ত্যাগ স্বীকারের উপকারিতা
৪. সম্মান ও মর্যাদা বুলন্দ হয় :
পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হ’তে চায়। কিন্তু মর্যাদামন্ডিত কোন মহৎ কর্ম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট ছাড়া সফল হয় না। পথ দীর্ঘ দেখে পথিক যদি তার যাত্রা বন্ধ রাখে অথবা কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসে, তবে সে কোন দিন গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। সেখানে পৌঁছতে হ’লে তাকে পথের ক্লান্তি স্বীকার করতেই হবে। স্বীকার করতে হবে পথের সকল প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা। ঠিক সেভাবেই দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মানিত জীবন লাভের জন্য বান্দাকে কষ্ট স্বীকার করা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। সেই ত্যাগ আর্থিক, শারীরিক, মানসিক প্রভৃতি মাধ্যমে হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন,أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ، ‘তোমরা কি ভেবেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জেনে নেননি কারা তোমাদের মধ্যে জিহাদ করেছে এবং কারা তোমাদের মধ্যে ধৈর্যশীল?’ (আলে ইমরান ৩/১৪২)। এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা ও মর্যাদা লাভের উপায় হ’ল আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং দ্বীনের পথে আপতিত যাবতীয় বিপদাপদে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা।
অনুরূপভাবে যারা রাতের বেলা আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে পারে, আল্লাহ তাদের মর্যাদামন্ডিত জীবন দান করেন। একদিন জিবরীল (আঃ) এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন,يَا مُحَمَّدُ شَرَفُ الْمُؤْمِنِ قِيَامُ اللَّيْلِ، ‘হে মুহাম্মাদ! মুমিনের মর্যাদা হ’ল ইবাদতে রাত্রি জাগরণ করা’।[1] অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগীতে বান্দা যে কষ্ট স্বীকার করে, তার বিনিময়ে তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত করা হয়। ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ সহ যুগে যুগে হকপন্থী ওলামায়ে কেরাম শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, বঞ্চনার স্বীকার হয়েছেন, কিন্তু কখনো সত্য থেকে একবিন্দু সরে আসেননি। এই আত্মত্যাগের কারণে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে ও দো‘আ করবে। অপরদিকে তাদের আপোষকামী আলেমদের মানুষ কখনো স্মরণ করে না এবং তাদের জন্য দো‘আও করে না। অনুরূপভাবে পৃথিবীতে যত মনীষী ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তা কেবল তাদের ত্যাগের কারণেই। সুতরাং জান্নাতের কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে হ’লে জান্নাত পিয়াসী মুমিনকে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। দ্বীনের পথে যেকোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার করা ব্যতীত বান্দা সফলতা ও মর্যাদার চূড়ায় পৌঁছতে পারে না। তাই তো কবি বলেন,
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?
৫. ঈমান পাকাপোক্ত হয় :
নরম মাটিকে পোড়ানো হ’লে সেটা যেমন শক্ত ইটে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে বিপদের ঝাপটা ও কষ্টের কষাঘাতে বান্দার ঈমান পাকাপোক্ত ও মযবূত হয়। আল্লাহ বলেছেন,لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ‘অবশ্যই তোমরা পরীক্ষায় পতিত হবে তোমাদের ধন-সম্পদে ও তোমাদের নিজেদের জীবনে। আর তোমরা অবশ্যই শুনবে তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের কাছ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। যদি তোমরা তাতে ধৈর্যধারণ কর ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন কর, তবে সেটাই হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ’ (আলে ইমরান ৩/১৮৬)। মুফাসসিরগণ বলেন,أن استمساك المؤمن بإيمانه يقتضيه جهادا وتضحية، بالنفس والمال، والأهل والولد، والوطن، ‘ঈমান গ্রহণ করার কারণে মুমিন বান্দাকে জান, মাল, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি এবং মাতৃভূমি বিসর্জন দিতে হয় এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়’।[2] ফলে নানামুখী ত্যাগ-তিতিক্ষার বদৌলতে তার ঈমান অদৃশ্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে।
