পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। শেষ পর্ব।
৫. উপদেশ ও পুনঃপুনঃ ভয় দেখানোর মাধ্যমে ভুলের প্রতিকার :
জুনদুব
বিন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
মুশরিকদের একটি গোত্রের নিকট (দ্বীন প্রচারার্থে এবং প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে)
একটি দল প্রেরণ করেন। তারা দু’দল মুখোমুখি হয়। এ সময় মুশরিকদের একটা লোক
সুযোগ বুঝে মুসলমানদের কোন একজনকে টার্গেট করে হত্যা করেছিল। এটা দেখে
মুসলমানদেরও একজন তার অন্যমনষ্কতার সুযোগ খুঁজছিল। তিনি (মুসলিম ভাইটা)
ছিলেন, আমাদের আলোচনা অনুসারে উসামা বিন যায়েদ। তিনি তাকে বাগে পেয়ে যখন
তরবারি উঠান তখন লোকটি বলে ওঠে, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’। তারপরও তিনি তাকে
হত্যা করেন। বিজয়ের সুসংবাদদাতা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এলে তিনি তাকে
ঘটনা জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে তিনি অভিযানের পুরো ঘটনা বলেন, এমনকি ঐ লোকের
ঘটনাও বলেন এবং সে কিভাবে কি করেছে এবং তার সাথে কি করা হয়েছে তাও বলেন।
তিনি উসামা (রাঃ)-কে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি তাকে কেন হত্যা করেছ?
উত্তরে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে মুসলমানদের খুন করছিল। অমুক অমুক
তার হাতে নিহত হয়েছে- তিনি তাদের নাম উল্লেখ করেন। এমন সময় আমি তার উপর
হামলা করি। সে যখন তরবারি দেখতে পেল তখন বলে উঠল, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তারপরও তুমি তাকে খুন করলে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ক্বিয়ামতের দিন যখন এই কালেমা ‘লা ইলা-হা
ইল্লাল্লা-হ’ (আল্লাহর দরবারে) হাযির হবে তখন তুমি কিভাবে কি করবে? তিনি
বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কিন্তু তিনি
বারবারই বলতে লাগলেন, ক্বিয়ামতের দিন এই কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
হাযির হবে তখন তুমি কিভাবে কি করবে? মোটের উপর কালেমা ‘লা ইলা-হা
ইল্লাল্লা-হ’ ক্বিয়ামতের দিন যখন হাযির হবে তখন তুমি কিভাবে কি করবে’- এর
উপর তিনি আর তাকে বেশী কিছু বলেননি।[1]
উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,
بَعَثَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِىْ سَرِيَّةٍ فَصَبَّحْنَا الْحُرَقَاتِ مِنْ جُهَيْنَةَ فَأَدْرَكْتُ رَجُلاً فَقَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ. فَطَعَنْتُهُ فَوَقَعَ فِى نَفْسِىْ مِنْ ذَلِكَ فَذَكَرْتُهُ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَقَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَقَتَلْتَهُ. قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّمَا قَالَهَا خَوْفًا مِنَ السِّلاَحِ. قَالَ : أَفَلاَ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ حَتَّى تَعْلَمَ أَقَالَهَا أَمْ لاَ. فَمَازَالَ يُكَرِّرُهَا عَلَىَّ حَتَّى تَمَنَّيْتُ أَنِّى أَسْلَمْتُ يَوْمَئِذٍ-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে একটি অভিযানে
প্রেরণ করেন। আমরা যখন জুহায়না গোত্রের উষ্ণ আবহাওয়ায় পৌঁছলাম তখন আমি এক
ব্যক্তিকে পাকড়াও করলাম। পাকড়াওয়ের সাথে সাথে সে বলল, ‘লা ইলা-হা
ইল্লাল্লা-হ’। কিন্তু আমি তাকে বল্লমের আঘাতে হত্যা করলাম। পরে এজন্য আমার
মনে অনুশোচনা জাগল। বিষয়টি আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট উত্থাপন করলাম।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শুনে বললেন, সে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলার পরও তুমি
তাকে হত্যা করলে? আমি বললাম, সেতো কেবল অস্ত্রের ভয়ে কালেমা বলেছিল। তিনি
বললেন, তুমি তার অন্তর ফেড়ে দেখলে না কেন- সে অন্তর থেকে বলেছিল কি-না?
