পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । শেষ পর্ব ।
গোড়ার কথা :
সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক, দয়াময়, করুণাময়, বিচার দিবসের মালিক, পূর্বাপর সকলের মা‘বূদ, আসমান-যমীনের রক্ষণাবেক্ষণকারী মহান আল্লাহর সকল প্রশংসা। তাঁর বিশ্বস্ত নবী যিনি সৃষ্টিকুলের মহান শিক্ষক এবং জগদ্বাসীর জন্য রহমত রূপে প্রেরিত তাঁর উপর ছালাত ও সালাম।
মানুষকে শিক্ষাদানের কাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। এর উপকারিতা সুদূরপ্রসারী এবং কল্যাণ সর্বব্যাপী। নবী-রাসূলগণ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে বিদ্যার উত্তরাধিকার রেখে গেছেন তা প্রচারক ও প্রশিক্ষকদের জন্য তারই একটি অংশ! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ- ‘আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, আকাশবাসী, যমীনবাসী এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও (পানির) মাছ পর্যন্ত মানুষকে যারা কল্যাণকর জিনিস শিক্ষা দেয় তাদের জন্য দো‘আ করে থাকে’।[1]
তা‘লীম বা শিক্ষণ কার্যক্রমের অনেক পদ্ধতি ও প্রকার রয়েছে। তার মাধ্যম ও পন্থাও বহু। তন্মধ্যে ভুল সংশোধন অন্যতম। সংশোধন শিক্ষণেরই একটি অংশ। আসলে শিক্ষণ-শিখন আর ভুল সংশোধন একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার মত নয়।
দ্বীনের মাঝে নছীহত বা কল্যাণ কামনা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। এই ফরযেরই একটি বিষয় মানুষের ভুল সংশোধন করা। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ-এর সাথে ভুল সংশোধনের সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সুস্পষ্ট। অবশ্য এটাও লক্ষণীয় যে, ভুলের গন্ডি নিষিদ্ধ বা অন্যায়ের গন্ডি থেকে অনেক প্রশস্ত। কেননা ভুল কখনো নিষিদ্ধের আওতায় হ’তে পারে আবার কখনো তার বাইরেও হ’তে পারে।
এমনিভাবে দেখা যায় যে, ভুল শুধরিয়ে সঠিক পন্থা প্রদর্শন মহান আল্লাহর অহি-র বিধান ও কুরআনী রীতির অন্তর্ভুক্ত। কুরআন যাবতীয় আদেশ-নিষেধ, স্বীকৃতি দান, অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং ভুল সংশোধনের মত বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হ’ত। এমনকি নবী করীম (ছাঃ) থেকেও যে সামান্য ত্রুটি ঘটেছে সে সম্পর্কেও ভৎর্সনা করে এবং আগামীতে এমনটা যেন না ঘটে সে সম্পর্কে সতর্ক করে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন,
عَبَسَ وَتَوَلَّى، أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى، وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى، أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى، أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى، فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى، وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى، وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى، وَهُوَ يَخْشَى، فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى-
‘ভ্রূকুঞ্চিত করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল এজন্য যে, তার নিকটে একজন অন্ধ লোক এসেছে। তুমি কি জানো সে হয়তো পরিশুদ্ধ হ’ত। অথবা উপদেশ গ্রহণ করত। অতঃপর সে উপদেশ তার উপকারে আসত। অথচ যে ব্যক্তি বেপরওয়া তুমি তাকে নিয়েই ব্যস্ত আছ। অথচ ঐ ব্যক্তি পরিশুদ্ধ না হ’লে তাতে তোমার কোন দোষ নেই। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তোমার নিকটে দৌড়ে এল, এমন অবস্থায় যে সে (আল্লাহকে) ভয় করে, অথচ তুমি তাকে অবজ্ঞা করলে’ (আবাসা ৮০/১-১০)।
وَإِذْ تَقُوْلُ لِلَّذِيْ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللهَ وَتُخْفِيْ فِيْ نَفْسِكَ مَا اللهُ مُبْدِيْهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ-
‘যেই লোকটার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে এবং তুমিও যাকে অনুগ্রহ করেছ তাকে যখন তুমি বলছিলে, তোমার স্ত্রীকে তুমি তোমার নিজের কাছে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। অথচ এ ব্যাপারে তুমি তোমার মনের মাঝে এমন একটা বিষয় লুকাচ্ছিলে যা আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন, তুমি এক্ষেত্রে মানুষের ভয় করছ, অথচ আল্লাহ তা‘আলাই তোমার ভয় করার বেশী উপযুক্ত’ (আহযাব ৩৩/৩৭)।
