চতুর্থ কারণ : ব্যক্তিপূজা (التقليد) :
তাক্বলীদ ‘ক্বালাদাতুন’ শব্দ থেকে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। বলা হয়, ‘ক্বাল্লাদাল বা‘ঈরা’(قلد البعير) ‘সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে’। সেখান থেকে মুক্বাল্লিদ, যিনি নিজের গলায় কারো আনুগত্যের রশি বেঁধে নিয়েছেন। পারিভাষিক অর্থে ‘নবী ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির কোন শারঈ সিদ্ধান্তকে বিনা দলীলে মেনে নেওয়াকে ‘তাক্বলীদ’ বলা হয়’। মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন,التَّقْلِيْدُ قُبُولُ قَوْلِ الْغَيْرِ بِلاَ دَلِيْلٍ ‘অন্যের কোন কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করার নাম ‘তাক্বলীদ’।[1]
সুতরাং শারঈ বিষয়ে কারো কোন কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করাই তাক্বলীদ। পক্ষান্তরে দলীলসহ গ্রহণ করলে তা হয় ইত্তেবা। আভিধানিক অর্থে ইত্তেবা হচ্ছে পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থে শারঈ বিষয়ে কারো কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া।
আব্দুল্লাহ বিন মাস‘উদ (রাঃ) বলেন,أَلاَ لاَ يُقَلِّدَنَّ رَجُلٌ رَجُلاً دِيْنَهُ فَإِنْ آمَنَ آمَنَ وَإِنْ كَفَرَ كَفَرَ- ‘সাবধান! তোমাদের কেউ যেন ঐ ব্যক্তির ন্যায় দ্বীনের ব্যাপারে কারো তাক্বলীদ না করে, যে (যার তাক্বলীদ করা হয়) ঈমানদার হ’লে সে (মুক্বাল্লিদ) ঈমানদার হয়, আর কাফের হ’লে সেও কাফের হয়।[2]
মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রহঃ) বলেন, নিশ্চয়ই ছাহাবীদের যুগে এমন অবস্থা ছিল না যে, কোন ব্যক্তি তাদের মধ্যে অপর কোন ব্যক্তির সকল কথার তাক্বলীদ করত, তা থেকে কোন কিছুই ছেড়ে দিত না। পক্ষান্তরে অন্যের কথাকে ছেড়ে দিত এবং তা থেকে কোন কিছুই গ্রহণ করত না। আমরা আবশ্যিকভাবে জানতে পারি যে, নিশ্চয়ই এটা (তাক্বলীদ) তাবেঈনদের যামানায় ছিল না এবং ছিল না তাবে‘ তাবেঈনদের যামানাতেও।
২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়।
শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘জেনে রাখ, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর আগের লোকেরা নির্দিষ্ট কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের মুক্বাল্লিদ তথা অন্ধানুসারী ছিল না। কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারো মাযহাব যাচাই করা হ’ত না’।[3]
এই উক্তি প্রমাণ করে যে, মাযহাবের তাক্বলীদ শুরু হয়েছে ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পরে। ওলামায়ে কেরাম যাদের ইজতিহাদ সর্বত্র গৃহীত হয়েছে, তাঁরা সকলেই তাক্বলীদের বিরোধিতা করেছেন।
হাম্বলী ও শাফেঈ মাযহাবের অধিকাংশ বিদ্বান বলেছেন,لاَ يَجُوْزُ الْفَتْوَى بِالْتَّقْلِيْدِ لِأَنَّهُ لَيْسَ بِعِلْمٍ وَالْفَتْوَى بِغَيْرِ عِلْمٍ حَرَامٌ وَلَا خِلَافَ بَيْنَ النَاسِ أَنَّ الْتَّقْلِيْدَ لَيْسَ بِعِلْمٍ وَأَنَّ الْمُقَلِّدَ لَا يُطْلَقُ عَلَيْهِ اِسْمُ عَالِمٍ- ‘নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ দ্বারা ফৎওয়া প্রদান করা জায়েয নয়। কেননা তা ইলম নয়। আর ইলমবিহীন ফৎওয়া প্রদান করা হারাম। আর এ ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, তাক্বলীদের নাম ইলম নয় এবং মক্বাল্লিদের নাম আলেম নয়’।[4]
অতএব তাক্বলীদ নয়, কুরআন ও হাদীছের যথাযথ অনুসরণই হচ্ছে ইসলামের মৌলিক বিষয়। যেমনটি অনুসরণ করেছেন সালাফে ছালেহীন। তারা কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,
إِذَا وَجَدْتُمْ فِيْ كِتَابِيْ خِلَافَ سُنَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقُوْلُوْا بِسُنَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَدَعُوْا مَا قُلْتُ. وَفِيْ رِوَايَةٍ: فَاتَّبِعُوْهَا، وَلَا تَلْتَفِتُوْا إِلَى قَوْلِ أَحَدٍ-