তিনি বারবার কথাটির পুনরাবৃত্তি করায় আমার মনে হচ্ছিল, হায় আমি যদি ঐ দিন
মুসলমান হ’তাম’![2]
আল্লাহর ক্ষমতার কথা বলাও
উপদেশের মাধ্যমে ভুল সংশোধনের ভেতর পড়ে। একটি উদাহরণ দেখুন। ইমাম মুসলিম
আবু মাসঊদ বদরী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আমার এক
ক্রীতদাসকে চাবুক পেটা করছিলাম। এ সময় আমি আমার পেছন দিক থেকে একটা আওয়াজ
শুনতে পেলাম- ‘হে আবু মাসঊদ জেনে রাখ’। কিন্তু রাগের চোটে আমি আওয়াজটা বুঝে
উঠতে পারিনি। তারপর তিনি যখন আমার কাছে এসে পড়লেন তখন দেখলাম যে তিনি
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। তিনি বলেই চলছিলেন, ‘হে আবু মাসঊদ জেনে রাখ! হে আবু
মাসঊদ জেনে রাখ!!’ তখন আমি আমার হাত থকে চাবুক ফেলে দিলাম। অন্য বর্ণনায়
এসেছে, তাঁর ভয়ে আমার হাত থেকে চাবুক পড়ে গেল। তিনি বললেন, হে আবু মাসঊদ,
জেনে রাখ, তুমি এই গোলামের উপর যতটা না শক্তি খাটাতে পারছ আল্লাহ তা‘আলা
তোমার উপর তার চেয়েও অনেকগুণ বেশী শক্তি খাটাতে পারেন। আমি বললাম, এরপর
থেকে আমি আর কোন দাসকে মারধর করব না। বর্ণনান্তরে এসেছে, আমি বললাম, হে
আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর সন্তোষ লাভের খাতিরে তাকে মুক্ত করে দিলাম। তিনি
বললেন, শোন, তুমি যদি তাকে মুক্ত করে না দিতে তাহ’লে জাহান্নামের আগুন
তোমাকে ঘিরে ধরত। মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,
আল্লাহর কসম! তার উপর তোমার যতটা ক্ষমতা আছে তার তুলনায় আল্লাহ অবশ্যই
তোমার উপর বেশী ক্ষমতাবান। অতঃপর তিনি তাকে মুক্ত করে দেন।[3]
আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
كُنْتُ أَضْرِبُ مَمْلُوْكًا لِىْ فَسَمِعْتُ قَائِلاً مِنْ خَلْفِىْ يَقُولُ اعْلَمْ أَبَا مَسْعُودٍ اعْلَمْ أَبَا مَسْعُودٍ. فَالْتَفَتُّ فَإِذَا أَنَا بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : لَلَّهُ أَقْدَرُ عَلَيْكَ مِنْكَ عَلَيْهِ. قَالَ أَبُو مَسْعُودٍ فَمَا ضَرَبْتُ مَمْلُوكًا لِى بَعْدَ ذَلِكَ-
‘আমি আমার এক গোলামকে মারছিলাম। তখন
আমার পেছন থেকে একজনকে বলতে শুনলাম- হে আবু মাসঊদ! জেনে রাখ, হে আবু মাসঊদ!
জেনে রাখ, আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। তিনি
বললেন, তার উপর তোমার যতটা ক্ষমতা আছে তার তুলনায় অবশ্যই আল্লাহ তোমার উপর
বেশী ক্ষমতাবান। আবু মাসঊদ বলেন, এ ঘটনার পর থেকে আমি কখনো আর কোন গোলামকে
মারিনি’।[4]
৬. ভুল-ভ্রান্তিকারীর উপর দয়া-মমতা প্রকাশ করা :
ভুল করার ফলে যে খুব অনুশোচনায় পোড়ে, আফসোসে কাতর হয়ে পড়ে এবং তার তওবা স্পষ্ট ধরা পড়ে তার ক্ষেত্রে এমনটা করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে কোন কোন জিজ্ঞাসারীকে তিনি এরূপ অনুকম্পা করেছিলেন। যেমন :
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَدْ ظَاهَرَ مِنِ امْرَأَتِهِ فَوَقَعَ عَلَيْهَا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّى قَدْ ظَاهَرْتُ مِنْ زَوْجَتِى فَوَقَعْتُ عَلَيْهَا قَبْلَ أَنْ أُكَفِّرَ. فَقَالَ : وَمَا حَمَلَكَ عَلَى ذَلِكَ يَرْحَمُكَ اللهُ. قَالَ رَأَيْتُ خُلْخَالَهَا فِى ضَوْءِ الْقَمَرِ. قَالَ : فَلاَ تَقْرَبْهَا حَتَّى تَفْعَلَ مَا أَمَرَكَ اللهُ بِهِ-
‘এক ব্যক্তি নিজের যিহারকৃত
স্ত্রীর সাথে সহবাস করার পর নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, ইয়া
রাসূলাল্লাহ! আমি আমার স্ত্রীর সাথে যিহার করেছিলাম। তারপর যিহারের কাফফারা
না দিয়েই তার সাথে সহবাস করে ফেলেছি। তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার উপর দয়া
করুন। তুমি এমন কাজ কেমন করে করলে? সে বলল, আমি চাঁদের আলোয় তার পা
দেখেছিলাম (ফলে আত্মসংবরণ করতে পারিনি)। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমার
সম্পর্কে কোন হুকুম না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তার কাছে যেয়ো না’।[5]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ، فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ هَلَكْتُ. قَالَ : مَا لَكَ. قَالَ وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِى وَأَنَا صَائِمٌ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هَلْ تَجِدُ رَقَبَةً تُعْتِقُهَا. قَالَ لاَ. قَالَ فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُوْمَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ. قَالَ لاَ. فَقَالَ فَهَلْ تَجِدُ إِطْعَامَ سِتِّينَ مِسْكِينًا. قَالَ لاَ. قَالَ فَمَكَثَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم، فَبَيْنَا نَحْنُ عَلَى ذَلِكَ أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَقٍ فِيْهَا تَمْرٌ وَالْعَرَقُ الْمِكْتَلُ قَالَ : أَيْنَ السَّائِلُ. فَقَالَ أَنَا. قَالَ : خُذْهَا فَتَصَدَّقْ بِهِ. فَقَالَ الرَّجُلُ أَعَلَى أَفْقَرَ مِنِّى يَا رَسُولَ اللهِ فَوَاللَّهِ مَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا- يُرِيدُ الْحَرَّتَيْنِ أَهْلُ بَيْتٍ أَفْقَرُ مِنْ أَهْلِ بَيْتِى، فَضَحِكَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ ثُمَّ قَالَ : أَطْعِمْهُ أَهْلَكَ-
‘একদা
আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে বসা ছিলাম। এমন সময় তাঁর নিকট এক ব্যক্তি
এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন, তোমার হয়েছে
কি? সে বলল, ছিয়াম অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন করেছি।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমার কি কোন দাস আছে যাকে তুমি মুক্ত করে দিতে
পার? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহ’লে কি তুমি দু’মাস লাগাতার ছিয়াম রাখতে
পারবে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহ’লে কি ষাটজন নিঃস্ব-মিসকীনকে খেতে দিতে
পারবে? সে বলল, না। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) থেমে গেলেন। আমরা ঐ অবস্থায়ই
ছিলাম, এমন সময় তাঁর নিকট এক ঝুড়ি খেজুর এল। তিনি বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়?
সে বলল, এই যে আমি। তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে দান করে দাও। সে বলল, হে
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার থেকেও কি দরিদ্র লোকেদের মধ্যে? আল্লাহর কসম,
মদীনার দুই উচ্চপ্রান্তের মাঝে এমন কোন ঘরবাড়ি নেই যে আমার পরিবার থেকেও
বেশী দরিদ্র। তার কথায় নবী করীম (ছাঃ) হেসে উঠলেন যে তাঁর চোখা দাঁতগুলো
দৃশ্যমান হয়ে উঠল। পরে তিনি তাকে বললেন, ঠিক আছে, তোমার পরিবারের লোকদেরই
খেতে দাও’।[6]
এই প্রশ্নকারী ভুলের শিকার লোকটি না তামাশা করে এসব বলেছিল, না বিষয়টা হাল্কাভাবে নিয়েছিল। বরং তার নিজেকে তিরস্কার করা এবং নিজের ভুল বুঝতে পারা তার কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। সে বলছিল, ‘আমি ধ্বংস হয়ে গেছি’। এজন্যই সে করুণা লাভের যোগ্য।
আহমাদের বর্ণনায় লোকটার জিজ্ঞাসার জন্য আসার মুহূর্তের অবস্থার আরো বেশী বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
أَنَّ أَعْرَابِيًّا جَاءَ يَلْطِمُ وَجْهَهُ وَيَنْتِفُ شَعَرَهُ وَيَقُوْلُ مَا أُرَانِى إِلاَّ قَدْ هَلَكْتُ. فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَا أَهْلَكَكَ. قَالَ أَصَبْتُ أَهْلِى فِى رَمَضَانَ. قَالَ : أَتَسْتَطِيعُ أَنْ تُعْتِقَ رَقَبَةً. قَالَ لاَ. قَالَ : أَتَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ. قَالَ لاَ. قَالَ أَتَسْتَطِيعُ أَنْ تُطْعِمَ سِتِّينَ مِسْكِيناً. قَالَ لاَ. وَذَكَرَ الْحَاجَةَ قَالَ فَأُتِىَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِزِنْبِيلٍ وَهُوَ الْمِكْتَلُ فِيهِ خَمْسَةَ عَشَرَ صَاعاً أَحْسَبُهُ تَمْراً قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَيْنَ الرَّجُلُ. قَالَ : أَطْعِمْ هَذَا. قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ مَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا أَحَدٌ أَحْوَجُ مِنَّا أَهْلَ بَيْتٍ. قَالَ فَضَحِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ قَالَ : أَطْعِمْ أَهْلَكَ-
‘এক বেদুঈন তার মুখে
চড়-থাপ্পড় মারতে মারতে এবং মাথার চুল উপড়াতে উপড়াতে আসছিল, আর মুখে বলছিল,
