৪
পরদিন ফজরের ছালাত পড়ে মসজিদ থেকে ফিরছি। দিনের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। পূর্বদিকে ঘন জমাট অাঁধার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গগণচুম্বী পাহাড়ের ঠিক মাথার উপর আটকে আছে বাঁকা চাঁদ, রহস্যময় ক্ষীণ আলো নিয়ে। চলতি পথে হঠাৎ যেন বাঁধা পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। একরাশ বিস্ময় নিয়ে থমকে দাঁড়ালাম আমিও। এমন মোহময় দৃশ্য তো হাতছাড়া করা যায় না। অনেক কায়দা-কসরৎ করে দৃশ্যপটটি স্থায়ী করে রাখতে চাইলাম ডিজিটাল যন্ত্রটা দিয়ে। পারলাম না। জানি আল্লাহর দুনিয়ার এই অকৃত্রিম সৌন্দর্যের উপর কখনও যন্ত্র দিয়ে দখলদারিত্ব কায়েম করা যায় না। তবু্ ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম। এ ব্যর্থতার মাঝে কোন আফসোসের জায়গা নেই। আছে কেবল ঘোরলাগা মুগ্ধতা আর আল্লাহর প্রশংসায় আনত হৃদয়-মন। আল্লাহু আকবার কাবীরা!
কুনহার নদীর পাড় ঘেঁষে কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঘরে ফিরলাম। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমে চোখ একটু জুড়িয়ে আসতেই যাহেদ ভাই উপস্থিত। সকালে একটু আগেভাগে আসার জন্য বলেছিলাম। ঠিক ঠিক এসেছেন। প্রস্ত্তত হয়ে বের হ’লাম সাতসকালে বালাকোটের জীবনযাত্রা দেখার জন্য। বাযারে ঢুকে প্রথমে তিনি সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর কবরের কাছে নিয়ে গেলেন। আমি বললাম, গতকাল একবার তো যিয়ারত করেছি। এবার চলুন নদীর ওপারের গ্রামে। তিনি বললেন, গতকাল এসেছিলেন? আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন আপনার সাথেই এলাম না? তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, কই না তো? ভারি বিপদ! তার চেহারার দিকে ভাল করে তাকালাম। বললাম, আপনি যাহেদ ভাই না? তিনি বললেন, না, আমি তো শাহেদ! শাহেদ মানে? খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারলাম ভুলটা। যাহেদ ভাই ও শাহেদ ভাই দু’জনের চেহারার মধ্যে খুবই মিল এবং পরস্পর চাচাতো ভাই। আমি ভেবেছিলাম, তিনি যাহেদ ভাই, যার সাথে গতকাল ঘুরেছিলাম। আজ উনি নিজে না এসে চাচাতো ভাইকে পাঠিয়েছেন। প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পেরে দু’জনই খুব হাসলাম। গতদিন উভয়ের সাথেই পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু চেহারার এতটা সাদৃশ্য খেয়াল করিনি।
কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজটা পার হয়ে নদীর ওপারের গ্রামে ঢুকলাম। দূর থেকে দেখে পাহাড়ের গায়ে বাড়ী-ঘর খুব ঘিঞ্জি হয়ে সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে মনে হয়। কিন্তু ভিতরে ঢোকার পর বাস্তবে সেরকম দেখা যায় না। যথেষ্ট সমতলভূমি রয়েছে এবং বাড়ী-ঘরের ঘনত্ব্ও তেমন নয়, যেমনটা দূর থেকে মনে হয়। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা সবই গড়ে উঠেছে এর মধ্যে। ফসলের ক্ষেত রয়েছে। রয়েছে আলাদা আলাদা সব পাড়া। একটি পাড়ায় ঢুকে যাহেদ ভাইয়ের বাড়ীতে গেলাম। নির্মাণাধীন নতুন দো’তলা বাড়ী। ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছিল। সরকারী অনুদানে আবার তৈরী করছেন। