বহুকাল আগের কথা। সে সময় আমরা জানতাম, সময় অটোমেটিক অতিবাহিত হয়। এটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কারো সাহায্য ছাড়া নিজে নিজেই ঘটে যায়। তবে কালের পরিক্রমায় আজ আমাদের জানা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মূলত সময় অতিবাহিত হ’তে চায় না। তাকে কষ্ট করে অতিবাহিত করতে হয়। আজ আমরা জেনেছি, সময় অতিবাহিত করা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। অথচ আমরা তা কখনো খেয়াল করতে পারি না। কারণ এই আলোচনা আমাদের মাঝে কখনোই হয় না। তবে আলোচনায় আসুক বা না আসুক, সময় অতিবাহিত করা একটি কঠিন কাজ। এর মাঝে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বর্তমান দুনিয়ার দিকে তাকালে যার শত শত দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়।
যুগে যুগে মানুষের সকল কঠিন কাজ সহজ করতে আবিষ্কৃত হয়েছে নানা ধরণের যন্ত্র ও পদ্ধতি। তেমনই সময় অতিবাহিত করার এই কষ্টসাধ্য কাজটি খুব সহজে সম্পন্ন করার জন্যও পথ-ঘাট কম আবিষ্কার হয়নি। এখন পর্যন্ত প্রতিটি দেশ এই দুঃসাধ্য কাজটিকে সহজ করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তারা মুখ ফুটে তাদের উদ্দেশ্য বলছে না। কারণ এটা সত্য হ’লেও শুনতে বেশ খারাপ শোনায়। যেমন বলা হ’ল, কয়েক লক্ষ মানুষের দেড় ঘন্টা সময় কাটানোর জন্য শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। সত্যিই বিষয়টা কেমন যেন প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে। সুতরাং ‘সময় কাটানো’ না বলে ‘মনোরঞ্জন’ বলতে হবে। তাহ’লে আর খারাপ শোনাবে না। মানুষ সময় অতিবাহিত করার জন্য কত কষ্ট করছে এবং এই খাতে কত বড় বড় বাজেট রাখছে তার হিসাব আপনাকে আশ্চর্য করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সেগুলোর দুয়েকটি নমুনা আপনাকে দেখাই।
২০২৪ সালে অফিসিয়ালভাবে ভিডিও গেমস তৈরি হয়েছে প্রায় ১৪ হাযারেরও অধিক। হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন ৪০টিরও বেশী ভিডিও গেমস তৈরি হয়েছে। কারণ সবার তো সব গেমস ভালো লাগে না। দুই তিন হাযার গেমসের মধ্যে যদি আপনার কোন গেম পসন্দ না হয় তবে আপনার সময় কাটানো তো মুশকিল কি বাত হয়ে পড়বে! এদিকে লক্ষ্য করে আপনার জন্য প্লে স্টোরে রাখা হয়েছে চল্লিশ লক্ষেরও বেশী গেমস। এই বিরাট প্রোজেক্টে আসলে কত মানুষ কাজ করছে বা কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে তার কোন পরিসংখান হয় না বলে আপনাকে সে তথ্য দিতে পারলাম না। এই বিশাল ভান্ডার থেকে আপনার সময় কাটানোর উপকরণ পসন্দ না হয়ে কোন উপায় নেই। আর হ্যঁা, তারা এর পেছনে যত টাকাই খরচ করুক, আপনি সেগুলো পেয়ে যাবেন একদম বিনামূল্যে।
