পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। শেষ পর্ব

৫. ভুল সংশোধনে প্রবৃত্ত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান মূল্যায়ন (اعتبار موقع الشخص الذي يقوم بتصحيح الخطأ) :

সমাজে কিছু লোকের কথা মান্য করা হ’লেও ঐ কথাই অন্যেরা বললে মান্য করা হয় না। কেননা তাদের এমন একটা অবস্থান রয়েছে, যা অন্যদের নেই। অথবা ভুলকারীর উপর তাদের এমন ক্ষমতা রয়েছে, যা অন্যদের হাতে নেই। যেমন পুত্রের উপর পিতার, শিক্ষার্থীর উপর শিক্ষকের এবং সরকারীভাবে পরিদর্শক হিসাবে নিয়োজিত ব্যক্তির অন্যায় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিষেধ করার ক্ষমতা। সুতরাং বয়সে যে বড় তার ভূমিকা সমবয়সী ও ছোটদের মত নয়; আত্মীয়-স্বজনের ভূমিকা অনাত্মীয়ের মত নয় এবং শাসন ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির ভূমিকা ক্ষমতাহীন ব্যক্তির মত নয়।

শ্রেণীগত এ পার্থক্য জানা থাকলে একজন সংশোধনকারীর পক্ষে যথার্থভাবে সংশোধনের কাজ আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে। সে সবকিছু বুঝে-শুনে যথাযথভাবে করতে পারবে। ফলে তার নিষেধ বা সংশোধনের উল্টো ফল হিসাবে বড় কোন অঘটন বা অন্যায়ের সূত্রপাত হবে না। নিষেধকারীর পদমর্যাদা ও প্রতিপত্তি অপরাধীর মনে নিষেধের মাত্রা এবং কঠোরতা ও নম্রতার মাপকাঠি নির্ণয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখান থেকে আমরা দু’টি সূত্র পেতে পারি।

এক. আল্লাহ যাকে শাসন ক্ষমতা দিয়েছেন সে যেন তা সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, নীতি-নৈতিকতা বা চরিত্র শিক্ষাদানে নিয়োজিত রাখে এবং তার দায়িত্বকে অনেক বড় মনে করে। কেননা জনগণ অন্যদের তুলনায় তার কথা বেশী মাত্রায় গ্রহণ করে এবং সে যা পারে অন্যরা তা পারে না।

দুই. আদেশকর্তা ও নিষেধকর্তা যেন নিজের ওযন ভুলে না যায়। তাহ’লে সে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাবে যার যোগ্য সে নয়। এমতাবস্থায় তার অধিকারহীন ক্ষমতা প্রয়োগে হিতে বিপরীত হবে এবং উল্টো তাকেই ঝামেলা ও বাধার সম্মুখীন হ’তে হবে।

নবী করীম (ছাঃ)-কে মহান আল্লাহ মানুষের উপর যে মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়েছিলেন, তা তিনি আদেশ-নিষেধ ও শিক্ষাদানে যথারীতি ব্যবহার করতেন। তিনি অনেক সময় এমন আচরণও করতেন, যা তিনি ব্যতীত অন্য কেউ করলে তা মোটেও শোভনীয় হ’ত না। দু’একটি উদাহরণ দেওয়া যাক-

ইয়াঈশ ইবনু তিহফা আল-গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

* সঊদী আরবের প্রখ্যাত আলেম ও দাঈ।

** সিনিয়র শিক্ষক, হরিণাকুন্ড সরকারী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহ।

ضِفْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيمَنْ تَضَيَّفَهُ مِنَ الْمَسَاكِينِ فَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى اللَّيْلِ يَتَعَاهَدُ ضَيْفَهُ فَرَآنِى مُنْبَطِحاً عَلَى بَطْنِى فَرَكَضَنِى بِرِجْلِهِ وَقَالَ لاَ تَضْطَجِعْ هَذِهِ الضِّجْعَةَ فَإِنَّهَا ضِجْعَةٌ يَبْغَضُهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ- وفي رواية: فَرَكَضَهُ بِرِجْلِهِ فَأَيْقَظَهُ وَقَالَ هَذِهِ ضِجْعَةُ أَهْلِ النَّارِ-

‘একবার আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর মেহমানখানায় অন্যান্য অভাবী মিসকীনদের সাথে মেহমান হয়েছিলাম। রাতে তিনি তাঁর মেহমানদের খোঁজ-খবর নিতে এসেছিলেন। তিনি আমাকে উপুড় হয়ে ঘুমাতে দেখে তাঁর পা দিয়ে আমাকে ঠেলা মারেন এবং বলেন, এমন করে ঘুমিও না। এভাবে ঘুমানো আল্লাহর নিকট অপসন্দনীয়। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি তাকে পা দিয়ে ধাক্কা দেন এবং জাগিয়ে তোলেন। তারপর বলেন, এটা জাহান্নামীদের শোয়া’।[1]

এভাবে পায়ে ঠেলে নিষেধ করা নবী করীম (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রে মানানসই হ’লেও অন্য কোন মানুষের জন্যে তা মানানসই হবে না। অন্য কোন ব্যক্তি কাউকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে এমন আশা করতে পারে না যে, সে তাকে পায়ে ঠেলে জাগিয়ে তুলবে এবং লোকটা তা মেনে নিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।

অনুরূপ আরেকটি কাজ হচ্ছে- ভুলে পতিত ব্যক্তিকে মারধর করা কিংবা তার দিকে কংকর জাতীয় কিছু ছুঁড়ে মারা। কিছু কিছু পূর্বসূরী ব্যক্তিত্ব এমনটা করেছেন। আসলে এসবই নির্ভর করে ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ও প্রতিপত্তির উপর। নিম্নে এমন কিছু ঘটনা তুলে ধরা হ’ল।