‘যদি তোমরা আমার গ্রন্থে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত বিরোধী কিছু পাও, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বল এবং আমার কথাকে প্রত্যাখ্যান কর’। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতেরই অনুসরণ কর এবং অন্য কারো কথার দিকে দৃকপাত কর না’।[5]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, لَا تُقَلِّدْنِيْ، وَلَا تُقَلِّدْ مَالِكًا وَلَا الْشَافِعِيَّ وَلَا الأَوْزَاعِيَّ وَلَا الْثَوْرِيَّ، وَخُذْ مِنْ حَيْثُ أَخَذُوْا- ‘তুমি আমার তাক্বলীদ কর না এবং তাক্বলীদ কর না মালেক, শাফেঈ, আওযাঈ ও ছাওরীর। বরং তাঁরা যে উৎস হ’তে গ্রহণ করেছেন, সেখান থেকে তোমরাও গ্রহণ কর’।[6]
একথা পরিষ্কার যে, ইসলাম মানব জাতিকে আল্লাহ প্রেরিত সত্য গ্রহণ ও তাঁর নবীর ইত্তেবা করতে আহবান জানিয়েছে। কোন মানুষের ব্যক্তিগত রায়ের অনুসরণ করতে কখনই বলেনি। মানুষ যেহেতু ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, তাই মানব রচিত কোন মতবাদই, সে মতবাদ ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যাই-ই হোক না কেন, প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। সেই মতবাদে পৃথিবীতে শান্তিও আসতে পারে না। আর এজন্যেই নবী ব্যতীত অন্যের তাক্বলীদ নিষিদ্ধ এবং নবীর ইত্তেবা মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
পঞ্চম কারণ : প্রবৃত্তিপূজা (اتباع الهوى) :
নিঃসন্দেহে প্রবৃত্তি পূজা মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথ হ’তে বিচ্যুত করে বাঁকা পথে পরিচালিত করে। এর ফলেই বিভিন্ন ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট দলের উদ্ভব হয়েছে। তাই এটি ভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের অন্যতম কারণ। এটি তার অনুসারীকে বিপজ্জনক অবস্থার দিকে নিয়ে যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রেরিত ও রাসূল (ছাঃ)-এর শেখানো ইবাদত, আনুগত্য, আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করে, সে কেবল প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করে। সে কখনো আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের আনুসারী হ’তে পারে না। কুরআনুল কারীমের অনেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা প্রবৃত্তির অনুসরণ করাকে তিরস্কার করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلٰهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُوْنُ عَلَيْهِ وَكِيْلًا ‘তুমি কি তাকে দেখ না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে?’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩)। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘যখনই কোন বিষয় তার নিকট ভাল মনে হয় এবং তার প্রবৃত্তিতে ভাল লাগে, সে তখন সেটিকে তার দ্বীন ও মাযহাব হিসাবে মেনে নেয়’।[7]
শরী‘আত বিরোধী প্রবৃত্তির অনুসারীকে প্রবৃত্তির পূজারী বলা হয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘শরী‘আত বিরোধী প্রবৃত্তিও এক প্রকার মূর্তি, যার পূজা করা হয়’। তিনি এর প্রমাণ স্বরূপ এই আয়াত তেলাওয়াত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللهِ أَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ- ‘তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছ, যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে। আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা কর না’ (জাছিয়া ৪৫/২৩)। মহান আল্লাহ মুমিনগণকে প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,فَلاَ تَتَّبِعُوا الْهَوَى ‘অতএব প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না’ (নিসা ৪/১৩৫)।
মহান আল্লাহ আরোও বলেন,ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيْعَةٍ مِّنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ ‘এরপর আমরা তোমাকে রেখেছি ধর্মের এক বিশেষ শরী‘আতের উপর। অতএব তুমি এর অনুসরণ কর এবং অজ্ঞদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না’ (জাছিয়া ৪৫/১৮)।
