ইমারত যেমন তার ভিত্তির দৃঢ়তা সমান শক্তিশালী, তেমনই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার আর্থিক সচ্ছলতায় সমান সুস্থির। অর্থের অভাবে যে কোন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। ঘুমিয়ে যায় অনেক শক্তিশালী চেতনা। পথ হারিয়ে ফেলে অনেক পথপ্রদর্শক। আর্থিক টানাপোড়েন থেকেই পরিবর্তন হয়ে যায় অনেক সম্ভাবনাময়ীদের চিন্তাধারা। পেটে ক্ষুধা আর মাথা ভরা চিন্তা নিয়ে এককালের মহামনীষীগণ দ্বীনের খিদমত করে গেলেও সাম্প্রতিককালে পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে তা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই নৈতিক অবক্ষয়, দ্বীন ও আক্বীদা সম্পর্কে অসচেতনতা, শারঈ মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে সীমাহীন মূর্খতা। এই সকল কিছুর মূলে রয়েছে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। এক কথায় বলতে গেলে ইলমের অভাব। ইলমের দুর্ভিক্ষ ও হাহাকার দেখলে মনে হয়, রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর মূর্খতার যুগ চলে এসেছে। একদিকে অজ্ঞতার ছড়াছড়ি, অন্যদিকে মানসম্মত শিক্ষা নাগালের বাইরে চলে যাওয়া; এই দুইয়ে মিলে যেন এক ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
মানসম্মত শিক্ষা সবার নাগালের বাইরে নয়। শুধুমাত্র সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণে যে ত্যাগ স্বীকার করতে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকে, সে মানসিকতা বড়ই মূল্যবান জিনিস। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত শিক্ষা দেয়া হ’লেও এই মানসিকতা তারা দিতে পারেন না। ফলাফলে দেখা যায়, যারা ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারে তাদের অধিকাংশের পড়ালেখার আগ্রহই নেই। যাদের আগ্রহ আছে তারা আবার বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় উন্নত প্রতিষ্ঠানের বারান্দা মাড়াতে পারে না। এই বিষয়টি মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। দেখা যায়, অনেক সম্ভাবনাময়ী মেধাবী ছাত্র পিতা-মাতার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শহরের উন্নত কোন মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতে পারে না। গ্রামের মাদ্রাসায় বছরের পর বছর লেখাপড়া করে পাকাপোক্ত মিলাদী মৌলভী তৈরি হয়। আমি তাদেরকে দোষ দিতে পারি না। কারণ এগুলো ছাড়া তাদের তেমন কিছু শেখানোও হয় না। পরবর্তীতে এটাই তাদের রুটি-রুযীর মাধ্যম হয়। ফলে অদূর ভবিষ্যতে তাদের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য কোন দ্বীনী খিদমত হয়ে ওঠে না।
এবার আসুন, আমরা আরেকটু পেছন থেকে আসি। যখন কোন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন মানুষের জীবনের সুরক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গ্রামে গঞ্জে নিরাপত্তা বাহিনীর ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়। এটার গুরুত্ব কাউকে বোঝাতে হয় না। আমাদের মত কাউকে কলম ধরে পাতার পরে পাতা লিখতে হয় না। মানুষ নিজে থেকেই ঘাঁটি তৈরি করে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিরাপত্তা চৌকির ব্যবস্থা করে। তারা জানে, এই দুর্গে যারা অবস্থান করছে তারা আমাদের জীবনের পাহারাদার। সুতরাং তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে এবং নিরাপত্তা সচল রাখার স্বার্থে সৈনিকদের সার্বিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। যদি জীবনের সুরক্ষার চিত্র এমন হয়, তবে ঈমানের সুরক্ষার চিত্র কেন ভিন্ন হবে? ঈমানের চেয়ে জীবনের দাম তো একজন মুসলমানের কাছে কখনোই বেশী হ’তে পারে না!
