জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবার ব্যাপারে বিদ্বানগণের অভিমত :
নির্ভরযোগ্য সকল বিদ্বান জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বরং তারা মনে করেন, ইমাম মিম্বারে উঠার পূর্বে সাধ্যানুযায়ী নফল ছালাত আদায় করতে থাকবে।
হাফেয ইরাকী (রহঃ) জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা হিসাবে ছালাত আদায় বিদ‘আত হওয়ার বিষয়টি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন,لم ينقل عن النبي أنه كان يصلي قبل الجمعة ‘জুম‘আর পূর্বে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক ছালাত আদায়ের ব্যাপারে কিছু বর্ণিত হয়নি’।[1]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, فَإِنَّهُ لَمْ يَكُنْ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ بَعْدَ الْأَذَانِ شَيْئًا وَلَا نَقَلَ هَذَا عَنْهُ أَحَدٌ فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يُؤَذَّنُ عَلَى عَهْدِهِ إلَّا إذَا قَعَدَ عَلَى الْمِنْبَرِ وَيُؤَذِّنُ بِلَالٌ ثُمَّ يَخْطُبُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْخُطْبَتَيْنِ ثُمَّ يُقِيمُ بِلَالٌ فَيُصَلِّي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالنَّاسِ فَمَا كَانَ يُمْكِنُ أَنْ يُصَلِّيَ بَعْدَ الْأَذَانِ لَا هُوَ وَلَا أَحَدٌ مِنْ الْمُسْلِمِينَ الَّذِينَ يُصَلُّونَ مَعَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ‘রাসূল (ছাঃ) জুম‘আর পূর্বে এবং আযানের পরে কোন ছালাত আদায় করতেন না। তাঁর থেকে এ মর্মে কেউ বর্ণনাও করেননি। নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে কেবল একটিই আযান দেওয়া হ’ত যখন তিনি মিম্বারে বসতেন। বেলাল (রাঃ) আযান দিতেন এবং নবী করীম (ছাঃ) দু’টি খুৎবা দিতেন। অতঃপর বেলাল (রাঃ) ইক্বামত দিতেন আর নবী করীম (ছাঃ) লোকদের ছালাতে ইমামতি করতেন। তাঁর পক্ষে বা তাঁর সাথে ছালাত আদায়কারী মুসলমানদের কারো পক্ষে আযানের পরে সুন্নাত ছালাত আদায় করা সম্ভব ছিল না।[2] ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর এ বিষয়ের উপর নাতিদীর্ঘ একটি পুস্তিকা রয়েছে যাতে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, জুম‘আর ছালাতের পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা নামে কোন ছালাত নেই।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,وَكَانَ إِذَا فَرَغَ بلال مِنَ الْأَذَانِ، أَخَذَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْخُطْبَةِ وَلَمْ يَقُمْ أَحَدٌ يَرْكَعُ رَكْعَتَيْنِ الْبَتَّةَ، وَلَمْ يَكُنِ الْأَذَانُ إِلَّا وَاحِدًا، وَهَذَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ الْجُمُعَةَ كَالْعِيدِ لَا سُنَّةَ لَهَا قَبْلَهَا، وَهَذَا أَصَحُّ قَوْلَيِ الْعُلَمَاءِ، ‘বেলাল (রাঃ) আযান শেষ করলে নবী করীম (ছাঃ) খুৎবা শুরু করতেন। কেউ কখনো দু’রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করতেন না। আর তখন একটিই আযান ছিল। আর এটা প্রমাণ করে যে, ঈদের মতই জুম‘আর পূর্বের ছালাতের বিধান। এর পূর্বে কোন সুন্নাত ছালাত নেই। আর এটাই বিদ্বানগণের অভিমতগুলোর মধ্যে অধিকতর বিশুদ্ধ’।[3] অতঃপর তিনি বলেন, এরপরেও যারা মনে করে যে, রাসূল (ছাঃ) বা তাঁর ছাহাবীগণ এর মধ্যে দুই বা চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করেছেন তারা সুন্নাতের ব্যাপারে বড়ই অজ্ঞ।[4]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,وَأَمَّا سُنَّةُ الْجُمُعَةِ الَّتِي قَبْلَهَا فَلَمْ يَثْبُتْ فِيهَا شَيْءٌ، ‘আর জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা, যার ব্যাপারে কোন কিছু সাব্যস্ত হয়নি’।[5]
