বায়তুল মাক্বদিস মুসলমানদের নিকটে কেন এত গুরুত্ববহ?

আল-কুদস, মাসজিদুল আক্বছা বা বায়তুল মাক্বদিস মুসলমানদের নিকট অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র স্থান। বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়স্পন্দন। এ পবিত্র ভূমি সকল মুসলমানের নিজস্ব সম্পদ। রাষ্ট্রীয় নিদারুণ অর্থকষ্টে ভোগা তুর্কী সালতানাতের শেষ দিকে খলীফা দ্বিতীয় আব্দুল হামীদের নিকট প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ইহুদীরা বায়তুল মাক্বদিসের সামান্য ভূমি দাবী করেছিল। সেদিন তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেছিলেন, এটি তোমাদেরকে দেওয়ার মানে হ’ল আমাকে জীবিতাবস্থায় কাফন পরানোর শামিল। দূরদর্শী আমীর বুঝতে পেরেছিলেন ইহুদীদের ষড়যন্ত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই ভূমি আজ ইহুদীদের করতলগত। বায়তুল মাক্বদিস ও ফিলিস্তীনকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য অভিশপ্ত ও বিপথগামী ইহুদী-খ্রিষ্টান চক্র আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের রক্তের হোলি খেলায় মেতেছে বিশ্বমোড়ল নামের হায়েনারা। টন কে টন বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে হাযার হাযার স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে এরা। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে পাখির মত হত্যা করছে। নারী ও শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না এদের হিংস্রতা থেকে।

অপরদিকে ফিলিস্তীনী ভাই-বোনেরা জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত বহু মুসলিম মুজাহিদ শাহাদাত অমিয় সুধা পান করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কেন তারা বিশ্ব মুসলিমের পক্ষে জিহাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? চলুন! জেনে নেই, ফিলিস্তীন ও বায়তুল মাক্বদিসের গুরুত্বের কারণ এবং ফিলিস্তীনীদের এই আত্মত্যাগের পেছনে কোন্ অনুপ্রেরণা কাজ করছে? আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল।- 

১. পবিত্র ও বরকতময় ভূমি :

মক্কা ও মদীনার পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র ও বরকতময় ভূমি হ’ল ফিলিস্তীনের বায়তুল মাক্বদিস। সকল নবী ও রাসূলের একমাত্র মিলন কেন্দ্র এটি। এটি অনেক নবী, রাসূলের জন্ম, মৃত্যু, কবর এবং বাসস্থানের স্মৃতিধন্য এক অনন্য ভূমি।

মহান আল্লাহ এই ভূমিকে বরকতময় ভূমি হিসাবে পবিত্র কুরআনে একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيْرُ، ‘যার চতুস্পার্শ্বকে আমরা বরকতমন্ডিত করেছি, তাকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১, আম্বিয়া ৭১, ৮১, আ‘রাফ ১৩৭, সাবা ১৮)

মহান আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর ভাষায় পবিত্র যমীন বলে উল্লেখ করে বলেন, يَاقَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللهُ لَكُمْ، ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা এই পুণ্য ভূমিতে (বায়তুল মুক্বাদ্দাসে) প্রবেশ কর। যা আল্লাহ তোমাদের (মুমিনদের) জন্য নির্ধারণ করেছেন’ (মায়েদাহ ৫/২১)। অত্র আয়াতে কারীমায় মহান আল্লাহ শিরক এবং পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত মুমিন-মুসলমান ও নবী-রাসূলদের পবিত্র ভূমি হিসাবে বায়তুল মাক্বদিসকে বুঝিয়েছেন। 

সকল আম্বিয়া কেরামের পদচারণা এর পবিত্রতা ও বরকত অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কেননা সেখানে তারা সকলেই যিকর ও ছালাতে এবং মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে সময় অতিবাহিত করেছেন। দাঊদ (আঃ), সুলায়মান (আঃ), ঈসা (আঃ) সহ সকল বনী ইস্রাঈলী নবীগণের আগমনস্থল এবং দাওয়াতী মারকায হিসাবে বরিত হয়েছিল এই বায়তুল মাক্বদিস। বিশেষ করে শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শুভাগমন একে আরো মর্যাদা মন্ডিত করেছে।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَلَيُوشِكَنَّ أَنْ لَا يَكُونَ لِلرَّجُلِ مِثْلُ شَطَنِ فَرَسِهِ مِنَ الْأَرْضِ حَيْثُ يَرَى مِنْهُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ خَيْرٌ لَهُ مِنَ الدُّنْيَا جَمِيْعًا، ‘শীঘ্রই এমন পরিস্থিতি হবে যে, একজন ব্যক্তির কাছে স্বীয় ঘোড়ার রশি সমপরিমাণ (সামান্য) ভূখন্ড সমগ্র দুনিয়া বা দুনিয়ার সমস্ত কিছু হ’তে অধিকতর মূল্যবান হবে, যেখানে দাঁড়িয়ে সে বায়তুল মাক্বদিসকে দেখতে পাবে’।[2]

