পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ ।

ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের রাজনৈতিক পথপরিক্রমা :

শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের সংস্কার আন্দোলন কেবল নজদবাসীর আক্বীদা ও আমল-আখলাকেরই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেনি; বরং নজদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। যার প্রত্যক্ষ ভূমিকায় যেমন ছিলেন তাঁর অনুসারী আলেম-ওলামা এবং ছাত্র-মুবাল্লিগবৃন্দ, তেমনি দ্বীনের যোগ্য মুজাহিদ হিসাবে অগ্রবর্তী তালিকায় ছিলেন ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ (১৭২৬-১৭৬৫ খৃঃ) ও তাঁর পরবর্তী বংশধরগণ। ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের সাথে এই পরিবারের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক যুথবদ্ধতা[1] এ আন্দোলন প্রসারে যে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষতঃ শায়খের মৃত্যুর পর ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের পরবর্তী ইতিহাস এই পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ফলে অনিবার্যভাবেই ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের বিস্তারের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনায় ‘সঊদী আরব’ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা লাভের ইতিহাস এসে যায়। যার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় বেগবান শোণিতধারার মত মিশে আছে ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের আদর্শিক বিপ্লবের তপ্ত মন্ত্র।[2] নিম্নে এই ইতিহাসকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করে আলোচনা করা হল। 

১ম সঊদী আরব রাষ্ট্র (১৭৪৪-১৮১৮ খৃঃ/১১৫৭-১২৩৪হিঃ) :

নজদে সঊদ বংশের উত্থানের পূর্বে আরব উপদ্বীপ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম আরবে লোহিত সাগরের পূর্বাঞ্চল জুড়ে ছিল মক্কাকেন্দ্রিক শরীফদের[3] শাসনভুক্ত স্বাধীন অঞ্চল হেজায। মধ্য আরবে ছিল আলে সঊদ, দাহ্হাম বিন দাওয়াস, বনু যায়েদ প্রভৃতি গোত্রভিত্তিক শাসকদের অধিকারভুক্ত তিনটি নগরী দিরঈইয়া, উয়ায়না ও হুফূফসহ বৃহত্তর নজদ অঞ্চল। আর পূর্বে আরব সাগরের বিস্তীর্ণ অববাহিকা জুড়ে ছিল ওছমানীয় সালতানাতের অনুগত যামেল আল-জাবারী বংশ ও বনু খালেদ বংশের শাসনাধীন উর্বর ফসলী অঞ্চল আল-আহসা।[4] ১৭২৬ খৃষ্টাব্দে নজদের ছোট্ট নগরী দিরঈইয়াতে মুহাম্মাদ বিন সঊদের ক্ষমতারোহনের মাধ্যমে আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী বংশ হিসাবে আবির্ভাব ঘটে সঊদ বংশের। যার পিছনে একমাত্র অনুঘটক হিসাবে কাজ করছিল ওয়াহ্হাবী আন্দোলন। অনধিক ৭৫ বছরের মধ্যে এ আন্দোলনের অনুসারীরা সমগ্র আরবভূমিকে নিজেদের করায়ত্ত করতে সক্ষম হয় এবং অহির বিশুদ্ধ দাওয়াতকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। এজন্য ১ম সঊদী আরবকে ইতিহাসে ‘ওয়াহ্হাবী রাষ্ট্র’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নিম্নে সঊদ বংশের উত্থান ও ১ম সঊদী আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচিত হল। 

মুহাম্মাদ বিন সঊদ (১৭২৬-১৭৬৫ খৃঃ):

১৭২৬ খৃষ্টাব্দে নজদের দিরঈইয়া নগরীর অধিকর্তা নিযুক্ত হন সঊদ বংশের কৃতি সন্তান মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিন মুক্বরিন। যাকে বর্তমান সঊদী আরবের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়। ১৭৪৪ খৃষ্টাব্দে শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের সাথে ইমাম মুহাম্মাদের ঐতিহাসিক সন্ধি পরবর্তীতে আরব উপদ্বীপে বৃহত্তর সঊদী আরব রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি রচনা করে। অপরপক্ষে তাঁর ঐকান্তিক সহযোগিতায় মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবও নির্বিঘ্নে নির্ভেজাল তাওহীদ ও সুন্নাতের দাওয়াতকে প্রথমে নজদ এবং পরবর্তীতে সমগ্র সঊদী আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। শায়খের দাওয়াত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র দিরঈইয়ার পরিচিতি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দিন দিন তা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে শীঘ্রই পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলো দিরঈইয়ার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় তাওহীদ ও সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল এবং ‘ইমাম’ লকবধারী শাসকের অধীনে পরিচালিত রাষ্ট্রটির আবির্ভাব নজদসহ সমগ্র সঊদী আরব জুড়ে শাসকদের টনক নড়িয়ে দেয়।[5] ১৭৪৯ সালে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ হেজাযের আলেম-ওলামার সাথে মতবিনিময়ের জন্য মুবাল্লিগদের একটি প্রতিনিধিদলকে মক্কায় প্রেরণ করেন। কিন্তু সেখানকার আলেমগণ তাদের সাথে খুব খারাপ আচরণ করেন এবং তাদের অধিকাংশকেই কারাবন্দী করা হয়।[6] এমনকি পরবর্তীতে বিশেষ অনুমতি ব্যতীত নজদবাসীদের জন্য হজ্জ আদায়ও নিষিদ্ধ করা হয়।[7] যাইহোক ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের উত্থান পর্বে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ। ইসলামের বিশুদ্ধ দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়াই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁর মহত্ত্বের প্রশংসা জনগণের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিল।[8] ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে এই মুজাহিদ শাসক সঊদী রাষ্ট্রের উত্থান পর্বের মাঝামাঝি সময় মৃত্যুমুখে পতিত হন। 

আব্দুল আযীয বিন সঊদ (১৭৬৫-১৮০৩ খৃঃ) :

ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদের মৃত্যুর পর দিরঈইয়ার শাসনভার গ্রহণ করেন তদীয় পুত্র আব্দুল আযীয। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ওয়াহ্হাবী রাষ্ট্রটির সীমানা বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৭৭৩ সালে তিনি দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে চলমান যুদ্ধে রিয়াদের শাসক দাহ্হাম বিন দাওয়াসকে পরাজিত করে রিয়াদ দখল করেন। এই বিজয় ওয়াহ্হাবীদের জন্য আরব উপদ্বীপের অন্যান্য অঞ্চলসমূহের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ করে দেয়। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই নজদের সৈন্যরা বড় বড় অভিযান পরিচালনা করা শুরু করল এবং নতুন নতুন স্থান বিজিত হতে লাগল।