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الْآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-
‘কোন নবীর পক্ষে বন্দীদের আটকে রাখা শোভা পায় না, যতক্ষণ না জনপদে শত্রু নির্মূল হয়। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা কর। আর আল্লাহ চান আখেরাত। আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৬৭)।
لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ-
‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্ষেত্রে তোমার কোনই কর্তৃত্ব নেই। আল্লাহ হয় তাদের মাফ করবেন, নয় তাদের শাস্তি দিবেন। কারণ তারা যালিম বা অত্যাচারী’ (আলে ইমরান ৩/১২৮)।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন কোন ছাহাবীর ভুল পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। মক্কা বিজয়ের অব্যবহিত পূর্বে হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ) কুরাইশ কাফেরদের নিকট একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর মক্কা পানে যাত্রার কথা উল্লেখ করে কাফেরদের সতর্ক করেছিলেন। তার এভাবে চিঠি পাঠানো ছিল বড় ধরনের ভুল। এ প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয় আল্লাহর বাণী-
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُوْنَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوْا بِمَا جَاءَكُمْ مِنَ الْحَقِّ يُخْرِجُوْنَ الرَّسُوْلَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوْا بِاللهِ رَبِّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِيْ سَبِيْلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنْتُمْ وَمَنْ يَفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيْلِ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা কখনো আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। (এটা কেমন কথা যে) তোমরা তাদের প্রতি বন্ধুত্ব দেখাচ্ছ অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তারা তা অস্বীকার করছে। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তারা তোমাদের প্রতিপালকের উপর তোমরা যে ঈমান এনেছ সেজন্য রাসূল এবং তোমাদেরকে (তোমাদের জন্মভূমি থেকে) বের করে দিয়েছে। যদি (সত্যই) তোমরা আমার পথে জিহাদ এবং আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে (ঘরবাড়ি থেকে) বেরিয়ে থাক, তাহ’লে কিভাবে তোমরা তাদের সাথে গোপনে গোপনে বন্ধুত্ব করতে পার? তোমরা যা গোপনে কর আর যা প্রকাশ্যে কর আমি তো তার সবটাই খুব ভালমত জ্ঞাত। আর তোমাদের মধ্য থেকে যেই (কাফেরদের সাথে) এমন গোপন বন্ধুত্ব করবে, সে অবশ্যই সরল পথ (ইসলাম) হারিয়ে ফেলবে’ (মুমতাহিনা ৬০/১)।
ওহোদ যুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ) তীরন্দাযদেরকে ওহোদের একটি গিরিপথে নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল জয়-পরাজয় যাই হোক, তোমরা গিরিপথ ত্যাগ করবে না। কিন্তু যুদ্ধের প্রথমেই মুসলমানদের বিজয় দেখে তাদের সিংহভাগ গণীমত সংগ্রহের জন্য গিরিপথ ছেড়ে চলে যায়। এই অরক্ষিত গিরিপথ দিয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করে কাফিররা মুসলমানদের পর্যুদস্ত করে ফেলে। মুসলমানরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। তীরন্দাযদের এহেন ভুলের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়-
وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّوْنَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا أَرَاكُمْ مَا تُحِبُّوْنَ مِنْكُمْ مَنْ يُرِيْدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيْدُ الْآخِرَةَ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ لِيَبْتَلِيَكُمْ وَلَقَدْ عَفَا عَنْكُمْ وَاللهُ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ-
