পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।

ছাহাবায়ে কিরামের যুগে ফৎওয়া :

রাসূল (ছাঃ)-এর অবর্তমানে তাঁরই একনিষ্ঠ ছাহাবীগণ ইসলামী শরী‘আতের ধারক-বাহক, সংরক্ষক ও প্রচারক হিসাবে দায়িত্বপালন করবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার জন্য রাসূল (ছাঃ) তাঁদেরকে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তোলেন। খোলাফায়ে রাশিদুনও এভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। যেমন ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে একদা তিনি শুরাইহ (রাঃ)-কে বললেন,

اقض بما في كتاب الله، فإن لم يكن في كتاب الله فبسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم، فإن لم يكن في سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فاقض بما قضى به الصالحون-

‘যা আছে আললাহর কিতাবে তা দিয়ে মীমাংসা করবে। আর যদি আল্লাহর কিতাবে সে বিষয়টি না থাকে, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত দ্বারা মীমাংসা করবে। আর যদি সে বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতেও না পাও তাহ’লে তোমার পূর্বসূরী সৎকর্মশীল মুহাক্কিক্ব আলেমদের মতামত অনুযায়ী মীমাংসা করবে’।[1]

রাসূল (ছাঃ)-এর পর ফৎওয়া প্রদানের দায়িত্বভার তাঁরই ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞ ও যোগ্য ছাহাবীদের উপর অর্পিত হয়। আছহাবে কিরামের মধ্যে যাঁরা ফৎওয়া প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে ১৩০ জনের কিছু বেশী ছিল। তাঁদের মধ্যে আবার কয়েকটি স্তর রয়েছে। সবচেয়ে বেশী ফৎওয়া প্রদানকারী ছাহাবার সংখ্যা সাত জন। তাঁরা হ’লেন- ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ), উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ), যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)। তাঁদের সকলেই এত বেশী ফৎওয়া প্রদান করেছেন যে, তা একত্রিত করলে বিরাট বিরাট পান্ডুলিপি হয়ে যাবে।[2]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর ফৎওয়া পরবর্তীতে (আববাসীয় যুগে) একত্রিত করলে তা বিশটি গ্রন্থে পরিণত হয়।[3]

আছহাবে কেরামের মধ্যে যাঁরা ফৎওয়া প্রদানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন, তাঁদের উল্লেখযোগ্য হ’লেন- আবু বকর, উম্মে সালামা, আনাস বিন মালিক, আবু সাঈদ খুদরী, ওছমান ইবনু আফফান, আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের, আবু মূসা আল-আশ‘আরী, সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ, সালমান ফারেসী, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ, মু‘আয ইবনু জাবাল, তালহা, যুবায়ের, আব্দুর রহমান ইবনু আউফ, ইমরান ইবনু হুসাইন, আবু বাকরাহ, উবাদা বিন ছামিত এবং মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ান (রাঃ) প্রমুখ।

যে সকল ছাহাবী অল্প সংখ্যক ফৎওয়া প্রদান করেছেন তাঁরা হ’লেন- আবু দারদা, আবুল ইয়াসার, আবু সালামা আল-মাখযূমী, আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ, সাঈদ বিন যায়েদ, হাসান, হুসাইন, নু‘মান ইবনু বাশীর, আবু মাসঊদ, উবাই কা‘ব, আবু আইয়ূব, আবু তালহা, আবু যর আল-গিফারী, উম্মে আতিয়্যাহ, ছাফিয়া, হাফছা, উম্মু হাবীবাহ, উসামাহ বিন যায়েদ, জা‘ফর ইবনু আবী তালিব ও বারা ইবনু আযিব (রাঃ) প্রমুখ।[4]

উল্লেখিত ছাহাবাগণ ছাড়াও একেবারে কম সংখ্যক ফৎওয়া প্রদান করেছেন কিছু ছাহাবী যাদেরকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তাবেঈদের যুগে ফৎওয়া :

