পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯। পর্ব ১০। পর্ব ১১। পর্ব ১২। পর্ব ১৩। পর্ব ১৪। পর্ব ১৫। পর্ব ১৬।
ন্যায় বিচার প্রসঙ্গ
Article-10 : Every one is entitled in full equality to a fair and public hearing by and independent and impartial tribunal, in the determination of his rights and obligations and of any criminal charge against him. ‘কেউ অপরাধী বলে অভিযুক্ত হ’লে তিনি তার অধিকার এবং দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে প্রকাশ্যে বিচারের দাবী করতে পারবেন’ (অনুঃ ১০)।
অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে আটক করা হ’লে এবং তিনি অভিযুক্ত হ’লে তার অধিকার ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করার জন্য তিনি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে প্রকাশ্যে বিচারের দাবী করতে পারবেন। এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির যথার্থ বিচার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার প্রতি যেন কোনরূপ খারাপ আচরণ না করা হয় এবং তিনি যেন ন্যায়বিচার পান সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ২৭ ধারাতেও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
বর্তমানে আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায় উল্লেখ রয়েছে যে, কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি কোন আদালতে ন্যায়বিচার পাবে না বলে মনে করেন, তবে তিনি বাংলাদেশের ফৌজদারী আইনের ৫২৬ (খ) ৫২৮ ধারা অনুযায়ী ঐ আদালত পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু এ কথা সত্য যে, আসামী নিরপেক্ষ (?) আদালতে গিয়েও যে ন্যায়বিচার পাবেন তারও কোন গ্যারান্টি নেই। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেগুলো পরে আলোচনা করা হবে।
Article-11 (1) : Every one charged with a penal offence has the right to be presumed innocent until proved guitly according to law in a public trial at which he has had all the guarantees necessary for his defence. ‘কেউ অভিযুক্ত হ’লে দোষী সাব্যস্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশ্য আদালতে আইনের আওতায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সকল সুযোগ-সুবিধা দাবী করতে পারবেন’।
অর্থাৎ কোন ব্যক্তি নিজেকে আদালতে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য সব কিছু উপস্থাপন করতে পারবে। এজন্য জামিনের ব্যবস্থা রয়েছে। তাকে কোনরূপ হয়রানি বা শাস্তি প্রদান করা যাবে না। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে যে হত্যা করা হচ্ছে সেগুলোও করা যাবে না। কারণ অনেক সময় নীরিহ মানুষও এর শিকারে পরিণত হ’তে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে এই আইনের ধারাটির লংঘন বেশী দেখা যাচ্ছে।
(2). No one shall be held guilty of any penal offence on account of any act or omission which did not constitute a penal offence under national and international law, at the time when it was committed. Non shall a heavier penalty be imposed than the one that was applicable at the time the penal offence was committed. ‘কেউ যদি কখনও এমন কাজ করেন যা রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে দোষণীয় নয়, তাহ’লে পরবর্তী পর্যায়ে অন্য কোন আইনের আওতায় ঐ কাজের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। যদি ঐ সময় দোষণীয় কিছু করেও ফেলেন তবে পরবর্তী কালে ঐ দোষের জন্য তাকে পূর্বের অবস্থায় প্রাপ্য সাজার চাইতে অধিকতর সাজা দেয়া যাবে না’।
এখানে রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে ব্যক্তির কোন কাজ যদি দোষণীয় বলে প্রমাণিত না হয় এবং পরবর্তীতে যদি অনুরূপ কোন কারণে দোষী সাব্যস্ত হয় তবে পূর্বোক্ত অপরাধের কারণে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। এমনকি তার জন্য বেশী শাস্তিও দেয়া যাবে না। অর্থাৎ একটা অপরাধের শাস্তি অন্য অপরাধের মধ্যে গণ্য করা যাবে না। আমাদের দেশ সহ বিভিন্ন দেশে এ সকল আইনের অপ্রয়োগ হচ্ছে বটে।
ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ :
