১৪ই মার্চ ২০২৩। ফজরের পর আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। আজকের গন্তব্য শারজাহ। প্রসঙ্গতঃ শারজাহ আরবী উচ্চারণে হয় আশ-শারেকা (الشارقة) বা পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা। অনারবরা ভুল উচ্চারণে শারজাহ বলে থাকেন, যা আরবরাও মেনে নিয়েছে। ফলে ইংরেজীতে তারাও এখন শারজাহ্ই লেখে। যাহোক ছফিউর রহমান ভাই আজমান থাকেন। সেখান থেকে আসতে বেশ দেরি করে ফেললেন। আজ চারজন যাব বলে নিয়ে এসেছেন সুপরিসর সাদা নিশান পেট্রোল জীপ। বেলা ১১টার দিকে রওয়ানা হ’লাম। চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া। শীতকাল শেষ হ’লেও শীতের ভাব এখনও পুরোপুরি কাটেনি। পথে দুবাই ক্রিক মেট্রো স্টেশন থেকে মুজাহিদ ভাইকে নেয়া হ’ল। দুবাইয়ে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করা বা থামানোর নিয়ম নেই। একটু ঘুরে এক খোলা মাঠে গাড়ি দাঁড়ায়। দূর থেকে মুজাহিদ ভাই হেঁটে আসছেন। ছফিউর রহমান ভাই হাত নেড়ে তাড়া দেন দ্রুত আসার জন্য। ঘুরে আসতে সময় লাগবে দেখে তিনি বাঙালী বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটিয়ে রাস্তার সাইড ব্যারিকেডের নিচের ফাঁকা অংশ দিয়ে চকিত বিশাল শরীরটা গলিয়ে দিলেন। কঠিন কাজটা সহজেই করে দ্রুত যোগ দিলেন আমাদের সাথে। আমরা তার উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করলাম। জীবনটা সবসময় পরিপাটি রাখা সম্ভব নয়। বিচিত্র সব মুহূর্ত, ঝুট-ঝামেলা আসবে। তবুও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কার্য সমাধা করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ঝুঁকি নিতে হবে। এতে দ্বিধা করলে, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভেবে বসে থাকলে ঝামেলা বাড়ে বৈ কমে না।
পূর্বদিকে হাত্তাগামী রোড ধরে ছুটতে থাকে আমাদের জীপটি। পথে ডেজার্ট সাফারী তথা মরুভূমির লাল পাহাড়ে জীপ রাইড উপভোগ করার জন্য বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট দেখা যায়। তবে হাতে সময় কম থাকায় আমাদের থামা হয় না। প্রায় ৬০ কি.মি. যাত্রার পর আমরা নাজওয়া নামক স্থানে পৌঁছি। এখানে কক্সবাজারের ভাই জনাব কায়ছার হোসাইনের একটি মাঝরাআ‘ বা কৃষিক্ষেত আছে। স্ত্রীসহ এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন বসবাস করছেন দুবাইয়ে। সেখানে ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন আকরাম চৌধুরী ভাই। মরুর বুকে পানির ব্যবস্থা করে সবুজের সমারোহ ঘটিয়েছেন কায়ছার ভাই। কোথাও মুলা, কোথাও পুদিনা পাতার চাষ হচ্ছে। রোদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কৃষক কাজ করছেন। তারাও বাঙালী। আমরা ক্ষেতের পাশে খেজুর বাগানে আরবীয় কায়দায় ফরাশ পেতে বসলাম। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার বিরাট আয়োজন। কায়ছার ভাইয়ের স্ত্রী বাসায় রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছেন। শুটকী মাছ থেকে শুরু করে গরুর বট পর্যন্ত কী নেই সেখানে। গাছের ছায়ায় ফুরফুরে মৃদু-মন্দ বাতাস গায়ে মেখে তাঁর এই আন্তরিক আতিথেয়তা আমরা প্রাণভরে উপভোগ করলাম। ফালিল্লাহিল হাম্দ। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন! কায়ছার ভাইয়ের আরও কয়েকটি ক্ষেত রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়। লাভজনক হওয়ায় বাঙালীরা এখন ক্ষেত-খামারের দিকে বেশ ঝুঁকছেন।
