পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯। পর্ব ১০। পর্ব ১১। পর্ব ১২। পর্ব ১৩। পর্ব ১৪। পর্ব ১৫। পর্ব ১৬।
দাসপ্রথা নিষিদ্ধতা প্রসঙ্গ :
জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ : Article-4
No shall be held in slavery of servitude, slavery and the slave trade shall be prohibited in all their forms.[1] ‘কোন ব্যক্তিকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখা যাবে না। সকল প্রকার দাস প্রথা এবং দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে’।
এখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ৪নং ধারায় দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এতে অমানবিকতা রয়েছে। পাশ্চাত্যপন্থীদের মতে এই প্রথাতে দাস-দাসীদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে। তাদের সামাজিক মর্যাদা দেয়া হয়নি। এক সময় এটা চালু থাকলেও আধুনিক সভ্য যুগে এ প্রথাকে মেনে নেয়া যায় না। এটা অবশ্যই রহিত হওয়া উচিত। তারা আরও বলেন, ইসলাম শাশ্বত ও সর্বজনীন ধর্ম। এতে অমানবিক সকল বিষয় নিষিদ্ধ করা হ’ল, অথচ এই ঘৃণ্য প্রথাকে কেন নিষিদ্ধ করা হ’ল না? তারা বলেন, আসলে ইসলাম মুসলিম রাজা-বাদশাহ ও জনগণের ভোগ-বিলাস এবং আরাম-আয়েশের জন্য এ ব্যবস্থা রেখে দিয়েছে। আরব জাহানে রাজা-বাদশাহরা এই সুযোগে বহু দাস-দাসীর নামে নারীদেরকে ব্যবহার করে থাকে। এভাবে অর্থে এই প্রথা নিয়ে হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদীসহ সকল বিধর্মী পন্ডিত মারাত্মকভাবে কুরআনকে কটাক্ষ করেছে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষী পন্ডিতগণ ও কথিত মুসলিম প্রগতিবাদীরা এই সুযোগকে হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে জন. জে. পোল, মুইর ও খৃষ্টান পাদ্রী টি.পি-হিউজ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে জন.জে পোল লিখেছেন, ইসলামী রাজ্য সমূহের দাম তত নয়, যত আছে দাস-দাসীর। মুসলমানদের শহরে-নগরে যে দাস প্রথার যথেষ্ট রেওয়াজ রয়েছে, এর কারণ কুরআনই এর অনুমতি দিয়েছে যে যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে দাসী বানিয়ে রাখবে এবং তাদের সাথে যৌন সংগম করবে। একজন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে বিপুল সংখ্যক দাসী রাখার অনুমতি মুসলমানদের জন্য পাপের নয়; বরং দাসদের গলায় এমন শৃংখল জড়িয়ে দিয়েছে যে, তা গোলামীর রেওয়াজকে ইসলামী রাজ্য সমূহে একটি পসন্দনীয় কাজ বানিয়ে দিয়েছে (স্টাডিজ ইন মুহাম্মাডেনিজম)।
ঐতিহাসিক মুইর স্বীয় Life of Mahomet নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মুসলমান মনিবদের প্রতাপ ও আধিপত্যের অধীন দাসীদের জীবন সম্পর্কে বলা যায় যে, মানবতার অপমান ও লাঞ্ছনার এতদপেক্ষা ভয়াবহ ও বিভৎস রূপ আর কিছুই কল্পনা করা যেতে পারে না। দাসীদের সাথে মানব সমাজের এক ঘৃণ্য জীবের ন্যায় ব্যবহার করা হয়। তারা বিবাহের যোগ্যা হ’লেতোদেরকে বিবাহের অধিকার হ’তে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করা হয় এবং দাসরা হয় সম্পূর্ণরূপে মনিবের মুষ্টিবদ্ধ। তিনি অন্যত্র লিখেছেন, ‘নারীদের দাসত্ব তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতির জন্য এক যরূরী শর্ত। এজন্য মুসলমানগণ কখনও আন্তরিকতা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ বিষয়টিকে নির্মূল করতে চেষ্টা করবে না’।[2]