দারেমী সুলায়মান ইবনু ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন,

أَنَّ رَجُلاً يُقَالُ لَهُ صَبِيْغٌ قَدِمَ الْمَدِينَةَ، فَجَعَلَ يَسْأَلُ عَنْ مُتَشَابِهِ الْقُرْآنِ، فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ عُمَرُ وَقَدْ أَعَدَّ لَهُ عَرَاجِيْنَ النَّخْلِ، فَقَالَ : مَنْ أَنْتَ؟ قَالَ : أَنَا عَبْدُ اللهِ صَبِيغٌ- فَأَخَذَ عُمَرُ عُرْجُوناً مِنْ تِلْكَ الْعَرَاجِيْنِ فَضَرَبَهُ وَقَالَ : أَنَا عَبْدُ اللهِ عُمَرُ فَجَعَلَ لَهُ ضَرْباً حَتَّى دَمِىَ رَأْسُهُ، فَقَالَ : يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِيْنَ حَسْبُكَ قَدْ ذَهَبَ الَّذِى كُنْتُ أَجِدُ فِى رَأْسِى-

‘ছাবীগ নামক এক ব্যক্তি মদীনায় এসে কুরআনের মুতাশাবেহ বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে থাকে। খবর পেয়ে ওমর (রাঃ) তাকে ডেকে পাঠান। এদিকে তার জন্য তিনি কিছু খেজুর ডাল (পাতা ছড়ান লাঠি আকারের ডাল) যোগাড় করে রাখলেন। সে এলে তিনি বললেন, তুমি কে? সে বলল, আমি আল্লাহর বান্দা ছাবীগ। ওমর তখন একটা খেজুর ডাল তুলে নিয়ে বললেন, আমি আল্লাহর বান্দা ওমর। তারপর তিনি খেজুর ডাল দিয়ে পিটিয়ে তার দেহ রক্তাক্ত করে দিলেন। সে তখন বলতে লাগল, আমীরুল মুমিনীন! যথেষ্ট হয়েছে আমাকে আর মারবেন না, আমার মাথায় যে ভূত চেপেছিল তা চলে গেছে’।[2]

ইমাম বুখারী (রহঃ) ইবনু আবী লায়লার বরাতে উলেলখ করেছেন,

كَانَ حُذَيْفَةُ بِالْمَدَايِنِ فَاسْتَسْقَى، فَأَتَاهُ دِهْقَانٌ بِقَدَحِ فِضَّةٍ، فَرَمَاهُ بِهِ فَقَالَ إِنِّى لَمْ أَرْمِهِ إِلاَّ أَنِّى نَهَيْتُهُ فَلَمْ يَنْتَهِ، وَإِنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم نَهَانَا عَنِ الْحَرِيرِ وَالدِّيبَاجِ وَالشُّرْبِ فِى آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَقَالَ هُنَّ لَهُمْ فِى الدُّنْيَا وَهْىَ لَكُمْ فِى الآخِرَةِ-

‘হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) তখন মাদায়েনের শাসক। তিনি পানি পান করতে চাইলে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি রূপার পাত্রে তাঁকে পানি এনে দিল। তিনি তা তার মুখে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, আমি এমনি এমনি তাকে ছুঁড়ে মারিনি। এর আগেও আমি তাকে নিষেধ করেছি, কিন্তু সে নিষেধ মানেনি। অথচ নবী করীম (ছাঃ) আমাদেরকে মসৃণ রেশম ও মোটা রেশমের কাপড় পরতে এবং সোনা ও রূপার পাত্রে পানাহার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ওগুলো দুনিয়াতে তাদের জন্য এবং পরকালে তোমাদের জন্য’।[3]

ইমাম আহমাদের বর্ণনায় এসেছে আব্দুর রহমান ইবনু আবী লায়লা বলেন,

خَرَجْتُ مَعَ حُذَيْفَةَ إِلَى بَعْضِ هَذَا السَّوَادِ فَاسْتَسْقَى فَأَتَاهُ دِهْقَانٌ بِإِنَاءٍ مِنْ فِضَّةٍ قَالَ فَرَمَاهُ بِهِ فِى وَجْهِهِ قَالَ قُلْنَا اسْكُتُوا اسْكُتُوا وَإِنَّا إِنْ سَأَلْنَاهُ لَمْ يُحَدِّثْنَا، قَالَ فَسَكَتْنَا قَالَ  فَلَمَّا كَانَ بَعْدَ ذَلِكَ قَالَ أَتَدْرُونَ لِمَ رَمَيْتُ بِهِ فِى وَجْهِهِ قَالَ قُلْنَا لاَ. قَالَ إِنِّى كُنْتُ نَهَيْتُهُ. قَالَ فَذَكَرَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَشْرَبُوا فِى آنِيَةِ الذَّهَبِ قَالَ مُعَاذٌ لاَ تَشْرَبُوا فِى الذَّهَبِ وَلاَ فِى الفِضَّةِ وَلاَ تَلْبَسُوا الْحَرِيرَ وَلاَ الدِّيبَاجَ فَإِنَّهُمَا لَهُمْ فِى الدُّنْيَا وَلَكُمْ فِى الآخِرَةِ-

‘আমি হুযায়ফা (রাঃ)-এর সঙ্গে (মাদায়েনের) এক শহরতলী এলাকায় গিয়েছিলাম। তিনি পানি চাইলে জনৈক নেতা রূপার পাত্রে পানি নিয়ে আসে। তিনি পাত্রটা হাতে নিয়ে তার মুখে ছুঁড়ে মারেন। তখন আমরা বলতে লাগলাম, চুপ করো! চুপ করো!! আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলে (হয়তো) তিনি কিছুই বলবেন না। আমরা চুপ করলে তিনি বললেন, ‘তোমরা কি জান, কেন আমি ওটা তার মুখে ছুঁড়ে মারলাম? আমরা বললাম, ‘না’। তিনি বললেন, এর আগে আমি তাকে এমন করতে নিষেধ করেছিলাম। (তারপরও সে আমার নিষেধ শোনেনি)। অতঃপর তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রসঙ্গ তুলে বললেন যে, তিনি বলেছেন, তোমরা সোনার পাত্রে পান করো না। (মুযাদের বর্ণনায় এসেছে) তোমরা সোনা ও রূপার পাত্রে পান কর না। মিহি রেশম ও মোটা রেশমের কাপড় পর না। কেননা এ দু’টো তাদের জন্য দুনিয়াতে এবং তোমাদের জন্য আখিরাতে বরাদ্দ রয়েছে’।[4]

ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন,

أَنَّ سِيْرِيْنَ سَأَلَ أَنَسًا الْمُكَاتَبَةَ وَكَانَ كَثِيْرَ الْمَالِ فَأَبَى، فَانْطَلَقَ إِلَى عُمَرَ رضى الله عنه فَقَالَ كَاتِبْهُ فَأَبَى فَضَرَبَهُ بِالدِّرَّةِ وَيَتْلُو عُمَرُ (فَكَاتِبُوهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ فِيْهِمْ خَيْرًا) فَكَاتَبَهُ-

