হক খুঁজে পাওয়া যেমন সহজ নয়, তেমনি হকের উপরে টিকে থাকাও সহজ নয়। হকের উপরে টিকে থাকার জন্য কতিপয় করণীয় রয়েছে। যেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. শারঈ ইলম অর্জন করা :
শারঈ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ যথার্থ মুত্তাক্বী হ’তে পারে। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ غَفُوْرٌ ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (ফাতির ৩৫/২৮)। সুতরাং আল্লাহভীরু মানুষ কখনো হকের পথে, আল্লাহর পথে মানুষকে বাধা দেয় না। তেমনি নিজেও হকের উপরে অটল থাকতে সচেষ্ট হয়। প্রকৃত আলেম সম্পর্কে তাই ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, الْعَالِمُ بِالرَّحْمَنِ مَنْ لَمْ يُشْرِكْ بِهِ شَيْئًا، وَأَحَلَّ حَلَالَهُ، وَحَرَّمَ حَرَامَهُ، وَحَفِظَ وَصِيَّتَهُ، وَأَيْقَنَ أَنَّهُ مُلَاقِيهِ وَمُحَاسَبٌ بِعَمَلِهِ. ‘আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞানী সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করেন না, তাঁর কৃত হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম গণ্য করেন। যিনি তাঁর আদেশ সমূহের হেফাযত করেন এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভ ও তাঁর নিকটে আমলের হিসাব দান বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন’।[1]
হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,الْعَالِمُ مَن خَشِيَ الرَّحْمَنَ بِالْغَيْبِ، وَرَغِبَ فِيْمَا رَغِبَ اللهُ فِيْهِ، وَزَهِدَ فِيْمَا سَخط اللهُ فِيْهِ، ثُمَّ تَلَا الْحَسَنُ: إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ، ‘আলেম তিনি যিনি না দেখে আল্লাহকে ভয় করেন। আল্লাহ যা ভালবাসেন, তিনিও তা ভালবাসেন। আল্লাহ যাতে ক্রুদ্ধ হন, তা থেকে তিনি বিরত থাকেন। অতঃপর তিনি অত্র আয়াতটি তেলাওয়াত করেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে’।[2]
অতএব শারঈ জ্ঞানে পারদর্শী কোন ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে তথা হকের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না। এজন্য শারঈ জ্ঞান অর্জন করা যরূরী।
২. ধৈর্য ও সহনশীলতা অবলম্বন করা :
ধৈর্য-সহিষ্ণুতা মানুষকে মহৎ হ’তে শেখায়। এর মাধ্যমে হক-বাতিলের পার্থক্য নিরূপণে মনোযোগী হওয়া যায়। এ গুণের অধিকারী মানুষ কোন বিপদে মুষড়ে পড়ে না। সর্বদা তারা আল্লাহর উপরে ভরসা রাখে। কোন মানুষের দেওয়া দুঃখ-কষ্টেও তারা ভেঙ্গে পড়ে না। আল্লাহ বলেন,وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلَّا بِاللهِ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلَا تَكُ فِيْ ضَيْقٍ مِمَّا يَمْكُرُوْنَ، ‘তুমি ধৈর্যধারণ কর। আর তোমার ধৈর্যধারণ হবে কেবল আল্লাহর সাহায্যে। তাদের উপর দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না’ (নাহল ১৬/১২৭)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,وَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُوْلُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلًا، ‘আর কাফের-মুশরিকরা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চল’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/১০)। অর্থাৎ মানুষের দেওয়া কোন কথায় ব্যথিত হয়ে ধৈর্যশীল মানুষ কখনো হকের পথ থেকে বিচ্যুত হয় না। বরং তারা মানুষের দেওয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْمُؤْمِنُ الَّذِىْ يُخَالِطُ النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ أَعْظَمُ أَجْرًا مِنَ الْمُؤْمِنِ الَّذِىْ لاَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَلاَ يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ، ‘যে মুমিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মেলামেশা করে এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্যধারণ করে সে এমন মুমিন ব্যক্তির তুলনায় অধিক ছওয়াবের অধিকারী হয়, যে জনগণের সাথে মেলামেশা করে না এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্যধারণ করে না’।[3] অনুরূপ সহনশীল মানুষ কখনো হকের পথ থেকে বাধা দেয় না। বরং তারা হক পালনে মানুষের সহযোগী হয়।
৩. প্রবৃত্তির অনুসারী না হওয়া :