২. মহানবী (ছাঃ)-এর গমনস্থল এবং ইসরা ও মি‘রাজ :

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দা ও বন্ধু মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নিলেন। মানুষ তার প্রভুর সাথে এইভাবে সাক্ষাৎ ও জান্নাতী দিকনির্দেশনা পাবে বিষয়টি সত্যিই বড় আশ্চর্যের! বিষয়টি অবিশ্বাস্য হ’লেও বাস্তব এবং সশরীরে রাসূল (ছাঃ)-এর মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাই তো কাফের নেতা আবু জাহল রাসূল (ছাঃ)-এর প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু আবুবকর (রাঃ)-কে কাহিনীটি শুনিয়ে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) সেদিন দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেছিলেন, অবশ্যই তিনি সত্য নবী এবং ঘটনাটি নিঃসন্দেহে সত্য। আর এমন একটি কাহিনীর বাস্তব সাক্ষী হ’ল বায়তুল মাক্বদিস।

এ সম্পর্কে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘বোরাক নিয়ে আসা হ’ল। বোরাক এমন জন্তু বিশেষ, যা ধবধবে সাদা ও দীর্ঘকায়। গাঁধার চেয়ে বড় এবং খচ্চরের চেয়ে গঠনে ছোট। আর জন্তুটি একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ সীমানায়’। তিনি বললেন, ‘আমি তার উপর আরোহণ করে বায়তুল মাক্বদিস পর্যন্ত গমন করলাম। এরপর আমি সেটাকে নবীদের জন্তুর খুঁটির সাথে বাঁধলাম’। তিনি বলেন, ‘অতঃপর আমি মসজিদে আক্বছাতে প্রবেশ করে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করলাম। এরপর সেখান হ’তে আমাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হল’।[3]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, আমি নিজেকে কা‘বা গৃহের হাত্বীমে দন্ডায়মান দেখলাম। আর কুরায়েশের লোকেরা আমাকে আমার মি‘রাজের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল। তারা আমাকে বায়তুল মাক্বদিস সম্পর্কে এমন কিছু প্রশ্ন করল, যা আমার স্মরণে ছিল না। ফলে আমি এমন অস্থির হয়ে পড়লাম যে, এর পূর্বে অনুরূপ অস্থির আর কখনো হইনি। তখন আল্লাহ তা‘আলা বায়তুল মাক্বদিসকে আমার সামনে উপস্থিত করে দিলেন, ফলে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম এবং তারা যে বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করত, আমি তা দেখে দেখে উত্তর দিতে লাগলাম। আমি (মি‘রাজের রাতে) নিজেকে নবীদের এক দলের মাঝে দেখতে পেলাম। তখন দেখি মূসা (আঃ) দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছেন। তিনি একজন মধ্যম গঠনের সামান্য লম্বা, মনে হ’ল যেন (ইয়ামন দেশের) শানুয়াহ্ সম্প্রদায়ের লোক। অনুরূপ ঈসা (আঃ)ও দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছেন। লোকদের মধ্যে উরওয়াহ ইবনু মাসঊদ আস্-সাক্বাফী হ’লেন তার অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার ইবরাহীম (আঃ)-কেও দাঁড়ানো অবস্থায় ছালাত আদায় করতে দেখলাম। লোকদের মধ্যে তার উপমা তোমাদের সঙ্গীসদৃশ অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর নিজেরই সদৃশ। অতঃপর ছালাতের সময় হ’লে আমিই ছালাতে তাদের ইমামতি করলাম। যখন আমি ছালাত শেষ করলাম তখন কেউ আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! ইনি হ’লেন জাহান্নামের দ্বাররক্ষী মালিক, তাঁকে সালাম করুন। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, আমি তার দিকে ফিরে তাকাতেই তিনি আমাকে আগে সালাম দিলেন’।[4]

৩. মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা :

বায়তুল মাক্বদিস হ’ল মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রথমে সেদিকে মুখ করেই ষোল বা সতের মাস ছালাত আদায় করেছেন। হিজরী দ্বিতীয় সনের শা‘বান মাসের মাঝামাঝিতে মহানবী (ছাঃ) কিছু সংখ‌¨ক ছাহাবায়ে কেরামসহ মদীনার অদূরে মসজিদে বনু সালামায় যোহর মতান্তরে আছরের ছালাত আদায় করছিলেন। তখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাক‘আতের মাঝামাঝি সময়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম চার রাক‘আতের অবশিষ্ট দুই রাক‘আত কা‘বার দিকে ফিরে আদায় করলেন। সেই থেকে এই মসজিদটি মসজিদে ক্বিবলাতাইন বা দুই ক্বিবলার মসজিদ হিসাবে সমধিক পরিচিত। হাদীছে এসেছে, ‘বারা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) মদীনাতে ষোল অথবা সতের মাস যাবৎ বায়তুল মাক্বদিসের দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেছিলেন। অথচ তিনি বায়তুল্লাহর দিকে তাঁর ক্বিবলা হওয়াকে পসন্দ করতেন। নবী করীম (ছাঃ) আছরের ছালাত (কা‘বার দিকে মুখ করে) আদায় করেন এবং লোকেরাও তাঁর সঙ্গে ছালাত আদায় করে। এরপর তাঁর সঙ্গে ছালাত আদায়কারী একজন বের হন এবং তিনি একটি মসজিদের লোকেদের পাশ দিয়ে গেলেন তখন তারা রুকূ‘ অবস্থায় ছিল। তিনি বললেন, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে মক্কার দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেছি। এ কথা শোনার পর তাঁরা যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় বায়তুল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নিল। আর যারা ক্বিবলা বায়তুল্লাহর দিকে পরিবর্তনের পূর্বে বায়তুল মাক্বদিসের দিকে ছালাত অবস্থায় মারা গিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে আমরা কী বলব তা আমাদের জানা ছিল না। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান ব্যর্থ করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি পরম মমতাময়, পরম দয়ালু’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)[5]

৪. পৃথিবীর বুকে স্থাপিত দ্বিতীয় মসজিদ :

বায়তুল মাক্বদিস হ’ল মহান আল্লাহর দ্বিতীয় গৃহ। পৃথিবীর প্রথম মানব আদি পিতা আদম (আঃ) মহান আল্লাহর আদেশে মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে আক্বছার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে মসজিদে হারাম পুনসংস্কার করেন ইবরাহীম (আঃ) এবং মসজিদুল আক্বছা সুলায়মান (আঃ)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي ذَرٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ مَسْجِدٍ وُضِعَ فِي الْأَرْضِ أَوَّلُ؟ قَالَ: (الْمَسْجِدُ الْحَرَامُ)، قَالَ: قُلْتُ: ثُمَّ أَيْ؟ قَالَ: (ثُمَّ الْمَسْجِدُ الْأَقْصَى) ، قُلْتُ: كَمْ بَيْنَهُمَا؟ قَالَ:أَرْبَعُونَ عَامًا ؟

আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! দুনিয়াতে প্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, তারপর হ’ল মসজিদুল আক্বছা। অতঃপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ্যে ব‌¨বধান কত বছরের? তিনি বললেন, চল্লিশ বছরের ব‌¨বধান’।[6]

৫. মসজিদুল আক্বছায় সফরের প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষ গুরুত্বারোপ :

মহান আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন দেখা ও জ্ঞান লাভের বড় মাধ্যম হ’ল সফর। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘তুমি বল, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ কিভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন পুনরায় সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বস্ত্তর উপরে সর্বশক্তিমান’ (আনকাবূত ২৯/২০)

বায়তুল মাক্বদিস মানব সভ্যতার সূতিকাগার এক অনন্য নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক স্থান। সে কথা বিবেচনায় মহানবী (ছাঃ) মাসজিদুল হারাম, মাসজিদে নববী ও মাসজিদুল আক্বছার উদ্দেশ্যে সফরকে বিশেষ পুণ‌¨ময় কাজ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। পৃথিবীর পরিভ্রমণের কথা বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ থাকলেও রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে এমন স্পষ্ট বার্তা অন‌¨ কোন স্থানের ক্ষেত্রে উল্লেখিত হয়নি। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ، وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ صلى الله عليه وسلم وَمَسْجِدِ الأَقْصَى. ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ব‌¨তীত অন‌¨ কোন মসজিদে বিশেষ ছওয়াবের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করো না। আর সে তিনটি মসজিদ হ’ল মাসজিদুল হারাম, মাসজিদে নববী ও মাসজিদুল আক্বছা’।[7] অন্য একটি হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ فَذَكَرَ الْحَدِيثَ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ فَلَقِيتُ بَصْرَةَ بْنَ أَبِى بَصْرَةَ الْغِفَارِىَّ قَالَ مِنْ أَيْنَ أَقْبَلْتَ فَقُلْتُ مِنَ الطُّورِ. فَقَالَ أَمَا لَوْ أَدْرَكْتُكَ قَبْلَ أَنْ تَخْرُجَ إِلَيْهِ مَا خَرَجْتَ إِلَيْهِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لاَ تُعْمَلُ الْمَطِىُّ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ إِلَى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِلَى مَسْجِدِى وَإِلَى مَسْجِدِ إِيلِيَاءَ أَوْ بَيْتِ الْمَقْدِسِ.