১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে হেজাযের শরীফের একটি কাফেলার সাথে ওয়াহ্হাবীদের সংঘর্ষ বাঁধে এবং কাফেলার নেতা মানছূরকে বন্দী করা হয়। ইমাম আব্দুল আযীয তাকে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দিলে শরীফদের সাথে ওয়াহ্হাবীদের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয়।[9] সেই সূত্রে ১৭৭৭ খৃষ্টাব্দে ইমাম আব্দুল আযীয তৎকালীন শরীফের জন্য উপঢৌকনসহ মক্কায় একটি বিশেষ মুবাল্লিগদল প্রেরণ করেন। তারা মক্কার মাযহাবপন্থী ওলামাদের বুঝাতে সক্ষম হন যে, ওয়াহ্হাবীদের আক্বীদা-আমল আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা‘আত থেকে পৃথক নয়; বরং তা পুরোপুরি কুরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তিশীল।[10] কিন্তু তারপরও অচলাবস্থা কাটল না। অতঃপর ১৭৯০ সালে নতুন শরীফ গালিব বিন মুসাঈদ ওয়াহ্হাবীদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাতে চাইলেন। তাঁর আগ্রহের প্রেক্ষিতে ইমাম আব্দুল আযীয শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের একটি চিঠিসহ আব্দুল আযীয বিন হুসাইনকে মক্কায় প্রেরণ করলেন। শরীফ তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর খুব সন্তুষ্ট হন এবং ওয়াহ্হাবী দাওয়াতের দলীল-প্রমাণের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন। কিন্তু মক্কার আলেমগণ ওয়াহ্হাবীদের সাথে শরীফের এই সমঝোতার সম্ভাবনা লক্ষ্য করে আতংকিত হয়ে উঠলেন এবং শরীফকে এই বলে প্ররোচনা দিলেন যে,هؤلاء الجماعة ليس عندهم بضاعة إلا إزالة نهج آبائك وأجدادك ورفع يدك عما يصل إليك من خير بلادك. ‘এই দলটির একমাত্র উদ্দেশ্য আপনাকে আপনার পূর্বপুরুষদের পথ থেকে বিচ্যুত করা এবং আপনার রাষ্ট্রক্ষমতা হাতছাড়া করানো।’ স্বভাবতই তাদের এই প্ররোচনায় শরীফ বিভ্রান্ত হলেন। ফলে সন্ধি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল এবং ওয়াহ্হাবীদের সাথে শরীফদের বৈরিতার সম্পর্ক অব্যাহত রইল।[11] পরের বছর ১৭৯২ সালে ৮৯ বছর বয়সে &ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব মৃত্যুবরণ করলেন এবং তাঁর ভাই সুলায়মান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। ততদিনে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন আরবের বুকে সুদৃঢ় ভিত্তি লাভ করেছে। ফলে শায়খের মৃত্যুতে তাঁর আন্দোলন মোটেই বাধাগ্রস্ত বা স্তিমিত হয়নি।[12] 

রিয়াদ বিজয়ের পর ইমাম আব্দুল আযীয পূর্বাঞ্চল তথা আল- আহসার শক্তিশালী বনু খালেদ বংশের শাসকের নিকট ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের দাওয়াত পৌঁছে দেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং এ আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার জন্য সুযোগমত ওয়াহ্হাবীদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন। অবশেষে দীর্ঘ কয়েক বছরের প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ১৭৯৩ সালে আল-আহসা অঞ্চল পুরোপুরিভাবে ওয়াহ্হাবীদের দখলে চলে আসে। সেখানে প্রচলিত কবর ও মাযারকেন্দ্রিক যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াযের অবসান ঘটানো হয়।[13] অতঃপর উপসাগরীয় অঞ্চল কুয়েত, বাহরায়েন, কাতার থেকে ওমান পর্যন্ত এক বিস্তৃত ভূখন্ড ওয়াহ্হাবীদের দখলে আসে। এভাবে সালাফী দাওয়াত ক্রমেই ব্যাপকাকারে ছড়িয়ে যেতে থাকল। এদিকে সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর মক্কার শরীফ গালিব বিন মুসাঈদ ওয়াহ্হাবীদেরকে সশস্ত্রভাবে মুকাবিলার পরিকল্পনা নেন।[14] প্রথমদিকে তার বাহিনী ওয়াহ্হাবীদের মিত্র গোত্রসমূহের উপর চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে।[15] অতঃপর ১৭৯৭ সালে তিনি ওয়াহ্হাবীদের বিরুদ্ধে এক বড় যুদ্ধে পরাজিত হন এবং সন্ধি করতে বাধ্য হন। চুক্তি অনুযায়ী উভয় পক্ষের রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারিত হল এবং নজদবাসীদের জন্য আরোপিত হজ্জ আদায়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হল। ফলে দীর্ঘ কয়েক যুগ পর ১৮০০ সালে সঊদ বিন আব্দুল আযীযের নেতৃত্বে ওয়াহ্হাবীরা নজদ ও আল-আহসা অঞ্চলের হাজীদের এক বিরাট কাফেলা নিয়ে মক্কায় আগমন করেন এবং আবার নিরাপদেই দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর ইমাম আব্দুল আযীযও বিরাট কাফেলা নিয়ে হজ্জব্রত পালন করেন। এর মাধ্যমে ওয়াহ্হাবীদের ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসীদের ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়ে যায় এবং এক প্রকার হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরী হয়।[16]

১৮০২ সালে এক ওয়াহ্হাবী কাফেলার উপর একটি শী‘আ গোত্র হামলা চালায়। এরই জের ধরে সঊদ বিন আব্দুল আযীযের নেতৃত্বে ওয়াহ্হাবীরা দক্ষিণ ইরাকের কারবালা নগরীতে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালায় এবং হোসায়েন (রাঃ)-এর মাযারসহ কারবালার সকল কবর-মাযার-গম্বুজ সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে দেয়।[17] এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ, ক্রদ্ধ ওছমানীয় সুলতান তৎক্ষণাৎ ইরাকের শাসক ইবরাহীম পাশাকে সঊদী বাহিনীর উপর আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইরাকী বাহিনী কুর্দী বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় এদিকে আর নযর দিতে পারেনি।[18]

এদিকে মক্কার শরীফের সাথে কৃত সন্ধিচুক্তি বেশীদিন বলবৎ রইল না। শরীফ গালিব সঊদী বাহিনীর প্রতি চুক্তি ভঙ্গ ও শত্রুতামূলক কার্যকলাপের অভিযোগ তুললেন এবং সমঝোতার জন্য স্বীয় উযীর ওছমান আল-মুযায়েফীকে নজদে পাঠালেন। কিন্তু উযীর ওছমান সঊদী বাহিনীর সাথে সাক্ষাত করার পর ওয়াহ্হাবীদেরই পক্ষাবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি মক্কায় ফিরে এসে ওয়াহ্হাবীদের পক্ষ থেকে নিজেই শরীফের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। একই সময়ে শরীফ গালিবের সাথে তার ভাই আব্দুল মঈনের সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে ত্বায়েফের নিকটে এক সংঘর্ষও বাঁধে। যেখানে শরীফ গালিব পরাজিত হন। এই সুযোগে ১৮০৩ সালে সঊদী বাহিনী ত্বায়েফ দখল করে নেয় এবং চারিদিক থেকে মক্কা নগরীর দিকে অগ্রসর হয়। অতঃপর হজ্জের মৌসুম শেষে ১২১৮ হিজরীর ৮ই মুহাররম মোতাবেক ১৮০৩ খৃষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল শনিবার সঊদ বিন আব্দুল আযীযের নেতৃত্বে সঊদী বাহিনী বিজয়ীর বেশে মক্কা মুকাররামায় প্রবেশ করেন।[19] শরীফ গালিব আগেই মক্কা ছেড়ে জেদ্দায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে বিনা বাধায় ওয়াহহাবী বাহিনী মক্কা মুকাররামা দখল করে। গালিবের স্থলাভিষিক্ত শরীফ আব্দুল মঈন মক্কার শরীফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন-এই শর্তসাপেক্ষে সঊদ বিন আব্দুল আযীযের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। অতঃপর সঊদ বিন আব্দুল আযীয মক্কার মসজিদে হারামের মিম্বরে দাঁড়িয়ে অধিবাসীদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তাদানের ঘোষণা দিয়ে বললেন-‘আপনারা হলেন বায়তুল্লাহর প্রতিবেশী, হারামের অধিবাসী, হারামের নিরাপত্তায় নিরাপত্তাপ্রাপ্ত জনগণ। আপনাদেরকে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বীনের দিকে আহবান জানাচ্ছি। আলে ইমরানের ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন! হে আহলে কিতাবগণ এস সেই কথার দিকে যা আমাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে সমান; তা এই যে, ‘আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করব না এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করব না, আর আমরা একে অপরকে আল্লাহর পরিবর্তে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করব না। এরপরও যদি তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো, তাহলে তোমরা বল, তোমরাই সাক্ষী যে আমরা মুসলিম।’ তোমরা আজ আল্লাহ, আমীরুল মুসলিমীন সঊদ বিন আব্দুল আযীয এবং তোমাদের ইমাম আব্দুল মুঈনের মুখোমুখি দন্ডায়মান। অতএব তোমরা তোমাদের শাসকের কথা শ্রবণ কর এবং তাঁর আনুগত্য কর, যতক্ষণ তিনি আল্লাহর আনুগত্যে থাকেন’।[20]