যে ফেসবুকে আমরা ৫ মিনিটের জন্য ঢুকে দুই ঘন্টা অনায়াসে কাটিয়ে দেই, সেই ফেসবুকের পেছনে রয়েছে অনেক মানুষের একত্রিত পরিশ্রম। ফেসবুক এ্যাপস পরিচালনা করতে কর্তৃপক্ষের প্রতি মাসে ৫.৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। বাংলাদেশী টাকায় যা ৬৩,৮০০ কোটি টাকা। এত টাকা খরচ করে বলেই তো সেখানে এত সহজে মোলায়েমভাবে সময় কাটে! যদিও সেখানে অসাধারণ কিছুই দেখানো হচ্ছে না। সেখানে হয়ত আপনি ময়লা কার্পেট পরিষ্কার করা দেখছেন। নয়ত রঙের বোতল ভাংতে দেখছেন। আর না হয় একজন মানুষ কিভাবে ব্রাশ করে, কিভাবে নাশতা করে এগুলোই দেখছেন। এভাবেই তারা আপনাকে সময় কাটাতে সাহায্য করছে। এই ব্যাপক সেবাটি আপনাকে তারা একদম ফ্রিতে দিচ্ছে। আপনার সময় কাটানো সহজ হোক, এতটুকুই তাদের প্রত্যাশা। সময় কাটানোর কাজে আপনি তাদের দেয়া এই সেবা ব্যবহার করবেন, এটাই তাদের পরম পাওয়া।
সময় কাটানো কতটা কঠিন সেটা হয়ত এখনো আপনি বুঝতে পারেননি। কারণ আপনি শুধু জানেন, পড়াশোনা করাই কঠিন। পড়াশোনাই সহজ করা দরকার। সময় কাটানো সহজ করা দরকার এটা আপনি কখনো ভাবেননি। আসুন আপনাকে আরেকটি হিসাবের লিস্ট দেখাই। ৯০ মিনিটের একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড়দের বেতন, নিরাপত্তা খরচ, স্টাফ ও ভলেন্টিয়ারের পারিশ্রমিক, বিদ্যুৎ বিল, সম্প্রচার খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকারও অধিক খরচ হয়। একবার ভাবুন, মাত্র দেড় ঘন্টা সময় কাটানোর জন্য মানুষকে কতবড় বাজেট করতে হয়! অথচ ১০০ কোটি টাকার বই আছে এমন লাইব্রেরীর সংখ্যা বাংলাদেশে চার থেকে পাঁচটির বেশী নয়।
আচ্ছা বাদ দিন। বাংলাদেশ তো আর এমন আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করে না। তবে বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপিএল এর আসর জমে। সেখানে আনুমানিক তিন থেকে চার শ’ কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশের গরীব জনগণ। বিপিএল এর জন্য যেহেতু সরকারী বাজেট হয় না তাই সরকারকে এখানে দোষ দেয়ার মত কিছু দেখি না। তবে আর দশটা দেশের মত আমাদের দেশও সময় কাটানো সহজকরণে পিছিয়ে নেই। উন্নয়ন খাতের বাজেট চলে যায় মনোরঞ্জন খাতে। শিক্ষা খাতের বাজেট চলে যায় শিক্ষার্থীদের বিনোদন অনুষ্ঠানে। এতকিছুর পরেও গত অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেট ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের ১.৭৬ শতাংশ মাত্র! যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ শতকরা হিসাবে এর চার থেকে ছয়গুণ বেশি বাজেট রাখে। গত ২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে মোট বাজেট ছিল ১৭৪ কোটি টাকা। যা দিয়ে দুইটি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা সসভব নয়।
গত আইপিএল ২০২৪ আসরে অস্ট্রেলিয়ান একজন খেলোয়াড়ের নিলাম হয় ২৪.৭৫ কোটি রূপিতে। বাংলাদেশী টাকায় যা ৩৩ কোটি প্রায়। যা বেতন কাঠামো হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের ২৫ বছরের বেতনের চেয়েও বেশী। এখন আপনি বলতেই পারেন, আমি এভাবে কেন হিসাব করছি। দেখুন! আমি আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি, খেলাধুলা ও বিনোদন খাতে যে অর্থ খরচ করা হচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও বিজ্ঞান, গবেষণা, আবিষ্কারে খরচ করার দরকার হচ্ছে না। কারণ বিনোদন মানুষের জীবনে যতটা প্রয়োজন; গবেষণা, আবিষ্কার এগুলো ততটা প্রয়োজন বোধ হয় না। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন যে বস্ত্ত, সেটা টাইম পাস। আশাকরি এটা আপনি বুঝতে পেরেছন।
