গত ৩০ সেপ্টেম্বর’১৩ (ঢাকা থেকে পাকিস্তান আসার সময়) করাচী থেকে ইসলামাবাদগামী পিআইএ’র ডোমেস্টিক ফ্লাইটে উঠার পর কেবিন ক্রু হাতে ধরিয়ে দিল পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ ইংরেজী দৈনিক দ্যা ডন। নামটির সাথে পরিচয় অনেক দিনের, সেদিন প্রথম পত্রিকাটি হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ পেলাম। প্রথম পাতা জুড়ে সেদিন ছিল বিগত সপ্তাহে পেশোয়ারে ঘটে যাওয়া পরপর দু’টি বোমা হামলার নিউজ ফলোআপ। প্রায় দেড়শ’ বনু আদমের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছিল সেই হামলায়। ফলে ‘সংঘাতমুখর’ পাকিস্তানে পা দেয়ার পর পরই ‘পেশোয়ার’ নামটির সাথে সন্ত্রাসের একটা সম্পর্ক মাথায় গেঁথে গিয়েছিল অবচেতনভাবে। ইসলামাবাদে আসার পর সে ধারণাটি পোক্ত হয়েছে আরো অনেকগুণ। যে কারো সামনে পেশোয়ার প্রসংগ আসুক না কেন, পেশোয়ারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তাবাহিনীর কড়াকড়ি নিয়ে দু’চার কথা শুনিয়ে দেবেই। সে কারণে ইসলামাবাদ থেকে সড়কপথে মাত্র ২ঘন্টার পথ হলেও ঐতিহাসিক এই শহরটা ঘুরে আসার চিন্তা স্থগিত রাখতে হয়েছিল।

দেখতে দেখতে ইসলামাবাদ ইউনিভার্সিটিতে আমার ৩টি মাস কেটে গেল। জানুয়ারীর ২য় সপ্তাহে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে পরিকল্পনা ছিল লাহোর সফরের। কোন কারণে যাওয়া হল না। ভাবলাম এই ফাঁকে পেশোয়ার শহরটা দেখে আসা যায়। কিন্তু যাওয়ার জন্য সঙ্গী প্রয়োজন। পেশোয়ারের পরিচিত ছাত্ররা পরীক্ষার পরদিনই পেশোয়ার শরণার্থী শিবির কিংবা আফগানিস্তান চলে গেছে। ফলে তাদের কাউকে এখন পাওয়া যাবে না। ওদিকে শাহীন লাহোর থেকে মাত্রই ইসলামাবাদ এসেছে। শেষমেশ ওকেই ফোন দিয়ে সহযাত্রী হিসাবে রাজী করালাম। অবশ্য বাধ্য করলাম বলাটাই ভাল। কারণ পেশোয়ারকে আর সব পাকিস্তানীর মত সেও একটা সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী হিসাবে জানে। নিজে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, উল্টো আমি যেন না যাই সে ব্যাপারে তার দীর্ঘ ৮ বছর পাকিস্তানবাসের অভিজ্ঞতা ঢেলে সবক দেয়া শুরু করল। এমতাবস্থায় শেষ অবধি যে ওকে রাযী করাতে পারলাম এ আমার কৃতিত্বই বলতে হবে।

যাত্রার পূর্ব রাতে আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশের এক জুনিয়র স্টুডেন্ট রশীদ আহমাদ বিন আব্দুল্লাহকে রুমে ডেকে আনলাম। উজবেক বংশোদ্ভূত ছেলেটা কট্টর আহলেহাদীছ। অসম্ভব মেধাবী ও বহুভাষী এই ছেলে মাতৃভাষা উজবেকসহ ফার্সী, পশতু, আরবী ও ইংরেজী ভাষা জানলেও বিস্ময়করভাবে এতদিনেও উর্দূ ভাষা রপ্ত করতে পারেনি। পেশোয়ারের বিভিন্ন আহলেহাদীছ মাদরাসায় মাধ্যমিক স্তর থেকে দাওরা পর্যন্ত শেষ করার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। ফলে পেশোয়ারের আহলেহাদীছ মাদরাসা এবং আলেমদের সম্পর্কে তার জানাশোনা বিস্তর। তার কাছে তথ্য পেলাম পেশোয়ারের নবতিপর আলেম শায়খ আব্দুল সালাম রুসতমী (সাবেক মুদীর, মাদরাসাতু তা‘লীমীল কুরআন আলা মানহাজিস সালাফ, বাদাবীর এবং সাবেক আমীর, জামা‘আতু ইশা‘আতুত তাওহীদ ওয়াস সুন্নাহ আলা মিনহাজিস সালাফ আস-সালেহীন), তাঁর পুত্র মাওলানা আবু সাঈদ (একই মাদরাসার বর্তমান মূদীর) শায়খ আমীনুল্লাহ পেশোয়ারী (মুদীর, মাদরাসা তা‘লীমুল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ, গান্জ এবং অদ্যাবধি ১১টি খন্ড প্রকাশিত ধারাবাহিক ফৎওয়া সংকলন ‘ফতোয়া আদ-দ্বীনুল খালেছ’ গ্রন্থের সংকলক), শায়খ আব্দুল আযীয নূরস্থানী (মূদীর, জামেআ আছারিয়া জাদীদাহ, চমকানী বাজার), শায়খ গোলামুল্লাহ রহমতী (মূদীর জামেআ‘ দারুল কুরআন ওয়াল হাদীছ আস-সালাফিয়াহ, কাযীকালী), শায়খ হাদিয়ুর রহমান বিন জামিলুর রহমান (মূদীর, জামে‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী, চমকানী মোড়), মু‘তাছিম বিল্লাহ ইকরামী (জামে‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী-এর শিক্ষক ও শায়খ ইকরামুল্লাহ বাদাখশানীর পুত্র), রুহুল্লাহ তাওহীদী (রাহনুমা, জমঈয়াতুশ শাবাব আস-সালাফিয়াহ পেশোয়ার) প্রমুখ আহলেহাদীছ আলেম সম্পর্কে। এছাড়া সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন এমন কয়েকজন আলেম যেমন শায়খ ইকরামুল্লাহ বাদাখশানী, শায়খ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদী, ড. শামসুদ্দীন আফগানী (১৯৫২-২০০০খৃঃ) (সাবেক মুদীর, জামেআ আছারিয়া মারকাযিয়া কাদ্বীমাহ, সুফায়েদ ঢেরী), শায়খ হামীদুল্লাহ ফায়েক, শায়খ কাযেম আশ-শারেকী প্রমুখ সম্পর্কে তথ্য পেলাম। তার কাছে শায়খ ইকরামুল্লাহ বাদাখশানীর একটি বই পেলাম ‘কাশফুল বাহেছ আন হাক্বীকাতিল বিদ‘আহ’ শিরোনামে। আরবী ভাষায় রচিত বিদ‘আত বিষয়ক প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার এই বইটি খুব গোছালো আলোচনা সমৃদ্ধ। ১৯৮১ সালে পাকিস্তানে হিজরত করে আসা এই আফগানী আহলেহাদীছ আলেম ফারসী ভাষায় ৮ খন্ডে রচনা করেছেন পবিত্র কুরআনের তাফসীর ‘আযহারুল বায়ান’। ফারসী ভাষায় মানহাজে সালাফ মোতাবেক রচিত এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ কোন তাফসীর গ্রন্থ।