এখন যদি আপনি চোখ বুঁজে বলেন, পরিস্থিতি তো স্বাভাবিক রয়েছে! রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মূর্খতা বর্ষণের যুগ এখনো আসেনি। তবে আপনি একবার বাইরের পরিবেশ থেকে ঘুরে আসুন! টিকটক আসক্ত, মোবাইলগ্রস্ত, গেমস-খেলাধুলা-আড্ডাবাজিতে মত্ত যুব সমাজকে দেখে আসুন! তাদেরকে দেখে আসুন, যারা দ্বীন ও দুনিয়ার সকল কাজ ফেলে রেখে তাদের প্রাণের নায়ক বা খেলোয়াড়ের জন্য রাজপথে নামছে। টিকটকে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য কেউ কাঁচা শাক-সব্জি খাচ্ছে, কেউ সার্কাসের বাদরের মত দর্শকদের মনোরঞ্জন করছে। আশা করি, আপনার ধারণা পাল্টে যাবে। তাদের অধঃপতনের হিসাব কষতে আপনি অবশ্যই হিমশিম খাবেন। অথচ তারা মুসলমান। যদি এমনই হয় অবস্থা, তবে আর দেরী করার সুযোগ কোথায়? আসুন! প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিই। আর এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হ’ল ইসলামী শিক্ষার বিস্তার। কারণ ইসলামী শিক্ষা ছাড়া তারা আল্লাহকে চিনবে না! মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কথা জানবে না! তারা যদি জান্নাত-জাহান্নাম না চেনে তবে কিসের আশায় নিজেদের আমূল পরিবর্তন করবে? তাই আসুন! ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমেই তাদেরকে পরিবর্তন করি।
আমরা বলতে চাই, অস্ত্রের যুদ্ধে জীবন রক্ষার্থে যেমন জিহাদে নামতে হয়, তেমনি ইলমে দ্বীন রক্ষা করাও বর্তমান পরিস্থিতিতে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ এর অভাবেই আমাদের সকল অবক্ষয়। সারা বিশ্বের বিধর্মীরা যেখানে শুধু মুসলমানদের ঈমানের ওপর আক্রমণ করছে সেখানে ঈমান রক্ষা করা জিহাদ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে কোন দলীলের প্রয়োজন নেই। আর ঈমানী সচেতনতা তখনই বাড়বে যখন ইসলামী শিক্ষার মাত্রা বাড়বে, এটা তো কুরআন থেকেই প্রমাণিত (ফাত্বির ৩৫/২৮)। আপনি যেদিক থেকেই দেখুন, সমাধান একটিই। তা হ’ল প্রতি পাড়া-মহল্লায় ইলমের মারকায গড়ে তোলা। এটা এখন সময়ের দাবী। আপনি যদি বলেন, লেখালেখির মাধ্যমে জিহাদ করতে হবে। দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। তবে আমরা বলব, আপনি যে ময়দানেই আসুন না কেন, মাদ্রাসাই মুজাহিদীনের আতুরঘর। সেখান থেকেই প্রতিটি ক্ষেত্রে মুজাহিদ তৈরি হবে। ‘বর্তমানে কেন হচ্ছে না’ সে প্রশ্নের উত্তর আপনি একটু পরেই পেয়ে যাবেন।
আসুন, আমাদের কথিত দ্বীনের দুর্গ, যেখান থেকে মুজাহিদ তৈরি হওয়ার কথা বলছিলাম সেখান থেকে একবার ঘুরে আসি। বর্তমান সমাজে দুই ধরনের মাদ্রাসা প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত: সরকারী মাদ্রাসা। যার সিলেবাস প্রণয়ন এবং অর্থায়নে রয়েছে দেশের সরকার। এখানে শিক্ষার্থীদের যেমন খরচাপাতির চাপ নেই, তেমনই শিক্ষকদেরও রয়েছে মানসম্মত বেতন-ভাতা। তবে দক্ষ আলেম গঠনে সরকারী সিলেবাস যে ভূমিকা রাখছে তা সর্বদাই প্রশ্নবিদ্ধ। দ্বিতীয়ত: রয়েছে কওমী বা খারেজী প্রতিষ্ঠান। সরকারী নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে হওয়ার কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে খারেজী বলা হয়। তাদের সিলেবাস অপরিবর্তিত অবস্থায় যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। জনগণের অর্থায়নে চলে আসা এই ধারা কখনোই তাদের সিলেবাস সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করেনি। ‘উছূলে হাশতেগানা’ (আট মূলনীতি)-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত কওমী ধারা তাদের সিংহভাগ উছূল থেকে সরে আসলেও উর্দূ-ফার্সী সম্বলিত সিলেবাসে এত পাকা অবস্থান কেন গ্রহণ করেছেন সেটাও প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়। তবে মাদ্রাসা পরিচালনায় তাদের মূলনীতি অনুযায়ী সাধারণ মুসলমানের চাঁদা গ্রহণ করে তারাও আর্থিকভাবে বেশ স্বাবলম্বী।
এই দুই ধারার বাইরে কিছু সংস্কারমুখী ধারা এবং প্রতিষ্ঠানও লক্ষ্য করা যায়। যারা কওমী বা আলিয়া শিক্ষাধারা থেকেই বের হয়ে এসেছে। যারা যোগ্য ও যুগোপযোগী আলেম তৈরিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কওমী ধারায় উর্দূ-ফার্সীকে পাশ কাটিয়ে আরবীকে মূল লক্ষ্য করে যেমন তৈরি হয়েছে মাদানী নেসাব, তেমনই সরকারী সিলেবাসকে কার্যকরী রূপে পরিবর্তন করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড ও প্রতিষ্ঠান। তবে সমস্যা হয়েছে, এই মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে কিছু মাদ্রাসা বিভিন্ন অর্থিক উৎস থেকে স্বাবলম্বী হ’লেও অধিকাংশ মাদ্রাসাই শুধুমাত্র ছাত্রদের নিকট হ’তে উত্তোলনকৃত ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনের ওপর নির্ভরশীল। তারা পূর্ণ সরকারী হয়ে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা লাভ করতে পারছে না, আবার কওমী মাদ্রাসাগুলোর মত সরাসরি চাঁদা আদায়েও নামতে পারছে না। ফলে এই ধরনের মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্রদের লেখাপড়ায় খরচাপাতি মোটামুটি থাকলেও শিক্ষকদের মানসম্মত সম্মানী নেই।
শুধু ছাত্রদের প্রদেয় টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীল হয়ে কোন শিক্ষাধারা শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে পারে না। হ্যঁা, সংস্কার হয়, তবে সহজলভ্য হয় না। সংস্কারকৃত শিক্ষা যদি সবার সাধ্যের ভেতরে না হয় তবে সে সংস্কার কতটুকু ব্যাপকতা লাভ করতে পারে, আর কতটুকুই বা স্বার্থকতা পেতে পারে! দেখুন! আমরা তো দুনিয়ামুখী নই। শুধু ধনীর দুলালদের নিয়ে ভাবা আমাদের কাজ নয়। বরং ইতিহাস আমাদেরকে শিখিয়েছে, বিপ্লব সর্বদা নীচের দিক থেকে ওপরের দিকে যায়। এজন্য নবী-রাসূলগণের দাওয়াতের ধারা এবং বিশ্বের বিভিন্ন মিশনারীদের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদেরকেও গোড়া কেন্দ্রিক মেহনত বাড়াতে হবে। তাদেরকে আলেম বানাতে হবে, যাদের কাছে আলেম হওয়াটাই বড় স্বপ্ন। তারা কুরআন-হাদীছ শিখবে শিখাবে এটাই তাদের কাছে পরম পাওয়া। একজন কোটিপতির ছেলে মাদ্রাসায় পড়তে পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে সে লেখাপড়া শেষ করে পিতার ব্যবসায় না