ভূমিকা : দিনে দিনে আমাদের সমাজে এক ভিন্ন ধরণের অজ্ঞতার প্রকোপ বাড়ছে। যেমন কোন বিষয়ে আমার অজ্ঞতা রয়েছে, অথচ আমি জানিই না যে, আমি সে বিষয়ে অজ্ঞ। এই অবস্থার সুন্দর একটি আরবী নাম আছে- জাহালা মুরাক্কাবা। দর্শনশাস্ত্রে কোন বস্ত্ত সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকে ‘ইলম’ বলে। এক-তৃতীয়াংশ জ্ঞানকে বলে وَهْمٌ। অর্ধেক জ্ঞানকে বলে شَكٌّ। দুই-তৃতীয়াংশ জ্ঞানকে বলে ظَنٌّ। কিছুই না জানলে তাকে বলে ‘জাহালাত’। ভুল জানাকে বলে ‘জাহালাতে মুরাক্কাব’। আজ আমি এমনই একটি বিষয়ে বলতে চলেছি, যে বিষয়ে আমরা অজ্ঞতায় ডুবে থেকেও নিজেদের বেশ বিজ্ঞ ভাবি। সেটা হ’ল, আরবী ভাষা, সাহিত্য ও ব্যাকরণ।
উপমহাদেশে দ্বীনী শিক্ষা এবং দুনিয়াবী শিক্ষা দীর্ঘদিন যাবৎ একই ধারায় চলে আসছে। সেকালে কখনো বাগদাদ, কখনো নীসাপুর, কখনো বোখারা, কখনো মদীনা ইলমের মারকায ছিল। সেসব কেন্দ্র থেকে যেমন কুরআন-হাদীছের ধারক তৈরি হয়েছে, তেমনই তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক। তবে একসময় এই দ্বিমুখী শিক্ষা দুই ধারায় ভাগ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান ভিন্ন হয়ে যায়। ভিন্নতা শুধু লেখাপড়ায় নয়, ভিন্নতা আসে চেতনায়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা সবাই বাংলাদেশী হয়েও কেউ আরবের চেতনা লালন করি। কেউ আবার লালন করি বৃটিশদের রেখে যাওয়া পশ্চিমা চেতনা। এজন্যই আমাদের কোন বিদ্যালয়কে স্কুল বলা হয়, আবার কোনটাকে মাদ্রাসা বলা হয়। কোন বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক আরবের পাঞ্জাবী টুপি পরেন। আবার কোন বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক পরেন ইংরেজদের কোট-টাই।
দুনিয়াবী শিক্ষা থেকে বিভক্ত হয়ে আসা ইসলামী শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে আজ আরবী চর্চার বেহাল দশা। বিষয়টা সহজভাবে বুঝতে একটু কল্পনা করুন, কোন মাদ্রাসার নোটিশ বোর্ডে একটি নোটিশ ঝুলানো হয়েছে। যার আগাগোড়া ইংরেজীতে লেখা...। বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তাই না? এবার কল্পনা করুন, একটি নোটিশ ঝুলানো হয়েছে। যার আগাগোড়া আরবী...। এবার বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। নোটিশের সামনে উৎসুক ছাত্রদের ভিড় জমে গেছে। যেন তারা আজব কোন জিনিস দেখছে। তাই না? এটাকে কি কখনো বৈষম্য বলে মনে হয়েছে আপনার? নাকি কখনো ভাবার প্রয়োজনই মনে হয়নি? দেখুন! আমরা আমাদের বিদ্যালয়কে ইংরেজীতে স্কুল না বলে আরবীতে মাদ্রাসা বলি। সেখানে আমরা যে জ্ঞান চর্চা করি তা আরব থেকে এসেছে। সেখানে আমরা যে পোষাক অনুমোদন করি সেটাও আরব সভ্যতা থেকে এসেছে। আমরা
* শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
যে চেতনা লালন করি সেটাও আরব থেকেই এসেছে। কারণ সকল পরিচয়ের পূর্বে আমরা মুসলমান। ঈমান ও ইসলাম ব্যতীত আমরা নিজেদের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি না। আমরা বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি, যে ভাষাভাষীই হই, আমাদের নাড়ি পোঁতা আছে দূর আরবের হারামাইনে। সুতরাং একজন মুসলিম সর্বপ্রথম বিদেশী ভাষা হিসাবে আরবী শিখবে। এটাই আখেরাতমুখী চেতনার দাবী।