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই একসাথে থাকেন। সকালের নাস্তা তার বাসাতেই সারলাম। শাহেদ ভাইয়ের ২ বাচ্চা, ছোট ভাই এবং আববার সাথে দেখা হ’ল। সত্যি বলতে কি এটুকু মেহমানদারীতে নিজেকে বেশ ভাগ্যবানই মনে হ’ল। তার কারণ পাকিস্তানে আসার পর কারও বাড়িতে নিছক ভদ্রতা ছাড়া সত্যিকার আমন্ত্রণ পেয়েছি এমন ঘটনা বিরল। যত অন্তরঙ্গ বন্ধুই হোক না কেন, এরা সাধারণতঃ কাউকে নিজ বাড়ীতে নিয়ে যেতে চায় না। এমনকি ঈদের সময়ও না। হোটেলে হোটেলেই মেহমানদারীর কাজ সারে। এখানকার বাংলাদেশীদের কাছে আগেই শুনেছিলাম, এদের এমন কালচারের কথা। কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করিনি। যার খেসারত দিতে হয়েছে রামাযান এবং কুরবানীর ঈদের সময়। সে করুণ অভিজ্ঞতার কথা পরে কোন এক সুযোগে বলা যাবে।
শাহেদ ভাইয়ের বাড়ী থেকে বের হয়ে একটা চাঁদের গাড়িতে চড়ে রওয়ানা হ’লাম কুনহার নদীর পূর্ব পাড়ের রাস্তা ধরে। গন্তব্য লোহারনারা গ্রাম। এখানে কয়েকটি পরিবার রয়েছে আহলেহাদীছ এবং ২০০৬ সালে একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ নির্মিত হয়েছে ‘মসজিদে খালিদ বিন ওয়ালিদ’। অন্য দু’টি আহলেহাদীছ মসজিদ শহরের মধ্যে হ’লেও এই মসজিদটি গ্রামের মধ্যে বেশ ভিতরে। শাহেদ ভাই ঐ মসজিদটি দেখানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। মসজিদে পৌঁছে ভিতরে ঢুকলাম। ইমাম ছাহেব মুহাম্মাদ ইয়াসির হাক্কানী (৩০) ছিলেন মসজিদেই। তার রুমেই বসা হ’ল। পরিচয়পর্বের পর মসজিদ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন, মসজিদটি ২০০৬ সালে নির্মিত হয়েছে স্থানীয় আহলেহাদীছদের উদ্যোগে। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হাজী বাশারাত (৭০) আগে থেকেই আহলেহাদীছ আক্বীদা সম্পর্কে জানতেন। পরবর্তীতে দেওবন্দী আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ আমীন ছফদর ওকাড়ভী এবং আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা কাযী আব্দুর রশীদের মধ্যে গুজরানওয়ালায় অনুষ্ঠিত একটি মুনাযারার ভিডিও দেখার পর তিনি আহলেহাদীছ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুনাযারাটি ছিল ‘রাফউল ইয়াদায়েন’-এর উপর। তিনি তাঁর সন্তানদেরকেও ভিডিওটি দেখান। এক পর্যায়ে তাঁর ৪ ভাই সহ পরিবারের সকলেই আহলেহাদীছ হয়ে যান। তাদের উদ্যোগেই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। মুছল্লী অবশ্য বেশী নয়। ১৫ জনের মত। তবে ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়ছে। জুম‘আ এখনও চালু হয়নি। মাসখানেক আগে মসজিদের নতুন বিল্ডিং নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। নির্মাণকাজ সমাপ্ত হ’লে জুম‘আ শুরু হবে। মসজিদের পশ্চিমদিকে নবনির্মিত মসজিদটি দেখতে গেলাম। নির্মাণকাজের সার্বিক দেখভাল করছেন মুযাফফরাবাদের এক মাদরাসার শিক্ষক ওহীদুর রহমান (৩২)। তিনি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। জানালেন স্থানীয় অনুদান এবং মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ইমাম ছাহেব মূলতঃ এ্যাবোটাবাদের অধিবাসী। জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া সালাফিইয়াহ গুজরানওয়ালা থেকে ফারেগ। কথা প্রসঙ্গে বললেন, তার জানা মতে এ্যাবোটাবাদ শহরে এখন কমপক্ষে ৫টি আহলেহাদীছ মসজিদ এবং ১টি মাদরাসা আছে। আর মানসেহরাতেও ৪টি মসজিদ এবং ১টি মাদরাসা রয়েছে। বালাকোটে আপাততঃ আহলেহাদীছ মসজিদ ৩টি। আর শহরের বাইরে বালাকোট থেকে নারান ভ্যালির পথে প্রায় ২০ কি.