মক্কা মুকাররামায় এক তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণে তিনি জনগণের সামনে সংস্কারপন্থী সালাফী দাওয়াতের মূলনীতি ও কর্মসূচীগুলো ব্যাখ্যা করেন এবং কবরের উপর প্রতিষ্ঠিত গম্বুজগুলো উৎসাদনের আহবান জানান। তাছাড়া মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রচিত ‘কাশফুশ শুবহাত’ বইটি মসজিদে হারামের ইলমী হালকাসমূহে আলেম-ওলামা ও সাধারণ জনগণের উপস্থিতিতে পঠন-পাঠনের নির্দেশ দেন।[21]

অতঃপর তিনি তুর্কী সুলতান ৩য় সেলিমের নিকট পত্র লিখলেন-‘আমি মক্কা শহরে প্রবেশ করেছি এবং পৌত্তলিকতার চিহ্নবাহী সবকিছু ধ্বংস ও অনাবশ্যক সকল প্রকার কর রহিত করত: এখানকার অধিবাসীদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। আপনার নিযুক্ত বিচারককে ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছি। অতএব আপনি দামেশক ও কায়রোর গভর্ণরদের এই পবিত্র শহরে ঢাক-ঢোল-ঝুমুর নিয়ে আসতে নিষেধ করে দিন। কেননা এতে দ্বীনের কোন অংশ নেই।’[22]

ইবনে বিশর বর্ণনা করেন, ‘মক্কার সর্বত্র তখন শিরকের জয়জয়কার ছিল। সঊদী বাহিনী ২০ দিনের মত মক্কায় অবস্থান করে এবং সকল কবরের উপর থেকে গম্বুজগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে মক্কার বুকে কবর-মাযারকেন্দ্রিক শিরকের এমন একটি নিদর্শনও অবশিষ্ট রইল না যা নিশ্চিহ্ন করে ধূলায় মিশিয়ে দেয়া হয়নি।’[23]

ফিলবী (Philby) বলেন, ইমাম সঊদ শরীফ আব্দুল মঈনের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেই মাসজিদুল হারামকে পৌত্তলিকতার আবর্জনা থেকে পরিষ্কার করার কাজে মনোযোগ দিলেন। কা‘বার ভিতর থেকে উদ্ধারকৃত ধন-সম্পদ ও সোনা-দানা তিনি মানুষের মাঝে বিতরণ করে দিলেন ও কবরের উপর নির্মিত সকল গম্বুজ ধ্বংস করলেন। [24]

T.P. Huges বলেন, মক্কা অধিকারের পর এই সংস্কার আন্দোলনের মূলনীতিগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হল। মাদকদ্রব্য, পারসিক চুরুট, তাসবীহ-তাবীয, সিল্কের তৈরী পোষাকাদি প্রভৃতি যাবতীয় শরী‘আতবিরোধী বস্ত্তসমূহ জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে দেয়া হল। মসজিদগুলো এমনভাবে আবাদ করা হল যে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে শহরের কোন লোককে অনুপস্থিত পাওয়া যেত না। ফলে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ও ইবাদতের এমনই পবিত্র দৃশ্য পরিস্ফূট হল এই নিরাপদ শহরে, যার নযীর স্বর্ণযুগের পর আর কখনো দেখা যায়নি। [25]

অনুরূপভাবে পর্যটক বারখার্ট (Burchhardt) তাঁর আরব ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখেছেন, মক্কার অধিবাসীরা আজও পর্যন্ত ইমাম সঊদের নাম কৃতজ্ঞতা ও ভক্তির সাথে স্মরণ করেন। এখনও পর্যন্ত তাঁর পবিত্র বাহিনীর পদক্ষেপসমূহ বিশেষতঃ হজ্জ ও যিয়ারতের সময়কালে তাদের খেদমতের কথা সর্বত্র প্রশংসার সাথে উচ্চারিত হয়। যে ন্যায়ানুগ আচরণ তারা সেদিন প্রদর্শন করেছিলেন তা মক্কাবাসী আজও ভুলেনি।[26]

মক্কা বিজয়ের পর সঊদী বাহিনী জেদ্দা নগরীও অবরোধ করে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় তারা দিরঈইয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। এই সুযোগে শরীফ গালিব পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সঊদী দখল থেকে মক্কা পুনরুদ্ধার করেন।[27]

ঠিক ঐ সময়ই সঊদী আরবের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আব্দুল আযীয মসজিদে আছরের ছালাতে সিজদারত অবস্থায় জনৈক শী‘আ অথবা কুর্দী আততায়ীর বর্শার আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন।[28]

ইমাম আব্দুল আযীয ছিলেন এক আকর্ষণীয় প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। পিতার মত তিনিও ছিলেন দ্বীনদার এবং আলেম হিসাবে সুপ্রসিদ্ধ। এক ক্ষুদ্র গোত্রপতি হিসাবে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, স্বীয় নেতৃত্বগুণে একসময় তিনিই সমগ্র আরবের এক প্রতাপশালী অধিপতিতে পরিণত হন।[29] শুধু তাই নয় দীর্ঘ প্রায় ৩৯ বছরের শাসনামলে তিনি আরবের বুকে এমন এক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, যা ছিল পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর উপর সুদৃঢ়ভাবে ভিত্তিশীল। খুলাফায়ে রাশেদার পর এমন ন্যায়বিচারপূর্ণ শাসনব্যবস্থা আর কখনো পরিদৃষ্ট হয়নি। তিনি কেবল আপোষহীন রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না; বরং শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের নিবিড় সাহচর্যে তিনি পরিণত হয়েছিলেন তাওহীদ ও সুন্নাতের একজন প্রজ্ঞাবান দাঈ ইলাল্লাহ। তাই যখনই কোন নতুন অঞ্চল বিজিত হ’ত তাঁর প্রথম কাজ ছিল সেখানে মুবাল্লিগ এবং দাঈ প্রেরণ করা। তাঁর অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টার বরকতে শিরক ও বিদ‘আতের আস্তাকুড়ে পরিণত হওয়া সমগ্র আরব আবারও তাওহীদের আলোকচ্ছটায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে।[30] তাঁর সমসাময়িক ইমাম শাওকানী তাই তাঁর প্রশংসায় লিখেছেন, প্রায় সমগ্র হেজাযের অধিবাসী ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করল এবং শরী‘আতের নির্দেশাবলী পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এমন এক সময়ে এটা ঘটেছিল যখন তারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানত না কেবল বক্র উচ্চারণে কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করা ব্যতীত। এই চরম জাহেলিয়াতের মধ্য থেকেই উঠে এসে তারা সময়মত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতসহ ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান যথার্থভাবে পালনকারীতে পরিণত হল’।[31]ফালিল্লাহিল হামদ