আজ যখন আরবী ও ইংরেজীকে সমন্বয় করে একটি উন্নত সিলেবাস প্রণয়নের চেষ্টা চলছে ঠিক তখনই আমরা একটি ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কলম ধরেছি। আমাদের এমন কর্মকান্ডে আমাদেরকে পক্ষপাতী বা পক্ষবিদ্বেষী মনে করবেন না। আমরা মনে করি, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আরবী ভাষা ‘মূল’ ও ইংরেজী ‘শাখা’। আমরা বিশ্বাস করি, মূল সর্বদা শাখা অপেক্ষা অধিক গুরুত্বের দাবী রাখে। যখন মূল ও শাখা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে তখন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের দায়িত্ব হয়ে যায়। আমাদের কথাগুলো শাখা বিরোধী মনে হয়। যেন আমরা শাখার বিরোধিতা করছি। তবে কখনই আমরা শাখা বিরোধী নই। আমরা কেবল মনে করি, যে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে সে নদী বরাদ্দের সিংহভাগ পানির হকদার! সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাষা শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে কলম ধরলে আরবীকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা আমাদের দেশে আরবী ভাষায় বিশেষজ্ঞ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট : আমাদের তালিবুল ইলমরা যখন পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নেয়া শুরু করে তখন আমরা লক্ষ্য করি, তারা দিন-রাত পরিশ্রম করে নিজেদের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। আমরা যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, পরীক্ষার প্রস্ত্ততি কিভাবে নিচ্ছ? তারা বলে ২/১টা বিষয়ে কোচিং করছি। আলাদাভাবে পড়াশোনা করছি। প্রতিদিন কিছু লেখালেখি করছি-এই আরকি। আপনাকে হয়ত বলে দিতে হবে না, তারা যে দুই/একটি বিষয়ে কোচিং করছে সেগুলো কোন কোন বিষয়। তারা এগুলোই আলাদাভাবে পড়াশোনা করছে। না বোঝা পড়াগুলো বুঝিয়ে নিতে বিভিন্ন শিক্ষকের দ্বারস্থ হচ্ছে। আপনি যদি তাদের বলেন, আরবী সাহিত্যের কি অবস্থা? তারা বলে, হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। নাহু? ইনশাআল্লাহ! ছরফ? ইনশাআল্লাহ! হাদীছ, তাফসীর সব ‘ইনশাআল্লাহ’। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এগুলো বিষয়ে তাদের আল্লাহর ওপর ভরসা এত বেশী কেন! অথচ তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন, বিসমিল্লাহ শব্দে মীমের উপর যের হ’ল কেন? ইসম শব্দের আলিফকে বাদ দেয়া হ’ল কেন? আলিফ যদি মূল হরফ না হয়, তবে ইসম শব্দের মূল হরফ কি কি? এধরনের আলিফের নাম কি? তখন তারা আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসবে। বলবে, শিক্ষক আমাদেরকে এসব পড়াননি। শিক্ষক কি পড়িয়েছেন? এই তো, বিসমিল্লাহ অর্থ ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি’। এতটুকুই।