আছরের ছালাতের পর আমরা কায়ছার ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হই। সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ায় এদেশের সবচেয়ে বড় পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র হাত্তা ড্যাম পরিদর্শনের আর সুযোগ হ’ল না। এছাড়া পরিকল্পনায় ছিল পূর্বদিকে আরও প্রায় ২০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত ওমান সাগরের তীরবর্তী পর্যটন শহর খোর ফাক্কান সফরের। সময়াভাবে সেটাও বাতিল করতে হ’ল। আসলে সকালে বের হ’তেই আমাদের দেরি হয়েছে। এখন খুব আফসোস হ’লেও আর কিছু করার ছিল না। আমরা শারজাহ শহরের পথে রওয়ানা হ’লাম। ঘন্টাখানেক বাদে পড়ন্ত বেলায় শারজাহ শহরের দক্ষিণ প্রবেশমুখে নবনির্মিত চমৎকার গ্রান্ড মসজিদে পৌঁছলাম। ২০১৯ সালে এর উদ্বোধন হয়েছে। তুর্কী স্থাপত্যশৈলীর সাথে মুঘল ঐতিহ্যের মিশেলে মসজিদ চত্তরের বাইরে বিশাল এলাকা জুড়ে ক্যাসকেডের মত জলাধার, ফোয়ারা আর দহলিজ। চারপাশে সবুজ ঘাস ও ফুলের সমারোহ মসজিদটিকে ভীষণ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সেখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা মাগরিবের আগ দিয়ে শহর অভিমুখে রওয়ানা হই।
দুবাই থেকে মাত্র ৩০ কি. মি. উত্তর-পূর্বের এই শহরটিতে দুবাইয়ের কোন ছোঁয়া টের পাওয়া গেল না। উঁচু উঁচু টাওয়ারের রাজত্ব নেই। সাধারণ তবে অভিজাত একই ধাঁচের মেটে রঙের বাড়িঘর, অফিস-আদালত। সবুজ গাছপালা ঘেরা আইল্যান্ড। সুপ্রশস্ত রাস্তাঘাট। কোথাও কোন জ্যাম নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল দুবাইয়ের মত পশ্চিমাদের অবাধ বিচরণ এখানে একেবারেই নেই। ইসলামী পরিবেশ বিবেচনায় আমিরাতের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শহর শারজাহ। এটা আমিরাতের সাংস্কৃতিক শহর বা ইসলামী সংস্কৃতির রাজধানী হিসাবেও খ্যাত। শুধু তাই নয়, আমিরাতের একমাত্র শহর যেখানে শুক্রবার জুমআ‘র জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে এবং শনি ও রবিবারও অন্যান্য শহরের মত ছুটি। ফলে সপ্তাহে তিনদিনই সরকারী ছুটি।
শারজাহর বর্তমান শাসক ড. সুলতান বিন মুহাম্মাদ আল-কাছেমী (১৯৩৯ খ্রী.-) অত্যন্ত সজ্জন, উচ্চশিক্ষিত ও ধর্মানুরাগী মানুষ। এই শহরে ধর্মীয় ভাব বজায় রাখতে তিনি যে বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকেন, তা এই শহরে ঢোকামাত্রই অনুভব করা যায়। ১৯৭২ সাল থেকে সুদীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ তিনি শারজাহ শাসন করছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দেশে ও বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সুশাসনের জন্য জনসাধারণের নিকট খুবই প্রশংসিত।
আমাদের গাড়ি গ্রান্ড মসজিদ থেকে মালেহা রোড ধরে সিটি সেন্টার আল-যাহিয়ার দিকে চলতে থাকে। পথে বিখ্যাত কুরআন পার্ক পড়ে। ব্যতিক্রমী এই পার্কে কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন, গাছপালা, ফল-ফলাদি, সাগরমাঝে মূসা (আঃ)-সামনে উন্মোচিত হওয়া পথের কাল্পনিক রূপ ইত্যাদির প্রদর্শনী রয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন অংশকে মানসপট থেকে দৃশ্যপটে আনার প্রচেষ্টা থেকেই এই চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরপর শারজাহ ইউনিভার্সিটি সিটি এবং ইসলামী স্থাপত্যকলার মনোরম নিদর্শনে মোড়া শারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ক্যাম্পাস চোখে পড়ে। মাগরিবের পূর্বে আমরা সিটি সেন্টারের নিকটবর্তী মুওয়াইলিয়াহ বাণিজ্যিক এলাকায় পৌঁছি। এখানেই আকরাম চৌধুরী ভাইয়ের বাসা ও কর্মস্থল। আকরাম ভাই সপরিবারে এদেশে আছেন দীর্ঘ দুই দশক। তার ৬/৭ বছরের বুদ্ধিমান ছেলেটা আমাদেরকে তার বাসায় রিসিভ করল। ভাবীর হাতে বানানো পিঠা-পুলিসহ ভরপুর বৈকালিক নাশতা সেরে আমরা পার্শ্ববর্তী মসজিদে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম।
