পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯। পর্ব ১০। পর্ব ১১। পর্ব ১২। পর্ব ১৩। পর্ব ১৪। পর্ব ১৫। পর্ব ১৬

দাসপ্রথা নিষিদ্ধতা প্রসঙ্গ :

ইসলাম প্রদত্ত দাস-দাসীদের অধিকার :

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলাম দাস প্রথাকে চূড়ান্ত রূপে নিষিদ্ধ করেনি নানাবিধ যৌক্তিক কারণে। আর সে কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ব্যবস্থার ফলাফল মানব কল্যাণে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। প্রকৃতপক্ষে বাহ্যিক কিছু দিক খারাপ মনে হ’লেও ইসলামী জীবন বিধানে এ দাস ব্যবস্থাকে কেউ কখনও খারাপ বলতে পারেনি। প্রগতিবাদী ও পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ এ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ইসলামের মূল চেতনার ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা কখনও দাসব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলোকে সামনে আনেনি এবং আনার চেষ্টাও করেনি। আবার কোন কোন পন্ডিত এটাকে কিছুটা মেনে নেয়ার চেষ্টা করলেও তারা বলেছেন মানবতার ধর্ম ইসলাম বিশ্বের সকল মানুষের আশ্রয়স্থল হিসাবে স্বীকৃত, অথচ ইসলাম কেন মানুষের মধ্যে একটি গোষ্ঠীকে এত নিচু স্তরে রাখবে? কেন তাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে? কেন তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা নষ্ট করবে ইত্যাদি? প্রকৃত অর্থে ইসলাম কখনও চায়নি দাস ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে টিকিয়ে রাখতে। পক্ষান্তরে ইসলাম যতটুকু এ ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার বিপরীতে দাস-দাসীদেরকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী। একটা মানুষকে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য কয়েকটি মৌলিক অধিকার দরকার। যথা: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি। পাশ্চাত্য পন্ডিতদের মতে হয়তো এই অধিকারগুলো ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিধায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং একই কারণে মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য পন্ডিতগণ ইসলামের এই ব্যবস্থার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। সুতরাং আমরা প্রথমে সেদিকে অর্থাৎ দাস-দাসীদের ক্ষেত্রে কতটুকু মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করব-

১. খাদ্য-বস্ত্র ও বাসস্থানের অধিকার : ইসলাম দাস-দাসীদেরকে খাদ্য-বস্ত্র ও বাসস্থান প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছে। মহান আল্লাহ পাক দাস-দাসীদেরকে সকল দিকে পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন। রাসূল (ছাঃ) দাস-দাসীদের বিষয়ে বিদায় হজ্জের ভাষণে অত্যন্ত কঠোরভাবে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা দাস-দাসীদের উপর অত্যাচার কর না। তোমরা যা খাবে দাস-দাসীদেরকে তা খেতে দিবে, নিজেরা যা পরবে তাদেরকে তা পরতে দিবে’।[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এই ছোট অমিয় বাণীই বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত হ’ল সে যুগ থেকেই দাস-দাসীদের উপর এই নীতির যথাযথ প্রয়োগ। সেজন্য অনেক দাস-দাসী নিজের অভাব পূরণের নিমিত্তে ইচ্ছা করে মনিবদের নিকটে বন্দীদশাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। কোন মুসলিম শাসক বা সাধারণ মানুষ কোন দাস-দাসীদেরকে কষ্ট দিয়েছে এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি এবং পারবেও না। আর মনিবরা কখনও তাদেরকে খাওয়া-পরার কষ্ট দেয়নি। যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘খাদ্য ও পোষাক-পরিচ্ছদ দাস-দাসীদের প্রাপ্য এবং তাদের উপর এমন কাজের বোঝা চাপিয়ে দিবে না, যা তাদের সাধ্যের বাইরে’।[2]

এ সম্পর্কে আবূ যর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনে করে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যার (কোন ব্যক্তির) ভাইকে তার অধীনে করেছেন, সে যেন নিজে যা খায় তাকেও তাই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরে তাকেও তা পরায়। আর যে কাজ তাদের সাধ্যের বাইরে তাদেরকে যেন সে কাজের কষ্ট না দেয়। একান্ত যদি তার উপর সাধ্যাতীত কাজ অর্পণ করতে হয়, তবে যেন তাকে সাহায্য করে’।[3]

অন্য হাদীছে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর হ’তে বর্ণিত, একদা তার কর্ম তত্ত্বাবধায়ক তাঁর নিকট আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গোলামদেরকে তাদের খোরাকী সরবরাহ করেছ? সে বলল, না। তখন তিনি বললেন, তুমি এখনই যাও এবং তাদের খোরাকী দিয়ে দাও। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তির গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে ঐ ব্যক্তির খোরাকী আটক করে রাখে, যার খোরাকী তার যিম্মায় রয়েছে’। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘কোন ব্যক্তির গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, যার খাদ্য এই ব্যক্তির যিম্মায় রয়েছে, সে তা নষ্ট করে দেয়’।[4]

অন্য এক হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কারও খাদেম খানা তৈরী করে, অতঃপর সে উক্ত খানা তার মালিকের সম্মুখে উপস্থিত করে, অথচ সে আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার কষ্ট সহ্য করেছে, তবে যেন মালিক তাকে নিজের সাথে বসায় এবং নিজের সঙ্গেই খানা খাওয়ায়। কিন্তু খাদ্যের পরিমাণ যদি কম হয়, তাহ’লে অন্তত তা হ’তে এক/দুই গ্রাস খানা তার হাতে তুলে দেয়’।[5] এ হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু দাস-দাসী নয় অধীনস্ত চাকর-চাকরাণীদের প্রতিও নযর রাখার তাকীদ রয়েছে।