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বললেন, আমি বছরায় ইবনু আবি বাছরা গিফারীর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, কোথা থেকে আগমন করলে? আমি বললাম, তূর হ’তে। তারপর তিনি বললেন, সেখানে গমনের পূর্বে যদি আমি তোমাকে পেতাম, তবে তোমার যাওয়া হ’ত না। কেননা আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনটি মসজিদ ব্যতীত (অন্য কোন স্থানের জন্য) সওয়ারীর আয়োজন করা যায় না- (১) মসজিদুল হারাম (কা‘বাগৃহ), (২) আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববী) ও (৩) মসজিদ ইলিয়া বা বায়তুল মাক্বদিস’।[8]

৬. ছালাত আদায়ে অঢেল ছওয়াব :

ছালাত মুসলিম জীবনের শ্রেষ্ঠ ইবাদত। ছালাত মুসলমানের পরকালীন মুক্তির সবচেয়ে বড় মানদন্ড হিসাবে বিবেচিত হবে। ক্বিয়ামতের দিন বান্দার প্রথম হিসাব হবে ছালাতের। ছালাত আদায়ের সফলতা বান্দার একমাত্র মুক্তির সোপান। আর যদি কেউ বায়তুল মাক্বদিসে ছালাত আদায় করে তার জন্য বিশেষ ছওয়াব প্রাপ্তির বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে হাদীছে বিধৃত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

لَمَّا فَرَغَ سُلَيْمَانُ بْنُ دَاوُدَ مِنْ بِنَاءِ بَيْتِ الْمَقْدِسِ سَأَلَ اللهَ ثَلاَثًا حُكْمًا يُصَادِفُ حُكْمَهُ وَمُلْكًا لاَ يَنْبَغِى لأَحَدٍ مِنْ بَعْدِهِ وَأَلاَّ يَأْتِىَ هَذَا الْمَسْجِدَ أَحَدٌ لاَ يُرِيدُ إِلاَّ الصَّلاَةَ فِيهِ إِلاَّ خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِهِ كَيَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم- أَمَّا اثْنَتَانِ فَقَدْ أُعْطِيَهُمَا وَأَرْجُو أَنْ يَكُونَ قَدْ أُعْطِىَ الثَّالِثَةَ.

‘যখন সুলায়মান ইবনু দাঊদ (আঃ) বায়তুল মাক্বদিসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে তিনটি বিষয়ের প্রার্থনা করলেন। আল্লাহর হুকুমমত সুবিচার, এমন রাজত্ব, যা তার পরে কাউকে প্রদান করা হবে না। ছালাত আদায়ের জন্য একনিষ্ঠ মনে উক্ত মসজিদে এবং আগমনকারীর পাপ মোচন করা হবে তার মা তাকে প্রসব করার দিনের ন্যায় (অর্থাৎ নিষ্পান করা হবে)। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তার আবেদনের ভিত্তিতে প্রথম দু’টি তাকে প্রদান করা হয়েছে। তৃতীয়টিও দান করা হবে বলে আমি প্রত‌¨vশা করছি’।[9] অন্য হাদীছে এসেছে,

আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَضْلُ الصَّلاةِ فِي المسجد الحرام على غيره مِئَة أَلْفِ صَلاةٍ وَفِي مَسْجِدِي أَلْفُ صَلاةٍ وَفِي مسجد بيت المقدس خمسمِئَة صَلاةٍ ‘মসজিদে হারামে এক ছালাত এক লাখ ছালাতের সমান, আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) এক ছালাত এক হাযার ছালাতের সমান এবং বায়তুল মাক্বদিসে এক ছালাত পাঁচশত ছালাতের সমান’।[10]

৭. বায়তুল মাক্বদিস অহি অবতরণস্থল এবং নবী-রাসূলগণের ভূমি :

