১৩.
২২শে আগস্ট বুধবার। মিনার ময়দানে দিনটি প্রায় বিশ্রামেই কেটে গেল। যোহরের পর আন্দোলনের ছানা‘ইয়া আছেমা, রিয়াদ শাখার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর ভাই (নায়ায়ণগঞ্জ) এলেন, যিনি আমাদের পাহাড়ের উপরের তাঁবু থেকে নীচে অদূরে এক তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। আন্দোলনের সঊদী আরব শাখা সভাপতি এবং রিয়াদের বাদিয়াহ ইসলামিক সেন্টারের দাঈ শায়খ মুশফিকুর রহমানও মিনায় ছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে দেখা করতে পারেননি। তাঁর সাথে ফোনে কথা হ’ল।
আছরের পর আমরা দ্বিতীয় দিনের মত জামরায় কংকর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। আলমগীর ভাইসহ আরও তিন জন প্রবাসী ভাই মনীর হোসাইন (নারায়ণগঞ্জ), জাহাঙ্গীর হোসাইন (নবাবগঞ্জ, ঢাকা), বেলাল হোসাইন (নবাবগঞ্জ, ঢাকা) আমাদের সঙ্গী হ’লেন, যারা ছানা‘ইয়া আছেমা, রিয়াদ শাখা আন্দোলনের বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন। ওদিকে মতীউর রহমান ভাই সঊদী ধর্মমন্ত্রী ড. আব্দুল লতীফ বিন আব্দুল আযীয আলে শায়েখের কাছে আববার নামে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলেন। সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল বিকাল ৫টা। মাসজিদুল খায়েফের নিকটস্থ একটি সরকারী ভবনে সাক্ষাতটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি সময়মত জানতে না পারায় আমাদের রওয়ানা হ’তেই সাড়ে ৪টা বেজে গেল। তিনটি টানেল পায়ে হেঁটে পেরিয়ে জামরায় পৌঁঁছতে সময় লাগল ৪০ মিনিট। কিন্তু পাথর মারা শেষে আমরা যখন মাসজিদুল খায়েফ পৌঁছলাম, তখন মাগরিবের সময় হয়ে গেল। ফলে মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। মতীউর ভাইয়েরা কয়েকজন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসেন মাগরিবের আগেই।
আমরা সেখানে বেশ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলাম। সংক্ষিপ্ত কোন রাস্তার খোঁজে আরও বেশ কিছু সময় চলে গেল। অনেক স্থানে পুলিশ রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে গতদিনের মত আবারও দীর্ঘ পথ হেঁটে কিং আব্দুল্লাহ ব্রীজে আসতে হ’ল। সেখান থেকে একটি বাস পাওয়া গেল। অবশেষে তাঁবুতে এসে পৌঁছলাম রাত দশটার দিকে। মিনায় এটি ছিল আমাদের তৃতীয় দিন এবং সর্বশেষ রাত্রিযাপন। রাতের খাবার খেয়ে আমি আর নাজীব তাঁবুর বাইরে এসে পায়চারী করলাম দীর্ঘক্ষণ। পাহাড়ের ওপর থেকে দিগন্তবিস্তারী মিনার ময়দান কী যে অদ্ভুত লাগে! সুশৃংখল আলোকোজ্জ্বল তাঁবুর রেখা আর মধ্যখানের চওড়া রাস্তায় দলে দলে হাজীদের পায়দল গমনাগমন সবকিছুতেই এক সুকোমল প্রশান্তির আবেশ ছড়ায়। মনটা নিমেষেই পবিত্রতায় ভরে ওঠে।
পরদিন ১২ই যিলহজ্জ বেলা বাড়ার সাথে সাথে হাজীদের মধ্যে বিদায়ের তোড়জোড় শুরু হ’ল। আমরা তখনও আরও একদিন তথা ১৩ই যিলহজ্জ পর্যন্ত থাকার পরিকল্পনা নিয়ে ছিলাম। কিন্তু দুপুর হ’তে হ’তে তাঁবুগুলো প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। যে বাথরুমগুলোর সম্মুখে সর্বদা লম্বা লাইন পড়ে থাকত, সেগুলো এখন ফাঁকা। হায় বাথরুম! কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছে এ কয়দিন! বেশ শান্তি শান্তি লাগে। কিন্তু মু‘আল্লিম অফিস থেকে জানা গেল আছরের পর থেকে আর কোন কাকপক্ষীও থাকবে না ক্যাম্পে। সব গুটিয়ে নেয়া হবে। সুতরাং পরিকল্পনা পরিবর্তন করে আমরাও বিদায়ের প্রস্ত্ততি নিলাম। আছর পড়ে তিনদিনের আবাসস্থলকে বিদায় জানিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হ’ল জামরার উদ্দেশ্যে। আজও সঙ্গ দিলেন আলমগীর ভাই ও তার সাথীরা। নিরাপদে ও সুস্থভাবে জামরায় পাথর মারা শেষ করে আমরা মক্কার পথে রওয়ানা হলাম পায়ে হেঁটে। প্রায় দু’ঘন্টা পর হারামে পৌঁছে মাগরিবের জামা‘আত ধরলাম। শায়খ সুদাইসের সুমধুর তেলাওয়াতে সমস্ত ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল। রাতেই তাওয়াফে ইফাযাহ করার ইচ্ছা ছিল। তবে আববা ও ফুফু আম্মার শারীরিক ক্লান্তির কথা ভেবে তা স্থগিত রাখা হ’ল। আলমগীর ভাইয়েরা রাতে আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নিলেন।
১৪.