প্রবৃত্তির অনুসরণ করলে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে দেয়। আল্লাহ বলেন,وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِيْنَ يَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيْدٌ بِمَا نَسُوْا يَوْمَ الْحِسَابِ، ‘এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৬)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوْا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُوْنَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِِّنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ، ‘অতঃপর যদি তারা তোমার কথায় সাড়া না দেয় তবে জানবে যে, তারা কেবল তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াত অগ্রাহ্য করে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
তিনি আরো বলেন,أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيْهِ مِنْ بَعْدِ اللهِ أَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ، ‘তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের উপাস্য করে নিয়েছে? আল্লাহ জেনেশুনেই ওকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং ওর কর্ণ ও হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন এবং ওর চোখের ওপর রেখেছেন পর্দা। অতএব আল্লাহ মানুষকে বিভ্রান্ত করার পর কে তাকে পথনির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না’? (জাছিয়া ৪৫/২৩)।
সুতরাং প্রবৃত্তির অনুসারীরা হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। ফলে তারা জাহান্নামে নিপতিত হয়। আল্লাহ বলেন,فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا، ‘তাদের পরে এলো তাদের অপদার্থ উত্তরসূরিরা। তারা ছালাত বিনষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। ফলে তারা অচিরেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’ (মারিয়াম ১৯/৫৯)।
হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوْبِ كَالْحَصِيْرِ عُوْدًا عُوْدًا فَأَىُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا نُكِتَ فِيْهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ وَأَىُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا نُكِتَ فِيْهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ حَتَّى تَصِيْرَ عَلَى قَلْبَيْنِ عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلاَ تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالأَرْضُ وَالآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ مُجَخِّيًا لاَ يَعْرِفُ مَعْرُوفًا وَلاَ يُنْكِرُ مُنْكَرًا إِلاَّ مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ، ‘মানুষের মনে ফিৎনা বা গোমরাহী এমনভাবে ঢেলে দেওয়া হয় যেমন করে খেজুরের মাদুর বা পাটি বুনতে একটা একটা করে পাতা ব্যবহার করা হয়। যে মনে ঐ ফিৎনা অনুপ্রবেশ করে তাতে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। আর যে মন তা প্রত্যাখ্যান করে তাতে একটা সাদা দাগ পড়ে। এভাবে মনগুলো দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক. মসৃণ পাথরের মত সাদা মন, যাতে কোন ফিৎনা বা পাপাচার আসমান-যমীন বিদ্যমান থাকা অবধি কোনরূপ বিরূপ ক্রিয়া করতে পারবে না। দুই. কয়লার ন্যায় কালো মন, যা উপুড় করা পাত্রের মত, না সে কোন ন্যায়কে বোঝে, না অন্যায়কে স্বীকার করে। তার প্রবৃত্তি বা কামনা-বাসনা তাকে যেভাবে পরিচালনা করে সেভাবেই কেবল সে পরিচালিত হয়’।[4]
মুহাম্মাদ ইবনু আবুল ওয়ার্দ বলেছেন,إن لله عز وجل يوما لا ينجو من شره منقاد لهواه وان أبطأ الصرعى نهضة يوم القيامة صريع الشهوة، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াস্তে এমন একদিন আসবে যেদিনের ক্ষতি থেকে প্রবৃত্তির পূজারীরা রেহাই পাবে না। প্রবৃত্তির কাছে ধরাশায়ী ব্যক্তিরাই ক্বিয়ামতের দিন ভূপাতিতদের মধ্যে সবচেয়ে দেরিতে উত্থিতদের কাতারে থাকবে’।[5]
আতা (রহঃ) বলেছেন,مَنْ غَلَبَ هَوَاهُ عَقْلَهُ وَجَزَعَهُ صَبْرَهُ افْتُضِحَ، ‘প্রবৃত্তি যার বুদ্ধি-বিবেককে পরাস্ত করেছে এবং তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছে, বিচার দিবসে তাকে অপদস্থ হ’তে হবে’।[6]
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,إِنَّ كَثِيْرًا لَيُضِلُّوْنَ بِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ، ‘অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতাবশত নিজেদের প্রবৃত্তি দ্বারা অন্যকে বিপথে চালিত করে’ (আন‘আম ৬/১১৯)। অর্থাৎ তারা অন্যদেরকে তাদের কুপ্রবৃত্তি দ্বারা পথভ্রষ্ট করে।