আমার একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, কিসে তোমার
সর্বনাশ করল। সে বলল, আমি রামাযানে দিনের বেলায় আমার স্ত্রীর সাথে দৈহিক
মিলন করেছি। তিনি বললেন, তুমি কি একজন দাস মুক্ত করতে পারবে? সে বলল, না।
তিনি বললেন, তুমি কি এক নাগাড়ে দু’মাস ছিয়াম রাখতে পারবে? সে বলল, না। তিনি
বললেন, তাহ’লে ষাটজন নিঃস্ব-দরিদ্রকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। সে তার
অভাবের কথা উল্লেখ করল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এক বস্তা মাল এল।
তাতে পনের ছা‘ খেজুর ছিল (এক ছা‘ বর্তমান ওযনে আড়াই কেজি)। নবী করীম (ছাঃ)
বললেন, প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে হাযির হ’লে তিনি বললেন, এগুলো খেতে দাও।
সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মদীনার দুই পাথুরে উপত্যকার মাঝে আমার পরিবার
থেকে অভাবী আর কেউ নেই। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হেসে দিলেন, যাতে তাঁর
চোখা দাঁতগুলো পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়ে উঠল। তিনি তাকে বললেন, ঠিক আছে, তোমার
পরিবারের লোকদেরই খেতে দাও’।[7]
(৭) ভুল ধরায় তাড়াহুড়ো না করা :
হযরত ওমর (রাঃ)-এর নিজের বেলায় এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যা তিনি তা নিজে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
سَمِعْتُ هِشَامَ بْنَ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ يَقْرَأُ سُوْرَةَ الْفُرْقَانِ فِىْ حَيَاةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَاسْتَمَعْتُ لِقِرَاءَتِهِ فَإِذَا هُوَ يَقْرَؤُهَا عَلَى حُرُوفٍ كَثِيرَةٍ لَمْ يُقْرِئْنِيهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَكِدْتُ أُسَاوِرُهُ فِى الصَّلاَةِ فَانْتَظَرْتُهُ حَتَّى سَلَّمَ فَلَبَبْتُهُ فَقُلْتُ مَنْ أَقْرَأَكَ هَذِهِ السُّورَةَ الَّتِى سَمِعْتُكَ تَقْرَأُ قَالَ أَقْرَأَنِيهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم. فَقُلْتُ لَهُ كَذَبْتَ فَوَاللهِ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَهُوَ أَقْرَأَنِى هَذِهِ السُّورَةَ الَّتِى سَمِعْتُكَ، فَانْطَلَقْتُ بِهِ إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَقُودُهُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّى سَمِعْتُ هَذَا يَقْرَأُ سُورَةَ الْفُرْقَانِ عَلَى حُرُوفٍ لَمْ تُقْرِئْنِيهَا وَإِنَّكَ أَقْرَأْتَنِى سُورَةَ الْفُرْقَانِ. فَقَالَ : يَا هِشَامُ اقْرَأْهَا. فَقَرَأَهَا الْقِرَاءَةَ الَّتِى سَمِعْتُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هَكَذَا أُنْزِلَتْ. ثُمَّ قَالَ : اقْرَأْ يَا عُمَرُ. فَقَرَأْتُهَا الَّتِى أَقْرَأَنِيهَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هَكَذَا أُنْزِلَتْ. ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ-
‘আমি হিশাম বিন হাকিম বিন হিযামকে রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় সূরা ফুরক্বান পড়তে শুনলাম। আমি মনোযোগ দিয়ে তার
ক্বিরাআত (পড়া) শুনছিলাম। দেখলাম সে অনেক পদ্ধতিতে তা পড়ছে। যেগুলো
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে শিখাননি। আমার দৃষ্টিতে ভুল পড়ার জন্য আমি তাকে
ছালাতের মধ্যেই জাপটে ধরার উপক্রম করছিলাম। কিন্তু আমি তার সালাম ফিরানো
পর্যন্ত ধৈর্য ধরলাম। সালাম ফিরানোর সাথে সাথেই আমি তার চাদর দিয়ে গলা
পেঁচিয়ে ধরে তাকে বললাম, তোমাকে যে সূরাটা পড়তে শুনলাম কে তোমাকে তা
শিখিয়েছে? সে বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেই আমাকে তা শিখিয়েছেন। আমি বললাম,
তুমি মিথ্যা বলছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তো আমাকে তোমার পদ্ধতিতে শেখাননি।
তারপর আমি তাকে টানতে টানতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে গেলাম এবং
বললাম, আমি একে সূরা আল-ফুরক্বান এমন সব পদ্ধতিতে পড়তে শুনেছি যা আপনি
আমাকে পড়াননি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। তারপর বললেন, হিশাম,