মাগরিবের পর শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও বিমানবন্দর অতিক্রম করে আল-জাযাত এলাকায় পৌঁছি। সেখানে চট্টগ্রামের হাসান ভাইয়ের বাসার গেস্ট রুমে আজকের প্রোগ্রামের আয়োজন। হাসান ভাইও দীর্ঘদিন যাবৎ শারজাহ আছেন। বাংলাদেশীদের আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। আজও তার বাসাতেই আমরা সমাবেত হয়েছি। সরকারী অনুমতি ছাড়া বড় প্রোগ্রাম করার সুযোগ না থাকায় শারজাহতে অবস্থানরত বিশেষ কিছু ভাই এসেছেন। ফুজাইরাহ থেকে এসেছেন সিলেটের খন্দকার ফয়ছাল বিন মুছতফা ভাই কয়েকজন সঙ্গী-সাথীসহ। আমাদের আরব আমিরাত প্রবেশের পূর্বে সঊদীআরব শাখা ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীল ইমরান ভাইয়ের মাধ্যমে তিনিই মূলতঃ আমাদের সাথে সার্বিক যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা দেখভাল করেছিলেন। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমীন! এশার ছালাতের পর প্রোগ্রাম শুরু হ’ল। আমরা তিনজন সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে দাওয়াতী কার্যক্রম সাধ্যমত এগিয়ে নেওয়ার জন্য আহবান জানালাম এবং সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রমের গুরুত্ব উপস্থাপন করলাম। তাদের জন্য কিছু বইপত্র আনা হয়েছিল। সেগুলো হাদিয়া প্রদান করলাম। আলোচনা ও মতবিনিময় শেষে খাওয়া-দাওয়া হ’ল। দ্বীনী ভাইদের আন্তরিকতা ও চমৎকার আতিথেয়তা ভাষায় প্রকাশের মত নয়। বের হ’তে হ’তে রাত ১২টা অতিক্রম করে। আমরা আকরাম ভাই, হাসান ভাইসহ অন্যান্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হই।
শারজাহর সাথেই আজমান শহর। দু’টিকে একসাথে টুইন সিটি বলা হয়। আমরা রাতের আলো ঝলমলে দুই শহর দেখতে দেখতে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। পথিমধ্যে ছফিউর রহমান ভাই এক বাঙালী টেইলার্সে গাড়ি থামান। সেখানে বেশ কয়েকজন বাঙালী কর্মরত আছেন। তারা আমাদের চিনতে পেরে খুব খুশী হ’লেন। সেখানে সফরসঙ্গী ড. সাখাওয়াত হোসাইন এবং শরীফুল ইসলামের জন্য দু’টি জুববার অর্ডার করা হ’ল। বিগত রাতের মতই আরমাদায় ফিরতে ফিরতে আজও প্রায় রাত দু’টো বেজে গেল।
পরদিন ১৫ই মার্চ ২০২৩। আবুধাবী সফরের জন্য ধার্য দিন। শারজাহর মত আবুধাবীও সঠিক উচ্চারণ নয়। বরং আরবীতে বলা হয় ‘আবু যবী’ (أبو ظبي)। অনারবদের কবলে পড়ে এর দশাও তথৈবচ। আবুধাবীর ব্যবসায়ী চট্টগ্রামের ফাহাদ বিন বদীউল ইসলাম ভাই জসীম নামক এক ভাইকে সকাল সকাল পাঠালেন আমাদের নেওয়ার জন্য। সুদর্শন, সদাহাস্য ফাহাদ ভাইয়ের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। তিনি চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠন কালচারাল ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম (সিএফসি)-এর সেক্রেটারী এবং আবুধাবীতে একজন সফল প্রিন্টিং ব্যবসায়ী। দেশে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এক যুগ আগে আবুধাবীতে এসে ছহীহ আক্বীদার সন্ধান পেয়েছেন। সপরিবারে এখানে থাকেন। বর্তমানে আরব আমিরাতের আহলেহাদীছ ভাইদের মধ্যে অন্যতম সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করছেন। ফয়ছাল ভাইয়ের মত তিনিও পূর্ব থেকেই আমাদের খোঁজখবর রাখছিলেন এবং দূর থেকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে আমরা রওয়ানা হ’লাম আবুধাবীর উদ্দেশ্যে। দুবাইয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে শেখ যায়েদ রোড ধরে নাক বরাবর গাড়ি ছুটতে শুরু করে। রাস্তায় দু’ধারে ছায়াদার গাছপালা আর মধ্যবর্তী আইল্যান্ডে চমৎকার সবুজ বনায়ন দেখে যেন মরুর দেশ ভাবার অবকাশই হয় না।