আল্লামা শানক্বীতী (রহঃ) বলেন,والخلاصة من هذا أن للجمعة راتبة، وتختص راتبتها بالبعدية، وليس للجمعة راتبة قبلية، ‘মোদ্দাকথা হ’ল জুম‘আর জন্য সুন্নাতে রাতেবা রয়েছে। আর তা জুম‘আর পরের সাথে খাছ। জুম‘আর ছালাতের পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা নেই’।[6]
তিনি বিরোধীদের মতামত উল্লেখ করার পর বলেন, ‘আর শক্তিশালী অভিমত সেটিই যাকে সুন্নাত সমর্থন করে। আর তা হ’ল তিনি জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা ছালাত আদায় করেননি। কিন্তু লোকদের জন্য উত্তম ও সুন্নাত হ’ল যখন তারা জুম‘আর পূর্বে মসজিদে যাবে তখন অধিকহারে নফল ছালাত আদায় করবে’।[7]
শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘জুম‘আর ছালাত যার পূর্বে কোন সুন্নাতে রাতেবা নেই। বরং যে লোক মসজিদে হাযির হবে সে সাধ্যমত অনির্ধারিত সংখ্যক ছালাত আদায় করবে। ইচ্ছামত দুই, চার বা ছয় রাক‘আত ছালাত পড়বে। প্রথম ও দ্বিতীয় আযানের মাঝে কিছু লোক যা করে থাকে তার কোন ভিত্তি নেই এবং তা শরী‘আত সম্মতও নয়’।[8]
শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) বলেন,قد دلت سنة رسول الله عليه الصلاة والسلام على أنه ليس للجمعة سنة راتبة قبلها، ولكن المؤمن متى وصل إلى المسجد يصلي ما كتب الله له، يصلي ثنتين أو أكثر لقوله صلى الله عليه وسلم في الحديث الصحيح: من اغتسل يوم الجمعة، ثم أتى المسجد فصلى ما قدر الله له، ‘রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত প্রমাণ করে যে, জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা নেই। কিন্তু মুমিন যখন মসজিদে পৌঁছবে আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তা আদায় করবে। সে দুই বা ততোধিক রাক‘আত আদায় করবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) বিশুদ্ধ হাদীছে বলেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুম‘আর ছালাত আদায় করতে এসেছে এবং আল্লাহ তার জন্য যতটুকু নির্ধারণ করেছেন ততটুকু আদায় করেছে’।[9] তিনি আরো বলেন, ‘মোদ্দাকথা নবী করীম (ছাঃ) রাক‘আত সংখ্যার ব্যাপারে কোন কিছু নির্ধারণ করেননি। তিনি বিভিন্ন হাদীছে বলেছেন, ‘যতটুকু সম্ভব হয়েছে ছালাত আদায় করেছে’। অতএব লোকেরা জুম‘আর পূর্বে সাধ্যানুযায়ী দুই বা ততোধিক রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। এরপরে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বা চুপ থেকে বা তাসবীহ, তাহলীল ও যিকির-আযকারের মাধ্যমে আযানের অপেক্ষা করবে।[10] আযান হ’লে আযানের জওয়াব দিবে অতঃপর খুৎবা শ্রবণ করবে।
শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র একটি রিসালাহ লিখেছেন। যাতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা নামে কোন ছালাত নেই। তিনি তাতে বিরোধীদের পক্ষে উপস্থাপিত দলীলগুলোর সুন্দর পর্যালোচনা করেছেন এবং সূক্ষ্মভাবে খন্ডন করেছেন। তিনি বলেন,وهو أنه لا أصل لهذه السنة الصحيحة ولا مكان لها فيها فقد علمت من الأحاديث المتقدمة أن الزوال فالأذان فالخطبة فالصلاة سلسلة متصلة، ‘জুম‘আর দিনে এই বিশুদ্ধ সুন্নাতের কোন ভিত্তি নেই এবং এর জন্য স্থান বা সময় নির্ধারিত নয়। কারণ পূর্বের হাদীছগুলো থেকে জানা গেল যে, সূর্য ঢলে গেলে আযান হ’ত। আযান শেষে খুৎবা তারপরেই ছালাত যা ধারাবাহিকভাবে চলমান ছিল’।[11]
তিনি ইমাম ত্বহাবীর ধারণা প্রসূত উক্তি উল্লেখ করে আরো বলেন,فهذا اعتراف ضمني بأن السنة القبلية المزعومة لم تكن معروفة في العهد النبوي وأن الصحابة كانوا لا يصلونها لأنه لم يكن آنئذ الوقت الذي يتمكنون فيه من أدائها وهذا أمر صحيح، ‘পরোক্ষভাবে এটা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যে, জুম‘আর পূর্বে ধারণাকৃত সুন্নাত রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে প্রচলিত ছিল না। আর ছাহাবায়ে কেরামও এই ছালাত আদায় করতেন না। কারণ আদায় করার জন্য যে সময় প্রয়োজন
সেটা পাওয়া সম্ভব ছিল না। আর এটাই বিশুদ্ধ’।[12]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, জুম‘আর দিনে মুছল্লীরা সকাল সকাল মসজিদে গিয়ে নফল ছালাত, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার ও দো‘আর মাধ্যমে ইমামের মিম্বারে আরোহণের জন্য অপেক্ষা করবে। ইমামের সাথে ফরয ছালাত আদায় করে মসজিদে বা বাড়িতে দুই, চার বা ছয় রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করবে।
জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবার পক্ষে উপস্থাপিত দলীলগুলোর পর্যালোচনা :
জুম‘আর পূর্বে চার বা দু’রাক‘আত সুন্নাতে রাতেবাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একদল বিদ্বান কিছু যঈফ-জাল ও কিছু অপ্রাসঙ্গিক হাদীছ পেশ করে থাকেন। নিম্নে সেগুলোর পর্যালোচনা করা হ’ল।-
1- عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَرْكَعُ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، لَا يَفْصِلُ فِي شَيْءٍ مِنْهُنَّ-
১. ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) জুম‘আর (ফরয) ছালাতের পূর্বে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন এবং সেগুলোকে (মধ্যখানে সালামের দ্বারা) পৃথক করে পড়তেন না বা তার মাঝখানে সালাম ফিরাতেন না।[13]
পর্যালোচনা : আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এ বর্ণনার সনদকে বাতিল বলে গণ্য করেছেন। কারণ উক্ত বর্ণনার সনদে একাধিক দুর্বল, মিথ্যাবাদী ও হাদীছ জালকারী রাবী রয়েছে।[14] এছাড়াও ইমাম নববী, হাফেয ইরাকী, যায়লাঈ ও হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানীসহ সকল মুহাক্কিক্ব উক্ত হাদীছকে বাতিল, নিতান্ত যঈফ ও জাল বলেছেন।[15] তিনি আরো বলেন, ‘জুম‘আর দিনে আযান ও ইক্বামতের মাঝে ছালাত আদায় করা রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ এ দু’টোর মাঝে খুৎবা ছিল। এ সময়ে এ দু’টোর মাঝে কোন ছালাত ছিল না। হ্যাঁ ওছমান (রাঃ)-এর আমলে যাওরা বাজারে আযান চালু হওয়ার পর ইমামের খুৎবার জন্য বের হওয়ার পূর্বে সুন্নাত ছালাত আদায় করা সম্ভব ছিল। আমি বলব, কিন্তু এটিও সাধারণভাবে বর্ণিত হয়নি যে, ওছমান (রাঃ)-এর আযান ও খুৎবার মাঝে প্রচলিত চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করার সময় ছিল। এটাও বর্ণিত হয়নি যে, তাঁর (ওছমান (রাঃ)-এর) আমলে ছাহাবীগণ এই সুন্নাত আদায় করতেন। সুতরাং উল্লিখিত সম্ভাবনা বাতিল হয়ে গেল’।[16]
