পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। শেষ পর্ব

(৯) ভুলের ভয়াবহতা বর্ণনা করা :

ইবনু ওমর, মুহাম্মাদ বিনু কা‘ব, যায়েদ বিন আসলাম ও কাতাদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এ বর্ণনা অবশ্য তাদের পরস্পরের বর্ণনার সংমিশ্রণে তৈরী। তাবূক যুদ্ধের সময়ে জনৈক ব্যক্তি বলেছিল, আমাদের কুরআন পাঠকদের মত এমন খানাপিনায় পেটুক, কথাবার্তায় মিথ্যুক আর যুদ্ধকালে কাপুরুষ আমরা দ্বিতীয় আর দেখিনি। একথা দ্বারা সে নবী করীম (ছাঃ) এবং তাঁর কুরআনে অভিজ্ঞ ছাহাবীদের বুঝিয়েছিল। তার কথা শুনে আওফ বিন মালিক বলে ওঠেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি তো দেখছি (পাকা) মুনাফিক। আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এ কথা বলে দেব। অতঃপর আওফ খবরটা দিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গিয়ে দেখেন তার আগেই কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উটে চড়ে রওয়ানা দিয়েছেন। তখন ঐ লোকটা এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কেবল পথ অতিক্রম করার মানসে আবোল-তাবোল কথা, হাসি-রহস্য করছিলাম, আর কাফেলার লোকেরা যেমন কথাবার্তা বলে তেমনি করে বলছিলাম। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি- লোকটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাওদার রশি ধরে চলছে আর পাথরের আঘাতে তার দু’পা কেমন ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, আর সে বলে চলেছে- আমরা কেবলই আবোল-তাবোল কথা বলছিলাম, আর হাসি-রহস্য করছিলাম। এদিকে তার কথার উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে চলছিলেন-‘বল, তোমরা কি আল্লাহ, তার নিদর্শনাবলী এবং তার রাসূলকে নিয়ে হাসি-রহস্য করছিলে’? (তওবা ৯/৬৫) তিনি তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করছিলেন না এবং ঐ কথার অতিরিক্তও কিছু বলছিলেন না।

এ ঘটনা ইবনু জারীর বিন ওমর (রাঃ)-এর বরাতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, তাবূক যুদ্ধকালে এক মজলিসে এক ব্যক্তি বলে বসে, আমাদের এসব ক্বারীদের মত খানাপিনায় পেটুক, কথাবার্তায় কিথ্যুক এবং যুদ্ধে ভীরু কাপুরুষ দ্বিতীয় আর কাউকে আমরা দেখিনি। ঐ মজলিসে এক লোক (প্রতিবাদ করে) বলে, তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি বরং মুনাফিক। আমি একথা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানিয়ে দেব। অবশ্য ইতিমধ্যে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, আমি তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উষ্ট্রীর হাওদা ধরে ঝুলে থাকতে দেখেছি। পাথরের আঘাতে তার পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল, আর সে মুখে বলছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কেবল আবোল-তাবোল কথা বলে হাসি-তামাশা করছিলাম।

* সঊদী আরবের প্রখ্যাত আলেম ও দাঈ।

** সিনিয়র শিক্ষক, হরিণাকুন্ড সরকারী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহ।

অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলছিলেন, ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শনাবলী ও তাঁর রাসূলকে হাসি-তামাশার পাত্র বানিয়ে নিয়েছিলে? ঈমান আনার পরপর তোমরা কুফরী করেছ। সুতরাং তোমরা এখন আর কোন অজুহাত দেখিও না’।[1] এ হাদীছের বর্ণনাকারীগণ বুখারী মুসলিমের বর্ণনাকারীদের দলভুক্ত। তবে হিশাম বিন সা‘দ থেকে মুসলিম কোন বর্ণনা করেননি। অবশ্য আল-মীযান গ্রন্থে সমর্থক (شاهد) বর্ণনা হিসাবে তার নাম উল্লেখ করেছেন। ইবনু হাতেম হাসান সনদে এর সমর্থক বর্ণনা করেছেন কা‘ব বিন মালিক থেকে।[2]

(১০) ভুলের মাশুল বা খেসারত বর্ণনা করা :

আবু ছা‘লাবা আল-খুশানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

إِذَا نَزَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْزِلاً تَفَرَّقُوْا فِى الشِّعَابِ وَالأَوْدِيَةِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ تَفَرُّقَكُمْ فِىْ هَذِهِ الشِّعَابِ وَالأَوْدِيَةِ إِنَّمَا ذَلِكُمْ مِنَ الشَّيْطَانِ. فَلَمْ يَنْزِلْ بَعْدَ ذَلِكَ مَنْزِلاً إِلاَّ انْضَمَّ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ حَتَّى يُقَالُ لَوْ بُسِطَ عَلَيْهِمْ ثَوْبٌ لَعَمَّهُمْ-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সফরে কোন স্থানে (বিশ্রাম কিংবা রাত কাটানোর জন্য) অবস্থান গ্রহণ করতেন তখন তাঁর সঙ্গে আগত লোকেরা বিভিন্ন গিরিপথে ও উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ত। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের বললেন, তোমাদের এভাবে গিরিপথে ও উপত্যকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শয়তানী আচরণের পর্যায়ভুক্ত। এরপর থেকে ছাহাবীগণ কোন স্থানে অবতরণ করলে একে অপরের সাথে এমনভাবে মিলেমিশে থাকতেন যে, এক কাপড়ে তাদের ঢেকে দিতে চাইলে যেন সবার জন্য তাতে হয়ে যাবে’।[3] অন্য বর্ণনায় এসেছে, حَتَّى إِنَّكَ لَتَقُوْلُ لَوْ بَسَطْتُ عَلَيْهِمْ كِسَاءً لَعَمَّهُمْ ‘এমনকি তুমি বলতে পার, তাদের উপর একটা কাপড় বিছিয়ে দিলে তাতে সকলেরই হয়ে যাবে’।[4]