পক্ষান্তরে এর বিপরীত চিত্র অন্যান্য জাতি ও ধর্মে আমরা দেখতে পাই। যেমন রোমক সাম্রাজ্যবাদীরা দাস-দাসীদেরকে মাঠে মাঠে অমানবিক পরিশ্রম করাত। তাদের কোন অধিকার স্বীকার করা হ’ত না। মাঠে কঠিন কাজ করার সময় যাতে পালাতে না পারে, সেজন্য হাতে ও পায়ে লোহার শিকল ও বেড়ী লাগানো হ’ত। তাদেরকে পেট পুরে খেতে দিত না। কোন মতে বেঁচে থাকার মত খাবার দিত। তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতাটুকু যাতে টিকে থাকে সেজন্যই এ খাবারটুকু দিত। এ খাবার যে তার পাওনা এ কথা তারা ভাবত না কখনও। যদিও পশু-পাখী কিংবা গাছ-পালাকে যত্ন করাটা তাদের কর্তব্য বলে ভাবত। কাজের সময় কথায় কথায় দাসদের বেত্রাঘাত করে তারা সুখানুভব করত। কাজের শেষে তাদের অধিকাংশকেই ইঁদুর-পোকার নিবাস অাঁধার কুঠুরীতে শৃংখলে বাঁধা অবস্থায় শুতে দেওয়া হ’ত। গরু-ছাগলের থাকার জন্য যতটুকু খোলা ও প্রশস্ত জায়গা দেয়া হ’ত, দাসদের তাও দেয়া হ’ত না।[6] এভাবে ইতিহাসের পাতা ঘাটলে বহু অমানবিক চিত্র তুলে ধরা যাবে। পক্ষান্তরে ইসলাম দাস-দাসীদের খাদ্য-বস্ত্রের পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে মনিবদের নির্দেশ দিয়েছে।

২। শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার : ইসলামে মনিবদের অধীনে দাস-দাসীদেরকে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। একবার কাইসারীয়ার চার হাযার গোলাম বন্দী হয়ে এলে ওমর ফারূক (রাঃ) তাদের অনেককেই শিক্ষালয়ে লেখাপড়া করার জন্য ভর্তি করে দিয়েছিলেন।[7]

আববাস (রাঃ) তাঁর গোলাম ইকরামাকে কুরআন-হাদীছের শিক্ষা দান করেছিলেন। আবু আমের সালীম গ্রেফতার হয়ে মদীনায় নীত হ’লে তাকে লেখাপড়া শিক্ষার জন্য পাঠশালায় বসিয়ে দেয়া হয়। ওছমান (রাঃ)-এর গোলাম ইমরানকে ক্রয় করে লেখাপড়া শিক্ষার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। গোলামদের ন্যায় দাসীদেরকেও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করা হ’ত। এজন্য তাদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহ দেয়া হ’ত। রাসূল (ছাঃ) এজন্য নিজে ছাহাবীগণকে বিশেষ উপদেশ দিতেন। তিনি বলেন, ثَلاَثَةٌ يُؤْتَوْنَ أَجُورَهُمْ مَرَّتَيْنِ رَجُلٌ كَانَتْ لَهُ أَمَةٌ فَأَدَّبَهَا فَأَحْسَنَ تَأْدِيبَهَا وَعَلَّمَهَا فَأَحْسَنَ تَعْلِيمَهَا ثُمَّ أَعْتَقَهَا فَتَزَوَّجَهَا ‘তিন ব্যক্তি দু’টি বড় শুভ কর্মফল লাভ করবে। একজন সে, যে তার দাসীকে বিদ্যা শিক্ষা দিবে এবং খুব ভালভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলবে। তাকে খুব ভালভাবে আদব-কায়দা শিখাবে এবং পরে তাকে মুক্ত করে দিয়ে নিজে তাকে বিয়ে করবে’।[8]

মনিবরা দাস-দাসীদেরকে কখনও বিনা চিকিৎসায় থাকতে দেয়নি। রোগে আক্রান্ত হ’লেই তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষার ব্যবস্থা করত। কারণ মনিবরা মনে করত দাসদের কষ্ট দেয়া মানেই আল্লাহর অসন্তোষে পতিত হওয়া। তাই তারা এ ব্যাপারে অত্যধিক সজাগ থাকত। সুতরাং ইসলাম দাস-দাসীদের শুধু খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রতিও বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছে।

দাস-দাসীদের অন্যান্য অধিকার :

১. ক্ষমা প্রদর্শন : ইসলাম দাস-দাসীদের প্রতি অতি দয়া দেখিয়েছে। যা অন্য কোন ধর্মে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেখানে রোমকরা দাসদের পরস্পর যুদ্ধে অংশ নিতে বলত। এ মরণপন যুদ্ধে দাসরা একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তরবারি ও বল্লমের মারে প্রতিদ্বন্দ্বী দাসকে ক্ষতবিক্ষত করে চলত তারা। আর যুদ্ধ সাঙ্গ হ’ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিষমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে। মনিবরা সপরিষদ হাত তালি দিয়ে বিজয়ী দাসদের অভিনন্দন জানাত। খেলা দেখতে দেখতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত তারা। রোমান সম্রাটও এ ধরনের আনন্দ-উপভোগে অংশ নিত। আধুনিক ইউরোপীয়ান ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরাও ঐ একই নীতি অবলম্বন করে যাচ্ছে।[9]

ইসলাম দাস-দাসীদের প্রতি ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, একদিন একজন ছাহাবী জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমরা গোলামদের কতবার ক্ষমা করব? প্রথম ও দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসার কোন জবাব দিলেন না। তৃতীয়বারে তিনি বললেন, তাকে দৈনিক সত্তরবার ক্ষমা করবে।[10]