টি.পি.হিউজ বলেছেন, ‘দাস প্রথার শিক্ষা ইসলামের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু খৃষ্টান ধর্মে দাসত্বের প্রতি রয়েছে তীব্র ঘৃণা। মুহাম্মাদ (ছাঃ) আরব জাহিলিয়াতের দাস প্রথায় কিছুটা সংশোধন এনেছিলেন সন্দেহ নেই; কিন্তু এতেও সন্দেহ নেই যে, আরবের এই শরী‘আত প্রদাতার ইচ্ছা ছিল দাস প্রথাকে স্থায়ীভাবে কায়েম রাখা।[3]
খৃষ্টান লেখকগণ বড় নির্লজ্জভাবে বলে বেড়ায় যে, দাস প্রথা চালু থাকার কারণে মুসলমানেরা দেশ-বিদেশের সুন্দরী-রূপসী ও যুবতী মেয়েদের সম্ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিল। এই কারণে তারা সবসময় দাস প্রথাকে চালু রেখেছে। কেবল চালু রেখেই ক্ষান্ত হয়নি, খুব জোরালোভাবে এর সমর্থন ও উন্নতি সাধন করেছে। জন জে. পোল আরও লিখেছেন, যেসব কারণে মুসলমানরা দাস প্রথাকে চালু রাখতে বাধ্য হয়েছে, সেটা যে কতদূর শক্তিশালী তা আমরা এখন ধারণা করতে পারি। একে খতম করার অর্থ এই হ’তে পারে যে, এর ফলে মুসলমানদের যে হেরেম সজ্জিত করার প্রথা দৃঢ়মূল হয়েছিল তা-ই খতম করে দেয়া হবে।[4]
এসব উক্তি থেকে বুঝা যায় যে, খৃষ্টান ও অন্যান্য প্রগতিশীল পন্ডিতগণ এই দাস প্রথাকে অস্ত্র হিসাবে ইসলাম ও মুসলমানকে কিভাবে খাটো করেছে। স্বাভাবিকভাবে যেকোন মানুষের এসব উক্তি শুনলে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা জন্মাতে পারে এবং সে চরম বিদ্বেষীও হ’তে পারে। আর বর্তমানে নানাভাবে তা হচ্ছেও বটে। বিষয়টি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ; সেহেতু ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার।-
দাস প্রথা কি? দাস শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। ইংরেজীতে একে Slave বলে। এই দাসদের নিয়ে সমাজে বিদ্যমান প্রথাকে দাস প্রথা বলে। এই প্রথা বহুকাল থেকে চালু ছিল। ‘ধর্ম ও নৈতিকতার বিশ্বকোষে’ দাস প্রথার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে- এটি একটি সামাজিক রেওয়াজ, এর দরুন এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির মালিকানাধীন হয়ে যায়। The world wide Encyclopedia-তে লেখা হয়েছে, Slavery, the status one who is the property of another. ‘কোন ব্যক্তির অন্যের সম্পত্তিতে পরিণত হওয়ার অবস্থাকে দাসত্ব বলা হয়’। ওয়েস্টার মার্ক (Wester mark) দাসত্বের সংজ্ঞায় বলেন, গোলামের মালিকানায় মালিকের অধিকার যদিও অনিবার্য ও নিরংকুশ নয়, তবুও এটা একটি বিশেষ রকম পদ্ধতি। অন্য কথায়, এই মালিকানা অধিকার এমন একটি অধিকার যে, কেবল মাত্র মনিবই এর থেকে হাত তুলে নিতে পারে, পরিত্যাগ করতে পারে। কিন্তু একে নিরংকুশ মালিকানা বলা যায় না। কেননা আইন গোলামকেও এক রকম অধিকার দান করেছে।[5]
মোটকথা দাস প্রথা হ’ল এমন একটি সামাজিক চিরাচরিত ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় একজন মানুষ অন্য কোন মানুষের অধীনে চুক্তি অনুযায়ী তার বশ্যতা স্বীকার করতঃ নিজের সার্বিক স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে মানুষের অধীনে এক প্রকার গৃহবন্দী হয়ে জীবন পরিচালনা করে।