‘আল্লাহ তোমাদের নিকট (ওহোদ যুদ্ধে) দেওয়া (বিজয়ের) ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা (দিনের প্রথম ভাগে) ওদের কচুকাটা করছিলে তাঁর হুকুমে। অবশেষে (দিনের শেষভাগে) যখন তোমরা হতোদ্যম হয়ে পড়লে ও কর্তব্য নির্ধারণে ঝগড়ায় লিপ্ত হ’লে (যেটা তীরন্দাযরা করেছিল) আমি তোমাদেরকে (বিজয়) দেখানোর পর যা তোমরা কামনা করেছিলে, এ সময় তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া (গণীমত) কামনা করছিলে এবং কেউ আখেরাত কামনা করছিলে (অর্থাৎ দৃঢ় ছিলে)। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তাদের (উপর বিজয়ী হওয়া) থেকে ফিরিয়ে দিলেন যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন। অবশ্য আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ’ (আলে ইমরান ৩/১৫২)।
একবার নবী করীম (ছাঃ) কিছু আদব-লেহাজ শিক্ষাদানের লক্ষ্যে তাঁর স্ত্রীদের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু কিছু লোক তিনি স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন বলে অপপ্রচার করে। অথচ বিষয়টা মোটেও তেমন ছিল না। তাই আল্লাহ নাযিল করলেন-
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوْا بِهِ وَلَوْ رَدُّوْهُ إِلَى الرَّسُوْلِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُوْنَهُ مِنْهُمْ-
‘আর যখন তাদের নিকট স্বস্তিদায়ক কিংবা ভীতিকর কোন বার্তা আসে তখনই তারা তা প্রচারে লেগে যায়; অথচ তারা যদি তা রাসূল ও তাদের মধ্যকার জ্ঞানী-গুণীজনের নিকট তুলে ধরত তাহ’লে তাদের মধ্যেকার গবেষণা শক্তির অধিকারীগণ তা অবশ্যই বুঝতে পারত’ (নিসা ৪/৮৩)।
কিছু ছাহাবী কোন প্রকার শারঈ ওযর ছাড়া মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত না করে বসেছিলেন। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِيْ أَنْفُسِهِمْ قَالُوْا فِيْمَ كُنْتُمْ قَالُوْا كُنَّا مُسْتَضْعَفِيْنَ فِي الْأَرْضِ قَالُوْا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوْا فِيْهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا-
‘যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছিল, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ কবয করার পর বলে তোমরা কিসে ছিলে (অর্থাৎ মুসলিম না মুশরিক?)। তারা বলবে, জনপদে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলবে, আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে তোমরা সেখানে হিজরত করে যেতে? অতএব ওদের বাসস্থান হ’ল জাহান্নাম। আর তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান’ (নিসা ৪/৯৭)।
আয়েশা (রাঃ)-এর সতীত্বে কলঙ্ক লেপনে কিছু মুনাফিক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। অথচ তিনি সেই মিথ্যা অপবাদ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিলেন। এরপরেও কিছু ছাহাবীও তাদের পেছনে সায় দিয়েছিল। বিষয়টা ডাহা মিথ্যা হিসাবে তারা উড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে নীরব ছিল। এটা ছিল ভুল। তাই আল্লাহ অপবাদ প্রসঙ্গে নাযিল করলেন, وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِيْ مَا أَفَضْتُمْ فِيْهِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ- ‘যদি ইহকালে ও পরকালে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তাহ’লে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদের স্পর্শ করত’ (নূর ২৪/১৪)। পরে আরো বলেছেন, وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ قُلْتُمْ مَا يَكُوْنُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهَذَا سُبْحَانَكَ هَذَا بُهْتَانٌ عَظِيْمٌ- ‘আর যখন তোমরা এ অপবাদ শুনেছিলে তখন কেন তোমরা একথা বলনি যে, এ বিষয়ে আমাদের কিছুই বলা উচিৎ নয়। আল্লাহ পবিত্র। নিশ্চয়ই এটি গুরুতর অপবাদ’ (নূর ২৪/১৬)।
কিছু ছাহাবী নবী করীম (ছাঃ)-এর উপস্থিতিতে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং তাদের গলার স্বর বেশ উঁচু মাত্রায় পৌঁছে যায়। এহেন অশোভন আচরণ না করতে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تُقَدِّمُوْا بَيْنَ يَدَيِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ، يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَرْفَعُوْا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوْا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রগামী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের গলার আওয়ায নবীর আওয়ায থেকে উঁচু কর না এবং নিজেরা যেভাবে একে অপরের সাথে উঁচু গলায় কথা বল সেভাবে তাঁর সামনে বল না। এমন যেন না হয় যে, তোমাদের আমল সব পন্ড হয়ে যাবে অথচ তোমরা তা বুঝতে পারবে না’ (হুজুরাত ৪৯/১-২)।
