বহিরাগত কারণ :
বর্তমান কুফর তথা নাস্তিকতা প্রসারের পিছনে কাজ করছে পাশ্চাত্যের জীবনধারা। ধর্ম বিশ্বাসে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশ খৃষ্টান। কিন্তু খৃষ্টান ধর্মের প্রভাব পাশ্চাত্যের জনগণের উপর সামান্যই। ধর্মকে তারা ব্যক্তিগত বিষয়ের ঊর্ধ্বে বেশী কিছু মনে করে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বল্গাহীন জীবন উপভোগে স্রষ্টার উপস্থিতি বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে তারা তার আদেশ-নিষেধ এমনকি অস্তিত্ব পর্যন্ত মানতে নারাজ। খৃষ্টীয় বিশ্বাস অনুসারে খৃষ্টধর্মে ধর্মীয় বিধান পালনের কোন আবশ্যকতা নেই। কেবল ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করলেই মৃত্যুর পর তাদের জন্য স্বর্গ লাভ অবধারিত। এজন্য শুধু ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস আর খৃষ্টের অনুসারীদের পাপের ভার নিয়ে যিশুর ক্রুশে আত্মদানের স্বীকারোক্তিতে স্বর্গ লাভের সহজ উপায়কে পূঁজি করে সারা বিশ্বে খৃষ্টধর্ম প্রচারে তাদের জুড়ি নেই। এজন্য সকল খৃষ্টানকে তাদের আয়ের একটা অংশ চার্চে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ধর্মের বিধি-বিধান পালন না করলেও বাপ-দাদার অনুসরণার্থে তাদের সমাজ ও মননে খৃষ্টধর্ম গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। তাদের মাঝে আল্লাহর উপর বিশ্বাসে শিথিলতা ও নাস্তিকতার জনমলাভের পিছনে নিম্নের কারণগুলো কম-বেশী দায়ী।
১. ভ্রান্ত ধর্মীয় চিন্তা ও পাদ্রীদের অত্যাচার ২. দর্শন, ৩. বিজ্ঞান, ৪. রাষ্ট্র, ৫. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, ৬. বিদ্বেষভরা মানসিকতা ৭. প্রবৃত্তির দাসত্ব ৮. মনস্তাত্বিক যুদ্ধ ইত্যাদি। আর বস্ত্তগত দিক দিয়ে উন্নত পাশ্চাত্যের অনুকরণ করতে গিয়ে বর্তমান মুসলিম মানসে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতা দেখা দিচ্ছে।
ভ্রান্ত ধর্মীয় চিন্তা ও পাদ্রিদের অত্যাচার : পাশ্চাত্যের প্রায় সবগুলো দেশ ধর্মবিশ্বাসে খৃষ্টান। খৃষ্টধর্মের মূল গ্রন্থ বাইবেল মূলত মানব রচিত এবং তাতে বহু রদবদল হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে যখন বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং নানা বৈজ্ঞানিক সত্যের উন্মোচন আরম্ভ হয় তখন বাইবেলের বহু সূত্রের সাথে তা সাংঘর্ষিক হওয়ার ফলে গির্জা ও বিজ্ঞানের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হয়। গির্জার পাদ্রিদের ক্ষমতা তখন রাজার মাধ্যমে কার্যকর হ’ত। পাদ্রিরাই ছিল দেশের মূল হর্তা-কর্তা। বস্ত্তত পোপের আদেশের বাইরে রাজার করার তেমন কিছু ছিল না। ফলে বাইবেল স্রষ্টার বাণী ও অভ্রান্ত এবং বিজ্ঞান মানব উদ্ভাবিত বিধায় তা ভুল, এ কথা বলে পাদ্রিরা বিজ্ঞানীদের উপর দৈহিক ও মানসিকভাবে নানারকম নির্যাতন করতে থাকে। দূরবিন বা টেলিস্কোপ আবিষ্কারক ইতালির গ্যালিলিও তার বড় প্রমাণ। কিন্তু দিন যতই গড়াতে থাকে জনগণের সামনে বিজ্ঞানের সত্য ততই স্পষ্ট হ’তে থাকে। আর বাইবেল যে ভুলে ভরা অসত্য তথ্যে ভরপুর তাও উন্মোচিত হ’তে থাকে। সেই সাথে বাইবেল ও গির্জার পাদ্রিদের প্রতি জনমনে ঘৃণা ও বিরূপ ধারণা তৈরি হ’তে থাকে। এই ঘৃণা ও বিরূপ মনোভাব খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মে শিথিলতা ও নাস্তিকতার ঢেউ তোলে। পরে এসে বিবর্তনবাদ এই ঢেউয়ে তীব্র বাতাস সঞ্চার করে। কেননা বিবর্তনবাদ সৃষ্টিকর্তার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কিভাবে জীব ও জড় জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তার তথাকথিত এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাদের হাতে তুলে দেয়, যা আদতে মিথ্যা হ’লেও বাইবেলের সৃষ্টি সংক্রান্ত বিবরণ থেকে অনেক যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য।
দর্শন : এই বিবর্তনবাদকে পূঁজি করে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে নবতর দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে পাশ্চাত্য দার্শনিকরা এগিয়ে আসেন। তারা স্রষ্টার ধারণাকে প্রথমে অপ্রয়োজনীয় এবং পরিশেষে অবাস্তব প্রমাণ করে মানুষের ধর্মবিশ্বাসে শিথিলতা ও নাস্তিকতাকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। দার্শনিক ভল্টেয়ার বলেছেন, গড এই বিশ্ব প্রকৃতিকে ঠিক সেভাবে তৈরি করেছেন যেভাবে একজন ঘড়ি প্রস্ত্ততকারী ঘড়ির পার্টস সমূহ একত্রিত করে সেগুলোকে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে চালু করে দিয়েছেন, অতঃপর সে ঘড়ির সাথে আর সম্পর্ক রাখেননি।
পরবর্তীতে হিউম এসে এই নির্জীব ও নিষ্কর্মা গডকে এই বলে একেবারে খতম করে দিয়েছেন যে, আমরা ঘড়ি তৈরি হ’তে দেখেছি, কিন্তু এই বিশ্ব চরাচর তৈরি হ’তে দেখিনি। তাই এটা কি করে সম্ভব যে আমরা একজন স্রষ্টাকে বিশ্বাস করব?