সালমান ফারসী ও ওছমান (রাঃ) তাঁদের গোলামদের উপর কোন কষ্টকর কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতেন না। ইসলামী শরী‘আতে গোলামদের শাস্তি অর্ধেক রাখা হয়েছে। যেমন মুক্ত-স্বাধীন মানুষের যে অপরাধের জন্য ৮০ দোররা মারার বিধান রয়েছে, সেখানে গোলামদের ৪০ দোররা মারা হবে। আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি আমার এক গোলামকে প্রহার করছিলাম, এমন সময় আমার পিছন দিক থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে আবূ মাসঊদ! নিশ্চয়ই তার উপরে আল্লাহ যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন তোমার উপর তার চাইতে অধিক ক্ষমতা দিয়েছেন। আমি ফিরে দেখি, রাসূল (ছাঃ) কথা বলছেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আল্লাহর ওয়াস্তে ওকে আযাদ করে দিলাম। তিনি বললেন, أَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ لَلَفَحَتْكَ النَّارُ أَوْ لَمَسَّتْكَ النَّارُ ‘যদি তুমি তাকে আযাদ না করতে, তবে জাহান্নাম তোমাকে অবশ্যই স্পর্শ করত’।[11]

২. সাক্ষ্য প্রদানের অধিকার :

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সুস্থ, বিবেক সম্পন্ন দাস-দাসীদেরকে সাক্ষ্য প্রদানের অধিকার দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আনাস (রাঃ) বলেন, ক্রীতদাসের সাক্ষ্য কেউ অগ্রাহ্য করেছে বলে আমার জানা নেই। ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) লিখেছেন, আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত, ছাহাবাদের ইজমা এবং ন্যায়বিচারের মানদন্ড সব কিছুই প্রমাণ করে যে, যেসব ব্যাপারে মুক্ত-স্বাধীন মানুষের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে, সেসব ব্যাপারে গোলামদের সাক্ষ্য অবশ্যই গ্রহণীয়।[12]

৩. সদাচরণ পাবার অধিকার :

ইসলাম দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন-হাদীছে যার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যেমন- আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) বলেন, যে কেউ তার গোলামকে প্রহার করবে নির্যাতক রূপে তাকেই ক্বিয়ামতের দিন শৃংখলে আবদ্ধ করা হবে।[13] অন্য এক হাদীছে এসেছে আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে, ক্বিয়ামতের দিন তার নিকট হ’তে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে’।[14]

দাস-দাসীদেরও নতুন ও ভাল পোষাক এবং ভাল খাবার পাবার অধিকার রয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, মারূর ইবনু সুয়েদ বলেন, আমি একদা আবূ যার (রাঃ)-কে নতুন এক জোড়া কাপড় পরা অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন তার গোলামের গায়েও অনুরূপ একজোড়া নতুন কাপড় ছিল। আমি তখন এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, আমি (আমার দাসদের মধ্যকার) এক ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলাম। তখন সে নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তখন নবী করীম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তার মা তুলে গালি দিয়েছ? আমি বললাম, জি হ্যাঁ। অতঃপর তিনি বললেন, তোমাদের দাসরা হচ্ছে তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার অধীনে যার ভাই রয়েছে, তার উচিত সে যা খায়, তা তাকে খেতে দেয়া এবং সে যা পরে তাই তাকে পরতে দেয়া এবং যে কাজ তার সাধ্যের অতীত তার উপর তা চাপাবে না। আর এরূপ কোন কাজ তাকে করতে দিলে তাকে সেই কাজে সে নিজেও সাহায্য করবে’।[15]

দাস-দাসীদের শুধু অন্ন-বস্ত্র পাবার অধিকার নয় বরং তা প্রদান করাকে মুসলমানদের জন্য ছাদাক্বার ন্যায় বলা হয়েছে। যাতে পরকালে অশেষ নেকী রয়েছে। এ সম্পর্কে মিকদাম (রাঃ) বলেন, তিনি নবী করীম (ছাঃ) বলতে শুনেছেন, مَا أَطْعَمْتَ نَفْسَكَ وَوَلَدَكَ وَزَوْجَكَ وَخَادِمَكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ ‘তুমি নিজে যা খাও, তোমার স্ত্রী, পুত্র এবং ভৃত্যকে যা খাওয়াও তার সবই ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত’।[16]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمْ خَادِمُهُ بِطَعَامِهِ فَلْيُجْلِسْهُ فَلْيَأْكُلْ مَعَهُ فَإِنْ أَبَى فَلْيُنَاوِلْهُ مِنْهُ ‘যখন তোমাদের মধ্যকার কারও খাদেম তার আহার নিয়ে তার কাছে আসে, তখন তাকেও সাথে বসিয়ে নেয়া উচিত। সে যদি তাতে সম্মত না হয় তবে তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে দেয়া উচিত’।[17]

উক্ত হাদীছগুলো থেকে বুঝা যায়, ইসলাম দাস-দাসীদের সাথে কি মহৎ ও উদার আচার-ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে। কোন মানবাধিকার সনদে অথবা ধর্মে এর নাম নিশানাও পাওয়া যায় না। উপরন্তু উচ্চবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণী বাড়ীর চাকর-চাকরাণী বা নিম্নশ্রেণীর সাথে খাদ্য হৌক কিংবা অন্য কোন সামাজিক ক্ষেত্রে হৌক চরম অসদাচরণ ও বৈষম্যমূলক ব্যবহার করে থাকে। ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও তাদের দু’মুঠো খাবার জোটে না। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে গৃহকর্তা/কর্ত্রী কর্তৃক নিষ্ঠুর অত্যাচারে তারা আহত হয়ে মৃত্যুবরণও করে থাকে। গরম খুনতির ছ্যাকা, বাথরুমে আটকে রেখে নিপীড়ন ও যৌন নির্যাতন প্রভৃতি অত্যাচার চালান হচ্ছে অহরহ। এগুলো বন্ধ হওয়া অতীব যরূরী। এগুলো অবশ্যই মানবাধিকার লংঘন।