ওয়াহহাব ইবনু মুনাবিবহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, দ্বীনের উপর চলতে চরিত্রের যে গুণটি সবচেয়ে বড় সহায়ক তাহ’ল দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি বা নির্লোভ জীবন যাপন। আর যে দোষটি মানুষকে দ্রুত ধ্বংসের দিকে টেনে নেয় তাহ’ল প্রবৃত্তির অনুসরণ। প্রবৃত্তির অনুসরণের একটি হ’ল দুনিয়ার প্রতি আসক্তি। আর দুনিয়ার প্রতি আসক্তির মধ্যে রয়েছে সম্পদ ও সম্মানের প্রতি মোহ। আর সম্পদ ও সম্মানের মোহে মানুষ হারামকে হালাল করে নেয়। এভাবে যখন হারামকে হালাল করে নেওয়া হয় তখন আল্লাহ তা‘আলা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। আর আল্লাহর ক্রোধ এমন রোগ, যার ঔষধ একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ। আল্লাহর সন্তোষ এমন ঔষধ, যে তা পেলে কোন রোগই ক্ষতি করতে পারবে না। আর যে তার রবকে খুশি করতে চায় তার নিজের মনকে নাখোশ করতে হয়। কিন্তু যে নিজের মনকে নাখোশ করতে রাযী নয় সে তার রবকে খুশি করতে পারে না। কোন মানুষের উপর দ্বীনের কোন বিষয় ভারী মনে হ’লে সে যদি তা বর্জন করে তাহ’লে এমন একটা সময় আসবে যখন তার নিকট দ্বীনের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না’।[7] সুতরাং প্রবৃত্তির অনুসরণ পরিহার করতে হবে। কেননা প্রবৃত্তিপরায়ণ মানুষ নিজে যেমন হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তেমনি সে অন্যকেও পথভ্রষ্ট করে।
৪. পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসারী না হওয়া :
বাপ-দাদা বা পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করার কারণে মানুষ হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُوْنَ، ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জ্ঞান রাখতো না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০)। তিনি আরো বলেন,وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ قَالُوْا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُوْنَ، ‘আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেদিকে এবং রাসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে আমাদের জন্য তাই-ই যথেষ্ট, যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কোন জ্ঞান রাখত না বা তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (মায়েদাহ ৫/১০৪)।
পূর্বপুরুষরা যে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, সেটা ফুটে ওঠে পরকালে জাহান্নামীরা তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহর কাছে যে স্বীকৃতি দিবে তার মধ্যে। তাদের বক্তব্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করেছেন,رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلَا، ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল’ (আহযাব ৩৩/৬৭)।
পূর্ববর্তী বংশধরদের অন্ধ অনুসরণের কুফল সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوْا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوْهُ، ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের পন্থা পুরোপুরি অনুসরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে এবং প্রতি গজে গজে। এমনকি তারা যদি সাপের গর্তেও ঢুকে তবে তোমরাও তাতে ঢুকবে’।[8]
সুতরাং পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের কারণে মানুষ হক পথ থেকে দূরে সরে যায়। এজন্য পূর্বপুরুষসহ যে কোন মানুষের অন্ধ অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আর হকের পথে অবিচল থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
৫. পরমত সহিষ্ণু হওয়া :
অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া মানুষের একটি মহৎ গুণ। অপরের গঠনমূলক পরামর্শ ও মতামত শ্রবণ করা এবং তা সাধ্যমত মেনে নেওয়া উচিত। যা মানুষকে হকের উপরে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। গভীর ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতা ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানুষের প্রতি মহববত, তাকে সাক্ষাৎ জাহান্নাম থেকে ফিরিয়ে আনার নিরন্তর প্রচেষ্টা তাঁকে করেছিল মহান। তিনি অলৌকিক ক্ষমতা হাতে পেয়েও তা প্রয়োগ করেননি তাঁর প্রাণঘাতি শত্রু মক্কা ও ত্বায়েফের ধুরন্ধর নেতাদের বিরুদ্ধে। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশতার আবেদনের জবাবে নির্যাতিত রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, ওদের পিষে মেরে ফেলার চাইতেبَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، ‘আমি বরং আশা করি আল্লাহ ওদের ঔরসে এমন সন্তান জন্ম দিবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না’।[9]
২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধে বিজয়ের পর যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে তিনি ছাহাবীগণকে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ফলে ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান।[10] অথচ ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য’।[11]
