী কাজ করছেন। বিশুদ্ধ দ্বীনের খোঁজ পেয়ে তারা যে আজ কত খুশী, তা ভাষায় প্রকাশের নয়। দাওয়াতী ময়দানে প্রবাসীদের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সমূহেও আজ হকের আওয়ায বুলন্দ হচ্ছে। ফালিল্লাহিল হামদ। অনুরূপ হকের দাওয়াত গ্রহণ করার কারণে অনেক ভাই পরিবার ও সমাজ থেকে ব্যাপক নিগ্রহের শিকারও হয়েছেন। একজন ভাই তাঁর পরিবারকে কোনভাবে সংশোধন করতে পারলেও তাঁর কওমী মাদরাসা পড়ুয়া ছেলেটাকে ফেরাতে পারেননি বলে কতই না হতাশা ব্যক্ত করলেন। কোন সান্ত্বনাবাণীই যেন তাঁর জন্য যথেষ্ট হচ্ছিল না। তাঁর একটাই কামনা সন্তানটি যেন শেষ পর্যন্ত হেদায়েতের পথ খুঁজে পায়।
মাগরিবের ছালাতের পূর্ব পর্যন্ত পরিচয়ের এই পর্ব চলতেই থাকল। নানামুখী ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা এই ভাইদের পূর্বাপর অভিজ্ঞতাগুলো জানান দিল মহান আল্লাহ কাকে, কিভাবে হেদায়েতের পথ দেখান, আর কিভাবে মানুষ হকের সন্ধান পায়। বিশুদ্ধ দ্বীনের পথে ফিরে আসা এই মানুষগুলোর আবেগঘন বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে হৃদয়জগত আনন্দ-বেদনার মিশ্রণে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই আর্দ্র হয়ে ওঠে চক্ষুযুগল। আমি তাদের ঈমানের তেজ, শুদ্ধতা, দৃঢ়তা মাপার অসম্ভব চেষ্টা করি আর ভাবি, আল্লাহর কর্মকৌশল এমন বিচিত্র, যে সম্পর্কে মানুষ কোনরূপ ধারণাও করতে পারে না। যেখানে মানুষের ভাবনার শেষ হয়, সেখানেই আল্লাহর কৌশল শুরু হয়। নতুবা যে অজস্র, অবারিত ফিৎনার দেশে এসে মানুষের অধঃপতনের অতলে ডুবে যাওয়ার কথা সেখানে আল্লাহ কিভাবে তাদের জন্য হেদায়েতের পথ খুলে দিলেন! সত্যিই যে ফেরাউন মূসা (আঃ)-এর হাত থেকে রক্ষা পেতে রাজ্যের সমস্ত শিশুকে হত্যা করল, স্বয়ং তারই ঘরে আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে লালন-পালন করিয়ে নিয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর কর্মকৌশল কত অদ্ভূত আর কত সুনিপুণ! সুবহান্নাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।
মাগরিব ছালাতের পর একে একে সবাই বিদায় নিয়ে কেউ মেট্রো রেল, কেউবা বাসে স্ব স্ব গন্তব্যের পথে রওয়ানা হলেন। আমরা ফিরে এলাম বাংলা স্কয়ারে। তারপর ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।
৫.
পরদিন ২৬শে ফেব্রুয়ারী শনিবার। সিঙ্গাপুরে আমার ৩য় দিন। সকালে ১০-টার দিকে মোয়াজ্জেম ভাই হোটেল রুমে এলেন স্থানীয় মি নামক এক খাবার নিয়ে। বেশ ভাল লাগল। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সাথে আসাদ (রাজবাড়ী) নামের এক ভাই এলেন, যিনি এক সময় আহলেহাদীছদের প্রতি প্রচন্ড রকম বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সাথে অনেকবার বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁকে হেদায়েত দান করেন। সেই মানুষটা এখন ইউটার্ন করে হকের পথ খুঁজে পেয়েছেন। আর তাঁর সেই বিদ্বেষ এখন পরিবর্তিত হয়েছে নিখাদ দ্বীনী ভালবাসায়। সত্য খুঁজে পাওয়ার যে দীপ্তি তাঁর চোখেমুখে জ্বলজ্বল করছিল, তাতেই যেন হকের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখি। মনটা ফুরফুরে আর আশাবাদী হয়ে ওঠে এজন্য যে, যে মানুষগুলো আজ তীব্র ঘৃণার রাজত্ব নিয়ে বসে আছেন, একদিন তারা নিশ্চয়ই ভুল বুঝবেন এবং হকের আওয়াজকে এভাবেই আপন করে নেবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন!