এই প্রথা আজও বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-গোত্রে কম-বেশী প্রচলিত। এই প্রথা নিয়ে বিশ্বে আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিতর্কের কমতি নেই। ইসলাম এই দাসপ্রথাকে সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ না করলেও এই প্রথাকে একটা অবমানাকর প্রথা হিসাবে গণ্য করেছে। তবুও একে কেন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেনি সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে।
দাসত্বের শ্রেণীভেদ :
দাস সাধারণতঃ দুই প্রকার। এক. জন্মগতভাবে দাস। যারা বহু পূর্বে দাস ছিল, বংশপরম্পরায় তারাই দাস হয়ে এখনও পৃথিবীতে বসবাস করছে। এ ধরনের দাস ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে।
দুই. যুদ্ধবন্দী অথবা অন্য কোন কারণে বন্দী হয়ে দাসত্ব বরণ করা। বর্তমানে এ প্রকারের দাসই বেশী পরিলক্ষিত। এ প্রকার দাসও ক্রয়-বিক্রয় হয়। তবে মুক্তিপন দিয়ে তাদের মুক্তির ব্যবস্থাও রয়েছে।
মাওলানা আব্দুর রহীম তাঁর ‘দাস প্রথা ও ইসলাম’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘নীতিগত দাসত্ব দুই প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথমটি এক গোত্রের কিছু লোক সেই গোত্রের কিছু লোককে নিজের গোলাম বানিয়ে নেয়। আর দ্বিতীয়টি এক গোত্রের কিছু লোক অপর এক গোত্রের কিছু লোক বা সমস্ত লোককেই নিজেদের গোলাম বানিয়ে নেয়। প্রথম প্রকারকে ইংরেজীতে বলা হয়, Inta-tribal slavery এবং দ্বিতীয় প্রকারকে বলা হয়, Extra-tribal slavery. এখানে দ্বিতীয় প্রকারের দাস প্রথা হ’ল যুদ্ধবন্দী। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন বা মারামারির সময়ে এই প্রকারের দাসের জন্ম হয়। কারণ পক্ষদ্বয়ের যুদ্ধ শেষে বিজিত দল পরাজিত দলের লোকদেরকে হত্যা-নির্যাতন করতে পারে অথবা যুদ্ধবন্দী করতে পারে। তাই হত্যা না করে তাদেরকে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের অধীনে দাস (গনীমতের মাল) হিসাবে রাখা হয়।
দাস প্রথা চালু হওয়ার কারণ :
মানুষ সাধারণতঃ একে অপরের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উঁচু শ্রেণীর মানুষ দরিদ্র ও নীচু শ্রেণীর মানুষগুলোকে অধীনস্ত রাখতে চায়। এর সাথে সে বিস্তীর্ণ এলাকা নিজের কর্তৃত্বে রাখতে চায়। আর ঐ মানুষগুলোকে উক্ত মনিব কর্তৃক নানাভাবে ব্যবহারের চিন্তা উদয় হওয়া থেকে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। হয়তো এভাবে এক পর্যায়ে নানা প্রয়োজনে ও বাস্তবতার কারণে দাসত্বের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে মিঃ এ.এন গুলবার্টসন লিখেছেন যে, উত্তর আমেরিকাস্থ ভারতীয়দের মধ্যে একটা রেওয়াজ ছিল যাকে Adoption (এডাপশান) বলা হয়। এতে যুদ্ধ শেষে বিজিত পক্ষের পুরুষদেরকে হত্যা করা হ’ত এবং শিশু ও নারীদেরকে জীবিত রেখে নিজেদের ঘরে রেখে দেয়া হ’ত। এই লেখকই বলেছেন যে, দাসপ্রথা এই প্রথারই একটি উন্নত রূপ, যাতে শিশু ও নারীদের ন্যায় পুরুষদেরকেও জীবিত থাকতে দেয়া হ’ত এবং তাদেরকে গোলাম বানানো হ’ত। এ প্রসঙ্গে মনস্তাত্বিক কারণের দিকে ইঙ্গিত করে Nieboer সুন্দর কথা বলেছেন, ‘পশু পালন মানুষের একটি স্বভাব। এই স্বভাবই ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়ে মানুষকে পালবার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং একেই বলা হয় গোলামী বা দাস প্রথা (Excyclopedia of religion and ethics)।