খেয়াল-খুশীর অনুসারীরা পথভ্রষ্ট। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ لاَ أَتَّبِعُ أَهْوَاءَكُمْ قَدْ ضَلَلْتُ إِذًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ ‘তুমি বলে দাও যে, আমি তোমাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করব না। তাতে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাব এবং সুপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকবো না’ (আন‘আম ৬/৫৬)।
অন্যত্র তিনি আরোও বলেন,وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াত অগ্রাহ্য করে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
তাছাড়াও প্রবৃত্তিপূজারীরা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যদেরকেও বিপথগামী করে। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنَّ كَثِيْرًا لَيُضِلُّوْنَ بِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِيْنَ- ‘নিশ্চয়ই বহু লোক অজ্ঞতাবশে নিজেদের প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে লোকদের পথভ্রষ্ট করে। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক সীমালংঘনকারীদের ভালভাবেই জানেন’ (আন‘আম ৬/১১৯)।
প্রবৃত্তির অনুসরণই সব অনিষ্টের মূল এবং যাবতীয় বিপদ-আপদের ভিত্তি। এটি সকল প্রকার বিদ‘আতের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। তাই এটি অজ্ঞতা অপেক্ষা অধিক বিপজ্জনক। কেননা অজ্ঞতার চিকিৎসা সহজেই করা যায় এবং তা অজ্ঞ ব্যক্তির সাধ্যের ভিতরে পড়ে। যেমন জ্ঞান অন্বেষণ এবং দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সে সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। কিন্তু প্রবৃত্তি এমন একটি বিষয়, চাই তা জ্ঞান অন্বেষণরত অবস্থায় হোক, কিংবা জ্ঞান লাভের পরে হোক সর্বাবস্থায় এটি ভয়ানক ও বিপজ্জনক, যা দূর করতে প্রয়োজন পড়ে কঠোর আত্মসংগ্রাম ও যথাযথ প্রতিষেধকের। এই প্রবৃত্তির বালার কারণেই মানুষ কামনা-বাসনা ও সন্দেহ-সংশয়ের মাঝে নিপতিত হয়। ফলে সে সত্য জানা ও তা মানা থেকে মাহরূম হয়।
১. শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ক্বলবের প্রভাব বিস্তার এবং নফসের প্রবৃত্তি থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। এই দু’টি জিনিস হক্ব জানা ও মানার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়’।[8]
২. ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম হ’ল, যে প্রবৃত্তি, রাগ ও লোভ-লালসা থেকে নিরাপদ থাকল’।[9]
৩. আবূ ওছমান নীসাপুরী (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কথায় ও কর্মে সুন্নাতকে নিজের আমীর নিয়োগ করে, সে হিকমতপূর্ণ কথা বলে। পক্ষান্তরে যে কথায় ও কর্মে প্রবৃত্তিকে নিজের আমীর নিয়োগ করে, সে বিদ‘আতী কথা বলে’।[10] কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ تُطِيعُوْهُ تَهْتَدُوْا ‘আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর তাহ’লে তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে’ (নূর ২৪/৫৪)। সেজন্য সালাফে ছালেহীন প্রবৃত্তির অনুসারীদের থেকে সাবধান থাকতে বলেছেন।
৪. বিশিষ্ট ছাহাবী ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীর নিকট বসো না। কেননা তাদের সঙ্গ দেওয়া অন্তরে রোগের জন্ম দিবে’।[11]
৫. আবু ক্বিলাব (রহঃ) বলেন, ‘তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীদের কাছে বসো না, তাদের সাথে তর্ক-বিতর্কও করো না। কেননা আমি তাদের অনিষ্ট থেকে কোন অবস্থাতেই নিরাপদ মনে করি না। তারা তোমাদেরকে ভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত করবে অথবা তোমাদের জানা বিষয়ে সন্দেহ-সংশয় ঢুকিয়ে দিবে’।[12]
৬. ইব্রাহীম নাখঈ (রহঃ) বলেন, ‘তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সঙ্গ দিয়ো না। কেননা তাদের সঙ্গ দিলে তোমাদের অন্তর থেকে ঈমানের জ্যোতি দূরীভূত করে দিবে, বাহ্যিক সৌন্দর্যাবলী ও মর্যাদার গুণাবলী ছিনিয়ে নিবে এবং মুমিন হৃদয়ে ত্রুটি এনে দিবে’।[13]