২৪শে আগস্ট শুক্রবার হারামে জুম‘আর ছালাত আদায় করা হ’ল। রিয়াদের ভাইয়েরা সারাদিন বাস এবং এয়ারলাইন্সে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করলেন যে, কোনভাবে রিয়াদে সাংগঠনিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা যায় কি না। তবে সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করে আপাতত না যাওয়ার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত করা হ’ল। একই সাথে সিদ্ধান্ত হ’ল যে রিয়াদের ভাইয়েরা মক্কায় আসবেন পরবর্তী শুক্রবার ৩১শে আগস্ট। এদিকে আমাদের ফিরতি ফ্লাইট ছিল ২০শে সেপ্টেম্বর। রিয়াদের প্রোগ্রাম স্থগিত হওয়ায় আববা আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না। বাংলাদেশ বিমানের টিকেট এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ‘ইত্তিহাদ’ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ৩রা সেপ্টেম্বর ফিরতি টিকেট কাটা হ’ল আববা, ফুফু আম্মা ও শাকিরের জন্য। আমি আর নাজীব আরও কয়েকদিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে রাতে মতীউর ভাই বিদায়ী সাক্ষাতের জন্য আমাদের হোটেলে এলেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হ’ল। পরদিন তিনি ইন্ডিয়া ফিরে যাবেন।
২৫শে আগস্ট সকাল দশটায় আমরা তাওয়াফে ইফাযার উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। দিনের বেলায় সূর্যের খরতাপ এড়াতে আজ আর মাত্বাফে নামলাম না। প্রথম তলাতে তাওয়াফ করলাম। সময় বেশী লাগলেও অনেকটা স্বস্তির সাথে তাওয়াফ করা গেল। অতঃপর সাঈ শেষ করে বের হ’তে যোহরের সময় হয়ে গেল। এরই সঙ্গে শেষ হ’ল হজ্জের মূল কার্যক্রম। একটা ঘোরের মধ্যে যেন কেটেছে হজ্জের এই ক’দিন। লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোতে যেন ভেসে চলছিলাম। কোথায় যেয়ে সে স্রোত ঠেকে তা ভাবার ফুরছৎ ছিল না। প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্ত্তত থাকতে হয়েছে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য। সর্বোপরি আল্লাহর অশেষ রহমত যে, শারীরিক তেমন কোন অসুস্থতা ছাড়াই আববা, ফুফুসহ আমরা সবাই হজ্জের সকল কার্যক্রম সুচারুরূপে সমাপ্ত করতে পেরেছি। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
রাতে সাক্ষাৎ হ’ল আমার এক ইন্দোনেশীয় সহপাঠী শু‘আইব আব্দুল হালীমের সাথে, যে ইসলামাবাদে ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে আমার সহপাঠী ও সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। এখন পিএইচ.ডি রত আছে ইসলামাবাদেই। আগেই হজ্জে আসার খবরটা জানিয়েছিল। অনেক দিন পর আজ তার সাথে সাক্ষাতে বন্ধুত্বের পুরোনো উষ্ণতা খুঁজে পেলাম।
১৫.
২৬শে আগস্ট রবিবার বেলা ৩টার দিকে আমরা মক্কা থেকে ৯০ কি. মি. দক্ষিণ-পূর্বে ত্বায়েফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। হজ্জযাত্রীরা অধিকাংশই ত্বায়েফ শহরকে ভ্রমণ তালিকায় রাখেন। মরুময় উষ্ণ মক্কা শহরের সম্পূর্ণ বিপরীত শীতল আবহাওয়া এবং বিশেষত রাসূল (ছাঃ)-এর প্রস্তরাঘাতে আহত হওয়ার করুণ ইতিহাস জড়িত থাকায় এই শহর বাড়তি আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। বিকাল ৩-টার দিকে আমরা একটি মাইক্রো যোগে রওয়ানা দিলাম। কাযী হারূণ চাচা এবং গোলাম কিবরিয়া আমাদের সাথী হ’ল। উষর মরুভূমির ধুসর প্রান্তর অতিক্রম করে গাড়ি এগিয়ে চলে। সময় লাগে প্রায় দেড় ঘন্টা। সমতল থেকে প্রায় ১৯০০ মিটার উঁচু এই শহরের কেন্দ্রে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে গাড়ী সর্পিলভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করতে থাকে। আর সমতলের পৃথিবী ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হ’তে থাকে। আর দৃষ্টিসীমা বিস্তৃত হয়। ধুসর কুয়াশার পর্দা না থাকলে সুদূর মক্কা শহরও নযরে আসত। পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ পর্বতাঞ্চলে বহুবার এমন রাস্তা অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। তবুও এমন দৃশ্য বার বার চোখ ফিরিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। আসমান থেকে পাখির চোখে উন্মুক্ত পৃথিবী দেখার অনুভূতি সবসময়ই অন্যরকম।