গিয়ে দ্বীনের খেদমত করবে এটা দিবাস্বপ্ন। এখানে বিভিন্ন মিশনারীদের কথা এজন্য বললাম যে, আপনি খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, ইহুদী-খৃস্টান মিশনারীর এতটা অর্থ রয়েছে যে, তারা চাইলেই বিভিন্ন জনপদের প্রভাবশালীদের কিনে ফেলতে পারে। কিন্তু তারা সেটা না করে বিভিন্ন অভাবগ্রস্ত এলাকায় কাজ করে। তারা নীচ থেকে ওপরে যেতে চায়, যদিও এক লাফে আগায় ওঠার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। বোঝা যায়, এটাই আমূল পরিবর্তনের তরীকা।
সুতরাং এককালে কি হয়েছে সেটা ভিন্ন বিষয়, তবে বর্তমান পরিবেশে যে কোন জিনিসকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সেখানে বিনিয়োগের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কারণ বিনিয়োগহীন ব্যবস্থায় একদিকে পর্যাপ্ত স্কলারশীপ না থাকার কারণে যেমন গরীব মেধাবীরা বঞ্চিত হবে, তেমনি অন্যদিকে মানসম্মত বেতন-ভাতা না হওয়ায় ভাল শিক্ষকরাও শিক্ষকতায় নাক সিটকাবেন। যতই ওয়ায-নছীহাত করা হোক না কেন, দিন শেষে রাতের বিশ্রামে সকল কম বেতনের শিক্ষকের মাথায় বাড়তি উপার্জনের চিন্তা জাগবে। ফলাফলে তারা সকল আমানতদারিতা বিসর্জন দিয়ে বাড়তি উপার্জনের রাস্তা খুজঁবেন। অবশ্যই খুঁজবেন। সেটা আজ বা কালের বিষয়।
আর্থিকভাবে দুর্বল এই শিক্ষাধারায় যে সমস্যাগুলো আগামীতে হ’তে পারে বলে আমরা মনে করি, তা খুবই শংকাজনক। কেননা সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা কখনো হারাবে না। শতাব্দী ধরে তারা কোন আলেম তৈরি করতে পারুক বা না পারুক, সেখানে দারস হোক বা না হোক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ চলমান থাকবে। কারণ মাস শেষে পকেটে মোটা বেতন আসার শতভাগ নিশ্চয়তা সেখানে রয়েছে। কিন্তু আমাদের সংস্কারমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন নয়। হাদীছের দারস চলমান থাকতে থাকতেই অর্থাভাবে বেতনহীনতায় ঘন্টার আওয়াজ থেমে যেতে পারে।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষক বহিরাগত। ভিন্ন যেলায় তাদের বাড়ী হওয়ার কারণে মাদ্রাসার আশেপাশে একটি ভাড়া বাসাতে পরিবার নিয়ে থাকার প্রয়োজন হয়। এক্ষণে মাদ্রাসার বেতনে যদি একজন শিক্ষক বাসা ভাড়া দিয়ে একমাসের চাল, ডাল কিনতে না পারেন তবে তিনি প্রাইভেটের দিকে ঝুঁকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তার প্রাইভেট শুধু প্রাইভেটেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং মাদ্রাসার সাধারণ দারসে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। যার ফলাফল গভীরভাবে ভাবতেই ভেতরে ভীতির উদ্রেক হয়। অনেক মেধাবী শিক্ষক রয়েছেন, যাদের চিন্তার মাধ্যমে শিক্ষাধারায় উন্নতি সাধন করা সম্ভব ছিল। তারা যদি একবার বাড়তি উপার্জনের তাকীদে বাইরের দিকে মনোযোগ দেন, তবে মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবার কোন সময়ই তাদের হবে না। যা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানকে স্তিমিত করে দেবে।
