হাদীছ অনুসরণে পরবর্তী মুসলিম বিদ্বানদের সীমাবদ্ধতা ও তার মৌলিক কারণসমূহ

ইমাম চতুষ্ঠয়ের পরবর্তী যুগেও অনেক বিদ্বানের মধ্যে হাদীছ গ্রহণে কখনও সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। এর বিবিধ কারণ রয়েছে। তবে প্রধানত ৩টি কারণ চিহ্নিত করা যায়।[1] যথা-

  • খবর ওয়াহিদ সম্পর্কে দুর্বল ধারণা :

মু‘তাযিলা সম্প্রদায়ের গৃহীত যুক্তিবাদী নীতিতে অনেক মুসলিম বিদ্বান প্রভাবিত হয়েছেন। তারা খবরে ওয়াহেদ হাদীছকে ‘যান্নী’ ধারণা করে আক্বীদার ক্ষেত্রে তা দলীলযোগ্য নয় মনে করেন। আধুনিক যুগের কিছু ইসলামপন্থী দাঈদেরকে পর্যন্ত এই নীতির প্রতিধ্বনি করতে শোনা যায় যে, খবরু ওয়াহিদ দ্বারা আক্বীদার দলীল গ্রহণ করা হারাম।

  • উছূলবিদদের গৃহীত মূলনীতিসমূহ অনুসরণ :

ফিক্বহী মাযহাবগুলি হাদীছ গ্রহণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিছদের নীতিমালা বহির্ভূত কিছু যুক্তিবাদী ক্বিয়াসী উছূল অবলম্বন করে থাকেন। এসকল যুক্তিভিত্তিক উছূলের কারণে তারা অনেক ক্ষেত্রে ছহীহ হাদীছ গ্রহণ করেননি। ফলে দেখা যায় যে, হানাফীগণ কোন হাদীছ সুপ্রসিদ্ধির কারণে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু শাফেঈগণ হাদীছটির সনদ যঈফ হওয়ায় গ্রহণ করেননি। আবার কোন হাদীছ মালিকীগণ মদীনায় প্রচলিত আমলের বিরোধী মনে করে পরিত্যাগ করেছেন, কিন্তু শাফেঈগণ হাদীছটির সনদ শক্তিশালী হওয়ায় গ্রহণ করেছেন। এভাবে এ সকল মূলনীতির আলোকে কখনও হাদীছ ছহীহ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করা হয়নি। আবার যঈফ সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করা হয়েছে। আবূ মানছূর আব্দুল কাহির আল-বাগদাদী (৪২৯হি.) উছূলগুলি তৈরীর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলেন,وهذه أصول مهدوها من أجل أخبار احتج بها أصحابنا عليهم في مواضع عجزوا عن دفعها، فردوها من هذه الوجوه، ‘উছূলগুলি তারা তৈরী করেছেন সে সকল হাদীছের জন্য, যা আমাদের মাযহাবপন্থীগণ (শাফেঈ) তাদের বিরুদ্ধে (হানাফী) দলীল হিসাবে উপস্থাপন করেন এবং তারা তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এ সকল উছূলের মাধ্যমে তারা হাদীছগুলি রদ করেন’।[2] শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (মৃ. ১২৩৯হি.) এ সকল উছূল বা মূলনীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ومن اللطائف التى قلما ظفر بها جدلى لحفظ مذهبه ما اخترعه المتأخرون لحفظ مذهب أبي حنيفة، وهي عدة قواعد يردون بها جميع ما يحتج بها عليهم من الأحاديث الصحيحة، ‘এমন একটি অদ্ভুত বিষয় যা আমার যুক্তিতে সহজে ধরে না, আর তা হ’ল ইমাম আবূ হানীফার মাযহাব রক্ষা করতে গিয়ে পরবর্তীগণ যা কিছু আবিষ্কার করেছেন, তা হ’ল অনেকগুলি কায়েদা বা মূলনীতি, যা দ্বারা তারা রদ করেছেন সেসব ছহীহ হাদীছকে, যা তাদের বিরুদ্ধে দলীল হিসাবে পেশ করা হয়।’[3]

  • তাকবলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা :

এটিই সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে অনুমান করা যায়। মুসলিম বিদ্বানদের কেউ কেউ তাদের ইমাম কিংবা মাযহাবকেই হাদীছ অনুসরণের প্রধান মানদন্ডে পরিণত করেন। হানাফী বিদ্বান আবুল হাসান আল-কারখী (৩৪০হি.) এতদূর পর্যন্ত বলেন যে, كل اية تخالف اصحابنا فهي مؤولة أو منسوخة، وكل حديث كذلك فهو مؤول أو منسوخ، ‘প্রতিটি আয়াত যা আমাদের মাযহাবের পূর্বসূরীদের গৃহীত নীতির বিরোধী তা হয় ব্যাখ্যাকৃত হবে অথবা মানসূখ গণ্য হবে। আর প্রতিটি হাদীছ যা এরূপ হবে, তা-ও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ কিংবা মানসূখ গণ্য হবে’।[4] দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর পর থেকে যখন মুসলিম সমাজে বিশেষ একজন ইমামের অনুসরণের প্রবণতা দানা বাঁধতে শুরু করে তখন একেকজন ইমামের অনেক অনুসারী সৃষ্টি হয়। তারা স্বীয় ইমামদের সুন্নাহ অনুসরণে গৃহীত নীতির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে তাদের বিরোধীদের গৃহীত যে কোন হাদীছ যা ছহীহ সনদে প্রমাণিত হয়েছে, তার বিরুদ্ধাচরণ করা শুরু করেন। ফলে তারা নিজেদের অনুসৃত ইমামগণ যে সকল হাদীছ গ্রহণ করেননি তা যে কোন মূল্যে দুর্বল প্রমাণে সচেষ্ট হন। যখন সনদে দুর্বলতা পাননি, তখন তারা মু‘তাযিলা মতবাদপুষ্ট বিভিন্ন যুক্তিভিত্তিক মূলনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে হাদীছটি রদ করার চেষ্টায় লিপ্ত হন।[5] এভাবে তারা বহু হাদীছ পরিত্যাগ করেছেন কিংবা দূরবর্তী ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।[6] এমনকি কেউ কেউ হাদীছের শব্দ পরিবর্তনেরও দুঃসাহস দেখিয়েছেন।[7] 

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (মৃ. ১১৭৬হি.) চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পরবর্তী সময়ের এই দুঃখজনক চিত্রটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ‘এর পর সময় যত গড়াতে লাগল ফিৎনা তত বৃদ্ধি পেতে লাগল, তাক্বলীদ পরিপুষ্টতা পেতে লাগল, মানুষের অন্তর থেকে আমানতদারিতা একেবারেই উঠে যেতে লাগল, এমনকি দ্বীনের বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনাই বন্ধ হয়ে গেল এবং তারা বলতে লাগল, إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ، ‘আমরা তো আমাদের পূর্বসূরীদেরকে এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি’।[8] তিনি ইয্য ইবনে আব্দুস সালাম (৬৬০হি.)-এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন, فإن أحدهم يتبع إمامه مع بعد مذهبه عن الأدلة مقلدا له فيما قال كأنه نبيا أرسل، وهذا نأي عن الحق، وبعد عن الصواب لا يرضى به أحد من أولى الألباب ‘মুক্বাল্লিদগণ তাদের ইমামের মাযহাবে দলীল না থাকা সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্য এমন অন্ধভাবে অনুসরণ করতে লাগল যেন তিনি একজন প্রেরিত রাসূল। এটি সত্য এবং সঠিক কর্মপন্থা থেকে অনেক দূরে। কোন বিজ্ঞজন এমন নীতির প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না’।[9]

তিনি আরও বলেন,ومن العجب العجيب أن الفقهاء المقلدين يقف أحدهم على ضعف مأخذ إمامه بحيث لا يجد لضعفه مدفعا، وهو مع ذلك يقلده فيه، ويترك من شهد الكتاب والسنة والأقيسة الصحيحة لمذهبهم جمودا على تقليد إمامه، بل يتخيل لدفع ظاهر الكتاب والسنة، ويتأولها بالتأويلات البعيدة الباطلة نضالا عن مقلده. ‘অতীব আশ্চর্যের বিষয় হ’ল মুক্বাল্লিদ ফক্বীহগণ কখনও তাদের ইমামের গৃহীত মতের পক্ষে দুর্বল দলীল দেখতে পান এবং সে দুর্বলতা কাটানোর কোন উপায় খুঁজে পান না; অথচ তা সত্ত্বেও তিনি সেই মতের অন্ধানুসরণ করেন এবং অন্ধানুসরণের ওপর অটল থাকতে গিয়ে সে সকল মত বর্জন করেন, যার সপক্ষে কুরআন, সুন্নাহ এবং সঠিক ক্বিয়াস বিদ্যমান। বরং তিনি কিতাব ও সুন্নাহের প্রকাশ্য অর্থ রদ করার উপায় খুঁজতে থাকেন এবং অন্ধানুসরণের পক্ষে টিকে থাকার সংগ্রামে ভ্রান্ত দূরবর্তী ব্যাখ্যার সাহায্যে তার তা’ভীল করেন’।[10] 