পর্যটকদের জন্য পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে সাড়ে চার কি.মি. দীর্ঘ রোপওয়ে। যাতে ক্যাবল কারে চড়ে পর্যটকরা ত্বায়েফ শহর থেকে সরাসরি নীচে আল-হাদা অবকাশ কেন্দ্রে নেমে যায় এবং উঠে আসে। এটি বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ রোপওয়ে। মাঝপথে ড্রাইভার গাড়ি থামায়। রাস্তার ধারে প্রশস্ত চত্বর। নামতেই বানরের দল খাবারের খোঁজে এগিয়ে আসেই। সেখান থেকে নিচের দিকে তাকালাম। উচ্চতায় বুকে কাঁপুনি ধরে যায়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পেচিয়ে পেচিয়ে উপরে ওঠা রাস্তার সৌন্দর্যে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।
সাড়ে চারটার দিকে আমরা তায়েফ শহরের অন্দরে প্রবেশ করি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, বাহারী ফুলের বাগান, সুসজ্জিত পাতাবাহার, সুরম্য অট্টালিকা চমৎকৃত করে। ভূমি থেকে শহরের অবস্থান এত উঁচুতে হওয়া সত্তেবও অভ্যন্তরভাগ দিব্যি সমতল। বুঝার উপায় নেই যে, এটা কোন পাহাড়ী শহর। গাড়ি সোজা চলে যায় চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) জামে মসজিদে। আমরা এখানে আছরের ছালাত আদায় করি। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর কবর উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরে দেখার কোন সুযোগ নেই। কোথাও ইশারা পর্যন্ত নেই যে, এখানে কোন কবর আছে। শিরক-বিদ‘আতের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সতর্কতার পরিচয় রেখেছে সঊদী সরকার সর্বত্রই, আলহামদুলিল্লাহ। ৬৮ হিজরীতে এই ত্বায়েফে অবস্থানকালে ‘হাবরুল উম্মাহ’ তথা মুসলিম উম্মাহর মহাজ্ঞানী খ্যাত এই জলীলুল ক্বদর ছাহাবী ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এবং এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
কবর যিয়ারতের পর সেখান থেকে বের হয়ে তায়েফ শহর প্রদক্ষিণ করি। একদল হজ্জযাত্রীর অনুসরণে আমরা উপস্থিত হই পুরানো এক মসজিদের সামনে। অনেকের ধারণা রাসূল (ছাঃ) তায়েফবাসীর প্রস্তরাঘাতে আহত হয়ে এই স্থানে এসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছিলেন, যা মযলূমের দো‘আ নামে খ্যাত। মসজিদের সামনে সঊদী সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভাষায় বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) এই স্থান দিয়ে গমন করেছেন তার স্পষ্ট কোন প্রমাণ নেই। কোন ছাহাবী বা সালাফে ছালেহীন এই স্থানে বরকত লাভের জন্য আসেননি। সুতরাং এখানে বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে আগমন করা বিদ‘আত। সেখান থেকে অদূরে আছে খেজুর ও আঙ্গুর গাছের বাগান। রয়েছে একটি গভীর কুপ। ধারণা প্রচলিত আছে যে, এই আঙ্গুর বাগান ও কূপ রাসূল (ছাঃ)-এর স্মৃতিবিজড়িত। এক আফগান বৃদ্ধ সেখানে কৃষিকর্মে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি দূরে এক পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ঐ পাহাড়ের পাদদেশে রাসূল (ছাঃ)-কে পাথর নিক্ষেপে আহত করা হয়েছিল। আর দু’পার্শ্বের দুই পাহাড়কে জিবরাঈল (আঃ) অত্যাচারী তায়েফবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দয়ালু নবী নিজের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে চাননি বরং ভেবেছিলেন স্বীয় উম্মতের ভবিষ্যতের কথা। যেন তারা হেদায়াত পায়। জানি স্থানিক চিহ্নগুলো সবই কাল্পনিক, তবুও ঘটনা তো চরম সত্য। এই পাহাড়ী যমীন, এই খেজুর ও আঙ্গুর বাগান, এই পরিত্যক্ত কুপ, সান্ধ্যরাগে মৃদু মেঘের বুটিকে ঢাকা তায়েফের বিষণ্ণণ আসমান-সবকিছুতে মনটা কেমন বেচাঈন হয়ে ওঠে। হয়ত ১৫০০ বছর পূর্বে এমনই কোন এক ক্ষণে আমাদের প্রিয় নবী অসহায় অবস্থায় ত্বায়েফ থেকে যখমে রক্তস্নাত পদযুগল নিয়ে সুদূর মক্কার পথে ফেরত গিয়েছিলেন। বাস্তবতার জগত থেকে এক লহমায় ইতিহাসের সেই অমলিন দৃশ্যপট পরিভ্রমণে চক্ষুযুগল আপনাতেই ভিজে ওঠে।