লক্ষ্যণীয়, নবী করীম (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের কত বেশী দেখ-ভাল করতেন। এখানে সেনাদলের কল্যাণ সাধনে সেনাপতির আগ্রহও সমভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে আরো বুঝা যায়, যদি সৈন্যরা কোথাও ডেরা ফেলে যদি যার যার মত বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান নেয়, তাহ’লে শয়তান মুসলমানদের মনে ভয় দেখানোর সুযোগ পায় এবং শত্রুকেও তাদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।[5] আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে সেনাবাহিনীর একজন অন্যজনকে প্রয়োজন মুহূর্তে সাহায্য করতে পারে না।[6] আবার দেখুন- নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণই বা কি সুন্দরভাবে তাঁর আদেশ মেনে নিয়েছিলেন।

ভুলের ক্ষতি ও খেসারতের উদাহরণ নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীছেও পাওয়া যায়। ছালাতের জামা‘আতে লাইন সোজা করা প্রসঙ্গে নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لَتُسَوُّنَّ صُفُوْفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللهُ بَيْنَ وُجُوْهِكُمْ ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের লাইনগুলো সোজা করবে; তা না হ’লে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করবেন’।[7]

ছহীহ মুসলিমে সিমাক বিন হারব থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি,

 كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُسَوِّى صُفُوْفَنَا حَتَّى كَأَنَّمَا يُسَوِّىْ بِهَا الْقِدَاحَ حَتَّى رَأَى أَنَّا قَدْ عَقَلْنَا عَنْهُ ثُمَّ خَرَجَ يَوْمًا فَقَامَ حَتَّى كَادَ يُكَبِّرُ فَرَأَى رَجُلاً بَادِيًا صَدْرُهُ مِنَ الصَّفِّ فَقَالَ : عِبَادَ اللهِ لَتُسَوُّنَّ صُفُوْفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللهُ بَيْنَ وُجُوْهِكُمْ-

‘(জামা‘আতে ছালাত আরম্ভের সময়) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের লাইনগুলো এমনভাবে সোজা করতেন যেন মনে হ’ত তিনি তা দ্বারা তীর সোজা করছেন। তিনি এটাও দেখতেন যে, আমরা তাঁর থেকে আমাদের ভুল শুধরে নিয়েছি কি-না। একদিনের ঘটনা। তিনি এসে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেছেন, তাকবীর দিতে যাবেন এমন সময় দেখলেন একজনের বুক লাইন থেকে একটু বেড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, আল্লাহর বান্দারা! তোমরা অবশ্যই লাইন সোজা করে দাঁড়াবে, নতুবা আল্লাহ তোমাদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করবেন’।[8]

ইমাম নাসাঈ আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছিলেন, رَاصُّوْا صُفُوْفَكُمْ وَقَارِبُوْا بَيْنَهَا وَحَاذُوْا بِالأَعْنَاقِ فَوَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ إِنِّى لأَرَى الشَّيَاطِيْنَ تَدْخُلُ مِنْ خَلَلِ الصَّفِّ كَأَنَّهَا الْحَذَفُ ‘তোমরা তোমাদের লাইনগুলো যুক্ত করো, ওগুলোর মাঝে কাছাকাছি হও এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও। কেননা যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার শপথ, নিশ্চয়ই আমি শয়তানদের দেখতে পাই তারা লাইনের ফাঁকা জায়গাতে ঢুকে পড়ে- যেন সেগুলো দেখতে কালো ছাগল ছানা’।[9]

সুতরাং ভুলের ক্ষতি ও তার পরিণাম কি দাঁড়াতে পারে তা বর্ণনা করা ভুলকারীকে ভুল থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কখনো কখনো এই ভুলের পরিণাম ভুলকারীর নিজেকে ভুগতে হয়, আবার কখনো কখনো তা অন্যদের মাঝেও সংক্রমিত হয়। প্রথমটির উদাহরণ হিসাবে আবুদাঊদ (রহঃ) কর্তৃক তার সুনানে বর্ণিত হাদীছ উল্লেখ করা যায়। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ رَجُلاً لَعَنَ الرِّيحَ وَقَالَ مُسْلِمٌ إِنَّ رَجُلاً نَازَعَتْهُ الرِّيْحُ رِدَاءَهُ عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَعَنَهَا فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ تَلْعَنْهَا فَإِنَّهَا مَأْمُوْرَةٌ وَإِنَّهُ مَنْ لَعَنَ شَيْئًا لَيْسَ لَهُ بِأَهْلٍ رَجَعَتِ اللَّعْنَةُ عَلَيْهِ-