মার্কসীয় দর্শনে তো ধর্ম একটি ঐতিহাসিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছে আইন, চরিত্র, ধর্ম সবকিছু বুর্জোয়াদের প্রতারণা, যার আড়ালে ওদের অনেক স্বার্থ নিহিত রয়েছে। যুব কমিউনিস্ট লীগের তৃতীয় নিখিল রুশ কংগ্রেসে (১০/১৯২০) লেলিন বলেছিলেন, আমরা মোটেই আল্লাহ’তে বিশ্বাস করি না।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতায় এলে মার্কসীয় দর্শন তাদের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। তারা শুধু রাশিয়ায় নয় বরং পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার অনেকগুলো দেশে সমাজতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তাদের শাসন ও শিক্ষাব্যবস্থায় এ সকল দেশে অতি দ্রুত ধর্মীয় শিথিলতা ও নাস্তিকতার প্রসার লাভ করে। নববইয়ের দশকে রাশিয়া ও ইউরোপে কম্যুনিস্ট শাসন ভেঙ্গে পড়লেও দর্শন হিসাবে সমাজতন্ত্র আজও ফুরিয়ে যায়নি। মার্কসবাদ দুনিয়া জুড়ে এখন সবচেয়ে বেশী পরিমাণে নাস্তিকতা ছড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশে তো বামবুদ্ধিজীবী ও চরমপন্থীরা যেমন মিডিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে তেমনি স্বাধীনতার পর থেকে সর্বহারার নামে বোমাবাজি, অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজি করে দেশটাকে নরক গুলজার করে ফেলেছে। শিক্ষা ও সাহিত্যের জগতও তাদের অধিকারে।
মস্কোসহ সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটলেও এরা এ দেশে সর্বহারার রাজ কায়েম করেই ছাড়বে। নামে কিন্তু এরা অধিকাংশই মুসলিম। এভাবে আধুনিক দর্শন তার শিক্ষাব্যবস্থা ও চিন্তাধারা দিয়ে মানুষের হৃদয় থেকে আল্লাহ ও ধর্মকে উপড়ে ফেলতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
বিজ্ঞান : ধর্মে শিথিলতা ও নাস্তিকতার পিছনে আধুনিক বিজ্ঞানের অবদানও কম নয়। বিজ্ঞানের চোখ ধাঁধানো নানা আবিষ্কার মানুষকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। নিত্য নতুন আবিষ্কারের ফলে অনেক বৈজ্ঞানিক ও তাদের অন্ধ স্তাবকরা দাবী করতে শুরু করেছে যে, সৃষ্টি সংক্রান্ত সকল সত্য আবিষ্কার হয়ে গেছে কিংবা তা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে। বিজ্ঞান মানুষের সকল সমস্যার কার্যকর সমাধান দিতে পারে এবং তার মনের সকল প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারে। বিজ্ঞানের সকল সূত্রই পর্যবেক্ষণযোগ্য সত্য। এখানে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও মানব সৃষ্টির সকল রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে। ফলে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের এখন আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। জুলিয়ান হাক্সলির ভাষায় কোন সন্দেহ নেই যে, আণবিক বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পর বস্ত্ত সম্পর্কিত অতীতের সকল ধ্যান-ধারণা বদলে গেছে। গত শতাব্দীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে দ্রুত উন্নতি হয়েছে তাও এমন এক ধরনের জ্ঞানগত বিস্ফোরণ। যার ফলে আল্লাহ ও ধর্ম সম্পর্কিত যাবতীয় প্রাচীন ধারণা একদম উবে গেছে।
তিনি আরও লিখেছেন, নিউটন প্রমাণ করেছেন যে, এমন কোন আল্লাহ নেই যিনি গ্রহ-নক্ষত্রের গতির উপর শাসন চালাচ্ছেন। লাপ্লাস তার বিখ্যাত সূত্র দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, মহাকাশের নিয়ম-শৃঙ্খলার জন্য কোন স্রষ্টার কল্পনা করার প্রয়োজন নেই। জীববিদ্যার ক্ষেত্রে ডারউইন ও পাসচারও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বর্তমান যুগের উন্নত মনোবিজ্ঞান ও ব্যাপক ঐতিহাসিক জ্ঞান স্রষ্টাকে তাঁর ঐ স্থান থেকে হটিয়ে দিয়েছে যেখানে বসে তিনি মানব জীবন এবং মানব ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
এভাবে অনেক বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানভক্তরা সচেতনভাবে মানুষের মাঝে নাস্তিকতার চাষ করে চলেছেন। অবশ্য অনেক বিজ্ঞানী স্ব স্ব ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী স্রষ্টায় বিশ্বাস করে থাকেন। তারা যদি বিজ্ঞানের মতই বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ পরীক্ষা ও গবেষণা করে দেখতেন তাহ’লে তাওহীদ ভিত্তিক ইসলামই যে সত্য, বিজ্ঞান সম্মত ও প্রকৃতির ধর্ম তা বুঝতে পারতেন। তারা এভাবে আস্তিকতার পক্ষে মুখ খুললে ভক্তদের নাস্তিকতা হয়ত হালে পানি পেত না।
নাস্তিক বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব ও মানব সৃষ্টিতে আল্লাহর ভূমিকা উড়িয়ে দিয়ে সেখানে তাদের মনগড়া কিছু মতবাদ জুড়ে দিয়েছেন, যা এ প্রশ্নের মীমাংসা না হয়ে বরং আরও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারা আবিষ্কার করেছেন, এই মহাবিশ্ব যে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলছে তার নাম ‘প্রকৃতির নিয়ম’ বা Law of nature. এজন্য হাক্সলি বলেছেন, ঘটনা যখন প্রাকৃতিক কারণে ঘটে তখন আমাদের সেগুলো কোন অতিপ্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তারা বলছেন, এ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছনে পরিকল্পনাকারী কোন আল্লাহ নেই, বরং ইহা Big bang বা মহাবিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তাদের এ কথা মেনে নিলে নিম্নের
প্রশ্নগুলোর সমাধানও যরূরী হয়ে পড়ে।
-এই বিস্ফোরণ কেন ঘটল?