তায়েফ থেকে আরও প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে হাই বনু সা‘দ নামে একটি অঞ্চল রয়েছে। সাধারণ্যে ধারণা প্রচলিত আছে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর দুধমাতা হালীমার আবাসস্থল ছিল এই গ্রামে। আমরা ত্বায়েফের ভূ-চিত্র আরও বিস্তৃতভাবে দেখার সুযোগ নিতে ঐ পর্যন্ত গাড়ী ভাড়া করেছিলাম। ত্বায়েফ ভ্রমণকারীদের অনেকেই এ পথে আসেন। গাড়ি আরও প্রায় সোয়া ঘন্টা চলার পর আমরা বনু সা‘দ গ্রামে এসে পৌঁছলাম। দিনের অবশিষ্ট আলোয় অনুচ্চ পাহাড়ে ঘেরা জনশূন্য পল্লীটি বেশ ভালভাবেই দেখা গেল। কোন বাড়ি-ঘর অবশিষ্ট নেই। কেবল একটি গৃহের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। একজন পাকিস্তানী সেখানে দাঁড়িয়ে লোকদের বুঝাচ্ছে এটা হ’ল বিবি হালীমার গৃহ। এখানেই প্রতিপালিত হয়েছিলেন রাসূল (ছাঃ)। এই পল্লীতেই সংঘটিত হয়েছিল সিনাচাকের ঘটনা। জনাকয়েক পর্যটক পরম আবেগ নিয়ে সেখানে নেমে সম্ভবতঃ মাগরিবের ছালাত পড়ল। আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে সেখান থেকে চলে আসলাম।
দিন দিন পর্যটক সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৬ সালে সঊদী সরকারের একটি সংস্থা এই স্থানের উপর গবেষণা চালায় এবং ঘোষণা করে যে, এই পল্লী এবং গৃহের ধ্বংসাবশেষের সাথে বিবি হালীমার কোন সম্পর্ক নেই। সেই সাথে তারা এই গৃহের বাকি অংশটুকু গুঁড়িয়ে দেয়, যাতে মানুষ এখানে ভিড় না করে। ড্রাইভার জানালো যে, সঊদী সরকার কোন ড্রাইভার এই স্থানে গাড়ি নিয়ে এলে তাকে জরিমানা করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে তারা যে সকল পর্যটক এখানে আসতে চায় তাদেরকে অনেকটা লুকিয়ে নিয়ে আসে। মোটকথা বিবি হালীমা বনু সা‘দ গোত্রের হ’লেও তিনি এখানে বাস করতেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া মক্কা থেকে সুদূর ১৬০ কি.মি. দূরত্বে এই প্রত্যন্ত গ্রামে রাসূল (ছাঃ)-কে প্রতিপালনের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, এমন তথ্য বিস্ময়করই বটে। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, মক্কার নিকটবর্তী কোন মহল্লায় কেটেছিল রাসূল (ছাঃ)-এর শৈশবের দিনগুলো।
আমরা পার্শ্ববর্তী ছোট্ট এক লোকালয়ের মসজিদে মাগরিব-এশার ছালাত জমা ও ক্বছর সহ আদায় করলাম। জামালপুরের এক ভাইকে সেখানে পেলাম, যিনি পার্শ্ববর্তী এক হাসপাতালে মাত্র ৬০০ রিয়াল বেতনে চাকুরী করেন। যদিও তার চুক্তিতে ছিল ১৮০০ রিয়াল। তিনি বলেন, আগে হালীমা সা‘দিয়ার বাড়ী ভেবে দৈনিক বহু পর্যটক এখানে আসত। তাদের কাছ থেকে যা বখশিশ পেতাম, তাতে চলত। কিন্তু এখন কেউ না আসায় খুবই কষ্টে পড়ে গেছি। জনশূন্য এলাকা হওয়ায় হাসপাতালেও কোন রোগী নেই। সারা দিনে এক-দু’জনও হয় না। আববা তাকে দেশে ফিরে যেতে বললে তিনি বললেন, ফিরে যাবারও স্বাধীনতা নেই। কেননা পাসপোর্ট আটকে আছে কোম্পানীর কাছে। যা চুক্তি শেষে পাওয়া যাবে। এমনি করে বহু বাঙালী সঊদী আরবের বিভিন্ন প্রান্তে শোষণের শিকার হচ্ছে দালালদের খপ্পরে পড়ে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দীর্ঘ আড়াই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় ফিরে এলাম। ফেরার পথে রাতের জাঁকজমকপূর্ণ ত্বায়েফ শহর এবং রাস্তা থেকে নিচের পৃথিবীর চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা আমাদেরকে বারবার বিমোহিত হওয়ার উপলক্ষ্য এনে দিল।
১৬.