এই প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণেই খারেজীদের উদ্ভব হয়েছে, রাফেযীরা শরী‘আতের অনেক বিষয়কে অস্বীকার করেছে, জাবরিয়াদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। মু‘তাযিলারা আত্মপ্রকাশ করেছে, মুরজিয়ারা আল্লাহর শাস্তিবিধান সহ আরও অনেক শারঈ বিষয়কে অস্বীকার করেছে। ক্বাদারিয়ারা ভাগ্যকে অস্বীকার করেছে এবং মুসলিম মিল্লাত বহুধাবিভক্ত হয়ে গেছে। প্রতিটি ফের্কা নিজ নিজ মতবাদ ও মতাদর্শ নিয়েই আনন্দিত হচ্ছে। এই প্রবৃত্তিই শরী‘আতের অনেক বিধানের বিকৃতি সাধন করেছে এবং এর অপব্যাখ্যা করেছে। ইবাদতের ক্ষেত্রে সংযোজন ও বিয়োজন ঘটিয়েছে। আর মানুষকে নিক্ষেপ করেছে স্পষ্ট গোমরাহীতে। ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, ‘বাহাত্তরটি প্রবৃত্তি পূজারী ফির্কার মূল হ’ল চারটি। এ চারটি থেকেই ৭২টি ফির্কার উদ্ভব। সেগুলি হ’ল- ক্বাদারিয়া, মুরজিয়া, শী‘আ ও খারেজী। সুতরাং যারা আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাঃ)-কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সকল ছাহাবীর উপর মর্যাদাবান মনে করে এবং অবশিষ্ট ছাহাবীগণ সম্পর্কে কেবল ভাল কিছু বলে এবং তাঁদের জন্য দো‘আ করে, তাহ’লে তারা এর মাধ্যমে পূর্বাপর সকল শী‘আ মতবাদ থেকে বের হয়ে গেল। আর যারা বলে, ‘ঈমান হ’ল মুখে স্বীকৃতি দেওয়া এবং আমলে বাস্তবায়ন করা, যা কমে ও বাড়ে, তাহ’লে তারা পূর্বাপর সকল প্রকার মুরজিয়া মতবাদ থেকে মুক্ত হ’ল। আর যারা পুণ্যবান ও পাপী সকল মুসলিমের পিছনে ছালাত আদায় জায়েয মনে করে, খলীফার (শাসক) পক্ষে জিহাদ করা বৈধ মনে করে এবং শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করাকে হালাল মনে করে না; বরং তাদের জন্য কল্যাণ ও সংশোধনের দো‘আ করে, তাহ’লে তারা এর মাধ্যমে খারেজী মতবাদ থেকে বের হ’ল’।[14]
ষষ্ঠ কারণ : অহি-র উপর জ্ঞান ও বিবেককে প্রাধান্য দেওয়াتقديم العقل على النقل) ) :
এই উম্মতের পদস্খলনের আরেকটি বড় কারণ হ’ল স্বীয় জ্ঞান ও যুক্তিকে অহি-র বিধানের উপর প্রাধান্য দেওয়া এবং শরী‘আতের বিধানের ক্ষেত্রে সেটাকেই মূল উৎস হিসাবে গ্রহণ করতঃ আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে হিসাবে গ্রহণ করে তার উপর নির্ভরশীল হওয়া। আর কিছু নামধারী মুসলিম যেমন জাহ্মিয়া, মু‘তাযিলা, আশ‘আরিয়া সহ আরও অন্যান্য পথভ্রষ্ট ফের্কাগুলির বর্তমান অবস্থা এমনই। যারা গ্রীক জাতির বই-পুস্তক ও তাদের বিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং তাদের দর্শন ও চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করেছে। অতঃপর শরী‘আতের যা কিছু তাদের বিবেকের অনুকূলে মনে হয়েছে তা গ্রহণ করেছে, আর যা কিছু বিরোধী মনে হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিভিন্নভাবে তার উপর আক্রমণ চালিয়েছে। এর ফলে তারা সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস হ’তে দূরে চলে গেছে এবং সঠিক পথ হ’তে বিচ্যুত হয়ে বিপথগামী হয়েছে। যদি তারা কুরআন ও হাদীছ সমূহকে অাঁকড়ে ধরতো এবং এ দু’টিকেই শরী‘আতের একমাত্র মূল উৎস হিসাবে মেনে নিত, কোন বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে তার দিকেই প্রত্যাবর্তণ করত, সালাফে ছালেহীনের পথে চলত, সঠিক পথ বিরোধী যাবতীয় বিষয় থেকে দূরে থাকত, তাহ’লে তারা কখনোও পথভ্রষ্ট হ’ত না এবং মুসলিম জাতিও বিপথগামী হ’ত না। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيعُوْا اللهَ وَأَطِيعُوْا الرَّسُوْلَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلًا-
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের আমীরের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতর্ক কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।
অত্র আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য বলতে, কিতাবের অনুসরণ ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কখনো কোন বিষয়ে পারস্পরিক মতবিরোধ দেখা দিলে বিবাদ পরিহার করে উভয় পক্ষকে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর সিদ্ধান্তের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