-কিভাবে ঘটল?
-এর পিছনে কারণ কি ছিল?
-মহাবিস্ফোরণের আগে কি ছিল?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর মহাবিস্ফোরণবাদীরা দেননি। এখন পর্যন্ত তাদের নিকট এর কোন উত্তরও নেই। তারা যে প্রতিটি ঘটনার পিছনে কার্যকারণ (every effect has a cause) সম্পর্কের কথা বলেন সেই হিসাবেও বিস্ফোরণ যখন একটি কাজ তখন তার পিছনেও নিশ্চয়ই কারণ থাকার কথা। সেই আদি কারণ যে জন্য মহাবিস্ফোরণ ঘটল তা বিদ্যমান না থাকলে তাদের কথামতই দাবীটি মিথ্যা হয়ে যায়। তারা আরও দাবী করেন যে, বহু পরমাণু একদা সমবেত হয়ে এই মহাবিশ্ব অকস্মাৎ সৃষ্টি হয়ে গেছে।
তাদের এ দাবীও নিতান্ত যুক্তিহীন। অথচ এই যুক্তিহীন দাবীর উপরই গড়ে উঠেছে নাস্তিকতাবাদ। কোন পরিকল্পনাকারী ছাড়াই পদার্থের সংযোজনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্ব ছাপাখানায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে বিশাল অগ্নিকান্ডের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসলীলার মাঝে অকস্মাৎ একটি সুন্দর অভিধান বই ছাপা ও প্রকাশ লাভের মতই। এ যদি অতি অসম্ভব কথা হয় তাহ’লে কোন আদি মহাশক্তি ছাড়াই এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার যুক্তি আরও অবাস্তব ও অসম্ভব নয় কি? এই অর্থহীন যুক্তির বিরুদ্ধে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. আই. ভি. ও. বলেন, আকস্মিক- ভাবে এর (মহাবিশ্বের) উৎপত্তি ঘটেছে এ কথা বিশ্বাস করা মেঝেতে পানি ঢেলে দিলে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি হ’তে পারে, এ কথা কল্পনা করার চাইতেও অতি মাত্রায় অবাস্তব।
মহাবিশ্ব যদি নিজ থেকে সৃষ্টি হ’ত তাহ’লে আমরা প্রকৃতির সকল দিক ও বিভাগেই কিন্তু নির্দিষ্ট নিয়মশৃঙ্খলা ও ক্রমের ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ না করে বরং সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতাই প্রত্যক্ষ করতাম। সাথে সাথে একই নিয়মে প্রতিনিয়তই বহু জিনিস নিজ থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হ’তে দেখতাম। অথচ হাযার হাযার বছর ধরে পৃথিবীপৃষ্ঠে নিজে নিজেই কোন কিছু সৃষ্টি হয়েছে, এমন আশ্চর্য সংবাদ মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে উল্লেখ নেই। উল্লেখ যা আছে তা হ’ল, প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টির পিছনে একজন পরিপক্ক পরিকল্পনাকারী ও প্রস্ত্ততকারী রয়েছেন। পরিকল্পনাকারী ও প্রস্ত্ততকারী ছাড়া কোন জিনিসের অস্তিত্ব লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং মহাবিশ্বের নিশ্চয়ই একজন পরিকল্পনাকারী ও সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর তিনিই হ’লেন, কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহ।
মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করলে খোদ মানুষেরও যে কোন সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে না এ বিশ্বাস অবধারিত হয়ে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এল কোত্থেকে সে প্রশ্নও অনিবার্যভাবে দেখা দেয়। সেজন্য বস্ত্তবাদী নাস্তিকরা বিবর্তনবাদকে সৃষ্টিতিত্ত্বের মূলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিবর্তনবাদের প্রবক্তা হিসাবে চার্লস ডারউইনের নাম উল্লেখ করা হয়। ১৮৫৯ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত তার ‘অন দি অরিজিন অব স্পেসিস’ গ্রন্থে তিনি মানুষ কিভাবে বানর থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছেন। বিবর্তনের মূলকথা ‘প্রকৃতির নির্বাচন’-এর মাধ্যমে যোগ্যতমের টিকে থাকা এবং অযোগ্যদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।
প্রকৃতির নির্বাচন আইন যোগ্যতমের টিকে থাকার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু যোগ্যতমের আবির্ভাব কেন ও কিভাবে হ’ল তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