‘(সিরীন ছিলেন আনাস (রাঃ)-এর দাস)। মুক্তি লাভের জন্য তিনি তার সঙ্গে মুকাতাবা (অর্থ দানের বিনিময়ে মালিকের নিকট থেকে মুক্তি লাভের) চুক্তি করতে চান। এদিকে আনাস (রাঃ) সে সময় বেশ সম্পদশালী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি মুকাতাবা চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকট চলে যান। তিনি তাকে বলেন, ওর সঙ্গে তুমি মুকাতাবা কর। এবারও তিনি অস্বীকৃতি জানান। তখন ওমর (রাঃ) তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন এবং কুরআন থেকে পড়লেন, ‘তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর, যদি তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ আছে বলে তোমরা জানতে পার’। এ আয়াত শোনার পর আনাস (রাঃ) তার সঙ্গে মুকাতাবা চুক্তিতে আবদ্ধ হ’লেন’।[5]

ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করেছেন, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,

أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّى فَإِذَا بِابْنٍ لِمَرْوَانَ يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْهِ فَدَرَأَهُ فَلَمْ يَرْجِعْ فَضَرَبَهُ فَخَرَجَ الْغُلاَمُ يَبْكِى حَتَّى أَتَى مَرْوَانَ فَأَخْبَرَهُ فَقَالَ مَرْوَانُ لأَبِى سَعِيدٍ لِمَ ضَرَبْتَ ابْنَ أَخِيكَ قَالَ مَا ضَرَبْتُهُ إِنَّمَا ضَرَبْتُ الشَّيْطَانَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ فِى صَلاَةٍ فَأَرَادَ إِنْسَانٌ يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْهِ فَيَدْرَؤُهُ مَا اسْتَطَاعَ فَإِنْ أَبَى فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّهُ شَيْطَانٌ-

‘একদা তিনি ছালাত আদায় করছিলেন, এমন সময় খলীফা মারওয়ানের এক ছেলে তার সামনে দিয়ে যেতে থাকে। তিনি তাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে ফিরে না গিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। তখন আবু সাঈদ (রাঃ) তাকে মার লাগান। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে সোজা মারওয়ানের কাছে গিয়ে অভিযোগ করল। মারওয়ান তখন আবু সাঈদকে বললেন, আপনার ভাতিজাকে মারলেন কেন? তিনি বললেন, আমি তো তাকে মারিনি, আমি মেরেছি শয়তানকে। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যখন তোমাদের কেউ ছালাতে রত থাকে এবং এমন সময় কোন মানুষ তার সামনে দিয়ে যায়, তখন সে যেন তাকে যথাসাধ্য সরিয়ে দেয়। কিন্তু যদি সে না মানে তাহ’লে যেন তার সঙ্গে লড়াই করে। কেননা সে একটা শয়তান’।[6]

ইমাম আহমাদ আবুন নযর থেকে বর্ণনা করেছেন,

أَنَّ أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِىَّ كَانَ يَشْتَكِى رِجْلَهُ فَدَخَلَ عَلَيْهِ أَخُوهُ وَقَدْ جَعَلَ إِحْدَى رِجْلَيْهِ عَلَى الأُخْرَى وَهُو مُضْطَجِعٌ فَضَرَبَهُ بِيَدِهِ عَلَى رِجْلِهِ الوَجِعَةِ فَأَوْجَعَهُ فَقَالَ أَوْجَعْتَنِى أَوَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ رِجْلِى وَجِعَةٌ قَالَ بَلَى. قَالَ فَمَا حَمَلَكَ عَلَى ذَلِكَ قَالَ أَوَلَمْ تَسْمَعْ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَدْ نَهَى عَنْ هَذِهِ-

‘একবার আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর পায়ে অসুখ হয়। তিনি তখন এক পায়ের পর অন্য পা তুলে শুয়েছিলেন। এমন সময় তার ভাই সেখানে আসেন। তিনি তাকে ঐ অবস্থায় দেখে ব্যথাযুক্ত পায়ে মুষ্ঠাঘাত করেন। ফলে তিনি ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন এবং বলেন, তুমি আমাকে ব্যথা দিলে? তুমি কি জান না যে, আমার পায়ে ব্যথা? তিনি বললেন, হ্যাঁ জানি। আবু সাঈদ (রাঃ) বললেন, তাহ’লে কেন তুমি একাজ করলে? তিনি বললেন, তুমি কি শোননি, নবী করীম (ছাঃ) এভাবে পায়ের উপর পা তুলে শুতে নিষেধ করেছেন’?[7]

ইমাম মালেক আবু যুবায়ের আল-মাক্কীর বরাতে বর্ণনা করেছেন,أَنَّ رَجُلًا خَطَبَ إِلَى رَجُلٍ أُخْتَهُ فَذَكَرَ أَنَّهَا قَدْ كَانَتْ أَحْدَثَتْ فَبَلَغَ ذَلِكَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ فَضَرَبَهُ أَوْ كَادَ يَضْرِبُهُ ثُمَّ قَالَ مَا لَكَ وَلِلْخَبَرِ ‘এক লোক অন্য এক লোকের বোনকে বিয়ে করার জন্য ঐ লোকের কাছে প্রস্তাব দিল। তখন সে তার বোন ব্যভিচার করেছে বলে তাকে জানাল। একথা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের কানে পৌঁছলে তিনি তাকে ধরে মার দেন অথবা মারার উপক্রম করেন। তিনি তাকে বলেন, তোমার এ খবর দেওয়ার কি দরকার ছিল’?[8]