‘এক ব্যক্তি বাতাসকে অভিশাপ দিয়েছিল। মুসলিমের বর্ণনানুসারে এক ব্যক্তির চাদর বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে লোকটি বাতাসকে অভিশাপ দেয়। এ ঘটনা ঘটেছিল নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে। তিনি লোকটিকে ডেকে বলেছিলেন, তুমি তাকে অভিশাপ দিয়ো না, কেননা সে আদিষ্ট হয়ে একাজ করেছে। জেনে রাখ, যে জিনিস অভিশাপ দেওয়ার উপযুক্ত নয় তাকে যে অভিশাপ দিবে ঐ অভিশাপ তার উপরেই বর্তাবে’।[10]

অন্যদের মাঝে ভুলের পরিণাম সংক্রমিত হওয়ার উদাহরণ হিসাবে ছহীহ বুখারী বর্ণিত হাদীছ উল্লেখ করা চলে। আব্দুর রহমান বিন আবী বাকরা (রাঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন,  তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে আরেক ব্যক্তির প্রশংসা করল। (মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে), লোকটি বলল,يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا مِنْ رَجُلٍ بَعْدَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَفْضَلُ مِنْهُ فِىْ كَذَا وَكَذَا ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই এই গুণে বা ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে তার মত কোন মানুষ নেই।[11]

তিনি শুনে বললেন, কি সর্বনাশ! তুমি যে তোমার সাথীর গলা কেটে দিলে! তুমি যে তোমার সাথীর গলা কেটে দিলে!! কথাটি তিনি কয়েকবার বললেন। তারপর তিনি বললেন, مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَادِحًا أَخَاهُ لاَ مَحَالَةَ فَلْيَقُلْ أَحْسِبُ فُلاَنًا، وَاللهُ حَسِْيبُهُ، وَلاَ أُزَكِّى عَلَى اللهِ أَحَدًا، أَحْسِبُهُ كَذَا وَكَذَا إِنْ كَانَ يَعْلَمُ ذَلِكَ مِنْهُ ‘তোমাদের কাউকে যদি তার কোন ভাইয়ের প্রশংসা করতেই হয় তাহ’লে সে যেন বলে, আমি অমুকের সম্পর্কে এই এই ধারণা পোষণ করি। আর আল্লাহই তার হিসাব গ্রহণকারী। আমি আল্লাহর নিকটে কাউকে নির্দোষ বলছি না। এসব কথাও সে বলবে যদি তার ঐ লোক থেকে তার কথিত গুণাবলী নিশ্চিত জানা থাকে’।[12] ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ গ্রন্থে মিহজান আল-আসলামী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,

حَتَّى إِذَا كُنَّا فِي الْمَسْجِدِ، رَأَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلاً يُصَلِّيْ، وَيَسْجُدُ، وَيَرْكَعُ، فَقَالَ لِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ هَذَا؟ فَأَخَذْتُ أُطْرِيْهِ، فَقُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ، هَذَا فُلاَنٌ، وَهَذَا. فَقَالَ أَمْسِكْ، لَا تُسْمِعْهُ فَتُهْلِكَهُ-

‘এমনি করে আমরা যখন মসজিদে পৌঁছলাম তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক লোককে দেখলেন সে (অনবরত) ছালাত আদায় করছে- সিজদা করছে, রুকূ করছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন আমাকে বললেন, এই লোকটা কে? আমি তখন লোকটার বেশী বেশী প্রশংসা করতে লাগলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইনি অমুক, ইনি এই এই গুণের অধিকারী’।[13] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি থাম, তুমি তাকে শুনিয়ে বল না, তাহ’লে তাকে ধ্বংস করে ছাড়বে’।[14]

বুখারীর এক বর্ণনায় আছে, আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, سَمِعَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيَهِ وَسَلَّمَ رَجُلاً يُثْنِى عَلَى رَجُلٍ، وَيُطْرِيْهِ فِىْ مَدْحِهِ فَقَالَ أَهْلَكْتُمْ  أَوْ قَطَعْتُمْ ظَهْرَ الرَّجُلِ ‘নবী করীম (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে শুনলেন, সে আরেক ব্যক্তির প্রশংসা করছে এবং সে প্রশংসাও বাড়াবাড়ি রকমের করছে। তিনি তাকে বললেন, তোমরা লোকটাকে ধ্বংস করে দিলে। অথবা (তিনি বললেন,) তোমরা তার পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করলে’।[15]

এই ছাহাবীর মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসার পরিণাম কি দাঁড়াতে পারে তা মহানবী (ছাঃ) এখানে বর্ণনা করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসায় প্রশংসিত ব্যক্তির মন প্রতারণার শিকার হয়। তার মধ্যে হামবড়া ভাব জন্মে এবং নিজেকে দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে হয়। অনেক সময় প্রশংসার খ্যাতিরে সে আমল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে অথবা প্রশংসার মজা পেয়ে লোক দেখিয়ে আমল করতে শুরু করে। এভাবেই সে তার ধ্বংস ডেকে আনে- যা নবী করীম (ছাঃ)-এর ভাষায় ‘তোমরা তাকে ধ্বংস করলে’, ‘তোমরা লোকটার গলা কেটে দিলে’, ‘লোকটার পিঠে ছুরিকাঘাত করলে’।