৪. বিবাহ করার অধিকার : মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হ’ল প্রত্যেক নর-নারী উপযুক্ত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এটাই ইসলাম সম্মত। কিন্তু ইসলামপূর্ব যুগে দাস-দাসীদের বিয়ে করার অধিকার ছিল না। রোমান সাম্রাজ্য প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে গোলামদের বিয়ে-শাদী করার আইনগত কোন অধিকারী ছিল না।[18] ইসলাম এক্ষেত্রে দাস-দাসীদেরকে সমান অধিকার দিয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَأَنْكِحُوْا الْأَيَامَىْ مِنْكُمْ وَالصَّالِحِيْنَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ- ‘তোমরা তোমাদের অবিবাহিত মেয়ে ও তোমাদের নেক চরিত্রবান দাস-দাসীদের বিয়ের ব্যবস্থা কর’ (নূর ৩২)

কোন পুরুষ গোলাম শুধু দাসী বিয়ে করবে এমনটা নয়, সে যে কোন স্বাধীন মহিলাকে এবং উচ্চ সম্ভ্রান্ত পরিবারেও বিয়ে করতে পারে। স্বয়ং নবী করীম (ছাঃ) স্বীয় মুক্ত গোলাম যায়েদ ইবনে হারেছার সাথে নিজের ফুফাতো বোন যয়নাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে দিয়েছিলেন।

মারিয়া কিবতিয়া ও রায়হানা নামের দু’জন দাসীকে মুক্ত করে তিনি (ছাঃ) তাদের স্বীয় বিবাহিতা স্ত্রীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন। প্রথমোক্ত জনের গর্ভে তার সন্তান ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

রোমান সভ্যতার একটি কলঙ্কজনক নিয়ম ছিল। কোন গোলামের কন্যার বিয়ে হ’লে তাকে প্রথম রাত মনিবের সাথে অতিবাহিত করতে হ’ত। সৈয়দ আমীর আলী লিখেছেন, এই নিলর্জ্জ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে খৃষ্টান পাদ্রীদেরও কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু ইসলামে এই ধরনের পাশবিক ব্যবস্থার কল্পনাও করা যায় না।[19]

দাসীকে বিবাহ করে আদব-কায়দা শিক্ষা দেওয়াকে মনিবের জন্য দ্বিগুণ ছওয়াবের কারণ বলে রাসূল (ছাঃ) উল্লেখ করেছেন। এক হাদীছে এসেছে,... তিন ব্যক্তির জন্য দু’টি করে পারিশ্রমিক রয়েছে : (১) আহলে কিতাবের ঐ ব্যক্তি যে তার স্বীয় নবীর প্রতি ঈমান এনেছে, আবার মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে, তার জন্য দু’টি পারিশ্রমিক রয়েছে (২) ক্রীতদাস যখন আল্লাহর হক এবং তার মনিবের হক আদায় করে। (৩) ঐ ব্যক্তি, যার কাছে একটি দাসী ছিল সে তাকে শয্যাসঙ্গিনী করল, তাকে উত্তমরূপে আদব-কায়েদা শিক্ষা দিল, অতঃপর তাকে মুক্ত করে বিয়ের মাধ্যমে জীবনসঙ্গিনী রূপে বরণ করল। তার জন্যও দু’টি পারিশ্রমিক রয়েছে।[20]

এখানে স্পষ্টত বুঝা যায়, দাস-দাসীদের বিবাহ-শাদী কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং তারা স্বাধীন ব্যক্তিদের ন্যায় বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে এবং পরিবার গঠন করতে পারবে। অথচ আধুনিক বিশ্বে একদল সভ্য শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান এক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানকে একই দেশের, ভাষার ও ধর্মের মানুষ হওয়া স্বত্ত্বেও জনৈকা শ্বেতাঙ্গীনির প্ররোচনায় তার সাহচর্য দানের সাহস দেখানোর অপরাধে বুটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করল। পুলিশের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ছিল নির্বিকার।[21]

৫. সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার : ইসলামে সকল মুক্ত মানুষের যেমন সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত, দাস-দাসীদেরকেও অনুরূপ অধিকার দেয়া হয়েছে। যেমন- কোন দাস যদি রাসূল (ছাঃ)-কে দাওয়াত দিত তাহ’লে তিনি (ছাঃ) কবুল করতেন এবং তাদের ঘরে উপস্থিত হয়ে তাদের দেয়া খাদ্যবস্ত্ত আনন্দের সাথে গ্রহণ করতেন। ইসলামে ছালাতে ইমামতি করা অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন কাজ। যোগ্যতা থাকলে গোলামরা ছালাতে ইমামতি করার সুযোগ পেত। ইসলামের বড় ছাহাবীগণ তাদের পিছনে ছালাত আদায় করে তার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আবু হুযাইফা (রাঃ)-এর গোলাম সালেম ছালাতে ইমামতি করতেন এবং তার পিছনে আবুবকর (রাঃ), ওমর ফারূক (রাঃ), আবু সালমা (রাঃ), যায়েদ (রাঃ) এবং আমের ইবনে বারিতা (রাঃ) প্রমুখ সম্মানিত ছাহাবীগণ ছালাত আদায় করতেন। ওমর (রাঃ) যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-কে কূফার বিচারপতি নিযুক্ত করেছিলেন, তখন মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম আম্মার ইবনে ইয়াসার কূফায় ছালাতের ইমাম এবং সাময়িক গভর্ণর রূপে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

ইসলামপূর্ব সমাজে গোলামরা কোন কিছুর মালিক হ’তে পারত না। কিন্তু ইসলামে মুক্তিপ্রাপ্ত গোলামরাও ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার অধিকারী ছিল। ওমর (রাঃ) তাঁর খেলাফত আমলে যেসব বৃত্তি ও অনুদান বণ্টন করতেন, গোলামরাও তা থেকে ন্যায্য অংশ লাভ করত।[22]