ইমাম মুসলিম তাঁর ছহীহ গ্রন্থে আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আসওয়াদ ইবনু ইয়াযীদের সঙ্গে মসজিদে আ‘যম বা বড় মসজিদে বসে ছিলাম। আমাদের সাথে শা‘বী ছিল। শা‘বী তখন ফাতিমা বিনতে কায়সের হাদীছ বর্ণনা করল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (তালাকের জন্য) তার নামে বাসস্থান ও খোরপোশ (ভরণ-পোষণ) এর কোন বিধান দেননি। একথা শুনে আসওয়াদ এক মুঠি কঙ্কর তুলে নিয়ে তার মুখে ছুঁড়ে মারল এবং বলল, তুমি ধ্বংস হও! তুমি এমন হাদীছ বর্ণনা করছ? অথচ ওমর (রাঃ) তার সম্পর্কে বলেছেন, আমরা একজন মহিলার কথায় আল্লাহর কিতাব এবং আমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করতে পারি না। আমরা জানি না যে, সে বিষয়টা মনে রেখেছে না-কি ভুলে গেছে? এ ধরনের মহিলা বাসস্থান ও খোরপোশ উভয়ই পাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,لاَ تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلاَ يَخْرُجْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ- ‘তোমরা তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে দিও না এবং তারাও যেন বের হয়ে না যায়, তবে তারা কেউ সুস্পষ্ট অশ্লীল কাজ করে বসলে ভিন্ন ব্যবস্থা হবে’ (তালাক্ব ৬৫/১)।[9]

আবুদাঊদ বর্ণনা করেছেন,

دَخَلَ رَجُلاَنِ مِنْ أَبْوَابِ كِنْدَةَ وَأَبُو مَسْعُودٍ الأَنْصَارِىُّ جَالِسٌ فِى حَلْقَةٍ فَقَالاَ أَلاَ رَجُلٌ يُنَفِّذُ بَيْنَنَا فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْحَلْقَةِ أَنَا. فَأَخَذَ أَبُو مَسْعُودٍ كَفًّا مِنْ حَصًى فَرَمَاهُ بِهِ وَقَالَ مَهْ إِنَّهُ كَانَ يُكْرَهُ التَّسَرُّعُ إِلَى الْحُكْمِ

‘দু’জন লোক কিন্দার ফটক দিয়ে ঢুকল। সেখানে এক মজলিসে ছাহাবী আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বসা ছিলেন। তারা দু’জনেই বলল, এখানে এমন কেউ কি আছে যে আমাদের মাঝে সমাধান করে দিবে? মজলিসের মধ্যস্থিত এক ব্যক্তি বলে উঠল, আমি আছি। আবু মাসঊদ (রাঃ) তখন এক মুষ্ঠি কঙ্কর নিয়ে তাকে ছুঁড়ে মারলেন ও বললেন, থাম, বিচার-ফায়ছালায় দ্রুত সাড়া দেওয়া একটি অপসন্দনীয় কাজ’।[10]

আমরা এও লক্ষ্য করি যে, নবী করীম (ছাঃ) তাঁর কিছু বিশেষ ছাহাবীর উপর সময় বিশেষে এতটা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন যা উদাহরণ স্বরূপ কোন বেদুঈন কিংবা বহিরাগত পরদেশী কেউ একই ঘটনা ঘটিয়ে থাকলে করেননি। এসব কিছুই ছিল তাঁর হিকমত অবলম্বন এবং নিষেধ করার ক্ষেত্রে অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখার উদাহরণ।

জেনে-বুঝে ভুলকারী ও না জেনে-বুঝে ভুলকারীর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ(التفريق بين المخطئ الجاهل والمخطئ عن علم) :

উল্লেখিত বিষয়ে মু‘আবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী (রাঃ)-এর ঘটনা স্পষ্ট বার্তা বহনকারী। তিনি তখন থাকতেন মদীনা থেকে দূরে মরু এলাকায়। ছালাতে কথা বলা নিষেধ হয়ে গেছে তিনি তা জানতেন না। মরুগ্রাম থেকে মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করার সময় তিনি কথা বলেছিলেন। তিনি নিজেই বলছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে ছালাতে রত ছিলাম, এমন সময় একজন হাঁচি দিলে আমি বলে উঠলাম يَرْحَمُكَ اللهُ ‘আল্লাহ তোমার উপর দয়া করুন’। তখন জামাতস্থ লোকেরা আমার দিকে তাকাতে লাগল। আমি বললাম, আমার মা সন্তান হারা হোক! (অর্থাৎ আমার মরণ হোক!) তোমাদের কী হ’ল? তোমরা আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? তখন তারা তাদের হাত দিয়ে তাদের উরুতে আঘাত করতে লাগল। যখন আমি দেখলাম, তারা আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করছে তখন আমি তাদের কথার জবাব দিতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। আমার মাতা-পিতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য কুরবান হোক; আমি এর আগে ও পরে কোন শিক্ষককেই তাঁর থেকে সুন্দর করে শিক্ষা দিতে দেখিনি। আল্লাহর কসম, তিনি ছালাত শেষ করে না আমাকে ধমক দিলেন, না মারলেন, না গালমন্দ করলেন। তিনি শুধু বললেন, এই ছালাত এমনই যে, এতে মানুষের কথাবার্তার কোন সুযোগ নেই। এ কেবলই তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়।[11]

সুতরাং অজ্ঞের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, সন্দেহবাদীর জন্য প্রয়োজন বর্ণনা ও ব্যাখ্যা, উদাসীনের জন্য প্রয়োজন উপদেশ এবং একগুঁয়ের জন্য প্রয়োজন ওয়ায-নছীহত। সুতরাং বিধান সম্পর্কে অবগত ও অনবগত লোকদের একইভাবে নিষেধ বা বাধাদান সমীচীন নয়। বরং অনবগত অজ্ঞ মূর্খের উপর কঠোরতা দেখালে অনেক সময় তা হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনবে, এমনকি সে আনুগত্য পরিহারও করতে পারে। অথচ প্রথমে তাকে নরম মেযাজে কৌশলের সাথে বুঝালে ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং শুধরাতে পারবে। কারণ জাহিল অজ্ঞরা নিজেদের ভুলের উপর আছে বলে মনে করে না। তাই কেউ তাকে অন্যায় থেকে নিষেধ করলে তৎক্ষণাৎ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে- না শিখিয়ে না জানিয়ে তুমি আমার উপর হঠাৎ চড়াও হচ্ছ কেন? অনেক সময় ভুলকারী সঠিক নিয়মের পাশেই অবস্থান করে। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারে না। বরং নিজেকে সঠিক ভেবে সেটাই ধরে রাখতে চায়।

মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ) থেকে উল্লেখ আছে। তিনি বলেন,