পরদিন বিশ্রাম নিয়ে ২৮শে আগস্ট মঙ্গলবার সকালে আমরা মক্কা শহর ভ্রমণে বের হ’লাম। একজন ভদ্র ও জাননেওয়ালা তরুণ বাঙালী ড্রাইভার পাওয়ায় বেশ সুবিধা হ’ল। প্রথমেই গেলাম আরাফাহ ময়দানে অবস্থিত রাসূল (ছাঃ)-এর বিদায় হজ্জের খুৎবা প্রদানের স্থল জাবালে রহমতে। এখন খুৎবা হয় মসজিদে নামিরাহ থেকে। হজ্জের সময় এই পাহাড় দেখার সুযোগ পাইনি। এখানে বহু মানুষের আনাগোনা দেখা গেল। পাহাড়ের শীর্ষদেশে যে পিলার রয়েছে সেখানে সরকারীভাবে নানাভাষায় এই স্থানকে ইবাদতের স্থানে পরিণত করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু মানুষকে সেখানে নফল ছালাত আদায় করতে দেখা গেল। উপর থেকে গোটা আরাফাহ ময়দান নযরে আসে। হজ্জের পর ইতিমধ্যেই তাঁবুগুলো খুলে ফেলা হয়েছে। পরে সেখান থেকে মসজিদে নামিরা, মুযদালিফা ময়দান, মসজিদ মাশ‘আরুল হারাম, মাসজিদুল খায়েফ এবং মিনা ময়দান অতিক্রম করে আবার আমরা মক্কার দিকে ফিরে এলাম। মাত্র ক’দিন পূর্বেই লক্ষ লক্ষ মানুষের পদভারে প্রকম্পিত হওয়া এই স্থানগুলি এখন খাঁ খাঁ করছে। এভাবেই পড়ে থাকবে বছরব্যাপী। পরবর্তী হজ্জ মওসুমের আগ পর্যন্ত। মক্কা শহরে ফিরে আমরা জাবালে নূরে অবস্থিত হেরা গুহা, গারে ছওর দেখলাম। যদিও দুপুরের রোদে উপরে ওঠা হয়নি। সবশেষে তানঈমে অবস্থিত মসজিদে আয়েশা এবং মাসজিদুল জিন দেখার পর হোটেলে ফিরে এলাম।
এদিন বিকেলে হিলটন হোটেল সংলগ্ন আবুবকর মসজিদে এসে দেখা করলেন মাগুরার হাসান ভাই। ইতিপূর্বে ‘আন্দোলন’-এর মক্কা শাখার দায়িত্বশীল ছিলেন এবং আত-তাহরীকের এজেণ্ট ছিলেন। দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ তিনি এই হোটেলে কর্মরত আছেন। তিনি আমাদেরকে হিলটন ৩৪ তলা হোটেলের ২০ তলায় হোটেল মালিকের জন্য সংরক্ষিত এ্যাপার্টমেন্ট পরিদর্শনে নিয়ে গেলেন। এখান থেকে কা‘বা গৃহসহ মাসজিদে হারামের পূর্ণ চিত্র অত্যন্ত চমৎকারভাবে নযরে আসে। রাতে তিনি আমাদের মেহমানদারীও করলেন। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন। তার মুখেই শুনলাম এই হোটেল মালিক ফাক্বীহ গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বিন আব্দুল ক্বাদের ফাক্বীহ (জন্ম : ১৯২৫ খৃঃ) ছিলেন সামান্য একজন মুরগী বিক্রেতা। ১৯৬৩ সালে সঊদী আরবে সর্বপ্রথম বিশেষায়িত পোল্ট্রি ফার্ম স্থাপনের মাধ্যমে তার উত্থান ঘটে। বর্তমানে তিনি এই ব্যবসার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক এবং বিশ্বের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি। আজও পর্যন্ত একক মালিকানায় এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ পোল্ট্রি ফার্ম। এই খামারের বৈশিষ্ট্য হ’ল, এখানে শতভাগ প্রাকৃতিক খাবার দ্বারা মুরগী পালন করা হয়।
১৭.
২৯শে আগস্ট বুধবার ফজরের পর হোটেলে এলেন আমাদের পূর্ব পরিচিত করাচী প্রবাসী নূরুল ইসলাম ভাই (বাগেরহাট)। দুপুরে দু’জন সাথী নিয়ে আব্দুল মান্নান চাচা (সাতক্ষীরা) এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন বাঙালী খাবার আলুভর্তা, বেগুনভর্তা, করলা ও ডিম ভর্তা এবং খাসীর গোশত ও মোটা চাউলের ভাত। ওনাদের বিদায় দিয়ে দুপুরের পর আমরা জেদ্দা রওয়ানা হ’লাম। সেখানে সাইফুল ইসলাম ভাই আমাদেরকে রিসিভ করলেন, যিনি রিয়াদে ‘আন্দোলন’-এর একজন দায়িত্বশীল ছিলেন। সম্প্রতি জেদ্দায় এসেছেন। কিছু কেনাকাটা সেরে সাইফুল ভাইয়ের গাড়িসহ অপর একটি গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত বিখ্যাত ভাসমান মসজিদ আর-রহমাহ-এর উদ্দেশ্যে। এটি ইন্দোনেশিয়ান মসজিদ নামেও পরিচিত। জেদ্দা ডাউনটাউন থেকে দূরত্ব প্রায় ৩০ কি.মি.। ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে ঘন্টাখানেক লাগল পেঁŠছতে। মাগরিবের ছালাত আদায় করে লোহিত সাগরের পানিতে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ কাটালাম। সেখান থেকে সমুদ্র তীরে নির্মিত অসংখ্য পার্ক অতিক্রম করে কিং ফাহদ ফোয়ারার নিকটবর্তী একটি পার্কে এলাম। এটি বিশ্বের উচ্চতম ফোয়ারা হিসাবে স্বীকৃত। উচ্চতায় প্রায় ৩০০ মিটার এবং ঘন্টায় ৩৭৫ কি.মি. গতিতে পানি উৎক্ষিপ্ত হয় সপ্তমীর বাঁকা চাঁদের মত। সাইফুল ভাই সাড়ে চার কেজি ওযনের ‘বাইত’ নামক একটি সামুদ্রিক মাছ ফ্রাই করে নিয়ে আসলেন। ড্রাইভার সহ আমরা ৮জন পার্কের সবুজ ঘাসের বিছানায় বসে রাতের আকাশে শ্বেত-শুভ্র ফোয়ারার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সেই মাছের ফ্রাই দিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম তৃপ্তির সাথে। তারপর বালাদ মার্কেট থেকে আরও কিছু কেনাকাটা শেষে মক্কায় ফিরে এলাম রাত সোয়া ১-টায়। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হ’লেও সাইফুল ভাইয়ের আন্তরিকতা ও মেহমানদারীতে সফরটা অনেক প্রাণবন্ত ও আনন্দমুখর হ’ল। আল্লাহ তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন!