মি. দূরে কাওয়াই নামক স্থানে একটি ছোট্ট হিফয মাদরাসা চালাচ্ছেন জনৈক হাফেয আদেল (৫০)। তিনিও একজন নব-আহলেহাদীছ। হয়ত সেখানেও কিছুদিনের মধ্যে একটি মসজিদ নির্মিত হবে। তারা দাবী করলেন, বালাকোট শহরে অন্ততঃ ৫০টি আহলেহাদীছ পরিবার রয়েছে। যাদের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০০-এর মত। আর পুরো বালাকোট তহসিলে ১০০০-এরও উপরে আহলেহাদীছ রয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিনই সংখ্যাটা বাড়ছে। ফলে প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা মুশকিল।
চা-নাস্তা করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার বের হ’লাম শহরে ফেরার জন্য। বালাকোট ব্রীজের পার্শ্বেই ‘জামে মসজিদ শুহাদায়ে আহলেহাদীছ’। বালাকোটের প্রথম আহলেহাদীছ মসজিদ (নির্মাণকাল : ১৯৮৩ ইং)। মসজিদের ভিতরে ঢুকে প্রথমে সন্তুষ্ট হ’তে পারিনি নড়বড়ে দশা দেখে। তখনও জানতাম না ২০০৫ সালে মূল মসজিদটি ধ্বংস হওয়ার পর এটি অস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মসজিদের ভিতরে-বাইরে নানা শ্লোগান লেখা। একটি শ্লোগান দেখে ভাল লাগল, ‘আহলেহাদীছ কি দো উছূল, আতীউল্লাহ ওয়া আত্বীউর রাসূল’। মসজিদের খাদেম বশীর হোসাইনের সাথে গেটেই দেখা হ’ল। জানা গেল মসজিদের খত্বীব জনাব মুহাম্মাদ ছিদ্দীক মুযাফফরাবাদী (৬২) ভিতরেই আছেন। তিনি বর্তমানে ট্যাক্সিলা ওয়াহ ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় পরিবারসহ থাকেন। সাধারণতঃ শুক্রবার ছাড়া আসেন না। আজ শনিবার। কোন বিশেষ কাজে এসেছেন। তার টয়োটা প্রাইভেট কারটি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রওনা হবেন কিছুক্ষণের মধ্যে। সে সময়ই তাঁর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। মসজিদের পাশে পুরোনো কয়েকটি কামরা। মাওলানা ছিদ্দীকের পুরনো আবাস। এখন কেউ থাকে না। তিনি সপ্তাহে একবার এসে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন এখানে। সেই বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে বসলাম আমরা। বাঙালী পরিচয় পেয়ে মুরববী খুব খুশী হ’লেন। খাদেমকে নাস্তাপানি আনার জন্য তোড়জোড় করলেন। কাশ্মীরী মানুষ। মধ্যম গড়ন। টকটকে গৌরবর্ণ আর সফেদ দাড়িতে অন্য রকম সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। প্রেŠঢ়ত্বের সীমানায় যে পা দিয়েছেন বেশ আগে, তা এমনিতেই বোঝা যায়। বর্তমানে তিনি মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের একজন কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য এবং কেপিকে’র নায়েবে আমীর।