বিজ্ঞানীদের কথা মতো, কতিপয় পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণই হ’ল বিজ্ঞান। কিন্তু বিজ্ঞানের সাহায্যে যতটুকু আমাদের অভিজ্ঞতায় আসে প্রকৃত সত্য মাত্র ততটুকুই, স্বয়ং বিজ্ঞানও এমন দাবী কখনও করেনি এবং এমন দাবী তার পক্ষে করা সম্ভবও নয়। কেননা বিজ্ঞানের সকল কথা বা আবিষ্কারই ধ্রুব সত্য ও চূড়ান্ত নয়। সে আজ যা বলছে কাল যে তা পরিবর্তিত হবে না এমন নিশ্চয়তা সে দেয়নি। বরং বাস্তব সত্য যে, তার অনেক আবিষ্কারের তথ্য নিজেই সে পরিবর্তন করেছে। এক সময় যে সত্য পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে পরে দেখা গেছে তা ছিল ভুল। মহাকাশ সম্পর্কিত কথাই ধরুন। গ্যালিলিও দূরবিন আবিষ্কার করে জানালেন যে পৃথিবী ঘোরে, সূর্য স্থির। এই সত্য বাংলাদেশ আমলেও আমরা পাঠ্য বইয়ে পড়েছি। কিন্তু এখন নবম দশম শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ নামে যে বই পড়ান হয় তাতে সৌর জগত সম্পর্কিত অধ্যায়ে স্পষ্ট বলা আছে, সূর্য নিজ অক্ষের উপর ২৫ দিনে একবার আবর্তন করে। বাংলাদেশী বইয়ে যদি মনে করেন ভুল তথ্য আছে তাহ’লে চলুন উইকিপিডিয়ায় দেখে আসি। সেখানে আছে, সূর্য আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আনুমানিক ২৪-২৬ হাযার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং কেন্দ্রের চারদিকে ২২.৫ থেকে ২৫ কোটি বছরে একবার ঘুরে আসে। ছায়াপথীয় উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের এই আবর্তন ঘড়ির কাঁটার দিকে। আমাদের ছায়াপথ যেহেতু মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের (পটবিকিরণের) সাপেক্ষে হরদসর্প মন্ডলের দিকে সেকেন্ডে ৫৫০ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হচ্ছে সেহেতু পটবিকিরণের সাপেক্ষে সূর্যের বেগ কাংস্য বা সিংহ মন্ডলের দিকে সেকেন্ডে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার। আকাশগঙ্গা ছায়া- পথের কেন্দ্রের চতুর্দিকে ৫৪০০০ আলোকবর্ষব্যাপী কক্ষপথে সূর্যের সাধারণ গতিবেগ সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার।
সূর্য সম্বন্ধে উইকিপিডিয়ার শেষ কথা এই : ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাও সূর্যের গাঠনিক উপাদান এবং শক্তির উৎস সম্পর্কে জানতেন না। এখনও সূর্য নিয়ে গবেষণা চলছে, কারণ তার কিছু ব্যবহার এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি। তাহ’লে গ্যালিলিওর তখনকার আবিষ্কার পুরো সত্য ছিল না, বরং এখনকার হিসাব অনুযায়ী আংশিক সত্য ছিল। তখন সূর্য স্থির ছিল, ঘুরত না; এখন ঘোরে। সামনে যে এ তথ্যও বদলে যাবে না তার অনিশ্চয়তা দেখুন উইকিপিডিয়াতেই লেখা আছে।
আবার দেখুন, ১৯৩০ সালে প্লুটো আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরাই তাকে গ্রহের মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৬ সালে এসে এমন কি ঘটল যে, প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা বিজ্ঞানীরাই কেড়ে নিলেন। বিজ্ঞান যদি ধ্রুব সত্য হয় তাহ’লে এমন ঘটার কারণ কি? অথচ এই বিজ্ঞানের নামে নাস্তিকরা আল্লাহ, ধর্ম, চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বাজে মন্তব্য করে চলেছে।
The knowledge of Islam নামক software-এ ‘এক নাস্তিক অধ্যাপক ও আস্তিক ছাত্রের বিতর্ক’ শিরোনামে এক আলোচনায় বিবর্তনবাদপন্থী বিজ্ঞানে বিশ্বাসী অধ্যাপক ও দু’জন ছাত্রের কথোপকথনের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-
অধ্যাপক : বাছা, তুমি কি স্রষ্টায় বিশ্বাস কর?
ছাত্র-১ : জি হ্যাঁ করি।
অধ্যাপক : বিজ্ঞান বলে তোমার পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে যা দিয়ে তুমি তোমার চারপাশের জগতকে পর্যবেক্ষণ কর এবং চিনতে পার। তুমি কখনো স্রষ্টাকে দেখনি, দেখেছ?
ছাত্র-১ : না স্যার দেখিনি।
অধ্যাপক : তোমার আল্লাহর কথা শুনেছ?
ছাত্র-১ : না স্যার শুনিনি।
অধ্যাপক : তুমি কি কখনও তোমার স্রষ্টাকে অনুভব করেছ? তার স্বাদ-গন্ধ পেয়েছ? তোমার আল্লাহ সম্বন্ধে কোন ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধি আছে কি? (ছাত্র-১ নীরব)
অধ্যাপক : দয়া করে মুখ খোল।
ছাত্র-১ : না স্যার, আমি দুঃখিত যে, এমন কোন উপলব্ধি আমার নেই।
অধ্যাপক : তুমি দুঃখিত তোমার তা নেই।
ছাত্র-১ : না স্যার।
অধ্যাপক : তবুও তুমি তাকে বিশ্বাস কর? ছাত্র-১ : জী হ্যাঁ।
অধ্যাপক : একেই বলে বিশ্বাস! পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর স্বাদযোগ্য, প্রদর্শনযোগ্য, বিধি অনুসারে বিজ্ঞান বলে তোমার আল্লাহর কোন অস্তিত্ব নেই। এ ব্যাপারে তুমি কি বলবে বাছা? এখন বল, কোথায় তোমার আল্লাহ?
[ছাত্রটি কোন উত্তর দিতে পারে না এবং অধ্যাপকের কথায় বসে পড়ে। এবারে দ্বিতীয় একজন মুসলিম ছাত্র তার সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বলে:]
ছাত্র-২ : স্যার আপনি কি ছাত্রদের শেখান যে, তারা বানর থেকে বিবর্তিত হয়েছে?
অধ্যাপক : তুমি যদি প্রাকৃতিক বিবর্তনের কথা বলে থাক তবে এর উত্তর হ’ল, ‘হ্যাঁ’।
ছাত্র-২ : অবশ্যই আমি বিবর্তনবাদের কথা বলছি। আপনি কি কখনও নিজের চোখে বিবর্তন দেখেছেন স্যার?