অতীতে সমাজে পাশবিকতা ও বর্বরতা বিদ্যমান ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ সব সময় লেগে থাকতো। তখন যুদ্ধবন্দীদেরকে হত্যা করা হ’ত। এভাবে সমাজে কর্মক্ষম মানুষের শূন্যতা দেখা দেয়। ফলে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসত্বে রেখে বিভিন্ন কার্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এ প্রসঙ্গে হার্বাট স্পেন্সার বলেন, ‘একথা খুব সমর্থনযোগ্য যে, একপক্ষ যখন আধিপত্য ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিরোধী পক্ষকে হজম করার পরিবর্তে নিজেদের গোলাম বানিয়ে নেয়, তখন তাদেরকে জীবিত রাখাই উন্নতির দিকের পদক্ষেপ। দাস প্রথা যতই খারাপ হোক না কেন তা আপেক্ষিকভাবে ভাল। আর কোন কোন সময় সাময়িকভাবে এটাই হয় একমাত্র কর্ম উপযোগী পথ বা পন্থা (Study of soiology)।
লর্ড একটিন বলেছেন, ‘অনেক সময় এমন অবস্থা হয়, যখন সেই অবস্থা দৃষ্টে একথা বলা মোটেই অসমীচীন হয় না যে, গোলামী মূলত আযাদী মঞ্জিলের এক পর্যায়’।[6] এ প্রসঙ্গে মিঃ আর. এইচ. বারোর একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তার ‘রোমান সাম্রাজ্যে দাস প্রথা’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘গোলামী এমন একটি শব্দ যা শুনতেই খারাপ লাগে। এই শব্দ কানে প্রবেশ করা মানেই লৌহশৃংখলের ঝংকার, চাবুকের শপাং শপাং ধ্বনি এবং মযলূম গোলামদের মর্মবিদারী চিৎকার কর্ণকুহরে ধ্বনিত হ’তে শুরু করে। গোলামীকে সাধারণতঃ খারাপভাবে দেখা হয়। কিন্তু গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করলে এতে কোন সন্দেহ থাকে না যে, গোলাম খুব বেশী কিছু মহান আর পবিত্র না হ’লেও সভ্যতার অগ্রগতি ও উৎকর্ষ সাধনে তাদেরও যথেষ্ট অংশ রয়েছে। তবুও গোলামী রেওয়াজ বন্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু পুরাকালের দাস প্রথাকে সর্বোতভাবে খারাপ বলা এবং একে চূড়ান্ত ঘৃণিত মনে করা আমাদের উচিত নয়।
হার্বাট স্পেন্সার তাঁর 'The principal of sociology' গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দাস প্রথা ব্যতীত রাষ্ট্রনীতি পূর্ণতা লাভ করতে পারে না’।
তাহ’লে বুঝা যায়, দাস প্রথা চালু হওয়ার পিছনে সুদূর অতীতে কিছু জন্মগত বা বংশ-গোত্রীয় প্রভাব এবং বাস্তব প্রয়োজনীয়তা কাজ করেছিল। এর প্রচলনের আর একটি অন্যতম করণ হ’ল যুদ্ধবন্দী। সম্ভবতঃ পৃথিবীতে যখন থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয়েছে তখন থেকেই যুদ্ধবন্দী তথা দাসপ্রথা চালু হয়েছে। যার বাস্তব প্রমাণ এখনও দেখা দেখা যাচ্ছে। তবে বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম ও রাষ্ট্রে যুদ্ধবন্দীদের সাথে যে অমানবিক ও বর্বর আচরণ করা হচ্ছে ইসলাম তা কখনও স্বীকৃতি দেয়নি ও সমর্থন করেনি। বরং যুদ্ধবন্দী তথা দাস-দাসীদের ব্যবস্থাকে এক রকম মানবিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, যা বিশ্বের সকলের কাছে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দাস প্রথার ইতিহাস : দাসপ্রথার ইতিহাস বহু প্রাচীন। যা পৃথিবীর সকল জাতি, রাষ্ট্র ও ধর্মে স্বীকৃত ছিল। এ প্রথাকে কখনও ভাল কাজে, কখনও বা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মানবেতিহাসের প্রথম যুগ থেকে এই দাস প্রথা চালু ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন- The world wide Encyclopedia গ্রন্থে বলা হয়েছে, Slavery has Existed from the Earliest times in verying degres অর্থাৎ প্রাচীনতম যুগ হ’তেই দাস প্রথা বিভিন্ন রূপে ও মাত্রায় চালু হয়ে এসেছে।
প্রাচীন পারসিকরা বিপুল সংখ্যক দাস থাকাকে অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে মনে করত। এজন্য তারা বেশী বেশী দাস বা গোলাম রাখত। প্রাচীন গ্রীকে এই দাস ব্যবস্থাকে সেদেশের উন্নতি ও সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি বলে মনে করা হ’ত। এ মর্মে World wide Encyclopedia গ্রন্থে Slavery সম্পর্কে বলা হচ্ছে- It was the basis on which the ancient greece built up their civilization. অর্থাৎ দাস প্রথা ছিল প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার ভিত্তি এবং এরই উপর গ্রীক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন গ্রীক সমাজে দু’টি কারণে গোলামী ব্যবস্থা চালু ছিল। একটি যুদ্ধ ও অপরটি প্রয়োজন। উক্ত গ্রন্থের বর্ণনা মতে যুদ্ধবন্দী কিংবা অপহৃত ব্যক্তিরা দাস হয়ে থাকত। গ্রীক সমাজে দাসদের ঔরসজাত সন্তানও দাস হিসাবে বিক্রি হ’ত এবং দাসদের শিশু সন্তানও দাস হিসাবে গণ্য হ’ত।[7]
একইভাবে মিশরীয় সভ্যতায় দাসদেরকে খেদমত ও ভৃত্যের কাজে ব্যবহার করা হ’ত। প্রাচীন রোম সভ্যতায় দাসপ্রথা বিদ্যমান ছিল। সেখানে তাদের মানবীয় কোন মৌলিক অধিকার ছিল না। তাদেরকে জীবিত না মৃত রাখা হবে তা নির্ভর করত সম্পূর্ণ মনিবদের মর্জির উপর। প্রাচীন রাশিয়ার গ্রামীণ জনগণকে তিনভাগে ভাগ করা হ’ত। গোলাম, স্বাধীন কৃষি-মজুর ও কিষাণ। অষ্টাদশ শতকে এই তিন শ্রেণীর গোলামদের জন্য পৃথক একটি সংস্থা তৈরী করা হয়েছিল। ইউরোপীয় তথা পাশ্চাত্য জাতি সমূহের মধ্যে দাসপ্রথা চালু ছিল এবং তাদের উপর নানা রকম নির্মম ও অমানবিক আচরণ করা হ’ত। এ সম্পর্কে ‘ধর্ম নৈতিকতার বিশ্বকোষে’ লেখা হয়েছে- ১৪৪২ সালে গাঞ্জালেস (Ganzales) পর্তুগালের প্রিন্স হেনরীকে দশটি গোলাম উপঢৌকন স্বরূপ দিয়েছিলেন। এ সময় আফ্রিকার অধিবাসীদেরকেই বেশীর ভাগ গোলাম বানানো হ’ত। এজন্য ইউরোপীয়রা তাদের উপর হামলা করার নানা কৌশল রচনা করত। এ ব্যাপারে বর্ণিত আছে, ‘স্যার জন হকিং গাওনীয়া রওনা হয়ে গেলেন এবং তিনশত গোলাম ধরে তাদের বিক্রি করে ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন।[8] এসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রমাণ করে যে, ইউরোপীয় জাতিসমূহের ইতিহাস দাসপ্রথা ও দাসদের সাথে অমানুষিক ব্যবহার, অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন এবং দাস বিক্রির ব্যবসা করার কাহিনীতে ভরপুর।