অথচ প্রত্যেক ইমামই তাঁদের তাক্বলীদ করতে পরিষ্কারভাবে নিষেধ করে গেছেন। ইমামদের শিষ্যগণও এই নীতি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। ফলশ্রুতিতে ইমাম আবূ ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদের মত অতীব ঘনিষ্ঠ শিষ্যও তাঁদের ওস্তাদ ইমাম আবূ হানীফার দুই-তৃতীয়াংশ মাসআলায় দ্বিমত পোষণ করেছেন। অনুরূপভাবে দেখা যায়, শাফেঈ মুহাদ্দিছ ইমাম আল-বায়হাক্বী (৪৫৮হি.) এবং হানাফী মুহাদ্দিছ ইমাম আয-যায়লাঈ (৭৬২হি.) তাঁদের স্ব স্ব মাযহাবের দলীলসমূহ একত্রিত করলেও অগ্রাধিকার দিয়েছেন ছহীহ সনদভিত্তিক হাদীছকে এবং স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতা করেছেন।[11] তাদের এই বিরোধিতা কেবলমাত্র সুন্নাহ অনুসরণের নিমিত্তেই ছিল, অন্য কোন কারণে নয়। অথচ পরবর্তী যুগের বিদ্বানগণ এই নীতি পরিত্যাগ করে ঘোরতর তাক্বলীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হ’লেন এবং স্ব স্ব মাযহাব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে উছূল তৈরী করে বহু ছহীহ হাদীছ পরিত্যাগ করেছেন। আবার বিপরীতপক্ষে মাযহাবের স্বপক্ষে হওয়ায় বহু যঈফ হাদীছও তারা গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন, যা মুহাদ্দিছদের দৃষ্টিতে শরী‘আতের কোন দলীল হওয়ার যোগ্য নয়।[12] এভাবে মাযহাবই হয়ে যায় হাদীছ গ্রহণ বা পরিত্যাগের চূড়ান্ত মানদন্ড।

আব্দুল ওয়াহহাব আশ-শা‘রানী (৯৭৪হি.) বলেন, اعتقادنا واعتقاد كل منصف في أبي حنيفة أنه لو عاش حتى دونت أحاديث الشريعة وبعد رحيل الحفاظ في جمعها من البلاد والثغور وظفر بها لأخذ بها وترك كل قياس كان قاسه وكان القياس قل في مذهبه كما قل في مذهب غيره لكن لما كانت أدلة الشريعة متفرقة في عصره مع التابعين وتبع التابعين في المدائن والقرى كثر القياس في مذهبه بالنسبة إلى غيره من الأئمة ضرورة لعدم وجود النص في تلك المسائل التي قاس فيها، ‘আবূ হানীফার বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস এবং সকল নিরপেক্ষ মানুষের বিশ্বাস যে, তিনি যদি শরী‘আতের হাদীছগুলো সংকলিত এবং গ্রন্থাবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত এবং মুহাদ্দিছগণ দেশ-বিদেশের দূর-দূরান্ত থেকে হাদীছ জমা করা পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি তা সাদরে গ্রহণ করতেন ও যেসব ক্বিয়াস তিনি করেছেন, সব ছেড়ে দিতেন। তাঁর মাযহাবে অন্য মাযহাবের মতই ক্বিয়াস কম হ’ত। কিন্তু যেহেতু তার যুগে শরী‘আতের দলীলসমূহ বিভিন্ন শহর ও গ্রামে বসবাসরত তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের নিকট বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, সেহেতু তার মাযহাবে অন্য মাযহাবের তুলনায় ক্বিয়াস বেশী হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মাসআলাসমূহে কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য না পাওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে ক্বিয়াস করতে হয়েছে।’[13] তিনি আরও বলেন, ويحتمل أن الذي أضاف إلى الإمام أبي حنيفة أنه يقدم القياس على النص ظفر بذلك في كلام مقلديه الذين يلزمون العمل بما وجدوه عن إمامهم من القياس ويتركون الحديث الذي صح بعد موت الإمام فالإمام معذور وأتباعه غير معذورين، ‘সম্ভবত যিনি ইমাম আবূ হানীফার দিকে একথা সম্বন্ধিত করেছেন যে, তিনি ক্বিয়াসকে হাদীছের ওপর স্থান দিতেন; তিনি ইমামের মুক্বাল্লিদদের নিকট থেকে কথাটি পেয়েছেন। তারা তাদের ইমামের নিকট থেকে প্রাপ্ত ক্বিয়াসী ফৎওয়াসমূহের ওপর আমল করাকে নিজেদের জন্য আবশ্যিক করে নিয়েছিলেন এবং পরিত্যাগ করেছিলেন সে সকল হাদীছ, যা ইমামের মৃত্যুর পর ছহীহ সূত্রে পাওয়া গিয়েছিল। সুতরাং ইমাম দায়মুক্ত কিন্তু তাঁর অনুসারীগণ দায়মুক্ত নন’।[14]