কিছুক্ষণ কথা বলতেই বুঝলাম, মুরববী গাম্ভীর্য বজায় রাখলেও যথেষ্ট আলাপী। ভিতরে অনেক কথা জমা আছে তাঁর। মনে মনে ভাবলাম, ‘আত-তাহরীকে’র জন্য একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারলে মন্দ হয় না। প্রস্তাব দিলাম। তিনি ঘড়িতে যোহরের সময় তখনও অনেকটা বাকী আছে দেখে সাগ্রহে রাযী হ’লেন। মোবাইলের রেকর্ড অপশন চালু করে খাতা-কলম বের করলাম।[1] তিনি রূপকথার বুড়ো গল্পকথকের মত থেমে থেমে কখনও চোখ বুঁজে, কখনও উদাস শুন্য চোখে নিজের জীবনের গল্প শোনাতে লাগলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমরা তাঁর গল্প শুনতে লাগলাম। ঘন্টা পার হয়ে একসময় মোবাইলের রেকর্ড অপশন আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। তবুও গল্প শেষ হয় না। নিজ হাতে গড়ে তোলা যে মসজিদটি ২০০৫ সালে বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেটির একটি বড় বাঁধানো ছবি ঘরের ভিতর থেকে বের করে আনলেন। গভীর আগ্রহের সাথে সেটা দেখালেন আমাদের। শোনালেন ভবিষ্যতের নানা পরিকল্পনা। বর্তমান প্রজন্মের আহলেহাদীছদের প্রতি কিছুটা অনুযোগ প্রকাশ করলেন, তাদের অস্থির মনোভাবাপন্ন আচরণের কারণে। তিনি বললেন, ‘আমাদের অনেকেই বুঝতে চায় না যে, একজন মানুষের দীর্ঘদিনের আচরিত আক্বীদা-আমল পরিবর্তন করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ফলে তাঁরা অসহিষ্ণু হয়ে মানুষের সাথে উগ্র আচরণ করে বসছে। অথচ দাওয়াতী ময়দানে ধৈর্যশীল হওয়ার কোন বিকল্প নেই। অন্যদিকে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণেও অনেক যুবক চরমপন্থী হয়ে উঠছে। তবে এটাও মূলতঃ ধৈর্যহীনতার ফল। আমাদেরকে বুঝতে হবে, মুসলিম উম্মাহর উপর দিয়ে যে বিপর্যয় অতিবাহিত হচ্ছে, তা নতুন নয়। এর চেয়ে অনেক বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে আমাদের। সুতরাং আল্লাহর সাহায্যের উপর গভীর আস্থা রেখে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। হকপন্থী আলেমদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। নিজেদের ইচ্ছা মত পথ চলার চিন্তা পরিত্যাগ করতে হবে। নতুবা এ পরিস্থিতির উত্তরণ তো হবেই না, বরং আরো বড় বিপর্যয় নেমে আসবে’। তাঁর এই চিন্তাধারা আমাদের সাথে মিলে যেতে দেখে খুব ভাল লাগল। কথাগুলো যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য তা সাক্ষ্য দিচ্ছে চরমপন্থীদের উত্থানে বিপর্যস্ত মুসলিম দেশগুলো। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর তাঁর কাছে বিদায় চাইলাম। উনি ঘাড়ে হাত রেখে অনেক দো‘আ করলেন এবং বাংলাদেশী ভাইদের জন্য আন্তরিক ভালবাসা এবং শুভকামনা প্রকাশ করলেন।
তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে একটু পশ্চিমে সেই বৃদ্ধ হাজী বাশারত ছাহেবের দেখা পেলাম যিনি লোহারনারাতে নতুন মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে তাঁর একটা স্টেশনারীর দোকান আছে। সেই দোকানে বসেই তাঁর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে মাদানী প্লাজা শপিং সেন্টারে ঢুকলাম। আরো কয়েকজন আহলেহাদীছ ভাইয়ের সাথে দেখা হ’ল বেশ কয়েকটি দোকানে। শাহেদ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। চা-এর আমন্ত্রণ রক্ষা করতে হ’ল সব জায়গাতেই। ২য় তলার সম্মুখভাগে সরকারী হাসপাতালের দন্ত চিকিৎসক ডাঃ শাফকাত হোসাইনের প্রাইভেট চেম্বার। তিনি চেয়ার থেকে উঠে জোর করে তাঁর চেয়ারে আমাকে বসিয়ে দিয়ে একজন রোগী দেখতে লাগলেন। তারপর নাশতা-পানি আনিয়ে নিজের আহলেহাদীছ হওয়ার গল্প বললেন। কিছুক্ষণ তাঁর সাথে আলাপ করে বেরিয়ে আসলাম।