বিভিন্ন ধর্মে দাস প্রথা : বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থে দাস প্রথার উল্লেখ রয়েছে। ইঞ্জীলে গোলামদের স্বাধীন করার কিংবা তাদের সাথে সদ্ব্যব্যবহার করার নির্দেশ কোথাও নেই। ইহুদী ধর্মে গোলাম পলানোর অনুমতি রয়েছে। এ ধর্মে একজন ইবরানী অপর ইবরানীকে যে কোনভাবে হোক গোলাম বানাতে পারে। ইহুদীরা গোলামের ব্যবসা করতে পারত। সংস্কৃত ভাষার সকল ধর্মে ও দাস প্রথার সমর্থন পাওয়া পাওয়া যায়। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ মনু শাস্ত্রে মানুষকে গোলাম বানাবার সাতটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ বুঝা গেল দাসপ্রথা শুধু ইসলাম ধর্মে নয়; বরং এর বহুপূর্ব থেকে সকল ধর্ম ও জাতি-গোত্রে প্রচলন ছিল। সকল মানুষ ও সচেতন পন্ডিতগণ এ প্রথাকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেছেন। যেমন- Encyclopedia of Religion and Ethics গ্রন্থে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটল গোলামী ব্যবস্থাকে স্থায়ী ও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয়, এরিষ্টটল মনে করতেন গ্রীকদের বাদ দিয়ে অন্য সব মানুষকে দাস বানানোর যোগ্য।
পবিত্র কুরআনে দাস ব্যবস্থার উল্লেখ :
আল-কুরআন একটি নির্ভুল গ্রন্থ, যাতে কেবল আল্লাহ পাকের বাণী রয়েছে। এ বাণী নির্ভুল; এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। মানব সমাজে কখনও কখনও দাসদের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, যে বিষয় অবশ্যই আল্লাহ অবগত। সে কারণে তিনি এটাকে একেবারে নির্মূল করেননি। এ গ্রন্থে কেবল দাসমুক্তির ফযীলতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কোথাও সুস্পষ্টভাবে এ ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রতি উৎসাহ ও নির্দেশ দেয়া হয়নি।
পৃথিবীটা বড় ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ স্থান। এখানে যেমন ভাল-মন্দ ও সুখ-দুঃখ বিদ্যমান, তেমনি রয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং হানা-হানিও। আর যতদিন বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকবে ততদিন এ গোলামী ব্যবস্থা থাকবে। আর এ ব্যবস্থা যুদ্ধের একটি অনিবার্য পরিণতির ফল ছাড়া কিছুই নয়। এ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আনফালে একাধিকবার আলোচনা এসেছে। এ সূরায় যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ ‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সংগত নয়’ (আনফাল ৬৭)। অনেকের মতে বদর যুদ্ধের সাথে এ আয়াত সম্পর্ক যুক্ত। এ যুদ্ধে যেসব কাফির বন্দী হয়েছিল তাদের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে কিছু বন্দীকে মূল্য নিয়ে আর কিছুকে মূল্য না নিয়ে ছেড়ে দেন। এটা তখনকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের উপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। সে কারণে এ ঘটনাটিতে আল্লাহ পাক অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّمَنْ فِيْ أَيْدِيْكُمْ مِّنَ الأَسْرَى إِنْ يَعْلَمِ اللهُ فِيْ قُلُوْبِكُمْ خَيْراً يُؤْتِكُمْ خَيْراً مِّمَّا أُخِذَ مِنْكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ‘হে নবী! আপনাদের হাতে যেসব যুদ্ধবন্দী রয়েছে, তাদেরকে বলুন যে, আল্লাহ যদি তোমাদের মধ্যে কল্যাণ দেখতে পান, তবে তোমাদের কাছ থেকে যা গ্রহণ করা হয়েছে, তদপেক্ষাও ভাল তোমাদেরকে দান করবেন। আর তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন’ (আনফাল ৭০)।