বেলা ১১-টার দিকে আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। বাংলা স্কয়ারে আসার পর আরও কিছু ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলেন। সবার জন্য দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে ধানসিঁড়ি হোটেল থেকেই। কিছু ভাই সেগুলো বহন করে আমাদের সাথে চললেন। আমরা যাব সেরাঙ্গুনে। আমি প্রস্তাব দিলাম গাড়ির পরিবর্তে এবার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে চড়ে যাব। সুতরাং পার্শ্ববর্তী পাঙ্গল এমআরটি স্টেশনে এলাম। যেতে হবে আপার সেরাঙ্গুন। এমআরটি (Mass rapid transport) বা পাতাল ট্রেন লাইন প্রায় সারা সিঙ্গাপুর জুড়ে বিস্তৃত। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম মেট্রো ব্যবস্থা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত এগুলো চলাচল করে। গতিবেগ প্রায় ৯০ থেকে ১০০ কি.মি.। পাতালের গভীর তলদেশ দিয়ে এগুলো যাতায়াত করে। বেনকুলেন নামক একটি স্টেশন আছে যেটি সারফেস লেভেল বা মাটি থেকে ৪৩ মিটার তথা প্রায় ১০/১২ তলা নীচে অবস্থিত। ১৯৮৭ সালে এই রেল সিস্টেম চালু হয় এবং বর্তমানে প্রায় ২০০ কি. মি. ব্যাপী এর বিস্তৃতি। ২০৪০ সালের মধ্যে এটি ৪০০ কি. মি. বিস্তৃত হওয়ার কথা রয়েছে। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় এসব ট্রেনে কোন ড্রাইভার থাকে না। স্টেশনগুলিতে লোকেশন স্পষ্ট করে দেয়া আছে। এছাড়া আলাদা এ্যাপস রয়েছে যেখান থেকে সহজেই রুট ম্যাপ নির্ণয় করা যায়।
আমরা ট্রেনে চড়ে বসলাম। পীক টাইমে ২/৩ মিনিট এবং অফ পীক টাইমে ৫/৭ মিনিট পর পর ট্রেন আসে। মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা আপার সেরাঙ্গুন স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখান থেকে পায়ে হেটে আমরা মসজিদ আল-কাফে এসে উপস্থিত হলাম। যোহরের ছালাত ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। আমরা দ্রুত অযূ সেরে ছালাতে যোগ দিলাম।
এই মসজিদটি সিঙ্গাপুরের অন্যতম পুরানো মসজিদ। ১৯৩০ সালে এক ধনাঢ্য ইয়েমেনী আরব ব্যবসায়ী পরিবার এটি নির্মাণ করে। অনেকটা ক্যাথেড্রালের মত দেখতে এই মসজিদের বৈশিষ্ট্য হ’ল ওছমানীয় নির্মাণশৈলীর উঁচু মিনার, যা সিঙ্গাপুরের অন্য মসজিদগুলোতে সচরাচর দেখা যায় না। এখানে একসাথে ১২০০ মুছল্লী ছালাত আদায় করতে পারে। ছালাতের পর আমরা মসজিদের পেছনের অংশে বসলাম। আগেই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি নেয়া হয়েছিল। সিঙ্গাপুর আন্দোলনের ৭টি শাখা থেকে অর্ধশতাধিক দায়িত্বশীল উপস্থিত হয়েছেন। ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি শফীকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুকীতের সঞ্চালনায় প্রোগ্রাম শুরু হ’ল। দরসে কুরআন ও দরসে হাদীছের পর পরিচিতিপর্ব ছিল। সবার সাথে পরিচিত হওয়ার পর একটু বিরতি দিয়ে মসজিদের বহির্চত্বরে সবাই একত্রে দুপুরের খাবার খেলাম। কাগজের প্লেটে খাবারের আয়োজন। মোয়াজ্জেম ভাই রুম থেকে কিছু খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া হ’ল। এই আন্তরিক পরিবেশটা আমার খুবই ভাল লাগল। সবাই মিলে এভাবে কংক্রিটের চত্বরে বসে আল্লাহর পথের মুসাফিরদের মত ভাগাভাগি করে খাবার খাওয়ার তৃপ্তিই আলাদা। এই তৃপ্তি কখনও পাঁচ তারকা হোটেলের বিলাসবহুল আয়োজনেও পাওয়া যাবে না।