সঊদ বিন আব্দুল আযীয (১৮০৩-১৮১৪ খৃঃ) :

ইমাম আব্দুল আযীযের মৃত্যুর পর জেষ্ঠ্য পুত্র সঊদ বিন আব্দুল আযীয তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিনি ছিলেন পিতার চেয়েও অধিক চৌকস ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পিতার পদাংক অনুসরণ করে দ্রুতগতিতে তিনি নতুন নতুন রাজ্য দখল করতে লাগলেন এবং দাওয়াতের ময়দান বিস্তৃত করে চললেন। বাহরাইন, আম্মান ও রা’স আল- খাইমাহ জয় করার পর তিনি বছরা দখল করে নেন এবং যথারীতি সেখানকার শিরকী আস্তানাসমূহ সমূলে উচ্ছেদ করেন।[32] অতঃপর সবদিক থেকে নিরাপদ হয়ে তিনি আবারো হেজাযের কেন্দ্রভূমি মক্কা-মদীনার দিকে নযর দিলেন এবং ১৮০৫ সালে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে প্রথমে মদীনা দখল করলেন। অতঃপর মদীনার যাবতীয় কবর-মাযার ধূলিসাৎ করে সেখান থেকে শিরক ও বিদ‘আতী আমল-আক্বীদা উৎখাত করেন।[33] মদীনা বিজয়ের পর সঊদী বাহিনী মক্কার দিকে অগ্রযাত্রা করলে শরীফ গালিব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পূর্বেই ইমাম সঊদের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন।[34] অতঃপর ১৮১১ সালের মধ্যে ওয়াহ্হাবী সাম্রাজ্য দক্ষিণে আলেপ্পো থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এবং পূর্বে পারস্য উপসাগর থেকে ইরাকের সীমান্ত হয়ে পশ্চিমে লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে।[35]

অবশেষে শংকিত ওছমানীয় সুলতান আর অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করলেন না। তিনি যেকোন মূল্যে ওয়াহ্হাবীদের দমন করার জন্য তৎকালীন তুর্কী সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক মিসরের খেদিভ মুহাম্মাদ আলী পাশাকে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেয়ে মুহাম্মাদ আলী পাশা রণপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন এবং তাঁর পুত্র তুসুনের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী হেজাযের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। প্রথমে তুসুন ওয়াহ্হাবীদের সাথে কয়েকটি মোকাবিলায় পরাজিত হলেও ১৮১২ সালে দুই মাস যাবৎ অবরোধ রাখার পর মদীনা দখল করতে সক্ষম হন। পরের বছর মিসরীয়রা একইভাবে মক্কাও দখল করে নেয়। হেজায মিসরীয় দখলে চলে গেলেও আরবের বাকী অংশে ওয়াহ্হাবীদের আধিপত্য অটুট ছিল। মিসরীয়রা বিভিন্ন স্থানে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হলেও বার বার পরাজয়ের শিকার হয়। অবশেষে স্বয়ং মুহাম্মাদ আলী পাশা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য হেজাযে আগমন করেন এবং প্রথম যুদ্ধেই গুরুতর পরাজয় বরণ করেন।[36]

মিসরীয়দের বিরুদ্ধে সঊদী বাহিনী নতুনভাবে যখন একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছিল, ঠিক তখনই ১৮১৪ সালের ১লা মে ইমাম সঊদ বিন আব্দুল আযীয মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সঊদীদের মনোবল কিছুটা ভেঙে পড়ে। ফলে মিসরীয় বাহিনীর জন্য সমগ্র আরব দখলের পথ সহজ হয়ে গেল।[37] নেতৃত্বগুণে ও মহানুভবতায় ইমাম সঊদ ছিলেন এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনা ও যুদ্ধের ময়দানে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর নৈতিকতা ও উদারচিত্ততা ঐতিহাসিকদের অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর শাসনামলেই হেজাযসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপ ওয়াহ্হাবীদের পূর্ণ অধিকারে চলে আসে।[38]

আব্দুল্লাহ বিন সঊদ (১৮১৪-১৮১৮ খৃঃ):

ইমাম সঊদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পিতার মতই সাহসী ও রণকুশলী হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তেমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেননি।[39] মিসরীয়দের সাথে ত্বায়েফের এক বিরাট যুদ্ধে তাঁর ভুল রণকৌশলের কারণে সঊদী বাহিনী চরমভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং প্রায় ৫ হাযার সৈন্য মিসরী বাহিনীর হাতে নিহত হয় এবং ৩ হাযার সৈন্য গ্রেফতার হয়। এতে ওয়াহ্হাবীদের শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়।[40] এ যুদ্ধে মুহাম্মাদ আলী পাশা স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি তুসূনকে রেখে সাময়িকভাবে মিসরে যান। ইতিমধ্যে তুসূন আল-কাছীমে শিবির গড়ে নজদ আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিলে ইমাম আব্দুল্লাহ সেখানে তাদেরকে অবরোধ করতে সমর্থ হন। দুই মাস যাবৎ অবরোধের পর উভয় পক্ষ সন্ধিতে রাযী হয়। ইমাম আব্দুল্লাহ প্রতিকূল পরিবেশ বিবেচনা করে মিসরীয়দের সাথে সন্ধি করাকেই নিরাপদ মনে করলেন।[41] ১৮১৫ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির শর্ত নির্ধারিত হল যে, ইমাম আব্দুল্লাহ তুর্কী সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে নিবেন এবং সেনাপতি তূসূন মিসরীয়দের নিয়ে নজদভূমি ছেড়ে যাবেন।[42] কিন্তু খেদিভ মুহাম্মাদ আলী পাশা এই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে পরের বছর তাঁর ২য় পুত্র ইবরাহীম পাশার নেতৃত্বে আরব ভূখন্ডে এক অভিযান প্রেরণ করেন।[43] ইবরাহীম পাশা কতিপয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৮১৮ সালে ওয়াহ্হাবীদের রাজধানী দিরঈইয়া নগরী অবরোধ করেন। দীর্ঘ ৬ মাসের টানা অবরোধে অবশেষে ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে ইমাম আব্দুল্লাহ বিন সঊদ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। অতঃপর তাঁকে তুর্কী খেলাফতের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নেওয়া হয় এবং ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।[44] এভাবেই ১ম সঊদী রাষ্ট্র কিংবা ঐতিহাসিক ফিলবীর ভাষায় ‘১ম ওয়াহ্হাবী সাম্রাজ্য’-এর করুণ অবসান ঘটল।[45] উন্মত্ত মিসরীয় বাহিনী এ সময় সঊদ বংশের আরো ২১ জনকে হত্যা করে। এছাড়া মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের বংশধরদের বেশ কয়েকজনসহ বহুসংখ্যক আলেম-ওলামা ও কাযীগণ নিহত হন। অবশিষ্টদেরকে মিসর ও ইস্তাম্বুলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[46]