অধিকাংশ নবী-রাসূল এখানে প্রেরিত হয়েছিলেন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ), ইসহাক্ব (আঃ), ইয়াকূব (আঃ), ইউসুফ (আঃ), লূত (আঃ), দাঊদ (আঃ), সুলায়মান (আঃ), ছালেহ (আঃ), যাকারিয়া (আঃ), ইয়াইয়া (আঃ) ও ঈসা (আঃ) সহ প্রায় পাঁচ হাযার নবীর কর্মস্থল ছিল ফিলিস্তীন। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন,وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطًا إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِينَ ‘আর আমরা তাকে ও (তার ভাতিজা) লূতকে উদ্ধার করে সেই দেশে পৌঁছে দিলাম যেখানে আমরা বিশ্ববাসীদের জন্য কল্যাণ রেখেছিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭১)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ عَاصِفَةً تَجْرِي بِأَمْرِهِ إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا وَكُنَّا بِكُلِّ شَيْءٍ عَالِمِينَ، ‘আর আমরা প্রবল বায়ুকে সুলায়মানের অনুগত করে দিয়েছিলাম। যা তার নির্দেশমতে পরিচালিত হ’ত সেই জনপদের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছিলাম। বস্ত্ততঃ সকল বিষয়ে আমরা সম্যক অবগত’ (আম্বিয়া ২১/৮১)। উক্ত আয়াতদ্বয়ে الْأَرْضِ বলতে বায়তুল মাক্বদিস বুঝানো হয়েছে। ইবরাহীম (আঃ), লূত (আঃ) এবং সুলায়মান (আঃ)-এর নামগুলিও এখানে এসেছে।

. ফিলিস্তীন হাশরের ময়দান :

দুনিয়ার সব কিছুই নশ্বর। দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে একদিন সকলকেই মহান আল্লাহর সামনে হাশরের ময়দানে একত্রিত হ’তে হবে। আর সেই হাশরের ময়দান হবে বর্তমান বায়তুল মাক্বদিস ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। রাসূল (ছাঃ) বলেন, বায়তুল মাক্বদিস হ’ল হাশরের ময়দান। পুনরুত্থানের জায়গা (هوَ أرضُ المَحشرِ والمنشَرِ)।[11]

৯. দাজ্জাল মুক্ত ভূমি :

দুনিয়াতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ফিৎনা হ’ল দাজ্জালের ফিৎনা। রাসূল (ছাঃ) সহ সকল নবী ও রাসূলগণ এ বিষয়ে স্ব স্ব কওমকে সতর্ক করেছেন। পৃথিবীর সকল মানুষ দাজ্জালের ফিৎনায় পতিত হবে। তবে মহান আল্লাহ কিছু জায়গাকে দাজ্জালের ফিৎনা মুক্ত রাখবেন। তারমধ্যে অন্যতম হ’ল বায়তুল মাক্বদিসের ভূমি। রাসূল (ছাঃ) বলেন,بَعَثَ اللهُ الْمَسِيحَ بْنَ مَرْيَمَ، فَيَنْزِلُ عِنْدَ الْمَنَارَةِ الْبَيْضَاءِ، شَرْقِيَّ دِمَشْقَ بَيْنَ مَهْرُودَتَيْنِ، وَاضِعًا كَفَّيْهِ عَلَى أَجْنِحَةِ مَلَكَيْنِ، إِذَا طَأْطَأَ رَأْسَهُ قَطَرَ، وَإِذَا رَفَعَهُ تَحَدَّرَ مِنْهُ مِثْلُ جُمَانٍ كَاللُّؤْلُؤِ ; فَلَا يَحِلُّ لِكَافِرٍ أَنْ يَجِدَ مِنْ رِيحِ نَفَسِهِ إِلَّا مَاتَ، وَنَفَسُهُ يَنْتَهِي حَيْثُ يَنْتَهِي طَرْفُهُ، فَيَطْلُبُهُ حَتَّى يُدْرِكَهُ بِبَابِ لُدٍّ فَيَقْتُلَهُ، ‘আল্লাহ তা‘আলা ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন এবং তিনি দামেশকের পূর্ব প্রান্তের শ্বেত মিনারা হ’তে হলুদ রঙের দু’টি কাপড় পরিহিত অবস্থায় দু’জন ফেরেশতার পাখায় হাত রেখে অবতরণ করবেন। তিনি যখন মাথা নিচু করবেন তখন ফোটা ফোটা ঘাম ঝরবে, আর যখন মাথা উঁচু করবেন তখন তা স্বচ্ছ মুক্তার মতো ঝরতে থাকবে। তিনি যে কোন কাফেরের কাছে যাবেন সে তার শ্বাসের বাতাসে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যাবে তাঁর শ্বাসও ততদূর পর্যন্ত পৌছবে। এ অবস্থায় তিনি দাজ্জালকে অনুসন্ধান করতে থাকবেন। অবশেষে তিনি (বায়তুল মাক্বদিসের) ’লুদ্দ’ নামক দরজার কাছে পেয়ে তাকে হত্যা করবেন’।[12] রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَإِنَّهُ سَيَظْهَرُ عَلَى الْأَرْضِ كُلِّهَا غَيْرَ الْحَرَمِ وَبَيْتِ الْمَقْدِسِ ‘(দাজ্জাল) সর্বত্র প্রকাশ পাবে। শুধু বায়তুল হারাম এবং বায়তুল মাক্বদিস ব্যতীত’।[13]