বেতন-ভাতা সীমিত হওয়ার কারণে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের ওপর ছাত্রদের পড়াশোনার পরিচর্যামূলক অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে পারবেন না। যেমন ক্লাসের বাইরে তাকরার ঠিকমত হচ্ছে কি-না সেটা দেখাশোনা করা। ছাত্রদের সাথে অবস্থান করে তাদেরকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করা। বছরের বিভিন্ন সময় নাহু, ছরফ, বালাগাত অথবা আরবী তা‘বীরের স্বল্পমেয়াদী কোর্স পরিচালনা করা। রামাযান কেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা ইত্যাদি। মোটকথা, অফিস টাইমের বাইরে শিক্ষকগণ কোন দায়িত্ব নিতে চাইবেন না। ফলাফলে ছাত্রদেরকে বাড়তি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অপারগ হয়ে পড়বেন। যে বিষয়টি মোটেও সুখকর হবে না।
আরো একটি ক্ষতির আশংকা করা যায়। তা হ’ল, শিক্ষকদের যোগ্যতায় সীমাবদ্ধতা তৈরি হওয়া। সাধারণত কোন শিক্ষকই পূর্ণ যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের পরে শিক্ষক হন না। অনেকে শিক্ষক হওয়ার পরেই নিজের দুর্বলতাগুলো দূর করেন। দেখা যাবে, সারাদিন বাইরের বিষয় নিয়ে ভাববার কারণে কোন শিক্ষকই আর কিতাবী দিকগুলোতে দক্ষতা-সম্পন্ন হয়ে উঠছেন না। বরং যেটুকু যোগ্যতা নিয়ে এসেছিলেন সেটাও দিনে দিনে হারাতে বসেছেন। যদি এমন অবস্থা কখনও চলে আসে তবে বুঝতে হবে, আমাদের ট্রেন লাইনচ্যুত হ’তে শুরু করেছে। তখন এই পরিস্থিতির জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? সেদিন কি কপাল চাপড়ে সবকিছু ঠিক হবে? এভাবে যদি একটি শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে তবে নিঃসন্দেহে সেটা উন্নতির দিকে যাবে না। বরং অবনতির দিকেই যাবে। আর অবনতির চূড়ান্ত রূপ বিলুপ্তি। এই সংকটময় অবস্থায় যেন আমাদের পতিত হ’তে না হয় সেলক্ষ্যে আমরা কিছু প্রস্তাবনা রাখছি। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাকে কবূল করুন।- আমীন!
জনসাধারণের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, আপনারা বর্তমান দ্বীনী ইলমের ক্রান্তিলগ্নে মাদ্রাসাগুলো টিকিয়ে রাখার জিহাদে অংশগ্রহণ করুন। আপনাদের আর্থিক সহযোগিতা, মেধা ও শ্রমের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে। এতে করে দ্বীনী ইলম যেমন সহজ হবে তেমনই দ্বীনী ইলমের খিদমতে আলেমগণ উৎসাহিত হবেন। বর্তমানে অধিকাংশ মেধাবী আলেম লেখাপড়া শেষে ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন। বিভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন। এর একমাত্র কারণ, মাদ্রাসায় কুরআন-হাদীছ পড়িয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হওয়া। এ বিষয়ে আমাদের বিভিন্ন নছীহত একজন আলেমের কাছে শুধু পড়ার টেবিলেই সুন্দর। তিনি যখন কেনাকাটা করতে বাজারে যান তখন এসব নছীহত মনে পড়লে তার কাছে আমরা বিরক্তির কারণ হই। এটা আমরা বেশ ভালই বুঝি। এভাবেই দিনে দিনে আলেমশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। আপনি কি মনে করেন, এর পেছনে আপনার কোনই দায়বদ্ধতা নেই? আপনার কোনই দায়িত্ব নেই?