অনেক সময় প্রশংসাকারী প্রশংসা করতে গিয়ে বেফাঁশ কথা বলে বসে। ভালমত নিশ্চিত না হয়ে সে প্রশংসা করে এবং যা জানা সম্ভব নয় তেমন কিছু জানার জোর দাবী করে। এভাবে সে মিথ্যাচার করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসিত ব্যক্তি যা নয় তাই বলে সে প্রশংসা করে। এ এক বড় মুছীবত। বিশেষত প্রশংসিত ব্যক্তি যদি যালিম, ফাসিক ইত্যাদি হয়।[16]

তবে সম্মুখ প্রশংসা মোটের উপর নিষিদ্ধ নয়। নবী করীম (ছাঃ) অনেক লোকেরই সামনাসামনি প্রশংসা করেছেন। ছহীহ মুসলিমের অনুচ্ছেদের শিরোনাম থেকে এ কথা স্পষ্ট বুঝা যায়। যথা- অনুচ্ছেদ : ‘প্রশংসা করা নিষেধ যখন তাতে থাকবে বাড়াবাড়ি এবং ভয় হবে যে, প্রশংসিত ব্যক্তি তাতে ফিতনার শিকার হবে’। অধ্যায় : ‘যুহদ ও রাকায়েক বা সাদামাটা জীবন যাপন এবং আল্লাহর ভয় ও ভালবাসায় বিনম্র থাকা’।

সুতরাং যে নিজেকে তুচ্ছ ভেবে আত্মসংবরণ করতে পারবে সামনাসামনি প্রশংসা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। প্রশংসার কারণে সে ধোঁকায়ও পড়বে না। কেননা সে তো নিজের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে খুব অবগত। জনৈক পূর্বসূরি বলেছেন, যখন কাউকে সামনাসামনি প্রশংসা করা হয় তখন যেন সে বলে اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ مَا لاَ يَعْلَمُوْنَ وَلاَ تُؤَاخِذنِيْ بِمَا يَقُوْلُوْنَ وَاجْعَلْنِيْ خَيْرًا مِمَّا يَظُنُّوْنَ ‘হে আল্লাহ! এই লোকগুলো আমার যেসব পাপ-পংকিলতা সম্পর্কে জানে না, সেগুলো থেকে তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তারা যা বলছে সে জন্য তুমি আমাকে পাকড়াও করো না এবং আমাকে তাদের ধারণার থেকেও ভাল মানুষ বানাও’।[17]

(১১) ভুলকারীকে হাতে কলমে বা ব্যবহারিকভাবে শিক্ষাদান :

অনেক সময় ভাষা ও যুক্তির সাহায্যে শিক্ষাদান থেকে হাতে কলমে ব্যবহারিক শিক্ষাদানে বেশী উপকার হয়। নবী করীম (ছাঃ) এমন শিক্ষা দিয়েছেন। জুবায়ের বিন নুফায়ের কর্তৃক তার পিতা থেকে বর্ণিত, সে (নুফায়ের) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এলে তিনি তাকে ওযূর পানি আনতে আদেশ দিলেন। তারপর তাকে বললেন, হে জুবায়েরের পিতা! ওযূ করো। তখন আবু জুবায়ের তার মুখ ধোয়া থেকে ওযূ শুরু করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, আবু জুবায়ের, মুখ ধোয়া থেকে ওযূ শুরু করো না। কেননা কাফিররা এমনটা করে। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওযূর পানি আনতে বললেন। তিনি তা দ্বারা প্রথমে তাঁর দু’হাতের তালু (কব্জি পর্যন্ত) ভালমত পরিস্কার করে ধুলেন, তারপর তিনবার কুলি করলেন, তিনবার নাকে পানি দিলেন, তিনবার মুখমন্ডল ধুলেন, কনুই পর্যন্ত তাঁর ডান হাত তিনবার ধুলেন, বাম হাতও (কনুই পর্যন্ত) তিনবার ধুলেন, তারপর মাথা মাসাহ করলেন এবং তাঁর দু’পা (টাখনুর উপর পর্যন্ত তিনবার করে) ধুলেন।[18]

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ছাহাবী সঠিকভাবে না করে ভুল নিয়মে ওযূ করায় নবী করীম (ছাঃ) যখন বলছিলেন, ‘কাফিররা মুখ ধোয়া থেকে শুরু করে’ তখন একথা দ্বারা তিনি ঐ ছাহাবীকে কাফিরদের কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছেন। সম্ভবতঃ কাফিররা পানির পাত্রে হাত ঢুকানোর আগে তা ধুয়ে নেয় না। এভাবে ওযূ করায় পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। লেখক বলেন, শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ)-কে এই হাদীছের অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যা শুনিয়েছিলেন।