রাসূল (ছাঃ) অন্যের মতামত বা কথাকে গুরুত্ব দিতেন। এ সম্পর্কে একটি হাদীছে এসেছে, আবূ উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক তরুণ যুবক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে যেনা করার অনুমতি দিন। একথা শুনে উপস্থিত লোকজন তার নিকটে এসে তাকে ধমক দিয়ে বলল, থাম! থাম! রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খুব নিকটে এসে বসল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি তোমার মায়ের জন্য এটা (অন্যের সাথে যেনা করা) পসন্দ করবে? সে বলল, না, আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন! মানুষেরা এটা তাদের মায়েদের জন্য পসন্দ করবে না। তিনি বললেন, তোমার কন্যার জন্য কি তা পসন্দ করবে? সে বলল, না, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন! কোন মানুষ এটা তাদের মেয়েদের জন্য পসন্দ করবে না। তিনি বললেন, তুমি কি তোমার বোনের জন্য এটা পসন্দ করবে? সে বলল, না আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন! কোন ব্যক্তিই এটা তাদের বোনদের জন্য পসন্দ করবে না। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমার ফুফুর জন্য কি এটা পসন্দ করবে? সে বলল, না আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন! কোন পুরুষ এটা তাদের ফুফুদের জন্য পসন্দ করবে না। তিনি বললেন, তবে তোমার খালার জন্য কি এটা পসন্দ করবে? সে বলল, না আল্লাহর কসম। আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন! কোন মানুষ এটা তাদের খালাদের জন্য পসন্দ করবে না। রাবী বলেন, অতঃপর তিনি তার উপর হাত রেখে দো‘আ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তার গুনাহ ক্ষমা করে দাও, তার হৃদয় পবিত্র করে দাও এবং তার লজ্জাস্থানকে হেফাযত করো’। এরপর ঐ যুবক আর কারো (কোন মহিলার) প্রতি দৃষ্টিপাত করেনি’।[12] এভাবে রাসূল (ছাঃ) অন্যকে স্বাধীনভাবে মতামত পেশ করার সুযোগ দিতেন। আর মতামত ভুল হ’লে তিনি তা শুধরে দিতেন।
ছাহাবায়ে কেরামও অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (১৩-২৩ হি.)-এর খিলাফতকালে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের প্রাক্কালে খ্রিষ্টান নেতারা শর্ত দিল যে, খলীফাকে রাজধানী ছেড়ে এখানে আসতে হবে। তখন খলীফা ওমর (রাঃ) হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে পরামর্শ করলেন। তিনি বললেন, এটা হীনকর শর্ত। অতএব তাদের উপর অবরোধ আরোপ করুন। যাতে তারা সন্ধিতে বাধ্য হয়। অতঃপর তিনি আলী (রাঃ)-এর নিকট পরামর্শ নিলেন। তিনি বললেন, অবরোধে কালক্ষেপণ ও লোকক্ষয়ের সম্ভাবনা বেশী থাকে। তারচেয়ে আপনার সেখানে যাওয়াটাই উত্তম হবে। খলীফা শেষোক্ত পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং আলী (রাঃ)-কে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে তিনি যেরুযালেম রওয়ানা হ’লেন।[13] সুতরাং অন্যের মতামত গ্রহণ করার মত মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। কেবল আমার কথাই অন্যরা মানবে; আমারটাই সঠিক, অন্যেরটা ভুল কিংবা আমি হকের উপরে ও অন্যরা বাতিলের উপরে আছে, এমন মানসিকতা ব্যক্তিকে অহংকার ও আত্মম্ভরিতার দিকে ধাবিত করে। যাতে তার পক্ষে হকের উপরে দৃঢ় থাকা এবং অপরকে হকের উপরে থাকতে দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। তাই পরমতসহিষ্ণু হওয়া যরূরী।
৬. ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জোরদার করা :
মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সে হিসাবে পারস্পরিক সম্পর্ক হওয়া উচিত ভ্রাতৃত্বের, সম্প্রীতি ও সদ্ভাবের। অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নয়, বরং ভাই হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। যিনি কাজ করছেন তার দিকে নয়, বরং লক্ষ্য করা উচিত কী কাজ করছেন সেদিকে। আর ইসলাম ও মুসলমানের জন্য কল্যাণকর ও গঠনমূলক কাজের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা থাকা বাঞ্ছণীয়। কিন্তু যখন কাজের চেয়ে কর্তা অধিক গুরুত্ব পায়, প্রত্যেক কাজকে নিজের অবদান মনে করা হয় এবং খ্যাতি-যশের সুপ্ত বাসনা মনে জাগ্রত হয়, তখনই ঘটে বিপত্তি। বর্তমানে মানুষের অভ্যাস এরূপ হয়েছে যে, তাঁরা শুধু অন্যের দোষ-ত্রুটিই দেখে। অন্যের ভুলগুলি প্রকাশ করেই শান্তি পায়। তাদের রঙ্গীন চশমায় নিজের ভুল কিছুই ধরা পড়ে না। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُبْصِرُ أحَدُكُمُ الْقَذَاةَ فى عَيْنِ أخِيهِ، وَيَنْسَى الْجِذْعَ فِي عَيْنهِ ‘তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের চোখের সামান্য খড়-কুটা দেখতে পায়, কিন্তু নিজের চোখের উটও দেখতে পায় না’।[14] ঐসব লোক নিজের মধ্যে হাযারো দোষ থাকার পরেও অন্যের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আনন্দ পায়, সুখ অনুভব করে। তাদের ভাবখানা এমন যে, নিজেরটাই একমাত্র কাজ; অন্যেরটা কিছুই না। তাদের আচরণে প্রকাশ পায় যে, ইসলামের রক্ষক কেবল তারাই। তাদের উন্নতি-অগ্রগতির মাঝেই যেন ইসলামের অগ্রগতি নিহিত।
বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমানের মধ্যে ইসলামের আদর্শ নেই। তাদের কাজগুলিও পূর্ণাঙ্গরূপে রাসূলের সুন্নাত মোতাবেক হচ্ছে না। মিথ্যা অভিনয় করে অনেকে ইসলামের কৃত্রিম কান্ডারী বনে গিয়ে ইসলামী আদর্শকে কলুষিত করছে। ইসলামী লেবাসে তারা অনৈসলামী কর্মকান্ড করছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে খ্যাতি ও নেতৃত্ব লাভ। কখনো নিজের দল ও মতের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য অর্জন। আবার কখনো নিজের জ্ঞান বা বুদ্ধির বিকাশ সাধন। এরপরও তারা নিজেদের ভাবছে পূত-পবিত্র। আর অন্যদেরকে মনে করছে ভ্রষ্ট ও অচ্ছুত! এটা সরাসরি ইসলামের সাথে প্রতারণা বৈকি? এটা নিছক ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে ইসলামের অপব্যবহার। এগুলি থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জোরদার করা দরকার এবং মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা প্রয়োজন।
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিষয় উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ، ‘মুমিনগণ পরস্পরে ভাই ব্যতীত নয়’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى، ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদেরকে একটি দেহের মত দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর কারণে রাত্রি জাগরণ ও জ্বরের মাধ্যমে সেই ব্যথা অনুভব করে’।[15]
সুতরাং মুসলমান ভাইয়ের সম্মান হানি করা, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং কোন উপায়ে তার ক্ষতি সাধন করা বৈধ নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ مَالُهُ، وَعِرْضُهُ، وَدَمُهُ حَسْبُ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، ‘একজন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের সম্পদ, সম্মান ও জীবনে হস্তক্ষেপ করা হারাম। কোন ব্যক্তির নিকৃষ্ট প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে’।[16]
মুসলমানদের সাথে ভ্রাতৃত্বের মযবূত সেতুবন্ধন তৈরী করাই ইসলামের নির্দেশ। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الْمُؤْمِنُ يَأْلَفُ وَيُؤْلَفُ، وَلَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يَأْلَفُ، وَلَا يُؤْلَفُ، وَخَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، ‘মুমিন ব্যক্তি অন্যকে ভালোবাসে এবং অন্যের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেই ব্যক্তির মধ্যে কোন কল্যাণ নেই যে অন্যকে ভালোবাসে না এবং প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। আর মানুষের উপকারে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই সর্বোৎকৃষ্ট’।[17] দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব মানুষকে অন্য ভাইয়ের প্রয়োজনের প্রতি গুরুত্ব দিতে এবং তাকে হকের পথে অবিচল থাকার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে উৎসাহিত করে। কারণ ভাই কখনো ভাইয়ের ক্ষতি সাধন করবে না। তাকে হকের পথ থেকে ও কল্যাণকারিতা থেকে বাধাগ্রস্ত করবে না।
অপরদিকে অন্যের দোষ-ত্রুটি প্রচার করে তাকে লজ্জিত করা, তার সাথে হিংসা-বিদ্বেষ করা এবং তার পিছনে লেগে থাকার পরিবর্তে পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করার নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تَحَاسَدُوْا، وَلاَ تَبَاغَضُوْا، وَلاَ تَجَسَّسُوْا، وَلَا تَحَسَّسُوْا، وَلاَ تَنَاجَشُوْا، وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا، ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, একে অপরের সাথে শত্রুতা পোষণ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, অপরের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করো না এবং পরস্পরকে প্রবঞ্চিত করো না। বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও’।[18] আর পরস্পর ভাই ভাই হওয়ার মাধ্যমে হকের উপরে নিজে টিকে থাকা এবং অন্যকে টিকে থাকতে সাহায্য করাই মুমিনের কর্তব্য।
৭. কুরআন ও হাদীছের প্রকৃত অনুসারী হওয়া :