খাবার শেষে আমরা আবার মসজিদে বসি। আছরের ছালাতের পূর্ব পর্যন্ত সাংগঠনিক অগ্রগতির বিষয়ে বিবিধ আলোচনা হ’ল। অতঃপর দায়িত্বশীল ভাইদের প্রতি দিক-নিদের্শনামূলক বক্তব্য রাখার মাধ্যমে বৈঠক সমাপ্ত হ’ল। বাদ আছর আরো কিছুক্ষণ বসার পর আমরা বিদায় গ্রহণ করলাম। কর্মী ও দায়িত্বশীল ভাইরা যার যার গন্তব্যে রওয়ানা হলেন। আর আমরা মুনীর ভাইয়ের গাড়িতে সিঙ্গাপুরের প্রসিদ্ধ পর্যটন অঞ্চল মেরিনা বে দেখার জন্য বের হলাম। ভাই আব্দুল হালীম ও শফীকুল ইসলাম বাংলা স্কয়ারে কিছু কাজের জন্য থেকে গেলেন। আরও কয়েকজন ভাই আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এমআরটিতে রওয়ানা হলেন।
বিশ মিনিটের মধ্যে আমরা সিঙ্গাপুরের মূল পর্যটনস্থল মেরিনা বে স্কয়ারে এলাম। এটি সিঙ্গাপুরের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র বা বিজনেস হাব। এখানে সিঙ্গাপুর নদীর প্রবেশমুখে সিঙ্গাপুরের প্রতীক পৌরাণিক সিংহ-মৎস প্রাণী মার্লিওন (Merlion)-এর প্রতিমূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। পরে এখানে গড়ে উঠেছে মার্লিয়ন পার্ক। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫৭তলা বিশিষ্ট সুবিশাল পাঁচতারকা হোটেল মেরিনা বে স্যান্ডস্। আর এই বিলাসবহুল হোটেল কমপ্লেক্সকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে অজস্র বিনোদন কেন্দ্র। আমরা প্রথমে মেরিনা বে পার্কে প্রবেশ করলাম। মুনীর ভাই, মোয়াজ্জেম ভাই, সামী ইউসুফ ভাই, মাহবূব ভাই এবং কাউছার ভাই সঙ্গে ছিলেন। পরে এমআরটি যোগে আরও ১০/১২ জন কর্মী ভাই এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। প্রথমে ঢুকলাম সুপার ট্রি গার্ডেনে। এখানে ১৮টি কৃত্রিম গাছের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে, যেগুলোর উচ্চতা ২৫ থেকে ৫০ মিটার পর্যন্ত। আর এগুলোর গায়ে আগাগোড়া অর্কিড জাতীয় রং-বেরং-এর অসংখ্য গাছ-লতাপাতা ঝুলে আছে। লিফটের সাহায্যে গাছের শীর্ষদেশে ওঠা যায় এবং সেখান থেকে সিঙ্গাপুরের স্কাইভিউ নযরে আসে। রাতের বেলা মনোমুগ্ধকর লাইটিং-এ ঝলমলে হয়ে ওঠে গাছগুলো। আজ চাইনিজ নিউ ইয়ার তথা সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন বলে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আগমনে গমগমে হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা।
মাগরিবের পূর্বে ঘণ্টাখানিক সময় বাকি রয়েছে দেখে আমরা যতদ্রুত সম্ভব সামনে এগুলাম। পথে পথে চাইনিজ নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফুলের অপূর্ব সমারোহ। রঙ-চঙের বাহার দেখে কৃত্রিম ফুল মনে হলেও এগুলোর কোনটিই কৃত্রিম নয়। সবই আসল। ফুলে ফুলে ভরপুর একটি চত্বরের মাঝখানে ইঁদুরের ছোট ছোট মূর্তি সাজানো। দুই পার্শ্বে লেখা ‘হ্যাপি লুনার নিউ ইয়ার/২০২০ ইয়ার অব র্যাট’। অর্থাৎ এই বছরটি হ’ল ইঁদুর বর্ষ। চাইনিজ রাশিচক্র বারো বছরে সম্পন্ন হয়। এই বর্ষগুলোর নামকরণ করা হয় বিশেষ কিছু প্রাণীর নামে। যেমন বাঁদর, কুকুর, শুকর, সাঁপ ইত্যাদি। প্রতিটি প্রাণীর বৈশিষ্ট্য মোতাবেক সেই বছরের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়। আর