তথ্যগুলো নিয়ে মোটামুটি দু’দিনের সফর পরিকল্পনা করে ফেললাম। পরে আফগানী আব্দুর রঊফ ভাই এবং ইসলামাবাদের আব্দুল বাছীর ভাইয়ের কাছে আরো কিছু তথ্য নিয়ে রওনা হলাম ১২ জানুয়ারী’১৪ বেলা ১০টার দিকে।

বের হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিরুৎসাহবার্তার কোন অভাব হল না। ডজনখানেক আপত্তি এসে উপস্থিত হল কেন পেশোয়ার যাব এই পরিস্থিতিতে, পথে বার বার চেকিং হয় আর সামান্য সন্দেহ হলেই এজেন্সির লোকেরা তুলে নিয়ে যায়। এই মুহূর্তে বিশেষ করে কোন বিদেশীর ওখানে যাওয়া খুবই রিস্কি ইত্যাদি। স্বয়ং পেশোয়ারীরাও খুব সাবধান করল। কিন্তু বরাবরের মত এতসব সতর্কবার্তায় কান দেওয়ার মত উৎসাহ পেলাম না। আমার ভাবলেশহীনতায় অনেকেই মনক্ষুণ্ণ হলেন। কিছুটা নাছোড়বান্দা স্বভাব থাকলেও আমার স্থির বিশ্বাস কখনও নির্বিকল্প একরোখা টাইপের ছিলাম না। কিন্তু এখানকার সাথী ভাইয়েরা আমাকে রীতিমত একরোখাই ভেবে বসলেন। কি আর করা, অবশেষে ‘অপবাদে’র বোঝা মাথায় নিয়েই রওয়ানা হলাম। মনের মধ্যে অবশ্য একটু খচ্খচানী রয়ে গেল, এত নিষেধ মাড়িয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে তো!

ইসলামাবাদের G-9 মারকায (করাচী কোম্পানী) থেকে ১৫/২০ মিনিট পর পর হাইস মাইক্রো সার্ভিস পেশোয়ারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এই মাইক্রোতেই আমরা রওনা হলাম। মটরওয়ে ধরে প্রায় ১৮৫ কি.মি. যাত্রাপথ। ৬ লেনের চওড়া রাস্তায় কোন প্রকার যানজটের সুযোগ নেই, নেই কোন স্পীড ব্রেকার। নির্বিঘ্নে ১২০ কি.মি. গতিতে গাড়ি ছুটল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাংক রোড ধরেও পেশোয়ার যাওয়া যায়। তবে মটরওয়ের রাস্তাটি নতুন এবং সুপ্রশস্ত হওয়ায় এই রাস্তাটিই এখন অধিক ব্যবহৃত হয়। মটরওয়েতে এটোক যেলা পর্যন্ত ৮০ কি.মি. রাস্তাটির অধিকাংশটাই পাহাড় বেষ্টিত। হাইওয়ের দু’দিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের উপস্থিতি যাত্রাপথে যেন এক ভিন্ন আমেজ জুড়ে দেয়। এটোক যেলা অতিক্রম করার সময় ছাওয়াবী-জাহাঙ্গীরা রোড ক্রসিং-এর কিছু আগে পড়ল বিখ্যাত সিন্ধু নদ। আমাদের পদ্মা, যমুনা নদীর মতই করুণ দশা। বিশালাকার নদীর দুই-তৃতীয়াংশই চরে ঢাকা পড়ায় নদীর মূল স্রোতধারার খোঁজ পাওয়াই দুষ্কর। এটোক যেলার পর নওশেরা যেলা এবং এখান থেকেই পাকিস্তানের সবচেয়ে ছোট প্রদেশ খাইবার-পাখতুনখোয়া (কেপিকে) শুরু হয়েছে। প্রাচীন গান্ধারা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এই প্রদেশটি ইতিপূর্বে বৃটিশদের দেয়া ‘নর্থওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স’ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নামে পরিচিত ছিল। ২০১০ সালে এর নতুন নামকরণ করা হয় খাইবার-পাখতুনখোয়া (পাখতু ভাষায় ‘পাখতুনখোয়া’ বা ‘পাখতুনখাওয়া’ অর্থ পাখতুনদের হৃদয়)।

নওশেরা! নামটি চোখে পড়ার পর মনে পড়ল এই তো সেই এলাকা, যেখানে শিখ-ইংরেজ বিরোধী জিহাদের উদ্দেশ্যে আহলেহাদীছ আন্দোলনের বীর সিপাহসালার সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, শাহ ইসমাঈল শহীদসহ মুজাহিদদল আগমন করেছিলেন। সিত্তানা, মুলকার বিখ্যাত যুদ্ধগুলো তো এই এলাকাতেই ঘটেছিল। অজানা শিহরণে মনটা আনচান করে উঠল। নওশেরা থেকে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের জিহাদকেন্দ্র বিখ্যাত পাঞ্জতার ঘাঁটি বেশী দূরে নয়। পার্শ্ববর্তী ছওয়াবী যেলা থেকে আরো কিছুটা উত্তর-পূর্বদিকে যেতে হয়। ১৮২৭ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছর যাবৎ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ও তাঁর মুজাহিদদল এই ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাছাড়া ভারত উপমহাদেশ থেকে বৃটিশদের উৎখাতে যুগান্ত সৃষ্টিকারী জিহাদ আন্দোলনের সেই বেদনাবিধূর স্মৃতিবাহী ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধের ময়দানও এই খাইবার-পাখতুনখোয়ার মানশেরা যেলার এক প্রান্তে অবস্থিত। এবারের সংক্ষিপ্ত সফরে উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের গৌরবমন্ডিত ইতিহাসের নির্বাক স্বাক্ষী পাঞ্জতার, বালাকোটের প্রান্তরগুলো ঘুরে দেখা সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে কোন একসময় নিশ্চয়ই আসব ইনশাআল্লাহ।       

নওশেরা এবং পেশোয়ার যেলার সীমানায় ঢোকার পর থেকে পাহাড়গুলো সব উধাও হয়ে গেল। তার পরিবর্তে রাস্তার দুপার্শ্বে বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। শাক-সব্জি, ধান, গম আর সরিষার তাজা লকলকে শীষের সমারোহ দেখে বিস্মিত হতে হ’ল। পেশোয়ার মানেই রুক্ষ খাইবার পাসের যে চোখ ঝলসানো চিত্র ফুটে ওঠে মনের আয়নায়, তাতে দৃষ্টির সামনে শুধু বৃক্ষ-পল্লববিহিন ঊষর মরুর ধুসর পাহাড়ই থাকার কথা। কিন্তু এ দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো দৃশ্য। পেশোয়ার শহর থেকে ১৫-২০ কি.মি. আগে টলটলে নীল পানির স্নিগ্ধ কাবুল নদীর দেখা মিলল। অন্ততঃ সিন্ধুর নদের চেয়ে স্বাস্থ্যবান চেহারা দেখে মনে হ’ল একটা নদী বটে।