কোন কোন গোলাম তাদের মনিবদের কাছে এতই স্নেহ-ভালবাসা, সম্মান ও অধিকার ভোগ করত যে তারা দাসত্ব থেকে ইচ্ছা করে স্বাধীন হ’তে চাইত না। অথচ অন্যত্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বর্ণবৈষম্যের ভয়াল চিত্র আমরা দেখতে পাব। বিশ্ব পরাশক্তি আমেরিকার হোটেলে নোটিশ টানানো হ’ত যে, এটা শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্য, এখানে কৃষ্ণাঙ্গ ও কুকুর ঢুকতে পারবে না’।[23] আমেরিকা, বৃটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্রে এখনও কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে উক্ত মর্যাদা তো দূরের কথা সেখানে এমনও অবস্থা রয়েছে যে হোটেলে পাশাপাশি কালো মানুষদেরকে বসতে দেখলে সাদারা দূরে চলে যায়। এমনকি তাদেরকে থুথু নিক্ষেপ করার কথাও জানা যায়। অথচ ইসলাম দাস-দাসীদেরকে কতই না মর্যাদার স্থানে অভিষিক্ত করেছে।

পক্ষান্তরে পৌত্তলিক, মুসলিম বিদ্বেষী ও নিম্নস্তরের এক দাস মুসলমানদের দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-কে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। তখন তার সাথে খলীফা কোন খারাপ ব্যবহার করেননি, তিনি শুধু বলেছিলেন দাসটি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে এবং এর প্রতিকারে কোন ব্যবস্থাই তিনি নিলেন না। তার বিরুদ্ধে তখনই অভিযোগ এল, যখন সে খলীফাকে হত্যা করল।[24] সমাজে দাসদের এমন মর্যাদা দেয়া হয়েছিল যে, ওমর (রাঃ)-এর ন্যায় সম্মানিত ছাহাবী ও খলীফা ক্রীতদাস বেলাল হাবশীকে ‘মওলানা’ বা ‘আমাদের বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি বলতেন, আবু বকর (রাঃ) আমাদের বন্ধুকে মুক্ত করে দিয়েছেন। সালমান ফারসী (রাঃ)ও ক্রীতদাস ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, সালমান তো আমাদের পরিবারভুক্ত একজন। এ থেকেই বুঝা যায়, ইসলামে দাসদেরকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হ’ত। কৃতদাস বেলাল (রাঃ)-কে কা‘বা ঘরে প্রথম আযান দেয়ার জন্য মুয়াযযিন নিযুক্ত করা হয়েছিল। এভাবে বহু দাস ছিল যারা কখনও বুঝতে পারেনি যে, তারা দাস ছিল।

৬. রাজনৈতিক তথা নেতৃত্ব পাবার অধিকার : ইসলাম দাসদের রাজনৈতিক অধিকার তথা নেতৃত্ব পাওয়ার সকল পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে, যা অন্য কোন ধর্ম বা মানবাধিকার সনদে দেখা যায় না। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল হুছায়েন (রাঃ) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যদি তোমাদের উপর নাককাটা কৃষ্ণকায় গোলামও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন তোমরা তার কথা শোন ও মান্য কর’।[25]

দাসদেরকে ইসলাম সেনাপতিত্ব ও নেতৃত্বের মর্যাদায় ভূষিত করেছিল। মহানবী (ছাঃ)-এর ঘনিষ্ঠতম ছাহাবীদের সমন্বয়ে গঠিত এক সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলেন এক সময়ের কৃতদাস যায়েদকে। সে বাহিনীতে আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর মত বিশিষ্ট ছাহাবীগণ থাকা সত্ত্বেও যায়েদের মৃত্যুর পর সেনাপতিত্ব দেয়া হ’ল তদীয় পুত্র উসামাকে। এভাবে ইসলাম দাসকে শুধু মনিবদের সমান মর্যাদাই দেয়নি; বরং কখনও কখনও মনিবেরা দাসদের আনুগত্যও করত। আর এসব ছিল মহানবী (ছাঃ)-এর অনুসৃত নীতির কিছু নমুনা। সুতরাং ইসলাম দাসদেরকে গোত্রীয় নেতা ও রাষ্ট্রনেতা বানাতেও স্বীকৃতি দিয়েছে।

৭. দাসদের স্বাধীন হওয়ার অধিকার : ইসলাম দাসদের শুধু মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; বরং দাস প্রথাকে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে তাদের মুক্ত করার নানা উপায় ও পদক্ষেপ নিয়েছে। যাতে এক পর্যায়ে দাসপ্রথা নির্মূল হয়ে যায়। জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করার আর একটি কারণ হচ্ছে, দাস প্রথাতে মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। অর্থাৎ তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না। কিন্তু ইসলামে তাদের স্বাধীনতা রয়েছে এবং সকল কাজে-কর্মে, বিয়ে-সাদী, চলাফেরা সকল ক্ষেত্রেই তা প্রয়োগ করতে পারে। দাস-দাসীরা স্বাধীনভাবে সবকিছু করতে পারে তবে তা মনিবদের অবগত করাতে হয়।

দাস-দাসীদের মুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার জন্য যেসকল ব্যবস্থা ইসলাম খোলা রেখেছে, তা নিম্নে বর্ণিত হ’ল-

মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَالْمَلآئِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّيْنَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَالسَّآئِلِيْنَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ ‘কিন্তু সবচেয়ে বড় নেকীর কাজ হ’ল, যে ঈমান আনল আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি। তারই মহববতে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃস্ব পথিক, প্রার্থী ও দাস মুক্তিতে অর্থ ব্যয় করল এবং ছালাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল’... (বাক্বারাহ ১৭৭)। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরও বলেন, مِمَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَكَاتِبُوْهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ فِيْهِمْ خَيْراً وَآتُوْهُم مِّنْ مَّالِ اللهِ الَّذِيْ آتَاكُمْ ‘আর তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে কেউ তার মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি চাইলে, তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হও, যদি তোমরা তাদের মধ্যে মঙ্গলের সন্ধান পাও। আর আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দান করবে’ (নূর ৩৩)। আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, فَإِمَّا مَنّاً بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء ‘অতঃপর হয় অনুকম্পা নয়, মুক্তি পণ’ (মুহাম্মাদ ৪)