সবশেষে এহসান এলাহী যহীর ভাইয়ের কম্পিউটারের দোকানে গেলাম। আজই যোহরের পর চলে যেতে চাইছি শুনে তিনি বললেন, আজকে যাওয়া যাবে না, থেকে যান। কাল রবিবার ছুটি, আমার কোন কাজ নেই, আপনাকে কাগান-নারান ভ্যালিটা ঘুরিয়ে দেখাবো। ভেবে দেখলাম, বারবার তো আসার সুযোগ হবে না, একেবারে দেখেই যাওয়া যায় কাগান-নারান ভ্যালী। সুউচ্চ পাহাড় আর খরস্রোতা নদীর মিলিত সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এই উপত্যকা। না করার কোন মানে হয় না। সানন্দে রাযী হয়ে গেলাম। তারপর দোকান থেকে বের হয়ে এহসান ভাই, শাহেদ ভাই সহ ব্রীজের পাশ দিয়ে কুনহার নদীতে নেমে আসলাম। দু’জন সাথে থাকায় বেশ সাহস করে কয়েকটা পাথর ডিঙিয়ে বরফ ঠান্ডা পানিতে পা ডুবালাম। বড় বড় পাথরের ফাঁক গলিয়ে সবেগে স্রোত বের হয়ে আসছে। সেই স্রোতে পড়লে নির্ঘাৎ প্রাণ হারাতে হবে। প্রতি বছর এমন দু’চারটা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষতঃ পর্যটকরা বেখেয়ালে কিংবা অতি উৎসাহে নদীতে নামতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনেন। কয়েকটা ঘটনা শুনালেন এহসান ভাই। এমনকি অধিকাংশের মৃতদেহ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।[2] পাহাড়ী এই নদীগুলো আমাদের চিরচেনা নদীর মত নয়। কিছু কিছু স্থান বাদে নদীর তলদেশ অগভীর, যদিও প্রস্থে অনেকটা চওড়া। বড় বড় পাথরে ভর্তি সর্বত্র। নৌকা চলাচলের কোন উপায় নেই। সারাবছর স্রোতের তোড় থাকে। তবে বর্ষাকালে মাত্রাটা অনেক বেড়ে যায়। তখন নদীর পরিবর্তে একে বিরাট এক ঝর্ণাধারা বললেও মনে হয় ভুল হয় না।
‘কুনহার’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। মাওলানা ছিদ্দীক বলছিলেন, এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপকথা হ’ল, একবার কোন রাজার কন্যা বা স্ত্রী নদীর পানিতে নামলে গলার হার পানিতে পড়ে যায়। সেই থেকে এর নাম কুনহার। মজার ব্যাপার যে, এই নদীর আরেকটি নাম হ’ল ‘নয়ন সুখ’। খাঁটি বাংলা একটি বাক্য। অর্থেও কোন ভিন্নতা নেই। অথচ বলা হয়, এটি নাকি ফারসী ভাষার শব্দ! ধাঁধাই থেকে গেল বিষয়টা নিয়ে। শব্দটির উৎপত্তি ফারসী না হয়ে হিন্দকোই হওয়ার কথা। কারণ বাংলার সাথে হিন্দকো ভাষার যথেষ্ট মিল আছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলায় ‘কোথায় যাচ্ছ’ বাক্যটি হিন্দকোতে ‘কোথা যাছো’ বাক্যে প্রকাশ করা হয়। অনুরূপভাবে ‘নয়ন সুখ’ নামটিও হিন্দকো ভাষার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। যেহেতু এখানকার প্রচলিত ভাষাও হিন্দকো।
সেখান থেকে হাসপাতালে ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া করলাম। আছরের পর একাকী বের হ’লাম আবার। ভাবছিলাম পাহাড়ের উপরে মেট্টিকোট গ্রামটি থেকে ঘুরে আসব। কিন্তু বাযারে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদের গাড়ি চালক বলল, মেট্টিকোট যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। আর মাগরিব পর উপর থেকে কোন গাড়ি আর নীচে নামবে না। সুতরাং ওদিকে আর না গিয়ে পায়ে হেঁটে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর কবরের দিকে অগ্রসর হ’লাম। পাহাড়ের গা বেয়ে পীচ ঢালা পথ উঠে গেছে। পা টিপে টিপে হাঁটছি। ‘মূসা কা মুছাল্লা’ পর্বতের বরফাবৃত চূড়া অপরাহ্নের সোনালী সূর্যালোকে তখন বিরাট এক স্বর্ণখন্ডে পরিণত হয়েছে। দূরের কুনহার নদী আর পাহাড়ের গোড়ায় বালাকোট শহরটাও নযরে আসছে প্রায় পুরোটাই উপর থেকে। ঊর্ধ্বাকাশে ছন্নছাড়া মেঘের গায়ে বিচিত্র রঙের ছন্দ। এমন বিশুদ্ধ কাব্যময় দৃশ্যপটকে সামনে রেখে মহাকালের এই ক্ষুদ্রতম অংশটিকে মনে হয় স্রেফ আমার, একান্তই আমার। প্রাণভরে উপভোগ করি মহান আল্লাহর এই নয়নাভিরাম অপরূপ সৃষ্টিসুধা।
হাঁটতে হাঁটতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) যে পাথরের নিকটে শাহাদাত বরণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়, সেখানে এসে দাঁড়াই। অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি সেই পাথরের বিশাল ঢিবি, কালো হয়ে যাওয়া মাটি, গাছের শিকড়, আগাছা, সবকিছু। প্রকৃতির রস শুষে প্রায় দু’শো বছর পূর্বেকার সেই মুহূর্তটি কল্পনায় আনার চেষ্টা করি। তারপর পিছনের পথ দিয়ে উঠে আসি উঁচু ঢিবির উপর। উপর থেকে যুদ্ধের স্থানটি আরো স্পষ্টভাবে দেখা যায়। সাতবানে ঝর্ণার পাথরভরা সেই বিরাট চওড়া বুকটা দেখি যেখানে বালাকোটের মুজাহিদরা অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ঝর্ণার ওপাশে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) এবং অপরাপর মুজাহিদদের কবরগাহটি দেখা যায়। একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে থাকি একদৃষ্টে। ইতিহাসের এক চওড়া বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে মাথার ভিতর তখন ঘুরতে থাকে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মিশেলে এক অদ্ভুত পরাবাস্তব কল্পনা।
মাগরিবের আযান হ’লে ব্রীজটা পার হয়ে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর কবরের পার্শ্বের মসজিদটায় ছালাত আদায় করি। মসজিদটি তাঁর নামে নামকরণ করা হ’লেও ইমাম-মুছল্লী সবাই গতানুগতিক ধর্মের অনুসারী। যে আক্বীদা-আমল প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন দিলেন শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ), তার কোন ছাপ নেই মুছল্লীদের মধ্যে। ভারাক্রান্ত মনে বেরিয়ে আসলাম মসজিদ থেকে। তারপর আবার হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি এফআইএফ-এর ফিল্ড হাসপাতালে। এহসান ভাই এসে দুঃসংবাদটা দিলেন যে, ল্যান্ড স্লাইডিং অর্থাৎ পাহাড়ী ভূমিধ্বসের কারণে নারান-কাগানের রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। তাই কালকে আর ওদিকে যাওয়া সম্ভব হবে না। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে আবার বালাকোটে বেড়াতে আসেন, সে সময় সব ঘুরে দেখাবো ইনশাআল্লাহ।
৫
পরদিন সকালে নাশতার পর এহসান ভাই আসলেন মটর সাইকেল নিয়ে, সোহেল নাজাফ খান গ্রামটা দেখাবেন বলে। রওয়ানা হ’লাম তাঁর সাথে। মানসেহরাগামী রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর এক জায়গায় থামলেন। এটা সোহেল নাজাফ খান থেকে কিছুটা আগের এক গ্রাম। তার এক বন্ধু থাকেন এই গ্রামে, তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। গ্রামটির নাম শাহোতার। নদী পার হয়ে যেতে হয়। নৌকা চলাচলের কোন সুযোগ নেই, তাই রোপওয়ে তৈরী করা হয়েছে মানুষের যাতায়াতের