(১২) সঠিক বিকল্প তুলে ধরা :

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করতাম তখন বলতাম,السَّلاَمُ عَلَى اللهِ مِنْ عِبَادِهِ السَّلاَمُ عَلَى فُلاَنٍ وَفُلاَنٍ ‘আল্লাহর উপর তার বান্দাদের থেকে সালাম বর্ষিত হোক, সালাম হোক অমুকের উপর, অমুকের উপর।[19] এতে নবী করীম (ছাঃ) আমাদের বললেন, لاَ تَقُولُوا السَّلاَمُ عَلَى اللهِ فَإِنَّ اللهَ هُوَ السَّلاَمُ، وَلَكِنْ قُولُوا التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ السَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ، السَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ. فَإِنَّكُمْ إِذَا قُلْتُمْ أَصَابَ كُلَّ عَبْدٍ فِى السَّمَاءِ أَوْ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، ثُمَّ يَتَخَيَّرُ مِنَ الدُّعَاءِ أَعْجَبَهُ إِلَيْهِ فَيَدْعُو- ‘তোমরা আল্লাহর উপর সালাম বলো না। কেননা আল্লাহই তো সালাম বা শান্তি দাতা’। তোমরা বরং বলবে, সব রকম মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার উপর শান্তি, আল্লাহর দয়া ও কল্যাণ বর্ষিত হোক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেককার বান্দাদের উপর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি এ সাক্ষ্যও দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তার বান্দা ও রাসূল’।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেককার বান্দাদের উপর) বলার পর বলেছিলেন, তোমরা যখন এ কথা উচ্চারণ করবে তখনই তা আসমান ও যমীনের মাঝে সকল বান্দা পেয়ে যাবে। আত্তাহিয়্যাতু পড়ার পর বান্দা তার পসন্দমত যে কোন দো‘আ নির্বাচন করে (আল্লাহর কাছে) দো‘আ করবে।[20]

এ বিষয়ে আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى نُخَامَةً فِى الْقِبْلَةِ، فَشَقَّ ذَلِكَ عَلَيْهِ حَتَّى رُئِىَ فِىْ وَجْهِهِ، فَقَامَ فَحَكَّهُ بِيَدِهِ فَقَالَ : إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ فِىْ صَلاَتِهِ، فَإِنَّهُ يُنَاجِىْ رَبَّهُ أَوْ إِنَّ رَبَّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْقِبْلَةِ فَلاَ يَبْزُقَنَّ أَحَدُكُمْ قِبَلَ قِبْلَتِهِ، وَلَكِنْ عَنْ يَسَارِهِ، أَوْ تَحْتَ قَدَمَيْهِ. ثُمَّ أَخَذَ طَرَفَ رِدَائِهِ فَبَصَقَ فِيْهِ، ثُمَّ رَدَّ  بَعْضَهُ عَلَى بَعْضٍ، فَقَالَ : أَوْ يَفْعَلْ هَكَذَا- ‘নবী করীম (ছাঃ) কিবলার দিকে মসজিদের গায়ে পোঁটা লেগে থাকতে দেখলেন। এ দৃশ্য তাঁর মনকে এতটাই ব্যথিত করে যে, ব্যথার প্রভাব তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে। তিনি উঠে গিয়ে নিজ হাতে খামচিয়ে তা ছাফ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন স্বীয় ছালাতে দাঁড়ায় তখন সে মূলত: তার প্রভুর সাথে একান্তে কথা বলে। তার প্রভু তখন তার ও কিবলার মাঝে থাকেন। সুতরাং তোমাদের কেউই যেন কিবলার দিকে কফ-থুতু নিক্ষেপ না করে। তার বাম দিকে অথবা দু’পায়ের তলায় ফেলতে পারে। তারপর তিনি তাঁর চাদরের এক কোণা ধরে তাতে থুতু ফেললেন এবং চাদরের অন্য অংশ ঐ থুতুর উপরে ডলে দিলেন। তারপর বললেন, অথবা এভাবেও সে করতে পারে’।[21] অন্য বর্ণনায় আছে,لاَ يَتْفِلَنَّ أَحَدُكُمْ بَيْنَ يَدَيْهِ وَلاَ عَنْ يَمِينِهِ، وَلَكِنْ عَنْ يَسَارِهِ أَوْ تَحْتَ رِجْلِهِ- ‘তোমাদের কেউ যেন তার সামনে ও ডানে থুতু না ফেলে, বরং তার বামে অথবা পায়ের তলায় ফেলে’।[22]