ছাহাবায়ে কেরামের যুগ রাসূল (ছাঃ)-এর ইন্তেকালের পর ১১ হিজরী হ’তে প্রায় ৯৩ হিজরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর পর থেকে তাবেঈদের যুগ শুরু হয়।

এ যুগে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত বিশ্বের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শারঈ বিধানও প্রচার ও প্রসার লাভ করে। স্থান, কাল, পাত্র এবং জাতি, বর্ণ ও গোত্র ভেদে পবিত্র কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত ফৎওয়া ব্যতীত নানামুখী ফৎওয়া বা যুগ- জিজ্ঞাসার জওয়াব-এর প্রয়োজন দেখা দেয়। এসব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইন্তেকালের দীর্ঘকাল পর তাবেঈদের যুগে বিশেষজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে ইসলামী শরী‘আতের আরকান, আহকাম, শর্তসমূহ ও অন্যান্য আদব সমূহ পৃথক আকারে সুবিন্যস্ত হয়। এর ফলে কোনটি ফরয, কোনটি ওয়াজিব, কোনটি সুন্নাত এবং কোনটি মুস্তাহাব- এসব কিছু বের করা সহজ হয়। যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে এবং ছাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না। কেননা আছহাবে কেরাম কোন রূপ ব্যাখ্যা ও আলোচনা ব্যতিরেকে রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কাজ ও অনুমোদনকে গ্রহণ করেছেন। শারঈ হুকুম-আহকামকে কখনও সুবিন্যস্ত বা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁরা ফৎওয়া দিতেন কোনরূপ ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ ছাড়াই। কারণ তাঁদের কাছে প্রত্যক্ষ শারঈ ইলম বিদ্যমান ছিল। তাঁদের অবর্তমানে তাঁদেরই উত্তরসূরী তাবেঈগণ ফৎওয়া প্রদানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তবে খুবই অল্প সংখ্যক তাবেঈ ফৎওয়া প্রদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁরা সাধ্যমত চেষ্টা করতেন পবিত্র কুরআন ও হাদীছে উল্লেখ রয়েছে এমন বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কথা না বলতে। তাঁরা ছোট-খাট মাসআলার সমাধানে ফৎওয়া প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। কারণ ক্বিয়াস ও নিজস্ব মতামত দ্বারা কোন বিষয়ে ফৎওয়া দিতে তাঁরা ভয় পেতেন। তবে যতটুকু প্রয়োজন শুধুমাত্র ততটুকুরই সমাধান দিতে চেষ্টা করতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ওযূর সুন্নাত, মুস্তাহাব, ওয়াজিব কোনটাই উল্লেখ ছিল না, এটা পরবর্তীতে (তাবেঈ যুগে) নির্ণিত হয়েছে।

স্থানভেদে উল্লেখযোগ্য কতিপয় তাবেঈর নাম উল্লেখিত হ’ল-

মদীনা : সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আবু সালামাহ বিন আব্দুর রহমান বিন আউফ, উরওয়াহ ইবনু যুবাইর, উবায়দুল্লাহ, কাসেম ইবনু মুহাম্মাদ, সুলায়মান বিন ইয়াসার, খারেজাহ বিন যায়েদ, ইমাম যুহরী (মৃত্যু ১১৪ হিঃ), কাযী ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ, রবী‘আহ ইবনু আব্দুর রহমান (রহঃ) প্রমুখ।

মক্কা : আত্বা ইবনু আবী রাবাহ (রহঃ), আলী ইবনু আবী তালহা, আব্দুল মালিক ইবনু জুরাইজ (রহঃ) (মৃত্যু ১৫০ হিঃ), মুজাহিদ বিন জাবর, উবাইদ বিন উমাইর, আমর ইবনু দীনার, আব্দুল্লাহ বিন আবী মুলায়কা, আব্দুর রহমান বিন সাবেত্ব, ইকরিমা (রহঃ) প্রমুখ।