বিরক্তিকর হিসাব কষাকষি রেখে চলুন একটু সন্ধ্যার শহরে পথ-ঘাটের সৌন্দর্য দেখে আসি। আমরা যখন সন্ধ্যার পরে শহরের রাস্তার দিকে তাকাই তখন এক জনকোলাহলপূর্ণ সড়ক দেখতে পাই। রাস্তার ধারে ধারে চেয়ার পেতে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে হাযার হাযার তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী। মেতে উঠছে বিভিন্ন খোশগল্পে। এই শ্রেণীর মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিকেল থেকে অর্ধরাত পর্যন্ত অনেক ফাস্ট ফুডের দোকান। নদীর ধারে বা যেকোন নিরিবিলি পরিবেশে মেলা বসছে প্রতিদিন। আপনি জানেন, এরা অধিকাংশই ছাত্র-ছাত্রী। প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের নয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। এরা এমন স্তরে লেখাপড়া করে, যে স্তরে একজন শিক্ষার্থীকে অর্ধরাত পর্যন্ত স্টাডি করতে হয়।
এখন চিত্রটা একটু ভিন্ন। অনেক বেশী পড়াশোনা থাকার কারণে তাদের সময় কাটতে চায় না। সন্ধ্যার পরে আড্ডা মেরে, ক্যারাম খেলে অনেক কষ্টে তাদেরকে সময় অতিবাহিত করতে হয়। রাতে কমপক্ষে দুইটা পর্যন্ত মোবাইল টিপতেই হবে। কারণ রাত তিনটায় ঘুমালে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত ঘুমানো সম্ভব হয়। যদি কোনদিন দুর্ঘটনা বশত প্রথম রাতে ঘুমিয়ে পড়ে তবে পরের দিন সকালে ঘুম পূর্ণ হয়ে যায়। নতুন করে আবার ঘুম আসতে চায় না। জোর করে ঘুমালেও শরীর ব্যথা করে। সকালে আড্ডা দেয়ার জন্য বন্ধু-বান্ধবও জোটে না। সেদিন সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হ’তে কত যে কষ্ট হয় তা বলার মত নয়। এত সময় কাটানো কি চাট্টিখানি কথা! তখনই বন্ধু হয়ে পাশে আসে গেমস, ফেসবুক ইত্যাদি। প্রথম রাত থেকে টানা রাত তিনটা পর্যন্ত ব্যবহৃত হওয়া মোবাইলটার ওপরে যুলুম চলে আবার টানা বিকেল পর্যন্ত।
মাদ্রাসা পড়ুয়াদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ভিন্ন নয়। তাদেরও সময় অনেক বেশী। কাটতেই চায় না। অপারগ হয়ে তারা লুকিয়ে ফোনে ফেসবুকিং করে। কেউ বা গেমে আসক্ত হয়ে সময় অতিবাহিত করার গুরুদায়িত্ব (?) পালন করে। যারা এগুলো করে না তারা গোল হয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটায়। এরা ক্লাসের গুরুত্বপূর্ণ পড়া ছেড়ে খেলা দেখে। যাদের জন্য লাফালাফি করে, ঝগড়া-বিবাদ করে তারা এদেরকে চেনেই না। এরা সাত শ’ টাকায় ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার জার্সি কিনতে পারে কিন্তু চার শ’ টাকায় একটি আরবী অভিধান কিনতে পারে না। খেলায় খেলায় দিন কাটিয়ে দিনশেষে এরা আবার নিজেদের খেলোয়াড় বা সাপোর্টার পরিচয় না দিয়ে বিশিষ্ট ভাষাবিদ, আলেম, দাঈ হিসাবে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বড়ই আশ্চর্য!
আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, এদের কাছে কী পরিমাণ সময় আছে। এদের সময় কাটানোর পদ্ধতি ও পন্থা দেখলে মনে হয়, এরা যেন অনাদী অনন্তকালের জন্য দুনিয়ায় এসেছে। এদের জীবনে না আছে ইবাদত। না আছে ইলম অর্জন। আর জাতির উপকারার্থে কিছু অবদানের কথা না হয় নাই বললাম। আপনি বিশ্বাস করুন! এরা পাগল নয়। তবে এরা আপনাকে পাগল মনে করবে, যদি আপনি তাদেরকে সময়ের মূল্য বুঝাতে চান। তারা মনে করবে, আরে! তারা যদি লেখাপড়া করে, সময়কে কাজে লাগায় তবে আপনার বড়ই লাভ হয়ে যাবে। তারা মনে করবে, তাদেরকে উপদেশ দেয়ার মাধ্যমে আপনি নিজের জ্ঞান যাহির করছেন। তারা যদি আপনার কথা মানে তবে আপনি বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে যাবেন ইত্যাদি। সত্যি! এক আজব জেনারেশন পেয়েছি আমরা। যাদের কাছে জীবনের একটিই অর্থ, মাস্তি। জ্ঞান গরিমায় উন্নত হওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই কিন্তু কিভাবে টাইম পাস করতে হয় তার সবরকম কলাকৌশল এদের রপ্ত করা আছে। কারণ জীবনে কিছু হোক বা না হোক, খেল তামাশায় সময়টা কাটাতেই হবে। এটাই যেন জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে।
এরা আপনাকে আর কিছু শোনাতে পারুক বা না পারুক টাইম পাসের গুরুত্ব সম্পর্কে সাজিয়ে গুছিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারবে। অন্তত এতটুকু তো সবারই মুখস্থ রয়েছে যে, বিকেল বেলা বাইরে ঘুরতে যাওয়া মস্তিষ্কের জন্য ভাল। একটানা বেশীক্ষণ পড়ালেখা করলে মাথার ওপরে চাপ পড়ে। আর ঐ আয়াতের অর্থও মুখস্থ আছে যেখানে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা যমীনে সফর কর...। এই কথাগুলো সবই সঠিক। তবে আমি বুঝি না, পড়ালেখায় গন্ডমূর্খ থেকে এসব বাণী উচ্চারণ করতে তাদের লজ্জা লাগে না! এতকিছু মেইন্টেন করতে গিয়ে অধিকাংশের মগজ যে বছরের পরে বছর নিরেট অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে সেদিকে কোন খেয়াল আছে? সারাদিন যে লেখাপড়াই করে না তার কিসের মাথা ঠান্ডা করা! সারা বছর যে পড়ালেখার কোন চাপই নেয়নি তার কিসের আল্লাহর যমীন ঘুরতে শীতকালে কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন যাওয়া!
দেখুন! হঠাৎই আমার কথার মোড় ঘুরিয়ে নেয়ার জন্য আমি দুঃখিত নই। কারণ আমার উদ্দেশ্য ছিল, এই কথাগুলোই আপনাকে বলা। আমি কষ্ট অনুভব করি। কেননা আমার মনে হয়, তারা সময় কাটানোর জন্য যতটা ত্যাগ স্বীকার করে, তার অর্ধেকও যদি পড়াশোনার জন্য করত তবে জাতি তাদের কাছে অনেক কিছুই পেত। এই আফসোস আমাদেরকে কুরে কুরে খায়! অবশ্য সকল দোষ তাদেরও নয়। বরং আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি যেখানে সময় নষ্ট করাই একটি সামাজিকতা হয়ে দাড়িয়েছে। এই সমাজে যারা টাইম পাস করে না তারা যেন সাধারণদের চোখে একেকটি রোবট। এদেরকে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়। নিজেদের মাঝে বলাবলি করে, আরে! এদের জীবনে কি সুখ, শান্তি, ঘোরাঘুরি বলতে কিছুই নেই! এমন রোবটিক জীবন যাপন কেমনে করে এরা! ইত্যাদি!