এ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হ’ল মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার না থাকলে মানুষ পশুর মত হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বে মানব রচিত আইন ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আদেশ করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তাঁর বিধানকে বাস্তবায়নের জন্য। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ ‘তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি’ (শূরা ৪২/১৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَن تَحْكُمُواْ بِالْعَدْلِ ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন তা ন্যায় পরায়ণতার সাথে করবে’ (নিসা ৪/৫৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاء لِلّهِ وَلَوْ عَلَى أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالأَقْرَبِينَ إِن يَكُنْ غَنِيّاً أَوْ فَقَيراً فَاللهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلاَ تَتَّبِعُواْ الْهَوَى أَن تَعْدِلُواْ وَإِن تَلْوُواْ أَوْ تُعْرِضُواْ فَإِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيراً ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও এটা তোমাদের নিজের অথবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, যদি সে সম্পদশালী বা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহই তাদের জন্য যথেষ্ট। অতএব সুবিচারে স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না এবং যদি তোমরা বক্রতা অবলম্বন কর বা পশ্চাৎপদ হও, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সমস্ত কর্মের পূর্ণ সংবাদ রাখেন’ (নিসা ৪/১৩৫)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ كُوْنُوْا قَوَّامِيْنَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটা তাক্বওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহ্কে ভয় করবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন’ (মায়েদা ৫/৮)।
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُواْ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى ‘যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায় কথাই বলবে, তোমার নিকট আত্মীয় হ’লেও’ (আন‘আম ৬/১৫২)।
ন্যায়বিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরও বলেন,وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيْهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالأَنْفَ بِالأَنْفِ وَالأُذُنَ بِالأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوْحَ قِصَاصٌ ‘আমরা তাদের জন্য এতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখমের বদলে অনুরূপ কিছাছ (যখম)’ (মায়েদাহ ৫/৪৫)।
আল্লাহ তাঁর বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করার জন্য মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর যারা তার বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না কুরআন মাজীদে তাদেরকে কাফির, যালিম ও ফাসিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে (মায়েদাহ ৫/৪৫-৪৭)।
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে অসংখ্য নযীর পাওয়া যায়। একদিন অভিজাত বংশের ফাতিমা নাম্নী এক নারী চুরি করে বসল। উসামা (রাঃ) তাকে মাফ করে দেওয়ার সুপারিশ করলে মহানবী (ছাঃ) কঠোর ভাষায় বললেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি সমূহ এজন্যই ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের সাধারণ লোকরা চুরি করলে শাস্তি কার্যকর করত। কিন্তু অভিজাত লোকরা চুরি করলে তাদের কোন শাস্তি দিত না। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম।[1]
ন্যায়বিচার সম্পর্কে বিচারকদের উদ্দেশ্যে ওমর (রাঃ) বলেন, وعلى القاضي أن يتحرى الحق فيبتعد عن كل ما من شأنه أن يشوش فكره فلا يقضي أثناء الغضب الشديد أو الجوع المفرط أ و الهم المقلق أو الخوف المزعج أو النعاس الغالب أو الحر الشديد أو البرد الشديد أو شغل القلب شغلا يصرف عن المعرفة الصحيحة والفهم الدقيق. ‘বিচারকের উচিত হক অনুসন্ধান করে ঐ সকল বিষয় থেকে দূরে থাকা যা তার চিন্তাকে এলোমেলো করে দেয়। কাজেই কঠিন ক্রোধ, তীব্র ক্ষুধা, চিন্তা, অস্থিরকারী ভয়, তন্দ্রা, কঠিন গরম বা তীব্র শীত, এমন মানসিক অবস্থা যা সঠিক ও সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি থেকে বিরত রাখে এ সকল অবস্থায় বিচারক বিচার করবেন না’।[2]