কুফা : ইবরাহীম আন-নাখঈ (মৃত্যু ৯৬ হিঃ), আমের ইবনু শারাহীল আশ-শা‘বী, আলকামা ইবনু কায়েস আন-নাখঈ (মৃত্যু ৬২ হিঃ), আসওয়াদ ইবনু ইয়াযীদ, মুররা ইবনু শারাহীল আল-হামাদানী (রহঃ) প্রমুখ।

বসরা : আমর ইবনু সালামাহ আল-জারমী, আবু মারইয়াম আল-হানাফী, কা‘ব ইবনু সাওদ, হাসান বসরী, আবু শা‘ছা, মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, আবু ক্বিলাবা আব্দুল্লাহ ইবনু যায়েদ আল-জারমী, মুসলিম বিন ইয়াসার, আবুল আলিয়া, হুমায়দ ইবনু আব্দুর রহমান, মুত্বারিরফ বিন আব্দুল্লাহ আশ-শিক্ষীর, যুরারাহ বিন আবী আওফা, আবু বুরদাহ বিন আবী আওফা (রহঃ) প্রমুখ।

ইয়ামান : আউস ইবনে কাইসান, ওয়াহাব ইবনু মুনাবিবহ, ইয়াহইয়া ইবনু কাছীর, মুতারিরফ ইবনু মাযেন, আব্দুর রাযযাক ইবনু হুমাম, হিশাম ইবনু ইউসুফ, মুহাম্মাদ ইবনু ছাওর ও সিমাক ইবনুল ফযল (রহঃ) প্রমুখ।

সিরিয়া : মাকহূল ইবনু আবী মুসলিন, আল-হুযালী (মৃত্যু ১৯৩ হিঃ), আবু ইদরীস আল-খাওলানী, শুরাহবীল ইবনু আস-সামাত, আব্দুল্লাহ আবি যাকারিয়া আল-খুযাঈ, কাবীছাহ ইবনু আবী যুওয়াইব আল-খুযাঈ, হিববান ইবনু উমাইয়া, সুলাইমান ইবনু হাবীব আল-মুহারিবী, হারিছ ইবনু উসাইর যুবাইদী, আব্দুর রহমান ইবনু জুবাইর, ওমর ইবনু আব্দুল আযীয, রাজা ইবনু হায়াত (রহঃ) প্রমুখ।[5]

মিসর : ইয়াযীদ ইবনু আবী হাবীব, বুকাইর ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনিল আশাজ্জ, আমর ইবনিল হারেছ (রহঃ) প্রমুখ।

স্পেন : ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, আব্দুল মালেক ইবনু হাবীব, বাক্বী ইবনু মাখলাদ, কাসেম ইবনু মুহাম্মাদ, মাসলামা ইবনু আব্দুল আযীয আল-কাযী, মুনযির ইবনু সাঈদ (রহঃ) প্রমুখ।

বাগদাদ : এখানে বহু মুফতীর সমাগম ঘটেছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লেন আবু উবাইদ আল-কাসেম ইবনু সাল্লাম, আবু ছাওর ইবরাহীম ইবনু খালেদ আল-কালবী, যিনি ইমাম শাফেঈর শাগরেদ ছিলেন।[6]

উল্লেখ্য যে, তাবেঈদের অধিকাংশ ফৎওয়া সংকলিত হয়েছে মুয়াত্ত্বা, মুসনাদ ও সুনান কিতাব সমূহ, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, কিতাবুল আছার প্রভৃতি গ্রন্থে।[7]

আববাসীয় যুগ :