অধ্যাপক তার দাঁতে কটকট শব্দ করেন এবং নীরব পাথর চোখে তার দিকে চেয়ে থাকেন।
ছাত্র-২ : যেহেতু কেউ কখনো বিবর্তন প্রক্রিয়া ঘটতে দেখেনি, এমনকি প্রমাণও করতে পারে না যে, এই প্রক্রিয়া চলমান সেহেতু আপনি কি আপনার অভিমত শেখাচ্ছেন না? আর এটা কি অন্ধ বিশ্বাস নয়?
অধ্যাপক : আমি যা বিশ্বাস করি তা হ’ল বিজ্ঞান।
ছাত্র-২ : স্যার আপনি যথার্থই বলেছেন যে, বিজ্ঞান হ’ল দৃশ্যমান ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়বস্ত্তর আলোচনা। বিজ্ঞানও এমন এক বিষয় যা ভ্রান্ত। অধ্যাপক : বিজ্ঞান ভ্রান্ত?
শ্রেণীকক্ষে কলরব উঠল। মুসলিম যুবক দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না হট্টগোল থামল।
ছাত্র-২ : অপর ছাত্রের সাথে যে পয়েন্ট নিয়ে আপনি আলোচনা করছিলেন তা চালিয়ে নেবার জন্য আমি কি আরেকটি উদাহরণ দিতে পারি, আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি সে ব্যাপারে?
অধ্যাপক বিজ্ঞের মতো নীরব থাকেন। মুসলিম যুবক শ্রেণীকক্ষের চার দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়।
ছাত্র-২ : ক্লাসে কি এমন কেউ আছে, যে কখনো বায়ু, অক্সিজেন, অণু, পরমাণু ও স্যারের বুদ্ধিমত্তা দেখেছে?
ক্লাসটি হাসিতে ফেটে পড়ল। মুসলিম ছাত্রটি ভেঙ্গে পড়া বয়োবৃদ্ধ শিক্ষকের দিকে নির্দেশ করল।
ছাত্র-২ : এখানে এমন কেউ আছে কি, যে স্যারের বুদ্ধিমত্তা শুনেছে, তার বুদ্ধিমত্তা অনুভব করেছে, স্যারের বুদ্ধিমত্তা ছুঁয়ে দেখেছে কিংবা ঘ্রাণ নিয়েছে? কেউ তা করেছে বলে মনে হ’ল না। মুসলিম যুবক দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ে।
ছাত্র-২ : মনে হচ্ছে এখানে এমন কেউ নেই যে, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কোন একটির সাহায্যে স্যারের বুদ্ধিমত্তা উপলব্ধি করেছে। বেশ, তাহ’লে পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর, সুস্থিত, প্রদর্শনযোগ্য বিধি অনুসারে, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি ঘোষণা করছি যে, স্যারের কোন বুদ্ধি নেই।
দেখুন, এই স্যার, অন্যান্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা দিয়েই প্রমাণ হচ্ছে বিবর্তনবাদ মিথ্যা। কেননা বিবর্তন প্রক্রিয়া পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। এটা একান্তই অনুমান নির্ভর। আর যে বিজ্ঞান তার নিজস্ব সংজ্ঞার আলোকে স্যারের বুদ্ধি আছে কি-না তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ তার বুদ্ধি যে আছে তা সন্দেহাতীতভাবে সত্য- সেই বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আল্লাহকে অস্বীকার করা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত?
রাষ্ট্র : ধর্মে বিশ্বাস ও তা পালনে শিথিলতা এবং নাস্তিকতার প্রসারে রাষ্ট্রের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রের যে সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে তা প্রয়োগ করে সরকার। আর সরকার পরিচালনা করে একদল মানুষ। যাদের শীর্ষে থাকেন প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী, কিংবা রাজা-বাদশাহগণ। এই শীর্ষ ব্যক্তি ও তার উপদেষ্টা মন্ত্রীবর্গের কথাতেই মূলত দেশ চলে। তাদের ইচ্ছামতো আইন তৈরি হয়। সংবিধান তৈরি ও রদবদলও করেন তারাই। তারা ধর্মীয় বিষয়ে দায়িত্ববান হ’লে এবং জনগণকে আইনানুগভাবে ধর্ম পালন করতে নির্দেশ দিলে তারা ধর্ম পালনে এগিয়ে আসে। আবার শীর্ষ ব্যক্তিরা আল্লাহতে অবিশ্বাসী হ’লে এবং জনগণকে নাস্তিক হ’তে বাধ্য করলে বা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করলে দেশের বহু মানুষ বাধ্য হয়েই নাস্তিক হয়ে পড়ে। অপরদিকে সরকার রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করলে ধর্ম তখন ব্যক্তিগত পালনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তির যতটুকু ইচ্ছে হ’ল ধর্ম পালন করল, আবার ইচ্ছে হ’ল তো কিছুই পালন করল না। এক্ষেত্রে কারও কিছু বলার নেই। অধিকন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারীরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বাকস্বাধীনতার নামে ধর্মপালনকারীদের যাচ্ছেতাই বলার অধিকার ভোগ করে। দেখভালকারী কর্তৃপক্ষ ছাড়া শুধুই ব্যক্তির ইচ্ছায় ধর্ম পালনে যে মানুষ অন্তত ইসলামী বিধি-বিধান মানে না তা আমাদের চার পাশে তাকালে দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। কোন কোন দেশে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে সংবিধানে শোভা পায় বটে, কিন্তু তা নামেই। রাষ্ট্র তা পালনে দেশের নাগরিকদের কিছুই বলে না। আজকের বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ ও সরকারের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে কর্তৃপক্ষের ধর্ম পালনে অনীহা জনগণকেও ধর্ম পালনে অনাগ্রহী করে তুলছে।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা : আধুনিক যুগে শিক্ষা একটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালনকারী বিষয় বলে গণ্য হ’লেও ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধিতে তার ভূমিকা মোটেও ইতিবাচক নয়। বর্তমানে শিক্ষার বিষয় ও সংখ্যা এত ব্যাপক যে একজন মানুষের পক্ষে তা আয়ত্ত্ব করা কল্পনাতীত। প্রতি বিষয়ে আবার প্রচুর বই লেখা হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে আবার রয়েছে লক্ষ লক্ষ বই। এসব বই পড়ে দেশ ও সমাজ শিক্ষিত হয়ে উঠছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ বস্ত্তবাদী এ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাক্রমে জনগণকে তাওহীদ বিশ্বাসী হিসাবে গড়ে তোলার কোন উদ্যোগ নেই। পাঠ্যপুস্তকও সে লক্ষ্যে রচিত হয় না। ধর্মীয় বই একটা থাকলেও তার ভূমিকা খুবই নগণ্য।