একবার নবী করীম (ছাঃ) জুম‘আর ছালাতে খুৎবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় একটি বাণিজ্য কাফেলা মদীনায় প্রবেশ করে। তখন বেশ কিছু লোক খুৎবা শোনা বাদ দিয়ে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে কাফেলার দিকে দৌড়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়,
وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوْا إِلَيْهَا وَتَرَكُوْكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ وَاللهُ خَيْرُ الرَّازِقِيْنَ-
‘আর যখন তারা কোন ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ক্রীড়াকৌতুক দেখতে পায় তখন তোমাকে দন্ডায়মান রেখেই তারা সে দিকে দ্রুত চলে যায়। তুমি বলে দাও, আল্লাহর নিকট যা আছে তা ক্রীড়াকৌতুক ও ব্যবসায়ের পণ্য থেকে অনেক মূল্যবান। আর আল্লাহই তো সর্বোত্তম রিযিকদাতা’ (জুমু‘আ ৬২/১১)। এরকম উদাহরণ আরো অনেক রয়েছে। এগুলো ভুল সংশোধনের গুরুত্ব এবং এ ব্যাপারে নীরবতা পালন যে আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়, সে কথাই নির্দেশ করে।
আর নবী করীম (ছাঃ) তো তাঁর মালিকের দেওয়া আলোকিত পথের পথিক ছিলেন। অসৎ কাজের নিষেধ এবং ভুল সংশোধনে তিনি কখনই শিথিলতা বা বিলম্বের ধার ধারেননি। এসকল কারণে আলেমগণ একটি মূলসূত্র বের করেছেন যে,لا يجوز في حقّ النبي صلى الله عليه وسلم تأخير البيان عن وقت الحاجة ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্য প্রয়োজনের সময়ে কোন কিছু বিলম্বে বর্ণনা করা জায়েয নয়’।
নবী করীম (ছাঃ)-এর সমকালীন যুগে যে সমস্ত লোক ভুল-ভ্রান্তি করেছিল তাদের সংশোধনে তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তার স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। কেননা তিনি তাঁর প্রভুর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎ সহযোগিতা প্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর সকল কাজ ও কথা নির্ভুল হ’লে যেমন তার সমর্থনে অহী এসেছে, তেমনি ভুল হ’লে সংশোধনার্থেও অহী এসেছে। কাজেই ভুল সংশোধনে তাঁর গৃহীত পদ্ধতি যেমন অত্যন্ত সুবিচারপূর্ণ ও ফলদায়ক, তেমনি তা ব্যবহারে জনমানুষের সাড়া লাভের সম্ভাবনাও অনেক বেশী।
ভুল সংশোধনকারী নবী করীম (ছাঃ)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করলে তার কাজ যেমন সঠিক হবে, তেমনি তার পদ্ধতিও সহজ-সরল হবে। আর এতে নবী করীম (ছাঃ)-এর অনুসরণও হবে। তিনিই তো আমাদের জন্য সুন্দরতম আদর্শ। আল্লাহ তা‘আলাও এজন্য মহাপুরস্কার দিবেন, যদি আমাদের নিয়ত বিশুদ্ধ থাকে।
নবী করীম (ছাঃ)-এর পদ্ধতি জানার মাধ্যমে জাগতিক কর্মপদ্ধতির ত্রুটি ও ব্যর্থতা কোথায় তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। মানব উদ্ভাবিত এসব কর্মপদ্ধতিই তো দুনিয়া জুড়ে রাজ্য চালাচ্ছে। এসব কর্মপদ্ধতি তাদের অনুসারীদের দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। কেননা এসব তন্ত্রের অনেকগুলোই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিমূলক এবং বাতিল দর্শনের উপর দন্ডায়মান। যেমন বল্গাহীন স্বাধীনতা। আবার কিছু তন্ত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাতিল ধর্মজাত। যেমন পিতৃপুরুষ থেকে প্রাপ্ত অন্ধবিশ্বাস, যা অহী ও যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে মোটেও পরখ করা হয়নি।
অবশ্য একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান পরিস্থিতি ও উদ্ভূত অবস্থায় নবী করীম (ছাঃ)-এর কর্ম-পদ্ধতি কার্যকরী করতে একটা বড় মাত্রার ইজতিহাদ বা গবেষণার আবশ্যকতা রয়েছে। যে নিজেই ফকীহ বা ইসলামী আইন বিশারদ সে বর্তমান ও নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগের অবস্থা ও পরিবেশের সাদৃশ্য নিরূপণে সহজেই সমর্থ হবে, ফলে নবী করীম (ছাঃ)-এর কর্মপদ্ধতি থেকে যা উপযুক্ত ও ফলদায়ক তা নির্বাচন করতে পারবে।