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكَلَ طَعَاماً ثُمَّ أُقِيمَتِ الصَّلاَةُ فَقَامَ وَقَدْ كَانَ تَوَضَّأَ قَبْلَ ذَلِكَ فَأَتَيْتُهُ بِمَاءٍ لِيَتَوَضَّأَ مِنْهُ فَانْتَهَرَنِى وَقَالَ وَرَاءَكَ. فَسَاءَنِى وَاللهِ ذَلِكَ ثُمَّ صَلَّى فَشَكَوْتُ ذَلِكَ إِلَى عُمَرَ فَقَالَ يَا نَبِىَّ اللهِ إِنَّ الْمُغِيرَةَ قَدْ شَقَّ عَلَيْهِ انْتِهَارُكَ إِيَّاهُ وَخَشِىَ أَنْ يَكُونَ فِى نَفْسِكَ عَلَيْهِ شَىْءٌ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لَيْسَ عَلَيْهِ فِى نَفْسِى شَىْءٌ إِلاَّ خَيْرٌ وَلَكِنْ أَتَانِى بِمَاءٍ لأَتَوَضَّأَ وَإِنَّمَا أَكَلْتُ طَعَاماً وَلَوْ فَعَلْتُ فَعَلَ ذَلِكَ النَّاسُ بَعْدِى-

‘একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খাওয়া-দাওয়া সেরেছেন, এমন সময় ছালাতের আযান হল। তিনি ছালাতের জন্য উঠে দাঁড়ালেন, এর আগে অবশ্য তিনি ওযূ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ওযূ করবেন ভেবে আমি তাঁর নিকট পানির পাত্র নিয়ে এলাম। কিন্তু তিনি আমাকে তিরষ্কার করে বললেন, পিছিয়ে যাও। আল্লাহর কসম, তাঁর এ আচরণে আমি মর্মাহত হই। তাঁর ছালাত শেষ হ’লে আমি ওমরের নিকট আমার অনুযোগের কথা বললাম। তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! আপনার তিরষ্কার মুগীরার মনে খুব দাগ কেটেছে, সে ভয় পাচ্ছে যে, তার জন্যে আপনার মনে কোন কষ্ট লেগেছে কি-না। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমার মনে তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া কোন মন্দ ধারণা নেই। আমি যাতে ওযূ করি সেজন্য আমার নিকট সে পানি নিয়ে এসেছিল। আমি তো শুধু খাবার খেয়েছি। তারপরও যদি আমি ওযূ করতাম তাহ’লে আমার পরবর্তীতে লোকেরা খেয়েদেয়ে ওযূ করত’।[12]

লক্ষণীয় যে, এ ধরনের বড় মাপের পদস্থ ছাহাবীদের কোন কাজকে নবী করীম (ছাঃ) কর্তৃক ভুল আখ্যায়িত করা তাদের মনে কোন নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির জন্য ছিল না। তারা অসন্তুষ্ট হবেন কিংবা তাঁর সাহচর্য ছেড়ে দিবেন-বিষয়টা সেজন্যও ছিল না। বরং এতে তাদের মনে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই তিনি তিরষ্কার করেছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) কর্তৃক তাঁদের কোন কাজ ভুল আখ্যা দেওয়া বা তিরস্কারের পর তাতে যে কেউ ভীত-চকিত হয়ে পড়বে, নিজেকে নিজে দোষারোপ করবে যে এমনটা কেন করতে গেলে এবং যতক্ষণ না নবী করীম (ছাঃ) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে তিনি নিশ্চিত না হচ্ছেন ততক্ষণ তাঁর মনে অস্থিরতা বিরাজ করবে।

উল্লেখিত ঘটনাই দেখুন। নবী করীম (ছাঃ) ব্যক্তি মুগীরার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে তিরষ্কার করতে যাননি, তিনি বরং সকল মানুষের উপর করুণা করার ইচ্ছায় এবং খানাপিনা করলে যে ওযূ ভাঙ্গে না তা বর্ণনা করার জন্য এমনটা করেছেন। যাতে করে যা ফরয নয় তাকে ফরয ভেবে মানুষ সঙ্কটে পতিত না হয়।

মুজতাহিদের অনিচ্ছাকৃত ভুল এবং ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা ও অপারগতাজনিত ভুলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ :

মুজতাহিদের অনিচ্ছাকৃত ভুল মোটেও দোষের নয়; বরং তিনি এজন্য একটি ছওয়াব লাভের যোগ্য- যদি তিনি আন্তরিকতার সাথে ইজতিহাদ করেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ وَاحِدٌ ‘বিচারক যখন ইজতিহাদ বা গবেষণার মাধ্যমে বিচার করে এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তখন তার দু’টি ছওয়াব হয় আর যদি ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তাহ’লেও তার একটি ছওয়াব হয়’।[13]

ইচ্ছা করে ভুলকারী কিংবা অক্ষম মুজতাহিদের বিষয়টি এ থেকে ভিন্ন। সুতরাং এই দু’জন কখনো সমান হ’তে পারে না। প্রথমজনকে ইজতিহাদের নিয়ম-কানূন শিখাতে হবে এবং তার কল্যাণ কামনা করতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয়জনকে ইচ্ছাকৃত অন্যায়ের পরিণাম সম্পর্কে উপদেশ দিতে হবে এবং এ ধরনের ইজতিহাদে তাকে বাধা দিতে হবে। ভুল ইজতিহাদে যে মুজতাহিদ ছাড় পাবেন তার বিষয়টি যেমন বৈধ ক্ষেত্রে হ’তে হবে, তেমনি মুজতাহিদকে ইজতিহাদের যোগ্যতাধারী হ’তে হবে। না জেনে-শুনে যে ফৎওয়া দেয় কিংবা অবস্থার প্রতি লক্ষ না রেখে বিধান দেয় সে কোনভাবে ছাড় পাওয়ার যোগ্য নয়। এজন্যই নবী করীম (ছাঃ) মাথা ফাটা ব্যক্তির ঘটনার ভুল বিধান দাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছিলেন। ঘটনাটি ইমাম আবুদাঊদ তার সুনান গ্রন্থে জাবির (রাঃ) থেকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন,