প্রকাশ থাকে যে, নিশ্চয়ই জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় নে‘মত। তিনি তা মানুষকে দান করেছেন ভাল-মন্দ ও হক্ব-বাতিলের মাঝে পার্থক্য করার জন্য। কিন্তু মানবীয় জ্ঞান ও বিবেকের একটি নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে, যেখানে গিয়ে তা থেমে যায়। আমাদেরকে যে জ্ঞান দান করা হয়েছে তা খুবই সামান্য। মহান আল্লাহ্ বলেন, وَمَا أُوْتِيْتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيْلًا ‘এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৮৫)।
আর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সবকিছু অর্জন করার ক্ষমতা দেননি। সুতরাং এমন কিছু বিষয় রয়েছে, জ্ঞান ও বিবেক সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। আবার কিছু বিষয় এমন রয়েছে, যার বাহ্যিক অবস্থা বুঝতে পারলেও তার ভিতর তথা প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে জ্ঞান ব্যর্থ হয়। জ্ঞান ও বিবেকের এমন স্বত্তাগত ঘাটতি থাকার কারণে যেসব বিষয় উপলব্ধি করা সম্ভব সেগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞানসমূহ একমত হ’তে পারে না। কেননা উপলব্ধি করার ক্ষমতা ও মাধ্যম ব্যক্তি ও জ্ঞান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই যে বিষয়ে জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করার কোন পথ নেই এবং বিবেকবানরাও যে বিষয়ে মতবিরোধ করে, সে বিষয়ে অবশ্যই সত্য সংবাদ বাহকের দিকে ফিরে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জ্ঞান অপারগ হয়ে অবশেষে তাকে সত্য হিসাবে স্বীকার করতে বাধ্য। আর তিনি হ’লেন রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)। সুতরাং যে সমস্ত বিষয়ে আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, সে বিষয়ে আমাদের নিজস্ব জ্ঞান ও বিবেককে প্রবেশ করানো এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাদরেকে কিতাব ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরার যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা অমান্য করা স্পষ্ট গোমরাহী। কেননা মুসলমানরা যদি উক্ত বিষয়গুলি অাঁকড়ে ধরতো এবং বিরোধী বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত, তাহ’লে জ্ঞান ও বিবেক যে কাজের জন্য সৃষ্ট হয়নি, সে বিষয়ে তারা তাকে বিচারক বা হক্ব-বাতিলের মানদন্ড হিসাবে কখনোও নিয়োগ করত না। তারা কখনো গোমারাহীর মধ্যে নিপতিত হ’ত না। এমনটিই বলেছেন, জুয়াইনী, গায্যালী, বাযী প্রমুখ বিদ্বান।
কোন খবর যদি আল্লাহ অথবা তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সত্য হিসাবে প্রমাণিত হয়, তাহ’লে তা গ্রহণ করা কিংবা প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে জ্ঞান ও বিবেকের সামান্য কোন এখতিয়ার নেই। বরং তার আনুগত্য করা এবং তা মেনে নেওয়া ওয়াজিব, যদিও মানবীয় জ্ঞান তার গূঢ় তথ্য উপলব্ধি করতে পারেনি, তবুও তা মেনে নিতে হবে। কেননা আমাদের জ্ঞান সবকিছুকে আয়ত্ব করতে অপারগ। মহান আল্লাহ্ বলেন,إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ- ‘অথচ মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হ’তে পারে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)। মহান আল্লাহ আরোও বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِيْنًا- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে কোন এখতিয়ার নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় পতিত হয়’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