ওছমান (রাঃ)-এর যুগ পর্যন্ত ফৎওয়া প্রদানের মূল দায়িত্ব পালন করতেন খুলাফায়ে রাশেদীন। অবশ্য মুজতাহিদগণ ইজতেহাদ করতেন। কিন্তু তাঁদের মতবিরোধ কোন অনিষ্টকর রূপ পরিগ্রহ করত না। কারণ প্রত্যেক মুজতাহিদের এলাকা ছিল ভিন্ন। এরপর আসে উমাইয়া যুগ। তাদের যুগে খিলাফতের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল রাজ্য জয়ের দিকে। মুজতাহিদ-ফক্বীহদের অবস্থাও প্রায় পূর্বের ন্যায়ই ছিল। রাজ্যের মধ্যে কোন ফৎওয়ায় মতবিরোধ দেখা দিলে তা নিয়ে বিরুদ্ধ অবস্থা তৈরী হ’ত না। আর রাজধানীতে কোন মতবিরোধ দেখা দিলে, তা খলীফা নিজেই সমাধান করতেন। আবার খলীফা যখন কোন বিরোধ মীমাংসায় অক্ষম হ’তেন, তখন মদীনার ফক্বীহগণের শরণাপন্ন হ’তেন এবং তাদের ফায়ছালা গ্রহণ করা হ’ত। উল্লেখ্য যে, উমাইয়া শাসকগণ ইসলামের জ্ঞানকেন্দ্রকে দামেশকে স্থানান্তরিত করেননি; বরং তাঁরা মদীনাকেই উৎস মনে করতেন।[8]

কিন্তু আববাসীয় শাসকগণ বাগদাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করার সাথে শিক্ষাকেন্দ্রও সেখানে নিয়ে যান। সুতরাং আববাসীয় আমলে মদীনার পরিবর্তে বাগদাদই হয়ে ওঠে ইসলামী জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র। আববাসীয় খলীফাদের কারো মধ্যে মুফতী-ফক্বীহ ও মুজতাহিদদের বিভিন্ন মতামত বিচার করে কোন একটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যোগ্যতা ছিল না। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমস্ত প্রশ্ন কেন্দ্রে এসে জমা হ’ত এবং সেসব মাসআলা নিয়ে ফক্বীহদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিত। এমতবস্থায় খলীফার প্রয়োজন ছিল এমন অভিজ্ঞ মুফতী, মুজতাহিদ বিদ্বান লোকের, যিনি সর্বদা তাঁর সন্নিধানে থাকবেন এবং মতবিরোধপূর্ণ মাসআলার সীমাংসা করতে সক্ষম হবেন। খলীফা আল-মনছূর এজন্য প্রথম দিকে মদীনার মুফতীদেরকে নিজের পক্ষভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সহযোগিতা লাভে তিনি অসমর্থ হন। অতঃপর খলীফা ইরাকবাসী ফক্বীহ-মুফতীদের শরণাপন্ন হন। তিনি ইমাম আবু হানীফার সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফাও তাঁকে নিরাশ করেন। অবশেষে ইমাম আবু ইউসুফ এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং সাম্রাজ্যের বিচার বিভাগকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। ইমাম আবু ইউসুফ ইমাম আবু হানীফার ইজতিহাদের উপর ভিত্তি করে সর্বত্র একটি কার্যবিধি বা আইন প্রণয়ন করেন এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান আশ-শায়বানীর উপর আইন শিক্ষাদানের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। তখন বিষয়টি দাঁড়াল এই যে, ইমাম মুহাম্মাদের কাছে শিক্ষালাভের পর যারা বের হ’তেন, তাঁরাই শুধু রাষ্ট্রীয় কাযীর পদের যোগ্য বিবেচিত হ’তেন এবং তাঁরাই সেখানে নিযুক্ত হ’তেন। এই কাযীগণ আবার তাঁদের ছাত্রদেরকে বাছাই করে অধঃস্তন কাযীর পদের জন্য নির্বাচন করতেন। এভাবে ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর মাধ্যমে আববাসীয় সাম্রাজ্যভুক্ত সমগ্র মুসলিম জাহান একই ধরনের আইনের আওতায় চলে আসে।[9] এ পর্যায়ে আববাসীয় শাসনামলের স্বর্ণযুগ সূচিত হয়েছিল। যেখানে সমগ্র মুসলিম জাহানব্যাপী যুগ-জিজ্ঞাসার জওয়াব ইমাম আবু হানীফার ইজতিহাদ অনুযায়ী প্রদান করা হ’ত। সুতরাং আহলুর রায় তথা হানাফী মাযহাবের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এ যুগেই।