সামাজিকতার দৃষ্টিতে মানুষের সংজ্ঞা একটু ভিন্ন। তারা মনে করে, মানুষ হয়ে জন্মেছি; মাগরিব পরে তো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত আড্ডা জমাতেই হবে। মানুষ মানেই প্রতিদিন নিয়ম করে একটু ঘোরাঘুরি করতেই হবে। একটু গপ্পগুজব করতে হবে। সপ্তাহে একদিন পিকনিক করতে হবে। এগুলো না করলে কি জীবন হয়! আপনি আশ্চর্য হবেন, যারা জীবনে কিছুই করেনি তারাও আপনাকে বলবে, জীবনে যদি একটু আয়েশ করতেই না পারি তবে এত কষ্ট করছি কেন! আমি বুঝি না, তারা এত সুন্দর সব ডায়ালগ মুখস্থ করে কোত্থেকে!
হ্যা! আমরাও হালকা বিনোদন, আড্ডা, গল্পগুজব, ঘোরাঘুরির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করি না। একটু ঘুরতে যাওয়া, একটু গল্প করা, একটু ফেসবুক চালানো যেতেই পারে। তবে সেটা জীবন গঠনকে জলাঞ্জলি দিয়ে তো নয়। একজন মানুষ কখনোই সারাদিন পড়তে পারে না। সারাদিন গবেষণা করতে পারে না। কাজ করতে পারে না। তার একটু বিনোদনের প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে একটু ফুরসতের। তবে ফুরসতেই যে জীবন পার করে দিতে হবে এই চিন্তাধারা কখনোই আদর্শ চিন্তাধারা হ’তে পারে না। একজন মুসলিমের চিন্তাধারা হ’তে পারে না।
প্রিয় ছাত্র ভাই! ঘুনে ধরা জীবন আর কতদিন দাঁড়িয়ে থাকবে। তা তো একসময় ভেঙ্গে পড়বেই। তখন এর ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কি আর ভাগ্য পরিবর্তন হবে? একটা কথা মনে রাখবেন! সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার ছাড়া কখনো সফলতা সম্ভব নয়। ছাত্র হিসাবে আপনার কিছু দায়িত্ব আছে। জীবনের একটি লক্ষ্য আছে। শুধু হেসে খেলে ফুর্তি করে কারো জীবন যায় না। ফুর্তিময় জীবন অচিরেই ভারি হয়ে আসে। সুতরাং জীবনে অর্জন ও উপার্জন করতে শিখুন। সময় ব্যয় করার আগে ভেবে দেখবেন, সময় দিয়ে আমি কী পাচ্ছি? অর্জন নাকি উপার্জন! যে বস্ত্ত অর্জনও হয় না উপার্জনও হয় না সে বস্ত্তর জন্য মূল্যবান সময় ব্যয় করবেন না।
দেখুন! মানুষ ইলম অর্জন করে। ছওয়াব অর্জন করে। টাকা উপার্জন করে। আর ফুর্তি? কোনটাই করে না। বিনোদন বা ফুর্তি; অর্জন বা উপার্জন করার যোগ্য কোন বস্ত্তও নয়। এটা যতদিন আপনি বুঝতে না পারবেন ততদিন আপনি সময়কে কাজে লাগানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন না। আপনার সাথে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। তখন আমি বিশের কোঠা পাইনি। আমাদের একটি বন্ধু মহল ছিল। আমরা প্রতি সপ্তাহে একদিন ‘কাজের লিস্ট’ করতে বসতাম। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা কাগজে লিখতাম, আগামী এক সপ্তাহে আমি কী কী আত্মউন্নয়নমূলক কাজ করব। যেমন, ১০০টি নতুন আরবী শব্দ মুখস্থ করা। ৫০ পৃষ্ঠা আরবী কিতাব পড়া। ৫০ পৃষ্ঠা বাংলা সাহিত্য পাঠ করা। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে একটি হ্যান্ডনোট তৈরি করা। সাত পৃষ্ঠা রোজনামচা লেখা। মোটকথা, আত্মউন্নয়নের জন্য যাকিছু দরকার। এরপর এক সপ্তাহে আমরা সে কাজগুলো পূর্ণ করতাম। যেটা হয়ে যেত সেটা টিক দিতাম। যেটা হ’ত না সেটা লিস্টে নিজ অবস্থায় থেকে যেত।
পরের সপ্তাহে আবার যখন কাজের লিস্ট করতে বসা হ’ত তখন আগের সপ্তাহের লিস্ট পর্যালোচনা করা হ’ত। দেখা হ’ত, কে কয়টি বিষয় পূর্ণ করতে পেরেছি। অনেকেই লিস্টের কাজগুলো পূর্ণ করতে সপ্তাহের শেষ দু’দিন এমনভাবে পড়ালেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত যেন তার পরীক্ষা চলছে! অথচ আমরা এই কাজগুলো নিতান্তই ফাঁকা সময়ে করতাম। প্রতি সপ্তাহের কাজের লিস্ট আমাদের পড়ার টেবিলের এক কোনায় আঠা দিয়ে লাগানো থাকত। পড়তে বসলেই আগে লিস্টের দিকে চোখ যেত। মাথায় একটি চাপ অনুভূত হ’ত। এই চাপ আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর তৈরি করে নিতাম। ফলাফলে আমরা পেতাম কিছু অর্জন। কারণ আমরা জানতাম, ফুর্তি, ভালোলাগা, আবেগ-অনুভূতি স্বল্প সময়েই ফুরিয়ে যায়। তবে অর্জন ফুরায় না। থেকে যায় আজীবন।
আমার মনে হয়, যুগে যুগে যারাই কিছু অর্জন করে তারা প্রচেষ্টার মাধ্যমেই করে। শুধু শুধু টাইম পাস করে কখনো অর্জনের ঝুলি ভারি হয় না। সুতরাং হে ভবিষ্যতের রাহবার! ভবিষ্যৎ আপনাকে যোগ্য হওয়ার আহবান জানাচ্ছে। তাই এখন থেকেই টার্গেট নিয়ে কাজ করা শিখুন। এখন থেকেই চাপ নিতে শিখুন। প্রেশার নেয়া ছাড়া নিজেকে মেলে ধরা যায় না। সাপ্তাহিক কাজের লিস্ট তৈরি করুন। এতে আপনি কাজে বারাকাহ পাবেন। টার্গেট পূর্ণ করতে না পারলেও জানতে পারবেন, আসলে আপনি এক সপ্তাহে কতটুকু নিজের উন্নতি সাধন করছেন। আপনার সময়-নদীতে যে স্রোত বয়ে যাচ্ছে তা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। সেই স্রোতে গা এলিয়ে দিবেন না। ভবিষ্যৎ মুসলিম জাতির জন্য আপনাকে অবদান রাখতে হবে। সুতরাং স্রোতে গা এলিয়ে দেয়া তো আপনার মানায় না। হেরে যাওয়া, ঝিমিয়ে যাওয়া, দমে যাওয়া কখনো আপনার বিশেষণ হ’তে পারে না। মনে রাখবেন, আপনি ছাত্র! সারা দুনিয়া বিনোদনের উপকরণে তলিয়ে গেলেও এই টাইম পাসের পসরা সাজানো জীবন আপনার জন্য নয়।
*. শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।