ঠিক দু’ঘন্টা পর বেলা ১টায় পেশোয়ার আড্ডা তথা বাসস্টান্ডে পৌঁছলাম (বাসস্ট্যান্ডের উর্দূ পরিভাষা আড্ডা)। বাসস্টান্ড মসজিদে যোহরের ছালাত আদায় করে সেখান থেকে উদ্ভট সাজে সজ্জিত এক ট্রাকসদৃশ লোকাল বাসে চড়লাম জামরুদ বাযার তথা বাবে খাইবারের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভিং সীটটা ট্রাক ওরফে বাসের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়। অলংকারাদির তীব্র ভিড়ে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে সামনের ঝাপসা উইন্ডস্ত্রীণটা। বুড়ো পাঠান ড্রাইভার সেই ভিড় ঠেলে কিভাবে রাস্তা মাপেন সেই কৌতুহল নিবারণ আর সেই সাথে শহরটাও দেখা-এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের জন্য ড্রাইভারের পার্শ্বে আধ খোলা দরজার মুখে বসে পড়লাম। শহরের মধ্য দিয়ে যানজট ঠেলে গাড়ি চলতে শুরু করল। পেশোয়ার শহর যে এত প্রাণবন্ত ও জনবহুল সেটা কল্পনাই করিনি। পুরোনো ঢাকার মত একই রোডে ঘোড়া, খচ্চরের গাড়ি থেকে শুরু করে বিএমডব্লিউ পর্যন্ত সব ধরণের গাড়িঘোড়ার সরব উপস্থিতি। সেই সাথে প্রচুর যানজট। বিলাসবহুল শপিং মল থেকে শুরু করে সর্বধরণের মার্কেট মিলিয়ে শহরটা খুব জমজমাট। অফিস-আদালতে, বাজারঘাটে সর্বত্রই মানুষের প্রধান ব্যবহারিক ভাষা পশতু, পাখতু কিংবা হিন্দকো। ফলে সেসব দূর্বোধ্য ভাষার অবাধ দাপটে নিজেকে কেমন যেন ভিন গ্রহের আগন্তুক মনে হয়।

জিটি রোড ধরে শহর থেকে প্রায় ১৮ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে জামরুদ। যাত্রা শুরুর পর সদ্দর রোড ক্রসিং-এর উপর মালিক সা‘দ শহীদ ফ্লাইওভার অতিক্রম করার সময় লক্ষ্য করলাম রাস্তার বাম পার্শ্বে বিরাট এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে দেড় সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক বালা হিছার কেল্লা। বিরাটকায় বুক হিম করা এই কেল্লাটি সর্বপ্রথম কে নির্মাণ করেছিলেন তা জানা যায় না। তবে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় বহু রাজ-রাজড়া ও সেনাপতিরা খাইবারের পথে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১০০১ খৃষ্টাব্দে সুলতান মাহমূদ প্রথম হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে এসে হিন্দু রাজা জয়পালকে পরাজিত করে এই কেল্লায় অবস্থান করেছিলেন। পরবর্তীতে মোগল বাদশাহ হুমায়ূনও এখানে কিছুকাল অবস্থান নিয়েছিলেন। ভূমি সমতল থেকে ৯০ ফুট উচ্চতার এই বিশাল কেল্লাটির টহল চৌকি থেকে সমগ্র পেশোয়ার ও খাইবার ভ্যালির উপর নজর রাখা হ’ত। ইতিহাসে পড়া কেল্লার ধারণার সাথে এই কেল্লার দারুণ মিল পেয়ে ঘাড় কাত করে বিহবল নজরে দেখরাম অনেকক্ষণ। ১৯৪৯ সাল থেকে এটি পাকিস্তান সীমান্তরক্ষী বাহিনী ফ্রন্টিয়ার করপ্স (এফসি)-এর হেডকোয়ার্টার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে কেল্লার প্রাচীন অবয়ব ঠিক থাকায় এর ঐতিহাসিক গাম্ভীর্য এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। সম্প্রতি অবশ্য এফসি’র হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর করে কেল্লাটিকে পূর্ণাঙ্গ পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেপিকে সরকার।

তারপর সদ্দর রোডে পেশোয়ার মিউজিয়ামের সামনে দিয়ে জামরুদের পথে গাড়ি এগিয়ে চলল। এমন জনবহুল গমগমে শহর কিভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব হ’তে পারে ভাবতেই অবাক লাগে। মানুষের অবিশ্রান্ত ছুটাছুটি, রাস্তার ফুটপাথে হকার ও ভাসমান দোকানদারদের হাক-ডাক, গাড়ি-ঘোড়ার ব্যস্ত চলাচলে কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা টের পাওয়া যায় না। কেবল কিছু স্থানে রাস্তার ধারেই নিরাপত্তাবাহিনীর বাংকার খুড়ে সতর্ক প্রহরা এবং মেশিনগান, মর্টার, রকেট লাঞ্চারের মত ভারী অস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র মহড়া জানিয়ে দেয় এটা পেশোয়ার।

মূল শহর ছেড়ে শহরতলীর দিকে আসার পর পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামিয়া কলেজের দেখা মিলল। পেশোয়ার বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রিক আরো কয়েকটি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এখানে। ফলে এই এলাকাটি একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানগরীতে পরিণত হয়েছে। তারপর হায়াতাবাদ চেকপোস্টে পেঁŠছে সেখান থেকে স্মাগলিং-এর জন্য কুখ্যাত বাজার কারখানো মার্কেট এবং কাবুল নদীর একটি শাখা নদী ‘চাওড়া খাওয়ার’ পার হয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে গেলাম জামরুদ বাযার।

খাইবার পাস প্রবেশের পূর্বে এটাই সর্বশেষ বাযার। খাইবার এজেন্সির উৎপাদিত যাবতীয় দ্রব্য-সামগ্রীর প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র এই বাযার। পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এখানে আসে পণ্য কেনার জন্য। বিশাল বাযারটিতে কিসমিস, বাদামসহ নানা শুকনো খাবারেরও বিরাট আমদানী রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী পাকোড়াসহ সুস্বাদু স্ট্রীট ফুডের প্রচুর দোকান। এমনকি শুনলাম এখানে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় কালাশনিকভ, একে-৪৭ রাইফেলের অনুকরণে পাঠানীদের নিজস্ব তৈরী বন্দুক ও গুলী। খুব কম দামে এসব অস্ত্র বেশুমার পাওয়া যায় এখানে। দু’বছর আগে এই বাযারের মধ্যস্থলে এক গাড়ীবোমা হামলায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। বাস থেকে নেমে আমরা সোজা হেঁটে চলে আসলাম সুপ্রসিদ্ধ বাবে খাইবারের নীচে। একে তোরখাম গেটও বলা হয়। ছোটখাটো দুর্গফটক সদৃশ এই গেটটি ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এটি পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকার সীমানা হিসাবে পরিগণিত হয়। এরপর থেকে পাক-আফগান বর্ডার তথা তোরখাম বর্ডার পর্যন্ত এলাকাটি আধা-স্বায়ত্বশাসিত খাইবার এজেন্সি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। কেপিকে’র সীমান্তবর্তী এলাকা জুড়ে আরো এরূপ ৬টি ট্রাইবাল এজেন্সি (ফেডারেলী এ্যাডমিনিস্ট্রেটেড ট্রাইবাল এজেন্সি/ফাটা) রয়েছে যেগুলোতে সরকারের শাসন চলে নামকাওয়াস্তে। অনাদিকাল থেকে সেখানে চলে আসছে পাঠানদের গোত্রীয় শাসন। এরা সরকারী নিয়ন্ত্রণের ধার ধারে না, কিন্তু সরকারী সুবিধাদি যেমন পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সব গ্রহণ করে। আবার এর জন্য কোন প্রকার মাশুল প্রদান করে না। খাইবার এজেন্সি এমনই একটি অঞ্চল। এখানকার জনগোষ্ঠী অধিকাংশই আফ্রিদী গোত্রভুক্ত। জনপ্রিয় পাকিস্তানী ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদী এই অঞ্চলের অধিবাসী।