পড়তো দেখি। সে তাঁকে ঠিক সেভাবেই পড়ে শুনাল যেভাবে আমি তাকে পড়তে
শুনেছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা শুনে বললেন, এভাবেই এ সূরা নাযিল হয়েছে।
তারপর বললেন, ওমর, তুমি পড়। তিনি আমাকে যে রীতিতে পড়িয়েছিলেন আমি সেভাবেই
পড়লাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এভাবেই এ সূরা নাযিল হয়েছে। আসলে এই কুরআন
সাত পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে। অতএব তোমাদের জন্য তন্মধ্যে যা সহজ মনে হয় তাই
পড়’।[8]
এই ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
(ক) তিনি দু’জনের প্রত্যেককেই অপরের সামনে পড়তে হুকুম করার পর প্রত্যেকের পড়াই সঠিক বলে প্রত্যয়ন করায় তারা প্রত্যেকেই যে সঠিক ছিল এবং কেউ যে ভুল করেনি তা জোরালোভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
(খ) নবী করীম (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে হিশাম (রাঃ)-এর ছেড়ে দেওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন اَرْسِلْهُ يَا عُمَرُ ‘ওমর, ওকে ছেড়ে দাও’।[9] এ কথায় উভয় পক্ষের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য সমান পরিবেশ তৈরীর নির্দেশনা মেলে। উভয়েই যাতে শান্ত্ব মনে কথা বলতে পারে। ওমর (রাঃ) যে এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে ফেলেছেন তার ইঙ্গিতও এখানে মেলে।
(গ) শিক্ষার্থীর জানাশোনার বিপরীতে কেউ কিছু বললে তার কথা সঠিক না বেঠিক তা নিশ্চিত না হয়ে তাড়াহুড়া করা মোটেও সমীচীন নয়। অনেক সময় দেখা যায় তা কোন না কোন বিদগ্ধ বিদ্বানেরই গ্রহণযোগ্য কথা।
এই একই বিষয়ের সঙ্গে যোগ হ’তে পারে শাস্তি দানে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ার মত বিষয়। নিম্নের ঘটনা তার সাক্ষী।
ইমাম নাসাঈ আরবাদ বিন শুরাহবীল (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
قَدِمْتُ مَعَ عُمُومَتِى الْمَدِينَةَ فَدَخَلْتُ حَائِطًا مِنْ حِيطَانِهَا فَفَرَكْتُ مِنْ سُنْبُلِهِ فَجَاءَ صَاحِبُ الْحَائِطِ فَأَخَذَ كِسَائِى وَضَرَبَنِى فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَسْتَعْدِى عَلَيْهِ فَأَرْسَلَ إِلَى الرَّجُلِ فَجَاءُوا بِهِ فَقَالَ: مَا حَمَلَكَ عَلَى هَذَا. فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّهُ دَخَلَ حَائِطِى فَأَخَذَ مِنْ سُنْبُلِهِ فَفَرَكَهُ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا عَلَّمْتَهُ إِذْ كَانَ جَاهِلاً وَلاَ أَطْعَمْتَهُ إِذْ كَانَ جَائِعًا ارْدُدْ عَلَيْهِ كِسَاءَهُ، وَأَمَرَ لِى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِوَسْقٍ أَوْ نِصْفِ وَسْقٍ-
‘আমি আমার চাচাদের সঙ্গে
মদীনায় আসি। তারপর সেখানকার প্রাচীর ঘেরা একটা খেজুর বাগানে প্রবেশ করি।
আমি খেজুরের কাঁদি থেকে কিছু খেজুর ছড়িয়ে নেই। এমন সময় বাগানের মালিক এসে
আমাকে পাকড়াও করে মারধর করে এবং আমার কাপড়-চোপড় নিয়ে নেয়। আমি রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর নিকট এসে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করি। তিনি লোকটিকে ডেকে
আনার জন্য লোক পাঠান। তারা তাকে তাঁর নিকট হাযির করে। তিনি তাকে বলেন,
তোমাকে এমন আচরণ করতে কিসে প্ররোচিত করল? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! সে
আমার বাগানে ঢুকে খেজুর কাঁদি থেকে খেজুর ছাড়িয়ে নিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বললেন, যেহেতু সে অজ্ঞ ছিল তাই তোমার উচিত ছিল তাকে শিক্ষা দেওয়া;
কিন্তু তুমি তাকে শিখাওনি। সে ক্ষুধার্ত ছিল কিন্তু তুমি তাকে খেতে দাওনি।
তার কাপড়গুলো তাকে ফেরত দাও। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে এক ওয়াসাক অথবা
অর্ধ ওয়াসাক (খেজুর অথবা অন্য কিছু) দিতে আদেশ দিলেন’।[10]
এ ঘটনা থেকে বুঝা যায়, ভুলে পতিত ব্যক্তি কিংবা বাড়াবাড়িকারীর কোন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ভুল করেছে বা বাড়াবাড়ি করেছে তা জানতে পারলে তার সঙ্গে সঠিক আচরণ করা সম্ভব হয়।