এ গ্রন্থ নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে যারা তাঁর সঙ্গে জীবন-যাপন করেছেন, তাঁর সামনাসামনি হয়েছেন, নানা সময় নানা পর্যায়ে তাদের যে ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে এবং নবী করীম (ছাঃ) তা সংশোধন করেছেন তাঁর সেই সংশোধন পদ্ধতি অনুসন্ধানের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র। আমি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার নিকট প্রার্থনা জানাই তিনি যেন গ্রন্থটিতে সঠিক তথ্য সন্নিবেশের সামর্থ্য দান করেন। গ্রন্থটি যেন আমার নিজের এবং আমার মুসলিম ভাই-বোনদের কল্যাণে লাগে। তিনি একাজের উত্তম সহায়ক, এ ক্ষমতা কেবল তারই আছে, তিনিই সঠিক পথের দিশারী।
ভুল সংশোধনকালে যেসব সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন : ভুল সংশোধনের মত কাজে নেমে পড়ার পূর্বে কিছু সতর্কতা ও সাবধানতামূলক বিষয়ে সংশোধনকারীর সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন। এতে আশানুরূপ ফল অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। নিম্নে তা তুলে ধরা হ’ল :
১. শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাজটি করা (الإخلاص لله) : মানুষের উপর বড়ত্ব ফলান, আত্মতৃপ্তি লাভ কিংবা অন্যদের থেকে উপকার লাভের আশায় সংশোধনের কাজে প্রবৃত্ত হওয়া যাবে না; বরং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে রাযী-খুশি করার নিয়তে তা করতে হবে।
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) শুফাই আল-আছবাহী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, তিনি মদীনায় ঢুকে এক জায়গায় দেখলেন, একজন লোকের পাশে অনেক লোক জমা হয়েছে। তিনি বললেন, ইনি কে? তারা বলল, ইনি আবু হুরায়রা (রাঃ)। আমি তাঁর কাছাকাছি গিয়ে তাঁর সামনে বসলাম। তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে হাদীছ বর্ণনা করছিলেন। যখন তিনি থামলেন এবং নিরিবিলি হ’লেন তখন আমি তাকে বললাম, আমি আপনাকে হকের পর হকের কসম দিয়ে বলছি, আপনি আমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাবেন যা আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে শুনেছেন। তারপর আপনি তা বুঝেছেন এবং মনে রেখেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, আমি তা করব, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, আমি তা বুঝেছি এবং মনে রেখেছি। একথা বলার পর আবু হুরায়রা (রাঃ) এমনভাবে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন যে তিনি প্রায় বেহুঁশ হওয়ার মত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল। তারপর তিনি স্বাভাবিক হয়ে বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে এই ঘরের মধ্যে বলেছিলেন, তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। আবু হুরায়রা (রাঃ) একথা বলে পুনর্বার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। হুঁশ ফিরে পেয়ে তিনি তার মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন। আমি আর তিনি তখন এই ঘরের মধ্যে ছিলাম। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। আবার আবু হুরায়রা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে পেয়ে তিনি চোখে-মুখে হাত বুলালেন এবং বললেন, আমি (তোমার কথা মত কাজ) করব। আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন। আমি তখন তাঁর সাথে এই ঘরের মধ্যে ছিলাম। তিনি ও আমি ছাড়া আমাদের সাথে আর কেউ তখন ছিল না। তারপর আবু হুরায়রা (রাঃ) কঠিনভাবে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। আমি তখন দীর্ঘ সময় ধরে তাকে আমার দেহের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। হুঁশ ফিরে এলে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, যখন ক্বিয়ামত দিবস হবে, তখন বিচার করার জন্য আল্লাহ তার বান্দাদের মাঝে নেমে আসবেন। তখন প্রত্যেক মানবদল নতজানু হয়ে থাকবে। প্রথমেই তিনি তিন প্রকার লোককে ডাকবেন। এক. ঐ ব্যক্তি যে কুরআন জমা করেছে তথা পড়েছে। দুই. ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর পথে লড়াই করে মারা গিয়েছে। তিন. ঐ ব্যক্তি যে প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিল। কুরআন পাঠককে আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাকে আমার রাসূলের উপর যা নাযিল করেছি তা শিখাইনি? সে বলবে, অবশ্যই, হে আমার মালিক! তিনি বলবেন, তোমাকে প্রদত্ত শিক্ষা মত তুমি কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি সারা রাত এবং সারা দিন তা পালনে তৎপর থেকেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ বলবেন, তোমার বরং ‘কারী’ বা কুরআন পাঠক নামে আখ্যায়িত হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তোমাকে তা বলা হয়েছে। সম্পদশালী লোকটিকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে এতটা প্রাচুর্য দেইনি যে, কোন ব্যাপারেই কারো কাছে তোমাকে হাত পাততে না হয়? সে বলবে, অবশ্যই, হে আমার মালিক! তিনি বলবেন, আমি তোমাকে যা দিয়েছিলাম তাতে তুমি কী আমল করেছিলে? সে বলবে, আমি আত্মীয়তা রক্ষা করতাম এবং দান-খয়রাত করতাম। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ বলবেন, তুমি বরং এই ইচ্ছা পোষণ করেছিলে যে, তোমাকে ‘অমুক বড় দানশীল’ বলে আখ্যায়িত করা হোক। তোমাকে তো তা (দুনিয়াতে) বলা হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় নিহত লোকটাকেও হাযির করা হবে। আল্লাহ তাকে বলবেন, কিসের জন্য তুমি নিহত হয়েছিলে? সে বলবে, আমি তোমার রাস্তায় জিহাদের আদেশ পেয়ে যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়েছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা তাকে বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, ফেরেশতারাও তাকে বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং এই ইচ্ছা করেছিলে যে, তোমাকে যেন বলা হয়, ‘অমুক খুব সাহসী বীর’। তোমাকে তো (দুনিয়াতে) তা বলা হয়েছে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার হাঁটুর উপর করাঘাত করে বললেন, হে আবু হুরায়রা! এই তিনজনই আল্লাহর সৃষ্টির প্রথম, ক্বিয়ামতের দিন যাদের দ্বারা জাহান্নাম উত্তপ্ত করা হবে’।[2] কল্যাণকামী নছিহতকারীর নিয়ত যখন সঠিক হবে তখন তা আল্লাহর হুকুমে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে, গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং ছওয়াব অর্জনের অসীলা হবে।
২. ভুল করা মানুষের স্বভাবজাত বিষয় (الخطأ من طبيعة البشر) : নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ بَنِى آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ ‘আদম সন্তানের প্রত্যেকেই ভুলকারী। আর ভুলকারীদের মধ্যে তারাই উত্তম, যারা তওবাকারী তথা সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনকারী’।[3]
এই বাস্তবতাকে মনে রাখলে সব কাজই সঠিক পন্থায় গতি লাভ করতে পারে। এমতাবস্থায় সংশোধনকারী যেন এমন না হয় যে, কিছু লোককে উত্তম নমুনা ও নির্দোষ ভেবে মূল্যায়ন করবে না; আবার কিছু লোকের ভুল-ভ্রান্তির মাত্রা বেশী কিংবা বারবার হ’তে দেখে তাদের উপর ব্যর্থতার তকমা লাগিয়ে দেবে। বরং সে তাদের প্রত্যেক শ্রেণীর সাথে বাস্তবানুগ আচরণ করবে। কেননা সে ভালমত জানে যে, মানুষের স্বভাব সদাই অজ্ঞতা, উদাসীনতা, অক্ষমতা, খেয়ালখুশি, বিস্মৃতি ইত্যাদি ক্ষতিকর আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে সে স্বভাবতই ভুল করে বসে।
ভুলের কারণে আরো কোন মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় মানুষে মানুষে তুলনা করা থেকে আমরা যাতে বিরত না থাকি এ সত্য আমাদের সে কথাও বলে।
একইভাবে এ সত্য বুঝতে পারলে একজন প্রচারক, সংস্কারক, সৎকাজের আদেশদাতা ও অসৎ কাজের নিষেধকর্তা অনুধাবন করবে যে, সেও অপরাপর মানুষের মত একজন মানুষ। ভুলে পতিত ব্যক্তির মত সেও ভুল করতে পারে। এরূপ চেতনা থাকলে সে ভুলে পতিত ব্যক্তির সঙ্গে রূঢ়-কঠিন আচরণ না করে; বরং দয়ার্দ্র ও নম্র আচরণ করবে। কেননা সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য তো কল্যাণ সাধন, শাস্তি বিধান নয়।
তবে ইতিপূর্বে যা বলা হয়েছে, তার অর্থ এটা নয় যে, ভুল-ভ্রান্তিকারকদের আমরা তাদের ভুলের উপর ছেড়ে দেব, কিছুই বলব না। পাপী ও কবীরা গোনাহকারীদের ব্যাপারে আমরা এমন ওযরখাহিও করব না যে, তারা মানুষ অথবা তারা উঠতি বয়সের কিশোর, তাদের তো এমন ভুল হ’তেই পারে। কিংবা তাদের যুগ ফিৎনা-ফাসাদ ও ষড়যন্ত্রে ভরা, তারা তো এসবের শিকার হ’তেই পারে। বরং শরী‘আতের মানদন্ড অনুযায়ী তাদের নিষেধ করা এবং কাজের হিসাব নেওয়া আমাদের জন্য একান্তই উচিত হবে।