বাবে খাইবার পেরিয়ে সামনে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পুলিশ চেকপোস্ট থেকে একজন গার্ড বেরিয়ে আসলেন। উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম তোরখাম বর্ডার যেতে হবে কিভাবে? উনি আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় জেনে উল্লসিত হয়ে ‘মেরে ভাই’ বলে কোলাকুলি করলেন। ইসলামাবাদেও দেখেছি বাংলাদেশী পরিচয়টা যেন বিশেষ সম্মানের। বাংলাদেশী শোনা মাত্র সচরাচর যে দৃশ্য দেখা যায় সহাস্যে ‘মেরে ভাই’ বলে এখানকার লোকজন আরেক দফা কোলাকুলি করে। সরকারী অফিসগুলোতেও এর ব্যত্যয় দেখিনি। উনি আমাদের কথা শুনে বললেন, প্রথমতঃ ট্রাইবাল এজেন্সিতে বিদেশীদের প্রবেশ করা খুব রিস্কি। দ্বিতীয়তঃ পেশোয়ার পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে এজন্য অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। তৃতীয়তঃ খাইবার পাস অতিক্রম করে বর্ডার পর্যন্ত যেতে দেড়-দু’ঘন্টা  সময় লেগে যাবে। এই বিকেলে ওখানে যেয়ে ফিরে আসতে পারবেন না। সুতরাং এখন পেশোয়ার ফিরে যান। কাল পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে অনুমতি নিয়ে তারপর আসেন’।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবে খাইবার থেকে মূল খাইবার পাসের এই ব্যবধানটা জানা ছিল না আমাদের। একেতো আজ কোনভাবে যাওয়ার সুযোগ নেই, অন্যদিকে এত কাছে এসে ফিরে যেতে মন চাইছে না একদমই। বাংলা সাহিত্যের অমর রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪খৃঃ) গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে কাবুল যাওয়ার পথে এখানে এসে থেমেছিলেন। জামরুদ ফোর্টে পাসপোর্ট দেখানোর পর পুনরায় শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা। তাঁর স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে খাইবার গিরিসংকটে আফ্রিদী পাঠানদের খুন-রাহাজানির ছেলেখেলা নিয়ে এক মনোজ্ঞ বিবরণ। এখানকার দূর্ধর্ষ পাঠানদের হাতে ধরা খেলে তার পরিণাম কি হয় তা নিয়ে মুজতবা আলীর ভয়ংকর রসিকতা...‘শিকারী হরিণ নিয়ে কি করে না-করে সকলেরই জানা কথা। চামড়াটুকুও বাদ দেয় না। এ স্থলে শুনলুম, শুধু যে হাসিটুকু গুলি খাওয়ার পূর্বে মুখে লেগেছিল সেটুকু হাওয়ায় ভাসতে থাকে। বাদবাকী উবে যায়’.. (দেশে-বিদেশে পৃঃ ৩৬)। সেদিন ভীত-কুণ্ঠিত লেখক বিপদসংকুল খাইবার পাস অতিক্রম করার পর হাফ ছেড়ে কাবুলী মটরচালকের যবানীতে লিখেছেন, ‘দুনিয়ার সব পরীক্ষা পাস করার চেয়ে বড় পরীক্ষা খাইবারপাস পাস করা’। তিনি তো তবু সে যাত্রায় পার হয়েছিলেন। কিন্তু আজ প্রায় শতবর্ষ পরে এই ‘আধুনিক সভ্যতা’র যুগে এসে সেই একই ‘জঙলী উপদ্রবে’র ভয়ে আরেক বাঙালীকে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হচ্ছে, এ সত্যিই বড় আফসোসের। বুক ফুঁড়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস এসে জানিয়ে দিয়ে গেল, পৃথিবীটা আসলে এগিয়েছে নামমাত্র, ঝকমকে বহিরাবরণের অন্তরালে খোল-নলচেটা রয়ে গেছে আদিমতরই।

খাইবার অভিমুখে চলে যাওয়া আলগা পীচ ঢালা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। সামনেই দেখা যাচ্ছে শত-সহস্র বছরের জ্বলজ্বলে ইতিহাস গায়ে জড়িয়ে সমহিমায় দন্ডায়মান হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণীর শাখা ‘স্পিন গার’ বা ‘সফেদ কোহ’ পর্বতশ্রেণী। পারসিক বীর দারিউস (খৃঃপূঃ ৫৫০-৪৮৬), ‘গ্রীক মহাবীর’ খ্যাত আলেকজেন্ডার (খৃঃপূঃ ৩২৬ সালে ইন্ডিয়া আক্রমণ করতে আসেন) থেকে শুরু করে মুসলিম বীর সুলতান মাহমূদ গযনভী (৯৭১-১০৩০খৃঃ), মোহাম্মাদ ঘোরী (১১৪৯-১২০৬খৃঃ), মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খান (১১৬২-১২২৭খৃঃ), তৈমূর লং (১৩৩৬-১৪০৫খৃঃ), মোগল সম্রাট বাবর (১৪৮৩-১৫৩০খৃঃ)সহ দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রাচীনতম প্রবেশদ্বারে কত বীরপুরুষের যে পদধূলি পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চলা সংকীর্ণ রাস্তা ধরেু লান্ডি কোটাল পৌঁছতে প্রায় ৩০ কি. মি. পথ অতিক্রম করতে হয়। এই অংশটুকুই ‘খাইবার পাস’ নামে সুবিখ্যাত। লান্ডি কোটাল থেকে পাক-আফগান সীমান্ত তোরখাম বর্ডার পৌঁছতে আরো যেতে হয় প্রায় ৮ কি.মি.। তোরখাম বর্ডার থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের দূরত্ব বেশী নয়। বর্ডার থেকে তোরখাম হাইওয়ে ধরে বাসে জালালাবাদ শহর ২ ঘন্টা, আর সেখান থেকে কাবুল যেতে ৪ ঘন্টার মত সময় লাগে। আপাততঃ এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথের চাক্ষুস মাহাত্ম্য অনুধাবনে শামিল হ’তে না পারলেও সৈয়দ মুজতবা আলীর বিবরণ থেকে কিছুটা জেনে নেয়া যেতে পারে। তাঁর এক ঝলক বর্ণনায়...‘দু’দিকে হাযার ফুট উঁচু পাথরের নেড়া পাহাড়। মাঝখানে খাইবার পাস। এক জোড়া রাস্তা এঁকেবেঁকে একে অন্যের গা ঘেঁসে চলেছে কাবুলের দিকে। এক রাস্তা মটরের জন্য, অন্য রাস্তা উট, খচ্চর, গাধা, ঘোড়ার পণ্যবাহিনী বা ক্যারাভানের জন্য। সংকীর্ণতম স্থলে দুই রাস্তায় মিলে ত্রিশ হাতও হবে না। সে রাস্তা আবার মাতালের মত টলতে টলতে এতই এঁকেবেঁকে গিয়েছে যে, যে-কোন জায়গায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে ডাইনে বাঁয়ে পাহাড়, সামনে পিছনে পাহাড়। দ্বিপ্রহর সূর্য যেন সেই নরককুন্ডে সোজা নেমে এসেছে। তাই নিয়ে চতুর্দিকের পাহাড় যেন লোফালুফি খেলছে। এই গিরিসংকটে আফগানের লক্ষ কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়ে কোটি কণ্ঠে পরিবর্তিত হত। এই গিরিসংকটে এক মার্তন্ডে ক্ষণে ক্ষণে লক্ষ মার্তন্ডে পরিণত হন...’ (দেশে-বিদেশে, পৃ ৩৪)।  