2- عَنْ عَبْدِ اللهِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا-
২. আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) জুম‘আর (ফরযের) পূর্বে চার রাক‘আত এবং পরে চার রাক‘আত (সুন্নাত) ছালাত আদায় করতেন।[17]
পর্যালোচনা : এর সনদে পাঁচটি ত্রুটি রয়েছে। ১. ইনকিতা‘। কারণ ইবনু মাসঊদ থেকে আবু ওবায়দা শ্রবণ করেনি। ২. এর সনদে খুছাইফ বিন আব্দুর রহমান জাযরী নামে দুর্বল রাবী রয়েছে। ৩. আত্তাব বিন বাশীর নামে আরেকজন সমালোচিত রাবী রয়েছে। ৪. সুলায়মান বিন আমর নামে আরেকজন গায়র ছিক্বাহ রাবী রয়েছে। ৫. আত্তাব বিন বাশীর ছাড়া অন্য কেউ খুছাইফ থেকে এমন কিছু বর্ণনা করেননি। যেগুলো প্রমাণ করে যে বর্ণনাটি শরী‘আতের দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়’।[18]
3- عَنْ عَلِيٍّ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا، يَجْعَلُ التَّسْلِيمَ فِي آخِرِهِنَّ رَكْعَةً-
৩. আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) জুম‘আর (ফরযের) পূর্বে চার রাক‘আত এবং পরে চার রাক‘আত (সুন্নাত) ছালাত আদায় করতেন এবং তাতে মাঝখানে সালাম না ফিরিয়ে শেষে সালাম ফিরাতেন’।[19]
পর্যালোচনা : এর সনদ মুনকার। কারণ এর সনদে মুহাম্মাদ বিন আব্দির রহমান আস-সাহমী নামে একজন দুর্বল রাবী রয়েছে। হাদীছ বিশারদগণ তাকে কেউ যঈফ, কেউ অপরিচিত, কেই অপ্রসিদ্ধ ইত্যাদি দোষে দুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন। তাছাড়া সাহমী হাদীছে ইযতিরাবও করতেন।[20]
4- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ كَانَ مُصَلِّيًا، فَلْيُصَلِّ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا-
৪. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের যে লোক ছালাত আদায় করতে চায় সে যেন জুম‘আর (ফরয ছালাতের) পূর্বে ও পরে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করে নেয়’।[21]
পর্যালোচনা : উক্ত হাদীছের সনদ যঈফ। এর সনদে আবইয়ায বিন আবান নামে যঈফ রাবী রয়েছে। আবু হাতেম বলেন, সে শক্তিশালী ছিল না।[22] ইমাম আযদীও তাকে সমালোচিত বলেছেন।[23] তাছাড়া সে সুফিয়ান ছাওরীর মত ছিক্বাহ রাবীর বিপরীত বর্ণনা করত।[24] যেমন ছহীহ হাদীছে জুম‘আর পরের চার রাক‘আতের কথা রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مُصَلِّيًا بَعْدَ الْجُمُعَةِ فَلْيُصَلِّ أَرْبَعًا ‘তোমাদের যে লোক জুম‘আর (ফরয ছালাতের) পর ছালাত আদায় করতে চায় সে যেন চার রাক‘আত ছালাত আদায় করে নেয়’।[25] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمُ الْجُمُعَةَ فَلْيُصَلِّ بَعْدَهَا أَرْبَعًا، ‘তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন জুম‘আর (ফরয) ছালাত আদায় করবে সে যেন এরপর চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করে নেয়’।[26] হাদীছে জুম‘আর পরের সুন্নাতের ব্যাপারে একাধিক মারফূ হাদীছ ও আছার বর্ণিত হ’লেও জুম‘আর পূর্বের সুন্নাতের ব্যাপারে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়নি।
5- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ رَكْعَتَيْنِ وَبَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ-
৫. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) জুম‘আর (ফরযের) পূর্বে দু’রাক‘আত এবং পরে দু’রাক‘আত (সুন্নাত) ছালাত আদায় করতেন।[27] কোন কোন বর্ণনায় পূর্বে চার ও পরে দু’রাক‘আতের কথা এসেছে।[28]
পর্যালোচনা : উক্ত বর্ণনায় একাধিক যঈফ ও মাজহূল রাবী রয়েছে। হাসান বিন কুতায়বাকে কেউ যঈফ, কেউ মাতরূক, কেউ ওয়াহিল হাদীছ, কেউ হালেক ইত্যাদি নামে মন্তব্য করেছেন। তাছাড়া উক্ত সনদে ইসহাক বিন সুলায়মান নামে আরেক মাজহূল রাবী রয়েছে।[29] তাছাড়া উক্ত সনদে ইযতিরাব রয়েছে। কারণ অন্য বর্ণনায় জুম‘আর পরিবর্তে যোহর রয়েছে। যেমন ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,كَانَ يُصَلِّى قَبْلَ الظُّهْرِ رَكْعَتَيْنِ، وَبَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ، ‘রাসূল (ছাঃ) যোহরের পূর্বে ও পরে দু’রাক‘আত করে সুন্নাত আদায় করতেন’।[30] হাদীছের শব্দ পরিবর্তনের মাধ্যমে হাদীছের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।[31] সুতরাং ইবাদত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এমন দুর্বল বর্ণনা যথেষ্ট নয়। জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে একদল বিদ্বান বলেন, রাসূল (ছাঃ) হয়ত বাড়িতে সুন্নাত আদায় করে মসজিদে এসেছিলেন। যদি সেটাই হ’ত তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ থেকে অবশ্যই কোন বর্ণনা থাকত। কিন্তু একটি ছহীহ বর্ণনাও নেই। তারা দলীল হিসাবে নিম্নের হাদীছটি পেশ করে থাকেন।
৬- عَنْ عَائِشَةَ أَنّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ رَكْعَتَيْنِ فِي أَهْلِهِ، وَبَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ-
৬. আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) তার
পরিবারেই জুম‘আর পূর্বের দু’রাক‘আত সুন্নাত ও পরে দু’রাক‘আত সুন্নাত আদায় করতেন’।[32]
পর্যালোচনা : এই বর্ণনাটি বাতিল ও জাল। কারণ উক্ত বর্ণনার সনদে ইসহাক বিন ইদরীস আল-বছরী নামে একজন রাবী আছেন, যিনি হাদীছ জাল করতেন।[33]
7- عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ السُّلَمِيِّ، قَالَ: كَانَ ابْنُ مَسْعُودٍ يَأْمُرُنَا أَنْ نُصَلِّيَ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا حَتَّى جَاءَ عَلِيٌّ رَضِي اللهُ عَنْهُ فَأَمَرَنَا أَنْ نُصَلِّيَ بَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ أَرْبَعًا-
৭. আবু আব্দির রহমান আস-সুলামী বলেন, ইবনু মাসউদ (রাঃ) জুম‘আর আগে ও পরে চার রাক‘আত করে ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিতেন। অবশেষে যখন আলী (রাঃ) আসলেন তখন তিনি জুম‘আর পরে দুই তারপরে চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিলেন।[34]