দিরঈইয়ার পতনের পর মুহাম্মাদ আলী পাশা সেখানে ৯ মাস অবস্থান করেন এবং শহরের সমস্ত অধিবাসীদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে সরকারী প্রাসাদ-দূর্গ, বাড়ী-ঘর, গাছ-পালা একে একে সমূলে ধ্বংস করে ফেলেন। সমস্ত শহরকে এমনইভাবে বিরান করে ফেলা হয় যেন সেখানে ইতিপূর্বে কোন জনবসতিই ছিল না।[47] পৌনে এক শতাব্দীকাল ব্যাপী যে নগরী আরব যমীনে তথা সারাবিশ্বের বুকে অভূতপূর্ব এক দ্বীনী জাগরণের পাদপীঠ হিসাবে তাওহীদী নিশান বহন করছিল, এক নিমিষেই তা জনমানবহীন এক ঊষর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হল। অপমৃত্যু ঘটল শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের হাতে গড়া ‘মানহাজুন নবুওয়াত’ এবং তাওহীদ ও সুন্নাতের জ্বলন্ত স্বাক্ষর এই পবিত্র সাম্রাজ্যের। ভোজবাজির মত হারিয়ে যাওয়া প্রতাপশালী এ রাষ্ট্রের কথা স্মরণ করতে যেয়ে তাই ১৮৮০ সালে ঐতিহাসিক ব্লেন্ট লিখেছিলেন, ‘আরবের বুকে সঊদী রাষ্ট্র আজ কেবল অতীত কেচ্ছা মাত্র।’[48] অনুরূপভাবে ১৮৭৫ সালে ডাউটি নজদবাসীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তাদের সকলেরই কমপক্ষে এই মত ছিল যে, এই ওয়াহ্হাবী রাষ্ট্রের নতুন করে জেগে উঠার আর কোন সম্ভাবনা নেই।[49] তবে আলহামদুলিল্লাহ শত্রুদের এই লোমহর্ষক নৃশংসতার পরও ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের সুপ্ত কোন বীজ থেকে আবারো পুনর্জন্ম নিয়েছিল সঊদী আরব রাষ্ট্র। ফলে দিরঈইয়া ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলেও পার্শ্ববর্তী রিয়াযেই আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উত্তর পুরুষদের নতুন রাজধানী।

১ম সঊদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য :

মানহাজুন নবুওয়াতের আদলে গড়ে উঠা এই রাষ্ট্রটির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচিত হল।

(১) রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা :

ইসলামী আক্বীদার পরিশুদ্ধি এবং তাওহীদ ও সুন্নাহর বিজয় সাধনের প্রতিজ্ঞা থেকেই জন্ম হয় ১ম সঊদী আরব রাষ্ট্রের। এ রাষ্ট্রের প্রধানকে ‘ইমাম’ বলা হ’ত এবং তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী।[50] তিনি যেমন ছিলেন ধর্মীয় নেতা, তেমনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও। ফলে ন্যায় ও ইনছাফের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং ইমামের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এই রাষ্ট্রে ইসলামী শরীআ‘ত ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হ’ত ইসলামী শরীআ‘তের পুংখানুপুংখ অনুসরণের ভিত্তিতে। যার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন পর্যটক বারখার্ট তাঁর গ্রন্থে।[51] প্রাদেশিক শাসকদেরকে কেন্দ্রীয় ইমামই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দান করতেন। তাদের আক্বীদা ও আমলের দৃঢ়তার প্রতি বিশেষ নযর রাখা হ’ত। এছাড়া সর্বস্তরে বিশেষ শূরা বা পরামর্শ কমিটি ও সাধারণ পরামর্শ কমিটি নামক দু’টি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী আঞ্জাম দেয়া হ’ত।[52] এছাড়া ওয়াহ্হাবী ইমামদের চাল-চলন ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় বারখার্টের বর্ণনায় তাতে তাঁদের সহজ-সরল ইসলামী জীবনযাপনের চমৎকার পরিচয় ফুটে উঠে।[53]

(২) সামরিক নীতি :

যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ইসলামী নীতিমালা অনুসৃত হ’ত এবং গণীমতের মালকে নিয়মমাফিক ৫ ভাগে ভাগ করা হ’ত। সাধারণত বাদ ফজর তাকবীরের মাধ্যমে সেনাদলের যুদ্ধযাত্রা শুরু করা হত এবং বিজিত অঞ্চলে আত্মসমর্পণকারী স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতি ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী ন্যায় ও ইনছাফের আচরণ করা হত।[54] বিজিত অঞ্চলে ওয়াহ্হাবীদের প্রথম কাজ ছিল শিরক ও বিদ‘আতের আখড়াগুলো ধ্বংস করে দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ও ইসলামী আইন কার্যকর করার জন্য ক্বাযী ও মুফতী নিয়োগ করা।[55]

(৩) সামাজিক অবস্থা :

ইমাম আব্দুল আযীযের শাসনামলে আরব ভূখন্ড পরিণত হয় এক ঐক্যবদ্ধ, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজ্যে। ওয়াহহাবী দাঈদের মাধ্যমে বেদুইনদের মাঝে ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা প্রসার লাভ করে। ফলে কলহপ্রিয় ও সংঘাতে লিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব বেদুইন গোত্রসমূহ পারস্পরিক সংঘাত ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই-ভাইয়ে পরিণত হয়। অথচ স্বর্ণযুগের পর এ দৃশ্য ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার।[56] সমাজ থেকে সকল অনৈতিক আচার-প্রথা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তুর্কীদের মধ্যে সিল্কের পোষাক পরা ও ধূমপানের যে বাজে অভ্যাস ছিল তা দূরীভূত করা হয়।[57] নারীদের বেপর্দা চলাফেরা নিষিদ্ধ ছিল। ছালাতের সময় বাজারে দায়িত্বশীলরা ‘ছালাত, ছালাত’ বলে মানুষকে মসজিদের দিকে আহবান করত এবং ছালাত তরককারীদের শাস্তি দিত। ফলে ছালাতের সময় কারো বাইরে ঘুরাফিরার সুযোগ ছিল না।[58] এভাবে একটি আইন-কানূনবিহীন বর্বর সমাজে ওয়াহ্হাবীরা নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের যে অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল- তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বারখার্ট বলেন, The merit, therefore, of the Wahabys, in my opinion, is not that they purified the existing religion, but that they made the Arab strictly observe the positive precepts of one certain religion. অর্থাৎ আমার মতে, এটাই ওয়াহ্হাবীদের কৃতিত্ব নয় যে, তারা প্রচলিত ধর্মমতকে পরিশুদ্ধ করেছিল বরং আরবদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মের সদর্থক নৈতিক শিক্ষাসমূহ কঠোরভাবে পালনে অভ্যস্ত করতে পারাই ছিল তাদের মূল কৃতিত্ব।[59]

(৪) বিচারব্যবস্থা :