خَرَجْنَا فِىْ سَفَرٍ فَأَصَابَ رَجُلاً مِنَّا حَجَرٌ فَشَجَّهُ فِىْ رَأْسِهِ ثُمَّ احْتَلَمَ فَسَأَلَ أَصْحَابَهُ فَقَالَ هَلْ تَجِدُوْنَ لِىْ رُخْصَةً فِى التَّيَمُّمِ فَقَالُوْا مَا نَجِدُ لَكَ رُخْصَةً وَأَنْتَ تَقْدِرُ عَلَى الْمَاءِ فَاغْتَسَلَ فَمَاتَ فَلَمَّا قَدِمْنَا عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أُخْبِرَ بِذَلِكَ فَقَالَ : قَتَلُوهُ قَتَلَهُمُ اللهُ أَلاَّ سَأَلُوْا إِذْ لَمْ يَعْلَمُوْا فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِىِّ السُّؤَالُ-

‘আমরা এক সফরে যাত্রা করেছিলাম। পথিমধ্যে আমাদের একজন লোকের মাথায় পাথর গড়িয়ে পড়ে। ফলে তার মাথা ফেটে যায়। পরে ঘুমের মধ্যে তার স্বপ্নদোষ হয়। সে তার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি আমার জন্য তায়াম্মুমের সুযোগ আছে বলে মনে কর? তারা বলল, তুমি তো পানি ব্যবহারে সক্ষম, ফলে আমরা তোমার জন্য তায়াম্মুমের অবকাশ আছে বলে মনে করি না। ফলে লোকটি গোসল করে এবং মারা যায়। পরে আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে এলে তাঁকে ঘটনা জানানো হয়। সব শুনে তিনি বললেন, ওরা তাকে হত্যা করেছে। আল্লাহ ওদের হত্যা করুন। যখন তারা জানে না তখন কেন জাননেওয়ালাদের নিকটে জিজ্ঞেস করল না? অক্ষমের নিরাময়তা তো জিজ্ঞেস করে জানার মধ্যে..।[14]

অনুরূপভাবে নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

الْقُضَاةُ ثَلاَثَةٌ وَاحِدٌ فِى الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِى النَّارِ فَأَمَّا الَّذِى فِى الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِى الْحُكْمِ فَهُوَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِى النَّارِ-

‘বিচারক তিন প্রকার। তাদের একজন যাবে জান্নাতে এবং দু’জন যাবে জাহান্নামে। অনন্তর যে জান্নাতী সে ঐ বিচারক, যে হক চিনে এবং তদনুযায়ী বিচার করে। কিন্তু যে হক বুঝার পরও অন্যায় বিচার করে সে জাহান্নামী। আর যে ঘটনার সত্যাসত্য না বুঝে মূর্খতার সাথে বিচার করে সেও জাহান্নামী’।[15] এখানে তৃতীয় ব্যক্তিকে মা‘যূর বা ছাড়প্রাপ্ত ও ক্ষমার যোগ্য গণ্য করা হয়নি।

ভুল ও অপরাধ সংশোধনের মাত্রা নির্ণয়ে যে পরিবেশে তা সংঘটিত হয়েছে তা লক্ষ রাখাও প্রয়োজন। যেমন সেখানে সুন্নাত কিংবা বিদ‘আতের কেমন প্রসার রয়েছে, অপরাধীদের একগুঁয়েমির সীমা কতখানি; জাহেল মূর্খ মুফতীরা তা জায়েয বলে ফৎওয়া দেয় কি-না, কিংবা সবকিছুকেই যারা হাল্কাভাবে নেয় তাদের মানসিকতা দেখে অন্যায়-অপরাধের নিষেধ করতে হবে।

ভুল পন্থায় ভাল কাজ সম্পাদনকারীকে বাধা দানে নিষেধ নেই (إرادة المخطئ للخير لا تمنع من الإنكار عليه) :

আমর ইবনু ইয়াহইয়া থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে তার পিতা থেকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমার পিতাকে তার পিতা থেকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত ফজর ছালাতের আগে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এর বাড়ির গেটে বসে থাকতাম। তিনি ঘর থেকে বের হ’লে আমরা তার সাথে হেটে মসজিদে আসতাম। একবার আমাদের কাছে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) এসে বললেন, তোমাদের মাঝে কি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ এখনো আসেননি? আমরা বললাম, না। তিনিও আমাদের সাথে বসে পড়লেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বেরিয়ে এলে আমরা সবাই উঠে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন আবু মূসা তাকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান, আমি এই মাত্র মসজিদে একটা ঘটনা দেখে এসেছি, যা আমার অচেনা অজানা। তবে আল্লাহরই সকল প্রশংসা- আমি তা ভাল বৈ অন্য কিছু ভাবিনি। তিনি বললেন, তা কী?  আবু মূসা (রাঃ) বললেন, বেঁচে থাকলে এক্ষুণি আপনি তা দেখতে পাবেন। আমি মসজিদে বেশ কিছু বৈঠক দেখলাম- যারা ছালাতের অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক বৈঠকের লোকদের হাতে কিছু ছোট ছোট নুড়ি পাথর রয়েছে। একজন লোক তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে বলছে, ‘তোমরা ১০০ বার আল্লাহু আকবার বল’। তারা ১০০ বার আল্লাহু আকবার বলছে। আবার বলছে ‘১০০ বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়’। তারা ১০০ বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ছে। এরপর বলছে, ‘১০০ বার সুবহানাল্লাহ পড়’। তারা ১০০ বার সুবহানাল্লাহ পড়ছে। তিনি বললেন, তুমি তাদের কী বললে? তিনি উত্তরে বললেন, আপনার মতামত ও আদেশের অপেক্ষায় আমি তাদের কিছুই বলিনি। তিনি বললেন, তুমি তাদের বললে না কেন- তারা তাদের পাপরাশি গণনা করবে, আর তুমি তাদের পুণ্য বিনষ্ট না হওয়ার যামিন থাকবে। তারপর তিনি রওয়ানা দিলেন, আমরাও তার সাথে রওয়ানা দিলাম। তিনি এসে সোজা ঐ বৈঠকগুলোর একটি বৈঠকের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা এ কী করছ? তারা বলল, হে আবু আব্দুর রহমান, এগুলো নুড়ি। আমরা এগুলো দিয়ে তাকবীর, তাহলীল ও তাসবীহ গণনা করছি। তিনি বললেন, তোমরা বরং তোমাদের পাপগুলো এক এক করে গণনা কর; তোমাদের পুণ্য যাতে নষ্ট হয়ে না যায় আমি সে জন্য যামিন থাকব। আফসোস!  হে মুহাম্মাদের উম্মত!! কত দ্রুত তোমাদের উপর ধ্বংস নেমে এল! এই যে তোমাদের নবীর ছাহাবীগণ এখনো তারা সংখ্যায় অনেক। তাঁর (নবীর) কাপড় এখনো জীর্ণ হয়নি; তাঁর ব্যবহৃত পাত্রগুলো এখনো ভেঙ্গে যায়নি। (তার আগেই তোমাদের মাঝে এত পরিবর্তন দেখা দিল?) যার হাতে আমার জীবন তার শপথ, তোমরা এমন একটা দ্বীনের উপর আছ, যা মুহাম্মাদের দ্বীন থেকে অনেক বেশী সঠিক, নাকি তোমরা গুমরাহির দরজা খুলে দিচ্ছ? তারা বলল, হে আবু আব্দুর রহমান, আমরা এর দ্বারা ভাল বৈ অন্য অভিপ্রায় পোষণ করিনি। তিনি বললেন, অনেক ভাল কাজের সংকল্পকারী আছে, যারা তার নাগাল পায় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন একদল লোক কুরআন পড়বে কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালীর নিচে নামবে না। আল্লাহর কসম, আমি জানি না; তবে মনে হয়, তাদের অধিকাংশই তোমাদের ভেতরকার হবে। তারপর তিনি তাদের নিকট থেকে ফিরে এলেন।