আমাদের মনে হয়, তাদের এই তাওয়াক্কুলের পেছনে আমরাই দায়ী। আমরাই তাদেরকে সকল পরীক্ষায় পার করে দিয়ে তাদের নিজেদের প্রতি সুধারণা তৈরিতে সাহায্য করেছি। একে একে আরবীর সবগুলো ভিত ধ্বংস করে ফেলেছি। তারা সেই প্রাথমিক স্তর থেকেই দেখে আসছে, আরবী বিষয়গুলো পরীক্ষার আগে একটু পড়ে নিলেই বেশ ভাল নম্বর পাওয়া যায়। তারা কখনোই নিজেদেরকে আরবীতে দুর্বল হিসাবে কল্পনা করেনি। কারণ আরবীর দুর্বলতা তাদের সামগ্রিক জীবনে কখনো কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং যারা অন্যান্য ভাষার তুলনায় আরবীর প্রতি যত্নবান, তাদেরকে তারা বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতন মনে করছে।
আমাদের এই গাফিলতি মাদ্রাসাগুলোতে কি পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে সেটা কল্পনাতীত। মাধ্যমিক পার হওয়ার পরে ছাত্ররা বুঝতে পারছে, পরীক্ষায় ৯৯ পাওয়াই যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। কারণ, টেনেটুনে ৮০ পাওয়া ইংরেজীতে কিছুটা হ’লেও যোগ্যতা অর্জন হয়েছে। মোবাইলের মেসেজগুলো পড়া যাচ্ছে। ইংরেজী সাইনবোর্ড পড়ে বোঝা যাচ্ছে। মোটকথা, ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে তাকে কেউ বোকা বানাতে পারবে না। তবে ৯৯ পাওয়া আরবী সাহিত্যে কোনই যোগ্যতা অর্জন হয়নি। এক হরফও হয়নি। এটা বোঝার পরে তারা আরবীকে পাশে রেখে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ইংরেজীকেই বেছে নিচ্ছে এবং যুক্তি দিচ্ছে, এই যুগে আরবী পড়ে কোন লাভ নেই। আরবী পড়ে সরকারী চাকুরি নেই। এই শ্লোগান মুখে এবং সরকারী চাকুরির স্বপ্ন বুকে নিয়ে তারা দাখিলের পরে মাদ্রাসা ছেড়ে বিভিন্ন কলেজে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলাফল হ’ল মাদ্রাসাগুলো হারাচ্ছে তাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের। আমরা ভুগছি আলেমশূণ্যতায়। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আমরা আলেম তৈরির স্থানে সেই শূণ্যের কোটাতেই থেকে যাচ্ছি। এরপরেও আমরাই আবার বেছে বেছে মেধাবীদের পরামর্শ দিচ্ছি, মাদ্রাসায় পড়াশোনা বাড়তি হিসাবে রেখে কলেজ, ভার্সিটিতে নিয়মিত হও! ভবিষ্যতে তো কিছু করতে হবে! নিজের পাকা ধানে নিজেই মই দেয়ার এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ বোধ হয় আর নেই।
সারা বিশ্বে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। সেখানে আপনার ছেলে যদি কুরআন-হাদীছ নিয়ে গবেষণা করে তবে বিজ্ঞানের খুব একটা ক্ষতি হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। ভার্সিটি, মেডিকেল ও পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের সিংহভাগ মেধাবীদের দখলে নিয়ে বসে আছে। অল্পকিছু মেধাবীদের আমরা মাদ্রাসা অঙ্গনে পাই। দিনশেষে তারাও যদি সাইন্সের দোহাই দিয়ে সেদিকেই চলে যায় তবে আমাদের দ্বীনী শিক্ষার ভবিষ্যৎ কি? দেখুন! শুধু লড়াই করাই জিহাদ নয়, দ্বীনী ইলমের এই ক্রান্তিলগ্নে নিজের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটিকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করা ও নিজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিকে ইলমের খেদমতে প্রস্ত্তত করাও একটি জিহাদ। আজ অনেক আলেমও যার প্রয়োজন বোধ করছেন না। কারণ নিজের নাতিপুতিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে দ্বীনী শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার কোন অবকাশই তারা পাচ্ছেন না।
আরবীকে আমরা কতটুকু আপন করতে পেরেছি?