নজদের বিচারব্যবস্থা ছিল পূর্ণাঙ্গভাবে কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফে ছালেহীনের নীতির উপর ভিত্তিশীল।[60] রাজ্যে বিচারপতির পদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচারক নির্বাচিত হওয়ার জন্য আলেমে দ্বীন হওয়া এবং ইসলামী শরীআ‘তের উপর বিশেষ দক্ষতা অপরিহার্য ছিল। সাথে সাথে তার ন্যায়পরায়ণতার দিকটি ছিল সর্বাধিক বিবেচ্য। ইসলামী শরী‘আতের ফৌজদারী কার্যবিধি তথা হুদূদ আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বিচারকগণ বিশেষ কোন মাযহাবের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন না; বরং সর্বাধিক অগ্রাধিকারযোগ্য মত অনুযায়ী ফয়ছালা করতেন। বিচার প্রক্রিয়ায় কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব ও শিথিলতার সুযোগ না থাকা এবং দ্রুততম সময়ে রায় কার্যকরের ফলে গোটা রাজ্যে সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও আনুগত্যবোধ সৃষ্টি হয়। ফলে পাপাচার ও হানাহানির প্রবণতা একেবারেই হ্রাস পেয়ে যায়।[61] স্বর্ণযুগের পর বেদুইন আরবের সামাজিক পরিমন্ডল আবারও সিক্ত হ’তে থাকে ন্যায়, ইনছাফ ও শান্তির অজস্র স্রোতধারায়। পর্যটক Burchhardt বলেন, For the first time after, perhaps, since the days of Muhammad, a single marchent might traverse the desert of Arabia with perfect safety, and the Bedouins slept without any apprehension that their cattle would be carried off by nocturnal depredators অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর যুগের পর সম্ভবত এই প্রথমবারের মত কোন ব্যবসায়ী মরুভূমির মাঝে একাকী পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে চলাচল করত, আর রাত্রিতে দস্যু দলের হাতে গৃহপালিত পশু-প্রাণী লুট হওয়ার কোন আশংকা ছাড়াই বেদুইনরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত।[62] হানাহানির মাত্রা এতটাই কমে আসে যে তিনি লিখেছেন, আমি নিশ্চিত করে বলছি, ইবনে সঊদের ১১ বছরের শাসনামলে দিরঈইয়ায় মাত্র ৪/৫ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল।[63] ঐতিহাসিক ইবনে বিশর ইমাম আব্দুল আযীযের শাসনামলের শান্তি-শৃংখলার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, তাঁকে সত্যিই যুগের ‘মাহদী’ হিসাবে আখ্যা দেয়া যায়। কেননা তাঁর শাসনামলে একজন মানুষ মূল্যবান ধন-সম্পদসহ শীত-গ্রীষ্ম, ডান-বাম, পূর্ব-পশ্চিম যখন যেখানে খুশী নজদ, হেজায, ইয়ামান, আম্মান সর্বত্রই নির্বিঘ্নে সফর করত। এমতাবস্থায় সে কেবল আল্লাহ ছাড়া কোন চোর বা দস্যুর ভয় পেত না।[64]

(৫) অর্থব্যবস্থা :

অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রেও পুরোপুরিভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর যুগকে অনুসরণ করা হ’ত। বায়তুল মাল ছিল এই ওয়াহ্হাবী রাজ্যের প্রধান অর্থ তহবিল। এই তহবিলের মূল উৎস ছিল যাকাত এবং ওশর। গণীমতের এক-পঞ্চমাংশও ছিল এর অন্যতম উৎস। জনগণের উপর বাড়তি কোন করারোপ করা হ’ত না।[65] সূদী কারবারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। কর্য হিসাবে অর্থ প্রদান কেবলমাত্র মুযারাবা ও মুশারাকার ক্ষেত্রে অনুমোদিত ছিল।[66] আর কুরআনে বর্ণিত খাতসমূহেই বায়তুল মালের অর্থ ব্যয়িত হ’ত এবং এখান থেকেই রাষ্ট্রীয় সকল ব্যয় নির্বাহ করা হ’ত।[67] সামাজিক শান্তি ও শৃংখলার অসাধারণ উন্নতি আরবদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করেছিল। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল এবং দ্রব্যমূল্য হ্রাস পেয়েছিল।[68] চাষাবাদ ও পশুপালন ছিল জনগণের জীবিকা নির্বাহের মূল উপাদান। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য তো ছিল তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। দূর-দূরান্তে ব্যবসার উদ্দেশ্যে গমন করা ছিল তাদের নিয়মিত অভ্যাস। পার্শ্ববর্তী বছরা, জেদ্দা, ছানআ‘, বাহরাইন, কুয়েত, দেমাশক ছাড়াও সুদূর দিল্লী পর্যন্ত তাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। এসব ব্যবসায়িক কাফেলা একই সাথে ইসলামের বিশুদ্ধ দাওয়াতও দেশে দেশে বহন করে নিয়ে যেত।[69]

(৬) শিক্ষাব্যবস্থা :

শিক্ষাগার হিসাবে তখন মসজিদ এবং মক্তব সমূহই ব্যবহৃত হ’ত। যেখানে প্রথম স্তরের দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা ছিল। রিয়াযুছ ছালেহীন, তাফসীরে ত্বাবারী, তাফসীরে ইবনে কাছীর, ইবনু তায়মিয়াহর গ্রন্থসমূহ এবং শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের গ্রন্থসমূহ সেখানে অবশ্যপাঠ্য ছিল। এছাড়া আরবী সাহিত্য, উলূমুল কুরআন ও হাদীছ এবং গণিতও শিক্ষা দেয়া হত। শায়খ নিজে এবং তাঁর সন্তানাদি ও ছাত্ররা রাজ্যের সর্বত্র শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্রদের শিক্ষা ব্যয় এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রীয়ভাবেই বহন করা হ’ত।[70] সেখানে জ্ঞানচর্চার হার এমনই বৃদ্ধি পায় যে, কোন কোন ঐতিহাসিক দিরঈইয়াকে মধ্যযুগের রোমের সাথে তুলনা করেছেন।[71]

(৭) বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক :

প্রতাপশালী তুর্কী সালতানাতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে গোটা আরব উপদ্বীপের বিশাল এলাকা জুড়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করে তাক লাগিয়ে দেয় ওয়াহ্হাবীরা। তাদের এই উত্থানকে পার্শ্ববর্তী তুর্কী সালতানাতের অনুগত মুসলিম অঞ্চলসমূহ মোটেও ভাল চোখে নেয়নি; বরং ওয়াহ্হাবীদের শিরক ও বিদ‘আত বিরোধী কঠোর সংস্কারবাদী মনোভাবের কারণে তারা মনেপ্রাণে তাদের পতন কামনা করছিল। ফলে আরবের বাইরে ওয়াহ্হাবীদের কোন মিত্র ছিল না। তবে আরবের সর্বত্র সঊদীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লক্ষ্য করে বৃটিশরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে সঊদীদের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এ লক্ষ্যে ১৭৯৯ সালে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুয়েত প্রতিনিধি রেনল্ডের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দিরঈইয়া সফর করে। এ সময় ইমাম আব্দুল আযীয বিন মুহাম্মাদ বিন সঊদ তাঁদেরকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান। এটাই ছিল দিরঈইয়ার সাথে কোন বহির্দেশের প্রথম সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস। কিন্তু এ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। সঊদীরা বৃটিশদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন থাকায় এ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন না। ফলে পরবর্তীতে যদিও বৃটিশরা ওয়াহ্হাবীদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল কিন্তু দিরঈইয়ার পতনের সাথে সাথে মিসরীয় সেনাপতি ইবরাহীম পাশাকে সংবর্ধনা প্রদান এবং ওয়াহ্হাবীদের বিরুদ্ধে অপবাদমূলক প্রপাগান্ডা চালানোর মাধ্যমে তাদের শঠতায় অাঁটা মুখোশ উন্মোচিত হয়।[72]