সমকালীন বিদ্বান ড. মুহাম্মাদ আবূ যাহূ যথার্থই বলেছেন, ‘ইমামদের পুনঃপুনঃ তাক্বলীদ পরিত্যাগের এ সকল উপদেশ থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেক মুক্বাল্লিদ আলেমদেরকে দেখি যে, তারা যখন কোন হাদীছ স্বীয় মাযহাবের বিরোধী পান এবং তার পক্ষে কোন উপযুক্ত জবাব খুঁজে পান না, তখনও স্বীয় মাযহাবী মতের উপরই অটল থাকেন এবং হাদীছের উপর আমলের ব্যাপারে অবহেলা করেন। কখনও দূরবর্তী ব্যাখ্যার দরজা খুলে দেন। কখনও স্বীয় ইমামদের গৃহীত মাযহাবকে অগ্রাধিকার প্রদানের উপায় খোঁজেন। যদি তাতেও ব্যর্থ হন, তবে কোন দলীল ছাড়াই কিংবা কোন বিশেষত্ব আছে বা এর ওপর আমল নেই ইত্যাদি কথা বলে হাদীছটি মানসূখ হওয়ার দাবী করেন। এতেও ব্যর্থ হ’লে বলেন, তাদের ইমাম সমস্ত হাদীছ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। অতএব এই হাদীছ তিনি পরিত্যাগ করেছেন এজন্যই যে তাতে নিশ্চয়ই কোন ত্রুটি রয়েছে। কখনও তারা বলেন, হাদীছ অনেক বড় বিষয়। আমাদের মত ব্যক্তি তা বুঝব কিভাবে আর কেমন করে তার ওপর আমল করব? অথচ তারা জানেন না যে, হাদীছকে সম্মান করার অর্থ তার ওপর আমল করা। আর পরিত্যাগ করার অর্থ তাকে অবজ্ঞা করা। হাদীছকে যথাযথভাবে বুঝতে পারলেই তার ওপর আমল অপরিহার্য হয়ে যায়। নতুবা ইমাম এবং মুজতাহিদদের ছাড়া আর কারো উপর আল্লাহর কোন হুকুম আরোপিত হ’ত না’।[15] 

শেষকথা :

কোন খবরু ওয়াহিদ ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত হওয়ার পরও পরবর্তী যুগের কিছু মুতাকাল্লিম এবং উছূলবিদ তার আমলযোগ্য হওয়ার শর্ত হিসাবে অতিরিক্ত যে সকল যুক্তিভিত্তিক ক্বিয়াসী মূলনীতি তৈরী করেছেন, তা মুহাদ্দিছ এবং জুমহূর ফক্বীহ বিদ্বানদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। সুন্নাহের যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করতে হ’লে এই সকল যুক্তিভিত্তিক মূলনীতির অপপ্রয়োগ বর্জনীয়। কেননা অনুসরণীয় চার ইমামসহ মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ বিদ্বানগণ সকলেই রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর একচ্ছত্র মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত ও রায়ের ওপর নিঃশর্তভাবে হাদীছকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবুও কখনও হাদীছ তাঁদের নিকট না পৌঁছা কিংবা পৌঁছার পরও স্বীয় ইজতিহাদ মোতাবেক হাদীছটি ছহীহ প্রমাণিত না হওয়ার কারণে কিছু ক্ষেত্রে তারা ছহীহ হাদীছের বিপরীত ফৎওয়া প্রদান করেছেন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের অন্ধানুসরণ করতে নিষেধ করেছেন এবং অনুসারীদেরকে কুরআন ও সুন্নাহের অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাদের সকলেরই একই বক্তব্য ছিল যে, ‘যখন কোন হাদীছ ছহীহ হবে, জেনে রেখ সেটাই আমার মাযহাব’। সুতরাং হাদীছের বিপরীত ফৎওয়ার কারণে তারা হাদীছ পরিত্যাগের দোষে দুষ্ট নন; বরং সেটি কেবল ইজতিহাদী ভুল হিসাবে গণ্য হবে। 