পর্যালোচনা : উক্ত বর্ণনাটি ইমাম তিরমিযী দুর্বল শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন। তবে আলবানী (রহঃ) উক্ত আছারের সনদকে ছহীহ বা হাসান বলেছেন। প্রথমতঃ এটি তার নিজস্ব আমল। দ্বিতীয়তঃ এটি যে সুন্নাতে রাতেবা ছিল এর পক্ষে কোন দলীল নেই। বরং ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সহ ছাহাবায়ে কেরামের রাক‘আত সংখ্যার ভিন্নতা প্রমাণ করে যে, এগুলো জুম‘আর পূর্বের নফল ছালাত ছিল। এই ছালাত আযান ও ওয়াক্তের পূর্বেই ছিল। প্রচলিত বয়ানের পরের সুন্নাত নয়। কারণ জুম‘আর দিনে ছাহাবীগণের আমল ছিল সকাল সকাল মসজিদে গিয়ে ইবাদতে লিপ্ত হওয়া।[35] ছাহাবায়ে কেরাম ঈদের পূর্বে সুন্নাত ছালাত নেই জেনেও ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে বাড়িতে বা ঈদের ময়দানে একাধিক রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করতেন।[36] এজন্য ইবনু মাসঊদ (রাঃ) চার জনের চতুর্থজন হিসাবে মসজিদে প্রবেশকারী হ’লে দুঃখ করে বিষণ্ণ মনে নিজেকে ভৎর্সনা করে বলতেন, رَابِع أَرْبَعَة وَمَا رَابِع أَرْبَعَة بِبسعِيد، ‘আমি চারজনের চতুর্থজন! চারজনের চতুর্থ ব্যক্তি খুব সৌভাগ্যশালী নয়’।[37]তৃতীয়ত: উক্ত বর্ণনায় জুম‘আর পরের সুন্নাতের বর্ণনায় অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
8- عَنْ قَتَادَةَ، أَنَّ ابْنَ مَسْعُودٍ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ، وَبَعْدَهَا أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ، قَالَ أَبُو إِسْحَاقَ: وَكَانَ عَلِيٌّ يُصَلِّي بَعْدَ الْجُمُعَةِ سِتَّ رَكَعَاتٍ،
৮. কাতাদা হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) জুম‘আর পূর্বে ও পরে চার রাক‘আত করে ছালাত আদায় করতেন। আবু ইসহাক বলেন, আলী (রাঃ) জুম‘আর পরে ৬ রাক‘আত সুন্নাত আদায় করতেন’।[38]
পর্যালোচনা : উক্ত আছারের সনদে ইনকিতা‘ রয়েছে। কারণ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে কাতাদা শুনেননি।[39] উক্ত আছারে তার একটি আমল প্রমাণিত হয়। তবে সুন্নাতে রাতেবার পক্ষে কোন দলীল নেই। কারণ সুন্নাতে রাতেবার জন্য ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর নির্দেশের প্রয়োজন নেই। বরং রাসূল (ছাঃ)-এর আমল ও নির্দেশই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু যেহেতু রাসূলের আমল বা নির্দেশ নেই সেজন্য তিনি নফল হিসাবে চার বা দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।[40] তাছাড়া ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে জুম‘আর পরের সুন্নাতের ব্যাপারে একই রাবী থেকে একাধিক বর্ণনা রয়েছে। অথচ সেগুলোতে জুম‘আর পূর্বের সুন্নাতের কথা উল্লেখ নেই।[41]
9- عَنْ صَافِيَةَ، سَمِعَهَا وَهِيَ تَقُولُ: رَأَيْتُ صَفِيَّةَ بِنْتَ حُيَيٍّ صَلَّتْ أَرْبَعًا قَبْلَ خُرُوجِ الْإِمَامِ وَصَلَّتِ الْجُمُعَةَ مَعَ الْإِمَامِ رَكْعَتَيْنِ-
৯. ছাফিয়া হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ছাফিয়্যা বিনতে হুওয়াই (রাঃ)-কে ইমামের বের হওয়ার পূর্বে চার রাক‘আত এবং ইমামের সাথে জুম‘আর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতে দেখেছি’।[42]
পর্যালোচনা : উক্ত বর্ণনার সনদ ছহীহ। তবে উক্ত চার রাক‘আত সুন্নাতে রাতেবা হওয়ার পক্ষে কোন দলীল নেই। বরং তারা দুই, চার বা ততোধিক রাক‘আত ছালাত জুম‘আর দিন খুৎবার পূর্বে আদায় করতেন। জুম‘আর দিন সূর্য ঢলে যাওয়ার সময়ও নফল ছালাত আদায় করা যায়।[43]