বুরায়দা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْقُضَاةُ ثَلاَثَةٌ وَاحِدٌ فِى الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِى النَّارِ فَأَمَّا الَّذِى فِى الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِى الْحُكْمِ فَهُوَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِى النَّارِ ‘বিচারক তিন শ্রেণীর। তন্মধ্যে দু’শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী এবং এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী। যিনি জান্নাতে যাবেন তিনি হলেন ঐ বিচারক, যিনি হক বুঝে সে অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করেন। দ্বিতীয় প্রকার ঐ বিচারক, যিনি সত্যকে জানেন কিন্তু বিচার-ফায়ছালায় যুলুম করেন, তিনি জাহান্নামী। তৃতীয় প্রকার বিচারক তিনি, যিনি অজ্ঞতার উপর মানুষের বিচার-ফায়ছালা করেন, তিনি জাহান্নামী’।[3]
বিচারকগণের কোন রায় প্রদানের সময় রাগান্বিত হ’লে চলবে না। যেমন হাদীছে এসেছে, আব্দুর রহমান বিন আবু বাকরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু বাকরা (রাঃ) তাঁর ছেলেকে লিখে পাঠালেন- তখন তিনি সিজিস্তানে অবস্থান করছিলেন- তুমি রাগান্বিত অবস্থায় দু’ব্যক্তির মাঝে বিচার-ফায়ছালা করবেন না। কেননা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, لاَ يَقْضِيَنَّ حَكَمٌ بَيْنَ اثْنَيْنِ وَهْوَ غَضْبَانُ ‘কোন বিচারক যেন রাগান্বিত অবস্থায় দু’জনের মধ্যে বিচার-ফায়ছালা না করে’।[4]
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের আচরণ যেমন হওয়া উচিত :
(ক) মোকদ্দমার বিবরণ শান্ত মেযাজে ও গভীর মনোনিবেশের সাথে শ্রবণ করা।
(খ) বাদী ও বিবাদীকে সম্মুখে বসানো।
(গ) বাদী ও বিবাদী কোন পক্ষের সাথে পক্ষপাতমূলক আচরণ না করা, যাতে অন্য পক্ষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
(ঘ) সাক্ষীগণের সাথে এমন আচরণ না করা, যাতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যথার্থ সাক্ষ্য প্রদানে অক্ষম হয়ে পড়ে।
(ঙ) বাদী-বিবাদী কোন পক্ষকে ভীত-সন্ত্রস্ত না করা।
(চ) প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কিংবা অন্যের আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক মোকদ্দমার রায় প্রদান না করা।
(ছ) মোকদ্দমার রায় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তা একান্তভাবে গোপন রাখা।
(জ) আদালতের বিচারকার্যের আগে সংশ্লিষ্ট কার্য ব্যতীত অন্য কোন কাজ না করা।
(ঝ) কর্কশ ভাষী, নিষ্ঠুর বা উৎপীড়ক না হওয়া।
(ঞ) ক্রোধান্বিত, ক্ষুধার্ত ও ঘুম জড়িত, তন্দ্রাচ্ছন্ন অথবা ব্যক্তিগত কারণে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিচারকার্য পরিচালনা না করা।
(ট) যতক্ষণ পর্যন্ত শান্ত মনে ও নিবিষ্টচিত্তে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব, ততক্ষণ বিচারকার্য পরিচালনা করা এবং বিরক্তি বা শ্রান্তিবোধ হ’লে বিচারকার্য মুলতবী করা।
(ঠ) স্বীয় আত্মীয়-স্বজন পরস্পরের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করলে তাড়াহুড়া না করে তাদের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করা।
(ড) ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত না হওয়া।
(ঢ) বাদী-বিবাদী কারো নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ না করা।
(ণ) আত্মীয় ব্যতীত কারো নিকট হ’তে কোন উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ না করা।
(ত) কোন জানাযায় শরীক হ’লে এবং রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গেলে তথায় বেশীক্ষণ অবস্থান না করা; রুগ্ন ব্যক্তি বাদী বা বিবাদী হ’লে তাদেরকে দেখতে না যাওয়া।
(থ) বাদী বা বিবাদীর কোন আহার্যের দাওয়াত গ্রহণ না করা।
(দ) একনিষ্ঠভাবে শরী‘আতের অনুসরণ করা।
(ধ) ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যোগ্যতা ও সততার প্রতীক হওয়া, যাতে লোকেরা তার প্রতি আস্থাশীল হয়।
(ন) জনগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং নিজ কর্মচারীগণকেও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া।[5]
উল্লেখ্য, ওমর (রাঃ) আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে যে দীর্ঘ পত্র লেখেন,[6] উপরোক্ত বক্তব্যগুলো তারই সারাংশ।
পর্যালোচনা :
জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ১০ ও ১১ নং ধারার আলোকে ন্যায়বিচার বিষয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে সে ব্যাপারে ইতিপূর্বে জাতিসংঘ সনদের ৫, ৬ ও অন্যান্য ধারাতে প্রসঙ্গতঃ কিছুটা ধারণা দেয়া হয়েছে। তবে আলোচ্য ১০নং ধারাতে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাবার ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা বিচারকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রতি তাকীদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ উক্ত আদালতের বিচারককের নিকট অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাবেন বিধায় সে সকল আদালতের আশ্রয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে। তাহলে এর দ্বারা একথা স্পষ্ট হয় যে, বর্তমানে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে আদালত রয়েছে তার সবগুলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নয়। কারণ জাতিসংঘের এই সনদে ‘স্বাধীন ও নিরপেক্ষ’ শব্দগুলো যোগ করে সনদটিকে প্রথমেই বিতর্কিত ও দুর্বল করে তোলা হয়েছে। আরো প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সকল আদালত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নয়।
পক্ষান্তরে ইসলামী আদালতে এ সকল বিশেষণবাচক অতিরিক্ত শব্দ যোগ করার কোন প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ইসলামী আদালত বলতে বুঝায় কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা। এখানে কম-বেশী করার কারো কোন সুযোগ নেই। তবে যুগসন্ধিক্ষণে যে সমস্যার সমাধান কুরআন-হাদীছে সরাসরি পাওয়া যায় না তখন ইসলামী জ্ঞানে পন্ডিতগণ ইজতিহাদের মাধ্যমে[7] তার সমাধান দিতে পারেন। কারণ ইসলামে ইজতিহাদের দরজা কিয়ামত অবধি খোলা রয়েছে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত। মানবাধিকার সনদের ১০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘স্বাধীন ও নিরপেক্ষ’ আদালতে ন্যায়বিচারের দাবী করতে পারবেন। কিন্তু এখানে একথার কোন গ্যারান্টি নেই যে, উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রকৃত ন্যায়বিচার পাবেন কি-না? তবে এ কথা সত্য যে, মানব রচিত বিধানানুযায়ী এই আইনে ন্যায়বিচার পাবে না। কারণ এর পদ্ধতি, প্রণয়ন ও প্রয়োগে রয়েছে প্রচুর ভুল।
প্রচলিত এই আইন পরিবর্তনশীল, সংশোধনযোগ্য এবং এর ব্যবহার যথার্থ নয়। ভারতে ১৯৫০ সালে তাদের সংবিধান চালুর পর থেকে ৩ জানুয়ারী ২০১৩ পর্যন্ত ৯৮ বার[8], মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দু’শ বছরে (১৯৮৭ পর্যন্ত) ৩০ বার এবং মাত্র ৪৩ বছরে বাংলাদেশ সরকার ১৫ বার সংবিধান সংশোধন করেছে। তবু যেন ন্যায়বিচার কিভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে, কিভাবে সমাজে শান্তি-শৃংখলা ফিরে আসবে তাতে হালে পানি পাচ্ছে না। যেমন- গত ৬ মার্চ ২০১৪ সংসদের নির্ধারিত প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বিগত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে ২৬ জন ফাঁসির দন্ড পাওয়া আসামীর সাজা মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। ২০০১ সাল থেকে দন্ড মওকুফ প্রাপ্ত মোট ৩৩ জনের মধ্যে আওয়ামীলীগ আমলে ২৬ জন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২ জন এবং এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আরো দুই ব্যক্তির ফাঁসির দন্ড মওকুফ করা হয়। বাকী ৩ জনের সাজা মাওকুফ অথবা কমানো হয়েছে।[9] বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৯ ধারা বলে রাষ্ট্রপতি তা মওকুফ করতে পারেন। প্রকৃত অর্থে প্রেসিডেন্ট মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের কোন দন্ড মওকুফ করেন না; বরং মওকুফ করেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে অথবা দলীয় স্বার্থে। পক্ষান্তরে ইসলামী বিধানে এইভাবে অপরাধীদের শাস্তি মওকুফ করার কোন এখতিয়ার নেই। পদ্ধতি যা রয়েছে তাহ’ল মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী অথবা যে কোন দন্ডপ্রাপ্ত অসামীকে দন্ড মওকুফ করতে পারে একমাত্র মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়। কোন দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্য কেউ নয়। যার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই সঊদী আরবের শরী‘আহ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থায়। কিছুদিন পূর্বে সঊদী আরবে জনৈক মিশরীকে