১০. আল্লাহর পসন্দনীয় ভূমি :

মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তবুও তিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে ফযীলত-মর্যাদা ও গুরুত্বের কম-বেশী করেছেন। যেমন তিনি রাত, দিন ও মাস সৃষ্টি করেছেন। মাসের মাঝে রামাযান, দিনের মাঝে আরাফাহ, জুম‘আ, দুই ঈদের দিন, তাশরীকের দিনগুলি এবং যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশককে, রাতের মাঝে লায়লাতুল ক্বদরকে এবং প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, জুম‘আর দিনের বিশেষ মুহূর্তটিকে উত্তম সময় হিসাবে মর্যাদামন্ডিত করেছেন।

অনুরূপভাবে তিনি মানুষের মাঝে মর্যাদার তারতম্য করেছেন। যেমন মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব কাফিরের উপরে। নবীগণ সকল মানুষের উপরে শ্রেষ্ঠ। রাসূলগণ সমস্ত নবীদের উপরে। আর সকল রাসূলগণের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ হ’লেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)। তেমনিভাবে যমীনবাসীর নিকট বিশেষ বিশেষ জায়গার বিশেষ বিশেষ মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে। যেমন জাযীরাতুল আরব বা আরব ভূখন্ডে মক্কা, মদীনা, শাম বা সিরিয়া, ফিলিস্তীন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বায়তুল মাক্বদিসের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা ইঙ্গিত করে বলেন, وَالتِّينِ وَالزَّيْتُونِ ‘শপথ ডুমুর ও যয়তূন বৃক্ষের’ (তীন ৯৫/১)। তাফসীর বিশারদগণ বলেন, ডুমুর ও যায়তূন ফলের দেশ হ’ল বায়তুল মাক্বদিস। উল্লেখ্য, তীন বা ডুমুর ফল খাওয়া হয় এবং যায়তূন বৃক্ষ থেকে তেল পাওয়া যায়। আর আল্লাহ কর্তৃক কোন অঞ্চলের বিশেষ কিছুর শপথ করার মানে হ’ল সে ভূমি তাঁর নিকটে অধিক প্রিয় ও পসন্দনীয় হওয়া’।[14]

১১. মূসা (আঃ) বায়তুল মাক্বদিসের পাশে সমাধিস্থ হওয়ার কামনা করেন :

মূসা (আঃ)-এর জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল বায়তুল মাক্বদিসের নিকটে কবরস্থ হওয়া। সেজন্য তিনি স্বীয় প্রতিপালকের নিকট কায়মনোবাক্যে দো‘আ করেছিলেন।

আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মৃত্যুর ফেরেশতা মূসা ইবনু ইমরান (আঃ)-এর কাছে এসে বললেন, আপনার প্রভুর ডাকে সাড়া দিন। তখন মূসা (আঃ) মৃত্যুর ফেরেশতার চোখের উপর চপেটাঘাত করলেন। ফলে তার চোখ উপড়ে গেল। তিনি বলেন, অতঃপর ফেরেশতা আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, আপনি আমাকে আপনার এমন এক বান্দার কাছে পাঠিয়েছেন, যে মরতে চায় না। এমনকি সে আমার চোখ উপড়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার চোখ ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেন, তুমি পুনরায় আমার সেই বান্দার কাছে যাও এবং বল, তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও? যদি বেঁচে থাকতে চাও, তাহ’লে একটি ষাড়ের পিঠে হাত রাখ এবং তোমার হাত তার যতগুলো লোম ঢেকে ফেলবে, প্রতিটি লোমের বদলে তোমাকে এক এক বছর আয়ু দান করা হবে। তা শুনে মূসা (আঃ) প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, তারপর কি হবে? ফেরেশতা বললেন, তারপর তোমাকে মরতে হবে। তখন মূসা (আঃ) বললেন, তাহ’লে কাছাকাছি সময়ে এখনই তা হোক। (এরপর তিনি দো‘আ করলেন,) হে প্রভু! আপনি আমাকে পবিত্র ভূমি (বায়তুল মাক্বদিস) হ’তে একটি ঢিল নিক্ষেপের দূরত্ব পর্যন্ত নিকটে পৌঁছিয়ে দিন। (অর্থাৎ তথায় যেন আমাকে দাফন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! যদি আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম, তবে পথপার্শ্বে লাল বালুর টিলার কাছে তাঁর কবর আমি তোমাদেরকে দেখিয়ে দিতাম’।[15]