আমর ইবনু সালামা বলেন, ঐ বৈঠকগুলোর অধিকাংশ লোককে দেখেছি, নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের পক্ষ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।[16]

ন্যায়বিচার করা, ভুলভ্রান্তি থেকে সতর্কীকরণে কোন পক্ষপাতিত্ব না করা(العدل وعدم المحاباة في التنبيه على الأخطاء) :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا  ‘আর যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায় কথা বলবে’ (আন‘আম ৬/১৫২)। তিনি আরও বলেন,وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ‘আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে’ (নিসা ৪/৫৮)

উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) ছিলেন নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রিয়জন এবং তার পিতাও ছিলেন তাঁর প্রিয়জন। তা সত্ত্বেও তাকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করতে নবী করীম (ছাঃ)-এর এতটুকু বাধেনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থাপিত হদ বা কুরআনী দন্ডমূলক একটি মামলায় আসামীর পক্ষে তিনি তাঁর কাছে সুপারিশ নিয়ে এসেছিলেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন,

أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّهُمْ شَأْنُ الْمَرْأَةِ الَّتِى سَرَقَتْ فِىْ عَهْدِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِىْ غَزْوَةِ الْفَتْحِ فَقَالُوْا مَنْ يُكَلِّمُ فِيهَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا وَمَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إِلاَّ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ حِبُّ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَأُتِىَ بِهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَكَلَّمَهُ فِيْهَا أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ فَتَلَوَّنَ وَجْهُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَتَشْفَعُ فِى حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ. فَقَالَ لَهُ أُسَامَةُ اسْتَغْفِرْ لِى يَا رَسُولَ اللهِ. فَلَمَّا كَانَ الْعَشِىُّ قَامَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَاخْتَطَبَ فَأَثْنَى عَلَى اللهِ بِمَا هُوَ أَهْلُهُ ثُمَّ قَالَ أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا سَرَقَ فِيْهِمُ الشَّرِيْفُ تَرَكُوْهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيْفُ أَقَامُوْا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَإِنِّى وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا. ثُمَّ أَمَرَ بِتِلْكَ الْمَرْأَةِ الَّتِى سَرَقَتْ فَقُطِعَتْ يَدُهَا-

‘নবী করীম (ছাঃ)-এর সময়কালে মক্কা বিজয়ের আমলে জনৈক মহিলা চুরি করেছিল। যেহেতু সে কুরাইশ বংশীয় ছিল তাই কুরাইশরা এতে খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এ বিষয়ে কে কথা বলতে পারবে তা নিয়ে তারা আলোচনায় মিলিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয়জন উসামা বিন যায়েদ ছাড়া আর কে সাহস দেখাতে পারবে। তখন উসামা বিন যায়েদ ঐ মহিলা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কথা বললেন। কিন্তু তার কথা শোনামাত্রই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি তাকে বললেন, আল্লাহর হদ বা দন্ড বিষয়ে তুমি আমার নিকট সুপারিশ নিয়ে এসেছে? উসামা (রাঃ) তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। অতঃপর বিকাল হলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সম্পর্কে একটি ভাষণ দিলেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, তোমাদের পূর্বেকার জাতিগুলো এই কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের মধ্যকার অভিজাত কেউ চুরি করলে তারা তাকে মুক্ত করে দিত, কিন্তু দরিদ্র অভাবী শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তার উপর দন্ড কার্যকর করত। কিন্তু আমার বেলায়- যার হাতে আমার জান তার শপথ করে বলছি- মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত তাহ’লে আমি তার হাত কেটে দিতাম। তারপর তিনি সেই মহিলা চোরের হাত কেটে দেওয়ার আদেশ দিলেন এবং তা কার্যকর করা হ’ল’।[17]

নাসাঈর বর্ণনায় আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,

اسْتَعَارَتِ امْرَأَةٌ عَلَى أَلْسِنَةِ أُنَاسٍ يُعْرَفُونَ وَهِىَ لاَ تُعْرَفُ حُلِيًّا فَبَاعَتْهُ وَأَخَذَتْ ثَمَنَهُ فَأُتِىَ بِهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَسَعَى أَهْلُهَا إِلَى أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ فَكَلَّمَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيهَا فَتَلَوَّنَ وَجْهُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يُكَلِّمُهُ ثُمَّ قَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَتَشْفَعُ إِلَىَّ فِى حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ، فَقَالَ أُسَامَةُ اسْتَغْفِرْ لِى يَا رَسُولَ اللهِ، ثُمَّ قَامَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَشِيَّتَئِذٍ فَأَثْنَى عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَا هُوَ أَهْلُهُ ثُمَّ قَالَ أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّمَا هَلَكَ النَّاسُ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ الشَّرِيفُ فِيهِمْ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ الضَّعِيفُ فِيهِمْ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا ثُمَّ قَطَعَ تِلْكَ الْمَرْأَةَ-