বলা হয় যে, আধুনিক শিক্ষা বাস্তবায়িত হ’লে দেশ শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে, ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, আর্থিক সমৃদ্ধিতে দেশ ভরে যাবে। মানুষ থাকবে না বঞ্চিত ও অবহেলিত। অবসান ঘটবে যুলুম ও অত্যাচারের। নিশ্চিত হবে প্রগতি। ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারীরা এমন মুখরোচক কথাই বলে। তারা জনগণকে ভয় দেখায় যে, ইসলামী শিক্ষা মানুষকে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, কূপমন্ডুক, মধ্যযুগীয়, অনগ্রসর, পশ্চাদপদ, প্রতিক্রিয়াশীল, ভূতের পায়ের মতো পিছনে হাঁটা, খুনী, জঙ্গি ইত্যাদিতে পরিণত করে।
অথচ ইতিহাস সাক্ষী, নৈতিকতা বিবর্জিত বস্ত্তবাদী বর্তমান শিক্ষা ও শাসনব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠী মানুষের মৌলিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা বেশী মাত্রায় হরণ করেছে। উন্নতি-প্রগতি তো দূরে থাক তাদের ভাগ্যে ভাগাড় জোটাও মুশকিল হয়ে পড়ছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে স্টালিন ক্রুশ্চেভরা সমাজতন্ত্রের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের ভিটে-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলে নির্বাসন দিয়ে হত্যা করেছে। চেচনিয়া, দাগিস্তান প্রভৃতি মুসলিম অঞ্চলের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুলেটের আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তথাকথিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে রাশিয়া খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, অথচ কম্যুনিস্ট আমলে তা পরিণত হয় খাদ্য আমদানিকারক দেশে। ১৯৯০ সালের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কম্যুনিস্ট শাসন ভেঙ্গে পড়লে সেসব দেশে অভাব অভিযোগ একেবারে মুখব্যাদান করে বেরিয়ে পড়ে।
বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবীদার ভারতে এমন দিন, মাস, বছর কমই যায় যেখানে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা সংখ্যালঘু মুসলিম ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে আক্রমণ ও হত্যা না করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার। মুসলমানদের উচ্ছেদ করে সেখানে রামরাজত্ব কায়েমই হিন্দুত্ববাদী শাসকদের যেন একমাত্র লক্ষ্য। ভারতের জনসংখ্যার ১৫% এর অধিক মুসলিম হ’লেও সরকারী চাকুরিতে তাদের সংখ্যা ২% এর অধিক নয়। সাচার কমিশন ও মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট দেখলে এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, স্বধর্মীয় দলিত হিন্দুদেরও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মানুষ গণ্য করে না। তাদেরও নানা নির্যাতনের শিকার হ’তে হয়।
বার্মা ওরফে মিয়ানমার আরেক প্রগতিশীল রাষ্ট্র। শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের তারা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের বাড়ি-ঘর সব দখল করে নিয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ফসলের মাঠ ধ্বংস করা ইত্যাকার কোন কিছু থেকেই তারা রোহিঙ্গাদের রেহাই দেয়নি। এখন যারা বেঁচে আছে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তুর্কিস্তানের উইঘুর মুসলমানদের দুর্দশার কথা তো মহাচীনের মহাপ্রাচীর ভেদ করে সভ্যজগতের কর্ণকূহরে খুব কমই প্রবেশ করে। এ অঞ্চলকে চীন জিনজিয়াং নাম দিয়ে নিজেদের দেশের অংশ বানিয়ে নিয়েছে। দ্বীন পালন তো দূরের কথা স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন পর্যন্ত তাদের যাপন করতে দেওয়া হয় না। পরিবার থেকে সন্তানদের আলাদা করে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ কথা শুনতেও কত মর্মান্তিক! আর বিশ্বমোড়ল আমেরিকা গণতন্ত্রের নিশানবরদারির নামে আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে এবং সারা বিশ্বে তাদের মোড়লিপনা যাহির করে যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে তারাও কি আধুনিক বস্ত্তবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত নয়? ইসরাঈলের মতো একটি স্বৈরাচারী অত্যাচারী রাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্টি ও টিকিয়ে রাখার পিছনে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর একচোখা নির্লজ্জ ভূমিকা কি এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা চোখে দেখতে পান? ফিলিস্তীনীরা আজ নিজ ভূমে পরবাসী। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিপনা। এর থেকে বড় সত্যবিকৃতি আর কি হ’তে পারে?