হত্যার দায়ে ৮ বাংলাদেশীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হৈ চৈ পড়ে যায়। তাদেরকে দন্ড মওকুফের জন্য বাংলাদেশ সরকার দেঁঁŠড়ঝাপ শুরু করলে সঊদী বাদশাহ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আমাদের করার কিছুই নেই। শারঈ বিধানুযায়ী যদি মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয় দন্ড মওকুফ করে দেন, তাহ’লেই তা করা সম্ভব অন্যথা নয়। বাদশাহ নিহত মিশরীর স্ত্রীর নিকট পত্র দিলে তিনি জানিয়ে দেন ‘আমি মৃত্যুদন্ড (কিছাছ) মওকুফ করব না’। অবশেষে ৮ বাংলাদেশীকে মৃত্যুদন্ড থেকে কেউ রক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশও যদি এই শিক্ষা গ্রহণ করত তাহ’লে এদেশের সমাজ ব্যবস্থাও উন্নত হ’ত। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হয়েও আমরা শরী‘আহ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি। শুধু তাই-ই নয়, প্রচলিত আইনের ফাঁক ফোঁকরে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসহায়-নিরীহ জনসাধারণ। যার হাযারো উদাহরণ রয়েছে বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায়। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে। এদেশে বিচারাধীন বহু মামলা পড়ে আছে। একটি রিপোর্ট দেখলে বুঝা যাবে, আমাদের দেশের আইন-আদালতের কি ভয়ংকর অবস্থা। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১লা জানুয়ারী ২০১১ পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৯ লাখ ৪২ হাযার ১৮৩ টি। এর মধ্যে সুপ্রীম কোর্টে আপীল বিভাগে ৯ হাযার ১৪১ টি ও হাইকোর্টে ৩ লাখ ১৩ হাযার ৭৩৫টি, যেলা ও দায়রা জজ আদালত সহ অন্যান্য ট্রাইবুনালে ৮ লাখ ৪৮ হাযার ৪৪২টি এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৭ লাখ ৭০ হাযার ৮৬৫টি মামলা রয়েছে। বলা হয়েছে, নতুন মামলা না হ’লে এগুলো শেষ হ’তে ৪-৬ বছর সময় লাগবে।[10] আর একটি রিপোর্টে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বর্তমানে বিচার ব্যবস্থায় মামলার জট ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, ফৌজদারী আদালতে প্রায় ২০ লাখের মত মামলা জমে আছে। কোন কোন মামলা নিস্পত্তি হ’তে পাঁচ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত লাগছে। ফলে বিচার প্রার্থীদের টাকা ও সময় দু’টিই অধিক ব্যয় হচ্ছে।[11] বিচার বিলম্বিত হ’লে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন বলা হয়, Justice delayed is justice dinied অর্থাৎ ‘বিচার বিলম্বিতকরণ অর্থ ন্যায়বিচার অস্বীকার করা’। দেশে এর কোন প্রতিকার নেই। এটাই আমাদের দেশের বিচার বিভাগের অবস্থা। কিন্তু ইসলামে এর কোন সুযোগ নেই।
অপর একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০১-২০০২ এ দেশের জেল কাস্টুডিতে কারাদন্ড প্রাপ্ত ৩০ জন, আটকাদেশ প্রাপ্ত ৮৭ জন এবং পুলিশ কাস্টুডিতে ৯ জন মারা যায়।[12]
প্রচলিত এই আইন ব্যবস্থার কবল থেকে শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। যেমন শেরপুরের অতিরিক্ত চীপ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় বাবা-মায়ের কোলে ১০ বছরের শিশু আব্দুল হাকীম। সে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। উল্লেখ্য, আব্দুল হাকীমকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে ২০ বছর বয়স দেখিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ঝিনাইগাতী থানায় নিয়মিত মামলা হিসাবে রেকর্ড করা হয়।[13]
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেও প্রচলিত আইন যে অচল তা সহজে বুঝা যাবে। যেমন এক রিপোর্টে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৫৭০ জন রয়েছে যুবক। এর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার কারাগারে রয়েছে ৩০১ জন। এদের সকলেই খুনের মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত। তবে সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এসব অপরাধীদের অধিকাংশ প্রকৃত অর্থে খুনী নয়।[14] আর এক রিপোর্টে প্রকাশ, ৩০ বছর পর প্রমাণিত হয়েছে প্লেন ফোর্ড নামে ফাঁসির আসামী আসলেই নির্দোষ। যুক্তরাষ্ট্রে লুই জানার কারাগারে যিনি ৩০ বছর সাজা খেটেছেন। তার বর্তমান বয়স ৬৪ বছর।[15]
তাহ’লে বুঝা যাচ্ছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে দেশ-বিদেশে কত বেআইনী শাসন ও অন্যায় বিচার করে যাচ্ছে মানুষ। কে ওদের বিচার করবে?