বারো বছরের এই চক্রটি শুরু হয় ইঁদুর দিয়ে। কেননা চাইনিজদের কাছে ইঁদুর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চাইনিজ সংস্কৃতিতে ইঁদুর হ’ল ধন-সম্পদ ও উন্নতির প্রতীক। তাছাড়া ইঁদুর চালাক, দ্রুত চিন্তাশক্তিসম্পন্ন এবং সফল; অথচ তারা একটি সাধারণ, শান্ত ও প্রশান্তিময় জীবনেই পরিতৃপ্ত। এজন্য তাদের জীবনাচার চাইনিজদের কাছে প্রিয়। ইঁদুরের ব্যাপক জন্মদান ক্ষমতার কারণে বিবাহিত দম্পতিরা তাদের কাছে সন্তান প্রার্থনা করে। এই হ’ল চাইনিজদের ইঁদুর পূজার ইতিবৃত্ত। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এসে এজন্য যে, আল্লাহর আমাদেরকে এত পরিশীলিত ও সুশৃংখল একটি জীবন বিধান দান করেছেন। যে জীবনের প্রতিটি কর্মেই মহত্তম ও অর্থপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে। এদের হাতে হয়ত রয়েছে ধন-সম্পদ, রয়েছে কার্যকরী বিদ্যা-বুদ্ধি, রয়েছে সফল পরিকল্পনা। কিন্তু তাদের জীবনের কোন মহৎ লক্ষ্য নেই। নেই কোন অর্থপূর্ণ জীবনাদর্শ। মুনীর ভাই বলছিলেন, এখানে প্রতি ছয়জনে একজন মিলিয়নিয়ার হ’তে পারে, কিন্তু তাদের জীবনে শান্তি নেই। খোঁজ করলে দেখা যাবে তারা প্রত্যেকেই জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত-শ্রান্ত। সারাটা জীবন অর্থের পিছনেই তারা ক্লান্তিহীন ছুটে চলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাপিত জীবনের কষ্ট লাঘবে তা যথেষ্ট হয় না। জীবনের প্রকৃত মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া তো বহু দূরের ব্যাপার।
আমরা সুপার ট্রি গার্ডেন থেকে হাটতে হাটতে এলাম দু’টি বিশালায়তন গ্লাস হাউজের সামনে। পিলারহীনভাবে এই ডোমগুলো বানানো হয়েছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম কলামবিহীন গ্লাসহাউজ। এর একটি হ’ল ফ্লাওয়ার ডোম। এই বিশাল গোলাকার কাঁচের স্থাপনার মধ্যে পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের গাছপালা ও ফুলের সমারোহ ঘটানো হয়েছে। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্রীনহাউজও বটে। দর্শকদের জন্য ভেতরে পাথওয়ে তৈরী করা রয়েছে যেন তারা ঘুরে ঘুরে এসকল গাছপালার সাথে পরিচিত হতে পারে। আর অপরটি হ’ল ক্লাউড ফরেস্ট বা মেঘের জঙ্গল। এখানে পর্যটকরা একই সাথে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা তথা বিভিন্ন আবহাওয়ার স্বাদ নিতে পারে। পাহাড়ের উপর মেঘের আড়ালে হারিয়ে যেতে পারে। সময়ের অভাবে আমরা এগুলোর ভেতরে ঢুকিনি। বাহির থেকেই কাঁচ ভেদ করে যতটুকু দেখা যায় দেখলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা ড্রাগনফ্লাই লেকের পাড়ে দাঁড়ালাম। প্রচুর লাল শাপলায় ভরা এই লেক। মেরিনা বে হোটেলটি চমৎকারভাবে দেখা যায় এখান থেকে। অতঃপর অনেকটা হেটে দক্ষিণ চীন সাগরের যে খাড়িটি শহরের মধ্যে ঢুকেছে সেখানে এসে দাঁড়ালাম। দূরে ব্রীজের পার্শ্বে দেখা যায় সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার। নাগরদোলার অত্যাধুনিক রূপ। ১৬৫ মিটার উচ্চতার এই সুউচ্চ নাগোরদোলার প্রতিটি ডেকে ২৮ জন করে বসতে পারে। এটিও সিঙ্গাপুরের একটি ল্যান্ডমার্ক সাইনে পরিণত হয়েছে।