এভাবে আববাসীয় যুগ শুরু হওয়ার পর ফক্বীহদের ফৎওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুর রায় এবং আহলুল হাদীছ- এ দু’টি ধারা সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি ধারা তথা আহলুর রায় বলতে তাদেরকে বুঝানো হ’ত যারা ছিলেন মূলতঃ ইমাম আবু হানীফার ইজতিহাদের অনুসারী। যেহেতু ইমাম আবু হানীফা ফৎওয়া প্রদানে হাদীছের চেয়ে রায়ের উপর অধিক নির্ভর করেছেন। তাই তাঁর অনুসারীদেরকে আহলুর রায় বলা হয়। কূফা এবং এতদঞ্চল জুড়েই ছিল তাদের উপস্থিতি।

অপরদিকে এর বিপরীতে মদীনা তথা হেজায অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে আহলুল হাদীছ তথা হাদীছপন্থীগণ। যারা ফৎওয়া প্রদানে মূলতঃ হাদীছের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। যেহেতু সর্বক্ষেত্রে তাঁরা হাদীছকেই একমাত্র প্রণিধানযোগ্য মনে করতেন। তাই তাদেরকে আহলুল হাদীছ বলা হয়। তাঁরা মাসআলার ক্ষেত্রে কূফী, বাগদাদীদের রায়ভিত্তিক ফৎওয়া গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না এবং তারা এর কঠোর সমালোচনা করতেন।[10]

এ দু’টি ধারার বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ :

(১) আহলুর রায় : ইরাকবাসী আহলুর রায়পন্থী ফক্বীহগণ ফৎওয়া প্রদানে হাদীছের চেয়ে রায়ের প্রতিই বেশী নির্ভরশীল ছিলেন। কারণ হেজাযের ফক্বীহদের চেয়ে তাদের সংগৃহীত হাদীছের সংখ্যা ছিল অনেক কম। কেননা সেখানে গমনকারী ছাহাবীদের সংখ্যা কম ছিল। আর ইরাক ছিল পারসিক সভ্যতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সেখানে নানাবিধ সমস্যার উপস্থিতি ছিল অনেক বেশী, যাতে ফৎওয়া প্রদানে নিজস্ব যুক্তি ও কিয়াসের ব্যবহার করার প্রয়োজন হ’ত। ইবরাহীম নাখঈ বলেন, ‘আমি একটি হাদীছ শুনি, আর তার উপর আরো একশটি মাসআলা কিয়াস করি’।[11] এছাড়াও শী‘আ ও খারেজীদের উৎপাত এবং রাজনৈতিক দলাদলির তীব্রতায় জর্জরিত ছিল ইরাক। আপন আপন স্বার্থে এসব দল-উপদল রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে নিয়েও ছেলেখেলা শুরু করে এবং স্ব স্ব মতের অনুকূলে লক্ষ লক্ষ জাল হাদীছ তৈরী করা আরম্ভ করে। ফলে হাদীছ জাল বা মিথ্যা হওয়ার আশংকায় এখানকার ফক্বীহগণ হাদীছ সংরক্ষণ ও রেওয়ায়াত করতেন খুব কম। তাই ফৎওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে হাদীছের চেয়ে রায়ের উপরই তারা ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, তারা শরী‘আতের আহকাম বর্ণনায় হাদীছের উদ্ধৃতি দিতে ভয় পেতেন, অথচ রায় উল্লেখ করতেন নির্ভয়ে।[12] এই মাসলাকের ফক্বীহগণের মধ্যে ইবনু আবী লায়লা, ইবনু শুবরামাহ, শুরায়েক আল-কাযী, ইমাম আবু হানীফা প্রমুখ নেতৃত্বে ছিলেন।[13]