একইভাবে লক্ষণীয় যে, নবী করীম (ছাঃ) বাগান মালিককে কোন শাস্তি দেননি। কেননা সে ছিল হকদার, তবে সে ভুল করেছিল তার আচরণে ও সতর্কীকরণে। সে বিধি-বিধান যে জানে না তার সঙ্গে বিধি-বিধান জানা মানুষের ন্যায় আচরণ করেছে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সঠিক আচরণ শিখিয়ে দেন এবং ক্ষুধার্তের কাপড় ফিরিয়ে দিতে আদেশ দেন।
(৮) ভুলকারীর সঙ্গে শান্তশিষ্ট আচরণ :
ভুল করে কেউ কিছু করে ফেললে তার উপর কঠোর ও মারমুখী না হয়ে বরং ধীরস্থিরভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যখন তার উপর খবরদারী ও কড়াকড়ি করায় ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিষয়টা আমরা মসজিদের মধ্যে পেশাব করে দেওয়া এক বেদুঈনের ঘটনায় নবী করীম (ছাঃ) কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি।
আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
بَيْنَمَا نَحْنُ فِى الْمَسْجِدِ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ جَاءَ أَعْرَابِىٌّ فَقَامَ يَبُولُ فِى الْمَسْجِدِ فَقَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَهْ مَهْ. قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تُزْرِمُوهُ دَعُوهُ. فَتَرَكُوهُ حَتَّى بَالَ. ثُمَّ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَعَاهُ فَقَالَ لَهُ إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لاَ تَصْلُحُ لِشَىْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ وَلاَ الْقَذَرِ إِنَّمَا هِىَ لِذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَالصَّلاَةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ. أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم. قَالَ فَأَمَرَ رَجُلاً مِنَ الْقَوْمِ فَجَاءَ بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ فَشَنَّهُ عَلَيْهِ-
‘আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে মসজিদে বসে ছিলাম। এমন সময় একজন বদ্দু এসে মসজিদে পেশাব করতে লাগল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ বলতে লাগলেন, আরে থাম! থাম! করছ কি? কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের বললেন, তোমরা তাকে বাধা দিয়ো না বরং পেশাব করতে দাও। ফলে তারা তাকে ছেড়ে দিল। তার পেশাব করা শেষ হ’লে কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘এসব মসজিদ পেশাব (পায়খানা) ও ময়লা ফেলার স্থান নয়; এগুলো কেবলই আল্লাহর যিকির, ছালাত আদায় এবং কুরআন তেলাওয়াতের জন্য অথবা এমন কিছু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন। তারপর তিনি উপস্থিত একজনকে এক বালতি পানি আনতে বলেন এবং তা ঐ পেশাবের স্থানে ঢেলে দেন’।[11] এখানে ভুলের প্রতিবিধানে নবী করীম (ছাঃ) অনুসৃত নীতি ছিল নম্রতা অবলম্বন ও কঠোরতা পরিহার।
ছহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে,
أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَالَ فِى الْمَسْجِدِ، فَثَارَ إِلَيْهِ النَّاسُ لِيَقَعُوْا بِهِ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَعُوهُ، وَأَهْرِيقُوا عَلَى بَوْلِهِ ذَنُوبًا مِنْ مَاءٍ أَوْ سَجْلاً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوْا مُعَسِّرِيْنَ-
‘জনৈক বদ্দু মসজিদে পেশাব করে দেয়, তখন লোকেরা তার
উপর হামলা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের বললেন, ওকে
তোমরা ছেড়ে দাও এবং ওর পেশাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কেননা তোমরা
প্রেরিত হয়েছ নম্র আচরণ করতে, কঠোর আচরণের জন্য তোমাদের প্রেরণ করা হয়নি’।[12]
ছাহাবীগণ
তাদের মসজিদ পবিত্র রাখার ইচ্ছায় অন্যায় কাজের বাধা দানে খুবই তৎপর হয়ে
উঠেছিলেন। এতদসংক্রান্ত হাদীছের ভাষার শব্দগুলো তার সাক্ষী। যেমন فَصَاحَ
بِهِ النَّاسُ ‘লোকেরা তার প্রতি চিৎকার করে উঠল’ فَثَارَ إِلَيْهِ
النَّاسُ ‘লোকেরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল’ فَزَجَرَهُ النَّاسُ ‘লোকেরা তাকে
গালমন্দ করতে লাগল’ فَأَسْرَعَ إِلَيْهِ النَّاسُ ‘লোকেরা তার দিকে ধেয়ে
গেল’। এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ বললেন, مَهْ مَهْ ‘থাম!