আমি এক বইমেলায় মন্তব্যবহির দায়িত্বে ছিলাম। শিক্ষক, গবেষক, প্রভাষকগণ যারা বইমেলায় এসেছিলেন তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে মন্তব্য নেয়াই ছিল আমার কাজ। সেখানে দেখেছিলাম, বাংলায় লেখা মন্তব্য খুবই কম আসছিল। যারা ইংরেজীতে ব-কলম তারাও ‘ভেরি নাইস’ লিখে স্বাক্ষর করছিলেন। এর বাইরেও দুয়েকজন পেয়েছিলাম যারা আরবীতে মন্তব্য লিখেছিলেন। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন। মাদ্রাসার কোন শিক্ষককে আরবী মন্তব্য লিখতে দেখিনি। তখন আমার বয়স খুবই কম ছিল। নচেৎ মাদ্রাসার উস্তাদগণকে আরবী না লেখার কারণ জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার ঝুলি কিছুটা সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করতাম।
ইংরেজী পড়ুয়া অনেককেই দেখেছি, তারা বাজার সদাইয়ের তালিকা পর্যন্ত ইংরেজীতে করেন। মন্তব্য ইংরেজীতে লিখেন। স্বাক্ষর ইংরেজীতে করেন। তাদের লেখা মন্তব্য কে বুঝল, আর কে বুঝল না সেটা তাদের কাছে বিবেচনার বিষয় নয়। তারা নিজেদের জীবন বৃত্তান্ত ইংরেজীতেই তৈরি করেন। ইংরেজী যারা বোঝে না তাদের দিকে লক্ষ্য করে একটি বাংলা জীবন বৃত্তান্ত তৈরি রাখেন না। আমি তাদের প্রশংসা করি। কারণ তারা ইংরেজী শিখেছেন এবং তাকে আপন করতে পেরেছেন।
পক্ষান্তরে আরবী ভাষায় আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে অবনতির কারণ সম্পর্কে বললে শুরুতেই বলতে হবে, আরবীর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা বিপদে পড়লে একটা আরবী কিতাব খুলি। বিপদে পড়লে দু’লাইন আরবী লিখি। নিজ ইচ্ছায় ও আগ্রহে কখনোই আরবী চর্চা করি না। নিজে যেহেতু চর্চা করি না তাই নিজ ছাত্রদের আরবী চর্চায় উদ্বুদ্ধও করতে পারি না। ক্লাসে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি না, ‘আমি তোমাদের আরবী শিক্ষক। তোমাদের আরবী সম্পর্কে যত প্রশ্ন মনে জাগে তা আমাকে করতে পার। আমি জানলে উপস্থিত উত্তর দেব। না জানলে জেনে এসে উত্তর দেব। তোমরা আরবী চর্চায় অগ্রগামী হও। তোমাদের যত সমস্যা হয়, সব সমস্যার সমাধান আমি দেব ইনশাআল্লাহ। আমি সবকিছু জানি না। আমিও শিখছি। আমিও চর্চা করছি। এসো! আমরা নিজেদের সমস্যাগুলো নিজেরা সমাধানের চেষ্টা করি’। মাদ্রাসার শিক্ষক হিসাবে আপনি যদি এভাবে বলতে পারেন এবং ছাত্রদের জিজ্ঞাসার যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেন তবে আপনার মাধ্যমেই আরবী চর্চার একটি বিপ্লব সাধিত হবে ইনশাআল্লাহ। আমরা দিনে দিনে মাদ্রাসায় পড়া সত্ত্বেও আরবীতে অজ্ঞতার যে অতল গহববরে তলিয়ে যাচ্ছি তাতে অচিরেই আমাদের দ্বীন শিক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটি জরাজীর্ণ হ’তে যাচ্ছে। এটা রোদ-ঝলমলে দিনের মত স্পষ্ট। তাই খুব তাড়াতাড়ি মাদ্রাসাগুলোতে আরবী চর্চায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী।