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً أَعْتَقَ اللَّهُ بِكُلِّ إِرْبٍ مِنْهَا إِرْبًا مِنْهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি একজন দাসকে মুক্ত করল, আল্লাহ তা‘আলা তাকে মুক্ত দাসের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে জাহান্নাম হ’তে নিষ্কৃতি দান করবেন’।[26] এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘গোলাম স্বাধীন কর এবং গলদেশ মুক্ত কর’। জনৈক ছাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, এই দু’টি কথার মধ্যে তো কোন পার্থক্য মনে হয় না। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এই দু’টি কথা অভিন্ন নয়। প্রথম পক্ষের অর্থ, তুমি নিজে কোন দাসকে মুক্তি দিবে এবং দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ কোন দাসের মুক্তি লাভে তুমি সাহায্য-সহায়তা করবে।

নবী করীম (ছাঃ) যায়েদ ইবনে হারেছাকে মুক্ত করে স্বীয় পালিত পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং নিজের ফুফাত বোনকে তার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। ছওবানকে মুক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন কা‘বা ঘরের ঝাড়ুদার। আবু রাফে‘, সালমান ফারসী, আবু কাবাশা, ইয়ালা, রুয়াইকা প্রমুখ তারই মুক্ত ক্রীতদাস ছিলেন।

একদিন আনাস (রাঃ)-এর গোলাম তার সাথে চুক্তি করতে চাইলে তিনি মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু পরে ওমর (রাঃ) এটা জানতে পেরে এটা মেনে নেবার জন্য আনাস (রাঃ)-কে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাতেও তিনি রাযী হ’লেন না দেখে ওমর (রাঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে আনাস (রাঃ)-কে দোররা মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আনাস (রাঃ) তা মেনে নিতে রাযী হয়েছিলেন।[27]

ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি বিনা দোষে তার গোলামকে শাস্তি দেয় অথবা চপেটাঘাত করে তবে এর কাফফারা হ’ল সে যেন তাকে আযাদ করে দেয়’।[28]

এ সম্পর্কে অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, জনৈক ছাহাবী কোন কারণে তার গোলামকে প্রহার করলে রাসূল (ছাঃ) তা দেখে ফেললেন। এর কারণ জানতে চাইলে উক্ত ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, আমি একে আযাদ (মুক্ত) করে দিলাম আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি যদি এটা না করতে তবে জাহান্নামের আগুন তোমাকে জ্বালিয়ে ফেলত। অথবা বলেছেন, আগুন তোমাকে স্পর্শ করত’।[29]

দাস মুক্তির জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা :

ইসলাম দাস-দাসীকে মুক্ত বা স্বাধীন করার কতিপয় স্থায়ী ব্যবস্থা রেখে গেছে। যেমন- গোলাম নিজের অথবা অন্যের দানকৃত অর্থের বিনিময়ে দাসত্ব মুক্ত হ’তে পারে। এজন্য ইসলাম অবারিত সুযোগ রেখেছে। ইসলামে যাকাত বণ্টনের যে আটটি খাত রয়েছে দাস মুক্তি তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতে যাকাতের অর্থ বরাদ্ধের মাধ্যমে মুসলমান দাসদের মুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় কোষাগার এবং বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দাস মুক্তির সকল ব্যবস্থা ছিল।

এমনকি মালিক কখনও যদি কৃতদাসকে লক্ষ্য করে বলে যে, আমার মৃত্যুর পরে তুমি মুক্ত, তাহ’লে তার মৃত্যুর পরই গোলাম স্বাধীন হয়ে যাবে। ইসলামে ভুলক্রমে হত্যা, যিহার, কসম ভঙ্গ, রামাযানে দিনের বেলায় যৌন মিলনের কারণে ছিয়াম ভঙ্গের কাফফারা হিসাবে দাস মুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে অসংখ্য দাস মুক্তির ঘটনা জানা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাসূল (ছাঃ) নিজে তেষট্টিজন গোলামকে মুক্ত করেছিলেন। তাঁর ছাহাবীগণ কর্তৃক মুক্ত গোলামদের সংখ্যা ছিল ৩৯,২৫৯ জন।[30] প্রকৃতপক্ষে ইসলাম দাসমুক্তির যে পদক্ষেপ ও উপায় রেখেছে তার বাস্তবায়ন করা হ’লে কোথাও দাসত্বের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। সে কারণে ইংল্যান্ডের ইসলাম বিদ্বেষী লেখক পোলও স্বীকার করেছেন এবং বলতে বাধ্য হয়েছেন, যেসব দেশে দাস প্রথা বিরাজমান, সেসব দেশে ইসলামের নবী কর্তৃক গোলাম মুক্ত করার লক্ষ্যে নির্দেশিত পন্থা অনুযায়ী কাজ করা হ’লে অল্পদিনের মধ্যেই দাসপ্রথার চূড়ান্ত অবলুপ্তি ঘটত, তাতে এক বিন্দু সন্দেহ নেই।[31]

মুক্তি লাভের পর : দাস-দাসীর মুক্তি বা স্বাধীন হওয়ার পর সে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে, যা অন্যান্য স্বাধীন মানুষ করে থাকে। অর্থাৎ সে মানবীয় সকল অধিকার ভোগ করবে। এ সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, যে লোক তার গোলামকে মুক্ত করে দিল, তার এই মুক্তি নিশ্চিত ও শাশ্বত হয়ে যাবে। তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে। তার যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান অবশ্যই স্বীকৃত হবে। তার উত্তরাধিকার চালু হবে। তার উপরে পূর্ববর্তী মনিবের কোন অধিকার থাকবে না এবং তার উপর কোন কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া যাবে না। অনুরূপভাবে তার উপর নতুন করে দাসত্ব চাপিয়ে দেয়া যাবে না।[32]

পর্যালোচনা :

জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৩নং ধারায় দাস প্রথা নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ মানুষ, মানুষের নিকট প্রভু হিসাবে থাকতে পারে না। পাশ্চাত্য পন্ডিতগণের মতে ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং সকল মানুষের ধর্ম হয়েও কেন এ জঘন্য প্রথাকে টিকিয়ে রাখল? এরপরেও মুসলমানরা দাসীদেরকে ভোগ-বিলাসের জন্য খেলনার মত ব্যবহার করতঃ সাংঘাতিক রকমের পাপের বিস্তার ঘটিয়েছে। তারা মানবাধিকার লংঘন করেছে। এটা মোটেও কাংখিত নয়। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল (ছাঃ) কেন এ প্রথাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে যাননি। এটা আমরা মেনে নিব না ইত্যাদি ইত্যাদি...।

বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও জবাব আমরা ইতিপূর্বে দিয়েছি। সেখানে আমরা বলেছি যে, এখন কোন বংশীয়, গোত্রীয় ও রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ অথবা অন্য কোন কারণে নতুন করে কাউকে দাস বানানো নিষিদ্ধ; কেবল দ্বীন ইসলাম রক্ষা ও প্রতিষ্ঠাকল্পে কোন ধর্মীয় যুদ্ধে বন্দী হওয়া ব্যতীত। যেমন- পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘আর তারপর হয় তাদের এক তরফাভাবে মুক্ত করে দাও অথবা অস্ত্র সংবরণ না হওয়া পর্যন্ত বিনিময় হিসাবে বন্দী করে রাখ’ (মুহাম্মাদ ৪)। এখানে যুদ্ধবন্দীদের দাসে পরিণত করার কথা কোথাও নেই; থাকলে সেটাই একটা স্থায়ী রণনীতি হিসাবে পরিণত হ’ত। পক্ষান্তরে কুরআন স্থায়ী রণনীতি হিসাবে নির্ধারণ করল। হয় যুদ্ধবন্দীদের এক তরফাভাবে মুক্তি দিতে হবে, অন্যথা তাদেরকে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক রাখতে হবে। ইসলামে যে রণ নীতি রয়েছে, তাতেও যুদ্ধ বন্দীদেরকে দাস বানাতে হবে এমন কোন কথা নেই। যখনই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের আর দাস হয়ে থাকতে হয়নি। মহানবী (ছাঃ) স্বয়ং যুদ্ধবন্দীদের এক দাসকে বিনিময় নিয়ে এবং অন্যদের থেকে বিনিময়ে না নিয়েই মুক্তি দিয়েছিলেন। তেমনি তিনি (ছাঃ) নাজরানের খৃষ্টানদের থেকে জিযিয়া কর নিয়ে তাদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন। এসব মহৎ কাজের লক্ষ্যই ছিল মানব জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়া।

ইসলাম দাস-দাসীদেরকে একজন মানুষ হিসাবে সকল অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে। একজন মানুষের অধিকার কখন ক্ষুণ্ণ হয়, যখন তার কোন মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয়। কিন্তু ইসলাম দাস-দাসীদের কোন অধিকার ক্ষুণ্ণ করেনি; বরং তাদের সকল মৌলিক অধিকার প্রদান করেছে। শুধু তাই নয়, তাদের জীবনের নিরাপত্তা, ব্যবসা-বাণিজ্য করতঃ সমাজে উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণের অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অধিকার, এমনকি নেতা হবার অধিকার সহ সকল অধিকার ইসলাম দিয়েছে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।

ছেলে পিতার অধীনে থেকে যেমন সকল অধিকার ভোগ করে থাকে, ঠিক দাসও তেমনি তার মনিবের অধীনে থেকে সকল অধিকার ভোগ করে।

উল্লেখ্য, এখানে দাসত্ব কথাটি ব্যবহার না করে একে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট ব্যক্তির অধীনে সাময়িক বা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারও স্বাভাবিক অবস্থান বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু নিকট আত্মীয়ের সাথে তার স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকে। আর এটা করা হয় সত্য দ্বীনের বিরুদ্ধে ও শান্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। যখনই সে সত্য দ্বীন মেনে নেবে, তাৎক্ষণিক সে নিজেকে সকল পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে নিতে পারবে।

পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ মুসলমানদের দাসীদেরকে উপপত্নী বা স্ত্রী হিসাবে ব্যবহার করাকে পাপাচার বা মানবাধিকার লংঘন বলে আখ্যায়িত করেছে। এটা আদৌ যুক্তিসংগত নয়; এতে মানবাধিকার লংঘিত হয়নি। কারণ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারিণীকে হত্যা করা যেত। কিন্তু মুসলমানরা তা না করে সসম্মানে তাদেরকে এক একজনের অধীনে রাখে। যেখানে তারা একজন মানুষ হিসাবে সকল অধিকার ভোগ করে। তাছাড়া একজন নারীর জন্য একজন পুরুষ অভিভাবকের প্রয়োজন পড়ে, এটাই স্বাভাবিক। নতুবা ঐ মহিলার মাধ্যমে নানা অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হ’তে পারে এবং সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হ’তে পারে। এজন্য দাসীকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে গ্রহণ করতঃ মুক্ত করে হৌক আর না হৌক তাকে স্ত্রীর মর্যাদা প্রদান করা হয়।