এ আয়াতটি বদর যুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এখানেও যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন বর্ণনা আসেনি। তবে নিম্নে বর্ণিত আয়াতে সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে, فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوْهُمْ فَشُدُّوْا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ‘তোমরা যখন কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর। পরিশেষে যখন তোমরা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করবে তখন তাদেরকে খুব শক্ত করে বেঁধে ফেলবে। অতঃপর হয় অনুগ্রহ করবে কিংবা মুক্তিপণ গ্রহণ করবে। যতক্ষণ না তারা যুদ্ধের অস্ত্র সংরবণ করবে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩)। এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, যুদ্ধবন্দীদের হয় বিনিময় মুল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে নতুবা না নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে আরো একটা বিষয় স্পষ্ট যে যুদ্ধবন্দী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শাসক তথা রাষ্ট্রপ্রধানকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রধান বন্দীদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করবে এবং তাদের কাছ থেকে শরী‘আত অনুযায়ী তা গ্রহণ করবে অথবা তাদেরকে হত্যা করবে, কিংবা গোলাম বানিয়ে নেবে, অথবা বিনিময় মূল্য নিয়ে বা না নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দিবে।
এ ব্যাপারে ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে তাঁর নবী ও মুমিন মুসলমানদের এখতিয়ার দিয়েছেন যে, হয় বন্দীদেরকে হত্যা করবে; নয় গোলাম বানিয়ে রাখবে। আর ভাল মনে করলে বিনিময় মূল্য নিয়ে ছেড়ে দেবে।৯
বাদায়েউছ ছানে‘ গ্রন্থকার আল-কাসানী বলেন, যুদ্ধ বন্দীদের সম্পর্কে রাষ্ট্র প্রধানের তিন প্রকারের মধ্যে যেকোন প্রকারের নীতি অবলম্বন করার এখতিয়ার রয়েছে।১০ মোদ্দাকথা হ’ল ইসলাম গোলাম বানানোর বিষয়টি পরিস্থিতি অনুযায়ী কেবলমাত্র অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু আদেশ দেয়নি। আর এটা কেবল যুদ্ধবন্দীদের ক্ষেত্রে, স্বাধীন মুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে নয়। তবে এটাও সত্য যে, ইসলাম এই প্রথাকে অনুমোদন করেছে বটে, কিন্তু দাস-দাসীদেরকে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদার স্থানে আসীন করেছে। [চলবে]
শামসুল আলম
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. Dr. Borhan Uddin Khan, Fifty years of the Universal Declaration of Human Rights, IDHRB, P. 200.
[2]. Willium Muir, Life of Mahomet. P. 347; মাওলানা আব্দুর রহীম, দাস প্রথা ও ইসলাম, (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৯), পৃঃ ৮।
[3].Note of Mohammadanism, (2nd edition), p. 195.
[4]. দাসপ্রথা ও ইসলাম, পৃঃ ৯।
[5]. তদেব, পৃঃ ১০।
[6]. Slavery in his Roman Empire p. 15.
[7]. Encyclopedia of Religion and ethics vol. 8.
[8]. দাসপ্রথা ও ইসলাম, পৃঃ ১৫।
৯. ফাৎহুল বারী ৯/৫।
১০. বাদায়েউছ ছানায়ে‘ ১৫/৩৫৮ পৃঃ।