৬. ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া :
যারা দ্বীনের পথে চলে, তারা নিশ্চিতভাবে বালা-মুছীবত ও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন। তাদের ঈমান যত মযবূত হবে, বিপদাপদে ত্যাগ স্বীকারের পরীক্ষাটাও অনেক বড় হবে। মূলতঃ আল্লাহ তাঁর বান্দার ঈমানের মাত্রানুযায়ী তাকে মুছীবতের সম্মুখীন করেন এবং তার ত্যাগ স্বীকারের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। তারপর তার পাপরাশি ক্ষমা করে তাকে পবিত্র করেন। সুতরাং এটা মনে রাখতে হবে যে, ঈমান আনলে ত্যাগ স্বীকারের পরীক্ষা দিতেই হবে। আল্লাহ বলেন, أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ- ‘মানুষ কি মনে করে যে, তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে কেবল এতটুকু বললেই যে, আমরা ঈমান এনেছি। অথচ তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমরা তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা নিয়েছি। অতএব আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা (তাদের ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী এবং অবশ্যই জেনে নিবেন কারা (তাতে) মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/২-৩)।
ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেন, এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, হে মুহাম্মাদ! তোমার যে সকল ছাহাবী মুশরিকদের পক্ষ থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা কি মনে করেছে যে, আমি কোন পরীক্ষা না নিয়ে এবং এমনিতেই তাদের ছেড়ে দেব?[3]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,أَنَّ اللهَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى لَا بُدَّ أَنْ يَبْتَلِيَ عِبَادَهُ الْمُؤْمِنِينَ بِحَسْبِ مَا عِنْدَهُمْ مِنَ الْإِيمَانِ، ‘মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের ঈমানের পরিমাণ অনুযায়ী তাকে অবশ্যই পরীক্ষা করবেন’।[4]
মূলতঃ মুমিন বান্দার পাপরাশি ক্ষমা করার জন্যই আল্লাহ তাকে বিবিধ পরীক্ষার কষ্টে নিপতিত করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلَاؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَمَا يَبْرَحُ البَلَاءُ بِالعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ، ‘মানুষকে তার দ্বীনদারীর অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। যার দ্বীন যত বেশী মযবূত হয়, তার পরীক্ষাটাও কঠিন হয়ে থাকে। আর সে যদি তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে, তাহ’লে তাকে সে অনুযায়ী পরীক্ষায় ফেলা হয়। এভাবে বান্দার ওপর বিপদাপদ লেগেই থাকে। অবশেষে তাকে এমনভাবে ছেড়ে দেয় যে, সে যমীনে চলাফেরা করে, অথচ তার কোন পাপই থাকে না’।[5] অপর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكُ شَوْكَةً، فَمَا فَوْقَهَا إِلَّا كُتِبَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ، ‘যে কোন মুসলিমের গায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ হ’লে কিংবা তার চেয়েও ছোট কোন আঘাত লাগলে, এর বিনিময়ে তার এক স্তর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তার একটি গুনাহ ক্ষমা করা হয়’।[6] সুতরাং দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে মুমিনের জীবনে যত ক্ষুদ্র কষ্ট আসুক না কেন, এর বিনিময়ে তার পাপরাশি ক্ষমা করা হয়।
৭. আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি :
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের অন্যতম বড় উপকারিতা হচ্ছে এর মাধ্যমে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি লাভ করা। মহান আল্লাহ সূরা ছফে ঈমান ও জিহাদকে লাভজনক ব্যবসার সাথে তুলনা করেছেন, যে ব্যবসার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ، تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হ’তে মুক্তি দিবে? তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে। সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ’ (ছফ ৬১/১০)।