খাইবার পাসে সর্বপ্রথম রেলপথ বসায় বৃটিশরা। বোলান পাসের মত এখানেও তাদের উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত আধিপত্য রুখে দেয়া। ১৯২৫ সালে রেলপথটির উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের দিন একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম ট্রেনটি চালনা করেছিলেন খাইবার পাস রেলপথের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ভিক্টর বেইলির স্ত্রী। এর একটি কারণ হিসাবে বলা হয়েছে উদ্বোধনের মাত্র ৩ মাস আগে মৃত্যুবরণ করা ইঞ্জিনিয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। অপরটি হল, পাঠানমুলুকে বৃটিশ রেলগাড়ী অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছিল খাইবারের পাঠানদের মধ্যে। তাই তারা বাঁধা দিতে পারে এই আশংকা থেকে মিসেস ভিক্টর বেইলীকে ড্রাইভিং সিটে বসানো হয়। কেননা রেল কর্তৃপক্ষ জানত, পাঠানরা নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই সামনে মহিলা উপবিষ্ট দেখলে তারা আক্রমণ চালানো থেকে বিরত হবে। বলা বাহুল্য, তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল এবং ট্রেন নিরাপদেই গন্তব্যে পেঁŠছেছিল।

২০০৬ সালে বন্যায় রেলপথটি ভেসে গেলে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অদ্যাবধি তা বন্ধই আছে। আসার সময় জামরুদের আগে কাবুল নদীর শাখা নদীটির উপর ঝুলে পড়া রেলব্রিজ এবং রেলপথটি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এখনও পর্যন্ত রেলপথটি সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ার কারণ কি? সম্ভবত নিরাপত্তাহীনতার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবেই পাকিস্তান সরকার রেলপথটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

খাইবার গেট দিয়ে এদিন গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল অনেক কম ছিল। কেবল ধূলো উড়িয়ে ন্যাটো সেনাদের জন্য রসদবাহী কাবুলগামী বিশাল কয়েকটি ট্রাক যেতে দেখা গেল। গেটের ঠিক ডান পার্শ্ব দিয়ে উঁচু টিলার উপর বৃহৎ জায়গা জুড়ে অবস্থিত জামরুদ ফোর্ট। ১৮৩৬ সালে শিখ রাজা রনজিৎ সিং-এর এক সেনাপতি খাইবারের পাঠান বাহিনীকে পরাজিত করার পর বিজয়স্মারক হিসাবে এই কেল্লাটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে কেল্লাটি ফ্রন্টিয়ার করপ্সের রেজিওনাল অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে ভিতরে ঢোকার সুযোগ নেই।

ভগ্ন মনোরথ হয়ে খাইবার গেট থেকে আবার জামরুদ বাযারের দিকে ফিরে আসলাম। কিছু কেনা-কাটা করার পর ফিরতি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলাম সে সময় কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল শাহীনের এক ক্লাসমেটের সাথে। আফ্রিদী সম্প্রদায়ভুক্ত সেই ভাই তো শাহীনকে পেশোয়ারে দেখে বিস্ময়ে হতবাক। উনি নিজে বর্তমানে খাইবার এজেন্সির সদর হাসপাতালে বেশ বড় দায়িত্বে আছেন। সব শুনে উনি বললেন, ‘তাহলে তোমরা একটা দিন অপেক্ষা কর, আমি কালকে আমার গাড়ি নিয়ে তোমাদের নিয়ে যাব। আমি সাথে থাকলে কোন সমস্যা হবে না’। কিন্তু উপায় নেই। পরদিন আমাদের প্রোগ্রাম ছিল আহলেহাদীছ মাদরাসাগুলো সফরের। তাই জোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অপারগতা জানিয়ে পরবর্তীতে কোন একসময় আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে আসলাম।

জামরুদ থেকে আমরা সোজা এসে পৌছলাম জিটি রোডের পার্শ্বেই অবস্থিত শতবর্ষের পুরোনো ইসলামিয়া কলেজে। ১৯১৩ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিল ইংরেজরা। মুঘল ও তুর্কী আর্টে নির্মিত বিশাল এই ইউনিভার্সিটি কলেজ এতটাই সৌন্দর্য এবং আভিজাত্যের পসরা বসিয়েছে যে শিক্ষাকেন্দ্রের পরিবর্তে একে পর্যটনকেন্দ্র বললেই বেশী মানায়। পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে কলেজ ক্যাম্পাস ঘিরে সারি সারি কমলার গাছ আর তাতে কদম ফুলের মত ফুটে থাকা পরিপক্ক গাঢ় রংয়ের কমলা দেখে আমরা বিমোহিত হয়ে গেলাম। খাওয়ার জন্য কিছু কমলা পাড়ার কথা ভাবছিলাম, হঠাৎ মনে হল এত কমলা কেউ পাড়ছে না কেন? নিষিদ্ধ নাকি! এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করতে সে হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে বলল, ভাই এটার নাম ‘নরেঞ্জ’, এটা ‘কেনু’ (কমলা) নয়। হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বলেন কি এটা খাওয়া যায় না? সে বলল, না এটা খাওয়ার জন্য নয়, কেবল শোভা বর্ধনের জন্য গাছগুলো লাগানো হয়েছে। ভেবে পেলাম না অবিকল কমলার মত দেখতে এই ফলের গাছ লাগিয়ে মানুষকে অকারণ ধোঁকার শিকার বানানোর মানেটা কি? পরে নিজেরা আবিষ্কার করলাম, কলেজ কর্তৃপক্ষ সম্ভবত কমলার গাছ হিসাবেই চারা রোপন করেছিল, কিন্তু ঘটনাক্রমে জাত ছিল ভিন্ন। ফলে গাছে কমলা ধরার পর কমলার চেহারা ঠিক থাকলেও স্বাদের ভিন্নতা দেখা দেয়ায় ওনারা একে ‘নরেঞ্জ’ অর্থাৎ ‘নট অরেঞ্জ’ নাম দিয়ে পিঠ বাঁচিয়েছেন। নতুবা বিচিত্র ‘নরেঞ্জ’ নামের আর কি কারণ থাকতে পারে!