প্রায় ১৩৫ কি. মি. দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে ঘন্টা দেড়েক লেগে যায়। যোহরের আগ দিয়ে আমরা আল-মুছাফ্ফা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় পৌঁছি। মূল শহর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. দূরত্বে এর অবস্থান। এখানেই ফাহাদ ভাইয়ের কর্মস্থল। তার প্রিন্টিং প্রেসে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর আমরা মসজিদের যোহরের ছালাত আদায় করি। অতঃপর স্থানীয় একটি ইয়ামনী রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাই। এখানে আবুল হোসাইন, রাসেল মাহমূদ, জাহিদ হোসাইন, জামালুদ্দীন প্রমুখ ভাই এসে উপস্থিত হ’লেন। একসাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে এখানেই মতবিনিময় বৈঠক হয়। অপরিচিত এই দ্বীনী ভাইদের আন্তরিকতা ও আবেগ ভোলার মত নয়। বিধিনিষেধের কারণে এখানেও বড় কোন পাবলিক প্রোগ্রাম করা যায়নি, যদিও অনেক ভাই সাক্ষাতের জন্য যোগাযোগ করেছিলেন।
আছরের ছালাতের পূর্বে আমরা রওয়ানা হ’লাম শেখ যায়েদ গ্রান্ড মসজিদের উদ্দেশ্যে। ফাহাদ ভাইয়ের ব্যস্ততা থাকায় তার গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে নিয়ে চললেন আবুল হোসাইন ভাই (চট্টগ্রাম)। মক্কা-মদীনার পর এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ হিসাবে খ্যাত। এর অভ্যন্তরভাগে ৭ হাযারসহ পুরো মসজিদে মোট ৪০ হাযার মুছল্লী একত্রে ছালাত আদায় করতে পারে। মসজিদের ভিতরের ষাট হাযার বর্গফুটের কার্পেটটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্পেট। ছোট-বড় মিলিয়ে এতে ৮২টি গম্বুজ রয়েছে। আরব আমিরাতের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ যায়েদ বিন সুলতান আল-নাহিয়ান (মৃ. ২০০৪খ্রি.) ছিলেন এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি এখানেই কবরস্থ হয়েছেন। দুঃখজনকভাবে তাঁর কবরের পার্শ্বে একটি বড় বিদ‘আত চালু রয়েছে। আর তা হ’ল, পালাক্রমে ২৪ ঘন্টা তাঁর কবরের পার্শ্বে বসে হাফেযদের কুরআন তেলাওয়াত। শুরু থেকে অদ্যাবধি চালু রয়েছে এই নিয়ম। কারো কিছু বলার নেই।
আমরা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে খুব হতবাক হই। মুছল্লীদের চেয়ে দর্শনার্থীদের সংখ্যাই বেশী। বিশেষতঃ স্বল্পবসনা বিদেশী অমুসলিম নারীর অবাধ বিচরণ চরম অস্বস্তিকর। যদিও মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য অনলাইন নিবন্ধন করা আবশ্যক এবং নারীদের মাথায় কাপড়সহ বোরক্বা পরিধানকরতঃ মসজিদে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তাতেও কি বিশেষ লাভ হয়? এতে মসজিদের পবিত্রতা যেমন চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তেমনি মসজিদ আর যেন মসজিদ নেই, বরং মিউজিয়াম বা যাদুঘরে পরিণত হয়েছে।
আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন ওযূখানা থেকে ওযূ করে আছরের জামা‘আত ধরি। মসজিদের অভ্যন্তরভাগের মূল অংশ শুধুমাত্র শুক্রবার উন্মুক্ত করা হয়। বাকি দিনগুলোতে একপার্শ্বে ছোট্ট ঘেরাওয়ের মধ্যে ছালাত আদায় করা হয়। দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। তাদের মাড়িয়ে নির্ধারিত ছালাতের স্থানে গিয়ে মাত্র শ’খানেক মুছল্লী পাওয়া যায়। অর্থাৎ মসজিদ যত না মুছল্লীদের, তার চেয়ে বেশী যেন দর্শনার্থীদের। সুকোমল কারুকার্যময় কার্পেট আর চোখ ধাঁধাঁনো ঝাড়বাতির ঐশ্বর্যে ছালাতের মূল রূহ খুশু-খুযূ ধরে রাখা কষ্টকর। তবুই মসজিদ তো মসজিদই। সহসাই ভাবাবেগ ছুয়ে যায় সঙ্গোপনে মনের অলিন্দে। বিনয়াবনত, আল্লাহভীরু হৃদয় যত প্রফুল্লতা, বিলাস-ব্যসনের আঘাতে জর্জরিত হোক না কেন, স্রষ্টার সমীপে একসময় সে ফিরে আসার ফুরসৎ খুঁজে নেবেই.. আলহামদুলিল্লাহ!