আরেকটি দৃষ্টান্ত : আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,جَاءَ بِلاَلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِتَمْرٍ بَرْنِىٍّ فَقَالَ لَهُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مِنْ أَيْنَ هَذَا. قَالَ بِلاَلٌ كَانَ عِنْدَنَا تَمْرٌ رَدِىٌّ، فَبِعْتُ مِنْهُ صَاعَيْنِ بِصَاعٍ، لِنُطْعِمَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم عِنْدَ ذَلِكَ أَوَّهْ أَوَّهْ عَيْنُ الرِّبَا عَيْنُ الرِّبَا، لاَ تَفْعَلْ، وَلَكِنْ إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تَشْتَرِىَ فَبِعِ التَّمْرَ بِبَيْعٍ آخَرَ ثُمَّ اشْتَرِهِ- ‘বেলাল (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট বারনী খেজুর নিয়ে এলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, এ জাতীয় খেজুর কোত্থেকে পেলে? তিনি বললেন, আমাদের কাছে কিছু খারাপ মানের খেজুর ছিল। আমরা নবী করীম (ছাঃ)-কে খাওয়াব বলে তার দু’ছা‘-এর বদলে এই খেজুর এক ছা‘ কিনেছি। নবী করীম (ছাঃ) একথা শুনে বললেন, হায়! হায়! এতো সরাসরি সূদ। হায়, হায়! এতো সরাসরি সূদ! এমনটা করো না। তবে তুমি যখন নিকৃষ্ট খেজুরের বদলে ভাল খেজুর কিনতে চাইবে তখন তোমার খেজুর বিক্রি করে দিবে। তারপর এই খেজুর কিনবে’।[23]  অন্য বর্ণনায় আছে,

أَنَّ غُلاَماً لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَتَاهُ ذَاتَ يَوْمٍ بِتَمْرٍ رَيَّانَ وَكَانَ تَمْرُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بَعْلاً فِيْهِ يُبْسٌ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَنَّى لَكَ هَذَا التَّمْرُ. فَقَالَ هَذَا صَاعٌ اشْتَرَيْنَاهُ بِصَاعَيْنِ مِنْ تَمْرِنَا. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ تَفْعَلْ فَإِنَّ هَذَا لاَ يَصْلُحُ وَلَكِنْ بِعْ تَمْرَكَ وَاشْتَرِ مِنْ أَىِّ تَمْرٍ شِئْتَ-

‘একদিন নবী করীম (ছাঃ)-এর এক দাস তাঁর নিকটে রাইয়ান খেজুর নিয়ে আসে। নবী করীম (ছাঃ)-এর খেজুর ছিল ভেজা-শুকনা মেশানো। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, এ খেজুর তুমি কোথায় পেলে? সে বলল, আমাদের দু’ছা‘ খেজুর দিয়ে এর এক ছা‘ আমরা কিনেছি। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এটা করো না, এমনভাবে কেনা বৈধ নয়। তুমি বরং তোমার খেজুর বিক্রি করে দিবে, তারপর ঐ অর্থ দিয়ে তোমার পসন্দমত খেজুর কিনে নিবে’।[24]

আমরা বাস্তবে সৎকাজের আদেশদাতা ও অসৎ কাজের নিষেধকর্তা এমন অনেক প্রচারককে দেখতে পাই, যারা কোন কোন মানুষের ভুল-ভ্রান্তি ধরতে গিয়ে ত্রুটি করে ফেলে। তারা কেবল ভুল ধরা আর হারামের ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। তারা হারামের বিকল্প তুলে ধরে না কিংবা ভুল হয়ে গেলে কি করা আবশ্যক তা বলে না। অথচ এটি সুবিদিত যে, যে কোন হারাম উপকারের বদলে হালাল উপকারের পন্থা শরী‘আতে রয়েছে। যখন ব্যভিচার হারাম করা হয়েছে তখন বিবাহ বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, যখন সূদ হারাম ঘোষিত হ’ল তখন ব্যবসা হালাল রাখা হ’ল, আবার যখন শূকর, মৃত জীব এবং প্রত্যেক হিংস্র পশু-পাখি হারাম করা হ’ল তখন জাবরকাটা অনেক চতুষ্পদ প্রাণী হালাল করা হ’ল। এমন দৃষ্টান্ত আরো অনেক রয়েছে। তারপর মানুষ যদি কোন হারামে জড়িয়ে পড়ে তাহ’লে শরী‘আত তাকে তওবা ও কাফফারার মাধ্যমে তার থেকে বের হওয়ার পথও তৈরী করে রেখেছে। কাফফারা বিষয়ক আয়াত ও হাদীছ থেকে তা বুঝা যায়। সুতরাং প্রচারকদের উচিত শরী‘আতের সমান্তরালে বিকল্পসমূহ তুলে ধরা এবং পাপ ও ভুল থেকে নির্গমনের শরী‘আতসম্মত উপায় বর্ণনা করা। বিকল্প তুলে ধরার উদাহরণ যেমন ছহীহ হাদীছ বর্ণনা করা, যা থাকতে দুর্বল ও জাল হাদীছের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আসলে শরী‘আতের প্রতিটি বিষয়ে পর্যাপ্ত ছহীহ হাদীছ রয়েছে। সুতরাং ছহীহ হাদীছ থাকতে জাল-যঈফ হাদীছ বলার মোটেও প্রয়োজন নেই।