মুসলিম দেশগুলোতে তুরস্ক প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ও শিক্ষা চালু করেছিল। সেখানে কোন বৈজ্ঞানিক জন্মেছিল কি না তা আমাদের গোচরিভূত না হ’লেও কামাল পাশা যে তুর্কি জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণ করে একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন এবং তাদের উপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়েছিলেন তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। মিশরের প্রগতিপন্থীরা ইসলামপন্থী হাযার হাযার মুসলিম ইখওয়ানের উপর অত্যাচার করেছে। বিনা বিচারে কিংবা বিচারের নামে প্রহসন করে তাদের হত্যা করেছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতেও যারা ক্ষমতাসীন তারা দ্বীন-ধর্মে মুসলিম হ’লেও শিক্ষায় ও মননে পাশ্চাত্যের বশংবদ। তাদের শাসন, আইন ও বিচার ব্যবস্থা হয় বৃটিশ থেকে অথবা ফ্রান্স থেকে কিংবা পাশ্চাত্যের কোন দেশ থেকে ধার করা। কলোনিজম শেষ হ’লেও তার প্রেতাত্মা এখনও আমাদের উপর সমানেই রয়ে গেছে। কাজেই ইসলামী আইন ও বিচার তাদের কাছে একেবারেই অগ্রহণীয়। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মুসলিম দেশেও মন-প্রাণ খুলে ইসলাম মানার পরিবেশ নেই। তথাকথিত প্রগতিবাদীরা তাদের অকথ্য ভাষায় বিদ্রূপ করে। তাদের ব্লগগুলো দেখলেও একথার প্রমাণ মিলবে।
ধর্মনিরপেক্ষ বস্ত্তবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত মানুষগুলো বরং ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিতদের থেকে অনেক বেশী স্বার্থপর, অর্থগৃধণু, অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ, প্রভুত্বলিপ্সু ও আত্মকেন্দ্রিক। তারাই আজকের পৃথিবীকে নরক বানিয়ে রেখেছে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার কোন পরওয়া করে না বলে এ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেদের অধিকাংশই দুর্বিনীত, অহংকারী, বিদ্বেষপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, মিথ্যুক ও প্রতিশোধ- পরায়ণ। তারা লোভী ও সুবিধাবাদী চরিত্রের মানুষ। স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারে তারা কোন নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না। আর এ কারণেও তারা আল্লাহকে মানতে চায় না।
বিদ্বেষ পরায়ণতা : বিদ্বেষের কারণেও অনেকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে পারে না। ফলে ইসলাম ও মুসলিমদের ভালোবাসা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যুগ পরিক্রমায় মানব জাতির মধ্যে এ বিদ্বেষ চলে আসছে। সত্যকে তারা সহজে মেনে নিতে পারে না। নানা কূটতর্ক ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে সত্যকে তারা পায়ে ঠেলে চলতে চায়। কেউ যেন মনে না করে যে, বিদ্বেষ কেবল অশিক্ষিত, ধর্মশিক্ষিত ও ছোটলোকদের ব্যাপার। বৈজ্ঞানিক, বড় মাপের শিক্ষিত, প্রগতিশীল ও ধনী লোকেরা বিদ্বেষ দ্বারা আক্রান্ত হন না। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানী ড. হিলস বলেন, I should be the last to claim that we, scientific men are less liable to prejudice than other educated men. অর্থাৎ আমরা বিজ্ঞানীরা অন্যান্য শিক্ষিত লোকদের অপেক্ষা কম বিদ্বেষভাবাপন্ন, এই দাবী করতে আমি নারায। চার শ’ বছর পূর্বে (সৌর জগত সম্পর্কিত) এরিস্টটলের মতের বিপরীতে প্রচারিত গ্যালিলিওর মত মেনে নিতে ইতালীয় পন্ডিতগণ শুধুমাত্র বিদ্বেষ হেতু অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অথচ লিনিং টাওয়ার থেকে নীচে পড়া গোলা গ্যালিলিওর মতের সত্যতা তাদের চোখে আঙগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বার্লিনের অধ্যাপক ম্যাক্সপ্লাঙ্ক আলোর এমন সব ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন যা বিশ্বলোক সংক্রান্ত নিউটনীয় ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিল। কিন্তু সেই সময়ের পন্ডিতগণ শুধুমাত্র বিদ্বেষ বশত তা গ্রহণ করেনি। তারা বরং নানাভাবে তাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিল। অথচ তা আজ ‘কোয়ান্টাম থিওরি’ রূপে পদার্থ বিদ্যার মৌলনীতির মধ্যে গণ্য।
বলতে গেলে জগতটা বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত। এখানে একটা বৈজ্ঞানিক সত্যও সংশ্লিষ্ট সমাজে স্বীকৃতি পায় না। শুধু এই বিদ্বেষের কারণে। একটা তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক বিচারে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হ’লেও তা যে সর্বশ্রেণীর লোক দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেবে, বিদ্বেষবিষাক্ত মানব সমাজে তেমনটা আশা করা যায় না। এখানে কোন কিছুর বিরুদ্ধে মনমগজে একবার বিদ্বেষ বদ্ধমূল হয়ে গেলে সে জিনিস যতই সত্য বিজ্ঞানসম্মত ও অকাট্য যুক্তিসঙ্গত হোক তা কোন দিনই স্বীকৃতি পেতে পারবে না। বিদ্বেষ এমনই এক ভয়াবহ জিনিস। ইসলামও আজ এই বিদ্বেষের কারণে সত্য বলে জানা-বুঝা সত্ত্বেও একশ্রেণীর লোকের নিকট স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও অন্ধ বিদ্বেষ তাদের মন-মগজে যুগ যুগ ধরে জমাট বেঁধে রয়েছে। অন্যথা ইসলামকে অমান্য করার এবং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার পুরোপুরি স্বীকৃতি না দেওয়ার কোন কারণ থাকার কথা নয়।
উল্লেখ্য যে, দ্বীনের কার্যকারিতা অস্বীকারের ফলে আমাদের ব্যক্তিজীবন নৈতিকতাশূন্য হয়ে পড়েছে। যে কারণে আজকের সমাজ ও রাষ্ট্র মারাত্মকভাবে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, অত্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার, ধর্ষণ, মারামারি, খুনোখুনি, রাহাজানি, নকলবাজি, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদিতে ভরে গেছে। আধুনিক আইন, পার্লামেন্ট, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এর কোনই প্রতিকার করতে পারছে না।