ঈমানের পথে চলতে হ’লে জান-মাল, সময়-শ্রম বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে এবং যে কোন ধরনের জিহাদ করার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আর এই ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, জিহাদ চার প্রকার- (১) নফসের সাথে জিহাদ (২) শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ (৩) কাফের ও মুনাফেকদের সাথে জিহাদ এবং (৪) যালেম, গুনাহগার ও বিদ‘আতীদের সাথে জিহাদ। এই চার প্রকার জিহাদের মধ্যে নিজের নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর সকল অবস্থায় ফরযে আইন। আর পরের দু’টি ব্যাখ্যা ও শর্তসাপেক্ষ জিহাদ।[7]
তিনি আরো বলেন, নফসের সাথে জিহাদের চারটি স্তর রয়েছে : (১) দ্বীনে হক্ব ও হেদায়াতের জ্ঞান অর্জনে চেষ্টা করা এবং এর উপর নফসকে বাধ্য করা। কারণ দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া সাফল্য লাভের কোন সুযোগ নেই। বান্দা তা অর্জনে ব্যর্থ হ’লে ইহকাল ও পরকালে সে হতভাগ্য হবে। (২) ইলম অর্জন করার পর ইলমকে আমলে পরিণত করা। কারণ আমল ছাড়া ইলম বান্দার কোন উপকারে আসবে না। (৩) মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার মাধ্যমে জিহাদ করা এবং অজ্ঞদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়া। অন্যথা সে আল্লাহর নাযিলকৃত হেদায়াত ও সত্য গোপন করার অপরাধে অপরাধী হবে এবং তার ইলম অন্যের উপকার করলেও তার নিজের কোন উপকার করবে না, আর তাকে আল্লাহর আযাব থেকেও রক্ষা করবে না। (৪) আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের কাজে যে সমস্ত বিপদ আসে বান্দা তার উপর নফসকে ছবর করতে বাধ্য করা। মানুষ তাকে কষ্ট দিলেও সে ধৈর্যধারণ করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সে সব কিছুই মাথা পেতে মেনে নিবে। যার ভিতরে এই চারটি গুণ পাওয়া যাবে সে আল্লাহওয়ালা হ’তে পারবে।
আর শয়তানের সাথে জিহাদের দু’টি স্তর রয়েছে : (১) ঈমান নষ্ট করার জন্য শয়তান যে সমস্ত সন্দেহ এবং ওয়াসওয়াসা বান্দার অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেয় তা প্রতিহত করার সংগ্রাম করা এবং (২) শয়তান মানুষের অন্তরে পাপ কাজের প্রতি যে আগ্রহ ও আসক্তি নিক্ষেপ করে তা প্রতিহত করার সংগ্রামে সদা প্রচেষ্টা চালানো।[8]
৮. প্রভূত নেকী অর্জন :
আল্লাহর পথে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করা নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত, যার মাধ্যমে পাপ ক্ষমা হয় এবং প্রভূত নেকী অর্জিত হয়। জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,يَوَدُّ أَهْلُ العَافِيَةِ يَوْمَ القِيَامَةِ حِينَ يُعْطَى أَهْلُ البَلَاءِ الثَّوَابَ لَوْ أَنَّ جُلُودَهُمْ كَانَتْ قُرِضَتْ فِي الدُّنْيَا بِالـمَقَارِيضِ، ‘ক্বিয়ামতের দিন বিপদে পতিত ব্যক্তিদের যখন প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন (পৃথিবীর) বিপদ মুক্ত মানুষেরা আক্ষেপ করে বলবে হায়! দুনিয়াতে যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চমড়া কেটে টুকরা টুকরা করে দেওয়া হ’ত’![9] ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এই হাদীছ দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কষ্ট ও দুর্দশার মাধ্যমে নেকী অর্জিত হয়। তাইতো নবীগণ সবচেয়ে বেশী বিপদগ্রস্ত মানুষ ছিলেন।[10] এজন্য সালাফগণ বলেন,لولا مصائب الدنيا لوردنا القيامة مفاليس، ‘যদি আমাদের উপর দুনিয়ার বালা-মুছীবত না থাকত, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন আমাদেরকে নিঃস্ব অবস্থায় উপস্থিত হ’তে হ’ত’।[11]
শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেন,الله عز وجل يبتلي عباده بالسراء والضراء وبالشدة والرخاء، وقد يبتليهم بها لرفع درجاتهم وإعلاء ذكرهم ومضاعفة حسناتهم كما يفعل بالأنبياء والرسل عليهم الصلاة والسلام والصلحاء من عباد الله، ‘মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সুখ-দুঃখ, কষ্ট-স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতির মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি তাদের পরীক্ষায় ফেলেন এই কারণে যে, (এর মাধ্যমে) তিনি তাদের মর্যাদা সমুন্নত করেন, তাদের সম্মান বৃদ্ধি করেন এবং তাদের প্রতিদান বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। যেমনভাবে তিনি নবী-রাসূলগণকে এবং তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন’।[12] অতঃপর তিনি হাদীছ বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَشَدُّ النَّاسِ بَلاَءً الأَنْبِيَاءُ، ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، ‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিপদগ্রস্ত মানুষ হ’লেন নবীগণ। এরপর যারা নেককার তারা। অতঃপর যারা নেককার তারা।[13]