‘জনৈক মহিলা কিছু পরিচিত মানুষের মৌখিক কথার ভিত্তিতে একটি অলংকার ধার নিয়েছিল। মহিলাটি তেমন পরিচিত ছিল না। পরে সে অলংকারটা বিক্রয় করে তার মূল্য খেয়ে ফেলে। মহিলাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট হাযির করা হ’ল। এ সময় মহিলার পরিবার উসামা বিন যায়েদের নিকট (সুফারিশের উদ্দেশ্যে) গেল। তিনি ঐ মহিলার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কথা বললেন। তার কথা বলার সময়েই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি আমার কাছে আল্লাহর দন্ড সমূহের একটি দন্ড স্থগিত রাখতে সুফারিশ করছ? উসামা তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ), আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। ঐদিন বিকালেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি ভাষণ দিলেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করলেন, তারপর বললেন, তোমাদের পূর্বেকার লোকেরা কেবল এ কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের মধ্যকার অভিজাত শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তারা তাকে দন্ডমুক্ত করে দিত কিন্তু দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপর দন্ড প্রয়োগ করত। যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার কসম, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদও যদি চুরি করত তাহ’লেও আমি তার হাত কেটে দিতাম। তারপর তিনি ঐ মহিলার হাত কেটে দেন’।[18]

উসামার সুফারিশ উপেক্ষায় রাসূলুল্লাহ ছাঃ)-এর মাঝে সুবিচারের চরিত্র ফুটে উঠেছে। তাতে এটাও বুঝা গেল যে, তাঁর নিকট মানুষের প্রতি ভালবাসার চেয়ে শরী‘আতের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে ছিল। তাছাড়া ব্যক্তিগত বিষয়ে কেউ ভুল করে থাকলে তার বিষয়টা উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু শরী‘আতের কোন বিষয়ে ভুল করলে তার ক্ষেত্রে চোখ বুঁজে থাকা কিংবা তার পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ মোটেও নেই।

কিছু লোকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আত্মীয়-বন্ধু কেউ ভুল করলে তাকে ততটা বাধা দেয় না, যতটা বাধা অপরিচিত কাউকে দেয়। আত্মীয়তা বন্ধুত্বের কারণে অনেক সময় তাদের কাজে-কর্মে বেআইনি ভাবধারাও অবলম্বন করতে দেখা যায়। বরং অনেক সময় তারা আপনজনের ভুলভ্রান্তির ব্যাপারে চোখ বুঁজে থাকে, আর অন্যদের ভুলের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসতে দিতেও নারায। কবি বলেছেন, চোখের মণির ভুলভ্রান্তি অন্ধকার রাতের মত ঢাকা পড়ে থাকে, কিন্তু চোখের বালির সকল অপরাধ দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাজকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেরও এই একই ধারা লক্ষণীয়। একই কাজ প্রিয়জন করলে যেভাবে নেওয়া হয় অন্যে করলে তা ভিন্নভাবে নেওয়া হয়।                 [চলবে]


[1]আহমাদ হা/২৩৬৬৪; আল-ফাতহুর রাববানী ১৪/২৪৪-২৪৫; তিরমিযী হা/২৭৪০; আবুদাঊদ হা/৫০৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৭০-২২৭১, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১৮৭, সনদ ছহীহ

[2]দারিমী ১/১৫, হা/১৪৬, সনদ মুনকাতি‘

[3]বুখারী হা/৫৬৩২

[4]. আহমাদ হা/২৩৪১২, সনদ ছহীহ; মুসলিম, মিশকাত হা/৪২৭২।

[5]. বুখারী ‘মুকাতাবা’ অধ্যায়-৫০, অনুচ্ছেদ-১; ফাৎহুল বারী ৫/১৮৪

[6]. নাসাঈ হা/৪৮৬২, সনদ ছহীহ।

[7]আহমাদ হা/১১৩৯৩, সনদ ছহীহ লি গাইরিহী।

[8]মুওয়াত্ত্বা মালিক হা/১৫৫৩ হা/২০১৩।

[9]ছহীহ মুসলিম হা/১৪৮০

[10]আবুদাঊদ হা/৩৫৭৭ ‘বিচার’ অধ্যায়, ‘বিচার প্রার্থনা এবং তাতে দ্রুত সাড়া দান’ অনুচ্ছেদ, সনদ যঈফ

[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৩৭

[12]আহমাদ ৪/২৫৩, হা/১৮২৪৪, সনদ হাসনি।

[13]তিরমিযী হা/১৩২৬; মিশকাত হা/৩৭৩২, সনদ ছহীহ।

[14]. আবুদাঊদ হা/৩৩৬, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, ‘আহত ব্যক্তি তায়াম্মুম করবে’ অনুচ্ছেদ, মিশকাত হা/৫৩১, সনদ হাসান।

[15]আবুদাঊদ হা/৩৫৭৩; মিশকাত হা/৩৭৩৫, সনদ ছহীহ।

[16]দারেমী হা/২১০, ২০৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০০৫

[17]বুখারী হা/৩৪৭৫; মুসলিম হা/১৬৮৮

[18]নাসাঈ হা/৪৮৯৮, সনদ ছহীহ; বুখারী হা/৪৩০৪, মিশকাত হা/৩৬১০।





পরহেযগারিতা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ইসলামের দৃষ্টিতে তাবীয ও ঝাড়-ফুঁক - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
তালাক সংঘটিত হওয়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায় (ফেব্রুয়ারী’২২ সংখ্যার পর) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডা. হ্যানিম্যান ও তার ইসলাম গ্রহণ - ডা. এস.এম. আব্দুল আজিজ
জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিরিখে যেলাসমূহের মাঝে সময়ের পার্থক্যের কারণ - তাহসীন আল-মাহী
নজরুলের কারাজীবন ও বাংলা সাহিত্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ - অধ্যাপক এনায়েত আলী বিশ্বাস
শয়তানের চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষার উপায় (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণ : একটি পর্যালোচনা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন : তুলনামূলক আলোচনা - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
সমাজ সংস্কারে ফরায়েযী আন্দোলনের ভূমিকা - এডভোকেট জারজিস আহমাদ
আরও
আরও
.