ছালাত শেষে আমরা দূরে আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটের অভ্যন্তর থেকে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আলীশান মসজিদের মূল অংশের সৌন্দর্য সুনীল আসমানের ঝকঝকে মার্তন্ডের প্রখরতা নিয়ে দর্শনার্থীদের বিমোহিত করলেও নিরব অশ্রুপাত প্রত্যাশীদের অন্তর্জগতকে কতটুকু নাড়া দেবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষই। কিয়ামতের পূর্বে শান-শওকতভরা মসজিদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যৎবাণীটা মনের গহীনে এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। আমীন!
শেখ যায়েদ মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর আবুল হোসাইন ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন ‘খলীফা পার্কে’। সবুজ ঘাসে ঘেরা ফুলের বাগান, ফোয়ারা ও লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা এই পার্কে ইমারতীরা পরিবার নিয়ে আসে। আমরা ৭ দিরহাম দিয়ে টিকিট কেটে টাইম টানেলে ঢুকলাম। ইমারতের ইতিহাসকে জীবন্ত করে দেখানোর জন্য যাদুঘরের আদলে গড়ে তোলা এই টানেলে ভ্রমণ করতে হয় ছোট্ট ক্যাপসুলে বসে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ইংরেজী ও আরবীতে ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে হারিয়ে যেতে হয় ইতিহাসের অরণ্যে। ২০ মিনিটের এই নাটকীয় ক্যাপসুল যাত্রাটি বেশ উপভোগ্য। টানেল থেকে বের হ’লেই দেয়ালের গহবর জুড়ে বিরাট এ্যাকুরিয়াম। নানা রঙের মাছের সাথে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক মস্ত বড় কাছিম।
পার্কের সবুজ ঘাসের বিছানায় বসে আমরা এক চিত্রালী পাকিস্তানী চা বিক্রেতা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চা পান করি। অদূরে এক বিদেশী মধ্যবয়সী দম্পতি খুব যত্নের সাথে পার্কের বিড়ালদের খাবার খাওয়াচ্ছেন। বিড়ালগুলো দলবেঁধে তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করছে। দৃশ্যটা বড় ভাল লাগে।
পার্ক থেকে মাগরিবের ছালাত আদায় করে আমরা আবুধাবী ডাউনটাউনের দিকে রওয়ানা দিলাম। সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেশ জ্যাম। গন্তব্য কর্ণিশ রোড, যেখান থেকে সাগরপাড়ের বিখ্যাত ক্বছরুল ইমারাত বা ইমারাত প্যালেস হোটেল দেখা যায়। সেখানে পৌঁছে আমরা পারস্য উপসাগরের পাশে দাড়িয়ে রাতের আলো ঝলমলে আবুধাবীর সৌন্দর্য উপভোগ করি। হাতে সময় কম। পার্শ্ববর্তী বিশাল মেরিনা মল থেকে কিছু কেনাকাটা সেরে আমরা আবার রওয়ানা হলাম ফাহাদ ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে। রাত ৯টা বেজে গেল পৌঁছতে। ফাহাদ ভাই বিরাট আয়োজন করেছেন খানাদানার। সামুদ্রিক মাছ থেকে শুরু করে কোর্মা, কোফ্তা, হরেক প্রকারের সবজি, বড়া, ভর্তা, পায়েস কী নেই সেখানে। চট্টগ্রামের মানুষ তিনি। এমন খানাদানী আয়োজনে সিদ্ধহস্ত। তাঁর আন্তরিক আতিথেয়তা ও দিলখোলা আলাপচারিতায় আমরা মুগ্ধ হ’লাম। তার গাড়িতেই আমরা আবুধাবী ঘুরলাম। রাতে আবার একই গাড়িতে আবুল হোসাইন ভাই এবং জামালুদ্দীন ভাই (ফেনী) আমাদের দুবাই রেখে আসলেন। আল্লাহ তাদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন!