হকের উপরে টিকে থাকার জন্য কুরআন-হাদীছের যথার্থ অনুসারী হওয়া আবশ্যক। কেননা হক কেবল এ দু’টির মধ্যেই পাওয়া যায় (কাহফ ১৮/২৯)। আর ঐ হকের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,اتَّبِعُوْا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيْلًا مَا تَذَكَّرُوْنَ، ‘তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে যা নাযিল করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর এবং তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কোন বন্ধুর অনুসরণ করো না। বাস্তবে তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (আ‘রাফ ৭/৩)। তিনি আরো বলেন,قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ، ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
তিনি আরো বলেন,قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوْهُ تَهْتَدُوْا وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ، ‘বল, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহ’লে তার দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর তাহ’লে তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে। বস্ত্ততঃ রাসূলের উপর দায়িত্ব হ’ল কেবল সুস্পষ্টভাবে (আল্লাহর বাণী) পৌঁছে দেওয়া’ (নূর ২৪/৫৪)।
কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, كَذَلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِنْ لَدُنَّا ذِكْرًا، مَنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا، خَالِدِيْنَ فِيْهِ وَسَاءَ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِمْلًا، ‘এভাবে আমরা পূর্বে যা ঘটেছে সেসব বিষয়ে তোমাকে বর্ণনা করি। বস্ত্ততঃ আমরা আমাদের নিকট থেকে তোমাকে দান করেছি কুরআন। এটা থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে ক্বিয়ামতের দিন (মহা পাপের) বোঝা বহন করবে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর ক্বিয়ামতের দিন এই বোঝা তাদের জন্য কতই না মন্দ হবে’ (ত্ব-হা ২০/৯৯-১০১)।
রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের ব্যাপারে হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
خَطَّ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْماً خَطًّا ثُمَّ قَالَ : هَذَا سَبِيْلُ اللهِ. ثُمَّ خَطَّ خُطُوْطاً عَنْ يَمِيْنِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ : هَذِهِ سُبُلٌ، عَلَى كُلِّ سَبِيْلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ. ثُمَّ تَلاَ (وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِى مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ).
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি (সরল) রেখা টানলেন এবং বললেন, এটা আল্লাহর পথ। এরপর তিনি এ রেখার ডানে ও বামে আরো কয়েকটি রেখা টানলেন এবং বললেন, এগুলোও পথ। এই প্রত্যেক পথের উপর শয়তান দাঁড়িয়ে থাকে। এরা (মানুষকে) তাদের পথের দিকে আহবান করে। অতঃপর তিনি কুরআনের এ আয়াত পাঠ করলেন, ‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে’... (আন‘আম ৬/১৫৩)।[19]
তিনি আরো বলেন,كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى، ‘আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেবল তারা ব্যতীত, যারা অসম্মত হবে। তারা জিজ্ঞেস করলেন, অসম্মত কারা? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর
আর যারা আমার অবাধ্যতা করবে, তারাই হ’ল অসম্মত’।[20]
সুতরাং কিতাব ও সুন্নাতের প্রকৃত অনুসারী হ’লে হকের উপরে টিকে থাকা সহজ হবে। অন্যথা হক থেকে বিচ্যুত হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَإِنِّيْ تَارِكٌ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ كِتَابَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، ‘আমি তোমাদের নিকটে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ছেড়ে যাচ্ছি। (একে মেনে চললে) এর পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না’।[21]
তিনি আরো বলেন,وَأَنَا تَارِكٌ فِيْكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللهِ فِيْهِ الْهُدَى وَالنُّوْرُ فَخُذُوْا بِكِتَابِ اللهِ وَاسْتَمْسِكُوْا بِهِ، ‘আমি তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এর প্রথমটি হ’ল আল্লাহর কিতাব। এতে হিদায়াত এবং নূর রয়েছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কিতাবকে ধারণ কর, একে শক্ত করে আঁকড়ে ধর’।[22] তিনি আরো বলেন,كِتَابُ اللهِ فِيْهِ الْهُدَى وَالنُّوْرُ مَنِ اسْتَمْسَكَ بِهِ وَأَخَذَ بِهِ كَانَ عَلَى الْهُدَى وَمَنْ أَخْطَأَهُ ضَلَّ. ‘আল্লাহর কিতাব, তাতে রয়েছে হিদায়াত ও আলো, যে এটাকে ধরে রাখবে, হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর যে এটা ছেড়ে দেবে, সে পথ হারিয়ে ফেলবে’।[23]
অপরদিকে আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)।