থাম!![13]
কিন্তু নবী করীম (ছাঃ)-এর নযরে ছিল কাজের শেষ পরিণতি। এখানে দু’টো সম্ভাবনার মধ্যে বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছিল। (ক) হয় লোকটাকে বাধা দেওয়া হবে (খ) নয় ছাড় দেওয়া হবে। যদি বাধা দেওয়া হয় তাহ’লে হয় তাৎক্ষণিক তার পেশাব বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে লোকটি কষ্ট পাবে। নয় তার পেশাব বন্ধ হবে না, কিন্তু উপস্থিত জনতার ভয়ে সে ছুটোছুটি করবে; ফলে মসজিদের নানাস্থানে নাপাকী ছড়িয়ে পড়বে। অথবা লোকটার শরীর ও কাপড় পেশাবে একাকার হয়ে যাবে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন লোকটাকে পেশাব করতে দেওয়ার মধ্যে তুলনামূলক কম ক্ষতি এবং কম অনিষ্ট। লোকটা যে খারাপ কাজ শুরু করেছে এবং মসজিদ অপবিত্র করে ফেলছে পবিত্র করার মাধ্যমে তার প্রতিবিধান করা সম্ভব। এজন্যই তিনি তাঁর ছাহাবীদের বলছিলেন, তাকে তোমরা ছেড়ে দাও। তাকে বাধা দিও না। তিনি আসলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত যুক্তির ভিত্তিতে তাদেরকে থামতে হুকুম দিয়েছিলেন। তা হ’ল দু’টি অনিষ্টের গুরুটাকে পরিহার করে লঘুটা গ্রহণ এবং দু’টি সুবিধার বড়টাকে গ্রহণ করে ছোটটা পরিহার।
এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) লোকটাকে এমন কাজ করার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তা জিজ্ঞেস করেছিলেন। ত্বাবারাণী আল-কাবীর গ্রন্থে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعْرَابِيٌّ فَبَايَعَهُ فِي الْمَسْجِدِ، ثُمَّ انْصَرَفَ فَقَامَ فَفَحَّجَ، ثُمَّ بَالَ فَهَمَّ النَّاسُ بِهِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تَقْطَعُوا عَلَى الرَّجُلِ بَوْلَهُ ثُمَّ قَالَ : أَلَسْتَ بِمُسْلِمٍ؟ قَالَ : بَلَى، قَالَ : مَا حَمَلَكَ عَلَى أَنْ بُلْتَ فِي مَسْجِدِنَا؟ قَالَ : وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ مَا ظَنَنْتُهُ إِلاَّ صَعِيدًا مِنَ الصُّعُدَاتِ، فَبُلْتُ فِيهِ، فَأَمَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِذَنُوبٍ منْ مَاءٍ فَصُبَّ عَلَى بَوْلِهِ-
‘জনৈক
বদ্দু নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এল। তিনি মসজিদের মধ্যে তাকে বায়‘আত করলেন।
তারপর লোকটা একটু দূরে সরে গেল এবং দু’ ঠ্যাং ছড়িয়ে গোড়ালির উপর ভর দিয়ে
বসে পেশাব করে দিল। লোকেরা তার উপর তেড়ে এল। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন,
তোমরা লোকটার পেশাব করায় বাধা দিয়ো না। পেশাব ফেরা হয়ে গেলে লোকটাকে তিনি
বললেন, তুমি কি মুসলিম নও? সে বলল, কেন নয়? (অবশ্যই)। তিনি বললেন, তাহ’লে
কেন আমাদের মসজিদে পেশাব করে দিলে? সে বলল, যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ
করেছেন তাঁর শপথ! আমি একে আর পাঁচটা ভূমির মত সাধারণ ভূমি মনে করে পেশাব
করেছি। তখন নবী করীম (ছাঃ) এক বালতি পানি আনতে হুকুম দিলেন এবং তার পেশাবের
উপর ঢেলে দিলেন’।[14]
সংশোধনের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিজ্ঞোচিত পদক্ষেপ ঐ বদ্দুর মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ইবনু মাজাহর একটি বর্ণনা থেকে তা বুঝা যায়।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