উল্লেখ্য, বৃটিশেরা ১৭৭২ সালে এদেশে যে ফৌজদারী ও দেওয়ানী আদালত গঠন করেছিল এখনও বাঙ্গালীদের মধ্যে সেই ভ্রান্ত বিচার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ফলে এদেশের মানুষেরা যেমন ন্যায়বিচার পাচ্ছে না, তেমনি ভোগান্তির শিকারে পড়ছে লাখো লাখো বনু আদম। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে চলে এদেশের আদালতে জমি-জমার মামলা। দেখা যায়, পক্ষগণ মারা গেছেন, তার পরবর্তী বংশধরও সে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তবু তা শেষ হচ্ছে না। এতে সর্বশান্ত হচ্ছে হতভাগারা। দেশের সেরা জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণও মানব রচিত বৃটিশের এই কালো আইন থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। অথচ এই আইনকে সমর্থন দিয়ে যায় যখন যে সরকার আসে তারা। কেউ কেউ বস্তাপঁচা এই আইনকে সংশোধন করার কথা বললেও এক শ্রেণীর স্বার্থবাদী মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ব্যক্তি এগুলো সংশোধন হোক চায় না। কারণ একটাই উদ্দেশ্য তাদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করা।
পক্ষান্তরে ইসলামী আদালতে আইনের অপব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। কারণ এই আদালতে যারা থাকেন এবং যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই মহা বিচারক আল্লাহকে ভয় করেন। তারা শুধু দুনিয়াতে আমীর বা খলীফার ভয়ে নয়; পরকালে জাহান্নামের ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানের বাইরে ঐ সকল মানুষ কিছুই করতে পারেন না। আর এজন্যই সেখানে ন্যায়বিচার আশা করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর উন্নত রাষ্ট্রের দিকে তাকালে সহজে অনুমান করা যায় তারা কিভাবে বিশ্ববাসীর ওপর বিশেষ করে মুসলিম জাহানে অন্যায় বিচার-যুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সনদের ১০ ধারার আলোকে আদালতে আশ্রয় নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার ন্যায্যবিচার পায় না, যেটা পায় ইসলামী আদালতে।
একইভাবে জাতিসংঘ সনদের ১১ ধারার ক উপধারায় যা বলা হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত অর্থ হ’ল যে, কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সকল সুযোগ পাবে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি আদালতে তার আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবে, জামিন পেতে পারে এবং রায়ের পূর্ব পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত এবং কোনরূপ পুলিশী হয়রানি করতে পারবে না ইত্যাদি। আর ইসলামী বিধানে প্রথমেই উল্লেখ রয়েছে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ তথ্য প্রমাণাদি না পেলে তাকে যেমন আটক রাখা যাবে না অথবা যুক্তিসংগত কিছু পেলেও কোন উকিল/আইনজীবী ছাড়াই আসামী নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করবে। এখানে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব অভিযোগকারীর। সাক্ষ্য-প্রমাণ না পেলে তাৎক্ষণিক আসামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানে কোন ওযর-আপত্তির সুযোগ নেই। এটাই ইসলামী বিচার পদ্ধতি। প্রচলিত আইনে ঘুষ, দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে, যা কেবল আমাদের দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও বিদ্যমান। আমাদের এখানে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। এখানে প্রচলিত আইনে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করতে হ’লে কত বছর, যুগ পার হয়ে যাচ্ছে তার কোন হিসাব নেই। এতে সংশ্লিষ্টদের জীবন-সংসার সবই শেষ করে দেয়া হচ্ছে।