(২) আহলুল হাদীছ : হেজাযবাসী আহলুল হাদীছ তথা হাদীছপন্থী ওলামায়ে কেরাম ছিলেন কঠোরভাবে হাদীছের অনুসারী। কেননা তাঁরা ছিলেন অহি-র অবতরণস্থল এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের কেন্দ্রভূমির অধিবাসী। সেখানেই বসবাস করেছেন অধিকাংশ ছাহাবীগণ। ফলে রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ ও ছাহাবাগণের আছারের উপরই ছিলেন তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। যায়েদ বিন ছাবিত, আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী, সাঈদ বিন মুসাইয়িবের মত তাবেঈগণ ছিলেন তাঁদের নেতৃত্বে। ফলে হাদীছ ও আছারের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকায় তাদেরকে সাধারণতঃ ব্যক্তির রায়ের অপেক্ষা করতে হ’ত না। তদুপরি এখানকার ফক্বীহগণ হাদীছের বিপরীতে নিজস্ব রায় প্রদানের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন। তাঁরা কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হ’লে সে বিষয়ে কোন আয়াত বা হাদীছ পেলে সে প্রশ্নের উত্তর দিতেন, অন্যথা ফৎওয়া প্রদানে বিরত থাকতেন। তারা বিশেষতঃ ইরাকের ফক্বীহদের হাদীছের পরিবর্তে রায়ের উপর নির্ভরতাকে খুব সমালোচনার চোখে দেখতেন।[14] এই ধারায় পরবর্তীতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ)।[15]

ফৎওয়া প্রদানে ক্রমশঃ এ দু’টি স্বতন্ত্র ধারা স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ফক্বীহদের পারস্পরিক মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্বের বিষয়টিও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর লাগল। ইলমের চর্চাকেন্দ্রসমূহে নেতৃত্বদানকারী চারজন মুজতাহিদ ইমাম যাঁদের দিকে মাযহাবগুলো সম্বন্ধ করা হয়; ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ- তাঁরা এই সময়ই তাঁদের কর্মময় জীবনকাল অতিবাহিত করেন।

হিজরী ২য় শতকের মাঝামাঝি হাদীছ সংকলন ও ফিক্বহী মাসাআলা সংকলনের সূচনা হয়। আর ৪র্থ শতকের মাঝামাঝি আববাসীয় সাম্রাজ্য ভঙ্গুর হওয়া পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে। হাদীছ সংকলনের স্বর্ণযুগ মূলতঃ শুরু হয় ৩য় শতকের প্রারম্ভে। বিভিন্ন শহর-নগর থেকে হাদীছ সংগ্রহের দীর্ঘ অভিযাত্রা এবং আয়াসসাধ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার বিশুদ্ধতা যাচাই- ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ইসলামী শরী‘আহ লিখিত আকারে সুরক্ষা লাভ করে। ফলে ফক্বীহদের জন্য সরাসরি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মূল উৎসের মাধ্যমে ফৎওয়া প্রদান করা সহজসাধ্য হয়। আর রাসূল (ছাঃ) বিবৃত হাদীছ এবং ছাহাবা ও তাবেঈনদের অনুসৃত নীতি মোতাবেক পরিচালিত ইসলামের সহজ-সরল বিশুদ্ধতম পথ খোলাফায়ে রাশেদীনের পরে আবারও সুস্পষ্ট হ’তে শুরু করে। তবে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং ছাহাবা, তাবেঈদের ফিক্বহ সম্পর্কে বুঝগত তারতম্যের কারণে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে উছূলগত কিছু বিষয়ে ও আহকাম সাব্যস্তকরণে বেশ কিছু মতভেদ ঘটে। তাঁদের নিজ নিজ মতের স্বপক্ষে অনুসারীদল গড়ে উঠল। আর শাসকগণও মাসআলাগত এসব বিতর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন এবং বিতর্ক অনুষ্ঠানে নিজেরা উপস্থিত থাকতেন। ফলে এসব বিতর্ক স্থায়ীরূপ লাভ করে এবং পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র ফিক্বহী মাযহাব সৃষ্টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দেয়।