রাত ১১টার দিকে দুবাই পৌঁছেই আমরা পেয়ে গেলাম মুর্শিদাবাদের মতীউর রহমান মাদানী ভাইকে। তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্যই আবুধাবী থেকে আমরা আবার দুবাই ফিরে এসেছিলাম। তিনি আজই ইন্ডিয়া থেকে ওমান হয়ে দুবাই পৌঁছালেন। তাঁর সাথে দীর্ঘরাত পর্যন্ত গল্পগুজব হ’ল। নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। অন্যদিকে আমাদের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় এবং আমার পাকিস্তান জীবনের ঘনিষ্ট সঙ্গী ছোট ভাই নাছরুয্যামান নাঈম তুরস্ক থেকে সকালে দুবাইতে এসে পৌঁছেছে ব্যবসায়িক কাজে। আমাদের অবস্থানস্থল দূরে হওয়ায় এই রাতে তার সাথে সাক্ষাতের আর সুযোগ হ’ল না। ও বলল, ভাইয়া! পাঁচ মিনিটের জন্য হ’লেও দেখা যেন হয়। ওর এই আঁকুতি মন ছুঁয়ে গেলেও কিছু করার ছিল না। একই শহরে থেকেও এই সাক্ষাৎ না পাওয়াটা বড় কষ্ট দিল।
১৬ই মার্চ ২০২৩ ফজরের পূর্বে আমরা আমাদের হোস্টকে বিদায় জানিয়ে দুবাই থেকে আবুধাবী বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য রওয়ানা হই। মুনীরুল ইসলাম (লক্ষীপুর) ভাই আমাদের নিতে এসেছিলেন। দ্বীনদার, নিপাট ভদ্রলোক মুনীর ভাই দুবাই শহরটা আরো ঘুরিয়ে দেখাতে না পারায় অনুযোগ করলেন। আসলেই একদিন/দু’দিনে দুবাই শহরে বিশেষ কিছু দেখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সাথে একই সালে জন্ম নেয়া এক অখ্যাত জেলেপল্লী দুবাই আজ বিশ্বের নয়নাভিরাম সুপার মেগাসিটিতে পরিণত হয়েছে বিস্ময়কর দ্রুততায়। আইন-শৃংখলা রক্ষায় বিশ্বের জন্য মডেল এই শহরে কোন পুলিশের চেহারা দেখতে পেলাম না। একটি দায়িত্বশীল ও দক্ষ নেতৃত্ব কিভাবে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে আমূল বদলে দিতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আরব আমিরাত। অনৈসলামিক কালচারের ব্যাপক প্রসার এদেশের ইসলামী ঐতিহ্যের উপর মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করলেও বৃহত্তর আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে পশ্চিমাদের প্রভাব এখনও খুব জোরালোভাবে পড়েনি বলেই অনুমিত হয়েছে। বিশেষ করে শারজাহ, আবুধাবীর মত পার্শ্ববর্তী শহরগুলো এখনও যথেষ্ট মার্জিত, রক্ষণশীল এবং ইসলামী সংস্কৃতি রক্ষায় যত্নবান মনে হয়েছে।
মুনীর ভাইকে বিদায় জানিয়ে সকাল সাড়ে নয়টায় ইত্তিহাদের একটি ফ্লাইটে আমরা রওয়ানা হ’লাম সঊদী আরবের পূর্বাঞ্চলীয় শহর দাম্মামের উদ্দেশ্যে। শেষ হ’ল আমাদের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সংক্ষিপ্ত ‘আরব আমিরাত’ অধ্যায়।
(ক্রমশঃ)