সীমানায় দাঁড়িয়ে যারা আপনার জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন তাদের পরিবার চলে আপনার অর্থে। আর এটা আপনি নিজের দায়িত্বও মনে করেন। তবে এই ফিতনার যুগে যারা আপনার ঈমানের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। ঘরে ঘরে কুরআন-হাদীছের বাহক তৈরি করার মাধ্যমে ঈমানী সচেতনতা বৃদ্ধি করেন তাদের পরিবার চালানোর দায়িত্ব কাদের সেটা কি আপনি বোঝেন না? যদি তাদের পরিবারকে আপনি ছেড়ে দেন তবে তারাও উম্মাহকে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করবে। উম্মাহর খিদমতে নিয়োজিত হওয়ায় যদি একজন আলেমের সংসারই না চলে তবে তিনি কেন পড়ে থাকবেন? কেন ব্যবসা করবেন না? তিনি সারাদিন বেচাকেনার ফাঁকে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করবেন, নিজের ঈমান হিফাযত করবেন। ব্যাস! তার দুনিয়ার জীবনও সুন্দর, আখিরাতের জীবনও সুন্দর! তিনি তো এটাই ভাববেন। কিন্তু আপনার কি হবে? এই ফিতনাময় অবস্থায় আপনার অনাগত সন্তানদের কি হবে? তারা কি ইলমহীন হয়ে জান্নাতের রাস্তা খুঁজে পাবে? নাকি জান্নাতের আশায় জাহান্নামের দিকে ছুটে যাবে? নাকি এক পর্যায়ে ‘জান্নাতের আশা করতে হয়’ এই জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলবে? খুব অসম্ভব মনে হচ্ছে কথাগুলো? দেখুন, মাত্র এক প্রজন্মের রদবদলে এতটুকু পরিবর্তন তো সত্যিই অস্বাভাবিক।
দেখুন! আমরা যা ছাদাক্বা করি সেটাই যদি সঠিক স্থানে হয় তবে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখতে আলাদা কোন বাজেটের দরকার হবে না। আমরা তো বর্তমানে দান করার জায়গা খুঁজে পাই না। আমাদের বড় দান মানেই ভুরি ভোজের আয়োজন, আর ছোট দান মানেই মসজিদে কুরআন কিনে দেয়। মসজিদে কুরআনের জায়গা হয় না। অথচ অনেক মাদ্রাসায় দরিদ্র ছাত্ররা দারসের বইগুলো কিনতে পারে না। দেখুন, যেখানে সেখানে শুধু দান করলেই ছওয়াব হয়, একথা সঠিক নয়। ছালাত, ছিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত যেমন শিখতে হয়, তেমনই দান করাও শিখতে হয়। আপনার বাড়ির পাশে মাদ্রাসায় আর্থিক অনটন, অথচ আপনি ওরসে গরু দান করলেন। আপনার দেয়া গরু দিয়ে হাযারখানেক গাঁজাখোরের ভোজন হ’ল। অথবা অমুক মহান ব্যক্তি বা হুযুরের সাথে আপনার সখ্যতা আছে বলে মোটা মোটা অংক শুধু তার হাতে গুঁজে দেন। আর তিনি সেই দানের পাহাড় দিয়ে যাচ্ছেতাই করে বেড়ান। আপনি হয়তো ধারণা করেন, তিনি আপনার জন্য হাশরের ময়দানে শাফা‘আত করবেন। শাফা‘আত তো দূরের কথা বরং এই দানের জন্য হাশরের ময়দানে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে।
সম্মানিত পাঠক! দ্বীনী ইলমের দুর্গগুলো রক্ষা করতে যে আর্থিক সচ্ছলতার প্রয়োজন রয়েছে আলোচ্য নিবন্ধে তা আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এক্ষণে উপরোক্ত আলোচনা থেকে যদি কিছু মানুষের বোধোদয় হয়, একটি মক্তবও আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়, একজন যোগ্য আলেমও যদি ব্যবসার চিন্তা ছেড়ে ইলমের খিদমতে ফিরে আসেন, তবে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। আপনারা পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন মাদ্রাসার নিয়মিত মাসিক দাতা হৌন। নিজেদের উদ্যোগে মাসিক দাতাদের তালিকা তৈরি করুন। কোন বেসরকারী মাদ্রাসায় যেন শিক্ষকদের বেতন আটকে না থাকে, এটা দেখা আপনার দায়িত্ব। আমরা একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়তে চেষ্টা করছি। এই প্রচেষ্টায় আমরা সকলকে সাথে চাই। আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। সেই আন্দোলনে আপনিও আমাদের সহযোদ্ধা হৌন!
সারওয়ার মিছবাহ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।