জন্য। হস্তচালিত মেশিনে নিয়ন্ত্রিত সেই রোপওয়ের ক্যাবল কারে বসে নদী পার হই। নীচে তুমুল শব্দে বহমান কুনহার। তার উপর দিয়ে যেন পাখির মত উড়ে যাচ্ছি। অসাধারণ এক অনুভূতি। ওপারে নেমে সুবিস্তৃত গম ক্ষেতের মধ্য দিয়ে গ্রামের পথ ধরলাম। গ্রামে ঢোকার পর এহসান ভাইয়ের বন্ধু সোহেল ভাই বেরিয়ে এসে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সঊদী রিলিফের প্লাইউড দিয়ে তৈরী করা লাল বাড়ি। আশেপাশের অধিকাংশ বাড়ী একই ধরনের। অর্থাৎ ভূমিকম্পের আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি এই গ্রামটিও। গ্রামের পিছনের পাহাড়টার চূড়াতেও বসেছে বরফের মেলা। ঘরের জানালা দিয়ে দেখি সেই মনোরম দৃশ্য।
চা-নাশতা সেরে বাসা থেকে বের হই। এহসান ভাই এখানে মূলতঃ নিয়ে এসেছিলেন গম ও অন্যান্য তরি-তরকারীর বিশাল ক্ষেতগুলো দেখাতে। দূর থেকে শুধু আমরা পাহাড়ই দেখি, পাহাড়ের নীচে যে এত বড় ফসলের মাঠ থাকে তা খুব কমই খেয়াল করা হয়। সবুজ-শ্যামল এই গ্রামটা সত্যিই অন্তর জয় করে নিল।
সোহেল নাজাফ খান গ্রামে আর যাওয়া হ’ল না। শহরে ফিরে আসলাম। বালাকোটের চাপলি কাবাব বেশ বিখ্যাত। অফিসের ভাইদের জন্য কিনলাম সবাই একসাথে খাওয়ার জন্য। নারানের আখরোটও কেনা হ’ল। তারপর অফিসে ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে ইসলামাবাদ ফেরার প্রস্ত্ততি নিলাম। বিদায়ের সময় সবার সাথে আরেক দফা মোলাকাত হ’ল। রোগী ফেলে ডাক্তার, ল্যাবরেটরিয়ান চলে আসলেন। দু’দিনে তাদের সাথে এমন আন্তরিকতা গড়ে উঠেছে যে ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছে। সময় পেলেই বালাকোট ঘুরে যাওয়ার জন্য তাদের বারাংবার আন্তরিক অনুরোধে মনটা প্রশান্ত হয়ে গেল। এমন ভূস্বর্গে, জিহাদ আন্দোলনের মহান স্মৃতিমাখা ভূখন্ডে তো বারবারই আসতে চাই। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা হ’লাম মানসেহরার উদ্দেশ্যে। কাশ্মীরের মুযাফফরাবাদ হয়ে ইসলামাবাদ ফেরার আরেকটি রুট আছে বালাকোট থেকে। কিন্তু পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে এই শংকায় ঐ রুটে যেতে বারণ করলেন সাজ্জাদ ভাই। মানসেহরা পৌঁছে সেখান থেকে অপর এক মাইক্রোতে ইসলামাবাদ ফিরে আসলাম। সবমিলিয়ে সফরটা আমার আজীবনের জন্য স্মরণযোগ্য তালিকায় উঠানো হয়ে গেল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
(সমাপ্ত)
আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
এমএস (হাদীছ), ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইসলামাবাদ, পাকিস্তান।
[1]. সাক্ষাৎকারটি মাসিক আত-তাহরীক জুন ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
[2]. আমি বালাকোট ঘুরে আসার মাসখানেক পর খবরে পড়লাম, জামা‘আতে ইসলামী করাচীর নায়েবে আমীর জনাব নাছরুল্লাহ সাজী তাঁর স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে এক শিক্ষাসফরে বালাকোটে এসে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই একই ঘটনা। এক ছাত্র নদীতে নেমে পা হড়কে পড়ে গিয়ে স্রোতের তোড়ে ভেসে যায়, তারপর তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে তিনিও ভেসে যান। পরে অবশ্য তাদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।