সাম‘আনী (রহঃ) বলেন,وأما أهل الحق، فجعلوا الكتاب والسنة أمامهم، وطلبوا الدين من قبلهما،... فإن الكتاب والسنة لا يهديان إلا إلى الحق، ورأي الإنسان قد يرى الحق وقد يرى الباطل، ‘হকপন্থীরা কিতাব ও সুন্নাহকে তাদের সম্মুখে রাখে এবং এতদুভয়ের মাধ্যমে দ্বীন অনুসন্ধান করে। ... কেননা কিতাব ও সুন্নাহ কেবল হকের দিকে পথ প্রদর্শন করে। আর মানুষের সিদ্ধান্ত কখনও সঠিক হয়, কখনও বেঠিক হয়’।[24] অতএব হকের উপরে টিকে থাকতে কুরআন ও হাদীছের একনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে হবে।
৮. উদার হওয়া :
উদারতা মানুষকে স্বীয় পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন ও অন্যের প্রতি উত্তম আচরণ করতে এবং বিনম্র হ’তে শেখায়। তাদের অধিকারের প্রতি সদা লক্ষ্য রাখতে, আত্মসমালোচনা করতে এবং বিরোধীদের প্রতিও সহনশীল হ’তে দীক্ষা দেয়। যা ঈমানের পরিচায়ক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اَلْإِيْمَانُ: الَصَّبْرُ وَالسَّمَاحَةُ ‘ঈমান হ’ল সহিষ্ণুতা ও উদারতা’।[25]
রাসূল (ছাঃ)-এর উদারতা সম্পর্কে আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে হাঁটছিলাম। তখন তাঁর গায়ে একখানা গাঢ় পাড়যুক্ত নাজরানী চাদর ছিল। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে চাদর ধরে সজোরে টান দিল। আনাস বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাঁধের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, জোরে টান দেওয়ার কারণে সেখানে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর বেদুঈন লোকটি বলল, হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহর দেওয়া যে সম্পদ আছে, তা থেকে আমাকে দেওয়ার জন্য আদেশ কর। তখন নবী করীম (ছাঃ) তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আদেশ দিলেন’।[26]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ঐ সময় রাসূল (ছাঃ) এক জানাযায় ছিলেন এবং তাঁর সাথে আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাঃ) সহ অনেক ছাহাবী ছিলেন। এমতাবস্থায় উক্ত বেদুঈন এসে উপরোক্ত দাবী করে এবং চাদর ধরে হেঁচকা টান মারে। তাতে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ওমর (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর শত্রু! তুমি আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে এমন বেআদবী করছ? যদি রাসূল (ছাঃ) এখানে না থাকতেন, তাহ’লে এই তরবারি দিয়ে আমি তোমার গর্দান উড়িয়ে দিতাম! এ সময় রাসূল (ছাঃ) ধীরস্থিরভাবে ওমরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অতঃপর বলেন, হে ওমর! আমরা তোমার নিকট থেকে আশা করেছিলাম যে, তুমি আমাকে তার দাবীটি সত্বর পূরণের কথা বলবে এবং তাকে ভদ্র ব্যবহার শিক্ষা দিবে। তুমি যাও তার দাবী পূরণ কর এবং তাকে অন্যদের চাইতে ২০ ছা‘ খাদ্যবস্ত্ত বেশী দাও’।[27] সুতরাং কারো আচরণে রুষ্ট না হয়ে তার প্রতি সহনশীল হওয়ার মাধ্যমে তাকে হকের পথে ফিরিয়ে আনা ও হকের উপরে টিকে থাকতে সহায়তা করা উচিত। আর উদারতার মাধ্যমে অন্যের হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরী করা যায়। ফলে তাকে হকের পথে ফিরিয়ে আনা যায়। অনুরূপভাবে নিজেও অন্যের মাধ্যমে হক খুঁজে পেতে ও হকের উপরে টিকে থাকতে সচেষ্ট হওয়া।
৯. গোঁড়ামি পরিহার করা :
মানুষ নিজের বুঝের উপরে অটল থাকতে চায়। সে যা ভাল মনে করে, তাই করে। তার এই গোঁড়ামি তাকে হক গ্রহণে বাধাগ্রস্ত করে। নবী করীম (ছাঃ) কোন বিষয়ে গোঁড়ামি তথা বাড়াবাড়ি পসন্দ করতেন না। তিনি বলেন, هَلَكَ الْمُتَنَطِّعُوْنَ ‘অতিরঞ্জনকারীরা ধ্বংস হয়েছে’।[28] এমনকি মহানবী (ছাঃ) তাঁর নিজের ব্যাপারেও বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেমন খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়ামকে নিয়ে করেছে। আমিতো আল্লাহর দাস মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর দাসও তাঁর রাসূলই বল’।[29]
তিনি আরো বলেন,صِنْفَانِ مِنْ أُمَّتِيْ لَنْ تَنَالَهُمَا شَفَاعَتِيْ: إِمَامٌ ظَلُوْمٌ غَشُوْمٌ وَكُلُّ غَالٍ مَارِقٌ، ‘আমার উম্মতের দুই শ্রেণীর লোক আমার সুফারিশ লাভ করতে পারবে না। অত্যাচারী রাষ্ট্রনেতা এবং প্রত্যেক বিপথগামী অতিরঞ্জনকারী’।[30] আর গোঁড়া ব্যক্তি কখনো পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হ’তে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, গোঁড়ামি ঈমান-আমল ও দ্বীনের জন্য ক্ষতিকর। তাই সকলের উচিত গোঁড়ামি ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা। যাতে হকের উপরে অবিচল থাকা যায়।
১০. শরী‘আতের সঠিক বুঝ থাকা :