আরবী চর্চায় যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারি : আজকের এই দুরবস্থা যেহেতু আমরাই তৈরি করেছি, তাই আমাদেরকেই এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। আমরাই তাদেরকে আবার বুঝাবো, তোমরা এই যোগ্যতা নিয়ে আরবীতে ৯৯ পাওয়ার উপযুক্ত নও। এটা তাদেরকে নিরাশ করার জন্য নয়, বরং সচেতন করার জন্য। মুমূর্ষু ব্যক্তিকে যেমন কালিমার তালকীন দেয়া হয়, তেমনই আমরা তাদেরকে আরবী শিক্ষার তালকীন দেব। তালকীন দেয়া মানে, আমরাই তাদের সামনে অধিক আরবী চর্চার মাধ্যমে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করব। নিজে চর্চা না করে শুধু শুকনা বয়ান দিয়ে আরবীর জোয়ার আসবে না। আমাদের আরবী চর্চার জোয়ারই তাদের শুষ্ক মন সিক্ত করবে। সেখানে আবারো আরবীর আবাদ হবে।
আমরা মনে করি, আরবীর সাথে সম্পৃক্ত পরিচয় একটি গৌরবময় পরিচয়। ছাত্রদের সামনে আমরা নিজেদের আরবীর সাথে সম্পৃক্ততা এবং আরবীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করব। মন্তব্য আরবীতে লিখব। ছোটখাটো প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আরবীতে বলব। একজন আরবী শিক্ষক আরেকজন আরবী শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের সামনে আরবীতে কথা বলবেন। এতে তাদের আরবীর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হবে।
এই মিশনে খেয়াল রাখতে হবে, একচেটিয়া হ’তে গিয়ে আমাদের ভাষাগত স্বকীয়তা যেন নষ্ট না হয়। মোবাইলকে ‘জাওয়াল’ না বলে মোবাইলই বলুন। কী-বোর্ডকে ‘লাওহাতুল মাফাতেহ’ বলারও কোন প্রয়োজন নেই। ইংরেজীকে তার স্থানে রাখুন। বাংলাকেও বাংলার স্থানেই রাখুন। বাংলাকে আলাদাভাবে চর্চা করুন। শুধু আরবী কিতাব বুকে জড়িয়ে রেখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইসলাম বিরোধী অপশক্তির রহম ও করমে ছেড়ে দেয়াও চরম অন্যায়।
স্বকীয়তা বজায় রাখার একটি ছোট্ট উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি, একজন আরবী শিক্ষক যদি তার ক্লাসে বলেন, তোমাদেরকে আরবী রিডিং, রাইটিং ও স্পিকিং-এ পারদর্শী হ’তে হবে। তবে তার ভাষা সুন্দর হ’ল না। কারণ রিডিং, রাইটিং ইংরেজীতে হয়। আরবীতে ক্বিরাআত, কিতাবাত এবং মুকালামা হয়। ইংরেজীতে যদি এক্সপার্ট হয়। বাংলাতে হয় পারদর্শী। আরবীতে হয় মাহের। ভাষাভেদে তাকে শব্দ চয়ন করতে হবে। একজন মাদ্রাসার ছাত্র যদি পোষাক ও ড্রেস চিনে, তাহ’লে তার লেবাস চিনলে সমস্যা কি? সে যদি আরবী সাইনবোর্ড পড়তে পারে, একটি আরবী পত্রিকার ভাষা বুঝতে পারে, ছালাতে দাঁড়িয়ে ইমাম ছাহেবের তিলাওয়াতের অর্থ বুঝতে পারে তবে কার কি ক্ষতি হ’ল?