পক্ষান্তরে বর্তমানে বহু দেশে নারীদেরকে যথেচ্ছা ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা একজন দাসী বা পরিচারিকাকে নিকৃষ্টভাবে ভোগ করে থাকে। ইহুদী-খৃষ্টান ও প্রগতিবাদীরা মুসলমান বিশেষত আরব জাহানের শাসকদের উপর যে নারীভোগী বলে অপপ্রচার করছে তা প্রকৃত অর্থে সঠিক নয়। কারণ আরব জাহানে কোন দাস-দাসী বর্তমানে নেই। ইসলামে দাস-দাসীর নামে কেউ যদি অপপ্রচার চালায় তাহ’লে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর যদি চাকর-চাকরাণীর নামে এরকম কিছু ঘটেই থাকে তাহ’লে এটা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এই অপরাধের কারণে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। ইসলাম কখনও অনৈতিক কর্মকান্ডকে সমর্থন করে না। সর্বদা পাক-পবিত্রতাকে পসন্দ করে। সেই সাথে আল্লাহভীরু মানুষও অনৈসলামিক কর্মকান্ড ও অশ্লীলতাকে পসন্দ করে না।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়, ইসলাম দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ না করে মানবাধিকার লংঘন করেনি। বরং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। কারণ যুদ্ধের ময়দানের পুরুষ-নারী যেই হৌক না কেন বন্দী হ’লে তাদের হত্যা করার কথা; কিন্তু তা না করে এবং তাদেরকে দ্বীপান্তর না করে, রাষ্ট্রীয় বন্দীশালায় খারাপ পরিবেশে অমানবিকভাবে না রেখে, তাদের ওপর কুকুর লেলিয়ে না দিয়ে, ইলেকট্রিক শক না দিয়ে, অনাহারে না রেখে, নিষ্ঠুর আচরণ না করে, নানা নির্যাতন না করে অপরের অধীনস্থ রেখে বাঁচার অধিকার দিয়েছে। দাসপ্রথাকে একবারে নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর নিষিদ্ধ না করার পিছনে রয়েছে মানবকল্যাণের এক দূরদর্শী ও ফলপ্রসু পরিকল্পনা, যা অবিশ্বাসীদের কাছে গৃহীত নাও হ’তে পারে। তাতে আল্লাহর কাছে কিছু যায় আসে না। আল্লাহ যে সর্বশক্তিমান, মহাদার্শনিক ও মহাজ্ঞানী এই মৌলিক বিশ্বাসের উপর অটল থাকলে এসকল বিষয়ে কারও বিভ্রান্তিকর চিন্তা আসবে না। অতএব নিঃসন্দেহে বলতে পারি, বাহ্যিকভাবে দাস ব্যবস্থা খারাপ মনে হ’লেও প্রকৃত অর্থে এ ব্যবস্থাকে বহাল রাখা মানব সভ্যতা ও মানবাধিকার পরিপন্থী নয়। পক্ষান্তরে জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৪নং ধারায় দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা সর্বযুগের সর্বশ্রেণী মানুষের জন্য নয়; কেবল কোন নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীর খন্ডিত চিত্র দেখে করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন স্থায়ী কল্যাণ ও দূরদর্শিতা নেই, যা আছে ইসলামে।

অতএব জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করণকে বাস্তবতা বিবর্জিত ও অসঙ্গত বলে আমরা তা মেনে নিতে পারছি না। কারণ বাস্তবতা ও কাগজে লিপিবদ্ধ বিষয় এক নয়। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সৃষ্টি ও হেকমত সম্পর্কে ভালভাবে বুঝার এবং তা মেনে চলার তাওফীক দান করুন- আমীন!

 [চলবে]

শামসুল আলম

শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

[1]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৪০; আদাবুল মুফরাদ হা/১৮৮।

[2]. মুসলিম হা/১৬৬২, মিশকাত হা/৩৩৪৪।

[3]. মুত্তাফাক্ব আলাইহি, মিশকাত হা/৩২০১।

[4]. মুসলিম, বাংলা মিশকাত, অনুবাদ: নুর মোহম্মদ আজমী, (ঢাকা : এমদাদিয়া পুস্তকালয়), হা/৩৩০৩।

[5]. মুত্তাফাক আলাইহ, বাংলা মিশকাত হা/৩২০৪।

[6]. মুহাম্মাদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ৮ম সংস্করণ, ১৯৯৪), পৃঃ ৩৬-৩৭।

[7]. মাওলানা আব্দুর রহীম, দাস প্রথা ও ইসলাম, (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, মার্চ ২০০৯), পৃঃ ২১।

[8]. বুখারী হা/২৫৪৭; আহমাদ হা/১৯৬১৮।

[9]. ভ্রান্তির জালে ইসলাম, পৃঃ ৩৭।

[10]. আবূদাঊদ হা/৫১৬৭, মিশকাত হা/৩৩৬৭।

[11]. মুসলিম হা/১৬৫৯, আদাবুল মুফরাদ হা/১৭১।

[12]. দাসপ্রথা ও ইসলাম, পৃঃ ৪২।

[13]. আদাবুল মুফারাদ হা/১৮১, সনদ ছহীহ।

[14]. আদাবুল মুফারাদ হা/১৮৬, সনদ ছহীহ।

[15]. বুখারী হা/৩০, আদাবুল মুফরাদ হা/১৮৯।

[16]. আদাবুল মুফরাদ হা/১৯৫।

[17]. আল-আদাবুল মুখরাদ হা/২০০।

[18]. দাস প্রথা ও ইসলাম, পৃঃ ৪২।

[19]. তদেব, পৃঃ ৪৩।

[20]. আদাবুল মুফরাদ, হা/২০৩।

[21]. মুহাম্মাদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৫৪।

[22]. দাসপ্রথা ও ইসলাম, পৃঃ ৪৫-৪৬।

[23]. ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৫৪।

[24]. তদেব, পৃঃ ৫৫।

[25]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬২, নেতৃত্ব ও বিচার ব্যবস্থা অধ্যায়।

[26]. মুসলিম হা/১৫০৯, নাসাঈ হা/৩১৪২।

[27]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১৭৬০।

[28]. মুসলিম হা/১৬৫৭, আবুদাঊদ হা/৫১৬৮।

[29]. মুসলিম, মিশকাত, বাংলা অনুবাদ, হা/৩২১০।

[30]. দাস প্রথা ও ইসলাম, পৃঃ ৩৮।

[31]. তদেব, পৃঃ ৩৯।

[32]. তদেব, পৃঃ ৪০।






আমানত - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৭ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
ধর্মদ্রোহিতা - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জান্নাত লাভের কতিপয় উপায় (প্রথম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় - ডা. মুহাম্মাদ এনামুল হক
হকের পথে বাধা : মুমিনের করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
ইসলামে পানাহারের আদব বা শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.