১২. সূর্য দন্ডায়মানস্থল :

প্রত্যকটি গ্রহ-উপগ্রহ মহান আল্লাহর নির্দেশে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। তারা সকলেই আল্লাহর আদেশ পালনে সদা তৎপর। মহান আল্লাহ বলেন,وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ‘আর (অন্যতম নিদর্শন হ’ল) সূর্য। যা তার গন্তব্যের দিকে চলমান থাকে। এটা হ’ল মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়ের নির্ধারণ’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৮)

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন নযীর নেই চলন্ত সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বায়তুল মাক্বদিসের ভূমি এ সম্মানের অধিকারী। সেটি সংঘটিত হয়েছিল নবী ইউশা‘ বিন নূন (আঃ)-এর মু‘জিযাকে কেন্দ্র করে। তিনি ফিলিস্তীনের বায়তুল মাক্বদিসের সন্নিকটে ‘আরাইহা’ জনপদে মহান আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। এমন সময় সূর্য আছর গড়িয়ে মাগরিব হ’তে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করে সূর্যকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে বলেন। ফলে তা দাঁড়িয়ে যায়।

রাসূল (ছাঃ) বলেন,فَغَزَا فَدَنَا مِنَ الْقَرْيَةِ صَلاَةَ الْعَصْرِ أَوْ قَرِيبًا مِنْ ذَلِكَ فَقَالَ لِلشَّمْسِ إِنَّكِ مَأْمُورَةٌ وَأَنَا مَأْمُورٌ، اللَّهُمَّ احْبِسْهَا عَلَيْنَا. فَحُبِسَتْ، حَتَّى فَتَحَ اللهُ عَلَيْهِ، ‘(ইউশা ইবনে নূন) জিহাদে গেলেন এবং আছরের ছালাতের সময় কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে একটি জনপদের নিকটে আসলেন। তখন তিনি সূর্যকে বললেন, তুমিও আদেশ পালনকারী আর আমিও আদেশ পালনকারী। হে আল্লাহ্! সূর্যকে থামিয়ে দিন। তখন তাকে থামিয়ে দেয়া হ’ল। অবশেষে আল্লাহ তাকে বিজয় দান করেন’।[16] রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন,ما حُبِسَتِ الشمسُ على بشَرٍ قطُّ، إلَّا على يوشَعَ بنِ نونٍ، ليالِيَ سارَ إلى البيتِ المُقَدَّسِ، ‘মানুষের ওপর সূর্যকে কখনো স্থির রাখা হয়নি, তবে ইউশা‘ বিন নূন (আঃ)-এর জন্য রাখা হয়। যে রাতে তিনি বায়তুল মাক্বদিস সফর করেন’।[17]

১৩. চিরগৌরবের বীরত্বগাথা ভূমি :

বায়তুল মাক্বদিস বীর, মহাবীর, মহানায়কদের স্মৃতিবিজড়িত ভূমি। ঐতিহাসিক জালূত ও তালূত কাহিনীর মহা নায়ক দাঊদ (আঃ)-এর বীরত্ব, অতুলনীয় বিশ্ব শাসক সুলায়মান (আঃ)-এর জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা বীরত্বগাথার ইতিহাস নিয়ে বায়তুল মাক্বদিস স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।

ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ) কর্তৃক বায়তুল মাক্বদিসের দূরদর্শী বিজয় ছিল ইসলামের চিরন্তন বিজয়। পরবর্তীতে আধুনিক কালে বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বীর ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কথা আমাদের সকলেরই জানা। তিনি বায়তুল মাক্বদিসের পবিত্র মাটির পবিত্রতা রক্ষার্থে ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন। প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ের মণিকোঠায় বায়তুল মাক্বদিস বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্বের জায়গায় রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يَرْحَمَكُمْ وَإِنْ عُدْتُمْ عُدْنَا وَجَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ حَصِيرًا، ‘অবশ্যই তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। কিন্তু যদি তোমরা (যুলুমের) পুনরাবৃত্তি কর, তাহ’লে আমরাও (শাস্তির) পুনরাবৃত্তি করব। আর জাহান্নামকে আমরা অবিশ্বাসীদের জন্য কারাগার স্বরূপ বানিয়েছি’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮)[18]

আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي عَلَى الدِّينِ ظَاهِرِينَ لَعَدُوِّهِمْ قَاهِرِينَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ إِلَّا مَا أَصَابَهُمْ مِنْ لَأْوَاءَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ. قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ وَأَيْنَ هُمْ؟ قَالَ: بِبَيْتِ الْمَقْدِسِ وَأَكْنَافِ بَيْتِ الْمَقْدِسِ ‘আমার উম্মতের একটি দল দ্বীনের (হকের) উপর বিজয়ী থাকবে, শত্রুর উপর দুর্দান্ত প্রতাপশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ব্যতীত অন‌¨ কোন বিরোধী পক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না; আল্লাহর আদেশ তথা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা এভাবেই থাকবে। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তারা কোথায়? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তারা বায়তুল মাক্বদিস এবং তার আশেপাশে’।[19]

উপসংহার : মহান আল্লাহ মক্কা-মদীনার পরেই বায়তুল মাক্বদিসকে মুসলমানদের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্বের জায়গা করেছেন। সকল নবী-রাসূলগণের ইমামতি করানোর মাধ্যমে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তিনি শেষ নবী ও বিশ্ব নেতা হিসাবে বরিত ও সম্মানিত করেছেন এই বায়তুল মাক্বদিসেই। অতএব ফিলিস্তীন এবং বায়তুল মাক্বদিসের ভূমি মুসলমানদের আত্মগৌরব ও সম্মানের। এর সম্মান এবং গুরুত্ব অন্য সকল কিছুর চেয়ে ভিন্ন। ফ্রি মিশনের ধ্বজাধারীরা সেটি দখলের যতই আস্ফালন করুক না কেন, কোন মুসলিম সন্তান কখনই তা তাদের ছেড়ে দিতে পারে না। ফিলিস্তীন ও বায়তুল মাক্বদিস আমাদের আছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ। হে আল্লাহ! তুমি বায়তুল মাক্বদিস ও ফিলিস্তীনী মুসলমানদের রক্ষা কর- আমীন!


[1]. আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর লি ইবনে ‘আশূর ১৫/২০ পৃ.।

[2]. হাকেম, ছহীহুত তারগীব হা/১১৭৯।

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৩; ছহীহাহ হা/৮৭৪।

[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৫১৩৫।

[5]. বুখারী হা/৪০।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭৫৩।

[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৯৩।

[8]. নাসাঈ হা/১৪৩০; ইবনে মাজাহ হা/১১৩৯; আহমাদ হা/২৩৮৯৯।

[9]. নাসাঈ হা/৬৯৩; ইবনে মাজাহ হা/১৪০৮।

[10]. মুসনাদে বাযযার হা/৪১৪২; মিরক্বাতুল মাফাতীহ ২/৫৮৬ পৃ.।

[11]. বায়হাক্বী, ছহীহুত তারগীব হা/১১৭৯

[12]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪৭৫

[13].  ইবনু হিববান ৭/১০২ পৃ.; ইবনু খুযায়মা ২/৩২৭ পৃ.

[14]. দ্র. তাফসীর ইবনু কাছীর ৮/৪৩৪ পৃ.।

[15]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭১৩।

[16]. বুখারী হা/৩১২৪, ফাৎহুল বারীর ব্যাখ্যা দ্র.।

[17]. আহমাদ হা/৮২৯৮, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২২৬।

[18].عَسَى ‘সম্ভবতঃ’ কথাটি যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তখন সেটির অর্থ হয় ওয়াজিব (عَسَى مِنَ اللهِ وَاجِبَةٌ)ক্বাতাদাহ বলেন, অতঃপর মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তার সাথীরা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অধিকারী হয় এবং সেখানকার অধিবাসীরা জিযিয়া প্রদানের মাধ্যমে হীনকর জীবন যাপনে বাধ্য হয় (ইবনু কাছীর)। এটি ১৫ হিজরীতে খলীফা ওমর (রাঃ)-এর হাতে সমাপ্ত হয় (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)। বর্তমানে পাশ্চাত্যের সাহায্যে ইস্রাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হ’লেও তা পুনরায় মুসলমানদের হাতে ফিরে আসবে। যার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে অত্র আয়াতে(মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তরজমাতুল কুরআন ৪২৩ পৃ. দ্র.)।

[19].  আহমাদ হা/২২৩৭৪; ছহীহাহ হা/১৯৫৭।






অভ্যাসগত বিশ্বাস থেকে চিন্তাশীল বিশ্বাসের পথে যাত্রা - মুহাম্মাদ আনওয়ারুল কারীম
আহলেহাদীছ মসজিদে হামলা : ইসলামী লেবাসে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন (ফেব্রুয়ারী’২১ সংখ্যার পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
দাওয়াত ও সংগঠন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সিজদার গুরুত্ব ও তাৎপর্য - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
হাদীছ ও কুরআনের পারস্পরিক সম্পর্ক (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মুনাফিকী - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শারঈ জ্ঞানার্জনের বাধ্যবাধকতা ও বর্তমান সমাজ বাস্তবতা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.