ছাত্রদের যে দরখাস্তগুলো শিক্ষক এবং মাদ্রাসাপ্রধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে সে দরখাস্তগুলো আরবীতে হ’তেই পারে। যেগুলো দরখাস্ত হিসাব বিভাগ বা ভিন্ন টেবিলে যাবে সেগুলো বাংলায় হ’লে সমস্যা নেই। ছোটখাটো দরকারে ক্লাস থেকে বাইরে যাওয়ার ছুটি নিতে আরবী বলা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বিভিন্ন মেয়াদী আরবী মুকালামায় পুরস্কার ঘোষণা করা যেতে পারে। যেমন বলা হ’ল, আগামী এক সপ্তাহ যারা পূর্ণ আরবীতে কথা বলবে তাদের মাঝে তিনজনকে পুরস্কৃত করা হবে। এক সপ্তাহ পরে যদি দশজন ছাত্র পাওয়া যায় তবে তাদের সবার সাথে আরবী মুকালামা করে তাদের দাবীর সত্যতা যাচাই করতে হবে এবং তাদের ফাছাহাত বিবেচনা করে পুরস্কৃত করা হবে। যদি ইচ্ছা থাকে তবে অনেক কিছুই সম্ভব। আমার এক শিক্ষক বলতেন, ‘করলে কাজ শরবত, না করলে পাহাড়-পর্বত’।
আমরা মনে করি, বাংলাভাষী হয়ে, বাংলাদেশে থেকেও যদি ইংরেজীকে আপন করা সম্ভব হয়, তবে মুসলিম হিসাবে বাঁচার জন্য দুয়েক হরফ আরবী শেখাই যায়। শুধু কুরআন-হাদীছ বোঝার স্বার্থে যদি বিভিন্ন জনপদ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে আরবী চর্চার মাধ্যমে আরবীকে তাদের নিজেদের ভাষা বানিয়ে নিতে পারে, তবে দু’লাইন আরবী শেখা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের হবে বলে আমরা মনে করি না। সুতরাং কে বুঝবে না, কে হাসবে, কে কি বলবে... এতগুলো বিবেচনার পাহাড় মাথায় নিয়ে আরবী চর্চা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।
শেষ কথা : শেষকথায় আমরা আবারো শুরুর কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা ইংরেজী বিদ্বেষী নই। জীবনে চলার জন্য ইংরেজীর প্রয়োজন আছে। আমরা ইংরেজীকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তবে একজন মুসলিম হিসাবে, একজন মাদ্রাসা ছাত্র হিসাবে তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি আরবীকে। আমি আমার পূর্ণ লেখায় কাউকে আঘাত করতে চাইনি। আমি প্রিয় তালিবুল ইলমদের আরবীতে উৎসাহ দিতে গিয়ে, শিক্ষকগণকে নিজের অন্তর-দহনের কথা শোনাতে গিয়ে যদি বাড়তি কিছু বলে থাকি, তবে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
আমরা মনে করি, একজন মাদ্রাসা ছাত্রকে ইসলামের স্বার্থেই বৈশ্বিক হ’তে হবে। সারাবিশ্বকে সামনে রেখে তাকে এগুতে হবে। তাকে ভাষাগতভাবে আরবী, বাংলা, ইংরেজীতে পারদর্শী হ’তে হবে। একই সাথে তাকে ‘জিও পলিটিক্স’ বুঝতে হবে, ‘ইকোনোমিক্স’ বুঝতে হবে, ‘সম্রাজ্যবাদ’ বুঝতে হবে, ‘পশ্চিমা দর্শন ও সংস্কৃতি’ চিনতে হবে। ‘জীবনদর্শন’ বুঝতে হবে। ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব’ বুঝতে হবে। ফেমিনিজম, কমিউনিজম, ডেমোক্রেসি বুঝতে হবে। আমি যদি বলি, তারা এগুলোর কোনটাই বোঝে না। আর এই কথাতে যদি আঘাত করা হয়, তবে সেই আঘাতই ভাল। কোনকিছু প্রতিষ্ঠা করার মত শক্তি ও সামর্থ্য কোনটাই হয়ত আমার নেই। তবুও তালিবুল ইলমদের মাঝে আরবী চর্চা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমার মন চায় বড্ড বেপরোয়া এবং কঠিন বিবেচনাহীন হ’তে।