মাগরিবের ছালাত সেখানেই আদায় করার পর পরিকল্পনা ছিল কিছ্ছাখানী বাযারে গিয়ে প্রয়োজনীয় বই-পত্র কেনা। মূলতঃ এই উদ্দেশ্যেই পেশোয়ার আসা। ফোন করলাম ‘তাহরীকে শাবাব সালাফিয়া’র প্রধান মাওলানা রূহুল্লাহ তাওহীদীর কাছে। ইসলামাবাদ থেকেই জেনে এসেছিলাম উর্দূবাজারে ‘মাকতাবা আইয়ূবিয়া’ নামে উনার একটা বইয়ের দোকান রয়েছে। উনি জানালেন, রাতে উনি থাকবেন না, তবে পরদিন বিকালে আসবেন। ফলে পরিকল্পনা বাতিল করে রাতে চমকানী মোড়ে ‘জামে‘আ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী (র.)’ মাদরাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কলেজের মেইন গেটে এসে ট্যাক্সি নেয়ার জন্য এক পথচারীর কাছে চমকানীর লোকেশন জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন, ‘ওহ! ঐ তালেবান এলাকা’? এ কথা শুনে শাহীন বেচারার চেহারা পান্ডুর হয়ে গেল। ও কাতর কণ্ঠে বলল, ‘দিনের বেলা যেখানে খুশি নিয়ে যাও। কিন্তু রাত্রে আমাকে রেহাই দাও, ঐখানে আমি যেতে পারব না’। বিকল্প ভাবতে গিয়ে হাবীবের কাছে খাইবার মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত বাঙালী ছাত্র শিহাবুদ্দীনের নাম্বার পাওয়া গেল। খাইবার মেডিকেল কলেজটা ইসলামিয়া কলেজের ঠিক পিছনেই। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ওকে ফোনে পাওয়া গেল। বিদেশ-বিভুঁইয়ে স্বদেশী অজানা-অচেনারাও যে কত শীঘ্র আপন হয়ে যায়, তা খুব ভালভাবে টের পেলাম শিহাবের সাথে পরিচয়ের পর। দিনাজপুরের বিরামপুর থানার শ্যামবরণ হাসি-খুশি ছেলেটা কফিশপে এসে আমাদের নিয়ে গেল ওর হোস্টেল রুমে। খাইবার মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে পড়াশোনা করছে এখন। পেশোয়ারে এখন বাঙালী বলতে ও একাই আছে। আমরা কিছু বলার আগেই ও আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করা শুরু করে দিল। তারপর ইসলামিয়া কলেজ মোড়ে এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। আমাদের জোর আপত্তি সত্ত্বেও একে একে হাজির করল দুম্বা কড়াই, চিকেন কড়াই, গাহওয়া ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী আফগানী আইটেম। ও বলল, ‘ভাইয়া আপনারা মোটেও আপত্তি করবেন না, বিদেশের মাটিতে আমরা সবাই এক পরিবারের মত। আমি ইসলামাবাদ গেলেও তো আপনারা এর চেয়ে বেশী করতেন, তাই না?’ ওর আন্তরিকতার সামনে আমাদের আর কিছু বলার রইল না। একেবারে গলা পর্যন্ত খাইয়ে ছাড়ল। ওর এক বালুচী পাঠান বন্ধু শাহরিয়ারও আমাদের সঙ্গ দিল। তারপর রুমে ফিরে এসে ঢেলে দিতে লাগল দীর্ঘদিনের জমে থাকা রাজ্যের সব গল্প।

সে রাতে খাইবার মেডিকেলের এই সীনা হোস্টেলেই থাকলাম। পরদিন শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সকাল ৯টার দিকে আমরা বের হলাম। প্রথমেই পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সুদৃশ্য স্থাপনা ঘুরে দেখলাম। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পাকিস্তানের অন্যতম প্রাচীন এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ার সর্বপ্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১১০০ একর আয়তন বিশিষ্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে এগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। মজার ব্যাপার হল এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলগুলো সব সারিবদ্ধ একই জায়গায় পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে। সত্যিই যেন একটা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানগরী। ইউনিভার্সিটির পিছনে শেখ যায়েদ ইসলামিক সেন্টার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি বড় ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র আছে। তবে ভিতরে ঢোকা গেল না, রবিবার তথা সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বন্ধ ছিল।

বেলা এগারোটার দিকে ভার্সিটি গেট থেকে একটা সিএনজি নিয়ে আমরা শহরের পূর্বদিকে চমকানী মোড়ের দিকে রওয়ানা হলাম। উদ্দেশ্য পেশোয়ারের সবচেয়ে বড় (আয়তনে) আহলেহাদীছ মাদরাসা জামে‘আ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী (রহ.)। সদ্দর, বালা হিছার দূর্গ, আড্ডা হয়ে আরো পূর্বদিকে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর চমকানী মোড় পৌছলাম। সেখানে নামার পর কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম মাদরাসার কথা। তারা পাশের একটা হানাফী মাদরাসা দেখিয়ে দিল। কিন্তু আমরা তো খুঁজছি আহলেহাদীছ মাদরাসা। এক মুরববী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন ‘ওয়াহহাবী মাদরাসা?’ হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই উনি পথ দেখিয়ে দিলেন। একটু ভিতরে ঢুকে সিএনজি একেবারে মাদরাসার মেইন গেটে নামিয়ে দিল। প্রাচীর ঘেরা মাদরাসা ক্যাম্পাসটি বাইরে থেকে অনেকটা বড় মনে হল। ভিতরে ঢুকতেই বন্দুকধারী গেটম্যানের মুখোমুখি হলাম। পরিচয় দেয়ার পর দেহ সার্চ করে ব্যাগ, ক্যামেরা নিজের কাছে রেখে ভিতরে ঢুকতে দিল। এক কর্মচারীর সাথে আমরা মারাসার সম্মুখ চত্বরে সুশোভিত ফুলের বাগান পেরিয়ে একাডেমিক ভবনের দোতলায় উঠলাম। কর্মচারী আমাদের মেহমানখানায় ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। আফগানী কায়দার বড়সড় মেহমানখানা। নকশাদার চওড়া কার্পেটের চারপাশে হেলান দেয়ার বিলাসী কুশন। ভিতরে প্রবেশ করার পর সেখানে উপস্থিত মাদরাসার ৪/৫ জন শিক্ষক এগিয়ে আসলেন। প্রথা মোতাবেক কোলাকুলি এবং কুশল বিনিময়ের গৎবাঁধা দীর্ঘ বাক্য ব্যয় অধ্যায় শেষ হ’ল। তারপর বসতে না বসতেই চলে এল ট্রাডিশনাল কাহওয়া। আমরা বাংলাদেশী এবং আহলেহাদীছ জানতে পেরে উনারা খুব খুশী হ’লেন। তারপর বাংলাদেশ বিষয়ক নানা প্রশ্নে আমাদের জর্জরিত করে ফেললেন। শেষে জামা‘আত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়েও জানতে চাইলেন। আমারও খুব ভাল লাগছিল যখন জানলাম তাঁরা প্রত্যেকেই দু’দশক আগে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত প্রথম আহলেহাদীছ হুকুমত কুনাঢ়ের অধিবাসী। শুধু তাই নয় আমাদের থেকে একটু দূরে বসা অশীতিপর বৃদ্ধ শায়খ ইহসানুল্লাহর পরিচয় যখন জানতে পারলাম যে তিনি ঐ প্রদেশের গভর্ণর ছিলেন তখন রীতিমত উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়ে সালাম করে আসলাম। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কুনাঢ়ের গভর্ণর ছিলেন। মুরববী কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী সাহিত্যে গ্রাজুয়েশনও করেছিলেন ষাটের দশকে। প্রায় দু’ঘন্টা ব্যাপী তাঁদের সাথে আলাপ হ’ল। আজও কুনাঢ়ের অধিকাংশ অধিবাসী আহলেহাদীছ বলে তাঁরা জানালেন। তাজ্জব হ’লাম মুরববীসহ শিক্ষক মহোদয় সকলেরই আরবী ভাষার ফাছাহাত দেখে। উনারা বললেন, এ মাদরাসার প্রায় শিক্ষকই মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ এবং মাধ্যমিক স্তর থেকে মাদরাসার পাঠদানও করা হয় সম্পূর্ণ আরবীতে। এ কারণে আরবীর চর্চা এখানে খুব বেশী। ক্লাস সিক্সের একটি ছেলেকে ডেকে আঁচ করতে চাইলাম আরবীর তেজ। মাশাআল্লাহ, সত্যিই দারুণ। ঐটুকু ছেলে মাতৃভাষা উজবেকসহ ফার্সী, পশতু ও আরবী ভাষায় ফ্লুয়েন্ট কথা বলতে পারে। এখন উর্দূও শিখছে।