৯. আল্লাহর নৈকট্য ও জান্নাত লাভ :
জান্নাতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কাঁটা বিছানো পথ মাড়িয়ে বান্দাকে জান্নাতে পৌঁছাতে হয়। মুমিনের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিপদাপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে নে‘মত স্বরূপ, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও জান্নাত লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ عِظَمَ الجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ البَلَاءِ، وَإِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلَاهُمْ، فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ، ‘বড় বড় বিপদ-মুছীবতের শুভ পরিণামে রয়েছে বড় বড় পুরষ্কার। আল্লাহ কোন জাতিকে ভালোবাসলে তাদেরেকে বিভিন্ন বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। যারা এতে সন্তুষ্ট থাকে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যারা এই বিপদে নাখোশ হয়, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’।[14] সুতারাং দ্বীনের পথে বিপদের কষ্ট সহ্য না করা ব্যতীত জান্নাত পাওয়া সম্ভব নয়।
খাববাব ইবনুল আরাত্ব (রাঃ) বলেন, একদিন আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট হাযির হ’লাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা‘বা গৃহের ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। আমরা মুশরিকদের পক্ষ হ’তে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম। তাই আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন,لَقَدْ كَانَ مَنْ قَبْلَكُمْ لَيُمْشَطُ بِمِشَاطِ الحَدِيدِ، مَا دُونَ عِظَامِهِ مِنْ لَحْمٍ أَوْ عَصَبٍ، مَا يَصْرِفُهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُوضَعُ المِنْشَارُ عَلَى مَفْرِقِ رَأْسِهِ، فَيُشَقُّ بِاثْنَيْنِ مَا يَصْرِفُهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، ‘তোমাদের পূর্বের ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত তামাম গোশত ও শিরা উপশিরাগুলি লোহার চিরুণী দিয়ে অাঁচড়ে বের করে ফেলা হ’ত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দ্বীন হ’তে বিমুখ করতে পারত না। তাদের মধ্যে কারো মাথার মাঝখানে করাত রেখে তাকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হ’ত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারত না’।[15] সেকারণ আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ، ‘নিশ্চয়ই আললাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে’ (তওবা ৯/১১১)।
অর্থাৎ বান্দা যদি তার জান-মাল উৎসর্গ করে দিয়ে দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাহ’লে এর বিনিময়ে সে জান্নাত পাবে। আল্লাহ আরো বলেন,أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيبٌ، ‘তোমরা কি ধারণা করেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের উপর এখনও তাদের মত অবস্থা আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। নানাবিধ বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেছিল ও তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। অবশেষে রাসূল ও তার সাথী মুমিনগণ বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতীব নিকটবর্তী’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)।
আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন, এই আয়াতটি খন্দকের দীর্ঘ প্রায় এক মাসব্যাপী যুদ্ধের শেষ দিকে নাযিল হয় এবং এরপরেই আল্লাহর হুকুমে ঝড়-ঝঞ্ঝা নাযিলের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ও শত্রু পক্ষ পালিয়ে যায়।[16] ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, যখন মুহাজিরগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসূলের ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজেদের সহায়-সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর মুশরিকদের কাছে রেখে মদীনায় চলে আসলেন এবং মদীনায় ইহুদীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হ’লেন, তখন আল্লাহ তাদের সান্ত্বনা দিয়ে অত্র আয়াত নাযিল করেন।[17] অত্র আয়াতে সকল যুগের ত্যাগী বান্দাদের বিজয় ও জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