অত্র আয়াতটি সব বিষয়কে শামিল করে। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যদি কোন বিষয়ের ফায়ছালা দেন, তাহ’লে তার বিরোধিতা করার ক্ষমতা ও এখতিয়ার কারো নেই এবং সে বিষয়ে কারো কোন মতামত ও বক্তব্য দেওয়ার অধিকারও নেই। তাই প্রতিটি মুসলিমের উপর ওয়াজিব আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতে যা আছে তা নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়া, স্বীয় জ্ঞান ও বিবেককে এ দু’টির অনুগামী করা, বিরোধিতা না করা এবং তার উপর কিছুকে প্রাধান্য না দেওয়া। যাতে করে সে হক্ব থেকে সরে না যায় এবং সরল-সঠিক পথ থেকে বিপথগামী না হয়।
সপ্তম কারণ : বিভক্তি ও দলাদলি (التفرق والتحزب) :
পূর্বের জাতিগুলো যেমন দলাদলি ও মতানৈক্য দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি উম্মতে মুহাম্মাদীও শতধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলগুলি পরস্পরের নিন্দা করে থাকে এবং প্রতিটি দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়েই খুশী থাকতে চায়। এ সবকিছুই কেবল সঠিক মানহাজ থেকে দূরে থাকার কারণে সৃষ্ট। কিতাব ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা, এ দু’টিকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকা, সে অনুযায়ী আমল করা এবং কোন বিষয়ে পরস্পরের মাঝে বিবাদ দেখা দিলে এ দু’টির দিকে প্রত্যাবর্তন করা...ইত্যাদি মেনে চলার নামই সঠিক মানহাজে চলা। মতভেদ ভুলে সবার মতামতকে একত্রিকরণের একটি মাত্র পথ হ’ল সালাফে ছালেহীনের মাসলাক অনুসরণে সঠিক মানহাজ তথা কুরআন ও সুন্নাতের দিকে পুরোপুরি ফিরে যাওয়া। এতেই বিদ্যমান রয়েছে দলাদলি ও অনৈক্য থেকে বাঁচার উপায় এবং ইহকাল ও পরকালে মুক্তি ও সফলতা। মহান আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلاَ تَفَرَّقُوْا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
‘আল্লাহর কিতাব শক্তভাবে অাঁকড়ে ধরা’-এর ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) বলেন, ‘মানুষের মতামত, তাদের রায়, যুক্তি, পসন্দ, ইচ্ছা ও আবেগ-অনুভূতিকে বাদ দিয়ে স্রেফ আল্লাহর কিতাবের বিধানকে প্রতিষ্ঠা করা এবং হক্ব ও বাতিলের মধ্যকার বিচারক হিসাবে মেনে নেওয়া। যদি কোন ব্যক্তি এমন হ’তে না পারে, তাহ’লে বুঝতে হবে সুদৃঢ়ভাবে ধরা হাতল থেকে তার হাত ফসকে গেছে। আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই দ্বীন পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যা জানা ও আমল করা, ইখলাছ, তাওয়াক্কুল, সাহায্য প্রার্থনা, অনুসরণ এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর উপর অবিচল থাকার মাধ্যমে হ’তে পারে।[15]
ولا تفرقوا ‘তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না’-এর ব্যাখ্যায় ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বিভক্তিকে অপসন্দ করেন এবং এ ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন এবং তা থেকে নিষেধও করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য কথা শ্রবণ, আনুগত্য, ভ্রাতৃত্ব ও সংঘবদ্ধতা পসন্দ করেন। সুতরাং সম্ভবপর তোমরা নিজেদের জন্য সেটাই ভালোবাস যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য ভালোবাসেন। আল্লাহ্ই সর্বশক্তির মালিক। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত সৎকাজ করার ক্ষমতা কারো নেই’।[16]
হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘তিনি তাদেরকে জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপন করতে আদেশ করেছেন এবং বিভেদ সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন। বিচ্ছিন্নতা হ’তে নিষেধ এবং ঐক্য ও সংঘবদ্ধ থাকা সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপ অনেক হাদীছে বিচ্ছিন্নতা ও মতভেদের ভয় দেখানো হয়েছে। অবশেষে সেটিই এই উম্মতের মধ্যে পতিত হ’ল। ফলে তারা ৭৩টি ফির্কায় বিভক্ত হয়ে গেল। তন্মধ্যে নাজী ফির্কা তথা নাজাতপ্রাপ্ত জান্নাতমুখী ও জাহান্নামের শাস্তি হ’তে নিরাপত্তা প্রাপ্ত দল মাত্র একটি। তারাই নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যে পথে চলেছেন সে পথের পথিক।[17]