প্রবৃত্তির দাসত্ব : দর্শন, বিজ্ঞান, প্রগতি ইত্যাদি গালভরা বুলি ও মুখরোচক শব্দ দিয়ে অর্বাচীন মানুষকে যখন আল্লাহর নিকট নিজের ভালো-মন্দ কাজের জবাবদিহিতার দায় থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে তখন থেকে তারা নিজেদের প্রবৃত্তি ও খেয়াল-খুশির দাসে পরিণত হয়েছে। মানব রচিত আইন তাদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগাতে পারছে না। ইসলাম মানলে যাচ্ছেতাই করার সুযোগ নেই। ইসলামের কথা, ঋণ থাকলে শহীদ হ’লেও জান্নাতে যাওয়া যাবে না। অথচ এখনকার রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা ঋণখেলাপী হওয়ার কোন পরওয়া করে না। ধূমপান, মদপান যে জাগতিক হিসাবেও মহাক্ষতিকর তা বৈজ্ঞানিকভাবেও সত্য; জাহান্নামের আগুনে জ্বলা তো পরকালীন প্রশ্ন। কিন্তু জাগতিক ক্ষতি দেখেও কি আজকের বিশ্ব মাদক ত্যাগ করতে পারছে? নাকি তা দিন দিন বেড়ে চলেছে? নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা থেকে সৃষ্ট ব্যভিচার, সমকামিতা ও ধর্ষণের মতো কুকর্মসমূহ এইডস, গণোরিয়া, সিফিলিস ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক ব্যাধি মানব সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারপরও ভোগবাদী মানুষ যত্রতত্র ব্যভিচার করে চলেছে, সরকারী-বেসরকারীভাবে গণিকালয় স্থাপন করা হচ্ছে। তাদের কথা- ‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার’। এসব কি প্রবৃত্তির চাহিদাপূরণ নয়? ধর্মের কথা বললে এসব ভোগবাদী মানুষ সে কথা শুনবে কেন? বিশেষত যখন তারা বিজ্ঞান নামক প্রভুর ছাড়পত্র পেয়ে গেছে!
তাই কালোবাজারী, মজুতদারী, ভেজাল মিশ্রণ, পরের সম্পদ জবরদখল করণ, সূদ-ঘুষ গ্রহণ, সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, ছিনতাই, ফাঁকিবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি কাজে মানুষ মজার্সে অংশ নিচ্ছে। যারা সুযোগ পাচ্ছে তারা আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। আর যারা সুযোগ পায়নি তারা লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষায় আছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কাজেই আল্লাহর কথা, দ্বীনের কথা মেনে নিলে খেয়ালখুশি মতো চলা যাবে না বলেও প্রবৃত্তি পূঁজারীরা আল্লাহ যে আছেন তা স্বীকার করতে চায় না।
মিডিয়ার আগ্রাসন ও মনস্তাত্বিক যুদ্ধ : ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীরা তাদের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড মিডিয়ায় অক্লান্ত ও অব্যাহত ধারায় ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিডিয়ার আগ্রাসন ও মনস্তাত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, সমাজতন্ত্রী, কম্যুনিস্ট, এগনিস্ট, পাশ্চাত্য শিক্ষিত ইসলাম বিদ্বেষী ইত্যাকার সকলে মিলে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। বস্ত্তত মুসলিমদের জঘন্য কুৎসিত হিসাবে চিত্রায়িত করা এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ আগ্রাসন ও যুদ্ধ। তারা ইসলামকে তাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। ইসলাম তলোয়ারের সাহায্যে প্রসার লাভ করেছে, ইসলাম আধুনিক যুগে অচল, ইসলাম নারী স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী, ইসলাম নারীকে হিজাব পরিয়ে গৃহাভ্যন্তরে বন্দি করে রেখেছে, ইসলাম সন্ত্রাসের ধর্ম, ইসলাম একটি পশ্চাৎপদ ধর্ম, ইসলাম মানেই প্রতিক্রিয়াশীল, ইসলাম সাম্প্রদায়িক ধর্ম, ইসলাম মৌলবাদ ও গোঁড়ামি উস্কে দেয়, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু, কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তারা তাকে হত্যা করে, ইসলামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ইসলাম মানলে আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যেতে হবে, ইসলাম বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষার বিরোধী, মাদ্রাসার সিলেবাসে বিজ্ঞানের কোন কথা নেই ইত্যাদি নানা অভিযোগ ও অপবাদ তুলে ধরে তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অহর্নিষ বিষোদগার করে চলেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ক্ষোভ ছড়ানোই যেন তাদের মূল কাজ। শুধু অমুসলিমরাই নয়, তথাকথিত মুসলিমরাও কোন বাছবিচার না করে এ কাজে তাদের সাথে সুর মিলাচ্ছে।
ফলে দেশ-বিদেশের অমুসলিমরা জন্ম থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ক্ষোভ নিয়ে বেড়ে উঠছে। পাশ্চাত্যের যোশুয়া ইভান্স, রুবেন ওরফে আবু বকর, ইউসুফ স্টেস, তালিবানদের হাতে বন্দী ইভন রেডলিসহ অনেক অমুসলিম ইসলাম গ্রহণের পর তাদের ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি এরূপ ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ক্ষোভের পূর্বধারণার কথা অকপটে বলেছেন। এরূপ মিথ্যা প্রচারণার ফলে মুসলিম প্রধান দেশের মুসলিম নাগরিকরাও অনেকে ভয়ে প্র্যক্টিসিং মুসলিম হ’তে সাহস পায় না। তাদেরকে অযথাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হয়রানির শিকার হ’তে হয়। ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ শাসকরা যে মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথে চলতে বাধা দেয় এবং সময়ে সময়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান গ্রহণ করে তাতো কারও অজানা নয়। ফলে তাদের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী অপপ্রচার বার বার শুনতে শুনতে মুসলিমদের মধ্যেও সেই অপপ্রচারের প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে। তারা মনস্তাত্বিক যুদ্ধে হেরে গিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস মযবূত রাখতে পারছে না। [ক্রমশঃ]