তবে লক্ষ্যণীয় যে, এ যুগের ওলামায়ে কেরাম কেবল দলীলের ভিত্তিতে বিতর্ক করতেন। তারা কারো অন্ধ অনুসরণ বা তাক্বলীদ করতেন না। কোন মতের উপর অাঁকড়ে পড়ে থাকতেন না। বরং দলীলের ভিত্তিতে হক্বের সন্ধান পেলে তা-ই তারা মেনে নিতেন।১৬ এ যুগে হাদীছ গ্রন্থ, ফিক্বহী মাসায়েল, ছাহাবা-তাবেঈনের ফিক্বহ, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ফিক্বহ প্রভৃতি গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়।

যে সকল প্রসিদ্ধ হাদীছ গ্রন্থ এ সময় সংকলন করা হয় সেগুলো হ’ল- ইমাম মালেকের মুওয়াত্ত্বা, আহমাদ বিন হাম্বলের আল-মুসনাদ, ইমাম বুখারীর আল-জামে‘ আছ ছহীহ, ইমাম মুসলিমের ছহীহ মুসলিম, ইমাম আবুদাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহর সুনানসমূহ প্রভৃতি বিশ্ববিখ্যাত হাদীছ সংকলনগ্রন্থ। এছাড়া ফিক্বহী মাসায়েলের যে সকল গ্রন্থ খ্যাতি লাভ করেছিল, তার মধ্যে সুফিয়ান ছাওরীর ‘আল- জামে‘ আল-কাবীর’, ইমাম শাফেঈর ‘ইখতিলাফুল হাদীছ’, ‘কিতাবুল উম্ম’, আবু ইউসুফের ‘কিতাবুল খারাজ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

(চলবে)

শিহাবুদ্দীন আহমাদ

পিএইচ.ডি. গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. ইবনুল কাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন আন রাবিবল আলামীন, ১ম খন্ড, (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৩ র্খঃ/১৪১৪হিঃ), পৃঃ ১০।

[2]. মুফতী তাকী ওছমানী, উছূলুল ইফতা, পৃঃ ২৪।

[3]. ঐ, পৃঃ ২৫।

[4]. ঐ, পৃঃ ২৬।

[5]. উছূলুল ইফতা, পৃঃ ২৮-৩১; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ১/২৩ পৃঃ।

[6]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ১/২২ পৃঃ।

[7]. উছূলুল ইফতা, পৃঃ ৩১।

[8]. মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯২), পৃঃ ১৫৮-১৫৯।

[9]. শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, পৃঃ ১৫৯-১৬০।

[10]. মান্না আল-কাত্ত্বান, আত-তাশরীঈ ওয়াল ফিক্বহ ফিল ইসলাম (কায়রো : মাকতাবা ওহাবাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৩), পৃঃ ২৯৩।

[11]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩৯৮হিঃ), ২/৬৬ পৃঃ। 

[12]. আত-তাশরীঈ ওয়াল ফিক্বহ ফিল ইসলাম, পৃঃ ২৯১।

[13]. ড. উমর সুলায়মান আল-আশকার, তারীখুল ফিক্বহ আল-ইসলামী (আম্মান : দারুন নাফায়েস, ৩য় প্রকাশ, ১৯৯০ খৃঃ), পৃঃ ৮৭।

[14]. আত-তাশরীঈ ওয়াল ফিক্বহ ফিল ইসলাম, ২৯৪ পৃঃ।

[15]. তারীখুল ফিক্বহ আল-ইসলামী, ৮৬ পৃঃ।

১৬. ঐ, ৯২-৯৩ পৃঃ।






আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি (৪র্থ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
শিশুদের চরিত্র গঠনে ‘সোনামণি’ সংগঠনের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল
বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম - আ.স.ম. ওয়ালীউল্লাহ
আমানত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
পাপ মোচনকারী আমল সমূহ - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
আল্লাহর নিদর্শন - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মুসলিম নারীর পর্দা ও চেহারা ঢাকার অপরিহার্যতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.