কুরআন-হাদীছ তথা শরী‘আতের ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা ছাহাবী-তাবেঈ ও তাঁদের যথাযথ অনুসারীদের নিকট থেকে নিতে হবে। কারণ তাঁরা ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَالسَّابِقُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهَاجِرِيْنَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ،
‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবা ৯/১০০)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُكُمْ قَرْنِى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ‘আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা’।[31]
আর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীদের অনুসারীরা মুক্তিপ্রাপ্ত। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ- َفِيْ رِوَايَةِ أَحْمَدَ وَأَبِيْ دَاؤدَ عَنْ مُعَاوِيَةَ: ثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ،
‘বনু ইস্রাঈল ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত। তারা বললেন, সেটি কোন দল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, যারা আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপরে টিকে থাকবে’। আহমাদ ও আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে যে, ৭২ দল জাহান্নামী হবে ও একটি দল জান্নাতী হবে। আর তারা হ’ল, আল-জামা‘আত’।[32]
সুতরাং হকের উপরে টিকে থাকতে শরী‘আতের ব্যাখ্যা সালাফে ছালেহীনের নিকট থেকে গ্রহণ করতে হবে। অন্যথা বিভ্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ শরী‘আতের বিষয়ে ছাহাবীগণ সরাসরি রাসূল থেকে এবং তাবেঈগণ ছাহাবীগণের নিকট থেকে অবহিত হয়েছেন। অনুরূপভাবে তাদের সনিষ্ট অনুসারীগণও হকের উপরে ছিলেন। তাই কেবল তাদের নিকট থেকে কুরআন-হাদীছের ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে।
পরিশেষে বলব, সঠিক দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা, তার উপরে যথাযথভাবে আমল করা ও কুরআন-হাদীছের অনুসরণের মাধ্যমে হকের উপরে অবিচল থাকা যায়। সবাইকে একান্তভাবে সে চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের উপরে তথা হকের উপরে অবিচল থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৬/৫৪৪ পৃঃ।
[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৬/৫৪৫ পৃঃ।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪০৩২; ছহীহাহ হা/৯৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৫১।
[4]. মুসলিম হা/১৪৪, মিশকাত হা/৫৩৮০।
[5]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ২/৩৯৫।
[6]. ইবনুল জাওযী, যাম্মুল হাওয়া, পৃঃ ২৭।
[7]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫১৬৮।
[8]. বুখারী হা/৩৪৫৬; মিশকাত হা/৫৩৬১।
[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৪৮।
[10]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৫।
[11]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩/৩০৭; আবুল হাসান নদভী, সীরাতুন নবাবিয়াহ, ১/৩১৩; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৪৫।
[12]. আহমাদ হা/২২২৬৫; ছহীহাহ হা/৩৭০।
[13]. হাকেম হা/২০৮; ছহীহাহ হা/৫১; আল-বিদায়াহ ৭/৫৫ পৃ.।
[14]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৫৭৬১; ছহীহাহ হা/৩৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৩৩১।
[15]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাতা হা/৪৯৫৩।
[16]. মুসলিম হা/২৫৬৪; আবূদাঊদ হা/৪৮৮২; মিশকাত হা/৪৯৫৯।
[17].ত্বাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৭৮৭; ছহীহাহ হা/৪২৬।
[18]. মুসলিম হা/২৫৬৩।
[19]. ইবনু মাজাহ হা/১১; মিশকাত হা/১৬৬, সনদ হাসান।
[20]. বুখারী হা/৭২৮০; মিশকাত হা/১৪৩।
[21]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৬২৭২, সনদ ছহীহ।
[22]. মুসলিম হা/২৪০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩৫১।
[23]. মুসলিম হা/২৪০৮; মিশকাত হা/৬১৩১।
[24]. ছাওনুল মানতিক, পৃঃ ১৬৬।
[25]. ত্বাবারাণী, ছহীহুল জামে হা/২৭৯৫।
[26]. বুখারী হা/৩১৪৯; মুসলিম হা/১০৫৭; মিশকাত হা/৫৮০৩।
[27]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৮৮; ত্বাবারাণী, কাবীর হা/৫১৪৭; যঈফাহ হা/১৩৪১।
[28]. মুসলিম হা/২৬৭০; ছহীহুল জামে হা/৭০৩৯।
[29]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।
[30]. ত্বাবারানী, ছহীহুল জামে হা/৩৭৯৮।
[31]. বুখারী হা/২৬৫১; মুসলিম হা/২৫৩৫।
[32]. তিরমিযী হা/২৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; আবূদাঊদ হা/৪৫৯৬-৯৭; মিশকাত হা/১৭১-১৭২; ছহীহাহ হা/১৩৪৮, ২০৩, ১৪৯২।