তারপর বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে মাওলানা মুজীবুর রহমান এবং মাওলানা আব্দুস সালাম আমাদেরকে মাদরাসার একাডেমিক বিল্ডিং, লাইব্রেরী, ইয়াতীমখানা সব ঘুরিয়ে দেখালেন। সবশেষে মাদরাসার মুদীর শায়খ হাদিউর রহমান বিন জামিলুর রহমানের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি এবং উনার বড় ভাই এনায়াতুর রহমান তখন উনাদের সমাজকল্যাণ সংস্থার অফিসের সামনের সবুজ লনে বেতের চেয়ারে বসে কাহওয়া খাচ্ছিলেন। পিতার চেহারার সাথে হুবহু মিল। ইন্টারনেটের কল্যাণে উনার পিতা শায়খ জামীলুর রহমান (রহ.)-এর ভিডিও বক্তব্য আগেই দেখেছিলাম। তাই প্রথম দেখাতেই চিনতে কষ্ট হয় না। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর সেখানে আরেকদফা কাহওয়াপর্ব হ’ল। উনি খুব উৎসাহের সাথে আফগানীদের এই কাহওয়া পানের ঐতিহ্যের কথা শুনালেন এবং এর গুণাগুণ বর্ণনা করলেন। তারপর জানতে চাইলেন বাংলাদেশের আহলেহাদীছদের খবরাখবর। কথা-বার্তার ফাঁকে ফাঁকে আমিও মাদরাসা সম্পর্কে এবং উনার পিতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিচ্ছিলাম এবং নোটবুকে টুকে রাখছিলাম। এর মধ্যে যোহরের আযান হয়ে গেলে আমরা বিদায় নিতে চাইলাম। উনি বললেন, যোহরের ছালাত পড়ে উনাদের সাথে দুপুরের খাবার খেতে। আমি বিনয়ের সাথে বললাম আমাদের আরো ২/৩ টা মাদরাসায় যাওয়ার প্রোগ্রাম আছে, দুপুরের খাবার আমরা একটু পরে খাব, আপাততঃ আজ বিদায় দিন। উনি স্মিত হেসে বললেন, ‘অতিথিকে এভাবে ছেড়ে দেয়া আফগানীদের ঐতিহ্য নয়, দুপুরের খাওয়া আমাদের সাথে খেয়ে তারপর বাকী কাজ’। ফলে বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হলো। প্রোগ্রাম ২/১ টা মিস হ’লেও আফগানী ঐতিহ্য ভাঙার দুঃসাধ্য কার! যোহরের ছালাতের পর মুদীরের কক্ষের সামনে বারান্দায় রোদের নীচে ফরাশ পেতে খাবার আয়োজন করা হল। মেন্যু ঐতিহ্যবাহী চিকেন কড়াই, লোবিয়া (সীমের বিচির মত একধরনের সবজি), রায়তা (টক দই দিয়ে বানানো বিশেষ সস, পাকিস্তানী খাবার টেবিলের অপরিহার্য মেন্যু), আফগানী রুটি, সালাদ আর সব শেষে গাহওয়া। শায়খ হাদিয়ুর রহমানসহ মাদরাসার ৪/৫ জন শিক্ষক আমাদের সাথে বসলেন। খেতে খেতেই অনেক কথা হ’ল। উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আহলেহাদীছ হিসাবে আপনাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন এখানকার মানুষের? তালেবান, ওয়াহহাবী বলে আপনাদের কটাক্ষ করার কারণ কী? স্বল্পভাষী শায়খ হেসে বললেন, ‘মাযহাবী গোঁড়ামীর কারণে কিছু মানুষ আছে যারা খারাপ ধারণা ছড়ায়, তবে এতে আমরা মোটেও বিচলিত নই। আমরা আমাদের মত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি’। খাওয়া শেষে উনাকে একটা সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম আত-তাহরীকের জন্য। উনি প্রথমে ভড়কে গেলেন। এটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। কারণ পেশোয়ারের মত সন্ত্রাস আক্রান্ত শহরে তাঁদেরকে প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তা করে ফেলতে হয়। তারপর একটু ভেবে শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে রাযী হ’লেন এবং প্রশ্নগুলো লিখে দিতে বললেন। আমি কয়েকটি প্রশ্ন লিখে দিলাম। প্রশ্নগুলি দেখে উনি সন্তুষ্ট হ’লেন, কেবল রাজনৈতিক প্রশ্নটা বাদ দিতে বললেন। তারপর ধারাবাহিকভাবে একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। প্রায় আধাঘন্টা সময় লাগল। আছরের সময় আর খুব বাকী নেই। অথচ আজই আরও কয়েকটি মাদরাসা অর্থাৎ জামে‘আ আছারিয়া, জামে‘আ বাদাবীর এবং জামে‘আ কাযীকালী যাওয়ার কথা ছিল। সময়ের স্বল্পতায় শুধু জামে‘আ আছারিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিদায় বেলায় শায়খ হাদিয়ুর রহমানসহ উপস্থিত শিক্ষকমন্ডলীর আবেগী আলিঙ্গনের স্মৃতি অনেকদিন মনে থাকবে। দ্বীনী সূত্রের এই অন্তরঙ্গ বন্ধন এশিয়া থেকে আফ্রিকায়, ইউরোপ থেকে আমেরিকায়, আরব থেকে আজমে কোন তফাৎ নেই। এর মাহাত্মও সব জায়গায়, সব কুলে সমান প্রাণবন্ত, সমান ঐশ্বর্যমন্ডিত। এর কোন ব্যতিক্রম ধারণা করাটাই যেন অস্বাভাবিক।