পরদিন ৩০শে আগস্ট রাতে আবুবকর মসজিদে এশার ছালাত আদায় করে বের হওয়ার মুখে হারাম চত্বরে দেখা হয় ঢাকার সোবহানবাগ মসজিদের খতীব মাওলানা শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং উম্মুল কুরায় অধ্যয়নরত তার ছোটভাইয়ের সাথে এবং লন্ডন প্রবাসী পিস টিভির আলোচক ড. আবুল কালাম আযাদ (যশোর), ফুরফুরা পীর ছাহেবের ছোট ছেলে প্রমুখের সাথে। তাঁদের সাথে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হ’ল। আববার সাথে তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করলেন। ড. আযাদ জানালেন ১৯৯৯ সালে তিনি একবার নওদাপাড়া মারকাযে এসেছিলেন দারুল ইহসান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আযহারী শিক্ষক ড. সাফতীকে নিয়ে। আমার মনে পড়ল সে সময় তাঁদের বিদায়দানকালে আমি মাইক্রোতে ছিলাম এবং তাঁদেরকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। অনেকদিন পর তাঁর সাক্ষাৎ পেয়ে ভাল লাগল।
১৮.
৩১শে আগস্ট শুক্রবার সকালে রিয়াদ থেকে সংগঠনের ২০জন কর্মী এলেন আববার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। আমাদের রিয়াদের প্রোগ্রাম বাতিল হওয়ার পর তাঁরা মক্কায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি শায়খ মুশফিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শায়খ আব্দুল হাই, আত-তাহরীক পাঠক ফোরামের সভাপতি মুস্তাফীযুর রহমান প্রমুখ বিবিধ কারণে আসতে পারেননি। তাঁদের সাথে ফোনে কথা হ’ল। আবূবকর মসজিদেই বাদ আছর আমরা একত্রিত হলাম। উপস্থিত ছিলেন ‘আন্দোলন’-এর সঊদী আরব শাখা সমাজকল্যাণ সম্পাদক জনাব কাযী রিয়াযুল ইসলাম (মধু), সাহিত্য ও পাঠাগার সম্পাদক মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন, দফতর সম্পাদক এমরান মোল্লা, মাসিক আত-তাহরীক পাঠক ফোরামের উপদেষ্টা কালামুল ইসলাম, সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল বাছীর (ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মতীন-এর পুত্র), সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম প্রমুখ। এছাড়াও রিয়াদের বিভিন্ন শাখা সভাপতি ও অন্যান্য দায়িত্বশীলবৃন্দ। আলমগীর ভাই এবং জেদ্দার সাইফুল ইসলাম ভাইও এসেছিলেন। আববা তাঁদের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ নছীহতমূলক বক্তব্য রাখেন। নানা বিষয়ে পরামর্শ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠান হ’ল। আলহামদুলিল্লাহ খুব আনন্দঘন পরিবেশে তাৎপর্যপূর্ণ এই সাংগঠনিক বৈঠকটি সমাপ্ত হ’ল। রাতেই তাঁরা রিয়াদ ফিরে গেলেন।
পরদিন ১লা সেপ্টেম্বর কেনাকাটা ইত্যাদি বিদায়ের প্রস্ত্ততিতে শেষ হ’ল। ২রা সেপ্টেম্বর বিদায়ী তাওয়াফ শেষে সন্ধ্যার পর আমরা জেদ্দা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পৌঁছলাম রাত ১০-টার দিকে। অতঃপর সেখান থেকে ভোর সোয়া ৫-টার ফ্লাইটে আববারা রওয়ানা হলেন আবুধাবী হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমি, নাজীব ও হারূন চাচা মক্কায় ফিরে এলাম ফজরের সময়।
১৯.