আল্লাহ তা‘আলা বিভক্তি ও মতভেদ করতে নিষেধ করে বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (আন‘আম ৬/১৫৯)। অত্র আয়াতের তাফসীরে শায়খ আব্দুর রহমান সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন যারা দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং এর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে। আর প্রত্যেকটি দল ইহুদী, নাছারা ও মাজূসী (অগ্নিপূজক) ইত্যাদি নামগুলির মধ্যে থেকে নিজের জন্য একটি নাম পসন্দ করেছে, যা তাদের কোন উপকারে আসবে না। তাছাড়াও তারা শরী‘আতের কিছু অংশ গ্রহণ করে তা দ্বীন হিসাবে মান্য করে আবার কিছু পরিত্যাগও করে। ফলে তারা পূর্ণ ঈমানদার হ’তে পারে না। আর বিদ‘আতী পথভ্রষ্ট ও উম্মতকে বিভক্তকারী দলগুলির বর্তমান অবস্থা এরূপই। আয়াতে কারীমা এ নির্দেশনা দিয়েছে যে, নিশ্চয়ই দ্বীন সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলে এবং দ্বীনের ঊছূল ও শাখা-প্রশাখাসহ যাবতীয় বিষয়ে বিভেদ ও মতভেদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে বলে’।[18]
উম্মতে মুহাম্মাদীর বিভক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
افْتَرَقَتِ الْيَهُوْدُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً، وَافْتَرَقَتِ النَّصَارَى عَلَى اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً، وَسَتَفْتَرِقُ هَذِهِ الْأُمَّةُ عَلَى ثَلاَثٍِ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً كُلُّهَا فِى النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةً، قِيْلَ مَنْ هِيَ يَا رَسُوْلُ اللهِ؟ قَالَ: مَنْ كَانَ عَلَى مِثْلِ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ.
‘ইহুদীরা একাত্তরটি ফির্কায় বিভক্ত হয়েছে। খ্রিষ্টানরা বাহাত্তরটি ফির্কায় বিভক্ত হয়েছে। আর অচিরেই এই উম্মত তিহাত্তরটি ফির্কায় বিভক্ত হবে। একটি দল ব্যতীত সবগুলিই জাহান্নামী। তাঁকে বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সেই (নাজাতপ্রাপ্ত) দল কোন্টি? তিনি বললেন, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে পথে আছি সে পথে যারা চলবে’।[19]
আমাদের পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের রায় ও বাতিলের অনুসরণের কারণে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করেছে। প্রত্যেকটি ফির্কা নিজেকে সঠিক বলে দাবী করত। তেমনি এই উম্মতও বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে, যার মধ্যে একটি বাদে সবগুলিই ভ্রষ্ট। সুপথ প্রাপ্ত সেই দলটিই হ’ল ‘আহ’লে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ তথা আহলেহাদীছ। তারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর একনিষ্ঠ অনুসারী এবং প্রথম সারির ছাহাবীগণ ও তাবেঈগণ সহ মুসলআনদের পূর্বাপর সকল ইমামগণ যে পথে ছিলেন সে পথেরও একনিষ্ঠ অনুসারী।
ইবনু আবিল ঈয্য হানাফী (রহঃ) বলেন, ‘সুতরাং ‘আহ’লে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ ব্যতীত সকল মতভেদকারী ধ্বংস হবে’।[20] অতঃপর সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে মুসলমানদের মাঝে দল বৃদ্ধি পেয়েছে, এখতেলাফ বেড়ে গেছে, বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, প্রবৃত্তিপূজারীদের কারণে ফিৎনা-ফাসাদ সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় উত্তাল হয়ে উঠেছে। তাদের অন্তর সমূহ পরস্পর এমন বিদ্বেষী, ঘৃণাকারী, অত্যাচারী ও তিমিরাচ্ছন্ন হয়েছে যে, কোনটি ভাল আর কোনটি মন্দ তা জানে না এবং খারাপকে ঘৃণাও করে না। কেবল রিপুর কামনা-বাসনার অনুকূলে যা কিছু তাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তা-ই করে’। এমনকি দ্বীনের ঊছূলেও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ্কে এক ও অদ্বিতীয় মানা এবং স্বয়ং ইবাদতের ক্ষেত্রেও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ইতিপূর্বে যারা বিভিন্ন তরীকার অনুসরণ করতে গিয়ে মতবিরোধ করেছে, উম্মতে মুহাম্মাদীও তাদের মত হয়ে গেছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এই বলে,لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوْا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوْهُ. قُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ، الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ. ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের হুবহু অনুসরণ করবে। এমনকি তারা যদি সাপের গর্তে প্রবেশ করে তোমরাও তাই করবে’। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কী ইহুদী ও নাছারা? তিনি বললেন, ‘(ওরা যদি না হয়) তাহ’লে কারা’?[21]