মাগরিবের সময় হয়ে আসছে। আমরা মেরিনা ব্যারেজের দিকে এগুলাম। ব্যারেজ কমপ্লেক্সের বাইরে বিশাল সবুজ মাঠ রয়েছে। সেখানে আমরা জামা‘আতে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। তারপর ব্যারেজের ছাদে উঠলাম। রাতের ঝলমলে সিঙ্গাপুর এখান থেকে খুব চমৎকারভাবে নযরে আসল। সংগঠনের ভাইরা আশাবাদ ব্যক্ত করলেন, যদি কখনও আমীরে জামা‘আতকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে এই ঘাসের ছাদে বসে আমরা প্রোগ্রাম করব ইনশাআল্লাহ।
ব্যারেজ থেকে ফেরার পথে আমরা বে ফ্রন্ট এভেনিউয়ের সামনে আসলাম। এখানে ডিএনএ-এর মত আকৃতির একটি দর্শনীয় চন্দ্রাকার পায়ে হাটা ঝুলন্ত ব্রীজ রয়েছে। এই ব্রীজ থেকে আমরা আর্ট-সাইন্স মিউজিয়ামের সামনে আসলাম। পদ্মফুল আকৃতির এই স্থাপনাটি বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই ভেতরে এত বড় মিউজিয়াম রয়েছে। পার্শ্বেই সুবিশাল চোখ ধাঁধানো মেরিনা বে শপিং মল। জিনিসপত্রের দাম যথারীতি আকাশছোঁয়া। এই মলেরই এক পার্শ্বে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের আলোচিত ক্যাসিনো সম্রাটরা এসে জুয়া খেলত। ভেতরে কিছুক্ষণ ঘোরাফিরা করে আমরা বেরিয়ে এলাম।
রাত ৯-টার সময় মেরিনা বেতে লাইট শো শুরু হ’ল। নিউ ইয়ার বলে প্রথমে রঙ-বেরঙের আতশবাজির ঝলকানীতে আকাশ মুখরিত হয়ে ওঠে। তারপর শুরু হল লাইট শো। পানির ফোয়ারার ছন্দময় নাচনদৃশ্য মুগ্ধ করলেও মিউজিকের উচ্চশব্দ সে দৃশ্য উপভোগ করতে দিল না। আমরা পায়ে পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। এবার বিদায়ের পালা। কর্মী ভাইরা এই দু’দিনে যে পরিমাণ ভালোবাসা দেখিয়েছেন এবং যেভাবে সঙ্গ দিয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তাদের সকলকে উত্তম প্রতিদান দিন। এমন এক ফিৎনার রাজ্যে থেকে তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের ঈমান ও আমলকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকে ভুলে যাননি। বরং নানামুখী বাধা সত্ত্বেও সাধ্যমত মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছেন। কুমিল্লার কাউছার ভাই বললেন, আমাদের এভাবে ঘোরাঘুরির সময় তেমন হয় না। কারণ সপ্তাহে যেদিনটি ছুটি পাই সেদিন সাংগঠনিক কাজ এবং দাওয়াতী সফরে থাকি। আল্লাহ তাদের এই কুরবানী ও প্রচেষ্টা কবুল করে নিন- আমীন! তাদেরকে বিদায় জানিয়ে আমরা গাড়িতে উঠি। মুনীর ভাইয়ের বাসায় আজ রাতে খাওয়ার দাওয়াত। ওদিকে আব্দুল হালীম ভাই এবং শফীক ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাত ১০-টার দিকে আমরা সেরাঙ্গুনে মুনীর ভাইয়ের বাসায় পৌঁছলাম। মুনীর ভাই কুমিল্লার মানুষ। বিগত কয়েক দশক যাবৎ তিনি সপরিবারে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। নিজস্ব ফ্ল্যাটও কিনেছেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ব্যবসায় লসের শিকার হয়ে কিছুটা বিপদে পড়েছেন। বর্তমানে তিনি সেখানে আন্দোলনের একজন উপদেষ্টা। ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি সাধ্যমত আন্দোলনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন এবং কর্মী ভাইদের চাঙ্গা রাখার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আল্লাহ তার ঈমান ও আমলে বরকত দিন- আমীন!