আববা বিদায় নেওয়ার পর আমরা মক্কায় আরও ৪দিন অবস্থান করলাম। মাঝে একদিন বাগেরহাটের মাওলানা রূহুল আমীনের পরামর্শে সন্ধ্যার পর হেরা গুহায় আরোহণ করলাম। প্রায় ৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই গুহায় আরোহণ করতে দিনের বেলা প্রখর রৌদ্রে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু রাতের আবহাওয়া সম্পূর্ণ বিপরীত। খুব স্বাচ্ছনেদ্য ঘন্টাখানিকের মধ্যে গুহামুখে পৌঁছে গেলাম। ভিড়ও ছিল খুব কম। ফলে আরও ঘন্টাখানেক সেখানে অবস্থান করার সুযোগ পাওয়া গেল। হারূণ চাচা এতবার আসা সত্ত্বেও আজ প্রথম এই গুহায় উঠলেন। গুহার মুখে দাঁড়িয়ে কানে কেবলই বেজে যাচ্ছিল ‘ইক্বরা বিসমি রাবিবকাল্লাযী খালাক্ব’-কুরআনের প্রথম নাযিল হওয়া ৫টি আয়াত। দু’চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল সেই স্থান যেখানে জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বুকে চেপে ধরেছিলেন। অন্তর থেকে অনুভবের চেষ্টা করছিলাম সেই মুহূর্তটির কথা, আর সেই দিনগুলির কথা যখন রাসূল (ছাঃ) দিনের পর দিন এই নির্জন গুহায় অতিবাহিত করতেন।
কালো পাহাড়ের সারির মধ্যে অন্তর্ভেদী আলোয় ঝলমলে রাতের মক্কা অপরূপ সৌন্দর্যে সুশোভিত। রাত ১০-টার দিকে হেরা গুহা থেকে মক্কায় ফিরে আমরা নাক্কাসা বাযার তথা বাঙালী বাযারে গেলাম। এই বাযারে অবশ্য অধিকাংশই রোহিঙ্গা। শাক-সব্জি-মাছ থেকে এমন কোন জিনিস নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। দামে সস্তা। এখানে মুরগীর ‘ফাহাম’ খাওয়ার জন্য হারূণ চাচা এক দোকানে নিয়ে গেলেন। যা এত সুস্বাদু লাগল যে, পরবর্তীতে কখনও আসার সুযোগ হ’লে এখানকার ‘ফাহাম’ খাওয়ার নিয়ত করে ফেললাম।
২০.
৭ই সেপ্টেম্বর হারামে জুম‘আর ছালাত আদায়ের পর বিকেলে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম একটি প্রাইভেট কারে। আমাদের সহযাত্রী হ’লেন আল-বারাকা হজ্জ কাফেলার পরিচালক আফযাল হোসাইন। যাওয়ার পথেই তার সাথে পরিচয়। সাড়ে চার ঘন্টা পর মদীনায় নেমে হারূণ চাচার বুক করা হোটেলে গেলাম। সেখান থেকে রাতেই আল-ক্বাছীমগামী একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করা হ’ল। হারূণ চাচা আমাদের সাথী হ’লেন। সাড়ে চারশত কি.মি. পথ অতিক্রম করে ফজরের ছালাতের সময় আমরা ক্বাছীমের আল-খাবরা উপশহরে পৌঁছলাম। ‘আন্দোলন’-এর সঊদী আরব শাখা সহ-সভাপতি এবং পিস টিভির আলোচক শায়খ আখতার মাদানীর বাসায় আমন্ত্রণ ছিল হজ্জের পূর্বেই। তাঁর শ্বশুর এবং ‘আন্দোলন’-এর শূরা সদস্য হাজী আব্দুর রহমান চাচাও বাসায় উপস্থিত ছিলেন। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম আমরা। দুপুরে বাসায় খানাদানার অনুষ্ঠানে যোগদান করতে এলেন আল-খাবরা ‘আন্দোলন’-এর কয়েকজন সাথীভাই। হরেক পদের বাঙালী খাবার সবাই অত্যন্ত তৃপ্তিভরে খেলাম।
আছরের ছালাতের পর হাফেয আখতার মাদানী আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর কর্মস্থলে। আলহামদুলিল্লাহ খুব সুনামের সাথে কাজ করছেন তিনি। স্থানীয় বাঙালী ভাইগণ একবাক্যে তাঁর অন্তঃপ্রাণ ভক্ত। অত্র অঞ্চলে সালাফী দাওয়াতের প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। কেবল অত্র অঞ্চলে নয়, বরং সাংগঠনিক দায়িত্বের কারণে সঊদী আরবের বিভিন্ন শহরে তিনি নিয়মিত সফর করেন। তাঁর কর্মস্থল ঘুরে দেখার পর আমরা আল-খাবরা শহর দেখতে বের হ’লাম। খুবই সুসজ্জিত ও ছিমছাম শহর আল-খাবরা। জনসংখ্যা কম বলে শহুরে ব্যস্ততা নেই। আবহাওয়া শুষ্ক। প্রচন্ড গরম। তবুও গ্রীনহাউজের মাধ্যমে প্রচুর শাক-সব্জি, ফলমূলের উৎপাদন হয়। উন্মুক্ত ভূমিতেও সেচের ব্যবস্থা করে ফসল ফলানো হচ্ছে। সেচের জন্য দূর থেকে পানি এনে বিরাট জলাধার তৈরী করা হয়েছে। যেখানে আমাদের কক্সবাজারের ভাই আব্দুল্লাহ প্রচুর মাছ চাষ করেছেন। জলাধারের পার্শ্ববর্তী একটি খেজুর বাগানে ঢুকে আমরা পরিপক্ক, অর্ধ-পক্ক খেজুরের স্বাদ গ্রহণ করলাম। পার্শ্বেই দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি। গাড়ি চালিয়ে ভেতরে যেতেই এক বিরাট উটের পাল এগিয়ে আসতে দেখা গেল। দু’জন নিগ্রো রাখাল মরুভূমিতে উট চরিয়ে বাথানে ফেরত আসছে। আমরা তাদের সাথে কথা বললাম। ফেরার পথে একটি গরুর খামারে প্রবেশ করলাম। আব্দুল্লাহ ভাই এখানে ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসাবে চাকুরী করেন। আধুনিক পদ্ধতিতে শত শত গরু এখানে পালিত হচ্ছে। প্যাকেটজাত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য তৈরীর কারখানা রয়েছে খামারের সাথেই।