পরিশেষে বলা যায়, ১ম সঊদী রাষ্ট্রটি ছিল ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের জন্য দর্পণস্বরূপ। নজদের বুকে যে সংস্কারের আহবান নিয়ে ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটেছিল, তার হাতে-কলমে বাস্তবায়নক্ষেত্র ছিল এই রাষ্ট্রটি। একটি প্রতিকূল পরিবেশে ‘মানহাজুন নবুওয়াত’ তথা রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের নীতিমালা অনুযায়ী সমাজ পরিচালনার যে দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে ওয়াহ্হাবীরা ময়দানে নেমেছিল এবং আরব উপদ্বীপ থেকে শিরক ও বিদ‘আতকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিল, তা সত্যিই তাদের অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে। আল্লাহর অসীম রহমত যে, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীরা এই মহান দায়িত্ব পালন করে আধুনিক মুসলিম বিশ্বকে পথভ্রষ্টতার অতল তলে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।[73] এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই সম্ভব হয়েছিল সুদীর্ঘকাল পর বিশৃংখল, দাঙ্গাবাজ আরব বেদুঈনদেরকে একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সুশৃংখল ও শক্তিশালী আরব রাষ্ট্রগঠনের এই বিস্ময়কর পর্বটিও।[74] এর মাধ্যমে স্বর্ণযুগের পর অহিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অনন্য নযীর হিসাবে আরো একবার সারাবিশ্বের নযর কাড়তে সক্ষম হয় আরব ভূখন্ড। ফলে কয়েক শত বছর ধরে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়া এবং ধর্মীয় অধঃপতনে নিমজ্জিত থাকা আরবভূমি আবারো তাওহীদী ঐশ্বর্যে সুষমামন্ডিত হয়ে উঠে। রাজনৈতিক পতন ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের দুর্দমনীয় অগ্রগতিতে ছেদ টেনে দিল বটে; কিন্তু এর ধর্মীয় প্রভাবকে কখনই স্তিমিত করতে পারেনি। ফলে পূর্বদিকে সুদূর ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিমে নাইজেরিয়া পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এ আন্দোলনের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছিল। পি. কে. হিট্টি বলেন, Wahhabi tenets, however, continued to spread, and their influence was felt from Sumatra in the east to Nigeria in the west. অর্থাৎ ‘ওয়াহ্হাবীদের পতন সত্ত্বেও ওয়াহ্হাবী মতবাদের প্রসার অব্যাহত থাকে এবং তাদের প্রভাব পূর্বে সুমাত্রা থেকে শুরু করে পশ্চিমে নাইজেরিয়া পর্যন্ত অনুভূত হতে থাকে।[75] লোথরোপ স্টোডার্ড বলেন, However, wahhabism's spritual role had just begun, The Nejd remained a focus of puritan zeal whence the new spirit rediated in all directions অর্থাৎ ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের ধর্মীয় দিকটির প্রসার বরং তখনই শুরু হয়েছিল। বিশুদ্ধতাবাদী দাওয়াতের উদ্দীপনাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল যে নজদ, তা আগের মতই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রইল; যখন নবপ্রেরণা নিয়ে নানা দিকে নানা মাত্রায় তার বিকিরণ ঘটতে থাকল’।[76]

 [চলবে]

আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব

এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. এমনকি এ সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল বলে কোন কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদের সাথে শায়খের এক কন্যার বিবাহ হয়। যদিও বিষয়টি হুসায়েন বিন গান্নাম বা ইবনে বিশর উল্লেখ করেননি বলে এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। দ্রঃ মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯১

[2]. James Wynbrant, A brief history of Saudi Arabia (New York : Facts on file. inc, 2004), P. 119.

[3]. মক্কা-মদীনা তথা হেজাযের শাসকদের উপাধি ছিল ‘শরীফ’। আরবে মূলতঃ রাসূল (ছাঃ)-এর বংশধর তথা বনু হাশেমের বংশধরদের চিহ্নিত করার জন্য উপাধিটি ব্যবহৃত হ’ত। ১২০১ খৃষ্টাব্দে আববাসীয় শাসনামলে বনু হাশিমের জনৈক উত্তরাধিকারী শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ‘শরীফ’ উপাধি ধারণ করেন। হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর বংশধারা থেকে আগত এই শরীফের মাধ্যমেই শরীফী শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে হেজাযে। তখন থেকে তাঁর বংশধরগণ মক্কা-মদীনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করে এসেছে। স্থানীয়ভাবে এই শরীফরা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করলেও মুসলিম সালতানাতের ক্ষমতাসীন শাসকদের আনুগত্যে থেকেই তাঁরা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। আববাসীয়, আইয়ূবী ও মামলূক শাসকদের পর তারা যথারীতি ওছমানীয় সালতানাতেরও আনুগত্য স্বীকার করে নেন। ১৯০৮ সালে হোসেন (রাঃ)-এর বংশধরের সর্বশেষ ‘শরীফ’ আলী আব্দুল্লাহ পাশা ক্ষমতাচ্যুত হন। অতঃপর হোসাইন (রাঃ)-এর বংশধর থেকে পরপর কয়েকজন শরীফ ক্ষমতায় আসেন। ১৯২৫ সালে সর্বশেষ শরীফ আলী বিন হুসাইনের পতনের মাধ্যমে হেজাযে শরীফী শাসনের অবসান ঘটে (উইকিপিডিয়া)

[4]. James Wynbrant, Ibid, P. 104-106; উইকিপিডিয়া।

[5]. আব্দুল্লাহ ছালেহ আল-উছায়মীন, বুহুছ ওয়া তা‘লীক্বাত ফি তারীখিল মামলাকাহ আল-আরাবিয়াহ আস-সঊদিয়াহ (রিয়াদ : মাকতাবাতুত তাওবাহ, ২য় প্রকাশ : ১৯৯০ ইং ), পৃঃ ২২-২৫।

[6]. ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৫৯ পৃঃ, মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ৯২ পৃঃ।

[7]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯২।

[8]. ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৯৯ পৃঃ, হায়কাল, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯-৭১।

[9]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৪।

[10]. ঐ, পৃঃ ৯৫।

[11]. ইবনে গান্নাম, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৩-৭৫।

[12]. James Wynbrant, Ibid, P. 132.