১১ (খ) উপধারার আলোকে রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে দোষণীয় না হ’লে কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। যদি পরবর্তীতে ঐ কাজের জন্য তার প্রমাণও পাওয়া যায়, তবে তার জন্য অতিরিক্ত কোন শাস্তি দেয়া যাবে না। সাধারণত রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এই আইনটির ব্যবহারগত দিক ফুটে উঠে। এখানে কোন দেশের রাজনৈতিক অপরাধী বা রাষ্ট্র কর্তৃক দন্ডিত ব্যক্তিকে বিশ্বের যেকোন দেশ ঐ ব্যক্তি দোষী হৌক আর না হৌক নিজেদের স্বার্থে তাকে আশ্রয় দিতে পারে। অথবা দেশ থেকে ঠেলে দিতে পারে। কি সুন্দর আইন? অথচ বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশে এ রাজনৈতিক আইনের খেল-তামাশার চিত্র দেখা যায়।
এখানে এ ধারাকে যে কোন ব্যক্তি অথবা রাষ্ট্রপক্ষ সুযোগ মত কাজে লাগায়। যখন কোন সরকার মনে করেন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিককে জেলে প্রবেশ করানো অথবা দেশের বাইরে পাঠানো দরকার, তখন তারা তা করেন এ আইনের অপব্যবহার করে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। একইভাবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেও সহজে অনুমান করা যায় যে, কিভাবে মানরচিত এইসব আইনকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে ইসলামে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের এ সকল ধারাগুলো যে রচিত হয়েছে আসলে তার কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে ও স্পষ্টতা নেই। নেই কোন স্থায়ীত্ব। সামান্য কিছু ভাল দিক থাকলেও তার যে ত্রুটি রয়েছে সে সুযোগে ব্যক্তি, জাতি-গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রপক্ষও কখনও কখনও সেটাকে অসদুদ্দেশ্যে কাজে লাগায়। একইভাবে কাজে লাগাচ্ছে আন্তর্জাতিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও। তাই বলা যায় যে, এই আইনের কোন স্থিতিশীলতা যেমন নেই, তেমনি নেই এর প্রতি কারো আস্থা। কারণ এই জরাজীর্ণ আইনের ফাঁক ফোঁকরে পড়ে সাধারণ মানুষেরা সর্বস্ব হারিয়ে ফেলছে। লাখ লাখ মানুষ ভিটে-মাটি হারিয়ে পথে বসেছে। কত মানুষ জেল-যুলুমের শিকার হয়েছে, কত মানুষের অকাতরে জীবন হারিয়েছে, কত শত-সহস্র মানুষ বিনা দোষে জেল খাটছে তার ইয়ত্তা নেই। পক্ষান্তরে ইসলামী বিধানে এর কোন সুযোগ নেই এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলামী আইন অপপ্রয়োগেরও কোন সুযোগ নেই। এ বিধানের কোন বিকৃতি নেই, নেই কোন সংশোধন। এটা আল্লাহ প্রদত্ত অভ্রান্ত সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ চিরন্তন বিচারিক বিধান। যার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হয় এবং এটাই সমাজে সুখ-শান্তির একমাত্র গ্যারান্টি।
[চলবে]
শামসুল আলম
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. বুখারী হা/৩৭৩৩, মুসলিম হা/১৬৮৯।
[2]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৪০০ ‘বিচার’ অধ্যায়; উমার ইবনুল খাত্ত্বাব, পৃঃ ৩০৭।
[3]. আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৩৭৩৫, সনদ ছহীহ।
[4]. বুখারী হা/৭১৫৮।
[5]. গাজী শামছুর রহমান, মাওলানা উবাইদুল হক (প্রমুখ), বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জুন ১৯৯৬), পৃ. ২২১-২২২।
[6]. দারাকুৎনী হা/৪৫২৪; ইবনু তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৬/৩৭।
[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৭৩২।
[8]. তাওহীদের ডাক, জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ২০১৪, পৃঃ ২৫।
[9]. প্রথম আলো, ৬ মার্চ ২০১৪, পৃঃ ২।
[10]. দৈনিক সোনালী সংবাদ, রাজশাহী ২১.৩.২০১১।
[11]. প্রথম আলো, ১৭ মার্চ ২০১৪, পৃঃ ৪।
[12]. Human Rights in Bangladesh, Dhaka, 2002, P. 162.
[13]. মানবাধিকার ও আইন আদালত সম্পর্কিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘আইন’, (ঢাকা: সেপ্টেম্বর ২০১২), পৃঃ ৫।
[14]. মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর ২০১২, পৃঃ ৪৪।
[15]. দৈনিক ইনকিলাব, ১৩.০৩.১৪, পৃঃ ১।