دَخَلَ أَعْرَابِىٌّ الْمَسْجِدَ وَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم جَالِسٌ فَقَالَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِى وَلِمُحَمَّدٍ وَلاَ تَغْفِرْ لأَحَدٍ مَعَنَا. فَضَحِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَقَالَ لَقَدِ احْتَظَرْتَ وَاسِعًا. ثُمَّ وَلَّى حَتَّى إِذَا كَانَ فِى نَاحِيَةِ الْمَسْجِدِ فَشَجَ يَبُولُ. فَقَالَ الأَعْرَابِىُّ بَعْدَ أَنْ فَقِهَ فَقَامَ إِلَىَّ بِأَبِى وَأُمِّى. فَلَمْ يُؤَنِّبْ وَلَمْ يَسُبَّ. فَقَالَ : إِنَّ هَذَا الْمَسْجِدَ لاَ يُبَالُ فِيهِ وَإِنَّمَا بُنِىَ لِذِكْرِ اللَّهِ وَلِلصَّلاَةِ. ثُمَّ أَمَرَ بِسَجْلٍ مِنَ مَاءٍ فَأُفْرِغَ عَلَى بَوْلِهِ-
‘এক বদ্দু মসজিদে এসে ঢুকল। নবী করীম
(ছাঃ) তখন মসজিদে বসা ছিলেন। সে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ও মুহাম্মাদকে
ক্ষমা কর। আমাদের সাথে আর কাউকে ক্ষমা কর না। তার কথায় নবী করীম (ছাঃ) হেসে
ফেললেন এবং বললেন, তুমি একটি ব্যাপক বিষয়কে সংকীর্ণ করে দিলে। কিছুক্ষণ পর
লোকটা ফিরে চলল, যখন সে মসজিদের এক কোণায় গিয়ে পৌঁছল তখন দু’পা ফাঁক করে
পেশাব করতে বসল। বিষয়টি যে ভুল হয়েছে তা জানার পর বদ্দু তার প্রতিক্রিয়া
প্রকাশ করে বলল, আমার পিতা-মাতা রাসূলের জন্য উৎসর্গ হোক, তিনি এজন্য না
আমাকে তিরস্কার করলেন, না গালাগালি করলেন। শুধু এতটুকু বললেন যে, মসজিদ তো
কেবল বানানো হয়েছে আল্লাহর যিকির এবং ছালাত আদায়ের জন্য। এখানে পেশাব করার
কোন সুযোগ নেই। তারপর তিনি এক বালতি পানি আনতে হুকুম দিলেন এবং তার পেশাবের
উপর ঢেলে দিলেন’।[15]
বদ্দুর এই হাদীছটির ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার বেশ কয়টি উপকারী দিক তুলে ধরেছেন। যথা-
(ক) অজ্ঞ লোকের সঙ্গে নম্র-ভদ্র আচরণ করতে হবে, কোন রাগ না করে তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কেননা সে তো গোঁয়ার্তুমি করে এসব করেনি। বিশেষ করে যদি সে এমন শ্রেণীর হয় যার মনস্ত্তষ্টি বিধান করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
(খ) এ হাদীছে নবী করীম (ছাঃ)-এর স্নেহশীলতা এবং সদাচারের পরিচয় মেলে।
(গ) নাপাক জিনিস থেকে পবিত্র থাকার মানসিকতা ছাহাবীদের অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল। ফলে নবী করীম (ছাঃ)-এর উপস্থিতিতে তাঁর অনুমতি না নিয়েই তারা নিষেধ করতে দ্রুত এগিয়ে এসেছিলেন। একই সাথে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধও তাদের মনে ভালমত জায়গা করে নিয়েছিল।
(ঘ) পেশাবের বাধা দূর হওয়ার পর
ছাহাবীগণ পেশাবের মত অপবিত্রতা দূর করতে দ্রুত এগিয়ে এসেছিলেন। তারা আদেশ
পাওয়া মাত্রই পানি ঢেলে তা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন।[16]
[চলবে]
[1]. মুসলিম হা/৯৭।
[2]. মুসলিম হা/৯৬।
[3]. ছহীহ মুসলিম হা/১৬৫৯।
[4]. তিরমিযী হা/১৯৪৮, সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী হা/১১৯৯, সনদ হাসান।
[6]. বুখারী ফাৎহুল বারী হা/১৯৩৬; মিশকাত হা/২০০৪।
[7]. আহমাদ হা/১০৬৯৯, সনদ হাসান।
[8]. বুখারী হা/৫০৪১।
[9]. ছহীহ তিরমিযী ৩/১৬ দ্রষ্টব্য।
[10]. নাসাঈ হা/৫৪০৯, সনদ ছহীহ।
[11]. মুসলিম হা/২৮৫; মিশকাত হা/৪৯২।
[12]. বুখারী হা/২২০, ৬১২৮; ফাৎহুল বারী হা/৬১২৮।
[13]. জামেউল উছূল ৭/৮৩-৮৭।
[14]. ত্বাবারানী আল-কাবীর হা/১১৫৫২, ১১/২২০। হায়ছামী মাজমাউয যাওয়য়েদ গ্রন্থে বলেছেন, এটির বর্ণনাকারীগণ ছহীহের বর্ণনাকারীদের অন্তর্গত ২/১০; (মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/২৫৫৭, সনদ জাইয়িদ।
[15]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/৪২৮।
[16]. ফাৎহুল বারী ১/২২৪-২২৫।