[13]. ইবনে গান্নাম, প্রাগুক্ত, ১৭২ পৃঃ; ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২০২ পৃঃ; সম্পাদনা পরিষদ, আল মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ (রিয়াদ : www. intaaj.net থেকে প্রকাশিত ই-বুক, ১৪২৫ হিঃ/২০০৪ইং), নিবন্ধ শিরোনাম : ‘আদ-দাওলাহ আস-সঊদিয়াহ আল ঊলা’।

[14]. John Lewis Burchhardt, Notes on Bedouins and Wahabys (London : Henry Colburn and Richard Bentley, 1830) P. 322. (সুইস পর্যটক John Lewis Burchhardt ছিলেন মিসরের খেদিভ মুহাম্মাদ আলী পাশার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুহাম্মাদ আলী পাশা মক্কায় অবস্থানকালে তিনি ১৮১৪ সালের আগস্ট মাসে হেজাযে আগমন করেন এবং ১৮১৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় বছরখানেক আরব ভূখন্ডে পরিভ্রমণ করে সেখানকার সমাজ ও রাজনীতির উপর ৪৩৯ পৃষ্ঠার একটি মূল্যবান ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনা করেন। আরব ঐতিহাসিক ইবনে গান্নাম ও ইবনে বিশরের গ্রন্থদ্বয়ের বাইরে এই গ্রন্থটিও ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উপর রচিত একটি বিশ্বস্ত দলীল হিসাবে বিবেচিত হয়)।

[15]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[16]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৪; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৪।

[17]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৫৭-৫৮ পৃঃ; ওয়াহ্হাবীদের এই আক্রমণে দুই হাযারের বেশী শী‘আ নিহত হয় এবং ধন-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজে এবং বিশেষতঃ ইরানী শী‘আদের মধ্যে ওয়াহ্হাবীবিরোধী এক প্রবল সেন্টিমেন্ট তৈরী হয়। দ্রঃ মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৬।

[18]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৬-৭; আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[19]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৯-৬১; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৮।

[20]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[21]. প্রাগুক্ত।

[22]. প্রাগুক্ত।

[23]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৬৩ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৯।

[24]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৯।

[25]. Thomas Patrick Hughes, A Dictionary of Islam (London: W.H. Allen & Co., 13 Waterloo palace, Pall Mall S.W. 1895) P. 660.

[26]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 329.

[27]. আল মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[28]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৬৪ পৃঃ।

[29]. আমীন আর-রায়হানী, তারিখু নজদ আল-হাদীছ ওয়া মুলহাকাতুহু (বৈরূত : আল-মাতবা‘আহ আল-ইলমিয়াহ, ১ম প্রকাশ : ১৯২৮), পৃঃ ৫৫।

[30]. ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৬৬ পৃঃ; হায়কাল, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫।

[31]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১২।

[32]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/ ২৬৯ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৩।

[33]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৮৮ পৃঃ; প্রাচ্যবিদ ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে, এসময় রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের উপর থেকে সবুজ গম্বুজটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। তবে এ ঘটনা সত্য নয়। দ্রঃ মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৪।

[34]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত; পৃঃ ১১৪; আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[35]. সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) পৃঃ ৩০৫; Philip K. Hitti, History of Arabs (London : Macmillan Press Ltd, 16th Edition: 1994) p. 741.

[36]. ইসলামী বিশ্বকোষ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৫; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৭; আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে, ১৮১৪ সালে তারাবা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যেসব যুদ্ধ হয়, তাতে ওয়াহ্হাবীদের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন ‘গালিয়া আল-বাক্বমিয়াহ’ নাম্মী এক বিধবা ধনী মহিলা। বুদ্ধিমত্তা ও প্রখর ব্যক্তিত্বের কারণে কার্যত তিনিই ছিলেন তারাবার শাসক। ওয়াহ্হাবীদেরকে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদ ও যোদ্ধা সরবরাহ করে অকুন্ঠ সহযোগিতা করেছিলেন। তারাবার পরাজয়ের পর মুছত্বফা বেক-এর নেতৃত্বাধীন তুর্কী সৈনিকরা যুদ্ধে গালিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাঁকেই সম্মিলিত ওয়াহ্হাবী বাহিনীর নেতৃত্বদানকারিনী হিসাবে ধারণা করেছিল (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.371)

[37]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৩৬৪ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।

[38]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১২৮-১৩০ পৃঃ; আমীন আর রায়হানী, প্রাগুক্ত, ৬২ পৃঃ; John Lewis Burchhardt, Ibid, P.382.

[39]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.288.

[40]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.398; বারখার্ট উক্ত যুদ্ধে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আলী পাশার কৌশলে ওয়াহ্হাবীরা উন্মুক্ত ময়দানে নেমে এসে ফাঁদে আটকা পড়ে এবং চারিদিকে ঘেরাও হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুহাম্মাদ আলী ঘোষণা দেন যে, প্রত্যেক ওয়াহ্হাবীর মাথার মূল্য ৬ ডলার। ফলে মিসরীয় সৈন্যরা পাইকারী হারে ওয়াহ্হাবীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রায় ৫ হাযার লাশের স্তুপ জমে গেল যুদ্ধের ময়দানে, যাদেরকে টুকরো টুকরো করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরে বন্দীদের মক্কায় নেয়ার পর অধিকাংশকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

[41]. ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৩৭৮ পৃঃ; তবে ঐতিহাসিকদের মতে, তাঁর এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কেননা তার সামনে ছিল দু’মাসের অবরোধে দুর্বল হয়ে পড়া মিসরীয়দের আরবের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার সূবর্ণ সুযোগ। কিন্তু এ সুযোগ কাজে না লাগিয়ে নিজেকে তিনি নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিলেন। দ্রঃ মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৪। 

[42]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩।

[43]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.419.

[44]. ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৪২২ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪১।

[45]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪০।

[46]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪০।

[47]. ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৪৩৪ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১৪৫ পৃঃ; আমীন আর-রায়হানী, প্রাগুক্ত, ৭৬ পৃঃ।

[48]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১৪৮ পৃঃ।

[49]. প্রাগুক্ত, ১৪৯ পৃঃ।

[50]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.293.

[51]. Ibid, P.278-83.

[52]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[53]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 287-293.

[54]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.319. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৭৭ পৃঃ।

[55]. Ibid, P. 280-281; আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[56]. James Wynbrant, Ibid, P. 127.

[57]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 283.

[58]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১১৭-১১৯ পৃঃ।

[59]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 285.

[60]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 296.

[61]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ; আমীন আর-রায়হানী, প্রাগুক্ত, ৬২ পৃঃ; John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 286.

[62]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.297.

[63]. Ibid, P.298.

[64]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৬৭ পৃঃ।

[65]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৭৩-২৭৪ পৃঃ।

[66]. John Lewis Burchhardt, Ibid, P.304.

[67]. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৭৫ পৃঃ।

[68]. মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৯।

[69]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[70]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।

[71]. আমীন আর-রায়হানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২।

[72]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ; মাসউদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৬।

[73]. যার ধারাবাহিকতা পরবর্তীরাও কম-বেশী অনুসরণ করার ফলে আজও পর্যন্ত সঊদী আরবের মাটিতে ইসলামের মূল রূহটা বহুলাংশেই টিকে রয়েছে এবং শিরক ও বিদ‘আতের উপস্থিতি সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে।- লেখক

[74]. মুনীর আল-আজলানী, তারীখুদ দাওলাহ আস-সঊদিয়াহ (রিয়াদ : দারুস সুনবুল, ১৪১৩ হিঃ), ২/১৯ পৃঃ; Madawi Al-Rasheed, A history of Saudi Arabia (Cambridge : Cambridge University Press, 2002), P. 21-22.

[75]. Philip K. Hitti, Ibid, P. 741.

[76]. Lothrop Stodderd, The new world of Islam (London : Chapman and Hall Ltd, 1922) P. 22.






বিষয়সমূহ: সংগঠন
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানবাধিকার ও ইসলাম (১২তম কিস্তি) - শামসুল আলম
বালা-মুছীবত থেকে পরিত্রাণের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আল্লাহর নিদর্শন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৯ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (শেষ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
হজ্জ : ফযীলত ও উপকারিতা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বাজারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.