তবে হারাম বা নিষিদ্ধের বিপরীতে বৈধ বিকল্প তুলে ধরতে হবে শক্তি-সামর্থ্য অনুসারে। কখনো এমন হয় যে বিষয়টা ভুল- তাকে বাধা দেওয়া অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবে তার উপযোগী বিকল্প মিলছে না। না মেলার কারণ হয়তো মানুষ আল্লাহর বিধান মানা থেকে অনেক দূরে, ফলে পরিবেশ হয়ে পড়েছে বিশৃঙ্খল। অথবা আদেশদাতা ও নিষেধকারীর কোন বিকল্প মনে আসছে না। কিংবা বর্তমানে যেসব বিকল্প মজুদ রয়েছে তার কোন্টার ভিত্তিতে সে নিষেধ করবে ও ভুল শুধরাবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। অমুসলিম কাফিরদের দেশে উৎপন্ন বিভিন্ন আর্থিক কারবার, লাভজনক সংস্থা যা সেসব দেশ থেকে মুসলিম দেশগুলোতে আগমন করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে এমন সমস্যা বেশী দেখা দিচ্ছে। কেননা এসব কারবার ও সংস্থা শরী‘আতের নিয়মনীতির পরিপন্থী। আবার মুসলমানদের মধ্যেও রয়েছে জ্ঞানের স্বল্পতা ও সার্বিক দুর্বলতা। ফলে তারা সেসব অবৈধ কারবার ও সংস্থার বিকল্প কিছু গড়ে তুলতে পারছে না। অবস্থাতো এই যে, মুসলমানদের মাঝে বিরাজ করছে দুর্বলতা ও অক্ষমতা, তারা এসবের শারঈ সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ শরী‘আতে ঠিকই এগুলোর বিকল্প সমাধান রয়েছে। যা মুসলমানদের কষ্ট লাঘব করতে পারে এবং সংকট দূর করতে পারে। বিষয়টা যে জানে সে জানে, আর যে জানে না সে জানে না।

(১৩) ভুল করা থেকে বিরত থাকার উপায় বলে দেওয়া :

আবু উমামা বিন সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তার পিতা তাকে বর্ণনা করে শুনিয়েছেন যে, (একবার) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা যাত্রা করেছিলেন। ছাহাবীগণও তাঁর সাথে ছিলেন। তারা জুহফা নামক স্থানের খাযযার গিরিপথে ডেরা ফেলেন। সেখানে সাহল বিন হুনাইফ গোসল করতে আরম্ভ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ফর্সা রূপবান সুপুরুষ। তখন বনু আদী বিন কা‘ব গোত্রীয় আমের বিন রবি‘আ তার দিকে তাকায়। সেও সেখানে গোসল করছিল। তাকে দেখে সে বলে উঠল, আজকের মত এমন সুশ্রী চেহারার মানুষ আমি আর দেখিনি, এমনকি পর্দানশীন শ্বেতকায় কোন কুমারী মেয়েও এর কাছে কিছু না। এ কথা বলার সাথে সাথে সাহল বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট হাযির করা হ’ল। তাঁকে বলা হ’ল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সাহলের বিষয়ে আপনি কি কিছু করবেন? সে তো মাথা তুলতে পারছে না, আর তার হুঁশ-জ্ঞানও নেই। তিনি বললেন, তার ব্যাপারে কি তোমাদের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে? তারা বলল, আমের বিন রাবী‘আহ তার দিকে চোখ করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমেরকে ডেকে উষ্মা প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ তার ভাইকে কি জন্য মেরে ফেলবে? তুমি যখন তার কিছু দেখে বিস্মিত হ’লে তখন তার জন্য কেন বরকতের দো‘আ করলে না কেন? (অর্থাৎ কারো সুন্দর চেহারা দেখে বরকত বা কল্যাণের দো‘আ করলে নযর লাগার মত ভুল থেকে বাঁচা যায়)। তারপর তিনি তাকে বললেন, তুমি ওর জন্য গোসল করো। সে তখন একটা বড় পাত্রের মধ্যে তার মুখমন্ডল, দু’হাত, দুই কনুই, দুই হাঁটু, দু’পায়ের চারিপাশ এবং দেহের লুঙ্গি আচ্ছাদিত অংশ ধুয়ে গোসল করল। গোসলের এই ধরা পানি সাহলের দেহে ঢেলে দেওয়া হ’ল। একজন লোক ঐ পানি তার মাথায় ও পেছন থেকে পিঠে ঢেলে দিল। তার পেছন দিকেই পাত্রটা উপুড় করে ধরল। এতে করে সাহল সুস্থ হয়ে উঠল এবং লোকদের সাথে এমনভাবে চলল যেন তার কোন অসুখই নেই’।[25]

ইমাম মালেক মুহাম্মাদ বিন আবু উমামা বিন সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি তার পিতাকে বলতে শুনেছেন যে, আমার পিতা সাহল বিন হুনাইফ খাররারে (খাযযারে) গোসল করতে গিয়েছিলেন। তার গায়ে যে জুববা ছিল তিনি তা খুলছিলেন। আমের বিন রাবী‘আহ গভীর মনোনিবেশে তা দেখছিল। সাহল ছিলেন শ্বেতকায় সুন্দর চামড়া বিশিষ্ট। তাকে দেখে আমের বিন রাবী‘আহ বলে ওঠে, কোন কুমারী মেয়েকেও আমি এত সুশ্রী রূপসী দেখিনি। একথা বলার সাথে সাথে সাহল সেখানে পড়ে গোঙাতে থাকেন। তার গোঙানি বেড়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে তাকে নিয়ে আসা হ’ল। তাঁকে বলা হ’ল, সাহল অসুস্থ হয়ে গোঙাচ্ছে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সাথে যাওয়ার মত অবস্থা তার নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার কাছে আসলেন। সাহল আমেরের সাথে যা হয়েছে তা তাঁকে বলা হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, তোমাদের কেউ তার ভাইকে কি জন্য মেরে ফেলবে? তুমি তার কল্যাণ চেয়ে দো‘আ করলে না কেন? কু-নযর বা কু-দৃষ্টি সত্য। তুমি তার জন্য ওযূ কর। আমের তার জন্য ওযূ করল। তারপর সাহল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে যাত্রা করলেন- যেন তার কোন অসুখ হয়নি।[26] এই ঘটনায় যেসব শিক্ষা পাওয়া যায় :