তবে সবচেয়ে ভাল লাগল প্রাচীন সঊদী আরবের একটি গ্রাম যার ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে জাদুঘরের মত করে। এই গ্রামে রয়েছে সাড়ে তিনশ’র মত মাটি ও গাছের খুঁটি দিয়ে নির্মিত বাড়ীঘর। রয়েছে সেই আমলের দোকানও। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এখানে বিরাট মেলা বসে। সঊদীরা এখানে এসে তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রার কথা স্মরণ করেন।
আল-খাবরা শহর পরিদর্শন শেষে এশার ছালাতের পর আমরা আল-খাবরা শাখা ‘আন্দোলন’-এর কার্যালয়ে এক দায়িত্বশীল বৈঠকে অংশগ্রহণ করলাম। বৈঠকে আখ-খাবরা দায়িত্বশীলগণ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বুরায়দা, উনায়যা প্রভৃতি শহর থেকে জনা তিরিশেক দায়িত্বশীল ও কর্মীভাই উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের আগ্রহ-উদ্দীপনা, শত ব্যস্ততার মাঝেও দাওয়াতী কাজে সময় দানের কারগুযারী আমাদের অভিভূত করল। জীবনে তারা মাদ্রাসার বারান্দায় পা দেননি। কিন্তু এই প্রবাসে সংগঠনই তাদের জন্য মাদ্রাসা হিসাবে কাজ করছে। তাদেরকে মানুষের সামনে সাবলীল ও সুশৃংখলভাবে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার উপায় ও পদ্ধতি শিখিয়েছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ। অনেকেই কথাগুলো আবেগময় ভাষায় ব্যক্ত করলেন। প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাপী বৈঠক শেষে একসাথে রাতের খানা সেরে আমরা ফিরে এলাম।
পরদিন কিছু ভাই উনায়যাতে আমন্ত্রণ জানালেও মদীনাতে হারূণ চাচার কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায় দুপুরের খাওয়া শেষে বের হ’তে হ’ল। হাফেয আখতার মাদানীর উষ্ণ আতিথেয়তা ও আন্তরিক সাহচর্যে সত্যিই স্মরণীয় দু’টো দিন কাটল আল-ক্বাছীমে আলহামদুলিল্লাহ। তাঁর প্রতি রইল অশেষ কৃতজ্ঞতা। রাত ৮টা নাগাদ আমরা মদীনায় ফিরে এলাম।
পরদিন ১০ই সেপ্টেম্বর সোমবার বাংলাদেশ বিমানের টিকেট এগিয়ে নিতে অফিসে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ কোন সমস্যা ও বাড়তি ফী ছাড়াই আট দিন এগিয়ে ২০ তারিখের বদলে ১২ই সেপ্টেম্বর রাতে জেদ্দা থেকে ফ্লাইট নির্ধারিত হ’ল।
১১ই সেপ্টেম্বর সারাদিন কেনাকাটার মধ্যেই গেল। সন্ধ্যায় মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং মারকাযের সাবেক ছাত্র আছিফ রেযা, আকমাল ও আব্দুল্লাহ আল-মামূন এলে তাদের সাথেই বাযারে গেলাম। পরে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি মীযানুর রহমানও এল। তার কাছে জানলাম মসজিদে নববীর লাইব্রেরীতে আববার বইগুলো দেয়া হয়েছে। পরে সেগুলো এন্ট্রি হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। উক্ত লাইব্রেরীর বিদেশী ভাষা বিভাগে বাংলায় আববার অনূদিত ‘ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব’ বইটি আগেই ছিল। এবারে যোগ হ’ল থিসিস, নবীদের কাহিনী-১,২,৩, তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা ইত্যাদি।
সব প্রস্ত্ততি শেষে ১২ই সেপ্টেম্বর বিকালে আমরা জেদ্দা রওয়ানা হলাম। ফ্লাইট ছাড়ল সউদী সময় ভোর ৫টায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় সকাল ৮-টায়। ঢাকায় এসে নামলাম বেলা ২-টার দিকে। বিমানবন্দরে মুস্তাফীযুর রহমান সোহেল, হুমায়ূন কবীর, রবীউল ইসলাম, এনামুল্লাহ প্রমুখ সংগঠনের ভাইয়েরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের সহযোগিতায় রাত ৯টার কোচে রওয়ানা হয়ে ১৪ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভোরে রাজশাহী পৌঁছলাম। এভাবেই শেষ হ’ল প্রায় মাসাধিককালের স্মৃতিময় হজ্জ সফর। ফালিল্লাহিল হাম্দ। আল্লাহ আমাদের সকলের হজ্জ কবুল করুন- আমীন!