মুনীর ভাইয়ের বাসায় আমরা দেশীয় কয়েক পদের আইটেম দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। ভাবী যথেষ্ট যত্ন ও পরিশ্রম করে এই আয়োজন করেছেন বোঝা গেল। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন। খাবার শেষে এশার ছালাত আদায় করে আব্দুল হালীম ভাই এবং শফীক ভাই বিদায় গ্রহণ করলেন। মুনীর ভাই তাঁর গাড়িতে আমাদেরকে মোসত্বফা শপিং সেন্টারে পৌঁছে দিলেন। সেখানে মানি এক্সচেঞ্জ করে নিলাম এবং পরদিন ট্রাভেল এজেন্সিতে জাকার্তার ফ্লাইটের খোঁজ-খবর নিতে গেলাম। প্রতিদিন অনেকগুলো ফ্লাইট যায় এখান থেকে। কিন্তু আজ অনেক চাপ বলে ভাড়া বেড়ে গেছে। চাইনিজ নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে অনেক ইন্দোনেশিয়ান সিঙ্গাপুরে এসেছিল। তারা কাল ফিরে যাচ্ছে। যাইহোক পরদিন বেলা ১১-টায় জেট স্টার এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে টিকেট কাটা হল। অবশেষে মোয়াজ্জেম ভাই, সামী ইউসুফ ভাই এবং মাহবূব ভাই আমাকে হোটেলে পৌঁছিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা।
পরদিন সকালে আমি মোসত্বফা সেন্টারে গিয়ে হালকা কিছু মার্কেটিং করলাম। এ সময় মোয়াজ্জেম ভাই ও রাকীব ভাই এলেন। তাঁদের সাথে পাকিস্তানী এক হোটেলে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। অতঃপর হোটেল থেকে চেক আউট করে বেরিয়ে এসে চাঙ্গি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সামী ইউসুফ ভাই ও মাহবূব ভাইও আমাদের সঙ্গী হলেন। গতদিন এমআরটিতে চড়লেও পাবলিক বাস সার্ভিস এবং এলআরটি (Light Rail Transit) তথা মাটির উপর দিয়ে চলা রেলে চড়া হয়নি। তাই এবারে প্রথমে বাসে এবং পরে ট্রেনে চাঙ্গি এয়ারপোর্ট গেলাম। কয়েকবার বাস ও ট্রেন পরিবর্তন করায় আধাঘণ্টার বেশী সময় লাগল। তবে এই সুযোগে সিঙ্গাপুর শহরটা ভালভাবে দেখা গেল। সকাল দশটার দিকে এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম। এসময় কাউছার ভাইও বিদায় দিতে আসলেন। সময় হাতে খুব কম। কিন্তু তখনও জানা ছিল না চাঙ্গি এয়ারপোর্ট এতটা ডিজিটালাইজ্ড। মেশিনের উপর শুধু পাসপোর্ট শো করতেই বোর্ডিং কার্ড হাতে পেলাম। তারপর ইমিগ্রেশনেও একই ব্যাপার। কোন অফিসার নেই। কেবল মেশিনে দু’হাতের ছাপ লাগাতেই দরজা খুলে গেল। সুতরাং সময় কম থাকলেও খুব দ্রুততার সাথে সবকিছু সম্পন্ন হয়ে গেল আলহামদুলিল্লাহ। বাইরে অপেক্ষমাণ দায়িত্বশীল ভাইদের প্রতি হাত নাড়িয়ে বিদায় গ্রহণ করলাম। ফিরতি পথে আবার দেখা হবে তাদের সাথে দু’দিন পরই ইনশাআল্লাহ। আমি চললাম জাকার্তার পথে। দু’দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে। (ক্রমশঃ)