১০. আল্লাহর দীদার লাভ :
জান্নাতের সবচেয়ে বড় নে‘মত হ’ল আল্লাহকে দর্শন। মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদ দেখতে যেমন কষ্ট হয় না; তদ্রূপ কোন প্রকার কষ্ট ছাড়াই মুমিন বান্দারা জান্নাতে আল্লাহর দীদার লাভ করবে। আল্লাহ বলেন, وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ، ‘সেদিন অনেক চেহারা হবে উজ্জ্বল। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২২-২৩)। আল্লাহর পথের ত্যাগী বান্দারা বিশেষভাবে তাদের প্রভুর দীদার লাভে ধন্য হবে। যেহেতু তারা পার্থিব দুঃখ-কষ্ট ও
নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না, তাই এই অস্থায়ী কষ্ট ভোগের পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللهِ لآتٍ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ، وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ إِنَّ اللهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর দীদার কামনা করে (তার জানা উচিৎ যে,) আল্লাহর সেই নির্ধারিত সময়টি আসবেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। আর যে ব্যক্তি (আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার জন্য) সর্বাত্মক চেষ্টা করে সে ব্যক্তি তার নিজের (কল্যাণের) জন্যই সেটা করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্ববাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন’ (আনকাবূত ২৯/৫-৬)।
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, আল্লাহ মুমিন বান্দার এই অস্থায়ী কষ্টের জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করেছেন। আর সেটি হচ্ছে আল্লাহর দীদার। বান্দা যেই স্বাদ উপভোগ করার জন্য কষ্ট ভোগ করেছে, সেদিন সে এই অফুরন্ত স্বাদ গ্রহণ করবে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে স্বীয় সাক্ষাৎ প্রদানের ওয়াদা করেছেন। যাতে বান্দা তাঁর সাক্ষাতের আশায় ক্ষণস্থায়ী দুঃখ-কষ্ট সহজেই ভোগ করতে পারে। বরং কখনও কোন কোন বান্দার অবস্থা এমন হয় যে, সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভের আগ্রহে ডুব দিয়ে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায় এবং এক পর্যায়ে তা আর অনুভবও করে না। এজন্যই নবী করীম (ছাঃ) তাঁর প্রভুর সাক্ষাৎ লাভের জন্য সবসময় দো‘আ করতেন’।[18]
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের তাওফীক্ব দান করুন এবং এর মাধ্যমে আলোচ্য উপকারিতা হাছিলের সুযোগ দানে ধন্য করুন- আমীন! [চলবে]
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ (অধ্যায়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪২৭৮; মুস্তাদরাক হাকেম হা/৭৩২১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯০৩; সনদ হাসান।
[2]. আত-তাফসীরুল কুরআন লিল কুরআন ১১/৪৭০।
[3]. তাফসীরে ত্বাবারী ১৯/৭।
[4]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ৬/২৬৩।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩; দারেমী হা/২৮২৫; মিশকাত হা/১৫৬২ সনদ হাসান।
[6]. মুসলিম হা/২৫৭২; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৬০।
[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ৩/৯,১১।
[8]. যাদুল মা‘আদ ৩/৯-১০।
[9]. তিরমিযী হা/২৪০২; মিশকাত হা/১৫৭০ সনদ হাসান।
[10]. ত্বীবী, আল-কাশেফ ‘আন হাক্বায়িক্বিস সুনান (শারহুল মিশকাত) ৪/১৩৫১।
[11]. আব্দুল আযীয সালমান, মাওয়ারিদুয যামআন ২/৩৭৪।
[12]. ইবনু বায, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ৪/৩৭০।
[13]. তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩ সনদ ছহীহ।
[14]. তিরমিযী হা/২৩৯৬; ছহীহাহ হা/১৬৪; মিশকাত হা/১৫৬৬ সনদ হাসান।
[15]. বুখারী হা/৩৮৫২।
[16]. শাওক্বানী, আল-ফাৎহুল ক্বাদীর ১/২৪৭।
[17]. তাফসীরে কুরতুবী ৩/৩৪।
[18]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৪-১৫।