[ক্রমশঃ]
[1]. তারহুত তাছরীব ৩/৪২।
[2]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৪/১৮৮।
[3]. যাদুল মা‘আদ ১/৪১৭।
[4]. যাদুল মা‘আদ ১/৪১৭।
[5]. ফাৎহুল বারী ২/৪১০।
[6]. শারহুল যাদিল মুস্তাকনে‘ ৫/৭১।
[7]. শারহুল যাদিল মুস্তাকনে‘ ৫/৭১।
[8]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৬/১৩৩; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৮/২।
[9]. মুসলিম হা/৮৫৭; মিশকাত হা/১৩৮২।
[10]. ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ১৩/২৭৭।
[11]. আল আজওয়াবাতুন নাফে‘আ ৪৬ পৃ.।
[12]. আল আজওয়াবাতুন নাফে‘আ ৪৮ পৃ.।
[13]. ইবনু মাজাহ হা/১১২৯।
[14]. যঈফাহ হা/১০০১; যঈফুল জামে‘ হা/৪৫৫০।
[15]. ফাৎহুল বারী ২/৪২৬; রওযাতুল মুহাদ্দিছীন হা/৩৯০; আলবানী, আল-আজওয়াবাতুন নাফে‘আ ৫৬-৫৭ পৃ.।
[16]. যঈফাহ হা/১০০১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[17]. ত্বাবারানী আওসাত্ব হা/১০১৬, ৩৯৫৯।
[18]. যঈফাহ হা/১০১৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; ইবনু হাজার, আদ-দেরাইয়াহ।
[19]. তাবারানী আওসাত্ব হা/১৬১৭; মু‘জামু ইবনুল আ‘রাবী হা/৮৫৪।
[20]. যঈফাহ হা/৫২৯০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[21]. ত্বাহাবী, মুশকিলুল আছার হা/৪১০৮।
[22]. যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল ১/৭৮, রাবী নং ২৭০।
[23]. লিসানুল মীযান ১/১২৯।
[24]. আল-আজওয়াবাতুন নাফে‘আ ৬৪ পৃ.।
[25]. মুসলিম হা/৮৮১; মিশকাত হা/১১৬৬।
[26]. মুসলিম হা/৮৮১; মিশকাত হা/১১৬৬।
[27]. তারীখে বাগদাদ ২১৬৩।
[28]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী ২/৪২৬।
[29]. যঈফাহ হা/১০১৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; রওযাতুল মুহাদ্দিছীন হা/৩৮৯; ফাৎহুল বারী ২/৪২৬।
[30]. বুখারী হা/৯৩৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৯৬৮।
[31]. আবু শামাহ, আল-বাঈছ..১০০ পৃ.।
[32]. জুযউল কাসেম বিন মূসা হা/২২।
[33]. আল-আজওয়াবাতুন নাফে‘আ ৬৪ পৃ. আবু ওবায়দাহ মাশহুর আলে সালমান, আল-কাওলুল মুবীন ফী আখতাইল মুছল্লীন ১/৩৫৮।
[34]. তাবারানী কাবীর হা/৯৫৫১; মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/৫৫২৫।
[35]. আবু শামাহ, আল-বাঈছ..৭০ পৃ.; আল-আজওয়াবাতুন নাফে‘আ ৬২পৃ.।
[36]. ইমাম শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ১/২৬৮-৬৯; আবু শামাহ, আল-বায়ে‘ছ ৯৭ পৃ.।
[37]. ইমাম গাযালী, ইহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/১৮২’ আবু শামাহ, আল বায়ে‘ছ ৯৭ পৃ.।
[38]. মুছান্নাফে আব্দির রাযযাক হা/৫৫২৪; তাবারানী কাবীর হা/৯৫৫৫।
[39]. হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৩১৯২-এর আলোচনা।
[40]. ইবনু হাজার, আত-তালখীছুল হাবীর ২/১৪৯; আযীমাবাদী, আউনুল মা‘বূদ ৩/৩৩৬; আলবানী, যঈফাহ হা/১০১৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[41]. হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৩১৯১-৯৩।
[42]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা হা/৪৭০১।
[43]. মুসনাদুশ শাফেঈ হা/৪০৮, সনদ হাসান; ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৪৩-৪৪, ৩৭৪; আলবানী, আল-আজওয়াবাতুন নাফে‘আ, পৃ. ৬১।