জামে‘আ আছারিয়া যেতে চমকানী মোড় থেকে কয়েক কি.মি. ভিতরে যেতে হয়। শায়খ হাদিয়ুর রহমান উনার মাদরাসার মাইক্রোতে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফলে ১০ মিনিটের মধ্যে চমকানী বাজার থেকে একটু ভিতরে জামে‘আ আছারিয়া মাদরাসার গেটে এসে উপস্থিত হ’লাম। মসজিদে তখন আছরের ছালাত শুরু হয়ে গেছে। জামে‘আ আছারিয়ার এই নতুন ক্যাম্পাসটি ২০০৬ সালে শায়খ আব্দুল আযীয নূরিস্তানীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে। মূল মাদরাসা ‘জামে‘আ আছারিয়া মারকাযিয়াহ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে কারখানো বাজার রোডের আছারাবাদ ইউনিভার্সিটি টাউন, সুয়াফেদ ঢেরীতে। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রখ্যাত আফগানী আলেম ড. শামসুদ্দীন আফগানী (১৯৫২-২০০০খৃঃ)। বর্তমানে উভয় মাদরাসাই চালু আছে। ভিতরে ঢোকার পর একজন শিক্ষক মেহমানখানায় নিয়ে গেলেন। উনার কাছে জানলাম শায়খ নূরিস্তানী সন্ধ্যার পর আসবেন মাদরাসায়। কিন্তু হাতে সময় কম থাকায় আমরা আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। অপর একজন শিক্ষক রশীদ আহমাদ ভাইকে (৩১ বছর বয়সী ৮ সন্তানের জনক, আফগানিস্তানের কুনাঢ় প্রদেশের এই ভাই আমাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস করছেন) সাথে নিয়ে দোতলায় অবস্থিত সুসজ্জিত বিশাল লাইব্রেরীটি দেখে আসলাম। তারপর মাদরাসার আবাসিক, একাডেমিক ভবন, সুরম্য মসজিদ একে একে সব দেখালেন। মহিলা শাখাটির অবস্থান মাদরাসার ঠিক পিছনেই। প্রায় ৬০০ ছাত্র-ছাত্রী এবং ৩৫জন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ে মাদরাসাটি পরিচালিত হচ্ছে। মাদরাসা বিল্ডিং ও আবাসিক ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নতমানের। ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন, বোর্ডিং সম্পূর্ণ ফ্রি। পাকিস্তানী ছাড়াও অনেক আফগানী এখানে পড়াশোনা করছে। এখানকার ছাত্রদেরকেও দেখলাম আরবী ভাষায় যথেষ্ট দক্ষ।

শায়খ নূরিস্তানী সন্ধ্যার পরও আসতে পারবেন কি-না নিশ্চিত হ’তে না পেরে আমরা মাগরিবের ঘন্টাখানিক পূর্বে মাদরাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। অবশ্য গত নভেম্বরে শায়খ নূরিস্তানী এবং উনার দুই ছেলে জনাব উমার ও উমায়েরের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। নতুবা আজ সাক্ষাৎ না করে ফিরতাম না নিশ্চয়ই।

পরবর্তী গন্তব্য কিছছাখানী বাযার। বালা হিছার দুর্গের পিছনেই লেডি রিডিং হাসপাতাল। সেখান থেকে একটু সামনে গেলে পেশোয়ারের সর্বপ্রাচীন এবং ঐতিহাসিক কিছছাখানী বাযার। পূর্বকালে মধ্যএশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বাণিজ্য ক্যারাভ্যান এসে এখানকার সরাইখানায় আবাস গাড়ত। তারপর নানা জাত, বর্ণ, ভাষার ব্যবসায়ীরা একত্রে বসে প্রতি রাতে জমাতো তুমুল গল্পের আসর। সে থেকেই এই বাযারের নাম হয়ে গেছে কিছছাখাওয়ানী বা গল্পকথকদের বাযার। ১৯৩০ সালে এই বাযারে বৃটিশ হঠাও আন্দোলনে শরীক পাঠানী ‘খোদায়ী খেদমতগার’ আন্দোলনের কর্মীদের মিছিল লক্ষ্য করে বৃটিশ পুলিশ গুলী চালালে প্রায় ৪০০ মানুষ নিহত হয়। এ ঘটনা গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে উঠে। সেখান থেকে বাযারটি আরো প্রসিদ্ধি পায়। পেশোয়ারের অন্যান্য স্থানের মত এই বাযারও সন্ত্রাসের মরণ থাবা থেকে রেহাই পায়নি। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর গাড়ী বোমা হামলায় ৪০ জনের বেশী নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল কয়েক শতাধিক।

সিএনজিতে এসে এই মার্কেটে নামতেই মনে হ’ল পুরোনো ঢাকার নবাবপুর রোডে এসে পড়েছি। শতবর্ষের পুরোনো গায়ে গায়ে লাগানো বাড়িঘর আর দোকানপাটে ঘেরা এক ঘিঞ্জি এলাকা। তবে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি বলে জ্যাম, ভীড়-বাট্টা বেশ কম। এই বাযারের একটা অংশ জুড়ে রয়েছে ইসলামী বইয়ের বড় মার্কেট। অনেক খুঁজে মাকতাবা আইয়ূবিয়ার দিশা পেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ততক্ষণে দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। রূহুল্লাহ তাওহীদী ছাহেবকেও ফোনে পেলাম না। ফলে অন্যান্য দোকানে কিছু বই-পত্র দেখে ফিরে আসলাম। মাকতাবা আইয়ূবিয়া খুঁজতে গিয়ে পাঠানদের আরেকটা ভাল গুণের দেখা পেলাম। দোকানটা বেশ ভিতরের দিকে হওয়ায় মধ্যবয়সী এক পাঠানের শরণাপন্ন  হয়েছিলাম। তিনি নিজেই আমাদের সঙ্গে করে অনেকটা ঘুরে সেই দোকানে নিয়ে গেলেন। তারপর দোকান বন্ধ কেন তার কারণ অনুসন্ধানে নিজ থেকেই কতক্ষণ আশ-পাশের দোকানে খোঁজ-খবর নিলেন। যখন নিশ্চিত হ’লেন যে, দোকান আর খুলবে না, তখন এক চায়ের দোকানে ঢুকিয়ে চা পান করাবেনই-এমন অবস্থা। অবশেষে তাকে স্পষ্টতঃ মনঃক্ষুণ্ণ করেই বিদায় নিয়ে সে যাত্রায় রেহাই পেলাম। পথচারী বা অতিথিদের প্রতি পাঠানদের এই নিবেদিতপ্রাণ অন্তরের প্রশংসা কেন এত শোনা যায়, এটা বোধহয় তার একটা দৃষ্টান্ত।

বাদ মাগরিব আমরা আড্ডা থেকে ইসলামাবাদগামী একটি হাইস মাইক্রোতে চেপে বসলাম। মাত্র দু’ঘন্টার মধ্যেই প্রায় ২০০ কি.মি. রাস্তা অতিক্রম করে মাইক্রোটি আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে নামিয়ে দিল। খাইবারের পাদদেশ থেকে দু’দিনের সংক্ষিপ্ত ও স্মৃতিমাখা সফর শেষে ফিরে এলাম আপন ডেরায়।

বলা আবশ্যক, যে নিরাপত্তাবাহিনীর ভয় দেখিয়ে আমাদের বার বার যেতে বারণ করা হয়েছিল, তারা আমাদেরকে একটিবারের জন্যও নযর বুলানোর যোগ্য মনে করেনি। ফলে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। একটু আক্ষেপ রয়ে গেল সময়ের অভাবে বাকি মাদরাসাগুলো এবং বিশেষতঃ শায়খ আব্দুল সালাম রুসতমীসহ কয়েকজন আলেমের সাথে সাক্ষাৎ না হওয়ায়। আল্লাহ কবুল করলে পরবর্তী কোন সফরের জন্য সেটা তোলা রইল।






বিষয়সমূহ: ভ্রমণ স্মৃতি
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৌত লাহোরে (আগস্ট’১৮ সংখ্যার পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মাসজিদুল হারামে ওমরাহ ও ই‘তিকাফ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
তাওহীদের এক চারণগাহ তাওহীদাবাদে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালাকোটের রণাঙ্গনে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
রিয়াদ সফরে অশ্রুসিক্ত সাংগঠনিক ভালবাসা - গোলাম কিবরিয়া আব্দুল গণী
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মালদ্বীপের পথে - আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল
আরও
আরও
.