৩. কোন কিছু ভুল আখ্যায়িত করা শারঈ দলীলের ভিত্তিতে হ’তে হবে, যার পেছনে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকবে। অজ্ঞতা কিংবা অবাস্তব জোড়াতালি দেওয়া কথার ভিত্তিতে তা হবে না : মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (জাবের (রাঃ) একটি লুঙ্গি পরে ছালাত আদায় করছিলেন। লুঙ্গিটা তিনি তার ঘাড়ের দিক দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন) এর কারণ ঐ সময় তারা পায়জামা ব্যবহার করতেন না। এক লুঙ্গিতেই ছালাত আদায় করতেন, তাই যাতে রুকূ ও সিজদাকালে সতর ঢাকা থাকে, সেজন্য তারা ঘাড়ের সাথে লুঙ্গি বেঁধে নিতেন।[4] (অথচ আলনায় তার কাপড় রাখা ছিল। এ দৃশ্য দেখে তাকে একজন বলল, আপনি এক লুঙ্গিতে ছালাত আদায় করছেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমি এটা কেবল এজন্য করছি যে, তোমার মত আহম্মকরা আমাকে দেখুক। নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে আমাদের মধ্যে এমন কেইবা ছিল যার পরার মত দু’টো কাপড় ছিল?[5] ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এখানে আহম্মক অর্থ অজ্ঞ। তাঁর কাজের উদ্দেশ্য ছিল, এক কাপড়ে ছালাতের বৈধতা তুলে ধরা, যদিও দুই কাপড়ে ছালাত আদায় উত্তম। যেন তিনি বলছেন, আমি বৈধতা বর্ণনার জন্য ইচ্ছে করে এটা করেছি। যাতে কোন অজ্ঞ লোক শুরু থেকেই নির্দ্বিধায় আমার অনুসরণ করে, অথবা আমাকে নিষেধ করে; তখন আমি তাকে বুঝিয়ে দেব যে, এটা জায়েয আছে।
তিনি আহম্মক বলে শক্ত ভাষায় সম্বোধন করেছেন, আলেমদের ভুল ধরতে সতর্ক হওয়ার জন্য। তাছাড়া অন্যরাও যেন শরী‘আতের কার্যাবলী নিয়ে অনুসন্ধান করে।[6]
৪. ভুল যত বড় হবে, সংশোধনে তত বেশী জোর দিতে হবে (كلما كان الخطأ أعظم كان الاعتناء بتصحيحه أشد) : উদাহরণস্বরূপ আক্বীদা-বিশ্বাসের ভুল সংশোধন আদব-আখলাকের ক্ষেত্রে ভুল সংশোধনের তুলনায় অধিক গুরুত্ববহ। দেখা গেছে, নবী করীম (ছাঃ) সকল শ্রেণীর শিরকের সঙ্গে জড়িত ভুল-ভ্রান্তি অনুসন্ধান ও তা সংশোধনে কঠিন গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা শিরকের পাপ অত্যন্ত ভয়াবহ। এখানে কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হ’ল।
মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (নবী তনয়) ইবরাহীম যেদিন মারা যান, সেদিন সূর্যগ্রহণ লেগেছিল। লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, ইবরাহীমের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ লেগেছে। এ কথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, চাঁদ-সূর্য আল্লাহর দু’টি নিদর্শন। কারো জন্ম-মৃত্যুতে এদের গ্রহণ লাগে না। সুতরাং তোমরা যখন এদের গ্রহণ লাগতে দেখবে তখন আল্লাহর কাছে দো‘আ করবে এবং না কেটে যাওয়া পর্যন্ত ছালাতে রত থাকবে’।[7]
আবু ওয়াকিদ আল-লায়ছী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,لَمَّا خَرَجَ إِلَى حُنَيْنٍ مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم سُبْحَانَ اللهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى (اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ) وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হুনাইনের যুদ্ধে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি পৌত্তলিক মুশরিকদের একটি গাছের পাশ দিয়ে যান। গাছটির নাম ছিল ‘যাতু আনওয়াত’। মুশরিকরা তাদের যুদ্ধাস্ত্রগুলো ঐ গাছে ঝুলিয়ে রাখত। এ দৃশ্য দেখে ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ওদের যেমন একটা যাতু আনওয়াত আছে, আমাদের জন্যও আপনি অনুরূপ একটা যাতু আনওয়াত বৃক্ষ নির্ধারণ করে দিন। নবী করীম (ছাঃ) তখন বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! এতো দেখছি, মূসার লোকদের মত কথা। ওরা বলেছিল, আমাদের জন্য তুমি ইলাহ বানিয়ে দাও, যেমন ওদের আছে অনেক ইলাহ। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের নিয়ম-নীতি অনুসরণ করবে’।[8]