কিন্তু মহান আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহে ও অসীম দয়ায় ক্বিয়ামত পর্যন্ত একটি দল হক্বের উপর বিজয়ী থাকবে। মু‘আবিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِى أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللهِ، لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلاَ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ-
‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমার উম্মতের মধ্য থেকে একটি দল আল্লাহর নির্দেশে চিরদিন (হকের উপরে) টিকে থাকবে। শত্রুরা ও বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি ক্বিয়ামত আসা পর্যন্ত তাঁরা এভাবেই থাকবে’।[22]
এই দলটির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে শিরক ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটন করে তাওহীদ ও সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। যখনই শিরক দ্বারা তাওহীদ এবং বিদ‘আত দ্বারা সুন্নাত কলুষিত হয়, তখনই আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাধ্যমে তা দূর করেন। তাঁরা ক্বিয়ামত পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহ্কে নিঃশর্তভাবে মেনে নিয়ে হক্বের দা‘ওয়াত দিয়ে যাবেন। তাঁরা পৃথিবীর বুকে শিরক ও বিদ‘আত মুক্ত ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে এক আল্লাহর রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে দা‘ওয়াতী মিশন অব্যাহত রাখবেন। তাঁরাই ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ তথা আহলেহাদীছ। হে আল্লাহ্! তুমি আমাদেরকে সে দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তাওফীক্ব দান কর-আমীন!
[1]. মোল্লা আলী ক্বারী প্রণীত শরহ ক্বাছীদাহ আমালী-র বরাতে হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (মুম্বাই : দাঊদ রায কর্তৃক সংশোধিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ, তাবি), পৃঃ ৪৪; তিনটি মতবাদ, পৃঃ ৬।
[2]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৮৫০; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/২০৮৪৬, সনদ ছহীহ।
[3]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ, ১/১৫২-৫৩ পৃঃ, ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[4]. ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন,‘কারো তাক্বলীদ করে ফৎওয়া দেওয়া’ অধ্যায় ২/৮৬ পৃঃ।
[5]. ইমাম নববী, আল-মাজমূ, ১/৬৩ পৃঃ।
[6]. ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন, ২/৩০২ পৃঃ।
[7]. ইবনু কাছীর ৩/৩৩৫।
[8]. ইবনু তায়মিয়া, ইক্বতিযাউছ ছিরাত্বিল মুস্তাক্বীম, পৃঃ ৫২।
[9]. ইবনু রজব, জামিঊল ঊলূম ওয়াল-হিকাম, পৃঃ ২৭২।
[10]. ই-ক্বাযুল হিম্মাহ লিত্তাবাঈ নাবিয়্যিল উম্মাহ, পৃঃ ২৯।
[11]. ইবনু বাত্ত্বা, আল-ইবানা ২/৪৩৮।
[12]. দারেমী ১/১২০; শারহু ঊছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাত ১/১৩৪।
[13]. ইবনু বাত্ত্বা, আল-ইবানা ২/৪৩৯।
[14]. ইবনু আবী ইয়া‘লা, ত্বাবাক্বাতুল হানাবিলা ২/৪।
[15]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ৩/৩২৩।
[16]. ত্বাবারী ৪/৩২।
[17]. ইবনু কাছীর ১/৪০৫।
[18]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান ২/৯১।
[19]. আবূদাঊদ হা/৪৫৯৬; তিরমিযী হা/২৬৪০; সিলসিলা ছহীহাহ ৩/৪৮০।
[20]. শারহুত ত্বাহাবী, পৃঃ ৪৩২।
[21]. বুখারী হা/৩৪৫৬; মুসলিম হা/১৬৬৯।
[22]. বুখারী হা/৩৬৪১; মুসলিম হা/১০৩৭।