১. মুসলিম ভাইয়ের কষ্ট দেওয়ার কারণ যে ব্যক্তি তার উপর মুরববী বা বড় মানুষদের ক্ষোভ প্রকাশ করা।

২. ভুলের ক্ষতি বর্ণনা করা। তা অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে।

৩. যে কাজ করলে বা যে কথা বললে ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া এবং মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচা যায় তার নির্দেশ প্রদান করা।                                        [চলবে]

 

 


[1]. তাফসীর বিনু জারীর তাবারী (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ ১৪১২ হিঃ) ১৪/৩৩৩ পৃঃ।

[2]. আছ-ছহীহুল মুসনাদ মিন আসবাবিন নুযূল, পৃঃ ৭১

[3]. আবুদাঊদ হা/২২৮৬; আলবানী ছহীহ আবুদাঊদে এটিকে ছহীহ বলেছেন, হা/২২৮৮।

[4]. আহমাদ হা/১৭৭৭১, সনদ ছহীহ

[5]. আওনুল মা‘বূদ ৭/২৯২ পৃঃ

[6]. দলীলুল ফালেহীন ৬/১৩০ পৃঃ

[7]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১৭

[8]. মুসলিম হা/৪৩৬

[9]. আল-মুজতাবা ২/৯২; নাসাঈ হা/৮১৫, সনদ ছহীহ

[10]. আবুদাঊদ হা/৪৯০৮, সনদ ছহীহ; ছহীহ আবুদাঊদ হা/৪১০২

[11]. ছহীহ মুসলিম হা/৩০০০

[12]. বুখারী হা/২৬৬২, ‘সাক্ষ্য’ অধ্যায়

[13]. আল-আদাবুল মুফরাদের আরেক বর্ণনায় আছে- ইনি অমুক, ইনি মদীনাবাসীদের মধ্যে সর্বোত্তম ছালাত আদায়কারী। আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩৪১, সনদ হাসান

[14]. ছহীহ আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১৩৭; আলবানী বলেছেন, হাদীছটি হাসান; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩৩৪, সনদ ছহীহ

[15]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৬৬৩

[16]. ফাতহুল বারী ১০/৪৭৮, সরকারী ক্ষমতাশীলদের স্তাবকরা হরহামেশাই তাদের এরূপ প্রশংসা করে। ফলে দেশ ও জনগণের অবস্থা যেমন তাদের গোচরীভূত হয় না, তেমনি অসত্যের উপর অবিচল থেকে দিন দিন তাদের দাম্ভিকতা বাড়তে থাকে। প্রকৃত সত্য কেউ তুলে ধরলে তারা তা মোটেও মানতে রাযী হয় না, উল্টো ঐ সত্যবাদীর উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ- অনুবাদক।

[17]. ফাৎহুল বারী ১০/৪৭৮

[18]. সুনানুল বায়হাকী ১/৪৬, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮২০

[19]. নাসাঈর বর্ণনায় আছে সালাম হোক জিবরীলের উপর, সালাম হোক মিকাইলের উপর ‘কিভাবে প্রথম তাশাহহুদ পড়তে হবে’ অনুচ্ছেদ। দ্রঃ নাসাঈ হা/১২৯৮, সনদ ছহীহ

[20]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৮৩৫

[21]. বুখারী, ফাৎহুল বারী ৪০৫

[22]. বুখারী, ফাৎহুল বারী ৪১২

[23]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৩১২

[24]. মুসনাদ আহমাদ হা/১১৬৫৮, সনদ ছহীহ

[25]. আহমাদ হা/১৬০২৩, হাদীছ ছহীহ

[26]. মুওয়াত্ত্বা, হা/১৯৭২।   





বিষয়সমূহ: জীবন কথা
কুরআন ও সুন্নাহর বিশ্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের ভূমিকা - শেখ ইমরান ইবনু মুয্যাম্মিল
শোকর (প্রথম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
কবিগুরুর অর্থকষ্টে জর্জরিত দিনগুলো - ড. গুলশান আরা
রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আলেমগণের অগ্রণী ভূমিকা - ড. নূরুল ইসলাম
সফরের আদব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ঈদের ছয় তাকবীরের পক্ষে উপস্থাপিত দলীল সমূহ পর্যালোচনা - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
জান্নাতের পথ - ড. নূরুল ইসলাম
মানবাধিকার ও ইসলাম - শামসুল আলম
আরও
আরও
.