অন্য বর্ণনায় আবু ওয়াকিদ থেকে বর্ণিত, তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে মক্কা থেকে হুনাইন পানে যাত্রা করেন। পথে কাফেরদের ‘যাতু আনওয়াত’ নামে একটি কুল গাছ ছিল। তারা গাছটির নীচে অবস্থান করত এবং গাছে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। তিনি বলেন, আমরাও একটা বড়সড় সবুজ কুল গাছের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের একটা যাতু আনওয়াত বানিয়ে দিন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের কথায় বললেন, ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! তোমরা তো দেখছি মূসার লোকদের মতই বলছ ‘আমাদের জন্য তুমি ইলাহ বানিয়ে দাও, যেমন তাদের আছে অনেক ইলাহ। নিশ্চয়ই তোমরা একটি অজ্ঞ জাতি’। নিশ্চয়ই এসবই যাপিত জীবনের রীতি। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্বকালের লোকদের রীতিগুলো এক একটা করে অনুসরণ করবে’।[9]
যায়েদ বিন খালেদ আল-জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে রাতে সংঘটিত বৃষ্টির পরে ফজর ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষে তিনি লোকদের দিকে মুখ করে বললেন, তোমরা কি জান, তোমাদের প্রভু কি বলেছেন? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেন, তিনি বলেছেন, আমার কিছু বান্দা আমার উপর ঈমান রেখে ভোর করে এবং কিছু বান্দা কাফির অবস্থায় ভোর করে। যারা বলে, আল্লাহর ফযলে ও দয়ায় আমাদের বৃষ্টি হয়েছে, তারা আমার উপর ঈমান রাখে এবং গ্রহের উপর ঈমান রাখে না। আর যারা বলে, অমুক অমুক গ্রহের কল্যাণে আমাদের বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার উপর ঈমান রাখে না; বরং ঐসব গ্রহ-নক্ষত্রের উপর ঈমান রাখে’।[10]
ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে বলল, يَا رَسُولَ اللهِ مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ ও আপনি যা চান, (তাই হবে)। তিনি তাকে বললেন, তুমি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ করে দিলে? বরং আল্লাহ একাই যা চান তাই হয়’।[11]
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-কে একটি কাফেলা বা দলে পেলেন। তিনি তখন তার পিতার নামে শপথ করছিলেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ডেকে বললেন, সাবধান, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের পিতৃপুরুষের নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। যার একান্তই শপথ করা প্রয়োজন সে যেন আল্লাহর নামে শপথ করে, নচেৎ চুপ করে থাকে’।[12]
জ্ঞাতব্য : ইমাম আহমাদ তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের নিকট ওয়াকী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের নিকট আ‘মাশ বর্ণনা করেছেন, তিনি সা‘দ বিন ওবায়দা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর সাথে এক মাহফিলে ছিলাম। পাশের মাহফিলের এক ব্যক্তিকে তিনি বলতে শুনলেন, না আমার পিতার কসম! ইবনু ওমর (রাঃ) তখন তার দিকে একটি কংকর ছুঁড়ে মেরে বললেন, এটাই ছিল ওমরের শপথ। নবী করীম (ছাঃ) তাকে এমন শপথ করতে নিষেধ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, নিশ্চয়ই এটা শিরক’।[13]
আবু শুরাইহ হানী ইবনু ইয়াদীদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক গোত্রের লোকেরা নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। তিনি তাদেরকে একজন লোকের আব্দুল হাজার বা পাথরের দাস বলে ডাকতে শুনতে পেলেন। তিনি তাকে বললেন, তোমার নাম কি? সে বলল, আব্দুল হাজার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, না, তোমার নাম বরং ‘আব্দুল্লাহ’।[14]
[চলবে]
[1]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান।
[2]. তিরমিযী হা/২৩৮২, হাদীছ হাসান।
[3]. তিরমিযী হা/২৪৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; মিশকাত হা/২৩৪১।
[4]. ফাৎহুল বারী, সালাফিয়া প্রকাশনী ১/৪৬৭।
[5]. বুখারী হা/৩৫২।
[6]. ফাৎহুল বারী ১/৪৬৭।
[7]. বুখারী হা/১০৬০।
[8]. তিরমিযী হা/২১৮০; মিশকাত হা/৫৪০৮, হাদীছ হাসান ছহীহ।
[9]. মুসনাদে আহমাদ ৫/২১৮, হা/২১৯৪৭।
[10]. বুখারী হা/৮৪৬।
[11]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৮৩৯, ১/২৮৩।
[12]. বুখারী হা/৬১০৮।
[13]. আহমাদ হা/৫২২২; আল-ফাৎহুর রববানী ১৪/১৬৪।
[14]. ছহীহ আদাবুল মুফরাদ হা/৬২৩, হাদীছ ছহীহ।