কিন্তু পরবর্তী যুগের মাযহাবী বিদ্বানদের মধ্যে ছহীহ হাদীছ গ্রহণে যথেষ্ট শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল খবরু ওয়াহিদ হাদীছের প্রতি দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বীয় মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ। এই কারণে তারা বহু ক্ষেত্রে ছহীহ হাদীছ জানা সত্ত্বেও আমল করেননি, যা অতীব দুঃখজনক। অথচ প্রাথমিক যুগ থেকেই মুহাদ্দিছগণসহ যে সকল বিদ্বান নিরপেক্ষভাবে শরী‘আত গবেষণা করেছেন তারা সকলেই শর্তহীনভাবে ছহীহ হাদীছকে অকুণ্ঠভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং দ্বিধাহীনচিত্তে তার ওপর আমল করে এসেছেন। তাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য ঘটেছে তা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহকে অনুধাবনের বিভিন্নতা ও জ্ঞানগত তারতম্যের কারণে। কিন্তু মৌলিকভাবে কখনই তারা ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত কোন সুন্নাহকে অগ্রাহ্য করেননি।


[1]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, আল-হাদীছু হুজ্জাতুন বিনাফসিহি, পৃ. ৩৯-৪০।

[2]. আয-যারকাশী, আল-বাহরুল মুহীত্ব ফী উছূলিল ফিকহ, ৬/২৬০।

[3]. ড. সাইয়িদ ইবনু হুসাইন আল-আফ্ফানী, যাহরুল বাসাত্বীন মিন মাওয়াকিফিল উলামা ওয়ার রববানিইয়ীন (কায়রো : দারুল আফ্ফানী, তাবি), ২/১৭৫।

[4]. আবূ যায়েদ আদ-দাবূসী, তা’সীসুন নাযার ও আবুল হাসান আল-কারখী, রিসালাহ ফিল উছূল (একত্রে প্রকাশিত) (বৈরূত : দারু ইবনু যায়দূন, তাবি), পৃ. ১৬৯-১৭০; খাযারী বেক, তারীখুত তাশরী‘ আল-ইসলামী, পৃ. ২১৯।

[5]. তারীখুত তাশরী‘ আল-ইসলামী, পৃ. ১৩২; আবূ যাহূ, আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন, পৃ. ২৮৩।

[6]. ছালাহুদ্দীন মাক্ববূল আহমাদ, যাওয়াবি‘ ফী ওয়াজহিস সুন্নাহ, পৃ. ৩৫৭-৩৮২।

[7]. ছালাহুদ্দীন মাক্ববূল আহমাদ এরূপ কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। দ্র. তদেব, পৃ. ৩০৯-৩৪০।

[8]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/২৬৩।

[9]. তদেব, ১/২৬৪।

[10]. তদেব, ১/২৬৪।

[11]. আশ-শা‘রানী, আল-মীযান, ১/১৬১-১৬২।

[12]. সাঈদ মা‘শাশাহ, আল-মুকাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাহ আল-আরবা‘আহ, পৃ. ৭৯।

[13]. আশ-শা‘রানী, আল-মীযান, ১/২২৭-২২৮।

[14]. তদেব, ১/২২৮।

[15]. আবূ যাহূ, আল-হাদীছু ওয়াল মুহাদ্দিছূন, পৃ. ৩৩।






সাকীনাহ : প্রশান্তি লাভের পবিত্র অনুভূতি (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মাসিক আত-তাহরীক : ফেলে আসা দিনগুলি - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানবাধিকার ও ইসলাম (১১তম কিস্তি) - শামসুল আলম
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
পুলছিরাত : আখেরাতের এক ভীতিকর মনযিল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৪র্থ কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
সমাজ সংস্কারে তাবলীগী ইজতেমা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
কুরআন মাজীদের অনুবাদ ও তাফসীরে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আলেমগণের অগ্রণী ভূমিকা - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.